ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা
-মূল : শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল ওয়াহহাব
-ব্যাখ্যা : শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছাইমীন
-অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক্ব বিন আব্দুল ক্বাদির*
(২য় কিস্তি)
মূলনীতি-২
আল্লাহ তা‘আলা দ্বীনের ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করা থেকে নিষেধ করেছেন। অতঃপর উক্ত বিষয়টিকে মহান আল্লাহ এতই স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন যে, সকল শ্রেণীর মানুষ খুব সহজেই তা বুঝতে সক্ষম। আমাদেরকে ঐ সমস্ত জাতির মত হতে নিষেধ করেছেন, যারা আমাদের পূর্বে বহু দলে-উপদলে বিভক্ত হয়েছিল এবং মতপার্থক্য করে ধ্বংস হয়েছিল। এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীছ দ্বারা বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে। পরবর্তীতে বিষয়টি আশ্চর্যজনকভাবে বাস্তবতার পুরো উল্টো হয়ে গেছে। অর্থাৎ দ্বীনের মৌলিক ও শাখা বিষয়ে বিভক্তি হওয়াই যেন প্রকৃত জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক এবং দ্বীনের ব্যাপারে যে ব্যক্তি ঐক্যের কথা বলে, তাকে কাফির, নাস্তিক অথবা পাগল আখ্যা দেয়া হয়।
ব্যাখ্যা
শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ)-এর প্রণীত ছয়টি মূলনীতির মধ্য হতে দ্বিতীয় মূলনীতি হল- ‘দ্বীনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকা ও দলে দলে বিভক্ত না হওয়া’। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি। যে ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ, ছাহাবী ও সালাফে ছালেহীনের আমল বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহর কিতাব থেকে দলীল
দলীল-১ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ حَقَّ تُقٰتِہٖ وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ- وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ۪ وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ کُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِہٖۤ اِخۡوَانًا وَ کُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَکُمۡ مِّنۡہَا کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ لَکُمۡ اٰیٰتِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَہۡتَدُوۡنَ.
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যেমনভাবে ভয় করা উচিত এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না। আর তোমরা একযোগে আল্লাহর রুজ্জু সুদৃঢ়রূপে ধারণ কর ও বিভক্ত হয়ে যেও না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর যে অনুগ্রহ রয়েছে তা তোমরা স্মরণ কর। যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে তখন তিনিই তোমাদের অন্তঃকরণে প্রীতি স্থাপন করেছিলেন। অতঃপর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা হেদায়াতপ্রাপ্ত হও’ (সূরা আলে ইমরান : ১০২-১০৩)।
দলীল-২ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ تَفَرَّقُوۡا وَ اخۡتَلَفُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡبَیِّنٰتُ وَ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পর। আর তাদের জন্যই রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৫)।
দলীল-৩ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا تَنَازَعُوۡا فَتَفۡشَلُوۡا وَ تَذۡہَبَ رِیۡحُکُمۡ ‘তোমরা পরস্পর ঝগড়া কর না, তাহলে তোমরা সাহস হারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে’ (সূরা আল-আনফাল : ৪৬)।
দলীল-৪ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ الَّذِیۡنَ فَرَّقُوۡا دِیۡنَہُمۡ وَ کَانُوۡا شِیَعًا لَّسۡتَ مِنۡہُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ اِنَّمَاۤ اَمۡرُہُمۡ اِلَی اللّٰہِ ثُمَّ یُنَبِّئُہُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَفۡعَلُوۡنَ.
‘নিশ্চয় যারা তাদের দ্বীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং দলে উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন ব্যাপারে আপনার কোন দায়িত্ব নেই। তাদের বিষয়টি নিশ্চয় আল্লাহর নিকট সমর্পিত, পরিশেষে তিনিই তাদেরকে তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত করবেন’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৯)।
দলীল-৫ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
شَرَعَ لَکُمۡ مِّنَ الدِّیۡنِ مَا وَصّٰی بِہٖ نُوۡحًا وَّ الَّذِیۡۤ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡکَ وَ مَا وَصَّیۡنَا بِہٖۤ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسٰۤی اَنۡ اَقِیۡمُوا الدِّیۡنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوۡا فِیۡہِ.
‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন, নূহকে আর যা ওহী করেছিলাম আপনার প্রতি এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি কর না’ (সূরা আশ-শূরা : ১৩)।
উল্লেখিত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা’আলা দ্বীনের বিষয়ে দলাদলি ও বিভক্তি থেকে নিষেধ করেছেন। পাশাপাশি জাতি, সমাজ ও ব্যক্তির উপর তার ভয়াবহ মন্দ পরিণতিরও বর্ণনা দিয়েছেন।
হাদীছ থেকে দলীল
দলীল-১ : আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اَلْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يَخْذُلُهُ وَلَا يَحْقِرُهُ. التَّقْوَى هَا هُنَا وَيُشِيْرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ.
‘এক মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই। সে তার উপর যুলম করবে না, তাকে অপমান করবে না, তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে না। তাঁর অন্তরের দিকে ইঙ্গিত করে তিনবার বললেন, আল্লাহভীতি এই জায়গায়। কেউ মন্দ বলে প্রমাণিত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার অপর মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করে। প্রত্যেক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের রক্ত ঝরানো, তার মানসম্মান ও সম্পদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হারাম’।[১]
দলীল-২ : আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর হিংসা কর না একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ কর না। গোয়েন্দাগিরি কর না, কারো দোষ খুঁজে বেড়িও না, পরস্পরকে ধোঁকা দিও না। বরং তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও’।[২]
দলীল-৩ : আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا تَقَاطَعُوْا وَلَا تَدَابَرُوْا وَلَا تَبَاغَضُوْا وَلَا تَحَاسَدُوْا وَكُوْنُوْا إِخْوَانًا ‘তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না, একে অন্যের বিরুদ্ধাচরণ কর না। পরস্পর বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ কর না, পরস্পর হিংসা কর না, বরং তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ও ভাই ভাই হয়ে যাও’।[৩]
দলীল-৪ : আবূ মূসা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেন, إِنَّ الْمُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا ‘একজন মুমিন আরেকজন মুমিনের জন্য ইমারতস্বরূপ, যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে’।[৪]
দলীল-৫ : আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবূ আইয়ূব আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আমি কি তোমাকে একটি ব্যবসার কথা অবগত করব না? তিনি বললেন, হ্যাঁ বলুন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তিনি বললেন, تَسْعَى فِيْ صُلْحٍ بَيْنَ النَّاسِ إِذَا تَفَاسَدُوْا وَتُقَارِبُ بَيْنَهُمْ إِذَا تَبَاعَدُوْا ‘তুমি মানুষের মাঝে বিবাদ মীমাংসার চেষ্টা করবে, যখন তারা পরস্পর ফাসাদ করবে এবং যখন তারা পরস্পর দূরে চলে যাবে, তখন তাদের মাঝে কাছাকাছি করে দিবে’।[৫]
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুমিনদেরকে পরস্পর ভালবাসা স্থাপন করা, সংগঠিত থাকা, আল্লাহভীতি ও সৎকাজে পরস্পর সহযোগিতা করা এবং ঐ সকল মাধ্যম অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন, যা মুমিনদের মাঝে সম্পর্ককে আরো মযবুত ও বৃদ্ধি করে। পক্ষান্তরে ঐ সকল বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন, যা মুসলিমেদেরকে দলে-উপদলে বিভক্ত করে ও তাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। কারণ বিভক্তি ও পরস্পর ঘৃণা পোষণের মাঝে বড় অকল্যাণ রয়েছে।
অতঃপর বিভক্তির মাঝে মানুষ ও জিন শয়তানের জন্য রয়েছে প্রশান্তি। কেননা মানুষ ও জিন শয়তানরা কোন বিষয়ে মুসলিম জাতির ঐক্যবদ্ধ থাকাকে পসন্দ করে না। তারা তাদের বিভক্তিই কামনা করে। তারা জানে যে, ঐক্যবদ্ধ ও আল্লাহ অভিমুখী হওয়ার মাধ্যমে যে প্রশান্তি অর্জন হয়, তা বিভক্তির মাধ্যমে খ--বিখ- হয়ে যায়। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে মুসলিম জাতিকে সুসংগঠিত হওয়ার ও পরস্পর ভালবাসা তৈরি করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর বিভক্তি ও মতানৈক্য করতে নিষেধ করেছেন, যা ঐক্য ও শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়।
ছাহাবীগণের কর্ম থেকে দলীল
ছাহাবীগণের মাঝেও মতানৈক্য সংঘটিত হয়েছিল। তবে সে কারণে তাদের মধ্যে কোন দলাদলি, বিভক্তি, শত্রুতা বা ঘৃণার সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দশাতেই ছাহাবীগণের মাঝে মতপার্থক্য ঘটেছিল। তন্মধ্যে বলা যায় যে, ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আহযাব যুদ্ধ হতে ফিরার পথে আমাদেরকে বললেন, বনূ কুরাইযাহ এলাকায় পৌঁছার পূর্বে কেউ যেন আছর ছালাত আদায় না করে। কিন্তু অনেকের রাস্তাতেই আছরের সময় হয়ে গেল, তখন তাদের কেউ কেউ বললেন, আমরা সেখানে না পৌঁছে ছালাত আদায় করব না। আবার কেউ কেউ বললেন, আমরা ছালাত আদায় করে নেব, আমাদের নিষেধ করার এ উদ্দেশ্য ছিল না (বরং উদ্দেশ্য ছিল তাড়াতাড়ি যাওয়া)। অতঃপর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এ কথা উল্লেখ করা হলে, তিনি তাঁদের কারোর ব্যাপারে কড়াকড়ি করেননি।[৬] ছাহাবীগণ নিজেরাও হাদীছ বুঝার ক্ষেত্রে মতের ভিন্নতার কারণে দলে-উপদলে বিভক্ত হননি।
সালাফদের আমল থেকে দলীল
ইখতিলাফী মাসয়ালার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতির মধ্যকার একটি মূলনীতি হল- যে সকল বিষয়ে ইজতিহাদ করা জায়েয, সেক্ষেত্রে ইজতিহাদের কারণে মতানৈক্য হলে মুজতাহিদগণ তারা একজন অপরজনের ইখতিলাফী ওযর মেনে নিবেন। তারা কেউ একজন অপরজনের প্রতি বিদ্বেষ, শত্রুতা ও ঘৃণাপোষণ করবেন না। বরং তাদের মাঝে মতানৈক্য সংঘটিত হলেও বিশ্বাস রাখবেন যে, সকলেই মুসলিম হিসাবে ভাই ভাই।
ইজতিহাদী মাসয়ালায় যদি মনে করা হয় যে, ইমামের ওযূ নেই, আর ইমাম মনে করেন যে, তার ওযূ আছে। সেক্ষেত্রে ঐ ইমামের পিছনে অবশ্যই ছালাত আদায় করবে।
যেমন বলা যায় যে, ইমাম উটের গোশত খেয়েছেন এবং তিনি মনে করেন যে, উটের গোশত খাওয়া ওযূ ভঙ্গের কারণ নয়। পক্ষান্তরে মুক্তাদী এটাকে ওযূ ভঙ্গের কারণ মনে করেন। সেক্ষেত্রে সালাফগণের আমল হল, ঐ মুক্তাদী ঐ ইমামের পিছনে ছালাত পড়বেন এবং ছালাত বিশুদ্ধ হয়েছে বলে মনে করবেন, যদিও তিনি এ অবস্থায় একাকী ছালাত পড়লে ছালাত বিশুদ্ধ হয় না মনে করেন। কেননা সালাফগণ জায়েয ইজতিহাদ বিষয়ে ইখতিলাফ হওয়াকে প্রকৃত ইখতিলাফ নয় বলে মনে করেন। কারণ প্রত্যেক মতানৈক্যকারী দলীলের অনুসরণ করেন, আর তাদের প্রতি এটিই আবশ্যক, যার ব্যতিক্রম করা বৈধ নয়।
সালাফগণ মনে করেন যে, তাদের ভাই যখন দলীলের আলোকে কোন আমলের ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতা করেন, তখন তিনি মূলত তাদের সাথে একমত পোষণ করেন। যদিও তিনি তার নিকট উপস্থিত দলীলকে মান্য করার কারণে তাদের বিরোধিতা করেছেন। কেননা দলীল যেখানেই পাওয়া যাক না কেন, সকলেই দলীলকে মান্য করার প্রতি আহ্বান করে থাকেন এবং কুরআন ও সুন্নাহকে ফায়ছালার মানদ- হিসাবে গ্রহণ করার দিকে আহ্বান করেন এবং পথ দেখান।
তবে যেসব বিষয়ে ইজতিহাদ ও ইখতিলাফ করা জায়েয নেই যেমন আক্বীদা তথা বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়। সেক্ষেত্রে ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণের বিশ্বাসের সাথে মিল না হলে তা অবশ্যই প্রকাশ্য ভ্রষ্টতা বলে গণ্য হবে। আক্বীদা বিষয়ে কিছু মতানৈক্য ছাহাবায়ে কেরামের যুগে বিদ্যমান থাকলেও তা বিস্তার লাভ করার সুযোগ পায়নি। বরং এ বিষয়ে মতানৈক্য শুধু সোনালী যুগ তথা তিন যুগের পরেই সংগঠিত হয়েছে এবং বিস্তার লাভ করেছে।
যদিও ছাহাবীদের যুগে কিছু মতানৈক্য লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু এটা জেনে রাখা দরকার যে, আমরা যখন ছাহাবীদের যুগ বলছি, তখন এর দ্বারা এটা প্রমাণ হয় না যে, সে যুগের সকল ছাহাবী এই আমলের উপরে মৃত্যুবরণ করেছেন, বরং অধিকাংশ ছাহাবী এমনটা করেছেন। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যখন কোন যুগের অধিকাংশ ব্যক্তি আলমটি করে, তখনই কেবল সেটাকে যুগ হিসাবে ধরা হয়’। সুতরাং ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণের সোনালী যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর যদি কেউ আক্বীদাহগত কোন বিষয়ে মতপার্থক্য করে, যা কোন ছাহাবী বা তাবেঈ করেননি, তাহলে তা মতানৈক্যকারীর উপর বর্তাবে, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
পক্ষান্তরে ইজতিহাদ জায়েয রয়েছে এবং যে বিষয়ে মতানৈক্য ছাহাবায়ে কেরামের যুগেও বিদ্যমান ছিল, এমন বিষয়ে মতানৈক্য তাদের পরবর্তী যুগেও অবশ্যই থাকতে পারে। কারণ নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘যখন বিচারক বিচার করে, অতঃপর সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে সফল হয়, তখন তার জন্য দ্বিগুণ ছওয়াব রয়েছে। পক্ষান্তরে চেষ্টা করে বিচার কাজে ভুল করলে তার জন্য একটি ছওয়াব।[৭]
অতএব মুসলিম জাতির উপর অবশ্য করণীয় হল- তারা একজাতি হিসাবে থাকবে। তাদের মাঝে কোন প্রকার বিচ্ছিন্নতা ও দলাদলি সংঘটিত হবে না। যাতে ইজতিহাদ জায়েয আছে এমন বিষয়কে কেন্দ্র করে তাদের মাঝে হানাহানি, পরস্পর শত্রুতা ও ঘৃণাভাব তৈরি না হয়। যদিও তারা তাদের বুঝ অনুযায়ী দলীলের আলোকে ইখতিলাফী বিষয়ে মতবিরোধ করেছে। কারণ আল্লাহর অসংখ্য প্রশংসা যে, এটি এমন একটি বিষয় যাতে প্রশস্ততা রয়েছে।
সবেেচয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, অন্তরের সেতুবন্ধন তৈরীর পাশাপাশি কালেমার বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ থাকা। আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, মুসলিমদের শত্রুরা চায় তাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতে এবং পরস্পরের মধ্যে শত্রুতাকে উসকে দিতে। যদিও তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বন্ধু হওয়ার ভাব দেখায়, কিন্তু তারা মোটেও তা নয়।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* মুহাদ্দিছ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; মিশকাত, হা/৪৯৫৯।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৬৬।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৩; তিরমিযী, হা/১৯৩৫।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮১।
[৫]. মুসনাদে বাযযার, হা/৬৬৩৩; সনদ হাসান, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৮১৮।।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৪৬।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩৫২।