ইয়ামানের কুখ্যাত জঙ্গীগোষ্ঠী হুতী শী‘আদের মুখোশ উন্মোচন
মূল : অধ্যাপক ড. সুলাইমান বিন ছালিহ আল-গুসন (হাফিযাহুল্লাহ)
অনুবাদক : শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী*
ভূমিকা
‘হুতী’ নামটি বর্তমানে অনেকের কাছে পরিচিত। যাদের বিরুদ্ধে ইয়ামানের বিরুদ্ধে সঊদী আরবের নেতৃত্বে ‘আসিফাতুল হাযম’ নামে একটি যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাভাষী অনেকেই এই ‘হুতী’ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না। ফলে বিভিন্ন শী‘আ প্রভাবিত এবং ইসলাম বিদ্বেষী মিডিয়ার কারণে অনেকেই বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। অথচ মুসলিম বিশ্বের উপর এই ঘটনা-প্রবাহের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে এবং পড়বে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই এ সম্পর্কে মুসলিম যুবকদের সচেতনতা অত্যন্ত যরূরী।
এই প্রেক্ষাপটে সঊদী আরবের ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘কিং সঊদ ইউনিভার্সিটি’র ‘আক্বীদা ও সমকালীন মতবাদ’-এর অধ্যাপক ড. সুলাইমান বিন ছালিহ আল-গুসন রচিত বক্ষ্যমাণ পুস্তিকাটি অনুবাদ করা হল, যেন বাংলাভাষী মুসলিমগণ এই ফিতনার ব্যাপারে সচেতন হতে পারে।
অত্র পুস্তিকাটিতে শী‘আ হুতী সম্প্রদায়ের উৎস, পরিচিতি, ক্রমবিকাশ, কার্যক্রম, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে এবং প্রাসঙ্গিকভাবে রাফিযিয়া, ইমামিয়া, ইছনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের মৌলিক আক্বীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর যমীনে সত্যের পতাকা উড্ডীন করুন। বাতিল ও মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করে দিন এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে ফিতনা-ফাসাদ থেকে হেফাজত করুন- আমীন!
হুতীদের উৎস ও পরিচয়
হুতীরা হল, উত্তর ইয়ামানের সা’দাহ[১] এলাকার একটি সম্প্রদায়ের নাম। এদের উৎপত্তি জারূদিয়া সম্প্রদায় থেকে। জারূদিয়া হল, শী‘আ-যায়দিয়াদের একটি গোঁড়া ও উগ্রপন্থী ফের্কা। হুতীরা রাফেযিয়া-ইছনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের মত উগ্রপন্থী আক্বীদা-বিশ্বাস প্রচার শুরু করে এবং ইরানের সাহায্য-সহযোগিতা ও আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে শী‘আ বিপ্লবের নায়ক খোমেনীর আদর্শ ও পদ্ধতির আলোকে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করতে থাকে।
হুতী সম্প্রদায়ের পরিচয়ের আগে জারূদিয়াদের সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। যাতে স্পষ্ট হয়, জারূদিয়া সম্প্রদায়ভূক্ত এই হুতী এবং রাফিযিয়া ইছনা আশারিয়াদের মাঝে কতটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে আর কিভাবে তারা ইমামিয়া-ইছনা আশারিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
জারূদিয়া সম্প্রদায়ের পরিচয়
প্রতিষ্ঠাতা : জারূদিয়ার সম্প্রদায়টির নামকরণ হয় আবুল জারূদ নামক এক ব্যক্তির নামানুসারে। তার পুরো নাম, যিয়াদ ইবন মুনযির আল-হামাদানী আল-কূফী। আহলে সুন্নাহ’র পূর্বসূরী ইমামগণ এ ব্যক্তিকে মিথ্যাবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।[২] শুধু তাই নয়, শী‘আদের কিছু বই-পুস্তকেও তার বদনাম করা হয়েছে।[৩]
জারূদিয়া সম্প্রদায়ের কিছু মৌলিক আক্বীদা
১. তারা বিশ্বাস করে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরে খলীফা হিসাবে ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তিনি ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাম না নিলেও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার মাধ্যমে তাঁকেই বুঝিয়েছিলেন।
২. তাদের মতে, ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মর্যাদা অন্য সকল ছাহাবীর চেয়ে বেশি।
৩. ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পরে ইমাম হবে কেবল হাসান-হুসাইন ও তাদের বংশধরের মধ্য থেকে।
৪. তারা ছাহাবীদেরকে কাফির মনে করে। কারণ, ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে খলীফা হিসাবে মনোনিত করেছেন। তারা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বলে যাওয়া গুণ-বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং সে বৈশিষ্ট্যের আলোকে তারা ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে খলীফা নিয়োগ করেনি।[৪]
৫. রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে যারা ‘আলী এবং তাঁর বংশধর থেকে ইমাম হওয়াকে আবশ্যক মনে করে না তারা কাফির।
৬. আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং তাদেরকে গালাগালি করা। অনুরূপভাবে ‘আয়িশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা), মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে গালাগালি করা।
৭. জারূদিয়া সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ মনে করে যে, তাদের যে সব ইমাম মারা গেছে তারা পুনরায় ফিরে আসবেন।
৮. তাদের মধ্যে অনেকে মুতা‘ বিবাহ (চুক্তি ভিত্তিক সাময়িক বিবাহ)-কে বৈধ মনে করে।[৫]
জারূদিয়াদের এসব আক্বীদা দেখলে বুঝা যাবে, তারা রাফিযীয়া- জাফরিয়া- ইমামিয়া- ইছনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের অনেক কাছাকাছি অবস্থান করে।
হুতীদের ইতিহাস এবং প্রেরণার উৎস
হুতীদের চরমপন্থী নেতা হুসাইন ইবন বদরুদ্দীন হুতী। তার পিতা বদরুদ্দীন ইবন আমীরুদ্দীন আল-হুতী হল তাদের ধর্মগুরু এবং রূহানী নেতা। যিনি ১৩৪৫ হিজরীতে উত্তর ইয়ামানের সা’দাহর উপকণ্ঠে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হন। তাকে জারূদিয়াদের বড় ‘আলিমদের মধ্যে গণ্য করা হয়। যায়দিয়া সম্প্রদায়ের কতিপয় ‘আলিমদের সাথে তার মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় তিনি ইরান চলে যান এবং তেহরানে কয়েক বছর বসবাস করেন। পরবর্তীতে সমঝোতার মাধ্যমে তাকে নিজ এলাকায় ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি ১৪৩১ হিজরীর যিলহজ্জ মাসের শেষ দিকে মৃত্যুবরণ করেন।
হুসাইন ইবন বদরুদ্দীন হুতী হল বদরুদ্দীনের বড় ছেলে। তিনি সা’দায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। তারপর সুদান থেকে শরী‘আহ বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করার পর ডক্টরেট শুরু করেন। কিন্তু পড়ালেখা বাদ দিয়ে দেন এবং মাস্টার্সের সার্টিফিকেট ছিড়ে ফেলেন এই যুক্তিতে যে, একাডেমিক সার্টিফিকেট জ্ঞান-বুদ্ধিকে জমাটবদ্ধ করে দেয়।
১৯৯০ সালে ইয়ামান ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর যখন রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয় তখন হুসাইন হুতী শী‘আ ‘হিযবুল হক’ নামক একটি দল প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করেন এবং দলের পক্ষ থেকে তিনি ১৯৯৩-১৯৯৭ইং সেশনের জন্য পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন।
এদিকে দক্ষিণ ইয়ামানের বিচ্ছিন্নতাবাদী কম্যুনিস্টরা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে হুসাইন হুতী তাদের পক্ষাবলম্বন করেন। যার কারণে সরকার তার বসত বাড়িতে সশস্ত্র অভিযান চালায়। ফলে তিনি সুদান পালিয়ে যান এবং সুদান থেকে ইরানে আত্মগোপন করে। অতঃপর ইরানের কুম শহরে তার পিতার সাথে কয়েক মাস অবস্থান করেন। সেখান থেকে লেবানন যান হিযবুল্লাহ গ্রুপের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। এ দিকে সরকার তার প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করলে তিনি পুনরায় ইয়ামানে ফিরে আসেন। ইয়ামানে ফিরে আসার পর তিনি তার ভক্ত ও অনুসারীদের মাঝে বক্তৃতা ও দারস দেয়া শুরু করেন এবং বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যেগুলোতে শতশত ছাত্র ভর্তি হয়।
আশ-শাবাবুল মুমিন (মুমিন যুবক) সংগঠন প্রতিষ্ঠা
বদরুদ্দীন হুতী ‘হিযবুল হক’ দলের সহ সভাপতি হিসাবে কাজ করতেন। কিন্তু সংগঠনের সভাপতি মাজদুদ্দীন আল-মুয়াইদীর সাথে তার মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। মতবিরোধের কারণ ছিল দু’টি। ১. ইমামিয়া মাসয়ালায় হুতী এবং তার অনুসারীদের গোঁড়ামিপূর্ণ ধ্যান-ধারণা পোষণ করা। ২. ইরানের খোমেনী বিপ্লবের আদর্শের দিকে প্রচণ্ড ভাবে ঝুঁকে পড়া।
এই মতবিরোধের জের ধরে হুতী এবং তার অনুসারীরা ‘হিযবুল হক’ থেকে বের হয়ে আশ-শাবাবুল মুমিন (মুমিন যুবক) সংগঠনে যোগ দেয়। যে সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তারা ইতোঃপূর্বে ১৯৯৭ সালে অংশগ্রহণ করেছিল। ইরান এবং তৎকালীন ইয়ামান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আশ-শাবাব সংগঠনটি তাদের কর্মপরিধি বৃদ্ধি করে উত্তর ইয়ামানের সাদাহ অঞ্চলসহ কয়েকটি জেলার অনেক যুবক, অল্প বয়সী তরুণ এবং বিভিন্ন গোত্রের সাধারণ জনগণকে তাদের দলে ভিড়াতে সক্ষম হয়। ১৯৯৭ সালে বদরুদ্দীন হুতী সংসদ থেকে পদত্যাগ করে তার সংগঠনের কাজে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করে।
এরপর শী‘আ রাফেযিয়া, ইমামিয়া, ইছনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের সাথে সমন্বয় সাধন করে তাদের সাথে একীভূত হওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে এবং ইরান বিপ্লবের স্তুতি গাইতে থাকে-যাতে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তারা ইয়ামানের মাটিতে বিপ্লব সাধন করতে সক্ষম হয়।
তারপর তিনি তার অনুসারীদেরকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে আরম্ভ করেন এবং তাদেরকে এমনভাবে গড়ে তোলেন যেন তারা অন্ধভাবে তার নির্দেশ পালন করে।
তারপর ইয়ামান সরকারের যুলুম-শোষণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেয় এবং বাস্তবেই তারা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে পড়ে। ২০০৪ সালে সরকারী বাহিনীর সাথে হুতী বাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু এ বছরই তিনি সরকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন। তার নিহত হওয়ার মাধ্যমে এসব আক্রমণ ও যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
আব্দুল মালেক হুতী
হুসাইন হুতী নিহত হওয়ার পর তার ভাই আব্দুল মালেক হুতী আশ-শাবাব সংগঠনের নেতৃত্বে আসে। তিনি ছিলেন প্রভাব সৃষ্টিকারী সুবক্তা। তিনি তার ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণে ইয়ামান সরকারের বিরুদ্ধ বিদ্রোহী আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
হুতীদের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ আক্বীদা ও মতবাদ
কতিপয় গবেষক নিশ্চিতভাবে বলেছেন যে, হুসাইন হুতী শী‘আদের ইমামী ইছনা আশারিয়া মতবাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তার লিখিত বই-পুস্তক এবং বক্তৃতার বিভিন্ন ক্যাসেট দ্বারা তাই প্রমাণিত হয়। হুতীদের বিভিন্ন প্রবন্ধ, বক্তৃতা এবং কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে তাদের বেশ কিছু আক্বীদা ও মতবাদ স্পষ্ট হয়। সেগুলোর সারাংশ নিম্নরূপ :
১. তাদের দাওয়াতের মূল কথা হল : (ক) ইমামিয়া আক্বীদাকে মজবুত করা। (খ) এই আক্বীদা পোষণ করা যে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরে ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে খলীফা হিসাবে নির্ধারণ করেছিলেন। (গ) ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পরে ইমাম হবেন হাসান এবং হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)। (ঘ) ইমাম হওয়ার পরম্পরা হাসান-হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর বংশধর থেকে কখনো বাইরে যাবে না। (ঙ) কোন ব্যক্তি এর ব্যতিক্রম আক্বীদা পোষণ করলে সে কাফির।
২. খুলাফায়ে রাশেদীন-বিশেষ করে তিন খলীফা (আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু), ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং অন্যান্য ছাহাবীদেরকে কাফির মনে করা। কারণ, তাদের আক্বীদা হল, মুসলিম বিশ্বে আজ পর্যন্ত যত ফেতনা-ফাসাদ আর সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তার মূল কারণ হল, এই তিন খলীফা সহ অন্য ছাহাবীগণ।
বদরুদ্দীন হুতী বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, তারা (অর্থাৎ ছাহাবীগণ) কাফির। কারণ, তারা রাসূলুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নির্দেশ লঙ্ঘন করেছে।”
হুসাইন হুতী নিশ্চিত করে বলেন, “আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাই‘আত গ্রহণের অনিষ্ট এবং কুপ্রভাব এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। এ কারণেই মুসলিম বিশ্বের সকল সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং শত্রুরা মুসলিম জাতির উপর চড়াও হয়েছে।” তিনি আরও বলেন যে, আবূ বকর, ওছমান এবং মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) সকলেই ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অন্যায় কার্যক্রমের ফসল।
৩. এ মর্মে দাওয়াত দেয়া যে, কেবল কুরআন অনুসরণ করতে হবে এবং কুরআন ছাড়া ইসলামী শরী‘আর অন্য সকল বিষয় বর্জন করতে হবে। কারণ তাদের মতে, হাদীছ ছাহাবী ও তাবিঈদের মাধ্যমে বিশ্বস্ততার সাথে বর্ণিত হয়নি। ফলে যে হাদীছ মুসলিম বিশ্বের কাছে যুগ পরিক্রমায় পরম নির্ভরতার সাথে গ্রহণীয় হয়ে আসছে তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য শারঈ উৎস নয়। এ কারণে, তারা ছহীহ বুখারী ও মুসলিমকে সরাসরি কটাক্ষ করে থাকে।
৪. তাদের দাবী হল, তাফসীর এবং উছূলে ফিক্বহের ক্ষেত্রে হাদীছকে উৎস হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। এর মূল উদ্দেশ্য হল, এই মতবাদে বিশ্বাসীরা যেন অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থেকে অন্ধভাবে তাদেরকে অনুসরণ করে। এভাবে অনুসারীদেরকে মূল রহস্য সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করা যাবে এবং অন্যান্য রাফিযিয়া আক্বীদা গ্রহণ করানো সহজ হবে।
৫. জনগণকে উত্তেজিত করে সেই জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার আহ্বান জানানো যাদের মধ্যে ইমাম হওয়ার শর্তাবলী বিদ্যমান নয়। তাদের মতে ইমাম হওয়ার অন্যতম শর্ত হল, হাসান ও হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর বংশোদ্ভূত হওয়া।
এ ধরণের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করাকে তারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম মনে করে। কারণ, প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সংগঠনের সদস্য ও সহযোগী লোকজনকে নিশ্চিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এবং অস্ত্র-শস্ত্র ক্রয় করে ব্যাপক অস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে তোলার আহ্বান জানানো।
৬. আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের লোকদেরকে এই যুক্তিতে সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করা যে, তারা তাদের সন্তানদেরকে বাতিল আক্বীদা শিক্ষা দিচ্ছে। যে কারণে ইতিহাস পরিক্রমায় মুসলিম জাতিকে খেসারত দিতে হচ্ছে।
আহলে সুন্নাহর লোকদেরকে বয়কট করা। কারণ, তারা আবূ বকর, ওমর ও ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-কে ভালোবাসে এবং তাদেরকে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উপর অগ্রাধিকার দেয়।
৭. ইরানের খোমেনী বিপ্লব এবং লেবাননের হিযবুল্লাহকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা। কারণ, তারা মনে করে সম্মান, মর্যাদা এবং মুক্তির জন্য এগুলোকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা কর্তব্য।
৮. মানুষের অনুভূতি ও চেতনায় উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য ইরান থেকে আমদানি করা কিছু অন্তঃসারশূন্য শ্লোগান দেয়া। যেমন, আমেরিকা ধ্বংস হোক, ইসরাইল ধ্বংস হোক, ইহুদীদের উপর লানত, ইসলামের বিজয়...ইত্যাদি।
৯. তাদের শী‘আ যায়দিয়া সম্প্রদায়ের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার জন্য সমালোচনা ও কান্নাকাটি করা এবং সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে তাদেরকে বিপ্লবের প্রতি উদ্ধুব্ধ করা।
১০. তাদের অনুসারীদেরকে আহলে সুন্নাতের তথাকথিত ‘ওহাবী’দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং হারামাইনের দেশকে তাদের কবল থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানানো। আহলে সুন্নাহর সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চিন্তাকে বোকামি প্রসূত চিন্তা বলে আখ্যায়িত করা।
১১. গাদ্দারী, বিশ্বাসঘাতকতা এবং অঙ্গীকারভঙ্গ ইত্যাদি অপকর্মে হুতীদের খ্যাতি রয়েছে।
ইরান এবং শী‘আ-ইছনা আশারিয়া মতবাদের সাথে হুতীদের সম্পর্ক
যায়দিয়া সম্প্রদায়ের কিতাবাদী রাফিজী-ইমামিয়া-ইছনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের সমালোচনায় ভরপুর। বরং তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট ও কাফির হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে ইমামিয়াদের কিতাবাদী যায়দিয়াদের সমালোচনা ও কুফরীর ফাতাওয়ায় পরিপূর্ণ।[৬]
এমন পরস্পর বিরোধী মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার পরও ইরানী বিপ্লব ‘তাক্বিয়া’ (তথা চরম গোপনীয়তা রক্ষা) নীতির অন্তরালে যায়দিয়াদের কাতারে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী হুতী জারূদীদের চিন্তা-চেতনার মাঝে তাদের হারানো মানিকের সন্ধান পায়।
তারা দেখল ইয়েমেনের মাটিতে তাদের বিপ্লব ও আক্বীদা-বিশ্বাস রপ্তানির জন্য হুতীরা সবচেয়ে ভালো প্রতিনিধি, অনুগত ছাত্র বা সৈনিক হওয়ার উপযুক্ত। এদের মাধ্যমেই ইয়ামানে তাদের আদর্শ, চিন্তা-চেতনা ও মতবাদ প্রচার করার পাশাপাশি তাদের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
উল্লেখ্য যে, বদরুদ্দীন হুতী এবং তার ছেলে হুসাইন হুতী ইতোঃপূর্বে ইরানে বসবাস করে রাফেযিয়া আক্বীদা এবং ব্যাপক-বিস্তর বিপ্লবী ধ্যান-ধারণা গলাধঃকরণ করে এসেছে।
এটাও অজানা নয় যে, এই হুতী ইরানের খোমেনী বিপ্লবের প্রতি মুগ্ধ। তিনি এই বিপ্লবকে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখে থাকে। তিনি এটিকে আল্লাহর রহমত ও নে‘মত মনে করেন। তিনি বলেন, ‘ইমাম খোমেনী ছিলেন একজন ন্যায়-নিষ্ঠ ও আল্লাহভীরু ইমাম। তিনি এমন ন্যায়পরায়ণ ইমাম ছিলেন যার দু‘আ বিফলে যায় না’।
ইয়ামানের যায়দিয়া সম্প্রদায়ের আলেমগণ এ মর্মে সতর্ক করেছিলেন যে, হুতীরা গোঁড়া ও বিচ্ছিন্নতাবাদী ইছনা আশারিয়া মতবাদ ও কর্মপদ্ধতি বহন করছে। এ ব্যাপারে তারা একটা বিবৃতিও প্রকাশ করেছিল। বাস্তবেই হুতীদের হাত ধরেই ইছনা আশারিয়া এবং ইরান বিপ্লবের সাথে যায়দিয়াদের ঐকমত্য সৃষ্টি ও কাছাকাছি আসার প্রবণতা বিস্তার লাভ করে।
রাফিযিয়া সম্প্রদায়ের কতিপয় মৌলিক আক্বীদা ও বিশ্বাস
ইরান বিপ্লব যে মতাদর্শে বিশ্বাসী তাহল ‘ইমামিয়া ইছনা আশারিয়া’ মতবাদ। এটি একটি গোঁড়া শী‘আ-রাফিযিয়া ফের্কা। এদের মৌলিক কিছু আক্বীদা নিম্নরূপ :
১. আল্লাহর সাথে শিরক : অর্থাৎ এ মতবাদে বিশ্বাসীরা তাদের ইমামদের নিকট দু‘আ করে, তাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে, তাদের কবরে যায় হজ্জ করার উদ্দেশ্যে, তাদের কবরে ত্বাওয়াফ করে, কবর জাপটে ধরে বরকত নেয়। এরা এই সব করবকে কা’বা এবং বাইতুল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে।
২. তারা এ দাবী করে যে, ইমামত হল দ্বীনের একটি রোকন বা স্তম্ভ। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে গেছেন। তিনি ইমাম হওয়ার বিষয়টি ১২ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন।
৩. তারা বলে, ইমামগণ ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে। তারা নিষ্পাপ। তারা অদৃশ্যের সব খবর রাখেন এবং এ বিশ্বজগত পরিচালনায় তাদেরও ক্ষমতা রয়েছে।
৪. তারা মনে করে, প্রতিক্ষিত ইমাম মাহদী বর্তমানে ইরাকের সিরডাপ সামুররায় আত্মগোপন করে আছে।
৫. তারা মনে করে, কুরআনকে বিকৃত করা হয়েছে এবং তা অপূর্ণ।
৬. ৪ জন ছাহাবী (আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) ছাড়া সকল ছাহাবীকে কাফির মনে করা এবং গালাগালী করা। বিশেষ করে আবূ বকর, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) এবং আয়িশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে।
৭. ‘তাকিয়া’ (চরম গোপনীয়তা রক্ষা) নীতি অবলম্বন করা। এরা আহলে সুন্নাহর প্রতি ভয়ানক শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে কিন্তু বাহ্যিক আচরণে সেটা প্রকাশ করে না।
৮. তারা বাদা‘আত মতবাদে বিশ্বাসী। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর নিকট এমন কিছু প্রকাশিত হয় যা তিনি আগে জানতেন না। যার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন।
৯. যে সব আহলে সুন্নাতের লোকেরা তাদের বিরোধিতা করে তাদেরকে তারা শুধু কাফিরই মনে করে না বরং মনে করে তাদেরকে হত্যা করা এবং সম্পদ লুণ্ঠন করা তাদের জন্য বৈধ।
১০. মুতা‘ বিবাহ (তথা শরী‘আত সম্মত বিবাহ ছাড়া) নারী সম্ভোগ করা বৈধ।
এই হল হুতী সম্প্রদায় সম্পর্কে এবং তাদের কার্যক্রম, উৎস, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আল্লাহর নিকট দু‘আ করি, তিনি যেন তাদেরকে হেদায়াত দান করেন এবং মুসলিমদেরকে তাদের অনিষ্ট ও ষড়যন্ত্রের কবল থেকে হেফাযত করেন। নিশ্চয় তিনি সব ব্যাপারে ক্ষমতাশীল- আমীন!!
* দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
তথ্যসূত্র :
[১]. ইয়ামানের রাজধানী ছানা‘ থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ২৪২ কি. মি. দূরে অবস্থিত একটি জেলা।
[২]. মীযানুল ই‘তিদাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৩; আল-কামিল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০৪৬-১০৪৮।
[৩]. রিজালুল কিশশী, পৃ. ১৯৯; ইবনু নাদীম, আল-ফিহরিস্ত, পৃ. ২৫৩।
[৪]. আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক্ব, পৃ. ৩০-৩২।
[৫]. দ্রষ্টব্য : ইমাম যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল, যিয়াদ ইবনু মুনযিরের জীবনী। রাফিযাতুল ইয়ামান, পৃ. ১২৬-১২৮; কাযী ইসমাইল আল আকওয়া, মুহাম্মাদ ইমাম যায়দিয়া : পরিচয় এবং আকীদা ও বিশ্বাস, পৃ. ২৪-২৫।
[৬]. দ্রষ্টব্য : মুহাম্মদ আল খুযার, আল ইমামাতুল ইসনা আশারিয়া লিয যায়দিয়া বাইনা আ‘দায়িল আমস ওয়া তকিয়াতুল ইয়াওম।