মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১০:২৬ পূর্বাহ্ন

ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন

-মাইনুল ইসলাম মঈন*


(৬ষ্ঠ কিস্তি)

৩). মাগরিবের ছালাত

‘মাগরিব’ শব্দটি মূলত  مِنْ غَرَبَتِ الشَّمْسُঅর্থাৎ ‘সূর্য ডুবে যাওয়া’ থেকে নেয়া হয়েছে। এটা এমন সময়, যখন সূর্য ডুবে গিয়ে আড়াল হয়ে যাওয়া। ‘মাগরিব’ শব্দটি আভিধানিক অর্থে সূর্যাস্তের সময় ও স্থান বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। আর ঐ সময়ে যে ছালাত আদায় করা হয়, তাকে মাগরিবের ছালাত বলা হয়।[১] মাগরিবের ছালাতকে এশাও বলা হয়। কিন্তু তা বলা নিন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

لَا تَغْلِبَنَّكُمُ الْأَعْرَابُ عَلَى اسْمِ صَلَاتِكُمُ المَغْرِبِ قَالَ الْأَعْرَابُ وَتَقُوْلُ هِيَ العِشَاءُ

‘বেদুঈনরা মাগরিবের ছালাতের নামের ব্যাপারে তোমাদের উপর যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। কেননা আরব বেদুঈনগণ মাগরিবকে এশা বলে থাকে’।[২]

মাগরিব ছালাতের প্রথম সময়

মাগরিবের ছালাতের সঠিক সময় হচ্ছে, যখন সূর্য পরিপূর্ণভাবে ডুবে যাবে। এটি উন্মুক্ত স্থানে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। আর জনপদ এলাকায় পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যের কিরণ বিলীন হওয়া, পূর্ব দিক থেকে অন্ধকার আগমন করা ও তারকা উদিত হওয়ার মাধ্যমে বুঝা যায়।[৩]

মাগরিব ছালাতের শেষ সময়

এ প্রসঙ্গে দু’টি অভিমত পাওয়া যায়।

প্রথম অভিমত

মাগরিবের সময় একটাই। তা হচ্ছে সূর্য ডোবার পর এমন পরিমাণ সময়, যাতে একজন ছালাত আদায়কারী পবিত্র হয়ে, লজ্জাস্থান ঢেকে (পোশাক পরিধান করে), আযান দিয়ে ও ইক্বামাত দিয়ে ছালাত আদায় করতে পারে। এটি ইমাম মালিক, আওযাঈ ও ইমাম শাফিঈ’র বক্তব্য।[৪]

দলীল হচ্ছে পূর্বে উল্লেখিত জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর ইমামতি সংক্রান্ত হাদীছ। যেখানে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে মাগরিবের ছালাত একই সময়ে আদায় করেছেন।[৫] এ ছাড়া সুয়াইদ ইবনু গাফলাতা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ওমর ইবনু খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,

صَلُّوْا هَذِهِ الصَّلَاةَ وَالْفِجَاجُ مُسْفِرَةٌ يَعْنِي الْمَغْرِبَ

‘তোমরা এ ছালাত তথা মাগরিবের ছালাত এমন সময় পড়ে নাও যখন (মক্কার) অলি-গলি ফর্সা থাকে’।[৬]

দ্বিতীয় অভিমত

মাগরিবের শেষ সময় হচ্ছে লালিমা ডুবে যাওয়া পর্যন্ত। এটি সুফিয়ান ছাওরী, আহমাদ, ইসহাক, আবূ সাওর, আছহাবে রায় ও ইমাম শাফিঈ’র কতিপয় শিষ্যের অভিমত। ইমাম নববী এটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন ও ইবনু মুনযির এ মতটিকে পসন্দ করেছেন।[৭] আর এটিই সঠিক। এ মর্মে দলীল রয়েছে। যেমন,

১). ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে মারফূ সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, صَلَّيْتُمُ الْمَغْرِبَ فَإِنَّهُ وَقْتٌ إِلَى أَنْ يَسْقُطَ الشَّفَقُ ‘মাগরিবের সময় হচ্ছে লালিমা দূরীভূত হওয়া পর্যন্ত’।[৮]

২). ছালাতের সময়সূচী জিজ্ঞেসকারী ব্যক্তি সম্পর্কে আবূ মূসা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীছ।[৯] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথম দিনে মাগরিবের ছালাত আদায় করলেন যখন সূর্য ডুবে গেল। আর দ্বিতীয় দিনে মাগরিবের ছালাত দেরি  করে শাফাক বা লালিমা বিলীন হওয়ার পূর্বে আদায় করলেন। অনুরূপ বুরাইদার হাদীছেও উল্লেখ করা হয়েছে।[১০]

৩). একদা যায়েদ ইবনু ছাবেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মারওয়ানকে বললেন,

مَا لَكَ تَقْرَأُ فِي المَغْرِبِ بِقِصَارٍ وَقَدْ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ بِطُوْلَى الطُّوْلَيَيْنِ

‘কী ব্যাপার! আপনি মাগরিবের ছালাতে ছোট ছোট সূরা তিলাওয়াত করেন কেন? অথচ আমি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দু’টি দীর্ঘ সূরার মধ্যে অধিকতর দীর্ঘটি পাঠ করতে শুনেছি’।[১১] অর্থাৎ সূরা আল-আ‘রাফ পাঠ করতে শুনেছি।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কিরা‘আত ছিল পূর্ণাঙ্গ রুকূ-সিজদাসহ তারতীলের সাথে, একটা একটা করে স্পষ্টভাবে তিলাওয়াত করা, যাতে বুঝা যায় মাগরিবের ছালাতের সময় লালীমা বিলীন হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ থাকে।

মাগরিবের ছালাত তাড়াতাড়ি আদায় করা মুস্তাহাব

রাফে‘ ইবনু খাদিজ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, كُنَّا نُصَلِّي المَغْرِبَ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَيَنْصَرِفُ أَحَدُنَا وَإِنَّهُ لَيُبْصِرُ مَوَاقِعَ نَبْلِهِ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে মাগরিবের ছালাত আদায় করতাম। অতঃপর ছালাত শেষে ফিরে এসে আমাদের কেউ তীর নিক্ষেপ করে তা পতিত হওয়ার স্থান দেখতে পেত’।[১২] ‘উক্ববা ইবনু আমের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, لَا تَزَالُ أُمَّتِيْ بِخَيْرٍ أَوْعَلَى الْفِطْرَةِ مَا لَمْ يُؤَخِّرُوا الْمَغْرِبَ حَتَّى تَشْتَبِكَ النُّجُوْمُ ‘আমার উম্মাত ততদিন কল্যাণের উপর থাকবে অথবা মূল অবস্থার উপর থাকবে, যতদিন তারা মাগরিবের ছালাত আদায়ে তারকা উজ্জ্বল হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করবে না’।[১৩]

৪). এশার ছালাত

এশা (الْعِشَاء) শব্দটি প্রথম অন্ধকারের নাম, যা সূর্যাস্ত থেকে উটনীর দুধ দহন করার সময় পর্যন্ত। এ সময়ে এ ছালাত আদায় করা হয় বিধায় একে এশার ছালাত বলা হয়। এশার ছালাতকে দ্বিতীয় এশাও বলা হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, أَيُّمَا امْرَأَةٍ أَصَابَتْ بَخُوْرًا فَلَا تَشْهَدْ مَعَنَا الْعِشَاءَ الْآخِرَةَ ‘যে মহিলা সুগন্ধি মাখবে সে যেন আমাদের সাথে দ্বিতীয় এশার ছালাতে অংশগ্রহণ না করে’।[১৪] অনুরূপভাবে এশার ছালাতকে ‘আতামা’ও বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, وَلَوْ يَعْلَمُوْنَ مَا فِي العَتَمَةِ وَالصُّبْحِ لَأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا ‘যদি তারা জানত এশা ও ফজরের ছালাতে কী ফযীলত, তাহলে তারা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও আসত’।[১৫] কিন্তু ‘আতামা’ নামে অভিহিত করা নিন্দনীয়। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন:

لَا تَغْلِبَنَّكُمُ الْأَعْرَابُ عَلَى اسْمِ صَلَاتِكُمْ أَلَا إِنَّهَا الْعِشَاءُ وَهُمْ يُعْتِمُوْنَ بِالْإِبِلِ

‘বেদুইনরা এশার ছালাতের নামের ব্যাপারে তোমাদের উপর যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। কেননা তারা এ সময়ে উটনীর দুধ দহন করে (বিধায় এ ছালাতকে আতাম বা দুধ দহনের ছালাত বলা হয়)’।[১৬]

সুতরাং এশার ছালাতকে আতামার ছালাত বলা উক্ত হাদীছের আলোকে সঠিক নয়। এটি ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) ও শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এর অভিমত। আল্লামা ইবনু মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) একে উত্তম বলেছেন ও ইবনে হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ) এ অভিমতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।[১৭]

এশার ছালাতের প্রথম সময়

এশার ছালাতের প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে যখন শাফাক বা লালিমা দূরীভূত হবে। ‘শাফাক’ দ্বারা উদ্দেশ্য সূর্যাস্তের পরের লাল আভা বা লালিমা। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে এটাই প্রমাণিত যে, তিনি ‘শাফাক’ ডুবে গেলে এশার ছালাত আদায় করেছেন। আর যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সম্পর্কে জ্ঞান রাখে সে ভালভাবে জানে যে, প্রথম রাতের এক তৃতীয়াংশের সময় সাদা আভা বিলীন হয়।[১৮] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর হাদীছ থেকে প্রমাণিত। তিনি বলেন, كَانُوْا يُصَلُّوْنَ فِيْمَا بَيْنَ أَنْ يَغِيْبَ الشَّفَقُ إِلَى ثُلُثِ اللَّيْلِ الْأَوَّلِ ‘তারা ডুবে যাওয়া হতে প্রথম রাতের এক তৃতীয়াংশ সময়ের মাঝামাঝি সময়ে এশার ছালাত আদায় করতেন’।[১৯] সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, ‘শাফাক’ দ্বারা লাল আভা উদ্দেশ্য, সাদা আভা উদ্দেশ্য নয়।

নু‘মান ইবনু বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনা অনুযায়ী (চাঁদের/মাসের) তৃতীয় রাতে চাঁদ ডুবে গেলে এশার সময় হয়।

عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيْرٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أَنَا أَعْلَمُ النَّاسِ بِوَقْتِ هَذِهِ الصَّلَاةِ صَلَاةِ الْعِشَاءِ الْآخِرَةِ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّيْهَا لِسُقُوْطِ الْقَمَرِ لِثَالِثَةٍ

নু‘মান ইবনু বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি এই এশার ছালাতের শেষ ওয়াক্ত সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে বেশি অবগত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উক্ত ছালাত (এ পরিমাণ সময়ের পর) আদায় করতেন, যখন তৃতীয়বার চাঁদ অস্তমিত হয়।[২০] সম্ভবতঃ সূর্য ডোবার পর থেকে ঘড়ি ধরে দেড় ঘণ্টা অতিবাহিত হলে এ সময় আসে।

এশার শেষ সময়

এ প্রসঙ্গে তিনটি অভিমত রয়েছে।

প্রথম অভিমত : এশার ছালাতের শেষ সময় হচ্ছে রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। এটি ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর পরবর্তী নতুন অভিমত।[২১] উক্ত অভিমতটি ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর প্রসিদ্ধ অভিমত।[২২] এ মর্মে তাদের প্রমাণ হচ্ছে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইমামতি করা প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীছ। যাতে বর্ণিত হয়েছে, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দ্বিতীয় দিনে রাতের এক তৃতীয়াংশ সময়ে এশার ছালাত পড়ালেন।[২৩]

দ্বিতীয় অভিমত : বিনা সমস্যা ও আপত্তি ছাড়াই এশার ছালাতের শেষ সময় হচ্ছে ছুবহে ছাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। এটি ‘আত্বা, ত্বাউস, ইকরামা, দাঊদ যাহেরীসহ কতিপয় ছাহাবী। যেমন, ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লামা ইবনু মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) এটিকে উত্তম বলেছেন।[২৪]

উল্লেখ্য, ‘এশার ছালাতের শেষ সময় হল ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত’- এ কথাটি সঠিক নয়। যাকারিয়া বিন গোলাম কাদের (রাহিমাহুল্লাহ) এবং শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উক্ত বর্ণনার কোন ভিত্তি নেই।[২৫] ‘আল-হেদায়া’-এর ভাষ্যকার আল্লামা ইবনুল হুমাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ছালাতের ওয়াক্ত সংক্রান্ত হাদীছের মধ্যে কোথাও এটা পাওয়া যায় না’।[২৬] আল্লামা যায়লাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, গরীব বা ভিত্তিহীন।[২৭] ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ)ও অনুরূপ বলেছেন।[২৮] কিন্তু ইমাম ত্বাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর পক্ষে মত দিয়েছেন, যা কাম্য নয়।[২৯]

তৃতীয় অভিমত : এশার শেষ সময় হচ্ছে অর্ধ রাত্রি পর্যন্ত। এটি ইমাম সুফিয়ান ছাওরী, ইবনু মুবারক, ইসহাক, আবূ সাওর ও আছহাবে রায়-এর অভিমত। ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর পুরাতন অভিমত এটিই।[৩০] এ অভিমতের পক্ষের দলীলগুলো নি¤œরূপ :

১). আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, وَوَقْتُ صَلَاةِ الْعِشَاءِ إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ الْأَوْسَطِ ‘এশার ছালাতের সময় অব্যাহত থাকে অর্ধ রাত্রি পর্যন্ত’।[৩১]

২). আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, صَلاَةَ العِشَاءِ إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এশার ছালাত অর্ধ রাত্রি পর্যন্ত বিলম্ব করলেন’।[৩২]

৩). ওমর ইবনু খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকটে চিঠি লিখে জানালেন যে,

وَأَنْ صَلِّ الْعِشَاءَ مَا بَيْنَكَ وَبَيْنَ ثُلُثِ اللَّيْلِ فَإِنْ أَخَّرْتَ فَإِلَى شَطْرِ اللَّيْلِ وَلاَ تَكُنْ مِنَ الْغَافِلِينَ

‘তোমার জানা সময় (শাফাক) ও রাতের এক তৃতীয়াংশের মাঝামাঝি সময়ে এশার ছালাত আদায় কর। আর যদি দেরি করতে চাও, তাহলে রাতের অর্ধেক পর্যন্ত। আর কখনো ছালাত থেকে উদাসীনের অন্তর্ভুক্ত হবে না’।[৩৩] অতএব অগ্রগণ্য অভিমত এটিই। তবে সমস্যা জনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে।

এশার ছালাত দেরি করে পড়া মুস্তাহাব

এশার ছালাত বিলম্ব করা প্রসঙ্গে একাধিক ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, لَوْلَا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي لَأَمَرْتُهُمْ أَنْ يُؤَخِّرُوا العِشَاءَ إِلَى ثُلُثِ اللَّيْلِ أَوْ نِصْفِهِ ‘আমার উম্মাতের উপর যদি কঠিন না হত, তাহলে আমি এশার ছালাতকে এক তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধ রাত পর্যন্ত বিলম্ব করার আদেশ দিতাম’।[৩৪]

এশার ছালাত বিলম্ব করার রহস্য হচ্ছে, এটা কোলাহল ও ব্যস্ততা হতে নির্জন-নিরালয়ে আল্লাহকে স্মরণ করার উপযুক্ত সময়। এশার ছালাতের পর দুনিয়াবী গুজব থেকে বিরত থাকা যরূরী। কিন্তু দেরি করে ছালাত আদায় করায় কখনো কখনো জামা‘আতে লোকসংখ্যা কম হয়। আবার কখনো জামা‘আত থেকে লোক হারিয়ে যায়। আর এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো এশার ছালাত বিলম্ব করতেন। আবার কখনো তাড়াতাড়ি করতেন। তাই যখন লোকজন সমবেত হয়ে যেত, তখন তিনি তাড়াতাড়ি করতেন। আর যখন লোকজন বিলম্ব করছে, তখন তিনি এশার ছালাত বিলম্বে আদায় করতেন।[৩৫]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

* এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়;  শিক্ষক, মহব্বতপুর দারুল উলূম আলিম মাদরাসা, মোহনপুর, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র : 
[১]. মিছবাহুল মুনীর, কাশফুল কান্না‘, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৩।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৪৪।
[৩]. আল-বাদায়েউ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৩; আল-মুগনী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৮১; নাইলুল আওত্বার, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৬।
[৪]. বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১০ম খণ্ড, পৃ. ১২৬; আলÑমাজমূ‘ঊ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৮; আল-আওসাত্ব, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৫।
[৫]. নাসাঈ, হা/৫১৩, সনদ ছহীহ।
[৬]. মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হা/২০৯২; মুছান্নাফে ইবনু আবী শায়বা, হা/৩৩২১, সনদ হাসান।
[৭]. বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, পৃ, ১২৭; আল-মাজমূ‘ঊ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৮; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, ২য় খণ্ড,পৃ. ৩৩৭।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬১২।
[৯]. নাসাঈ, হা/৫২৩।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬১৩; তিরমিযী, হা/১৫২; নাসাঈ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৮।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৬৪।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৯; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৩৭।
[১৩]. ইবনু মাজাহ, হা/৬৮৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৩২৯; ছহীহ ইবনু  খুযাইমাহ, হা/৩৩৯, সনদ ছহীহ।
[১৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৪৪; আবূ দাউদ, হা/৪১৭৫; নাসাঈ, হা/৫১২৮।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৫,৭২১; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৩৭।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৪৪; আবূ দাউদ, হা/৪৯৮৪; ইবনু মাজাহ, হা/৭০৫।
[১৭]. ছহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪৪।
[১৮]. নায়লুল আওত্বার, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬; বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৭, শারহ তিরমিযী।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৯; ছহীহ মুসলিম, হা/৬১৪।
[২০]. আবূ দাঊদ, হা/৪১৯; তিরমিযী, হা/১৬৫; নাসাঈ, হা/৫২৮; দারিমী, হা/১২১১, সকলেই আবূ রিয়ার সূত্রে; মিশকাত, হা/৬১৩, সনদ ছহীহ।
[২১]. কিন্তু তিনি উত্তম সময়ের নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ মত পেশ করেছেন। তদুপরী তিনি ‘আল-উম্ম’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, যদি এক তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হয় তাহলে তা ছুটে যাওয়া বলে গণ্য করা হবে।
[২২]. আল-আওসাত্ব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৩; আল-উম্ম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৪; বিদায়াতুল মুজাতাহিদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৮; আল-মাজমূ‘ঊ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪২।
[২৩]. নাসাঈ, হা/৫২৬; ইবনু মাজাহ, হা/৬৬৭, সনদ ছহীহ।
[২৪]. আল-আওসাত্ব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৬; বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৮
[২৫]. সিলসিলা যঈফাহ, হা/৬৫৬১, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ১৩৮; তানকীহ, পৃ. ২৬৭।
[২৬] ঐ, ফাৎহুল কাদীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯৬।
[২৭]. নাছবুর রাইয়াহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৪।
[২৮]. আল-দিরায়াহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০৩।
[২৯]. আত-ত্বাহাবী, হা/৮৫৯-এর ব্যাখ্যা দ্র.; তুহফাতুল আহওয়াযী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৩০।
[৩০]. তবে ‘আছহাবে রায়’-এর মতে, এ সময়ের পরেও এশার ছালাত আদায় করা মাকরূহ হিসাবে বৈধ। আর ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকটে এটি উত্তম সময় নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ফজর পর্যন্ত দেরি হলেও তা ছুটে যাওয়া বলে গণ্য হবে না।
[৩১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬১২; নাসাঈ, হা/৫২২
[৩২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭২।
[৩৩]. মুওয়াত্ত্বা ইমাম মালিক, মুছান্নাফে ইবনু আবী শাইবা, হা/৩৩৩৯, সনদ ছহীহ; ইবনু হাযম, ত্বাহাবী ছহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন, তামামুল মিন্নাহ, পৃ. ১৪২।
[৩৪]. তিরমিযী, হা/১৬৮; ইবনু মাজাহ, হা/৬৯১; মুসনাদে আহমাদ ২/২৪৫, সনদ ছহীহ
[৩৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৪৬, জাবের ভ হতে।




প্রসঙ্গসমূহ »: ছালাত বিধি-বিধান
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
বিদ‘আত পরিচিতি (৯ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
এমফিল ও পিএইচডি : গবেষণার প্রকৃতি ও পদ্ধতি - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (১০ম কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
বিদ‘আত পরিচিতি (২০তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (১৬তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
যিলহজ্জ মাসের আমল ও তার ফযীলত - মুহাম্মাদ জাহিদুল ইসলাম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (১৪তম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
তাক্বওয়াই মুক্তির সোপান (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুর রশীদ
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৫ম কিস্তি)  - আব্দুল গাফফার মাদানী
ফাযায়েলে কুরআন (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ