ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন
-হাসিবুর রহমান বুখারী*
(১০ম কিস্তি)
(২) বিশেষ করে বানূ তামীম গোত্রের উপর তথা আহলে হাদীছদের উপর
দাজ্জাল যাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে না, তাদের মধ্যে অন্যতম হল, ‘বানূ তামীম গোত্রের লোকেরা’। বরং এরাই দাজ্জালের উপর সর্বাধিক কঠোর হবে। বানূ তামীম (بَنُو تَمِيم) অন্যতম আরব গোত্র যারা প্রধানতঃ সঊদী আরবে বসবাস করে। যেহেতু বানূ তামীম তথা সঊদী আরবের লোকেরা কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহাব অনুসরণ করে না এবং কোন একজন নির্দিষ্ট ইমামের অন্ধ তাক্বলীদ করে না। বরং তাঁরা নিজেদেরকে মানহাজে সালাফের অনুসারী বা আহলেহাদীছ বলে পরিচয় দেয়। সেক্ষেত্রে আমরা নির্দিধায় বলতে পারি যে, বানূ তামীমের মত তাদের গুণে গুণান্বিত আহলেহাদীছদের উপরেও দাজ্জাল কোন প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে না ইনশাআল্লাহ।
তামীম আরবের বৃহৎ গোত্রগুলোর মধ্যে একটি। তামীম গোত্র ৬ষ্ঠ শতকে আরব উপদ্বীপের পূর্বাংশে বাস করত। ইসলামের উত্থানপর্বে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ৮ম হিজরী বছরে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সংস্পর্শে আসে। গোত্রটি আদনানের মাধ্যমে ইসমাইল (আলাইহিস সালাম) এবং ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর সংগে সম্পর্কিত। বলা হয়ে থাকে বানূ তামীম সব থেকে বড় আরব গোত্র।
বানূ তামীমের বংশধারা
বানূ তামীমের বংশধারা হল, ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)- আদনান- মা‘আদ- নিজার- মুদার ইবনে নিজার- ইলিয়াস ইবনে মুদার- আমর- এদ- মওর- তামিম। তাদের বেশিরভাগ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আগের দিনগুলোতে নাজদ তথা সঊদী আরবের স্থানীয় বাসিন্দা ছিল। পরবর্তীতে কিন্তু ইসলামের বিজয়ের সাথে সাথে সমস্ত আরব উপদ্বীপ ছড়িয়ে পড়ে।
বানূ তামীম সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী
(১) আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
مَا زِلْتُ أُحِبُّ بَنِيْ تَمِيْمٍ مُنْذُ ثَلَاثٍ سَمِعْتُ مِنْ رَسُولِ اللهِ ﷺ يَقُوْلُ فِيْهِمْ سَمِعْتُهُ يَقُوْلُ هُمْ أَشَدُّ أُمَّتِيْ عَلَى الدَّجَّالِ قَالَ وَجَاءَتْ صَدَقَاتُهُمْ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ هَذِهِ صَدَقَاتُ قَوْمِنَا وَكَانَتْ سَبِيَّةٌ مِنْهُمْ عِنْدَ عَائِشَةَ فَقَالَ أَعْتِقِيْهَا فَإِنَّهَا مِنْ وَلَدِ إِسْمَاعِيْلَ .
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে তিনটি কথা শোনার পর হতে বানী তামীম গোত্রকে আমি ভালোবেসে আসছি। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি যে, দাজ্জালের মুকাবিলায় আমার উম্মতের মধ্যে এরাই হবে অধিকতর কঠোর। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একবার তাদের পক্ষ হতে ছাদাক্বার মাল আসল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, এ যে আমার ক্বাওমের ছাদাক্বাহ। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর হাতে তাদের এক বন্দিনী ছিল। তা দেখে নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, একে মুক্ত করে দাও। কেননা সে ইসমাঈলের বংশধর’।[১]
উপরিউক্ত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বানূ তামীমের সম্মান ও মর্যাদার কারণে তাঁদেরকে নিজের জাতি হিসাবে সম্বোধন করেছেন। আর তা ছাড়া রাসুলুল্লাহ (ﷺ) নিজেও তো ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)-এর বংশোদ্ভূত। যেমন তিনি বলেন,
إِنَّ اللهَ اصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إِبْرَاهِيْمَ إِسْمَاعِيْلَ وَاصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إِسْمَاعِيْلَ بَنِي كِنَانَةَ وَاصْطَفَى مِنْ بَنِي كِنَانَةَ قُرَيْشًا وَاصْطَفَى مِنْ قُرَيْشٍ بَنِي هَاشِمٍ وَاصْطَفَانِىْ مِنْ بَنِي هَاشِمٍ
‘আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীমের সন্তানগণের মধ্য থেকে ইসমাঈলকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর ইসমাঈলের সন্তানগণের মধ্য থেকে বানূ কিনানাহকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর বানূ কিনানাহ থেকে কুরাইশ বংশকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর কুরাইশ থেকে বানূ হাশিমকে এবং বানূ হাশিম থেকে আমাকে বেছে নিয়েছেন’।[২]
(৩) আত্ব-ত্বায়িফাতুল মানছূরাহ্ (সাহায্যপ্রাপ্ত দল) বা আল- ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ (মুক্তিপ্রাপ্ত দল)-এর উপর
ইমরান ইবনু হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِيْ يُقَاتِلُوْنَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِريْنَ علَى مَنْ نَاوَأَهُم حتَّى يُقَاتِلَ آخِرُهُمُ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সত্যের পক্ষে জিহাদ করতে থাকবে এবং তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে। অবশেষে তাদের সর্বশেষ দলটি ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর নেতৃত্বে দাজ্জালের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে’।[৩]
এখন প্রশ্ন হল, এই সাহায্যপ্রাপ্ত বা বিজয়ী দলটি কারা? যারা শেষে দাজ্জালের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে এবং বিজয়ী হবে? হাদীছ স¤্রাট ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, ‘নবী (ﷺ)-এর বাণী : আমার উম্মতের মধ্যে এক দল সর্বদাই হক্বের উপর বিজয়ী থাকবে। আর তারা হল (দ্বীনী) ইলমের অধিকারীগণ’।[৪] অতঃপর তিনি নিম্নের হাদীছ দু’টি বর্ণনা করেন। মুগীরাহ ইবনু শু‘বাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন,لَا يَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِيْ ظَاهِرِيْنَ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ ظَاهِرُوْنَ ‘ক্বিয়ামত আসা পর্যন্ত আমার উম্মতের একদল সর্বদাই বিজয়ী থাকবে। আর তারা হল বিজয়ী’।[৫]
মু‘আবিয়া ইবনু আবূ সুফিয়ান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন। আমি তো (ইলমের) বণ্টনকারী মাত্র, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তা দান করে থাকেন। এ উম্মতের কার্যকলাপ ক্বিয়ামত অবধি কিংবা বলেছিলেন, আল্লাহ তা‘আলার হুকুম আসা পর্যন্ত (সত্যের উপর) সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে।[৬]
মু‘আবিয়া ইবনু কুররাহ (রাহিমাহুল্লাহ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
إِذَا فَسَدَ أَهْلُ الشَّامِ فَلَا خَيْرَ فِيْكُمْ لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِيْ مَنْصُوْرِيْنَ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى تَقُوْمَ السَّاعَةُ.
‘যখন সিরিয়াবাসীরা খারাপ হয়ে যাবে তখন তোমাদের মধ্যে আর কোন কল্যাণ অবশিষ্ট থাকবে না। তবে আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সকল সময়েই সাহায্যপ্রাপ্ত (বিজয়ী) থাকবে। যেসব লোকেরা তাদেরকে অপমানিত করতে চায় তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না’। অন্য বর্ণনায় এসেছে..., ‘আর আমি আমার উম্মতের পথভ্রষ্ট নেতাদের ব্যাপারে শঙ্কিত। আমার উম্মত যখন পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হবে, তখন ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা আর বিরত হবে না। আর আমার উম্মতের কিছু সংখ্যক মুশরিকদের সঙ্গে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত এবং আমার উম্মতের কতিপয় গোত্র মূর্তি পূজায় লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না। অবিলম্বে আমার উম্মাতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব ঘটবে, তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী করবে। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী এবং আমার পরে আর কোন নবী আসবে না। তবে আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সত্যের উপর অটল থাকবে। যারা তাদের বিরোধিতা করবে, তারা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, এমনকি এ অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশ (ক্বিয়ামত) এসে যাবে।[৭]
উপরিউক্ত হাদীছের শেষাংশে ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ) (অর্থাৎ ইমাম বুখারী) বলেন, আলী ইবনুল মাদীনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, সাহায্যপ্রাপ্ত বা বিজয়ী সেই দলটি হল, ‘আহলুল হাদীছ’।[৮]
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে যে, ঐ দলটি মুমিনদের মধ্যেই বিভিন্ন নামে বা বিভাগে বিভক্ত হয়ে আছে, তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক হচ্ছেন শক্তিশালী যোদ্ধা এবং কিছু সংখ্যক ফিক্বহবিদ, কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিছ, কিছু সংখ্যক ইবাদত গুজার এবং যারা সৎ কাজের আদেশ দেন এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করেন। এছাড়াও অন্যান্য সৎ কাজের সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিবর্গগণ। তাদের জন্য একত্রিত হওয়া শর্ত নয়। বরং তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন।[৯]
ফের্ক্বা নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দলটি মানুষের মধ্যে প্রবাসীর মত মুষ্টিমেয়। যাদের জন্য আল্লাহর রাসূল (ﷺ) দু‘আ করে বলেছেন,
إن الإسلام بدأ غريبًا، وسيعودُ غريبًا كما بدأَ، فطُوبَى للغُرباءِ قيل: من هم يا رسولَ اللهِ ﷺ؟ قال : الذينَ يصلحونَ إذا فسدَ الناسُ
‘ইসলাম শুরুতে প্রবাসীদের মত নিঃসঙ্গ ও অপরিচিত ছিল, অচিরেই তা আবার শুরুর মত নিঃসঙ্গ ও অপরিচিত হয়ে যাবে। সুতরাং এরূপ নিঃসঙ্গ ও অপরিচিত অবস্থাতেও যারা ইসলামের উপর অটল থাকবে তাদের জন্য সুসংবাদ। বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তারা কারা? তিনি বলেন, যখন মানুষেরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে তখন তারা ইছলাহ বা সংশোধনের কাজ করতে থাকবে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘শুভ সংবাদ ঐ (প্রবাসীর মত নিঃসঙ্গ) মুষ্টিমেয়ে লোকেদের জন্য, যারা বহু সংখ্যক অসৎ লোকের মাঝে অল্প সংখ্যক সৎ লোক হবে। তাদের অনুগত লোকের চেয়ে অবাধ্য লোকের সংখ্যা অধিক’।[১০]
উল্লেখ্য, ইসলামের শুরু হয়েছে মদীনাহ হতে অর্থাৎ পবিত্র মক্কা হতে কিছু সংখ্যক অপরিচিত মানুষ হিজরত করে মদীনায় আসেন। তাদের দ্বারাই ইসলাম শুরু হয়েছে। ইসলাম শেষ যুগে ঐ অবস্থায় ফিরে যাবে। অর্থাৎ সারা বিশ্বে কাফির ও বেঈমানদের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। আর ঈমানদারগণ ওদের ভয়ে মদীনায় ফিরে আসবে। কাযী ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীছের উদ্দেশ্য এই যে, প্রথমে ইসলাম আরম্ভ হয়েছিল অল্প সংখ্যক লোকের দ্বারা, শেষ যুগে কমতে কমতে ইসলাম আবার অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যে রয়ে যাবে। এই দলের অনুসারীদের সম্পর্কে কুরআনুল কারীম সুসংবাদ দিয়েছে। এদের প্রশংসা করে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, وَ قَلِیۡلٌ مِّنۡ عِبَادِیَ الشَّکُوۡرُ ‘এবং আমার বান্দাগণের মধ্যে অল্পসংখ্যকই লোক কৃতজ্ঞ’ (সূরা সাবা : ১৩)।
সাহায্যপ্রাপ্ত বা মুক্তিপ্রাপ্ত দলের শত্রু সংখ্যা অসংখ্য। লোকেরা তাদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়। তাদেরকে মন্দনাম ও বিশ্রি উপাধিতে অভিহিত করে থাকে। অবশ্য এ বিষয়ে তাদের আদর্শ ও নমুনা ছিলেন নবী-রাসূলগণ, যাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
وَ کَذٰلِکَ جَعَلۡنَا لِکُلِّ نَبِیٍّ عَدُوًّا شَیٰطِیۡنَ الۡاِنۡسِ وَالۡجِنِّ یُوۡحِیۡ بَعۡضُہُمۡ اِلٰی بَعۡضٍ زُخۡرُفَ الۡقَوۡلِ غُرُوۡرًا
‘এবং এরূপে আমি প্রত্যেক নবীর জন্য শয়তান মানব ও দানবকে শত্রু করেছি, যারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে থাকে..’ (সূরা আল-আন‘আম : ১১২)।
সঊদী আরবের প্রধান মুফতী শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) ফের্ক্বা নাজিয়াহ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে উত্তরে তিনি বলেন, ‘সালাফীগণই ফের্ক্বা নাজিয়াহ এবং তারা, যারা সালাফে ছালিহীনের (রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ছাহাবাদের) মতাদর্শে চলেন। আল্লামাহ ইবনুল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমার মতে তাঁরা হলেন আছহাবুল হাদীছ বা আহলুল হাদীছ’।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,ان لم يكون أهل الحديث فلا أدري من هم ‘এই সাহায্যপ্রাপ্ত দলটি যদি আহলুল হাদীছ না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা?’[১১]
আহলেহাদীছরাই যেহেতু কুরআন, সুন্নাহ এবং তার আনুষঙ্গিক সকল বিষয়ের অধ্যয়নে বিশেষজ্ঞ তাই তারাই সকল মানুষের চেয়ে নবী করীম (ﷺ)-এর সুন্নাহ, আদর্শ, পথনির্দেশ, চরিত্র, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত যাবতীয় বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখে। তারা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের পক্ষপাতিত্ব করে না, তাতে সে ব্যক্তি যতই শীর্ষস্থানীয় এবং সম্মানীই হোন না কেন। পক্ষপাতিত্ব করে শুধু মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর। পক্ষান্তরে অন্যান্য লোকেরা যারা আহলেহাদীছ ও হাদীছের উপর আমলে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত নয়, তারা তাদের ইমামগণের উক্তির পক্ষপাতিত্ব করে, অথচ এমনটি করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাদের পক্ষপাতিত্ব করে থাকে, যেমন আহলেহাদীসগণ তাদের নবী (ﷺ)-এর উক্তির পক্ষপাতিত্ব করে। সুতরাং বিস্ময়ের কিছু নয় যে, তারাই হল সাহায্যপ্রাপ্ত এবং মুক্তিপ্রাপ্ত দল বা জামা‘আত।
খত্বীব আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর শারফু আছহাবিল হাদীছ (আহলেহাদীছের মর্যাদা) নামক গ্রন্থে বলেন, ‘রায় ওয়ালা’ (মনগড়া মতকে প্রাধান্যদাতা) যদি ফলপ্রসু ইলম অন্বেষণে ব্যাপৃত হত এবং আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহসমূহ অনুসন্ধান করত, তবে সে সেই জিনিসই অর্জন করতে পারত যা অন্যান্য থেকে তাকে অমুখাপেক্ষী করত। যেহেতু হাদীছে রয়েছে তাওহীদের মৌলনীতি সমূহের পরিজ্ঞান, আগত বিভিন্নমুখী অঙ্গীকার ও তিরস্কারের বিবৃতি, বিশ্বজগতের প্রতিপালকের গুণাবলী, জান্নাত ও জাহান্নামের আকৃতি বিষয়ক সংবাদ, তাতে সংযমী ও দুষ্কৃতীদের জন্য আল্লাহ কী প্রস্তুত রেখেছেন তার খবর এবং আল্লাহ পৃথিবীসমুহে ও আকাশম-লীতে কী সৃষ্টি করেছেন তারও খবর ইত্যাদি ইত্যাদি।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আহলেহাদীছের দলভুক্ত করুন। হাদীছের উপর আমল, তার অনুসারীদের প্রতি ভালোবাসা এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী আমলকারীদের সহায়তা করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!
শায়খ ছালিহ ইবনে ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘কিছু মানুষ মনে করে যে, আত-ত্বায়িফাতুল মানছুরাহ (সাহায্যপ্রাপ্ত দল) এবং আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ (মুক্তিপ্রাপ্ত দলের)-এর মাঝে পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু তা ছহীহ নয়। বরং যারাই আত-ত্বায়িফাতুল মানছুরাহ (সাহায্যপ্রাপ্ত দল) তাঁরাই আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ (মুক্তিপ্রাপ্ত দল)’। প্রকৃতপক্ষে নাজিয়াহ না হলে মানছুরাহ হতে পারবে না এবং মানছুরাহ না হলে নাজিয়াহ হতে পারবে না। একই জিনিসের দু’টি অবিচ্ছিন্ন গুণ।
এই পার্থক্যকরণ জাহিলদের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে অথবা আত-ত্বায়িফাতুল মানছুরাহ (সাহায্যপ্রাপ্ত দল) এবং আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ (মুক্তিপ্রাপ্ত দলের)-এর যুবকদের মাঝে ফাটল সৃষ্টির জন্য কোন উদ্দেশ্যপরায়ণ ব্যক্তি করে থাকে।
হাদীছ বিশারদ ইমামগণের অভিমত হল, আদতে আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ হল, আত-ত্বায়িফাতুল মানছুরাহ, কারণ তাঁরাই হাদীছের অনুসারী, তাঁরাই সুন্নাহ এবং ছাহাবীদের জামা‘আতের অনুসারী, তাঁরাই সালাফী। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক বিদ্বান এমত ব্যক্ত করেছেন।
আল্লামা মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’র ভূমিকায় আবিল ইউমন ইবনে আসাকিরের একটি মত উল্লেখ করে বলেন, ‘হাদীছের অনুসারীরা আনন্দের সাথে এ সুসংবাদ গ্রহণ করুক যে তারাই আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ।’
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘খালকু আফ‘আলিল ‘ইবাদ’ নামক গ্রন্থের ৬১ নং পৃষ্ঠায় وَ کَذٰلِکَ جَعَلۡنٰکُمۡ اُمَّۃً وَّسَطًا ‘আর এভাবেই আমরা তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি’ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত আবূ সাঈদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীছ উল্লেখ করে বলেন, এরা হল হাদীছে বর্ণিত সেই لا تزال طائفة من أمتي ‘আমার উম্মাহর একটি দল থাকবে’ সেই দল।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) আত-ত্বায়িফাতুল মানছুরাহ (সাহায্যপ্রাপ্ত দল) এবং আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ (মুক্তিপ্রাপ্ত দলের)-এর মাঝে কোন পার্থক্য করেননি। বরং তিনি ‘আল-আক্বীদাতুল ওয়াসিত্বীয়্যাহ’ নামক গ্রন্থের প্রারম্ভে বলেছেন, আল্লাহর প্রশংসা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালাম পাঠের পর পরবর্তী কথা হল, এটা ক্বিয়ামত পর্যন্ত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ আল-মানছুরাহর আক্বীদাহ।[১২]
দলাদলি বিষয়ক হাদীছ উল্লেখ করার পর তিনি বলেছেন, ‘তারাই হল, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত, আর তারাই হল, আত-ত্বায়িফাতুল মানছুরাহ।[১৩] তিনি আরো বলেন, ‘আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দলের আক্বীদাহ হল, নবী করীম (ﷺ)-এর সুন্নাহ ও ছাহাবীদের আছার ভিত্তিক। অর্থাৎ যারা নবী (ﷺ) ও তাঁর ছাহাবীদের অনুসরণ করে তারাই হল, আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ। তিনি আরো বলেন যে, ‘এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় যে, আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ হওয়ার সবচেয়ে বেশি হক্বদার হল হাদীছ ও সুন্নাহর অনুসারীরা’।[১৪]
শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আত্ব-ত্বায়িফাতুল মানছুরাহই হল আল-ফের্ক্বাতুন নাজিয়াহ। দু’টো একই জিনিস। এর মাঝে কোন পার্থক্য নাই। এরাই হল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত, এরাই হল সালাফী।[১৫]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* মুর্শিদাবাদ, ভারত।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫৪৩, ৪৩৬৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫২৫।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৭৬; তিরমিযী, হা/৩৬০৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৯৮৬।
[৩]. আবূ দাউদ, হা/২৪৮৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৯২০; সনদ ছহীহ; ছহীহুল জামি‘, হা/৭২৯৪; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৯৫৯; ছহীহুল মুসনাদ, ১০২৫।
[৪]. আবূ দাউদ, হা/২৪৮৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৯২০; সনদ ছহীহ; সহীহুল জামি‘, হা/৭২৯৪; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৯৫৯; ছহীহুল মুসনাদ, ১০২৫।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৪০, ৭৩১১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৬, ১৯২১।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩৭।
[৭]. তিরমিযী, হা/২১৯২, ২২২৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯২০; আবূ দাউদ, হা/৪২৯২; ইবনু মাজাহ, হা/১০, ৩৯৫২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৪০৩।
[৮]. তিরমিযী, হা/২১৯২, ২২২৯-এর শেষাংশ।
[৯]. শারহুন নববী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৬৭; ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, ফাতাওয়া নং-২৩৭৮১২।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৬৫০, ৭০৭২; তিরমিযী, হা/২৬২৯; ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৮৮; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১২৭৩।
[১১]. শারহুন নববী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৬৭; ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব ফাতাওয়া নং-০৬।
[১২]. ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমুঊ‘ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২৯।
[১৩]. মাজমুঊ‘ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৫৯।
[১৪]. মাজমু‘ঊল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৭।
[১৫]. তার রেকর্ড ক্যাসেট থেকে। গ্রন্থ : মানহাজ আল-আজবিবাতুল মুফীদাহ, প্রশ্নোত্তর নং-৪১।
প্রসঙ্গসমূহ »:
আক্বীদা বা বিশ্বাস