বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৯ অপরাহ্ন

ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ

-ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন*


 (১৪তম কিস্তি)

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অধিকাংশ জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ করতেন আবূ বাক্র ও ‘উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর সাথে। তাঁরা ছিলেন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রধানমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রীর মত। হুদাইবিয়াহ’র সন্ধির পূর্বে মাক্কাহ’র কাফিরদের সাথে কূটনৈতিক লিয়াজোঁ (Diplomatic liaison) করার জন্য পাঠানো হয়েছিল ‘উছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে। আবার সন্ধিপত্র বা শান্তিচুক্তি (Peace treaty) লিখানো হয়েছিল ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে দিয়ে, যাঁকে খাইবারের যুদ্ধের সময় পতাকাবাহী কমান্ডারও করা হয়েছিল। নু‘আইম বিন মাসউদ আশ্জা’য়ী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) খন্দকের যুদ্ধে (৫ম হি., শাওয়াল মাস) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুমতি নিয়ে মুসলিম বাহিনীর পক্ষে স্থানীয় ও আশপাশের বিরোধী পক্ষ- কাফিরদের একাংশ যেমন গাত্ফান গোত্র এবং কুরাইযাহ্ গোত্রের ইয়াহুদী ও প্রধান শত্রু কুরাইশদের মধ্যে অতি দক্ষতার সাথে এমন অবিস্বরণীয় কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড (Diplomatic dealings) করেছিলেন, যা মুসলিম বাহিনীর জন্য বিজয়ের অন্যতম কারণ হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছিল।[১] এ যুদ্ধেই হুযায়ফাহ্ ইবনুল ইয়ামান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুবই কঠিন ও বিপজ্জনক গোয়েন্দাগিরির (Intelligence) দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যা তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা, দক্ষতা, অসমসাহসিকতা ও অসীম ধৈর্যের সাথে পালন করেছিলেন।[২]

ইবনু ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) শ্রেষ্ঠতম মুহাদ্দিছ, মুফতী ও ‘আমিল বিস্-সুন্নাহ্, আবূ হুরায়রাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হাদীছের সর্বোচ্চ হাফেয ও মুফতী, ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) শ্রেষ্ঠতম মুফাস্সির, মুহাদ্দিছ ও ফকীহ্; কিন্তু তাঁদের কাউকে কখনো যুদ্ধের সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়নি, বরং তা দেয়া হয়েছে খালিদ বিন ওয়ালিদ, আবূ ‘উবায়দাহ ইবনুল র্জারাহ, যায়েদ বিন হারিছাহ্, উসামা বিন যায়িদ, আলী বিন আবূ ত্বালিব, জা’ফর বিন আবূ ত্বালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) প্রমুখকে। আর বিভিন্ন প্রদেশের আমীর বা গভর্নর (Governor) করা হয়েছিল: ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ইয়ামানের (বিচারকের দায়িত্বসহ), আবূ সুফইয়ান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে নাজরানের, মু‘আয বিন জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জানাদের (ইয়ামানে), আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে যাবীদেও এবং ‘আদান ও ছাহিলের আর ‘আমর ইবনুল আল-‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ’ওমান ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকার আর ‘আত্তাব বিন উছাইদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে মাক্কাহ’র।[৩]

ইসলামী জাতীয় কবি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন হাস্সান বিন ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু), অব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) প্রমুখ ছাহাবীগণ। (কবিতা-সাহিত্য-সঙ্গীত বিষয়ে দেখুন: লিখকের গ্রন্থ- ‘ইসলামে সমাজ-জামা‘আত-সংগঠন’-এর বিশেষ অনুচ্ছেদ।)

দিহ্ইয়াহ্ আল-কালবী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে পাঠানো হয়েছিল নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চিঠিসহ দূত (Ambassador) হিসাবে বাহরাইনের শাসকের মাধ্যমে তা রোমান সম্রাট হারক্যুলিস (Hercules) দরবারে পৌঁছানোর জন্য।[৪] আর আব্দুল্লাহ্ বিন হুযাফাহ আস্সাহমীকে (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পারস্য সম্রাট কিসরার (Khosrau) কাছে চিঠি পৌঁছানের জন্য।[৫] হাবাশার বাদশাহ নাজ্জাশীর কাছে পাঠানো হয়েছিল আমর বিন উমাইয়্যাহ আয্যমিরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে, হাতেব বিন আবি বালতা’য়াহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে পাঠানো হয়েছিল মিসরের বাদশাহ মুকাউকিসের দরবারে। ওমানের বাদশাহ’র দরবারে পাঠানো হয়েছিল আমর বিন ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে।[৬] কেননা তাঁরা ওদের ভাষায় যথাসম্ভব দক্ষ ছিলেন আর পররাষ্ট্রনীতি (Foreign policy) এবং কূটনৈতিক (Diplomatic) কথা ও কাজে পটু (Expert) ছিলেন।

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো কোনো ছাহাবীকে অনারবীয় ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন উম্মতের প্রয়োজন মিটানোর জন্য যেমন: দাওয়াতি কাজ, অন্যদের কিতাব বুঝা, তাদের কাছে লেখা (চিঠিপত্র) পাঠানো, তাদের ভাষা অনুবাদ করা এবং তাদের ষড়যন্ত্র বুঝা এবং তা থেকে নিরাপত্তা গ্রহণ করা ইত্যাদি। সে সকল ছাহাবীর মধ্যে যায়েদ বিন ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অন্যতম। তাঁকে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈয়াহুদীদের ভাষা শিখতে বলেছিলেন।[৭] এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীসের ভাষা নিম্নরূপ:

قال زَيدُ بن ثابِت  رَضِىَ اللهُ عَنْهُ :"أمَرَنِي رَسولُ الِله ﷺ فَتَعلَّمْتُ لَه كِتابَ يَهُودَ، وقالَ: "إنِّي واللهِ! ما آمَنُ يَهودَ علَى كِتابِي"،فتَعلَّمْتُه، فلَمْ يَمرَّ بِي إلا نِصفُ شَهرٍ حتَّى  حَذَقْتُه، فكُنتُ أَكتُبُ لَه إذا كَتَبَ، وأقرأُ لَه إذا كُتِبَ إلَيه".  (أبو داود، علم، 3645).

যায়েদ বিন ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে (ইয়াহুদীদের কিতাবের ভাষা শিখতে) নির্দেশ দিলেন। তখন আমি তাঁর জন্য ইয়াহুদীদের কিতাবের ভাষা শিখলাম। আর তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, “আল্লাহ’র কসম, আমি আমার লিখায় ইয়াহুদীদেরকে (তাদের দ্বারা লিখানো বা পড়ানোতে) বিশ্বাস করি না।” যায়েদ বিন ছাবিত (রা.) বলেন, এক মাস অতিবাহিত না হতেই আমি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য সে ভাষা শিখে তাতে পরদর্শি হয়ে গেলাম। অতঃপর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাদের কাছে কিছু লিখতেন তখন আমি তাঁর পক্ষ থেকে লিখতাম আর যখন তাদের কোনো কিছু লিখিতভাবে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসতো তখন আমি সেটি তাঁর কাছে পাঠ করতাম’।[৮]

কাউকে কোনো বিশেষ দায়িত্ব দেয়ার সাথে সাথে সে দায়িত্ব পালনের জন্য যে প্রস্তুতি, পদ্ধতি ও নিয়ম কানুনের প্রয়োজন, তা যদি ইসলামের মূলনীতি বিরোধী না হয় সেটিও বিবেচনায় নেয়ার অবকাশ ইসলাম দিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সিলমোহর গ্রহণ ও ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে।

عن أنَس رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أنَّ نَبِيَّ اللهِ ﷺ أرادَ أنْ يَكتُبَ إلى رَهْطٍ (أو أُناسٍ) مِن الأعاجِمِ، فَقِيلَ له: "إنَّهمْ لا يَقبَلُونَ كِتابًا إلا عَليه خَاتَمٌ، فَاتَّخذَ النبيُّ ﷺ خاتَماً مِن فِضَّةٍ نَقشُه: مُحمَّدُ رَسولُ اللهِ

আনাস বিন মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে, আল্লাহ’র নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু সংখ্যক আজমী (অনারব) লোকদের (রাজা-বাদশাহদের) কাছে পত্র পাঠানোর ইচ্ছা করলেন। তখন তাঁকে বলা হলো: আজমীরা সিলমোহর ছাড়া কোনো চিঠি গ্রহণ করে না। তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রূপার আংটি গ্রহণ করলেন যার মধ্যে লিখিত ছিল: মুহাম্মার্দু রাসূলুল্লাহ ...’।[৯] (উল্লেখ্য, আংটিটিই সিলমোহর হিসাবে ব্যবহৃত হতো।)

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ স্বয়ং সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সার্বিকভাবে আরো পরিস্কার করে আলোচনা করেছেন-

قال شيخُ الإسلام ابن تَيمية:"لو أنّ المُسلمَ في دارِ حَرب أو دارِ كُفرٍ غيرِ حربٍ، لَم يكنْ مأموراً بالمُخالفةِ لهم في الهَديِ الظاهرِ، لِما عليه في ذلك مِن الضَّررِ، بَل قد يُستحبُّ لِلرجلِ أو يَجبُ عليه أنْ يُشارِكَهُم أحياناً في هَديِهم الظاهرِ، إذا كانَ في ذلك مَصلَحةٌ دِينِيَّة: مِن دَعوتِهم إلى الدِّينِ والاطّلاعِ علَى باطنِ أمورِهِم لِإخبارِ المُسلِمينَ بذلك أو دَفعِ ضَررِهم عن المُسلمين، ونَحوِ ذلك مِن المَقاصدِ الصالِحةِ. فأمَّا في دارِ الإسلامِ والهِجرةِ التي أعزَّ اللهُ فيها دِينَه وجَعلَ على الكافرينَ بِها الصغَارَ والجِزيَةَ، ففِيها شُرِعَتْ المُخالَفةُ. وإذا ظهرَ أنَّ المُوافَقةَ والمُخالَفةَ لَهم تَختلِفُ بِاختِلافِ الزمانِ والمَكان، ظهرَتْ حَقيقةُ الأحاديثِ فِي ذلك".

‘যদি কোনো মুসলিম ‘দারুল-র্হাব’ তথা অমুসলিম শাসিত যুদ্ধবিরাজিত দেশে কিংবা যুদ্ধহীন অমুসলিম দেশে অবস্থান করে, তাহলে সে (মুসলিম) সে দেশের অমুসলিম বা অমুসলিম সরকারের প্রকাশ্য রীতির বিরোধিতার জন্য নির্দেশিত নয়; কেননা তাতে তার প্রতি ক্ষতিকর পরিণতি নেমে আসতে পারে। বরঞ্চ এমত পরিস্থিতিতে ঐ ব্যক্তির জন্য মুস্তাহাব এমনকি ওয়াজিব হলো যে, সে কখনো কখনো তাদের কিছু কিছু প্রকাশ্য আচরণবিধি ও প্রচলিত চালচলনে (Norms, Customs, Traditions) অংশগ্রহণ করবে; যদি তাতে দ্বীনি কল্যাণ নিহিত থেকে থাকে যেমন: তাদেরকে দ্বীনে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়া এবং তাদের গোপনীয় দিক অবগত হওয়া এবং মুসলিমদেরকে তা জানিয়ে দেয়া এবং তাদের অনিষ্ট থেকে মুসলিমদেরকে সুরক্ষা দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি কল্যাণকর ও নেক উদ্দেশ্যসমূহ। কিন্তু মুসলিমদের নিজস্ব ভূমিতে বা হিজরতকৃত ভূখণ্ডে যেখানে আল্লাহ দ্বীনকে বিজয়ী করেছেন এবং কাফেরদেরকে বিজীত ও অবনত করেছেন ও জিয্ইয়া কর প্রদানের আওতায় এনেছেন, সেখানে অমুসলিমদের রীতিনীতি ও চালচলনের বিরোধিতা করার বিধান যথাযথভাবে বিদ্যমান ও বলবৎ থাকবে। (আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতিতে) যখন বুঝা গেল যে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে (পারিপার্শ্বিক কিছু বিষয়ে বিশেষ প্রয়োজনে) অমুসলিমদের সাথে সামঞ্জস্য ও বিরোধের বিষয়টি সম্পৃক্ত, তখন এ বিষয়ে বিদ্যমান হাদীছগুলোর হাকীকত তথা মর্মার্থ প্রকাশ পেয়ে যায়।”[১০]

এক্ষেত্রে শাইখুল ইসলামের একান্ত শিষ্য ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাউযিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর উস্তাযের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন এভাবে:

 وسَمعتُ شيخَ الإسلام ابن تَيميةَ يَقول: مَررتُ أنا وبَعضُ أصحابي في زَمنِ التتارِ بِقومٍ مِنهُم يَشرَبونَ الخَمرَ، فأنكَرَ عَليهم مَن كان مَعِي، فأنْكرتُ عليه، وقُلتُ لَه: إنَّما حرَّم اللهُ الخَمرَ؛ لِأّنَّها تَصدُّ عن ذِكرِ اللهِ وعن الصلاةِ، وهَؤلاءِ يَصدُّهُم الخَمرُ عن قتلِ النفوسِ وسَبْي الذرِّيَّةِ وأخذِ الأموالِ، فدَعْهُم". 

‘আমি শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: “আমি এবং আমার কিছু সাথী তাতারীদের আক্রমণের সময় এক জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলাম যেখানে তাদের একটি দল মদ্যপান করছিলো। আমার সঙ্গীদের কেউ একজন তাদেরকে এ কাজে বাধা দিতে প্রবৃত্ত হলো। তখন আমি তাকে বাধা দিলাম এবং বললাম: আল্লাহ মদ হারাম করেছেন এ জন্য যে, এটি আল্লাহ’র স্মরণ ও ছালাত থেকে মানুষকে বিরত রাখে; আর তাতারীদেরকে মদ্যপান বিরত রাখে মানুষ হত্যা করা থেকে এবং মানবপ্রজন্মকে বন্দী করা থেকে এবং মালসম্পদ লুণ্ঠন করা থেকে; সুতরাং তাদেরকে আপাততঃ মদ্যপান রত অবস্থায় থাকতে দাও’।[১১] (কেননা যতক্ষণ তারা মদ্যপান করে বুঁদ হয়ে থাকে ততক্ষণ মানবের জান-মাল-ইয্যত রক্ষা পায়।)

এ বিষয়টি অমুসলিম দেশে অবস্থানরত মুসলিম রাষ্ট্রদূত, দূতাবাস ও তার অন্যান্য কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে যথাযথ ইসলামী জ্ঞান ও তাক্ওয়ার ভিত্তি ঠিক রেখে প্রযোজ্য হবে। এ বিষয়ে মুসলিম রাষ্ট্রের দূতাবাসগুলোর (Embassy) ধর্মীয় বিভাগ (Religius Attache) প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিতে পারে।

উপরিউক্ত দু’চারটি দৃষ্টান্ত এজন্যই উপস্থাপন করা হলো যে, ইসলামী শরী‘আতে শুধু যথাযথ লোককে যথাস্থানে নিয়োগ করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং প্রয়োজনানুপাতে বৈধ পরিবেশ তৈরির সুযোগও দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে সুযোগের বিষয়বস্তু ও সীমারেখা বেশ জটিলবোদ্ধ ও শর্ত সাপেক্ষ। তাই  মুজতাহিদ পর্যায়ের আলেম ছাড়া কারো জন্য এ জাতীয় বিষয়ে হাত দেয়া উচিত নয়। ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাউযিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) এ প্রসঙ্গে বলেন,

قال الإمامُ ابن قيِّم الجَوزيَّة: "هذا فَصلٌ عَظيمُ النَّفعِ جِدّاً، وَقعَ بِسببِ الجَهلِ به غَلطٌ عَظيمٌ على الشريعَةِ أوجبَ مِن الحَرجِ والمَشقَّةِ وتَكليفِ ما لا سَبيلَ إليه

‘এ বিষয়টি অতিবিশাল উপকারী একটি অধ্যায়। এ বিষয়টি প্রসঙ্গে অজ্ঞতার কারণে ইসলামী শরী‘আতের উপর অনেক বড় ভুল আরোপিত হয়েছে যা অনেক সমস্যা, সঙ্কট এবং আপরগতার বিষয়াবলী চাপানো হয়েছে...’।[১২]

মাদীনাহ্’র মসজিদে আযানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে, কেননা তাঁর আওয়ায ছিল সুষ্পষ্ট ও বুলন্দ। আর তাঁর সাথে ইবনু উম্মে মাকতূম ছিলেন সহকারী মুয়ায্যিন। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের অনুপস্থিতিতে সাধারণতঃ ইবনু উম্মে মাকতূমকে দিয়ে যেতেন ছালাতে ইমামতির দায়িত্ব, যেমনটা করেছিলেন বদরের যুদ্ধের সময়; কেননা তিনি ছিলেন অন্ধ, তাই যুদ্ধ ও সফরে ছিলেন অপারগ।[১৩] মাক্কাহ’য় মুয়ায্যিনের দায়িত্ব পালন করতেন আবূ মাহযূরাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)।[১৪]

আনাস বিন মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও ইবনু মাস’উদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নবী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সার্বক্ষণিক খিদমতের দায়িত্ব পালন করতেন। আর ‘ওয়াহি’ লিপিবদ্ধ করা সহ অন্যান্য লেখালেখির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ‘উছমান বিন আফ্ফান, ‘আলী বিন আবী ত্বালিব, যায়িদ বিন ছাবিত, খালিদ বিন সা‘ঈদ, উবাই বিন কা‘য়াব ও মু‘আবিয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) প্রমুখকে। কেননা তাঁরা খুব ভাল লিখতে পারতেন ও কুরআন কারীম সংরক্ষণে তাদের আগ্রহ ও দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। আর নিরাপত্তা প্রহরী (Security guard) হিসাবে  সাধারণতঃ সা‘আদ বিন মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু), মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও যুুবাইর বিন ‘আওয়াম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) দায়িত্ব পালন করতেন।[১৫] খলীফাহ্ ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর যুগে দ্বিপাক্ষিক উচ্চতর কূটনৈতিক ও সামরিক দলিলাদি (Higher bilateral diplomatic and military agre ements) লিখেছেন মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। ফিলিস্তীন বিজয়ের সময় খ্রিস্টানদের সাথে সন্ধিনামা রচনা তার মধ্যে অন্যতম।

মাদীনাহ’য় কোনো সামাজিক সমস্যা ও দ্বন্দ্ব দেখা দিলে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাধারণতঃ সা‘আদ বিন মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও সা‘আদ বিন ‘উবাদাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এ দুই আউছ ও খাযরাজী সর্দারকে তা নিরসনের দায়িত্ব দিতেন। কেননা মাদীনাহবাসীদের কাছে এ দু’প্রসিদ্ধ সর্দারের গ্রহণযোগ্যতা ছিল যথেষ্ট।

রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও অনেক সময় দেখা যায় যে, যার যে কাজের যোগ্যতা দক্ষতা নেই তাকে সেই দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো পূর্বাভিজ্ঞতা নেই অথচ তাকেই সেখানে বড় চেয়ারে বসিয়ে কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে দেশের ক্ষতি করে শুধু মাত্র বেতন-ভাতা বণ্টন ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। আবার দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অনেককে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। আবার হীনম্মন্যতা ও হিংসা-বিদ্বেষকে বিবেচনায় নিয়ে অনেক যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাকে ও এস ডি (OSD) খেতাব দিয়ে কর্মশূন্য করে রাখা হয়েছে। যদিও এর পূরো বিবরণ (ব্যাসবাক্য) হলো ‘অফিসার অফ স্পেশাল ডিউটি’। কথাটি শুনতে তো ‘বেশ’; কিন্তু এর আসল হাকিকত হলো এই যে, তিনি রাজনৈতিক রোষানলে পড়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকে কাজ কেড়ে নিয়ে অসম্মান করা হচ্ছে এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধন করা হচ্ছে।

শিক্ষাক্ষেত্রের মত মানব গড়ার মূলকেন্দ্র ও পবিত্রাঙ্গণও অযোগ্যের সমাসীন ও অপনিয়োগের মাধ্যমে কলুষিত করে ফেলা হচ্ছে। এটি যেন এখন সর্বজনবিদিত সহজস্বীকৃত (Open secret) বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এজাতীয় নিয়োগপ্রাপ্ত গজভুক্তকপিত্থবৎ  মহোদয়গণ নাকি টালবাহানার আশ্রয় নিয়ে শ্রেণিকক্ষে কম-কমই প্রবেশ করে থাকেন। দয়াপরবশ হয়ে কখনো কখনো ছাত্রদের সামনে উপস্থিত হলেও তাঁরা নানা অঙ্গভঙ্গি, অন্যের গীবত-তোহমত, রাজনৈতিক কারিশমা প্রদর্শন, বাহুল্য দৃষ্টি আকর্ষণ, বাহু-বক্ষ ও আস্তিন প্রকম্পন, অশিক্ষকসুলভ আচরণ, গল্পগুজব ও রংঢং করেই ছাত্রদের মূল্যবান সময়টার সর্বনাশ করে আত্মতৃপ্তির সাথে মহাগৌরবে প্রস্থান করেন।

এমনতর এক প-িতমূর্খকে তার এক সুহৃদ একবার কথাচ্ছলে জিজ্ঞাস করেছিলেন, আচ্ছা ভাই! ‘এই বিদ্যাস্থানে শিক্ষাগুরুর মহান পেশায় নিয়োজিত হয়ে মহাস্থানের চিমটা ও গেুরুয়া সর্বস্য কলকিগুরু সেজে ছাত্রদের সোনালী জীবনের অমূল্য সময়গুলো গাঁজার ধোঁয়ার মত হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছেন- আপনার আমানতের খেয়ানত হচ্ছে না?’ তিনি আত্মস্বীকৃত অপরাধীর মত অসহায় ভঙ্গীতে চাতুর্যের সাথে জবাব দিয়েছিলেন- ‘আমার মন-মগজে বিদ্যার কোনো আমানত কখনই গচ্ছিত ছিল না এখনও নেই; সুতরাং তার খেয়ানত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ 

দুর্নীতিনির্ভর অপনিয়োগের অবধারিত ফলাফল স্বরূপ পরবর্তীতে পুরো দেশ একটি নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত কুনাগরিক ও অপজাতির আস্তানায় রূপান্তরিত হবে- এতে সন্দেহের আর কী থাকতে পারে? সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু-মন্ত্রী সাহেবের একটি বক্তব্য এ বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে: তিনি বলেন: “অবাক লাগে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষার মূল দায়িত্বে আছেন, তারা সেখানকার প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের কথায় ওঠেন আর বসেন। এই ব্যক্তিত্বহীনতা শিক্ষকতার মর্যাদাকে ভীষণভাবে ক্ষুণœ করেছে।  প্রভাবশালীদের তদবিরে শিক্ষক নিয়োগ হয়। যোগ্যতা এখানে মূল ব্যাপার নয়। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে যে, মেধা-যোগ্যতাকে পাশ কাটিয়ে নিয়োগ হচ্ছে। সবচেয়ে বড় তদবির যে করে, সেই তদবিরের দিকে তাকিয়ে কর্মকর্তা ভাবেন যে, এনাকে খুশি না রাখলে তো আমার অসুবিধা। এটা মনে করে নিয়োগে অনেকের প্রতি বৈষম্য করা হয়। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।”[১৬] 

সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও এজাতীয় স্বজনপ্রীতিনির্ভর অযোগ্যে ব্যক্তিদের কু-নিয়োগের বদ-নযীর প্রচুর। দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে এ অনুচ্ছেদের কলেবর আর বাড়ানো সঙ্গত মনে হচ্ছে না। আকলমন্দের জন্য ইশারাই কাফি। কোনো ইসলামী জামা‘আত-সংগঠনে যদি এ ধরনের মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তাহলে সে রোগের কুফল থেকে রোগের উদ্ভাবক, বাহক ও ব্যবহারকারী এবং খোদ সংগঠন কোনোটাই নিস্তার পায় না।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

তথ্যসূত্র :
[১]. আস্সীরাহ, ইবনু হিশাম, পৃ. ৬৩০-৬৩১; আররাহীক আল-মাখতূম, পৃ. ৪১৮-৪১৯; আস্সীরাহ, নদভী, পৃ. ২১৩-২১৪।
[২]. আররাহীক আল-মাখতুম, পৃ. ৪২০; আস্সীরাহ, নদভী, পৃ. ২১৪-২১৫।
[৩]. যাদুল মা‘আদ, ইবনু কাইয়্যেম আল-জাউযিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৫-১২৬।
[৪]. ছহীহ বুখারী, বাদউল-ওয়াহী, অধ্যায়: ৬, হা/৭।
[৫]. ছহীহ বুখারী, মাগাযী, হা/৪৪২৪।
[৬]. যাদুর মা‘আদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬৮৯, ৬৯১, ৬৯৩; র্আরাহীক আল-মাখতূম, পৃ. ৪৭১-৪৮০।
[৭]. ইকতিযাউছ্ছিরাত আল-মুস্তাকীম, শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, সম্পাদনা ও টীকা: প্রফেসর ড. নাছের বিন আব্দুল করীম আল-আক্ল, আল-উবাইকান, রিয়াদ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৪হি., (সম্পাদকের পক্ষ থেকে মূল কিতাবের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ), পৃ. ৫৩।
[৮]. আবূ দাঊদ, ইলম, হা/৩৬৪৫; তিরমিযী, ইস্তি’যান, সুরইয়ানী ভাষা শিক্ষা,  হা/২৭১৫, সনদ হাসান ছহীহ।
[৯]. ছহীহ বুখারী, লিবাস, হা/৫৮৭২; তিরমিযী, আশ্শামাইল (শারহ: মাওয়াহিব লাদুন্নিয়্যাহ সহ), নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আংটির বিবরণ হা/৯০, ৯২; জামে‘ তিরমিযী (অংশ বিশেষ) ইস্তিযান, হা/২৭১৮, সনদ হাসান ছহীহ।
[১০]. ইক্তিযাউছ্ছিাত আল-মুস্তাকীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১৮-৪১৯।
[১১]. ই’লামুল মুওয়াক্কি’য়ীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৮।
[১২]. ই’লামুল মুওয়াক্কি’য়ীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫-৬।
[১৩]. হাদীছ পূর্বে  উল্লেখ করা হয়েছে, আরো দেখুন: আস্সীরাহ, ইবনু হিশাম, পৃ. ৪১৯; আরো দেখুন: যাদুল মা‘আদ, ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাউযিয়্যাহ্, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৪।
[১৪]. যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৪।
[১৫]. প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৬, ১১৭, ১২৭।
[১৬] - প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, শনিবার।




সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৯ম কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
যাকাত বণ্টনে সমস্যা ও সমাধান - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
সন্ত্রাসবাদ : ইসলামের দিকে শ্যেনদৃষ্টি - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
শিক্ষাদানে নববী পদ্ধতি ও কৌশল - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ (৩য় কিস্তি) - ড. মেসবাহুল ইসলাম
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী - আব্দুল গাফফার মাদানী
দলাদলির কুপ্রভাব : উত্তরণের উপায় (শেষ কিস্তি) - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
আল্লাহ তা‘আলাকে কি স্বপ্নযোগে দেখা সম্ভব? - হাসিবুর রহমান বুখারী
মসজিদ: ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৮ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন

ফেসবুক পেজ