রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০৮:২৬ অপরাহ্ন

ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ

-ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন*


(১২তম কিস্তি)

মুঘলদের শেষ আমলে বাদশারা ভুলেই গিয়েছিলেন যে, একটি রাষ্ট্রের নির্বাহী বাদশাহ বা সম্রাটের মূল কর্তব্যগুলো কী! সাথে সাথে তারা পরবর্তী প্রজন্মকেও ভুল, বিভ্রান্তি ও বিভোরের মধ্যেই বড় করেছিলেন। পূর্ববর্তীরা পরবর্তীদের জন্য পরিবেশ এতটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিলাসময় করে রেখে যাচ্ছিলেন যে, তাদের মধ্যে শুধু বাহারী লেবাস, রাজকোষের অর্থ গ্রাস, কিছু কিছু সন্ত্রাস, ক্ষমতারহিত ও সম্ভাবনাহীন রাজ-আভিজাত্যের হাস্যকর বহিঃপ্রকাশ ইত্যাদি ছাড়া তাদের মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনা ও জাতীয় নেতৃত্বের মূল কর্তব্যবোধ জাগ্রতই হতে পারেনি। সে ধরনের জ্ঞান, যোগ্যতা, সাহসিকতা ও বিচক্ষণতা তাদের মধ্যে পয়দা হওয়ার সুযোগই অবশিষ্ট ছিল না। যার ফলশ্রুতিতে শুধু মুঘল বংশ নিজেরাই চিরতরে ক্ষমতা হারায়নি, বরং গোটা ভারত পরাধীন হয়েছে এবং মুসলিমরা হারিয়েছে তাদের নিজস্ব ভূমিতে তাদের ন্যূনতম সম্মানজনক অবস্থান ও অধিকার। 
উল্লেখ্য যে, মুঘল বাদশাহ আউরংযিব আলমগীরের যথাযোগ্য শক্তিশালী ৬৭ বছরব্যাপী শাসনের (১৬৫৮-১৭০৭) পর আর কোনো দক্ষ শাসক এ বংশে পয়দা হয়নি; অপরদিকে নামকা ওয়াস্তে দন্তনখরহীন স¤্রাটদের বাইরে আর কোনো মুসলিম শাসকেরও সর্বভারতীয় শাসন ক্ষমতা হাতে নেয়া ও পরিচালনা করা বা গণ-গ্রহণযোগ্যতা লাভ করার মত পরিবেশ ও অবস্থানও সৃষ্টি হতে পারেনি। আওরংযিবের মত এত বড় সৎসাহসী ও সুদক্ষ শাসকের সন্তানাদির বিদ্যমানতা এবং তাদের ক্ষমতায় আরোহণের পরও তারা রাজকার্যে কোনো ধরনের সফলতা দেখাতে পারেননি। সম্ভবত তারা সে স্বভাবগত যোগ্যতা নিয়ে পয়দা হননি এবং আওরংযিব ঐ পরবর্তী বংশধরকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সুযোগ্য ও সুদীক্ষিত করে গড়ে তুলেননি বা তোলার মত অবকাশ পাননি। (এর কারণগুলো নির্ণয় করা আলাদা ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়।) তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম  কেবল বংশধর হওয়ার কারণেই ক্ষমতায় আরোহণ করেছেন; তাদের যথাকর্মে যোগ্যতার কোনো বালাই ছিল না।

অযোগ্য সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগে কুচক্রি মতলববাজরা কুপরামর্শ দিয়ে সার্বিক অধঃপতনকে আরো ত্বরান্বিত করেছিল। সম্রাট-সম্রাজ্ঞী ও আমীর-ওমরাদের অতি বিলাসিতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে সেনাপতিরাও দেশ, জাতি ও শাসকদের প্রতি কর্তব্য ভুলে গিয়েছিলেন, তাই তারা যুদ্ধ যাত্রার পথে বা রণাঙ্গনে ঘোড়ায় বা অন্য কোনো যানবাহনে আরোহণের তাকলীফ বরদাস্ত করতেন না; বরং বেহারা-বাহিত রংবেরঙের পাল্কিতে চড়ে সমরে নেতৃত্বের অভিনয় করতেন এবং বিলাসবহুল তাঁবুতে যুদ্ধের নামে অবকাশ যাপন করতেন। এতটুকু জানার পর যুদ্ধের অবধারিত ফলাফলের জন্য সচেতন পাঠকের ইতিহাসের পাতা মন্থন করার তেমন প্রয়োজনই পড়ে না।  

মুঘলদের এই পরবর্তী পথহারা বাদশাহ্ শুধু নিজেরাই ব্যর্থ হননি, বরং গোটা দেশ ও জাতিকে ব্যর্থ, পরাজিত ও অপমানিত করেছেন এবং অসহ গ্লানির মধ্যে নিপতিত করেছেন। বাদশাহ্ আওরংযিবের মৃত্যুর পর ১৭০৭ থেকে নিয়ে ১৮০৬ খৃ. পর্যন্ত ১১ জন মুঘল সম্রাট দিল্লীর মসনদে আরোহণ করেছেন।[১] তাঁদের বিষয়ে ঐতিহাসিকদের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য নিম্নরূপ : “Aurongyib had made the empire vast and strong by his diligence, vigour abd sense of duty but the successors tried to atone his sense through their indolence, heedlessness, dependence on intriguing nobles and marry-making. It was misfortunate not of the great Mughals alone, but of India and intire Muslim community that Aurongyib’s throne came to be occupied, one after another by weak and worthless men. As Allah had willed it, the very first successor of Aurongyib (Muhammad Shah, 1707-1712) was just his reverse.”          

একই ধরনের কথা আব্বাসী বংশের পরবর্তী শাসকসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; কিন্ত মূল বিষয়বস্তুর চাইতে উপমা উদাহরণের পরিমাণ বেশি হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় এখানে সে অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী বিষয়াবলীর অবতারণা করা সঙ্গত মনে হচ্ছে না। 

সমাজে সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ’র পরিচিতি ছিল ‘রঙিলা’ অভিধায় আর ফররুখ শিয়ারের (১৭১৩-১৭১৯) মাশহুর ছিলেন ‘শাহান শাহে বে-খবর’ হিসাবে। যদিও দ্বিতীয় মুহাম্মাদ শাহ্ (১৭১৯-১৭৪৮) তার অনেক অকাম্য-কীর্তি ও বদনাম থাকা সত্ত্বেও শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভীকে উচ্চতর দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার ও বাড়ীঘর নির্মাণের জন্য দিল্লীর প্রাণকেন্দ্রে শাহজাহানাবাদে বিস্তর যমীন প্রদান করেছিলেন।[২] এখন সেটি পুরাতন দিল্লীতে ‘কালান মহল্লা’ নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালের মহা-হাঙ্গামার সময় ওগুলো বিনষ্ট করে ফেলা হয় এবং অনেক কিছুই লুটপাট হয়ে যায়।[৩]  (উল্লেখ্য, ভারতের আলীগড় বিশ^বিদ্যালয়ে ‘পিএইচ. ডি.’ গবেষণাকালীন (২০০০-২০০৩ খৃ.) লেখকের দিল্লীতে অবস্থিত উপরিউক্ত বিরান-প্রায় মাদরাসা যিয়ারতের সুযোগ ঘটেছিল।)

কুরআন ও হাদীছের যথাযথ জ্ঞান মুসলিম উম্মতের মূল সম্পদ ও রসদ; কিন্তু সার্বিক জাতীয় অবনতি ও রাষ্ট্রীয় পতন কি আর শুধু মাদরাসা ও ওয়ায-নছীহত দিয়ে রোধ করা যায়? তাহলে তো দিল্লীর ঐ বিখ্যাত মাদরাসাসহ আরো বহু মাদরাসা ভারতের সকলপ্রান্তরে তখনো বিরাজমান ছিল এবং এখনো আছে; কিন্তু ইসলামী শাশ্বত জীবন্ত চেতনা, সঠিক কর্তব্যবোধ, সামাজিক জাগরণ ও ক্ষমতা ছাড়া কতক্ষণ যথাযথ মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকা সম্ভবপর? আর শরী‘আতের সঠিক জ্ঞান ও দীক্ষা প্রদানের সাথে সাথে সেই পূর্ণাঙ্গ জাগরণ ঘটানোর মহা-সংগ্রামের নেতৃত্বইতো দিয়েছিলেন আমীর সাইয়্যেদ আহমাদ ও আল্লামাহ্ ইসমাঈল (শহীদ) ও তাঁদের পরবর্তীতে বেশ কিছুসংখ্যক মহান ত্যাগী নেতৃবৃন্দ সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী। (বিস্তারিত বিবরণ এ গ্রন্থের প্রথম খ-ে দেয়া হয়েছে)। পূর্ণাঙ্গভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য তো প্রয়োজন ‘কুরআন’ ও ‘সুলত্বান’ উভয়টির। যেমনটি ইমাম ইবনু কাছীর কুরআন কারীমের এই আয়াতের তাফসীরে উল্লেখ করেছেন :[৪]

وَ قُلۡ رَّبِّ اَدۡخِلۡنِیۡ مُدۡخَلَ صِدۡقٍ وَّ اَخۡرِجۡنِیۡ مُخۡرَجَ صِدۡقٍ وَّ اجۡعَلۡ لِّیۡ مِنۡ لَّدُنۡکَ سُلۡطٰنًا نَّصِیۡرًا

‘আর আপনি বলুন, হে আমার রব্! আপনি আমাকে সত্য-সংবলিত উত্তম অবস্থানস্থলে প্রবেশ করান এবং বের করে নিন সত্যবিশিষ্ট উত্তম অবস্থানস্থলের দিকে এবং আমার জন্য আপনার পক্ষ থেকে সহকারী শক্তি নিয়োজিত করুন।’ (সূরা আল-ইসরা : ৮০)।

এ প্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ বলেছেন :

فَمَنْ عَدلَ عَنِ الْكِتَابِ قُوِّمَ بالْحَديْدِ؛ وَلِهَذَا كانَ قِوَامُ الدِّيْنِ بِالْمُصْحَفِ وَالسَّيْفِ

‘যে ব্যক্তি কিতাব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে বা মানতে চাইবে না তাকে লৌহযন্ত্র ও প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগ করে শায়েস্তা করতে হবে। আর এজন্যই দ্বীনের অবস্থান-শক্তি মুছহাফ (কুরআন) ও তরবারী উভয়টির উপর নির্ভরশীল।’[৫]

তবে দুঃখজনক হলেও অতীব সত্য যে, ভূখণ্ডের আযাদী সংগ্রামের মুজাহিদ যারা নিজেদের জান-মাল সব কুরবান করে দিয়ে পরবর্তীদের জন্য স্বাধীনতার ভীত রচনা করে দিয়ে গিয়েছিলেন; যে ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশ স্বাধীনতার পথ খুঁজে পেয়েছে এবং মুসলিমরা দু-একটি নিজস্ব আবাসভূমি পেয়েছে,[৬] সেই পরবর্তী প্রজন্ম কি তাঁদের ঐ ত্যাগী সংগ্রামী মহাপুরুষদের অবদানের কথা মনে রেখেছে? তাঁদের সেই মহা সংগ্রাম ও ত্যাগের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি তারা ধারণ করেছে এবং বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা করেছে? তারা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়ে আত্মবিস্মৃত হয়ে আল্লাহকে ভুলে গেছে এবং তাঁর নাফরমানী করেছে ও করে চলেছে, সাথে সাথে তাদের পূর্বপুরুষ সেই বীর মুজাহিদদেরকেও তারা বিস্মৃত হয়ে গেছে এবং তাঁদের সাথে না-শুকুরী করেছে এবং করেই চলেছে। মানুষের সব বিস্মৃতি অপরাধ নয়; বরং তা ঘটাই স্বাভাবিক তবে কিছু কিছু বিস্মৃতি আছে যা অমার্জনীয় অপরাধ; আর উপরিউক্ত বিস্মৃতি সেই অপরাধগুলোর অন্যতম এবং রীতিমত ফাসেকীও বটে।  আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ نَسُوا اللّٰہَ فَاَنۡسٰہُمۡ  اَنۡفُسَہُمۡ ؕ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ

‘তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহ্কে ভুলে গেছে এবং যার ফলশ্রুতিতে তারা নিজেদের সত্তাকেই ভুলে গেছে; তারাই প্রকৃতপক্ষে ফাসেক (অনাচারী) (সূরা আল-হাশর : ১৯)।’

এ আয়াতের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় প্রখ্যাত মনীষী আল্লামাহ্ আব্দুল্লাহেল কাফী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন : “সমাজের এবং আহলে-হাদীস আন্দোলনের[৭] বর্তমান দুরবস্থার আর একটি কারণ এই যে, অজ্ঞতার তুল্য শত্রু আর কিছুই নাই। আহলে হাদীস মতবাদ (মানহাজ) এবং উক্ত আন্দোলনের কার্যক্রমের সহিত পরিচয় লাভ না করার দরুণ যেমন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মুসলমানগণ আহলে হাদীস আন্দোলনকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখিয়া থাকেন, স্বয়ং আহলে হাদীসগণের বর্তমান বংশধররাও উক্ত অজ্ঞতা নিবন্ধন আত্মবিস্মৃতির রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন। কুরআনে কারীম আত্মবিস্মৃতিকে অনাচার-ফিস্ক নামে অভিহিত করিয়াছে এবং বিশ্বাসী দল যাহাতে আত্মবিস্মৃতির মহামারিতে আক্রান্ত না হন তজ্জন্য এইভাবে (উপরি-উক্ত আয়াতের মাধ্যমে) সামাধান করিয়া দিয়াছেন।”[৮]   

মুঘল রাজধানীতে ও রাজপ্রাসাদে কাব্য-সাহিত্য চর্চা, কবিদের জমকালো আসর বসানো, সঙ্গীত শিল্পকলার উৎকর্ষ সাধন, স্থাপত্বের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন ইত্যাদিতে তো আর কমতি ছিল না। এর অনেক কিছুকেই প্রকারভেদে খুব বেশি না জায়েযও বলা যাবে না। এর উপরে আবার সূফীবাদের গভীর অনুসরণ, আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় পঞ্চ-শ্বাসপ্রশ্বাসতন্ত্র (পাঁচ অনফাস) কার্যে আত্মনিবেদন, মাশায়েখদের স্বনির্মিত বিভিন্ন ধরনের ওযীফাহ্ ও দিলের সাধনাবলীর মাধ্যমে ক্বলবের পরিচ্ছন্নতা ও উন্নতি সাধন- এগুলো পুরো যোশের সাথেই তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।

উপরন্তু, নানা ধরণের বাদ্যযন্ত্রের আবিস্কার, বহুমাত্রিক সুরের উদ্ভাবন, অগণিত নারী-দাসী ও খোজাদের (হিজরাদের) গৃহায়ণ ও রাজ-প্রাসাদে-দরবারে তাদের মহাসমারোহে বিচরণ, বাইজীদের নাচ-গান ও সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি এবং রাজদরবারের আমীর-ওমরাহ্দের সেখানে মদ্যপাত্র হাতে পান-রত অবস্থায় মদহুশ হালতে ‘সুবহানাল্লাহ-সুবহানাল্লাহ’ উচ্চারণ ও অকাতরে স্বর্ণমূদ্রা দু’ হাতে কুপথে কুখাতে ব্যয় ও রাজকোষ শূন্যকরণ ইত্যাদি ইত্যাদি ছিল তাদের সাধারণ কর্ম ও দৈনন্দিন আচরণ। অথচ রাজভাণ্ডারে অর্থাভাবে সেনাবাহিনীর বিলূপ্তকরণ কার্য ত্বরান্বিত হয়েছিল এবং রাজ-পরিবারের চূড়ান্ত পতনও নিশ্চিত হয়েছিল।

নামকা ওয়াস্তে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ যাফর নিজে যথেষ্ট শিক্ষিত, সৎসাহসী, মার্জিত চরিত্রের অধিকারী, ধর্মাশ্রয়ী ও শরীফ লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই উঁচু মানের কবি এবং তাঁর রাজ-দরবারে কবি-সাহিত্যিক ও লেখকদের আনাগোনার অভাব ছিল না। তাঁদের অন্যতম ছিলেন : ইব্রাহীম যওক, মুফতি ছদরুদ্দীন, মির্যা গালিব, হাকিম মুমিন, লালা হুজুর প্রমুখ।

কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ক্ষমতা ও কার্যক্রম তাঁর বহু পূর্বেই সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং তা চলে গিয়েছিল ইংরেজদের হাতে। ইংরেজদের কাছে দেশ ইজারা দিয়ে ভোগবিলাসী ও অকর্মণ্য জীবন যাপন করাকেই তারা ভাগ্যের লিখন হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন; এবং তা প্রত্যক্ষভাবে ঘটেছিল মুখল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আলমের আমলেই (১৭৫৯-১৮০৬) এবং বিশেষভাবে বক্সার যুদ্ধে (১৭৬৪) পরাজয়ের মাধ্যমে ও তারপর আরো খাস করে বৃটিশ প্রতিনিধি ওয়ারেন হেস্টিংস-এর শাসনামলে।[৯] বাকী ছিল শুধু রাজপ্রাসাদ, মাথার মুকুট, গায়ের লেবাস, বাদশাহের খেতাব, কবিতার আসর, ইংরেজদের দয়ার ভাতা ইত্যাদি।

ওগুলোও চূড়ান্তভাবে কেড়ে নেয়া হলো ১৭৫৭ সালের আযাদী যুদ্ধে ইরেজদের কাছে পরাজয়ের মাধ্যমে। বাহাদুর শাহ যাফরের জন্ম ১৭৭৫ সালে আর সম্রাটের পদবী লাভ ১৮৩৭ সালে। উপরি-উক্ত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ভাগ্যচক্রে তিনি হলেন পরদেশী দখলদার বেনিয়াদের কাছে বিদ্রোহের অপরাধে আসামী এবং বিচারের কাঠগড়ায় সাব্যস্ত হলেন মহাদোষী। তাঁর দশ পুত্রের গর্দান কেটে মস্তকগুলো পাতিলের মধ্যে ঢেকে তাঁর সামনে করে পেশ করা হলো খাবার টেবিলে। শোকাতুর, আশাহত, রোগে জরাজীর্ণ অশীতিপর বৃদ্ধ সম্রাটকে নির্বাসিত করা হলো রেঙ্গুনে, রাখা হলো এক গৃহে নযরবন্দী করে। ১৮৬২ সেখানেই তাঁর মৃত্যু ও দাফন কার্য সম্পাদিত হলো। মুমূর্ষাবস্থায় কয়লা দিয়ে ঘরের দেয়ালে যে আফসোস ভরা কবিতা লিখে গিয়েছিলেন তা নিম্নরূপ :

লাগতা নাহিঁ হ্যায় জি মেরি উজড়ে দিয়ার ম্যাঁ
কিসকি বানি হ্যায় আলমে না পয়েদার ম্যাঁ।
ইন্ হাসরতূঁ কো কাহ্দো কেহ্ আওর কাহে যা বছে
ইতনি জাগেহ্ কাহা হ্যায় দিলে দাগদার ম্যাঁ।
বুলবুল কো ছাইয়্যাদ ছে নাহ্ বাগবাঁ ছে গেলা
কিসমত ম্যাঁ কয়েদ লিখ্্খি থি ফছলে বাহার ম্যাঁ।
কিতনা হি বদ-নছীব হ্যাঁয় যাফর কেহ্ দাফন কে লিয়ে
দো গজ ভী যমীন নাহি মেলি কোয়ে ইয়ার ম্যাঁ।

চরম দুরবস্থায় পতিত প্রবাসে বন্দি অসহায় সম্রাট ক্ষীণ সান্ত¡না খুঁজে পেতে চেষ্টা করছেন এই মনে করে যে, পূর্ববর্তী সম্রাটদের ক্ষমতার বসন্তকালেই পরবর্তীদের নির্ঘাত পতনের সূচনা হয়েছিল; সুতরাং বাস্তবে আমাদের আর করারই বা কী ছিল? তবে আমি বাহদুর শাহ্ যাফরের মাধ্যমেই সে নাম-নিশানারও চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি এভাবেই হলো যে, বিশাল ভারতের সম্রাটের নিজ জন্মভূমিতে দাফন হওয়ার জন্য দুই গজ যমিনও মিললো না; আজ দাফন হতে চলেছি বন্দীদশায় মুত্যুর মাধ্যমে সুদূর রেঙ্গুনে।

প্রিয় পাঠক, যে উদ্দেশ্যে যে কাজের সূচনা হয় তাকে সে ধারাতেই জারী রাখতে হয়, প্রাণান্তকর প্রচেষ্ঠা ও পরিচর্যার মাধ্যমে তার পরিপুষ্টি সাধন করতে হয় এবং পরবর্তীতে সে আমানতের হেফাযত ও অধিকতর উন্নতি সাধনের জন্য যথাযথ দায়িত্বশীল ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করে যেতে হয়; নাহলে হয়তো মুঘলদের শেষ সম্রাটদের মত ঐ খেতাব, সাইনবোর্ড, পোশাক, কাব্য-সাহিত্য ইত্যাদি থেকে যায়,  থাকে না শুধু যা মূল লক্ষ্য ও প্রয়োজন তা। পাশে থাকে ইতিহাস চোখ ও কান পেতে আর রচিত হয় মস্ত-মস্ত দস্তাবেজ।

প্রসঙ্গত মহান আহলে হাদীস নেতা আল্লামাহ আব্দুল্লাহেল কাফী সাহেবের একটি বক্তব্যের কয়েকটি বাক্য এখানে পাঠকদের খিদমতে উল্লেখ করে দিতে চাই; হয়তো বা তা মুসলিম সমাজের সদস্য হিসাবে তাদের সাংগঠনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জগতে কখনো বিশেষভাবে কাজে লাগবে। এ বক্তব্য আজকের নয়; বরং তা ১৯৪৯ ইং সালে কম ও বেশি ৭০ বছর আগে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার (১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগষ্ট) বছর দেড়েক পর রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত আহলে হাদীস কনফারেন্সে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণ। সচেতন পাঠকের জন্য এর মধ্যে যেমন রয়েছে জাতীয় পর্যায়ের কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর বিষয়ে নীতি নির্ধারণী রসদ তেমনই রয়েছে সাংগঠনিক পীরতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রের বিষয়ে কঠিন সতর্ক সংকেত :

“থিওক্রেসীর (Theocracy) দুর্নাম এড়াইবার জন্য (পাকিস্তান গণপরিষদের ভাবী-সংবিধানের (Constitution) উদ্দেশ্য-প্রস্তাবে) প্রয়োজনের অতিরিক্ত চেষ্টা করা সত্ত্বেও সিকুলার (Secular) বা লা-দ্বীনী স্টেটের বৈশিষ্ট্য এই ঘোষণায় বিদূরিত হয় নাই। থিওক্রেসীর সরল অর্থ হইতেছে পাদ্রীতন্ত্র, পীরতন্ত্র, ব্রা‏হ্মণতন্ত্র বা লামাতন্ত্র - ইসলাম কোনদিন এই শ্রেণির শাসনতন্ত্রের বৈধতা স্বীকার করে নাই, সুতরাং থিওক্রেসীর অবতারণা ইসলামী রাষ্ট্রে অবান্তর।’’

ইসলামে যেরূপ কোন ব্যক্তি বিশেষ নিষ্পাপ ও আইনের স্রষ্টারূপে স্বীকৃত হয় নাই, সেইরূপ ইসলাম মানুষের কোন দল বা গণ্ডিকেও নির্ভুল বলিয়া মান্য করে নাই; সুতরাং আইন প্রণয়নের মৌলিক ও সার্বভৌম অধিকারী কেবল মাত্র আল্লাহ্।”[১০]

কখনো যদি ইসলামী বৃহত্তর সামাজিক ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে উপরিউক্ত তন্ত্রগুলো কোনো না কোনোভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বা অনুপ্রবেশ করে এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাহলে তার অদূর ও সুদূরপ্রসারী কুপরিণতি ও অবধারিত ক্ষতি কোন্ পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে, তা শুধু গভীরভাবে উপলব্ধির বিষয়ই নয় বরং চরম উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের বিষয়ও বটে। সুন্নাতে সাইয়্যোহ্ পরিবেশভেদে কদাচিৎ ঘটে যেতেই পারে কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক পর্যায়ে তা জারি হয়ে যাওয়া ও গ্রহণযোগ্যতার রূপলাভ করা খুবই দূষনীয় ও মারাত্মক ব্যাপার। আল্লামাহ্ কাফী সাহেব সেদিকেই কঠিনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেছেন।  

যথাযোগ্য নেতৃত্ব তৈরি না হলে এবং নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা রক্ষার সুস্পষ্ট সম্ভাবনা প্রস্তুত না থাকলে, সংগঠনের জন্য যে ধরনের সঙ্কট ও সমূহসমস্যা অপেক্ষা করে, তা সবার মন-মগজে জাগ্রত না হলেও যারা কওম নিয়ে সত্যিকার পক্ষেই চিন্তাভাবনা করেন, তাদেরকে অহরহ কঠিনভাবে পীড়া দিতে থাকে। আল্লামাহ্ আব্দুল্লাহেল কাফী সাহেবের একটি বক্তব্যের মধ্যে তার কিছুটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে; তিনি অতীব ক্ষোভ ও দুঃখের সাথে বলেছেন : “....তাহাদের দেখা-দেখি বাজারে সস্তা নেতার দলের মধ্যে আজ অনেকেই আহলে-হাদীস আন্দোলনের সহিত তাহাদের যোগাযোগ ছিন্ন করিয়া বসিয়া আছেন। চাকুরীজীবী ও ছাত্রসমাজের মধ্যে এই মানসিক পীড়া উৎকটভাবে প্রবেশ লাভ করিয়াছে। ফলে আজ অনেকের মনে আহলে হাদীস আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেই গভীর সন্দেহের উদ্রেক হইয়াছে এবং অদ্যকার অবস্থা যদি আগামীকল্যের পূর্বাভাষ হয় তাহা হইলে ইহা নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে যে, বর্তমান অবস্থার প্রতিকার-ব্যবস্থা অবলম্বিত না হইলে আহলে-হাদীস সমাজের বিলুপ্তি অবধারিত হইয়া গিয়াছে।”[১১]

উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক সংগঠনের গঠনতন্ত্র ও পরিচালনাবিধি এমনভাবে রচিত ও চর্চিত হওয়া দরকার যে, তা যেন ধারাবাহিক নেতৃত্ব সৃষ্টির পথ উম্মুক্ত করে রাখে। যে কোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্র কিংবা ঢিলেমীতন্ত্র সময়মত যথাযোগ্য স্বাভাবিক নেতৃত্বের পথ সংকুচিত করে ফেলে। যার কুপরিণতিতে সংগঠনগুলোকে মারাত্মকভাবে ভোগান্তিতে পতিত হতে হয়। অনিয়মের বিষয়টি শুধু সংগঠনের সাথে সীমাবদ্ধ নয়, বরং কখনো সখনো তা রাষ্ট্রকেও জর্জরিত করে ফেলে। কেননা কোনো কোনো সরকার সংবিধানকে সমুন্নত না রেখে দলীয় স্বার্থকে প্রধান্য দিতে গিয়ে সেখানে উদ্দেশ্যমূলক হস্তক্ষেপ করে এবং পরবর্তী পরিস্থিতি জটিল করে তুলে। বিভিন্ন সরকারের শাসনামলে দীন লিখককে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিলেন, দেখুন তো - এখন আমাদের নেতা ছাড়া আর কার দেশ চালানোর যোগ্যতা আছে? আমি বলতাম, দেখুনÑব্যক্তিগত কিছু অতি যোগ্যতা কিছু কিছু নেতার মধ্যে অবশ্যই  থাকে এবং তা শ্রদ্ধার সাথে স্বীকার্যও বটে; কিন্তু দু’টি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবেÑ এক : কোনো নেতাই অমর নন; বরং সবাইকে মরতেই হবে। সুতরাং পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও বিকল্প বাস্তবতাই স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা। তাই পরবর্তী নেতৃত্বের চিন্তা ও সে ধারাবাহিকতার কথা সবসময়ই মাথায় রাখতেই হবে, এর গত্যন্তর নেই। দুই : দলীয় গঠনতন্ত্র যেমন সংগঠনের লোকজনদের মেনে চলা দরকার, ঠিক তেমনি দেশের সংবিধানের সর্বজনীন ও জনকল্যাণকর বিষয়াবলী দলীয় ও সরকারী লোকজনদেরকে কার্যকরভাবে সততার সাথে মেনে চলা কর্তব্য। সংবিধানকে যথাযথভাবে মেনে চললে প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে দেশ কে চালাবে তা নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তার কারণ থাকে না। (এখানে সার্বিকভাবে পরিপূর্ণ ইসলামী সংবিধান নিয়ে কথা হচ্ছে না)।

সৌদি আরবে ইমাম মুহাম্মাদ বিন সউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা সময়ে কিছুদিন বাংলাদেশ দূতাবাস, রিয়াদে আমার অনুবাদকের কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। আমার একান্ত ঘনিষ্ট বন্ধু শামসুদ্দোহা বিন আনিস উপরিউক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে ঐ দূতাবাসে অনুবাদকের কাজ করতো, এখনো সেখানেই আছে। সে ওখানে আমার জন্য কাজ পেতে সহযোগিতা করেছিল। ও একদিন কথাচ্ছলে বলছিল যে, সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল গোলাম দস্তগীর (অবসরপ্রাপ্ত) সাহেবের কাছে আমার প্রাপ্ত ছুটির দরখাস্ত নিয়ে গিয়ে বলেছিলাম, স্যার! অনেকেই তো ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন, এখন কি আমাকে ছুটি দিবেন? কাজের বিঘ্ন ঘটবে না? উনি আমাকে বললেন, দোহা সাহেব! আপনার ছুটি ‘ডিউ’ হয়ে থাকলে নির্দ্বিধায় ছুটি নিয়ে চলে যান, তেমন কোনো সমস্যা হবে না। মনে রাখবেন এত বড় অফিস শুধু ব্যক্তিতে চলে না, বরং চলে নিয়মে। এই যে আমি, জেনারেল গোলাম দস্তগীর রাষ্ট্রদূত, আমার চেয়ারে যদি বিড়াল বসিয়ে রাখেন তাতেও অফিস চলবে; কারণ নিচের দিকে ধাপে ধাপে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত অফিসার রয়েছেন। অতি উত্তম, অতি সুন্দর ইত্যাদি নিয়ে কথা আছে থাকবে; কিন্তু ‘কাজ চলা’ নিয়ে আল্লাহ্ চাহে তো সমস্যা সঙ্কট কোনটাই হবে না। প্রয়োজন হলে পার্টটাইম লোক নিয়োগ দিব, নাহলে দূতাবাসের যারা পারে তাদেরকে ওভার টাইম দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করাব, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই কোনো না কোনো বিকল্প পথ বের হবেই ইনশা-আল্লাহ্। আপনার কোনো চিন্তা নেই, প্রাপ্য ছুটি ভোগ করুন আবার যথা সময় কাজে যোগ দিন- ‘অল দ্যা বেস্ট’। অর্থাৎ সব কথার সারমর্ম হলো প্রশিক্ষিত লোকবল, নিয়মতান্ত্রিকতা, ধারাবাহিকতা, স্পষ্টতা ও পরিচ্ছন্নতা।            

উল্লেখ্য, পরবর্তী নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে পরিবারকেন্দ্রিকতা এড়ানোর বিষয়ে এখানে আমরা গ্রাম ও এলাকাভিত্তিক এবং মসজিদকেন্দ্রিক প্রচলিত সমাজ-জামা‘আতগুলোর কথা বলছি না; এবং দখলদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের দিনগুলোতে আযাদী সংগ্রামে লিপ্ত স্থানীয়ভিত্তিক সর্দারদেরকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সামাজিক নেতৃত্বগুলোর দিকেও ইঙ্গীত করছি না। আযাদী সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী জনসমাজে কয়েক প্রকারের সর্দার (নেতা বা দায়িত্বশীল) ছিলেন, যেমন দ্বীন কে সর্দার : অর্থাৎ যিনি ধর্মীয় বিষয়াদি যথা ছালাতের ইমামত, জুম‘আহ’র খুৎবাহ প্রদান,  ওয়ায-নছীহত, বই-পুস্তক বিতরণ, মাস’আলাহ্-মাসায়েল ইত্যাদি বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতেন। দুনিয়াকে সর্দার : অর্থাৎ যিনি মানুষের সামাজিক বিষয়াবলি যথা শালিস দরবার, বিচার-ফয়ছালা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি কাজে দায়িত্ব পালন করতেন এবং ডাক কে সর্দার : যিনি ডাক তথা সুদূর  কেন্দ্রে সীমান্ত প্রদেশে চিঠি-পত্র ও সংবাদ আদান-প্রদান ও তথায় টাকা-পয়সা প্রেরণ, যাতায়াত বিষয়ক কার্যক্রম ইত্যাদির দায়িত্ব পালন করতেন। উইলিয়াম হান্টারের ভাষায় এনাদের পদবী মৌলভী, জেনারেল ম্যানেজার ও অফিসার।[১২] এসকল পরিবারের এলাকাভিত্তিক বিশেষ ধরনের ধর্মীয় ও সামাজিক কর্তৃত্ব, সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা থাকে এবং তা ঐ সকল সমাজের জন্য কল্যাণকরও বটে। আর ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় যার যার প্রাপ্য সম্মান তাকে তাকে দেয়া উচিত। তরুণ বয়সে নেতৃস্থানীয় জনৈক আহলে হাদীস মুরুব্বীর বক্তৃতায় শুনেছিলাম : “সমাজগুলো থেকে সর্দার প্রথা তুলে দেয়া উচিত।” এ বক্তব্য অরো দু একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরামেও উঠেছিল। তখন এ বিষয়ে তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। তবে পরবর্তীতে একটু লেখাপড়া করার পর বুঝতে পেরেছি  যে, সেই সহজ-সরল সম্মানিত মুরুব্বী সর্দার প্রথার বিষয়টি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অবগত না হয়ে ও না বুঝেই এমন আহ্বান জানিয়েছিলেন; তাঁর দৃষ্টিতে এটি যেন একটি অনাহুত সামাজিক সমস্যা এবং তা মিটিয়ে ফেলা প্রয়োজন। এমন বক্তব্য তাঁর জন্য তেমন দোষেরও ছিল না, কেননা ধর্মীয়-সামাজিক ইতিহাস নিয়ে তো আর কোথাও তেমন আলোচনা হয় না, কেউ তা তেমন শুনতেও চায় না বা বুঝতেও চায় না; তদুপরি সবাই যেন নিজ নিজ স্থলে সুপারহিরো; কারো গোড়ার খবর অনুসন্ধানের কোনো প্রয়োজন নেই। সর্দার বিষয়টি যে, সমাজ সংস্কার ও আযাদী আন্দোলনের গভীর শিকড়ের সাথে জড়িত; এ যে নিছক ভুঁইফোর কিছু নয় বরং তা যে নিজেদের সংগ্রামী ইতিহাসের সোনালী ধারার প্রতীক, ঐতিহ্য ও সম্মানের সাথে সম্পর্কিত এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িত - তা আজ আর কে কাকে বলে?

বিভিন্ন পর্যায়ের সামাজিক আলেমগণের পরিবারভিত্তিক ও সর্দারকেন্দ্রিক জামা‘আতগুলো অক্ষুন্ন রেখে, যথাযথ সম্মানের সাথে সেগুলোকে মুল্যায়ন করে ও কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর জাতীয় জামা‘আতের পরিধিকে বৃদ্ধি ও শক্তিশালী করা যেতে পারে। ক্ষুদ্রতম নেতৃত্বের ঐতিহ্য বৃহত্তর নেতৃত্ব তৈরির  ক্ষেত্রে অপরিহার্য না হলেও সহযোগী তো বটেই। (এখানে বিশেষভাবে সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত গঠনতন্ত্রের নিয়মাধীন বৃহত্তর ও জাতীয় পর্যায়ের জামা‘আত-সংগঠনের পরবর্তী নেতৃত্বের ধারাবহিকতা সৃষ্টি নিয়েই একান্তভাবে কথা বলা হচ্ছে; অন্যগুলোর বিষয়ে নয়।)

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

*সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

তথ্যসূত্র :
[১]. Teachings of Hadrat Shah Wali“ullah Muhadith Dehlavi, G. N. Jalbani, Delhi, 1997, p. 145, Tarikh-i-Da’wat wa `Ayimat, Maulana Abul Hasan Ali Nadwi, English tr. by: Muhiuddin Ahmad, Under the title: Saviours of Islamic SpiritÕ, Lucknow, 1993, Vol. 4, pp. 29-30. 
[২]. হাকিম মাহমূদ আহমাদ বারাকাতী, শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ আওর উন্কা খান্দান (দিল্লী, ১৯৯২ খ্রি.), পৃ. ৪৬-৪৭; যহীরুদ্দীন আহমাদ ওয়ালিউল্লাহী, খাতেমা-ই-তাভীল আল-আহাদীছ (দিল্লী, ১৮৯২ খ্রি.), পৃ. ৮৮; মাওলানা আবুল হাসান নাদভী, (প্রাগুক্ত), পৃ. ৮০।
[৩]. বশীরুদ্দীন আহমাদ, ওয়াকি’য়াতে দারুল হুকুমাত দিল্লী (আগ্রা, ১৯১৯ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৬।
[৪]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৭৫-১৭৬ (ইতঃপূর্বে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে)।
[৫]. আস্সিআসাহ্ আশ্শার’ইয়্যাহ্, পৃ. ২৩, ১৩২-১৩৩ (ইতঃপূর্বে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে)।
[৬]. এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক ও সামাজিক আলোচনা গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে করা হয়েছে। 
[৭]. উল্লেখ্য, এখানে  ‘আহলে হাদীস আন্দোলন’ বলতে নির্দিষ্ট একটি সংগঠন নয়। কেননা এ নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু আগে আল্লামা কাফী সাহেব এ নাম ব্যবহার করেছেন। ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত পাবনা আহলে হাদীস কন্ফারেন্সে ও ১৯৪৯ সালে অনুষ্ঠিত রাজশাহী আহলে হাদীস কন্ফারেন্সে তাঁর উপস্থাপিত সভাপতির ভাষণে ‘আহলে হাদীস আন্দোলন’ শব্দ বার বার উচ্চারিত হয়েছে। উপরিউক্ত ভাষণ দুটোই ‘আহলে হাদীস পরিচিতি’ নামে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়েছে। লেখকের প্রাথমিক গণনানুযায়ী এ গ্রন্থে ‘আহলে হাদীস আন্দোলন’ শব্দটি ১০১ (একশত একবার) উল্লেখিত রয়েছে।
[৮]. আহলে হাদীস পরিচিতি, পৃ. ৩।
[৯]. See : Fall of the Mughal Empire, Sir Jadu Nath Sarkar, Calcutta,1971, Vol. 2, p. 3, (Introduction), and Vol. 4, pp.334, 336, 337;  Cambridge History of India, Sir Jadu Nath Sarkar, Delhi, 1971, Vol. 1, pp. 414-415; Tarikh-i-DaÕwat wa `Ayimat, Maulana Abul Hasan Ali Nadwi, English tr. by: Muhiuddin Ahmad, Under the title: Saviours of Islamic SpiritÕ, op. cit.Vol. 4, p.36. For details, see the unpublished Ph. D thesis of author under the title: ÔShah WaliullahÕs Contribution to Hadtih Literature, pp. 1-20.
[১০]. আহলে হাদীস পরিচিতি, পৃ. ১০৪।
[১১]. আহলে হাদীস পরিচিতি, পৃ. ২-৩।
[১২]. দেখুন : উইলিয়াম হান্টার, ইন্ডিয়ান মুসলমানস, (বঙ্গানুবাদ), পৃ. ৬৮।




প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৮ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
আল-কুরআনের আলোকে দাওয়াতের মাধ্যম - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ধারা - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
রামাযানে দান-ছাদাক্বাহ - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (১০ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
রামাযান : কুরআন নাযিলের মাস - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (১৪তম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
নফল ছালাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
বিদ‘আত পরিচিতি (১১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ