সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৩:২১ পূর্বাহ্ন

ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায়

-মূল : মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ
-অনুবাদক : আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ *


(৩য় কিস্তি)

ছালাতে তেলাওয়াতকৃত আয়াতসমূহ এবং ছালাতের সংশ্লিষ্ট দু‘আ সমূহ নিয়ে গভীর চিন্তা করা এবং এগুলো পড়ার সাথে সাথে ছালাতের সকল কর্ম সম্পাদন করা।
আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনকে গভীরভাবে চিন্তা ও গবেষণা করার জন্য অবতীর্ণ করেছেন। তিনি বলেন,

کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰہُ اِلَیۡکَ مُبٰرَکٌ لِّیَدَّبَّرُوۡۤا اٰیٰتِہٖ وَ لِیَتَذَکَّرَ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ

‘আমরা আপনার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় গ্রন্থ। যাতে করে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা ছোয়াদ : ২৯)। আর ছালাতে তেলাওয়াতকৃত আয়াতের অর্থ জানা ব্যতীত তা নিয়ে গভীর চিন্তা ও গবেষণা করা সম্ভব নয়। সুতরাং যখন সে আয়াতের অর্থ জানবে, তখন সে আয়াত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে। ফলস্বরূপ তার চক্ষু দিয়ে অশ্রু ঝরবে এবং সে তার দ্বারা প্রভাবিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِّرُوۡا بِاٰیٰتِ رَبِّہِمۡ لَمۡ یَخِرُّوۡا عَلَیۡہَا صُمًّا وَّ عُمۡیَانًا

‘আর যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে অন্ধ ও বধিরদের মত পড়ে থাকে না’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৭৩)। এ আয়াত দ্বারা আল-কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা এবং তা নিয়ে গবেষণা করার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়। ইবনু জারীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

إِنِّيْ لَاَعْجِبُ مِمَّنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَلَمْ يَعْلَمْ تَأْوِيْلَهُ كَيْفَ يَلْتَذُّ بِقِرَاءَتِهِ

‘আমি ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে আশ্চর্য হই, যে ব্যক্তি আল-কুরআন পাঠ করে অথচ তার ব্যাখ্যা জানে না। সে কিভাবে তা পাঠ করে মজা পাবে? অর্থাৎ তার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করবে’।[১] সুতরাং একজন কুরআনের পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কুরআন তেলাওয়াতের সাথে সাথে তার ব্যাখ্যার দিকে মনোযোগ দেয়া, যদিও তা সংক্ষিপ্ত কোন তাফসীর গ্রন্থের দিকে হয়। যেমন ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর তাফসীর থেকে সংক্ষেপিত ‘আল-আশকার’ কর্তৃক রচিত (زُبْدَةُ التَّفْسِيْرِ) ‘যুবদাতুত্ তাফসীর’, আল্লামা ইবনু সা‘আদী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর (تَيْسِيْرُ الْكَرِيْمِ الرَّحْمَنِ فِيْ تَفْسِيْرِ كَلَامَِ الْمَنَّانِ) ‘তাইসীরুল কারীমির রাহমান ফী তাফসীরি কালামীল মান্নান’। আর এটাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে ‘আব্দুল ‘আযীয আস্-সায়রাওয়ান (রাহিমাহুল্লাহ)-এর আল-কুরআনের অপরিচিত শব্দাবলীর ব্যাখ্যা নিয়ে রচিত (اَلْمُعْجَمُ الْجَامِعُ لِغَرِيْبِ مُفْرَدَاتِ الْقُرْآنِ) ‘আল মু‘জামুল জামি‘ঊ লিগারীবি মুফরাদাতিল কুরআন’ পড়া যেতে পারে। কেননা তিনি এ গ্রন্থে আল-কুরআনের অপরিচিত শব্দাবলী সম্পর্কে রচিত চারটি গ্রন্থকে একত্রিত করেছেন। আর আল-কুরআনের আয়াতসমূহ নিয়ে গভীর চিন্তা করার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাহল, আয়াতসমূহ বেশী বেশী তেলাওয়াত করা। কেননা তা গভীরভাবে চিন্তা করা এবং তার অর্থের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। স্বয়ং নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরূপ করতেন। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘একদা রাতে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি আয়াত বারবার তেলাওয়াত করতে থাকেন, এমনকি ফজর হয়ে যায়। আয়াতটি হল,

اِنۡ تُعَذِّبۡہُمۡ فَاِنَّہُمۡ عِبَادُکَ وَ اِنۡ تَغۡفِرۡ لَہُمۡ فَاِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ

‘আপনি যদি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন, তাহলে তারা তো আপনারই বান্দা। আর যদি তাদের ক্ষমা করে দেন, তাহলে নিশ্চয় আপনি মহা পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ১১৮)।[২]

অনুরূপভাবে কুরআনের আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আরও সহায়তা করে তা হল, আয়াত পাঠ করার সাথে সাথে তা কাজে বাস্তবায়ন করা। যেমন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

صَلَّيْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتُ لَيْلَةٍ يَقْرَأُ مُسْتَرْسِلًا إِذَا مَرَّ بِآيَةٍ فِيْهَا تَسْبِيْحٌ سَبَّحَ وَإِذَا مَرَّ بِسُؤَالٍ سَأَلَ وَإِذَا مَرَّ بِتَعَوُّذٍ تَعَوَّذَ

‘এক রাত্রিতে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ছালাত আদায় করছিলাম, তিনি ছালাতে খুব থেমে থেমে তেলাওয়াত করছিলেন। যখন কোন তাসবীহ সংক্রান্ত আয়াত আসত, তখন তিনি তাসবীহ পাঠ করতেন। আবার যখন কোন চাওয়া বা প্রার্থনার আয়াত আসত, তখন তিনি চাইতেন। আবার যখন কোন আশ্রয় সংক্রান্ত আয়াত আসত, তখন তিনি আশ্রয় প্রার্থনা করতেন’।[৩] অপর এক বর্ণনায় আছে,

صَلَّيْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً فَكَانَ إِذَا مَرَّ بِآيَةِ رَحْمَةٍ سَأَلَ وَإِذَا مَرَّ بِآيَةِ عَذَابٍ تَعَوَّذَ وَإِذَا مَرَّ بِآيَةٍ فِيْهَا تَنْزِيْهٌ لِلهِ سَبَّحَ

‘এক রাত্রিতে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ছালাত আদায় করছিলাম, যখন কোন রহমতের আয়াত আসত, তখন তিনি রহমত প্রার্থনা করতেন। আবার যখন আযাবের আয়াত আসত, তখন তিনি আযাব থেকে মুক্তি চাইতেন। আর যখন আল্লাহর পবিত্রতা সংক্রান্ত আয়াত আসত, তখন তিনি তাসবীহ পাঠ করতেন’।[৪]

ক্বাতাদা ইবনু নু‘মান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নামক একজন ছাহাবী রাতের ছালাতে শুধু সূরা ইখলাছ ব্যতীত অন্য কোন সূরা পাঠ করেননি। অর্থাৎ তিনি সূরা ইখলাছই বার বার পাঠ করতে থাকেন।[৫] সাঈদ ইবনু ঊবাইদ আত্ব-তাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি শুনেছি, সাঈদ ইবনু জুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) রামাযান মাসে ইমামতি করতেন। তিনি একটি আয়াত বারবার পাঠ করতেন। আয়াতটি হল,

فَسَوۡفَ یَعۡلَمُوۡنَ- اِذِ الۡاَغۡلٰلُ فِیۡۤ اَعۡنَاقِہِمۡ وَ السَّلٰسِلُ یُسۡحَبُوۡنَ

‘অতএব তারা শীঘ্রই জানতে পারবে। যখন তাদের গলদেশে বেড়ী ও শেকল থাকবে, তাদেরকে ফুটন্ত পানিতে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। অতঃপর তাদেরকে আগুনে পোড়ানো হবে’ (সূরা আল-মুমিন : ৭০-৭২)।

ক্বাসিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি সাঈদ ইবনু জুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ)-কে এক রাত্রিতে ছালাত আদায় করতে দেখি, তিনি একটি আয়াত পঁচিশ বার তেলাওয়াত করেন। আয়াতটি হল,

وَ اتَّقُوۡا یَوۡمًا تُرۡجَعُوۡنَ فِیۡہِ اِلَی اللّٰہِ ثُمَّ تُوَفّٰی کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَ ہُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ

‘আর তোমরা সে দিনের ভয় কর, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে সে যা উপার্জন করেছে, তা পুরোপুরি দেয়া হবে। আর তাদের অত্যাচার করা হবে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৮১)।

ক্বায়স নামক এক ব্যক্তি (যার উপাধি আবু আব্দুল্লাহ) বলেন, এক রাত্রিতে আমি হাসান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট রাত্রি যাপন করি, তিনি ছালাত আদায় করার জন্য দ-ায়মান হন, একটি আয়াত তিনি বারবার পাঠ করতে থাকেন, এমনকি ভোর (সাহরীর সময়) হয়ে যায়। আয়াতটি হল,

وَ اِنۡ تَعُدُّوۡا نِعۡمَۃَ اللّٰہِ لَا تُحۡصُوۡہَا

‘যদি তোমরা আল্লাহ্র নে‘মত সমূহ গণনা করতে থাক, তাহলে তা গণনা করে শেষ করতে পারবে না’ (সূরা আন-নাহল : ১৮)। অতঃপর যখন সকাল হল তখন আমরা তাকে বললাম, হে আবূ সাঈদ! আপনি কেন সারা রাত এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন? তিনি বললেন, ‘অত্র আয়াতে আমি সূক্ষ্ম উপদেশ পাই। আমি যেদিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করি কিংবা যেদিকেই আমার দৃষ্টিকে ফেরাই সেদিকেই কোন না কোন নে‘মত দেখতে পাই। বস্তুত আল্লাহর নে‘মত সমূহ এত অধিক যে, তার সংখ্যা জানাই যায় না’।[৬]

হারূন ইবনু রুবাব আল-উসাইদী (রাহিমাহুল্লাহ) যখন রাত্রিতে তাহাজ্জুদের ছালাত আদায়ের জন্য দাঁড়াতেন, তখন তিনি প্রায়ই নিম্নোক্ত আয়াত বারবার পাঠ করতেন, এমনকি সকাল হয়ে যেত। তিনি সকাল পর্যন্ত কান্নাকাটি করতেন। আয়াতটি হল,

قَالُوۡا یٰا لَیۡتَنَا نُرَدُّ وَ لَا نُکَذِّبَ بِاٰیٰتِ رَبِّنَا وَ نَکُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ

‘তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আবার দুনিয়ায় ফিরে যেতে পারতাম। আমরা সেখানে আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করতাম না এবং আমরা ঈমানদার হয়ে যেতাম’ (সূরা আল-আন‘আম : ২৭)।

এছাড়াও আল-কুরআন মুখস্থ করা এবং বিভিন্ন রুকনে পঠিতব্য যিক্র-আযকার সমূহ মুখস্থ করা। যেগুলো পাঠ করার সময় গভীরভাবে চিন্তা ও গবেষণা করতে সহায়তা করে।

আর এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, গভীরভাবে চিন্তা করা, গবেষণা করা, বারবার তিলাওয়াত করা এবং তা কর্মে বাস্তবায়ন করা; এগুলো একজন মুছল্লির ছালাতে খুশূ‘-খুযূ‘ তথা একাগ্রতা ও বিন¤্রতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ یَخِرُّوۡنَ لِلۡاَذۡقَانِ یَبۡکُوۡنَ وَ یَزِیۡدُہُمۡ خُشُوۡعًا

‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয়কে বৃদ্ধি করে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১০৯)।

নিম্নে একটি প্রভাবময় ঘটনা আলোকপাত করা হচ্ছে, যার দ্বারা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর গভীর চিন্তা এবং ছালাতে খুশূ-খুযূ তথা বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করার বিষয়টি আরও ব্যাপকভাবে স্পষ্ট হয়। ‘আত্বা (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

دَخَلْتُ أَنَا وَعُبَيْدُ بْنُ عُمَيْرٍ عَلَىَ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا فَقَالَ ابْنُ عُمَيْرٍ حَدَّثِيْنَا بِأَعْجَبِ شَيْءٍ رَأَيْتِيْهِ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ فَبَكَتْ وَ قَالَتْ قَامَ لَيْلَةٌ مِنَ اللَّيَالِيْ فَقَالَ يَا عَائِشةُ ذَرِيْنِيْ أَتَعَبَّدُ لِرَبِّيْ قَالَتْ قُلْتُ وَاللهِ إِنِّيْ لَأُحِبُّ قُرْبَكَ وَأُحِبُّ مَا يَسُرُّكَ قَالَتْ فَقَامَ فَتَطَهَّرَ ثُمَّ قَامَ يُصَلِّي فَلَمْ يَزَلْ يَبْكِيْ حَتَّى بَلَّ حِجْرَهُ ثُمَّ بَكَى فَلَمْ يَزَلْ يَبْكِيْ حَتَّى بَلَّ الْأَرْضَ وَجَاءَ بِلَالٌ يُؤْذِنُهُ بِالصَّلَاةِ فَلَمَّا رَآهُ يَبْكِيْ قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم تَبْكِيْ وَقَدْ غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ؟ قَالَ أَفَلَا أكُوْنُ عَبْدًا شَكُوْرًا؟ لَقَدْ نَزَلَتْ عَلَيَّ اللَّيْلَةَ آيَات وَيْلٌ لِمَنْ قَرَأَهَا وَلَمْ يَتَفَكَّرْ فِيْهَا إِنَّ فِيْ خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ… الآية

‘আমি এবং ঊবাইদ ইবনু ঊমায়ের (রাহিমাহুল্লাহ) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকটে প্রবেশ করলাম, ইবনু ঊমায়ের আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে বলল, আপনি আমাদেরকে এমন এক আশ্চর্য বিষয় সম্পর্কে বলুন, যা আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে দেখেছেন, তখন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) কান্না করলেন এবং বললেন, এক রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাগ্রত হলেন এবং বললেন, হে আয়েশা! তুমি আমাকে ছাড়, আমি আমার রবের ইবাদত করব। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি বললাম, আল্লাহর কসম, নিশ্চয় আমি আপনার নৈকট্য এবং আপনাকে যা আনন্দিত করে তা ভালবাসি। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, তারপর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উঠলেন, ওযূ করলেন এবং ছালাতের জন্য দণ্ডায়মান হলেন। অতঃপর ছালাতে কান্না করতে থাকলেন এমনকি চোখের পানিতে তার কোল ভিজে গেল। তারপর আবারও কান্না করতে থাকলেন এমনকি মাটি ভিজে গেল। এমতাবস্থায় বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছালাতের জন্য জাগাতে আসলেন। যখন বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কান্না করতে দেখলেন, তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন, অথচ আপনি কান্না করছেন? তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, অমি কি কৃতজ্ঞতা স্বীকারকারী বান্দা হব না? আজ রাত্রিতে আমার উপর এমন কতক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, যে ব্যক্তি উক্ত আয়াতগুলো তেলাওয়াত করবে অথচ তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবে না তার জন্য ধ্বংস রয়েছে। আয়াতটি হল,

اِنَّ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّہَارِ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی الۡاَلۡبَابِ

‘নিশ্চয় নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টিতে এবং দিন ও রাত্রির পরিবর্তনে জ্ঞানবানদের জন্য স্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৯০)।[৭]

আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করার সাথে সাথে সাড়া দেয়ার একটি উত্তম উদাহরণ হল, সূরা ফাতিহা পাঠ শেষে আমীন বলা। কেননা এতে বিরাট প্রতিদান রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

إِذَا أَمَّنَ الْإِمَامُ فَأَمِّنُوْا فَإِنَّهُ مَنْ وَافَقَ تَأْمِيْنُهُ تَأْمِيْنَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ

‘যখন ইমাম আমীন বলে, তখন তোমরাও আমীন বল। কেননা যার আমীন বলা ফেরেশতাদের আমীন বলার সাথে মিলে যাবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে’।[৮] অনুরূপভাবে ইমামের সাথে (ছালাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে) প্রত্যুত্তর দেয়া। যেমন, ইমাম যখন سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ বলবে, তখন মুক্তাদীরা رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ বলবে। আর এতেও বিরাট প্রতিদান রয়েছে। রিফা‘আ ইবনু রাফে‘ আয্-যুরাক্বী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كُنَّا يَوْمًا نُصَلِّىْ وَرَاءَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرَّكْعَةِ قَالَ سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ قَالَ رَجُلٌ وَرَاءَهُ رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيْهِ فَلَمَّا انْصَرَفَ قَالَ مَنِ الْمُتَكَلِّمُ قَالَ أَنَا قَالَ رَأَيْتُ بِضْعَةً وَثَلَاثِيْنَ مَلَكًا يَبْتَدِرُوْنَهَا أَيُّهُمْ يَكْتُبُهَا أَوَّلُ

‘একদা আমরা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর পেছনে ছালাত আদায় করছিলাম, যখন তিনি রুকূ‘ থেকে মাথা উঠালেন তখন বললেন, سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ ‘আল্লাহ তার কথা শোনেন যে তাঁর প্রশংসা করে’। এ কথা শুনে পেছন থেকে এক ব্যক্তি বলল, رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيْهِ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার জন্যই অধিক প্রশংসা, যা অধিক, উত্তম এবং বরকতময়’। অতঃপর যখন ছালাত শেষ হল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এ কথাটির কথক কে? লোকটি বলল, আমি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি দেখলাম ত্রিশজনের অধিক ফেরেশতা প্রতিযোগিতা করছেন, তারা কে আগে তার ছওয়াব লিখবেন’।[৯]

[ইনশাআল্লাহ চলবে]

* অধ্যয়নরত, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।

তথ্যসূত্র :
[১]. মাহমুদ শাকির, মুকাদ্দামাহ তাফসীর ত্বাবারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০।
[২]. ইবনু খুযায়মাহ, ১ম খণ্ড, হা/২৭১; মুসনাদে আহমাদ, ৫ম খণ্ড, হা/১৪৯; নাছিরুদ্দীন আলবানী, সিফাতু ছালাতিন নাবী (ছা.), পৃ. ১০২।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৭২।
[৪]. তা‘যীমু ক্বাদরিছ ছালাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৭; বর্ণনাটি ক্বিয়ামুল লাইল তথা রাতের নফল ছালাতে দণ্ডায়মান হওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে এসেছে।
[৫]. ছহীহ বুখারী, ফাৎহুল বারী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৫৯; মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খণ্ড, হা/৪৩।
[৬]. কুরতুবী, আত্-তিযকার, পৃ. ১২৫।
[৭]. ইবনু হিব্বান, হা/৬৮, শায়খ আলবানী (রহ.) বলেন, সনদ জাইয়িদ।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪৭।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৯৯, ফাৎহুল বারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৪; মিশকাত, হা/৮৭৭।




প্রসঙ্গসমূহ »: ছালাত
বিদ‘আত পরিচিতি (১২তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলো ও অন্ধকার (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১২তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বরূপ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
যিলহজ্জ মাসের আমল ও তার ফযীলত - মুহাম্মাদ জাহিদুল ইসলাম
বিদ‘আত পরিচিতি (২৭তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১২তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৫ম কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
সুন্নাতের রূপরেখা (শেষ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির

ফেসবুক পেজ