মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১২:২৮ পূর্বাহ্ন

বিদ‘আত পরিচিতি

-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


(১৯তম কিস্তি)

(খ) বিদ‘আত কুফরী কিংবা শিরকী পর্যায়ের না হওয়া

কারো বিদ‘আত যদি কুফরী কিংবা শিরকী পর্যায়ের না হয়, তাহলে তাদের বিবাহের বিষয়টি (الكفاءة في الزواج) ‘বিবাহে কুফু বা সমতা’-এর মাসয়ালার সাথে সম্পর্কিত। নি¤েœ তা উল্লেখ করা হল,

সুখী, সুন্দর ও মধুর দাম্পত্য জীবনের জন্য পাত্র-পাত্রীর মাঝে কিছু বিষয়ে সমতা থাকা চাই। সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের দু’জনের মাঝে দাম্পত্য সম্পর্ক কিছুতেই মধুর হতে পারে না। যেমন একজন নেককার অন্যজন বদকার, একজন মুত্তাকী পরহেযগার, অন্যজন দুর্বৃত্ত ব্যভিচারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلزَّانِیۡ  لَا یَنۡکِحُ  اِلَّا  زَانِیَۃً  اَوۡ  مُشۡرِکَۃً ۫ وَّ الزَّانِیَۃُ  لَا یَنۡکِحُہَاۤ  اِلَّا زَانٍ  اَوۡ مُشۡرِکٌ ۚ وَ حُرِّمَ  ذٰلِکَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ.

‘ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী অথবা মুশরিক রমণীকেই বিবাহ করবে এবং ব্যভিচারিণী নারীকে বিয়ে করবে কেবল ব্যভিচারী পুরুষ কিংবা মুশরিক পুরুষ। মুমিনদের পক্ষ এদের বিবাহ করা বৈধ নয়’ (সূরা আন-নূর : ৩)। উক্ত আয়াতে স্পষ্ট হল যে, ব্যভিচারী নরনারী নেককার নরনারীর জন্য ‘কুফু’ নয়। কেননা কাজে-কর্মে, স্বভাবে-চরিত্রে তাদের মাঝে বিস্তর পার্থক্য। এত ব্যবধান নিয়ে পরস্পর মহব্বত, প্রীতি-সম্প্রীতি তৈরি হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  اَفَمَنۡ کَانَ مُؤۡمِنًا کَمَنۡ کَانَ فَاسِقًا ؕؔ لَا  یَسۡتَوٗنَ ‘ঈমানদার ব্যক্তি কি নাফরমান ব্যক্তির মত? তারা কখনো সমান নয়’ (সূরা আস-সাজদাহ : ১৮)।

ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৩১-৬৭৬ হি.) কুফু সম্পর্কে বলেন, وَعِفَّةٌ فَلَيْسَ فَاسِقٌ كُفْءَ عَفِيْفَةٍ ‘চারিত্রিক নিষ্কলুষতার সাথে নাফরমানীর কোন কুফু নেই’।[১] কুফুর আলোচনায় অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, وَالْمُبْتَدِعُ مَعَ السُّنِّيَّةِ كَالْفَاسِقِ مَعَ الْعَفِيْفَةِ ‘চারিত্রিক নিষ্কলুষতার সাথে নাফরমানীর যেমন কোন কুফু নেই। অনুরূপভাবে সুন্নাহপন্থীদের সাথে বিদ‘আতীদের কোন কুফু নেই’।[২]

ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) (৫৪১-৬২০ হি./১১৪৭-১২২৩ খ্রি.) বলেন, والكفء ذو الدين والمنصب ‘কুফু হল দ্বীন ও সম্মান-মর্যাদার’।[৩]  

সুধী পাঠক! ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিয়েতে বংশীয় কুফুর গুরুত্ব সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে। যেমন, অধিকাংশ আলেম বংশকে কুফুর অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন। তবে অন্যদল বিরোধিতা করে বলেছেন যে, দ্বীনি কুফু ছাড়া কোন কুফু নেই। এই মতের অনুসারীগণ হলেন উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু), ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা), মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন, উমার ইবনু আব্দুল আযীয, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ, শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ও ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখ।[৪]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৯১-৭৫১ হি./১২৯২-১৩৫০ খি.) তাঁর বিখ্যাত ‘যাদুল মা‘আদ’ গ্রন্থে الكفاءة في النكاح  ‘বিবাহের ক্ষেত্রে সমতা’-এর বিধানাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, বিবাহের ক্ষেত্রে দ্বীনই মূলত কুফু বা সমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু। সুতরাং দ্বীনদারিতার উপর ভিত্তি করে মুসলিম নারী-পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। কেননা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাপন্থী যদি বিদ‘আতী কোন ছেলে বা মেয়ের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়, তাহলে দ্বীন মানার ক্ষেত্রে উভয়ের মাঝে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে। যা পারিবারিক সুখ-শান্তি ও দাম্পত্যময় জীবনের জন্য চরম অন্তরায়। অনুরূপভাবে দ্বীন মানার ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হবে। মূলত তাক্বওয়া, পরহেযগারিতা তথা দ্বীনদারিতাই হলো বিবাহের ক্ষেত্রে কুফু বা সমতা। অতঃপর তিনি নি¤েœাক্ত দলীলগুলো উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ  اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ  مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا ؕ اِنَّ  اَکۡرَمَکُمۡ  عِنۡدَ اللّٰہِ  اَتۡقٰکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ.

‘হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহ‌র নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ‌ সবকিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ  اِخۡوَۃٌ  ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১০)। তিনি আরো বলেন, وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتُ بَعۡضُہُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ‘মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু’ (সূরা আত-তাওবাহ : ৭১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, فَاسۡتَجَابَ لَہُمۡ رَبُّہُمۡ اَنِّیۡ لَاۤ اُضِیۡعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِّنۡکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی ۚ بَعۡضُکُمۡ مِّنۡۢ  بَعۡضٍ ‘অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে কর্মনিষ্ঠ কোন নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না; তোমরা একে অপরের অংশ’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৯৫)। হাদীছে এসেছে,

لَا فَضْلَ لِعَرَبِىٍّ عَلَى أَعْجَمِىٍّ وَلَا لِعَجَمِىٍّ عَلَى عَرَبِىٍّ وَلَا لأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ إِلَّا بِالتَّقْوَى اَلنَّاسُ مِنْ آدَمَ وَآدَمَ مِنْ تُرَابٍ.

‘আযমীদের উপর আরবীদের কোন মর্যাদা নেই। আরবীদের উপর আযমীদেরও কোন মর্যাদা নেই। কালোর উপর লালের এবং লালের উপর কালোর কোন মর্যাদা নেই, তাক্বওয়া ব্যতীত। মানুষ আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে’।[৫] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আবূ হাতিম আল-মুযানী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِيْنَهُ وَخُلُقَهُ فَأَنْكِحُوْهُ إِلَّا تَفْعَلُوْا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِى الْأَرْضِ وَفَسَادٌ.

‘তোমরা যে লোকের দ্বীনদারী ও নৈতিক চরিত্র দ্বারা সন্তুষ্ট আছ, তোমাদের নিকট যদি সে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তবে তার সাথে (তোমাদের পাত্রীর) বিয়ে দাও। তা না করলে পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ ও বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়বে’।[৬]

সুধী পাঠক! নবী করীম (ﷺ) কুরাইশের যায়েদ ইবনু হারিছার মুক্ত গোলাম যায়নাব বিনতে জাহাশ এবং পালক পুত্র উসামা ইবনু যায়েদের তালাক্বপ্রাপ্তা কুরায়েশী স্ত্রী ফাতেমা বিনতে ক্বায়সকে বিয়ে করেছিলেন। আর বিলাল ইবনু রাবাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বোনকে বিবাহ করেছিলেন।[৭] এছাড়া আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ الطَّیِّبٰتُ لِلطَّیِّبِیۡنَ وَ الطَّیِّبُوۡنَ لِلطَّیِّبٰتِ ‘সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্য’ (সূরা আন-নূর : ২৬)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَانۡکِحُوۡا مَا طَابَ لَکُمۡ مِّنَ النِّسَآءِ  ‘বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভাল লাগে’ (সূরা আন-নিসা : ৩)।

অতএব বিবাহের কুফু মূলত দ্বীনদারিতাই। সুতরাং কাফিরের সাথে মুসলিম মহিলার বিবাহ করা জায়েয নয়, জায়েয নয় চারিত্রিক নিষ্ককলুষ কোন মহিলার সাথে নাফরমান কোন পুরুষের বিবাহ করা। এটা ব্যতীত কুফু বিষয়ে আল-কুরআন ও সুন্নাহতে কোন কিছু বর্ণিত হয়নি। তাই অপবিত্র ও ব্যাভিচারীকে বিবাহ করা মুসলিম মহিলার জন্য হারাম। এছাড়া বিয়ের ক্ষেত্রে বংশ মর্যাদা, চাকুরী-বাকুরী, সম্পদশালী ও স্বাধীন হওয়াও শর্ত নয়। সুতরাং দাসের জন্য উচ্চবংশীয় সম্পদশালী স্বাধীন মেয়েকে বিয়ে করা জাযেয, যদি সে মুসলিম হয় ও চারিত্রিক নিষ্কলুষের অধিকারী হয়। এমনকি কুরাইশ ও কুরাইশ নয় এবং হাশেমী ও হাশেমী নয় এমন ছেলে-মেয়ে পরস্পর বিবাহ করতে পারবে এবং ফক্বীর ধনাঢ্যশীলকেও বিবাহ করতে পারবে।[৮]

বংশীয় সমতার ব্যাপারে কোন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যায় না। বরং এর বিপরীতে এমন অনেক ঘটনা ও রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল (ﷺ) ও সাহাবীদের যুগে বংশীয় সমতা লক্ষণীয় বিষয় ছিল না। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) (১৯৪-২৫৬ হি./৮১০-৮৭০ খ্রি.) তাঁর ছহীহুল বুখারীতে بَابُ الْأَكْفَاءِ فِى الدِّيْنِ ‘স্বামী ও স্ত্রী একই দ্বীনভুক্ত হওয়া’ শীর্ষক শিরোনাম নির্ধারণ করেছেন। সেখানে তিনি চারটি হাদীছ উপস্থাপন করে প্রমাণ করেছেন যে, বংশীয় সমতা গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং তাক্বওয়া, দ্বীনদারিতাই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ أَبَا حُذَيْفَةَ بْنَ عُتْبَةَ بْنِ رَبِيْعَةَ بْنِ عَبْدِ شَمْسٍ وَكَانَ مِمَّنْ شَهِدَ بَدْرًا مَعَ النَّبِىِّ ﷺ تَبَنَّى سَالِمًا وَأَنْكَحَهُ بِنْتَ أَخِيْهِ هِنْدَ بِنْتَ الْوَلِيْدِ بْنِ عُتْبَةَ بْنِ رَبِيْعَةَ وَهْوَ مَوْلًى لْاِمْرَأَةٍ مِنَ الْأَنْصَارِ.

‘আবূ হুযাইফাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইবনু উতবাহ ইবনু রাবি‘আ ইব‌নু আবদে শাম্‌স, যিনি বদ‌রের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ‌ (ﷺ)-এর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন, তিনি সালিমকে পালক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন এবং তার সঙ্গে তিনি তাঁর ভাতিজী ওয়ালীদ ইব‌নু উতবাহ ইবনু রাবি‘আর কন্যা হিন্দাকে বিয়ে দেন। সে ছিল এক আনছারী মহিলার আযাদকৃত দাস’।[৯] আবার মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সহধর্মিণী ছিলেন যুবা‘আহ বিনতে যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহা)। অথচ তিনি ছিলেন অভিজাত বংশের সম্ভ্রান্ত মেয়ে।[১০] এমনকি দারিদ্র্যতা কুফুর ক্ষেত্রে বাধা তাও ঠিক নয়। যেমন সাহল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

مَرَّ رَجُلٌ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ فَقَالَ ্রمَا تَقُوْلُوْنَ فِىْ هَذَاগ্ধ. قَالُوْا حَرِىٌّ إِنْ خَطَبَ أَنْ يُنْكَحَ وَإِنْ شَفَعَ أَنْ يُشَفَّعَ وَإِنْ قَالَ أَنْ يُسْتَمَعَ. قَالَ ثُمَّ سَكَتَ فَمَرَّ رَجُلٌ مِنَ فُقَرَاءِ الْمُسْلِمِيْنَ فَقَالَ ্রمَا تَقُوْلُوْنَ فِىْ هَذَاগ্ধ. قَالُوْا حَرِىٌّ إِنْ خَطَبَ أَنْ لَا يُنْكَحَ، وَإِنْ شَفَعَ أَنْ لَا يُشَفَّعَ، وَإِنْ قَالَ أَنْ لَا يُسْتَمَعَ. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ্রهَذَا خَيْرٌ مِنْ مِلْءِ الْأَرْضِ مِثْلَ هَذَاগ্ধ.

‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ‌ (ﷺ)-এর নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিল। তখন তিনি (ছাহাবীবর্গকে) বললেন, তোমাদের এর সম্পর্কে কী ধারণা? তারা উত্তর দিলেন, যদি কোথাও কোন মহিলার প্রতি এ লোকটি বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তার সঙ্গে বিযে দেয়া যায়। যদি সে সুপারিশ করে, তাহলে সুপারিশ গ্রহণ করা হয়, যদি কথা বলে, তবে তা শোনা হয়। রাবী বলেন, অতঃপর নবী করীম (ﷺ) চুপ করে থাকলেন। এরপর সেখান দিয়ে একজন গরীব মুসলিম অতিক্রম করতেই রাসূলুল্লাহ‌ (ﷺ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তি সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা? তারা জবাব দিলেন, যদি এ ব্যক্তি কোথাও বিয়ের প্রস্তাব করে, তার সাথে বিযে দেয়া হয় না। যদি কারও জন্য সুপারিশ করে, তবে তা গ্রহণ করা হয় না। যদি কোন কথা বলে, তবে তা শোনা হয় না। তখন রাসূলুল্লাহ‌ (ﷺ) বললেন, দুনিয়া ভর্তি ঐ ধনীদের চেয়ে এ দরিদ্র লোকটি উত্তম’।[১১]

সুধী পাঠক! বিবাহের ক্ষেত্রে যেখানে ছেলে-মেয়ের দ্বীনদারিতাই মূলত কুফু। সেখানে আক্বীদার বিষয়টি আরো জোরালোভাবে মূল্যায়ন করা কর্তব্য। কেননা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাপন্থী কোন মেয়ে যদি বিদ‘আতী কোন ছেলের সাথে বিয়ে হয়, তাহলে সে বিদ‘আতের নোংরা নর্দমায় পতিত হবে এবং ছহীহ আক্বীদা ও ছহীহ আমলের মাধ্যমে তার জীবন পরিচালনা করা অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। বিদ‘আতী স্বামী যেমন তার আক্বীদা পরিপন্থী কোন কিছু মেনে নিবে না পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহপন্থী মেয়েও বিদ‘আতের কোন কিছু মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে। ফলে দাম্পত্য কলহ ব্যাপক আকার রূপ নিবে। পরিবার থেকে আত্মিক প্রশান্তি ও সুখ-সমৃদ্ধময় জীবন দুর্বিসহ জীবনে পরিণত হবে। এছাড়া তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মও ইসলামের সঠিক আক্বীদা ও আমল থেকে বঞ্চিত হবে। বর্তমানে এরকম ঘটনা হরহামেষা ঘটছে। অতএব বিবাহের ক্ষেত্রে অবশ্যই দ্বীনদারিতা ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের সুদৃঢ় ও বিশুদ্ধ আক্বীদাহকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা বিদ‘আতীদের সাথে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক স্থাপন করলে অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়বে এবং ইসলামের জ্যোতি থেকে হৃদয় মুক্ত হয়ে যাবে। এছাড়া তার আমল বরবাদ হয়ে যাবে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবে। যা নিরপেক্ষভাবে আল-কুরআন, ছহীহ হাদীছ ও সালাফী মানহাজের আলোকে সার্বিক জীবন পরিচালনা করার ক্ষেত্রে চরম বাধার সম্মুখীন করবে। ফুযাইল ইবনু ‘ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ)  (১০৭-১৮৭ হি.) বলেন,

مَنْ أَحَبَّ صَاحِبَ بِدْعَةٍ أَحْبَطَ اللهُ عَمَلَهُ وَأَخْرَجَ نُوْرَ الْإِسْلَامِ مِنْ قَلْبِهِ، وَمَنْ زَوَّجَ كَرِيْمَتَهُ مِنْ مُبْتَدِعٍ فَقَدْ قَطَعَ رَحِمَهَا، وَمَنْ جَلَسَ مَعَ صَاحِبِ بِدْعَةٍ لَمْ يُعْطَ الْحِكْمَةَ، وَإِذَا عَلِمَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ رَجُلٍ أَنَّهُ مُبْغِضٌ لِصَاحِبِ بِدْعَةٍ رَجَوْتُ أَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَهُ.

‘যে ব্যক্তি বিদ‘আতীকে ভালোবাসে আল্লাহ তা‘আলা তার আমলকে ধ্বংস করে দেন এবং তার অন্তর থেকে ইসলামের জ্যোতিকে বের করে দেন। আর যে কোন বিদ‘আতীর কন্যাকে বিবাহ করে তার প্রতি রহম বা আল্লাহর দয়া কেটে যায়। যে বিদ‘আতীর সাথে উপবেশন করে তাকে হেকমত বা প্রজ্ঞা দান করা হয় না। আর আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন ব্যক্তির ব্যাপারে জানেন যে, সে বিদ‘আতীর সাথে বিদ্বেষপরায়ণ, আমি আশা করি আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিবেন’।[১২]

বিদ‘আতীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। যেমন, ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) (৯৩-১৭৯ হি./৭১১-৭৯৫ খ্রি.) বলেন, لَا يُنْكَحُ أَهْلُ الْبِدَعِ وَلَا يُنْكَحُ إلَيْهِمْ وَلَا يُسَلَّمُ عَلَيْهِمْ وَلَا يُصَلَّى خَلْفَهُمْ وَلَا تُشْهَدُ جَنَائِزُهُمْ ‘বিদ‘আতীকে বিয়ে করা যাবে না। তাদের সাথে কাউকে বিয়ে দেয়া যাবে না, তাদেরকে সালাম দেয়া যাবে না, তাদের পিছনে ছালাত আদায় করা যাবে না এবং তাদের জানাযায় অংশগ্রহণ করবে না’।[১৩]

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, مَنْ لَمْ يَرْبَعْ بِعَلِّي ابْنِ أَبِي الطَّالِبِ فِي الخِلَافَةِ فَلَا تُكَلِّمُوْهُ وَلَا تَنَاكِحُوُهْ ‘যারা আলী ইবনু আবী তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফতকালে তাঁর সাথে থাকেনি তার সাথে তোমরা কথা বলবে না এবং তার সাথে বিবাহ করবে না’।[১৪]

 (ইনশাআল্লাহ চলবে)

* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. যাকারিয়া মুহাম্মাদ ইবনু যাকারিয়া আল-আনছারী আশ-শাফেঈ, মাবহাজুত তুল্লাবি ফী ফিক্বহি ইমাম আশ-শাফেঈ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খ্রি.), পৃ. ১৮৩।
[২]. মুগনীউল মুহতাজ, ৩য় খ-, পৃ. ১৬৬; গৃহীত : মাওক্বিফু আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতি মিন আহলিল হাওয়া ওয়াল বিদাঈ, ১ম খ-, পৃ. ৩৮৪।
[৩]. মাওক্বিফু আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতি মিন আহলিল হাওয়া ওয়াল বিদাঈ, ১ম খ-, পৃ. ৩৮৫।
[৪]. শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ, ফাতাওয়া সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৬৫৫১০।
[৫]. আলী ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবিল ঈয আল-হানাফী, শারহুল আক্বীদাতিত ত্বাহাবিয়্যাহ, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ২য় সংস্করণ, ১৪১৪ হি.), হা/৪০৬।
[৬]. তিরমিযী, হা/১০৮৫, সনদ হাসান।
[৭]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খায়রিল ‘ইবাদ (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৭শ সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ৫ম খ-, পৃ. ১৫৯; শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ, ফাতাওয়া সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৬৫৫১০।
[৮]. যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খায়রিল ‘ইবাদ, ৫ম খ-, পৃ. ১৫৯-১৬০।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৮৮।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৮৯।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৯১।
[১২]. আল-জামিঊ লি আহকামিল কুরআন, ৭ম খ-, পৃ. ১৩।
[১৩]. মালিক ইবনু আনাস, আল-মুদাওয়ানাতু (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ১ম খ-, পৃ. ১৭৭।
[১৪]. আবুল হুসাইন ইবনু আবূ ই‘আলা, মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ, ত্বাবাক্বাতুল হানাবালাহ (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, তাবি), ১ম খ-, পৃ. ৪৫।




রামাযানে দান-ছাদাক্বাহ - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বিদ‘আত পরিচিতি (৭ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৯ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
আল্লাহ তা‘আলাকে কি স্বপ্নযোগে দেখা সম্ভব? - হাসিবুর রহমান বুখারী
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
হজ্জের শিক্ষা ও হজ্জ পরবর্তী করণীয় - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ফাযায়েলে কুরআন (৫ম কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ফাযায়েলে কুরআন (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
এমফিল ও পিএইচডি : গবেষণার প্রকৃতি ও পদ্ধতি - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ

ফেসবুক পেজ