সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৮:৪৪ অপরাহ্ন

ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন

-মাইনুল ইসলাম মঈন*


(শেষ কিস্তি)

৫). ফজরের ছালাত

الفجر মূলত الشفق তথা সাদা আভা। الشفق দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে সকালের আলো। রাতের প্রথম সাদা আভার মত রাতের শেষে সাদা আভাও ‘শাফাক’। ফজর দু’ধরণের। ১. ফজরে আওয়াল তথা ছুবহে কাযিব। ২. ফজরে ছানী তথা ছুবহে ছাদিক।[১]

১). ছুবহে কাযিব : লম্বা সাদা রেখা, যা পূর্বাকাশের কিনারা হতে উদিত হয়। আরবগণ এটাকে নেকড়ের লেজ বলে আখ্যায়িত করত। অতএব তা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে ও অন্ধকার দূরীভূত হতে থাকে।

২). ছুবহে ছাদিক : পূর্বে দিগন্তে চওড়া ও বিস্তৃত সাদা আভা। সূর্য উঠা পর্যন্ত তার আলো বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ যে সময় ভোরের আভা পূর্ব আকাশে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তীর্ণ অবস্থায় দেখা যায়। হাদীছে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

لَا يَمْنَعَنَّكُمْ مِنْ سُحُوْرِكُمْ أَذَانُ بِلَالٍ وَلَا الفَجْرُ الْمُسْتَطِيْلُ وَلَكِنِ الفَجْرُ الْمُسْتَطِيْرُ فِي الْأُفُقِ

‘বেলালের আযান ও সরু সাদা রেখা যেন তোমাদেরকে সাহারী খাওয়া হতে বিরত না রাখে। কিন্তু পূর্ব দিগন্তের চওড়া ও বিস্তৃত সাদা আভা দেখা দিলে সাহারী খাওয়া ত্যাগ করবে’।[২]

ফজরের প্রথম সময়

ছুবহে ছাদিক উদিত হওয়া থেকে ফজরের ছালাতের প্রথম সময় আরম্ভ হয়।[৩]

ফজরের শেষ সময়

সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত ফজরের ছালাতের শেষ সময়।[৪]

(ক) ফজরের ছালাত অন্ধকার থাকতে পড়া উত্তম

(১) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كُنَّ نِسَاءُ المُؤْمِنَاتِ يَشْهَدْنَ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَاةَ الفَجْرِ مُتَلَفِّعَاتٍ بِمُرُوْطِهِنَّ ثُمَّ يَنْقَلِبْنَ إِلَى بُيُوْتِهِنَّ حِيْنَ يَقْضِيْنَ الصَّلَاةَ لَا يَعْرِفُهُنَّ أَحَدٌ مِنَ الغَلَسِ

‘আমরা মুমিন মহিলাগণ রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ফজরের ছালাতে চাদরে আবৃত হয়ে উপস্থিত হতাম। অতঃপর ছালাত শেষ করে বাড়ী ফিরে আসতাম। কিন্ত অন্ধকারের কারণে কেউ তাদেরকে (মহিলাদেরকে) চিনতে পারত না’।[৫]

(২) আবূ বুরযাহ আল-আসলামী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

وَكَانَ يُصَلِّي الصُّبْحَ فَيَنْصَرِفُ الرَّجُلُ فَيَنْظُرُ إِلَى وَجْهِ جَلِيْسِهِ الَّذِي يَعْرِفُ فَيَعْرِفُهُ وَكَانَ يَقْرَأُ فِيْهَا بِالسِّتِّيْنَ إِلَى الْمِائَةِ

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের ছালাত আদায় করে ফিরে আসতেন। তখনও আমাদের কেউ (অন্ধকারের কারণে) তার সহচরদেরকে চিনতে পারত না। আর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের ছালাতে ৬০ থেকে ১০০ আয়াত পাঠ করতেন’।[৬]

(৩) আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যায়েদ বিন ছাবেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন,

تَسَحَّرْنَا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ قُمْنَا إِلَى الصَّلَاةِ قُلْتُ كَمْ كَانَ قَدْرُ مَا بَيْنَهُمَا؟ قَالَ خَمْسِيْنَ آيَةً

‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সাহারী খেতাম। অতঃপর ফজরের ছালাত আদায় করতাম। আমি বললাম, সাহারী শেষ ও ছালাত শুরুর মাঝে কতক্ষণ সময় থাকত। তিনি বললেন, স্বাভাবিকভাবে ৫০ আয়াত পাঠ করা যায় এরকম সময়’।[৭]

সাহারী খাওয়া শেষ করা ও ছালাত আরম্ভ করার সময় হচ্ছে, ৫০ আয়াত পাঠ করা যায় এমন সময়। তথা ওযূ করার মত সময়। অতএব এ থেকে উপলদ্ধি করা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের ছালাত আওয়াল ওয়াক্তে (প্রথম সময়ে) পড়তেন।

عَنْ أَبِيْ حَازِمٍ أَنَّهُ سَمِعَ سَهْلَ بْنَ سَعْدٍ يَقُوْلُ كُنْتُ أَتَسَحَّرُ فِيْ أَهْلِيْ ثُمَّ يَكُوْنُ سُرْعَةٌ بِيْ أَنْ أُدْرِكَ صَلَاةَ الفَجْرِ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

আবূ হাযিম (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তিনি সাহল ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন, আমি আমার পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সাহারী খেতাম। খাওয়ার পরে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে ফজরের ছালাত পাওয়ার জন্য আমাকে খুব তাড়াহুড়া করতে হত।[৮]

(৪) আবূ মাসউদ আল-আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

وَصَلَّى الصُّبْحَ مَرَّةً بِغَلَسٍ ثُمَّ صَلَّى مَرَّةً أُخْرَى فَأَسْفَرَ بِهَا ثُمَّ كَانَتْ صَلَاتُهُ بَعْدَ ذَلِكَ التَّغْلِيْسَ حَتَّى مَاتَ وَلَمْ يَعُدْ إِلَى أَنْ يُسْفِرَ

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার অন্ধকার থাকতে ফজরের ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর অন্যদিন ফর্সা করে ফজরের ছালাত আদায় করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অন্ধকার থাকতেই ফজরের ছালাত আদায় করেছেন। আর কোন দিন ফর্সা করে আদায় করেননি’।[৯]

সুধী পাঠক! উক্ত হাদীছগুলো দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, আমাদের দেশে অধিকাংশ মসজিদে যে সময় ফজরের ছালাত আদায় করা হয় তা আদৌ হাদীছ অনুযায়ী আমল করা হয় না। কারণ ফজরের ছালাত এমন অবস্থায় শেষ করা হয় যে, নিকট হতে তো দূরের কথা, অনেক দূর থেকেও একে অন্যকে চিনতে পারে। শুধু তা-ই নয়, লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, রামাযানের দিনগুলোতে যে সময় ফজরের আযান দেয়া হয় তার থেকে রামাযান শুরুর পূর্বদিন ও রামাযান শেষের পরের দিন অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিন থেকে তার অনেক পরে আযান দেয়া হয়। অথচ একদিনে সময়ের ব্যবধান এত হতে পারে না। যদি কেউ নফল ছিয়ামের জন্য রামাযানের সময়ের বাইরে দেয়া আযান পর্যন্ত সাহারী খেতে থাকেন, তাহলে তার ছিয়াম আদৌ হবে কি? কারণ উক্ত আযানের সময় সাহারীর শেষ সময়ও পার হয়ে যায়। দলীলবিহীনভাবে এ রকম আমল না করে উচিত ছিল সর্বদা রামাযানের ন্যায় অন্য সময়ও আযান দেয়া, যেন আযানের পূর্ব পর্যন্ত সাহারী খেলে সাহারীর সময় থাকে। শুধু তাই নয় বরং শুধু রামাযান মাসেই অনেকে আউয়াল ওয়াক্তে ফজরের ছালাত আদায় করে থাকেন।

(খ) এমন অনেক দলীল রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, অন্যান্য ছালাত প্রথম ওয়াক্তে তাড়াতাড়ি পড়া উত্তম। এ দলীলসমূহের ব্যাপকতার কারণে ফজরের ছালাত অন্ধকার থাকতে তাড়াতাড়ি আদায় করা তারই অন্তর্ভুক্ত।

(গ) ফজরের ছালাত তাড়াতাড়ি করে আদায় করা খুলাফায়ে রাশিদীনের আমল ছিল।[১০]

ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) الإسفار শব্দের অর্থ নিয়েছেন, নিশ্চিতভাবে ফজর উদিত হওয়া ও তা স্পষ্ট হওয়া। অতএব الإسفار শব্দটি দু’টি অর্থের সম্ভাবনা রাখলেও আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত হাদীছসমূহের আলোকে তা একটি অর্থের সম্ভাবনা রাখে। তা হল নিশ্চিতভাবে ফজর উদিত হওয়া।[১১]

ইমাম আবূ হানীফা, সুফিয়ান সাওরী ও তাদের ছাত্রবৃন্দ বলেন, ফজরের ছালাত ফর্সা করে আদায় করাই উত্তম।[১২] তাদের দলীল নিম্নরূপ-

(১) রাফে‘ ইবনু খাদিজ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, أَسْفِرُوْا بِالْفَجْرِ فَإِنَّهُ أَعْظَمُ لِلْأَجْرِ ‘তোমরা ফজরের ছালাত ফর্সা আলোতে পড়বে। কেননা ছওয়াব অর্জনে এটি অতি উত্তম।[১৩]

ইবনে হিব্বান উক্ত হাদীছের জবাবে বলেন, أَسْفِرُوْا (তোমরা ফর্সা করো)- শব্দ দ্বারা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উদ্দেশ্য হল, চন্দ্র রাতে ফজর যেন স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। ফর্সা হওয়ার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে ফজর উদিত হয়েছে- এ দৃঢ়তা নিয়ে মানুষ যেন ফজরের ছালাত আদায় করে। কেননা ফজর উদিত হওয়ার দৃঢ়তা নিয়ে ছালাত আদায় করা সন্দেহ সংশয় নিয়ে ছালাত আদায় করার চেয়ে সওয়াব বেশি।[১৪]

‘ফিক্বহুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘এ হাদীছ দ্বারা ফজরের ছালাত শেষ করে ফেরার সময়টাকে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার করতে বলা হয়েছে, শুরু করার সময় নয়। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাতে দীর্ঘ ক্বিরাআত পড়তে আদেশ দিয়েছেন, যাতে ছালাত পড়ে বের হবার সময় ফর্সা হয়ে যায়। এমনটি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও করতেন। তিনি তো ছালাত ষাট থেকে একশ’ আয়াত পর্যন্ত পড়তেন। এ হাদীছের ব্যাখ্যা এ রকমও হতে পারে যে, ছুবহে ছাদেক হয়েছে কিনা, তা ভালাভোবে নিশ্চিত হয়ে নাও। কেবল ধারণার ভিত্তিতে ছালাত পড়োনা’।[১৫]

শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইসফার এবং তাগলীসের মাঝে সমন্বয়ের পদ্ধতি হল, আসল হুকম হল ইসফারে পড়াই উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসফারে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, যেটি রাফে‘ ইবনু খাদিজ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি অন্ধকারেও অনেক ছালাত পড়েছেন। কারণ ছাহাবায়ে কিরাম তাহাজ্জুদ ছালাত পড়তেন, যার কারণে তাদের সহজের জন্য অন্ধকারে ফজরের ছালাত পড়তেন। যেমন হানাফীদের মতে রামাযান মাসে ফজর ছালাত অন্ধকারে পড়া উত্তম। এ কারণে হানাফীগণ বলেন, যদি অন্ধকার থাকতে ছালাত পড়লে লোকসংখ্যা বেশি হয়, তাহলে অন্ধকারে ফজর আদায় উত্তম হবে। সুতরাং মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এই বিশেষ আমলের (তাহাজ্জুদ) কারণে ফজর ছালাত অন্ধকারেই বেশি ছিল। কিন্তু যেখানে এই আমল থাকবে না, সেখানে মূল হুকুমের দিকে ফিরে যেতে হবে। অর্থাৎ ইসফারে পড়াই উত্তম হবে’।[১৬]

(২) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুযদালিফার ছালাত সম্পর্কে ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, وَصَلَّى الْفَجْرَ يَوْمَئِذٍ قَبْلَ مِيْقَاتِهَا ‘সে দিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের ছালাত সময়ের পূর্বে (অন্ধকারে) পড়েছেন’।[১৭]

তারা বলেন, ইবনু মাসঊদের হাদীছ থেকে বুুঝা যায়, অন্ধকারে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ফজরের ছালাত আদায় করাটা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে হয়ে থাকলে, ফজরের নির্ধারিত সময় হচ্ছে ফর্সা হওয়া।

এর জবাব হল, তাদের এ মন্তব্য দলীল হিসাবে সঠিক নয়। কেননা তিনি নির্ধারিত সময়ের পূর্বে অন্ধকারে ফজরের ছালাত আদায় করেছেন। অতএব অন্ধকার থাকা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বুঝায় না। বরং তার পরেও হতে পারে।

‘আল-হেদায়া’ কিতাবের প্রথম আলোচনায় ফজরের সঠিক সময় উল্লেখ করা হয়েছে।[১৮] কিন্তু পরে পৃথক আলোচনায় বলা হয়েছে, وَيسْتَحب الْأَسْفَار بِالْفَجْرِ ‘ফর্সা করে ফজর ছালাত আদায় করা মুস্তাহাব’।[১৯] অথচ উক্ত ব্যাখ্যা চরম বিভ্রান্তিকর এবং ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য বিরাধেী। কারণ ইমাম তিরমিযী (২০৯-২৭৯ হি.) উক্ত হাদীছ বর্ণনা করে বলেন,

وقَالَ الشَّافِعِيُّ وَأَحْمَدُ وَإِسْحَاقُ مَعْنَى الإِسْفَارِ: أَنْ يَضِحَ الفَجْرُ فَلَا يُشَكَّ فِيْهِ وَلَمْ يَرَوْا أَنَّ مَعْنَى الْإِسْفَارِ تَأْخِيْرُ الصَّلَاةِ

‘ইমাম শাফেঈ, আহমাদ ও ইসহাক্ব (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘ইসফার’ হল- ফজর প্রকাশিত হওয়া, যাতে কোন সন্দেহ না থাকে। তারা কেউ বর্ণনা করেননি যে, ‘ইসফার’ অর্থ ছালাত দেরী করে পড়া’।[২০] ইমাম ত্বাহাবী (২৩৯-৩২১ হি.) বলেন,

يَنْبَغِي الدُّخُوْلُ فِي الْفَجْرِ فِيْ وَقْتِ التَّغْلِيْسِ وَالْخُرُوْجُ مِنْهَا فِيْ وَقْتِ الْإِسْفَارِ عَلَى مُوَافَقَةِ مَا رَوَيْنَا عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَصْحَابِهِ. وَهُوَ قَوْلُ أَبِيْ حَنِيْفَةَ وَأَبِيْ يُوْسُفَ وَمُحَمَّدِ بْنِ الْحَسَنِ رَحِمَهُمُ اللهُ تَعَالَى

‘(উক্ত হাদীছের অর্থ হল) অন্ধকারে ফজরের ছালাত শুরু করা এবং ফর্সা হলে শেষ করা, যা আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর ছাহাবীগণ থেকে বর্ণনা করেছি। আর সেটাই আবূ হানীফা, আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রাহিমাহুমুল্লাহ) -এর কথা’। তিনি আরো বলেন,

্রأَسْفِرُوْا بِالْفَجْرِগ্ধ أَيْ أَطِيْلُوا الْقِرَاءَةَ فِيْهَا لَيْسَ ذَلِكَ عَلَى أَنْ يَدْخُلُوْا فِيْهَا فِيْ آخِرِ وَقْتِ الْإِسْفَارِ وَلَكِنْ يَخْرُجُوْا مِنْهَا فِيْ وَقْتِ الْإِسْفَارِ

‘তোমরা ফজরের মাধ্যমে ফর্সা কর’ অর্থাৎ ফজরের ছালাতে ক্বিরাআত লম্বা কর। এর অর্থ এটা নয় যে, তারা যেন ফর্সা হওয়ার সময় ছালাতে প্রবেশ করে। বরং ফর্সা হওয়ার সময় তারা ছালাত থেকে বের হবে।[২১] শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন

المعنى الذى يدل عليه مجموع ألفاظ الحديث إطالة القراءة فى الصلاة حتى يخرج منها فى الإسفار ومهما أسفر فهو أفضل وأعظم للأجر كما هو صريح بعض الألفاظ المتقدمة فليس معنى الإسفار إذن هو الدخول فى الصلاة فى وقت الإسفار كما هو المشهور عن الحنفية

‘হাদীছের শব্দ সমূহ একত্রিত করলে প্রমাণিত হয় যে, এর অর্থ হবে- ফর্সা হওয়া পর্যন্ত ছালাতের ক্বিরাআত লম্বা করা। আর এভাবে ফর্সা করাই সর্বোত্তম এবং নেকীর দিক থেকে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ। যেমনটি পূর্বের শব্দগুলো থেকে প্রমাণিত হয়েছে। অতএব ‘ইসফার’ অর্থ এটা নয় যে, ফর্সা করে ছালাত শুরু করতে হবে, যেমনটি হানাফীদের মাঝে প্রচলিত আছে’।[২২]

অতএব ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করে দেরীতে ফজর ছালাত আদায় করা সুন্নাহ বিরোধী। ইমাম ত্বাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বক্তব্য অনুযায়ী ইমাম আবূ হানীফা, আবূ ইউসুফ এবং মুহাম্মাদ (রাহিমাহুমুল্লাহ) ও সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দলীয় কারণে কুরআন ও হাদীছের অর্থ বিকৃতি করা বড় অপরাধ। তাছাড়া ছহীহ হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজর ছালাতে ৬০-১০০ আয়াত পাঠ করতেন।[২৩] যদি ফর্সা হওয়ার পর ছালাত শুরু করা হয়, আর ৬০ থেকে ১০০ টি আয়াত পাঠ করা হয়, তবে সূর্য উঠতে কতক্ষণ বাকী থাকবে?

উপসংহার

পরিশেষে  বলা যায়, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেখানো নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করলেই তা আল্লাহর নিকটে কবুল হবে। অতএব সকল প্রকার দলীয় গোঁড়ামি ত্যাগ করে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশ মোতাবেক সঠিক সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা একজন সুন্নাহপ্রেমী মুমিনের কাম্য।



* এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়;  শিক্ষক, মহব্বতপুর দারুল উলূম আলিম মাদরাসা, মোহনপুর, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. বাদাআ‘, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২২; মুগনিল মুহতাজ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৪; ছহীহ ফিক্বহুস্ সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪৮।
[২]. তিরমিযী, হা/৭০৬; আবূ দাউদ, হা/২৩৪৬; নাসাঈ, হা/২১৭১; মিশকাত, হা/৬৮১, সনদ ‘ছহীহ’।
[৩]. ছহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪৯।
[৪]. ছহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪৯।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৪৫।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪১; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৪৭।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৯৭।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৭।
[৯]. আবূ দাউদ, হা/৩৯৪, সনদ ‘হাসান’।
[১০]. আল-আওসাত্ব লি ইবনে মুনযির, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৭৪; অনুরূপভাবে এটি আলী ও উসমান হতে বর্ণিত হয়েছে।
[১১]. ছহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খ-, পৃ. ২৫০।
[১২]. তিবইয়ানুল হাকায়েক লিয যাইলি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮২; শারহু মা‘আনিল আছার, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৪; আওসাত্ব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৭৭।
[১৩]. তিরমিযী, হা/১৫৪; আবূ দাঊদ, হা/৪২৪; দারেমী, হা/১২১৭-১২১৮।
[১৪]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৫৯; আল ইহসান।
[১৫]. বঙ্গানুবাদ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০৩।
[১৬]. দরসে তিরমিযী বঙ্গানুবাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১৫।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬৮২; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৮৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪০৪৬; মুসনাদে ইবনে আবী শাইবা, হা/৮২৪০
[১৮]. আল-হেদায়া, পৃ. ১৮০।
[১৯]. আল-হেদায়া, পৃ. ১৮২।
[২০]. তিরমিযী, হা/১৫৪-এর আলোচনা দ্র.।
[২১]. ত্বাহাবী, শারহুল মা‘আনিল আছার, হা/১০০৬, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৩।
[২২]. ইরওয়াউল গালীল, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৬।
[২৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪১; আবু দাউদ, হা/৩৯৮।




প্রসঙ্গসমূহ »: ছালাত আমল আত্মশুদ্ধি
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (২য় কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ইসলামে পর্দার বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
সর্বশ্রেষ্ঠ আমল - হাফেয আবূ তাহের বিন মজিবুর রহমান
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য (২য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
তাক্বওয়াই মুক্তির সোপান (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুর রশীদ
বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
রামাযানে দান-ছাদাক্বাহ - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ফাযায়েলে কুরআন (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বিদ‘আত পরিচিতি (১৯তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ