মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৯:০৬ অপরাহ্ন

ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ

-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন


(৪র্থ কিস্তি)

(চার) হায়াতুন্নবীতে বিশ্বাসী

তাবলীগ জামা‘আতের লোকদের আক্বীদা হল, রাসূল (ﷺ) মারা যাননি; বরং স্থানান্তরিত হয়েছেন মাত্র। তিনি কবর থেকে মানুষের উপকার করতে পারেন। আমাদের মত কবরে জীবিত আছেন। তিনি মানুষের কথা শ্রবণ করেন এবং জবাব দেন। মানুষের প্রয়োজন পূরণ করেন। এমনকি ওলীগণও কবরে জীবিত আছেন। রাসূল (ﷺ) গায়েব জানতেন। উক্ত মর্মে তারা কিছু দলীল পেশ করে থাকে এবং কতিপয় বানোয়াট মিথ্যা কাহিনী বর্ণনা করে থাকে।

(ক) ইবরাহীম বিন শাইবান বলেন, আমি হজ্জের পর যিয়ারতের জন্য মদীনায় উপস্থিত হলাম এবং কবরের নিকট গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি হুজরা শরীফের ভিতর থেকে ‘ওয়া আলাইকাস সালাম’ বলে জবাব দিলেন। আমি তার সালামের জবাব শুনতে পেলাম।[১]

(খ) আহমাদ রেফাঈ ৫৫৫ হিজরী সনে হজ্জ শেষ করে নবী করীম (ﷺ)-এর কবর যিয়ারতের জন্য মদীনায় যান। অতঃপর রওযার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে নিম্নোক্ত দু’টি পংক্তি পাঠ করেন। ‘দূর থেকে আমি আমার রূহকে রাসূল (ﷺ)-এর খেদমতে পাঠিয়ে দিতাম। সে আমার স্থলাভিষিক্ত হয়ে আস্তানায় চুম্বন করত। আজ আমি সশরীরে উপস্থিত হয়েছি। সুতরাং হে রাসূল (ﷺ)! আপনার হাত মুবারক বাড়িয়ে দিন, আমি যেন আমার ঠোঁট দ্বারা চুম্বন করে তৃপ্তি লাভ করতে পারি। উক্ত কবিতা পড়ার সাথে সাথে কবর হতে রাসূল (ﷺ) -এর হাত বের হয়ে আসে। আর রেফাঈ তাতে চুম্বন করে ধন্য হন। বলা হয় যে, সে সময় মসজিদে নববীতে ৯০ হাযার লোকের সমাগম ছিল। সকলেই বিদ্যুতের মত হাত মুবারকের চমক দেখতে পেল। তাদের মধ্যে মাহবূবে সুবহানী আব্দুল ক্বাদের জীলানী (রহঃ)ও ছিলেন।[২]  

পর্যালোচনা-১ : রাসূল (ﷺ) মারা গেছেন। মৃত্যুবরণ করার মাধ্যমে দুনিয়াবী জীবন থেকে বিদায় নিয়েছেন। এ মর্মে বহু কুরআনের আয়াত ও হাদীছ বিদ্যমান।[৩] তবে নিম্নের হাদীছগুলো না বুঝার কারণে অনেকেই উদ্ভট ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। যেমন-

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  اَلْأَنْبِيَاءُ أَحْيَاءٌ فِىْ قُبُوْرِهِمْ يُصَلُّوْنَ 

আসান ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, নবীগণ তাদের কবরে জীবিত থেকে ছালাত আদায় করছেন।[৪] অন্য বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ  قَالَ مَرَرْتُ عَلَى مُوْسَى لَيْلَةَ أُسْرِىَ بِىْ عِنْدَ الْكَثِيْبِ الأَحْمَرِ وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّىْ فِىْ قَبْرِهِ

আনাস ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, মি‘রাজের রাত্রে আমি যখন লাল টিলার নিকট দিয়ে মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে অতিক্রম করছিলাম, তখন তিনি তাঁর কবরে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছিলেন।[৫] অনুরূপ ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কেও বর্ণিত হয়েছে।[৬]

অন্য হাদীছে এসেছে, إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ حَرَّمَ عَلَى الأَرْضِ أَجْسَادَ الأَنْبِيَاءِ ‘নিশ্চয় মহান আল্লাহ যমীনের উপর নবীগণের শরীরকে হারাম করে দিয়েছেন।[৭] অন্যত্র এসেছে, مَا مِنْ أَحَدٍ يُسَلِّمُ عَلَىَّ إِلاَّ رَدَّ اللهُ عَلَىَّ رُوحِىْ حَتَّى أَرُدَّ عَلَيْهِ السَّلاَمَ ‘কোন ব্যক্তি আমার প্রতি সালাম প্রেরণ করলে আমার রূহ ফেরত দেয়া হয় এবং আমি তার প্রতি সালামের উত্তর দেই’।[৮]

প্রথমতঃ বর্ণনাগুলো বারযাখী জীবন সংক্রান্ত। অর্থাৎ দুনিয়াবী জীবন ও পরকালীন জীবনের মাঝের জীবন। যার সাথে দুনিয়াবী জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। উক্ত জীবন সম্পর্কে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, ঠিক সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে। কোন ব্যাখ্যা দেয়া যাবে না। কারণ এগুলো গায়েবের বিষয়। যেমন- রাসূল (ﷺ) মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে কবরে ছালাত আদায় করতে দেখলেন কিন্তু একটু পরে ৬ষ্ঠ আসমানে দেখা হল।[৯] এরপর যখন ফিরে আসলেন তখন সকল নবী-রাসূল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাঁর ইমামতিতে ছালাত আদায় করলেন বায়তুল মাক্বদেছে।[১০] এই অবস্থার ব্যাখ্যা কি মানুষ দিতে পারবে?

দ্বিতীয়তঃ কবরে ছালাত আদায়ের বিষয়টি কেবল নবীদের সাথে খাছ। অন্যদের ব্যাপারে নয়। কারণ মৃত্যুর পর কোন ইবাদত নেই। তাছাড়া কবরস্থানে ছালাত আদায় করা নিষেধ।[১১] তাহলে তারা কিভাবে সেখানে ছালাত আদায় করছেন? অতএব তা দুনিয়াবী বিষয়ের সাথে মিলানো যাবে না।

তৃতীয়তঃ রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি কেউ দরূদ ও সালাম পাঠালে ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁর কাছে পাঠানো হয়। অতঃপর আল্লাহ তাঁর মাঝে রূহ ফেরত দিলে সালামের উত্তর দেন। কবর থেকে রাসূল (ﷺ) নিজে সরাসরি শুনতে পেলে কেন উক্ত মাধ্যমের প্রয়োজন হয়? অতএব দুনিয়ার মানুষের কোন কথা সরাসরি কেউ কবর থেকে শুনতে পায় না এটাই চূড়ান্ত। আল্লাহ চাইলে কাউকে শুনাতে পারেন। এটা তাঁর ইচ্ছাধীন।[১২] কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, তাবলীগ জামায়াতের ফাযায়েলে আমল বইয়ের হজ্জ ও দরূদ অংশে রাসূল (ﷺ)-এর কবর নিয়ে এত মিথ্যা ঘটনা লেখা আছে, তা গুণে শেষ করা যাবে না। অতএব উক্ত বই থেকে সাবধান!

চতুর্থতঃ সাধারণ মানুষকে কবরে রাখার পর লোকেরা যখন চলে আসে, তখনও মৃত ব্যক্তি তাদের পায়ের জুতার শব্দ শুনতে পায়। উক্ত মর্মেও ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[১৩] এছাড়া মুমিন ব্যক্তিকে কবরে বসানোর সাথে সাথে আছরের ছালাত আদায় করতে চায়।[১৪] কিন্তু কুরআন-হাদীছ থেকে এর বেশী কিছু জানা যায় না। তাই যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে।

মূলত উক্ত বিষয়গুলো কোনটিই দুনিয়াবী জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। কারণ ছাহাবায়ে কেরাম উক্ত হাদীছগুলো জানা সত্ত্বেও তাঁরা কখনো রাসূল (ﷺ)-এর কবরের কাছে গিয়ে কিছু চাননি কিংবা তাঁর কাছে কোন অভিযোগ করেননি এবং তাঁকে অসীলা মেনে দু‘আও করেননি। বরং দুর্ভিক্ষের কারণে তাঁরা রাসূল (ﷺ)-এর কবরের কাছে না গিয়ে তাঁর জীবিত চাচা আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে গিয়ে দু‘আ চেয়েছেন। কারণ কবরে যাওয়ার পর দুনিয়ার সাথে যেমন কোন সম্পর্ক থাকে না, তেমনি কারো কোন উপকার বা ক্ষতি করারও সাধ্য থাকে না। যেমন-

عَنْ أَنَسٍ أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ كَانَ إِذَا قَحَطُوْا اسْتَسْقَى بِالْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَ اللهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا فَتَسْقِينَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا قَالَ فَيُسْقَوْنَ

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, মানুষ যখন দুর্ভিক্ষের মাঝে পড়ত, তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্ত্বালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মাধ্যমে পানি প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে পানি প্রার্থনা করতাম আমাদের নবীর মাধ্যমে। আপনি আমাদের পানি দিতেন। এখন আমরা আমাদের নবীর চাচার মাধ্যমে পানি প্রার্থনা করছি। আপনি আমাদেরকে পানি দান করুন। রাবী বলেন, অতঃপর তাদের উপর পানি বর্ষণ করা হত।[১৫] 

উক্ত হাদীছ প্রমাণ করে যে, ছাহাবীগণ কবরের কাছে গিয়ে নবী (ﷺ)-কে অসীলা ধরে দু‘আ করতেন না। অথচ তাঁর কবর তাঁদের নিকটেই ছিল। বরং তাঁরা জীবিত ব্যক্তি হিসাবে রাসূল (ﷺ)-এর চাচার কাছে গিয়ে দু‘আ চাইতেন। লক্ষণীয় হল, যদি মুহাম্মাদ (ﷺ) কবর থেকে তাঁর ছাহাবীদেরকে কোন উপকার করতে না পারেন, তবে পৃথিবীতে আর কোন্ ব্যক্তি আছে, যে কবর থেকে মানুষকে উপকার করতে পারে?

পর্যালোচনা-২ : দুইজন ব্যক্তির নামে যে ঘটনা পেশ করা হয়েছে, তা যে মিথ্যা তা উক্ত আলোচনা থেকেই প্রমাণিত হয়েছে। যেখানে ছাহাবায়ে কেরাম থেকে এ ধরনের কোন ঘটনা প্রমাণিত হয়নি, সেখানে কথিত এই বুযুর্গ কারা? সুধী পাঠক! বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ হায়াতুন্নবীতে বিশ্বাসী। এমনকি তথাকথিত পীর-ফকীর ও ওলীরাও কবরে জীবিত থাকে মর্মে বিশ্বাসী। এই বিশ্বাস ‘শিরকে আকবার’ বা বড় শিরক।

(পাঁচ) আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ﷺ)-কে সৃষ্টি না করলে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করতেন না।[১৬]

উক্ত ভ্রান্ত দাবীর পক্ষে তাবলীগী নিছাবে কতিপয় জাল বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-

(أ) لَوْلاَكَ لَمَا خَلَقْتُ الْأَفْلاَكَ

(ক) (আল্লাহ বলেন) আপনাকে সৃষ্টি না করলে বিশাল জগৎ সৃষ্টি করতাম না।[১৭] বর্ণনাটি প্রসিদ্ধ হলেও এটি জাল ও ভিত্তিহীন। কোন হাদীছগ্রন্থে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।[১৮] আরেকটি বর্ণনা হল,

 (ب) عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لَمَّا اقْتَرَفَ آدَمُ الْخَطِيْئَةَ قَالَ يَا رَبِّ أَسْأَلُكَ بِحَقِّ مُحَمَّدٍ لِمَا غَفَرْتَ لِىْ فَقَالَ اللهُ يَا آدَمُ وَ كَيْفَ عَرَفْتَ مُحَمَّدًا وَلَمْ أَخْلُقْهُ؟ قَالَ يَا رَبِّ لَأَنَّكَ لَمَا خَلَقْتَنِىْ بِيَدِكَ وََنفَخْتَ فِىَّ مِنْ رُوْحِكَ وَرَفَعْتُ رَأْسِىْ فَرَأَيْتُ عَلَى قَوَائِمِ الْعَرْشِ مَكْتُوْبًا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ فَعَلِمْتُ أَنَّكَ لَمْ تَضِفْ إِلَى اسْمِكَ إِلَى أَحَبِّ الْخَلْقِ فَقَالَ اللهُ صَدَقْتَ يَا آدَمُ إِنَّهُ لَأَحَبُّ الْخَلْقِ إِلَىَّ اُدْعُنِىْ بِحَقِّهِ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكَ وَلَوْلاَ مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُكَ

(খ) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যখন আদম (আলাইহিস সালাম) অপরাধ করে ফেললেন, তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর অসীলায় ক্ষমা চাচ্ছি, যেন আপনি আমাকে ক্ষমা করেন। তখন আল্লাহ বললেন, হে আদম! তুমি কিভাবে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে চিনতে পারলে, অথচ আমি তাকে এখনো সৃষ্টি করিনি? আদম (আলাইহিস সালাম) তখন বললেন, হে আল্লাহ! আপনি যখন আমাকে আপনার হাত দ্বারা সৃষ্টি করেন এবং আমার মাঝে আপনার পক্ষ থেকে রূহ ফুঁকে দেন তখন আমি মাথা তুলে দেখি যে, আরশের পায়ের সাথে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ লেখা আছে। তখন আমি উপলব্ধি করলাম যে, সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তির নামই আপনার নামের সাথে যুক্ত করেছেন। তখন আল্লাহ বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ হে আদম! নিশ্চয় মুহাম্মাদই আমার নিকট অধিকতর প্রিয়। তুমি তার অসীলায় আমার কাছে দু‘আ কর আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব। আর মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে সৃষ্টি না করলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।[১৯]

বর্ণনাটি মিথ্যা। এর সনদে আব্দুর রহমান ইবনু যায়েদ এবং আব্দুল্লাহ ইবনু মুসলিম নামে দুইজন মিথ্যুক রাবী আছে। যদিও ইমাম হাকেম বলেছেন, ছহীহ সনদ। কিন্তু তিনি শৈথিল্যবাদীদের একজন। তার সব মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।[২০] দ্বিতীয়তঃ যার অস্তিত্বই নেই তার অসীলায় কিভাবে দু‘আ করা যায়? এটি শিরকী আক্বীদা। উল্লেখ্য, এ ধরনের আরো কিছু জাল বর্ণনা সমাজে প্রচলিত আছে।

পর্যালোচনা : উক্ত মিথ্যা ও উদ্ভট বর্ণনাগুলোই মানুষকে বেশী বিপথে নিয়ে যায়। তাই কথা ও কর্ম গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই যাচাই করতে হবে। তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। এটি কারো সাথে শর্তযুক্ত নয়। তাই প্রকৃত মুসলিম ব্যক্তির দায়িত্ব হল, এগুলোকে ঘৃণা করা এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করা।

(ছয়) রাসূল (ﷺ)-এর পেশাব-পায়খানা পবিত্র।

উক্ত বিশ্বাসের পক্ষে তারা অনেক ঘটনার অবতারণা করেছেন। যেমন- একদা রাসূল (ﷺ) নিজের শরীরের মরা রক্ত বের করে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) -কে বললেন, তুমি এই রক্ত পুঁতে দাও। তিনি গিয়ে ফিরে আসলে রাসূল (ﷺ) বলেন, কোথায় পুঁতে দিলে? ছাহাবী বললেন, আমি খেয়ে ফেলেছি। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, যে ব্যক্তির শরীরে আমার রক্ত প্রবেশ করবে, তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না। আরো বিস্ময়কর হল, উক্ত বক্তব্য লেখার পর নিজের পক্ষ থেকে লেখক যাকারিয়া বলেছেন, ‘মর্যাদার কারণে রাসূল (ﷺ)-এর পেশাব-পায়খানা সবকিছুই পবিত্র’।[২১]

উক্ত ঘটনার পর মালেক ইবনু সিনান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কেও একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। রাসূল (ﷺ) যখন আহত হলেন তখন মাথা থেকে যে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল সেই রক্ত তিনি পান করেছিলেন। তাই রাসূল (ﷺ) বললেন, যার সাথে আমার রক্ত মিশ্রিত হবে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না।[২২] এছাড়া পেশাব পান করার একটি ঘটনা অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ঘটনাটি সঠিক নয়।[২৩] 

পর্যালোচনা : রাসূল (ﷺ)-এর পেশাব-পায়খানাকে পবিত্র মনে করা সীমহীন মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। বিশেষ করে লেখক এগুলো খাওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে ইসলামের মর্যাদা নষ্ট করেছেন। তাছাড়া রক্তপানের ঘটনাটিই ভিত্তিহীন। দ্বিতীয়তঃ পরের ঘটনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, আবুবকর ও আবু উবায়দা (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) রাসূল (ﷺ)-এর মাথা থেকে লোহার কড়া বের করলেন। কিন্তু রক্ত পান করলেন মালেক ইবনু সিনান। অথচ রাসূল (ﷺ) আবুবকর ও আবু উবায়দা (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর কাছে কত প্রিয় ছিলেন, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তারা রক্ত পান করলেন না কেন? 

(সাত) টঙ্গীর ইজতেমায় অংশগ্রহণ করলে হজ্জ বা ওমরার ছওয়াব পাওয়া যায়।

অধিকাংশ সাধারণ মানুষই উক্ত ধারণা পোষণ করে থাকে। তারই নেশায় টঙ্গীর মাঠে সমবেত হয়। তাছাড়া  বহু মানুষ এখন হজ্জের চেয়ে টঙ্গীর মাঠে শামিল হওয়াকে বেশী গুরুত্ব দেয়।

পর্যালোচনা : উক্ত ধারণা করার অর্থই হল, ইসলামের শাশ্বত একটি রুকনকে অস্বীকার করা। তবে একশ্রেণীর মানুষ যখন মক্কায় হজ্জ করা বন্ধ করে দিবে, তখন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। এ মর্মে রাসূল (ﷺ) ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।[২৪] যারা টঙ্গীর ইজতেমাকে ‘বিশ্ব ইজতেমা’ বলছে এবং হজ্জ কিংবা ওমরার সাথে তুলনা করছে, তারা উক্ত হাদীছের আওতায় পড়ে যাচ্ছে।  সুতরাং যারা উক্ত ধোঁকায় পড়ে যাবে তারা যে পথভ্রষ্ট, তাতে কোন সন্দেহ নেই। অতএব সাবধান!

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


[১]. ফাযায়েলে দরূদ, পৃ. ৩৩; উর্দূ, পৃ. ১৯।
[২]. ফাযায়েলে হজ্ব (বাংলা, তাবলীগী কুতুবখানা প্রকাশিত, এপ্রিল-২০০৯), পৃ. ১৪০-১৪১; (উর্দূ) ফাযায়েলে আ‘মাল ২য় খণ্ড, ফাযায়েল হজ্জ অংশ (দেওবন্দ : দারুল কিতাব প্রকাশিত), পৃ. ১৬৬। 
[৩]. সূরা আয-যুমার : ৩০ ও ৩১; আলে ইমরান : ১৪৪; ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৬৮ ও ৪৪৫৪।  
[৪]. মুসনাদে বাযযার, হা/৬৮৮৮; মুসনাদে আবী ইয়ালা, হা/৩৪২৫; বায়হাক্বী, হায়াতুল আম্বিয়া, পৃ. ৩; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৬২১; ফাযায়েলে দুরুদ শরীফ, পৃ. ৩৪; (উর্দূ), পৃ. ১৯।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৩০৬, ‘মর্যাদা’ অধ্যায়, ‘মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৪২।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৪৮, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭৭।
[৭]. আবু দাঊদ, হা/১০৪৭ ও ১৫৩১; মিশকাত, হা/১৩৬১ ও ১৩৬৬।
[৮]. আবু দাঊদ, হা/২০২১; মিশকাত, হা/৯২৫, সনদ হাসান। 
[৯]. ছহীহ বুখারী. হা/৩৮৮৭; মিশকাত, হা/৫৮৬২।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৪৮।  
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৩০; মিশকাত, হা/৭১২।   
[১২]. সূরা আল-ফাত্বির : ২২; সূরা আয-যুমার : ৫২; ইবনু মাজাহ, হা/১৯৮।   
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৩৮; মিশকাত হা/১২৬।
[১৪]. ইবনু মাজাহ, হা/৪২৭২, সনদ হাসান; মিশকাত, হা/১৩৮।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/১০১০, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৭।
[১৬]. ফাযায়েলে যিকির (বাংলা), পৃ. ১৫৩; ফাযায়েলে আমল, পৃ. ৪৫৯।
[১৭]. ছাগানী, মাওযূ‘আত, পৃ. ৭।
[১৮]. শাওকানী, আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ‘আহ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আহ, পৃ. ৩২৬। 
[১৯]. মুস্তাদরাক হাকেম, হা/৪২২৮।
[২০]. সিলসিলা যঈফাহ, হা/২৫।
[২১]. ফাযায়েলে আমল, হেকায়েতে ছাহাবা অংশ (বাংলা, দারুল কিতাব প্রকাশিত), পৃ. ৮৫৮; (উর্দূ), পৃ. ১৭০।  
[২২]. ফাযায়েলে আমল, হেকায়েতে ছাহাবা অংশ, পৃ. ৮৫৯; (উর্দূ), পৃ. ১৭০; ইমাম বুখারী উক্ত ঘটনাকে মুনকার বলেছেন।- সীরাতে ইবনে হিশাম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪১।  
[২৩]. ত্বাবারাণী কাবীর, হা/২০৭৪০; হিলইয়াতুল আওলিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৭; হাকেম, হা/৬৯১২; তালখীছুল হাবীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৭১।
[২৪]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫৯৩।




প্রসঙ্গসমূহ »: শারঈ মূলনীতি
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (৫ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
তাক্বওয়া অর্জনে ছিয়াম - প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
আল্লাহ তা‘আলাকে কি স্বপ্নযোগে দেখা সম্ভব? - হাসিবুর রহমান বুখারী
শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৫ম কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৫ম কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বিদ‘আত পরিচিতি (১০ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ