ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের ধারণা: গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য
-ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ভূমিকা
ইসলাম ধর্মের আলোকে বিশ্বাসীরা মনে করেন আইন হলো স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে যোগসূত্রের সেতুবন্ধন। আর স্রষ্টা কর্তৃক অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব সৃষ্ট কোন বস্তু বা বিষয়ের নিয়ন্ত্রণের নিয়মকেই আইন বলে।[১] ইসলামী আইন হচ্ছে মানব জাতিকে এ পৃথিবীতে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সুবিন্যস্ত বিধান।[২] উত্তরাধিকার আইন হলো একটি ইসলামী আইন। আর সে হিসাবে ‘আইন হলো একজন মুসলিমের সর্বব্যাপারে ধর্ম কিংবা নৈতিকতাবোধ যাহা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার নিকট হতে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণা প্রসূত’।[৩] উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কিত আহরিত জ্ঞান, জ্ঞান সমুদ্রের একটি ধূলিকণার তুল্যও নয়।[৪]
মূলত ইসলামী আইন হলো আল-কুরআন, আল-হাদীছ, ইজমা‘ ও ক্বিয়াছের স্বমন্বয়ে ইজতিহাদ বা গবেষণার মাধ্যমে একজন মুসলিম তার সামগ্রিক কার্য পরিচালনার বিধান হিসাবে ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে গ্রহণ করে থাকে। এটি কেনো নির্দিষ্টি ভূখণ্ডের সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কর্তৃক জারিকৃত বা বিশেষ সংসদ কর্তৃক গৃহীত আইন নয়। এ আইনের মূল বুনিয়াদ হলো ঈমান বা স্বীকৃতি। আর এ স্বীকৃতি আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের প্রতি ঈমানের পাশাপাশি মানবিক সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের উপর তার ক্ষমতার স্বীকৃতি ও দিক নির্দেশনাকে বুঝায়। তিনি মানবজাতির ব্যবহারিক জীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সকল বিধিনিষেধ বা বিধিবিধান তাঁর মনোনীত প্রেরিত মহানবী (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ করেছেন তাই ইসলামী আইন। পক্ষান্তরে মানব জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট হিসাবে মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ তাঁর উত্তরাধিকারীদের মাঝে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের ইসলাম প্রদত্ত নিয়ম-নীতিই হলো ইসলামী উত্তরাধিকার আইন। যা আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে বিভিন্ন সূরা নিসায় উহুদ যুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে বিদায় হজ্বের আগ পর্যন্ত মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আয়াত নাযিলের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। এর মাধ্যমে নারী-পুরুষ সকলের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। বিশেষ করে জাহেলী সমাজের নারীদের করুণ অবস্থার বিপরীতে ইসলাম নারীদের সম্পত্তিতে অধিকার নিশ্চিত করে সমাজের মূল স্রোতে একীভূত করেছেন। ইসলাম নারীকে অর্থ উপার্জন, অর্থ নিজ মালিকানাধীন রাখা, নিজস্ব ও বিভিন্ন প্রয়োজনে অর্থ ব্যয়, মোহর লাভ এবং পিতা-মাতার পরিত্যক্ত সম্পদে অধিকারী হওয়ার অধিকার প্রদান করে ক্ষমতায়িত করেছেন।[৫]
ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ইসলামের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইলমে ফারায়েয বা উত্তরাধিকার আইন। মীরাস বণ্টন সংক্রান্তর এই আইনের বিস্তারিত বিবরণ আল-কুরআনে এসেছে। ইসলামী উত্তরাধিকার আইন সংক্রান্ত জ্ঞানে দক্ষতা অর্জনের জন্য রাসূল (ﷺ) যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেনÑ
‘তোমরা ফারায়েয শেখো এবং মানুষকে শিক্ষা দাও। কেননা আমাকে একদিন বিদায় নিয়ে যেতে হবে। অচিরেই ইলম তুলে নেয়া হবে এবং নানা ফিতনা দেখা দেবে। তখন অবস্থা এ পর্যায়ে পৌঁছবে যে, ফারায়েয নিয়ে দুই ব্যক্তির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেবে, অথচ তারা এমন কাউকে পাবে না, যে তার ফায়সালা করবে’।[৬]
এ হাদীছে মানুষ বস্তুবাদী চিন্তায় ভোগবাদী মানসিকতায় দুনিয়া লাভের মোহে সম্পদ অর্জনের নেশায় পরিত্যক্ত সম্পত্তি ন্যায্যভাবে বণ্টন ব্যবস্থাপনা থেকে দূরে সরে যাওয়ার ঘোষণা এসেছে। বিভিন্ন স্বার্থের কারণে মতভেদ ও মতবিরোধ দেখা দেয়ার পাশাপাশি এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রাখেন এমন লোক খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে। রাসূল (ﷺ) এই বিষয়ে জ্ঞানলাভের প্রতি মনোযোগী হতে বলেছেন। উত্তরাধিকার আইন মৃত ব্যক্তি ও জীবিত ব্যক্তি উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এ বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে আবূ হুরায়রা! উত্তরাধিকার আইন তোমরা নিজেরা শিখো এবং অন্যকেও শিখাও, কেননা তা জ্ঞানের অর্ধেক’।[৭] তিনি আরো বলেছেন, ‘তিন ধরণের জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। এ ছাড়া বাকী জ্ঞান অতিরিক্ত। সে তিন ধরণের জ্ঞান হলো, আল-কুরআন, সুন্নাহ, ফারায়েয’।[৮] ন্যায়নীতির ভিত্তিতে সম্পদ বণ্টিত না হওয়ার দরুন সমাজের মধ্যে অসাম্যের সৃষ্টি হয়। আত্মীয়তার সম্পর্কের চরম বিরোধ ও অবনতি- এক কথায় সামাজিক নৈরাজ্য, অস্থিরতা ও পারস্পরিক কলহ-বিবাদ চরমে উঠে। অথচ ছিলাতুর রিহিম বা আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখা, উন্নত করা এবং কোনো ভাবেই এ সম্পর্কের যেন অবনতি না হয়Ñ এ ব্যাপারে আল-কুরআন ও আল-হাদীছে বহু নির্দেশনা এসেছে। যাদের অবহেলা বা অন্যায় আচরণের কারণে আত্মীয়তার সম্পর্ক খারাপ হবে তাদের ব্যাপারে কঠোর বক্তব্য এসেছে হাদীসে; এমনকি তাদের জান্নাতে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে।[৯] তাই নারী-পুরুষের অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখার সাথে এ শাস্ত্রের জ্ঞান লাভ ও এর বিধানের বাস্তবায়নের সম্পর্ক অত্যন্ত সুনিবিড়। আর এ কারণেই মীরাসী জ্ঞানকে তিনি প্রকৃত তিন ধরনের জ্ঞানের একটি শাখা হিসাবে ঘোষণা করেন।[১০]
উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন, ‘তোমরা যেমনিভাবে আল-কুরআন শিখো, তেমনিভাবে ফারায়েয শিখো; কারণ এটা তোমাদের দ্বীনের অংশ। তিনি আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে চিঠির মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘তোমরা যখন আলাপ-আলোচনা করবে, তখন ফারায়েয সম্পর্কে আলোচনা করবে’।[১১] উত্তরাধিকার সম্পত্তি সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের জন্য তিনি বলেনÑ ‘তোমরা ধারণা প্রসূত কথাবার্তা আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই ফারায়েয সংক্রান্ত মাসায়েল শিখে নাও’।[১২] ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) এ হাদীছ দ্বারা এ কথা বুঝিয়েছেন যে, ‘ফারায়েয ইসলামী আইনের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’।[১৩] এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের কোন বিকল্প নেই। উত্তরাধিকারীদের মাঝে সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে ধারণা নির্ভর হয়ে কোন কথাই বলা যাবে না। পক্ষপাতমুলকভাবে মৃতের অসহায় কন্যাদের ঠকিয়ে আসাবার নামে মৃতের ভাই বোনকে সম্পদ প্রদান করা ইসলামী বিধানের বিপরীত ধারা তৈরি করা। হাদীছে সন্তানদের সম্পদশালী করে রেখে যেতে নির্দেশনা এসেছে। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘নিজের উত্তরাধিকারীকে সম্পদশালী অবস্থায় রেখে যাওয়া ভালো এমন অবস্থার চেয়ে যে, তুমি তাদেরকে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে যাও এবং তারা লোকের কাছে হাত পাততে থাকে’।[১৪]
ইসলামী জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে, ইসলামী শরী‘আতের বণ্টন নীতি না জানার কারণে অথবা অন্যায়ভাবে পিতা-মাতার পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টন করলে পরকালে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এই আইন নৈতিক অবক্ষয় ও দেউলিয়াপনা থেকে সমাজ ও মানুষকে রক্ষা করে মানবীয় মূল্যবোধের উৎকর্ষ সাধনে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের একটি আইন কাঠামো দান করেছেন, কেবল তারই অনুসরণ করতে হবে এবং মানব রচিত আইনের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। ইসলামী আইনের মৌলিক কাঠামো ঠিক রেখে মানুষ নিজের প্রয়োজনে রাষ্ট্র ও সমাজের সামগ্রিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার সুবিধার্থে নতুন আইন বা বিধি প্রণয়ন করতে পারবে। তবে তা হতে হবে ইসলামী চেতনাকে ঠিক রেখে। এ প্রসঙ্গে আল‘কুরআনের বক্তব্য হলো, ‘কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে কখনও তা গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (সূরা আলে ইমরান: ৮৫)। এ আয়াতের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, কোন মুমিন ব্যক্তির জন্য ইসলামী আইনের একটি অংশ হিসাবে ইসলামী উত্তরাধিকার আইন ব্যতীত মানব রচিত আইন কোন অবস্থাতেই গ্রহণ করার সুযোগ নেই। যদি সে আল্লাহর বিধান মত ফয়সালা না করে তবে সে কাফির বা অবিশ্বাসী, যালিম বা অত্যাচারী ও ফাসিক বা পাপিষ্ঠ অভিধায় আল-কুরআনের ভাষ্যমতে আখ্যায়িত হবে।[১৫] তাই আল্লাহ তা‘আলা সুষ্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট যা নাযিল করা হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাঁকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা অতি অল্পই উপদেশ গ্রহণ করো’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩)। ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের পূর্ণ অনুসরণের উপরই আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল থাকা, সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হওয়া ও সৌহার্দপূর্ণ পারিবারিক সুদৃঢ় বন্ধন অটুট থাকা নির্ভর করে। গাজী শামসুর রহমান বলেন, ‘ইসলামী ওয়ারিসী আইন মানুষের স্বাভাবিক স্নেহ মমতার ভিত্তির নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা অধিক সেখানে প্রাপ্য অংশও আনুপাতিকভাবে অধিক। এর চাইতে সুন্দর, নৈতিক ও বিবেক সম্মত ওয়ারিসী আইন সম্পত্তির বিলি-বন্দোবস্ত ব্যাপারে অকল্পনীয়’।[১৬] বাংলাদেশের সমাজ জীবনে পারিবারিক সুসম্পর্কের শোচনীয় অবস্থার জন্য ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের প্রতি অবহেলা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী।
ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের বৈশিষ্ট্য
আল-কুরআনের আলোকে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের কতিপয় মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিম্মরূপধ:
১- ইসলামী আইন মহান আল্লাহ কর্তৃক মানুষের প্রতি সংবিধান, যা মানুষের পার্থিব ও অপার্থিব জগতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। ইসলামী শরী‘আর নির্দেশিত বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলিমের সম্পদ বণ্টিত হতে বাধ্য। ‘এই সকল বিধানে সে সকল ব্যক্তিদের উপর যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া হয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়, যারা স্বভাবতই স্নেহ ও মমতার জন্য প্রথম সারিতে এসে পড়েন এবং এর চেয়ে অধিক সুন্দর ও ন্যায়সঙ্গত কোন আইন সম্বলিত উত্তরাধিকার ব্যবস্থার চিন্তা করা খুবই কঠিন’।[১৭]
২- যোগ্যতা, বয়স, লিঙ্গ নির্বিশেষে মৃতের সব ওয়ারিছগণই নৈকট্যের ভিত্তিতে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির কম বেশি অংশ পায়। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন যে সম্পত্তি রেখে যায় আমি তার প্রত্যেকটির হকদার নির্দিষ্ট করে দিয়েছি’ (সূরা আন-নিসা: ৩৩)।
৩- কেউ তার সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের অধিক উইল (ওয়াছিয়াত) করতে পারবে না; উইল দাতব্য উদ্দেশ্যে হতে হবে; অথবা ব্যক্তিবর্গের জন্য হবে; যারা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির অংশীদার নয়। কেবল তাদের জন্য ওয়াছিয়াত করতে হবে। এ বিষয়ে আল- কুরআনের নির্দেশ হলো: ‘তোমাদের কারো যখন মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়, সে যদি ধন-সম্পদ ত্যাগ করে যায়, তবে তার জন্য ওয়াছিয়াত করা বাধ্যতামূলক করা হলো, পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য, বিধিসম্মতভাবে। আল্লাহভীরুদের জন্য এ নির্দেশ অবশ্যম্ভাবী। যদি কেউ ওয়াছিয়াত শোনার পর তাতে কোন রকম পরিবর্তন সাধন করে, তবে যারা পরিবর্তন করে তাদের উপর এর পাপ পতিত হবে। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সবকিছু শোনেন, জানেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮০-১৮১)। আলোচ্য আয়াতে এ ওয়াছিয়াতকে বাধ্যতামূলক হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ওয়াছিয়াত হবে মোট সম্পত্তির সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ। যেমন রাসূল (ﷺ)-এর কাছে হযরত সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রোগাক্রান্ত অবস্থায় জানতে চাইলে রাসূল (ﷺ) বললেন,
‘আমার অনেক সম্পদ এবং একটি মাত্র কন্যা সন্তান আছে। আমি কি আমার যাবতীয় সম্পদ দাতব্য উদ্দেশ্যে ওয়াছিয়াত করতে পারি? তিনি বললেন, না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, দুই তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন, না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তবে এক তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে এক তৃতীয়াংশও অনেক। তোমার সন্তান দরিদ্র অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে সম্পদশালী রেখে যাওয়া অধিক উত্তম, যাতে তারা অপরের নিকট হাত পাততে বাধ্য না হয়।[১৮] এ ওয়াছয়ত পুরুষের জন্য যেমন করা যায় তদ্রƒপ করা যায় নারীর ক্ষেত্রেও।
৪- মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতার জন্য একটি নির্দিষ্ট অংশের নিশ্চয়তা রয়েছে। নারীদের মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে অধিকার প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনবিদ বিচারপতি সৈয়দ আমীর আলী বলেন, ‘ইসলাম প্রাক ইসলামী আচার-ব্যবহারের আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে। যারা পুরাতন প্রথানুযায়ী উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল, ইসলামী আইন তাদের উক্ত অধিকার প্রদান করেছে। ইসলাম স্ত্রী জাতির নৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সাধন এবং মাতা, বিধবা ও ভগ্নী হিসাবে তাদের অধিকার প্রদান করে’।[১৯]
৫- মৃতের সম্পত্তিতে তার ভাই-বোনেরও অংশের নিশ্চয়তা রয়েছে। মৃত ব্যক্তি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তখন মৃতের ভাই-বোন সম্পত্তি প্রাপ্ত হন। আল-কুরআনের সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াতে কালালা বা নিঃসন্তান ব্যক্তির সম্পদ বণ্টন সংক্রান্ত আলোচনা এসেছে।
৬- স্ত্রীর জন্যে একটি অংশ সংরক্ষিত থাকে।
৭- মৃতের পিতা-মাতা ও স্ত্রী পরিজনের সাথে সাথে মীরাসী সম্পত্তির অবশিষ্ট অংশ মৃত ব্যক্তির সন্তান-সন্ততিগণ পায়।
৮- পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোন না থাকাবস্থায় দূরবর্তী আত্মীয়গণ ওয়ারিছ হয়।
৯- ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের বদৌলতে নাবালক, ইয়াতীম, দুঃস্থ, অন্ধ, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী প্রভৃতি যে কোন ধরনের মানুষই উত্তরাধিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে তাৎক্ষণিক অসহায়ের সহায় সৃষ্টি হয়।
১০- যদি কোন ব্যক্তি মারা যায় এবং নিকটবর্তী ও দূরবর্তী কোন উত্তরাধিকারী না থাকে, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র হবে তার সম্পদের উত্তরাধিকারী।
১১- সম্পদ বণ্টনের সময় ফকীর মিসকীন ও সাহায্যপ্রার্থীদের সাধ্যমতো সেবামূলক দান খয়রাত করার বিধান মীরাসী আইনে রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘সম্পদ বণ্টনকালে আত্মীয়, ইয়াতীম এবং অভাবগ্রস্থ লোক উপস্থিত থাকলে তাদেরকে ইহা হতে কিছু দিবে এবং তাদের সাথে সদালাপ করবে’ (সূরা আন-নিস : ৮)। ইসলামে সম্পদের পুনর্বণ্টন ক্ষেত্রে বিয়েরও প্রভাব রয়েছে। ড. আনাস ঝরকা বলেছেনÑ
স্বামী ও স্ত্রীর সম্পদের সহসম্বন্ধের সঙ্গ যদি দুর্র্র্র্র্র্বল হয় তাহলে সম্পদ পুনর্বণ্টনের উপর প্রভাব বৃদ্ধি পায়। যদি ধনীরা ধনীদের মধ্যেই এবং গরীবরা গরীবদের মধ্যেই বিয়ে করে তাহলে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীত্বের প্রভাব হবে দূর্বল। কেননা এ ক্ষেত্রে উভয়ের সম্পদের সহসম্বন্ধে সঙ্গ হবে খুব উঁচু।[২০] বিয়ে ও বিয়ের মাধ্যমে সংগঠিত পরস্পরিক দু’টি পরিবারের আন্তঃসম্পর্ক ও স্বামী-স্ত্রীর সম্পদে পারস্পরিক অধিকারের বিষয়টি ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ।
১২- কাফন, দাফন ও ঋণ-দেনা পরিশোধের পরই মৃতের বাকি সম্পত্তি ওয়ারিছগণের মধ্যে বণ্টন করার শরঈ বিধান রয়েছে।
১৩- পৃথিবীর প্রায় সমস্ত আধুনিক ইউরোপীয় দেশ সমূহে ওয়ারিছী আইনের ক্ষেত্রে স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তির বেলায় পৃথক সূত্র প্রচলিত আছে। ইসলামী আইনে সেটি নেই। ইসলামী আইনে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি একই নিয়মে নিয়ন্ত্রিত হয়।
১৪- আধুনিক ইউরোপীয় দেশ সমূহে মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে প্রথমে সন্তান অথবা অধঃস্তন পুরুষ উত্তরাধিকার পায়। তাদের অবর্তমানে পিতা বা ঊর্ধ্বতন পুরুষের অধঃস্তন পুরুষরা পায়। এই ব্যাপারে ইসলামী আইন এক সুদূরপ্রসারী দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। ইসলামী আইনে পুত্র কন্যার সাথে পিতা-মাতার উত্তরাধিকারের নীতি প্রচলিত আছে।
১৫- ইউরোপীয় দেশসমূহে আধুনিক কালে উইলের ব্যাপারে সকলের নিরংকুশ অধিকার আছে। মুসলিম আইনে এক তৃতীয়াংশের বেশী উইল করা চলে না।
১৬- ইসলামী আইনে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ার সাথে সাথেই তার ওয়ারিসগণের অধিকার জন্মে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে। ইউরোপীয় দেশ সমূহে দেনাগ্রস্ত ব্যক্তির মৃত্যু হলে এটি হয় না।
পৃথিবীতে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনই সহজ, সরল ও সুন্দর একটি বণ্টন পদ্ধতি, যার মাধ্যমে কোনরূপ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা বা বাইরের শক্তি প্রয়োগ ব্যতিরেকেই বিশ্বের মাঝে ব্যক্তিকে সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
* সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।
তথ্যসূত্র :
[১]. সিরাজুল ইসলাম তালুকদার, আলকুরানিক আইন (ঢাকা: আলীগড় লাইব্রেরী, ১৯৯৩), পৃ. ১।
[২]. আলহাজ্ব বদিউল আলম, ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, (ঢাকা: আইএল আর এন্ড এল বাংলাদেশ,-২০০৫), পৃ. ৪৯-৫০।
[৩]. আব্দুর রহিম, ইসলামী আইনতত্ত্ব (মাদ্রাজ: ১৯৯১), পৃ. ৫০; আব্দুল মান্নান তালিব সম্পাদিত, ইসলামী আইন ও বিচার, প্রবন্ধকার, এমবি তাজ মোহাম্মদ, ইসলামী আইন ও বিশ^ায়ন, ৩য় সংখ্যা (ঢাকা: ইসলামিক ল’ রিসার্চ সেন্টার এন্ড লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ, ২০০৩), পৃ. ২৮।
[৪]. এম হাবিবুর রহমান, মুসলিম আইন, প্রথম খণ্ড (রাজশাহী: সৈয়দ মর্জিনা খাতুন, ১৯৮৯), পৃ. ২।
[৫]. অনুপমা আফরোজ, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: পরিপ্রেক্ষিত ইসলাম, ইসলামী আইন ও বিচার, বর্ষ, ১০, সংখ্যা, ৪০, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০০৪, পৃ. ৯৪।
[৬]. আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনি আব্দুল্লাহ আল-হাকিম আন-নিসাপুরী, মুসতাদরাকে হাকিম, ৪র্থ খণ্ড (লেবানন: দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যা, ১৯৯০), পৃ.৩৮০।
[৭]. ইবনে মাজাহ, প্রগুক্ত, হাদীছ নং-২৭১৯।
[৮]. ইমামুদ্দীন ইসমা‘ঈল ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, (মিসর: দারুত তাকওয়ালিত তুরাছি, ১৯৮৪), পৃ. ৫৩০।
[৯]. আল্লাহ তা‘আলা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের নিন্দা করেছেন এবং তারা মহান রবের অভিসম্পাতপ্রাপ্ত হবে বলে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর (ইবাদত করার) দেয়া প্রতিশ্রুতির পর তা লঙ্ঘন করে, আর (আত্মীয়তার) সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে এবং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ। আর আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস’। দ্র.: সূরা আর-রা‘দ, ১৩:২৫।
[১০]. রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘তিন ধরনের জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। এ ছাড়া বাকী জ্ঞান অতিরিক্ত। সে তিন ধরনের জ্ঞান হলো: আল-কুরআন, সুন্নাহ ও ফারায়েয’- দ্র.: সুনানে আবী দাঊদ, প্রাগুক্ত, হাদীছ নং-২৮৮৫।
[১১]. আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-হাকেম আন-নিসাপূরী, মুসতাদরাক, আল-বাইহাকীর বরাতে ইফাবা প্রকাশনা: ২৩৫/১, পৃ. ১২।
[১২]. সহীহ বুখারী, অধ্যায়, ৮৫/২, ৬ষ্ঠ খণ্ড, (ঢাকা: তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ২০১৯), পৃ. ১৪৮।
[১৩]. হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী (শারহে বুখারী) (মিসর: দারুত তাকওয়ালিত তুরাছি, ১৯৮৮), পৃ. ৩৫৫
[১৪]. আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনু ইয়াযিদ ইবনু মাজাহ, সুনানে ইবনে মাজাহ (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০২), হাদীছ নং-২৭০৮।
[১৫]. কাফির, সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:৪৪; যালিম, সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:৪৫; ফাসিক, সূরা আল-মাায়িদাহ, ৫:৪৭।
[১৬]. গাজী শামছুর রহমান, মুসলিম আইনের রূপরেখা, ঢাকা: ইসলামিক একাডেমী পত্রিকা, জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যা, ১৯৬৫, পৃ. ৬০।
[১৭]. Asaf A.A. Fayzee, Outline of Mohammedan Law, 4th Edition (Delhi: Oxford University Press, 1974), p. 387
[১৮]. ইমাম বুখারী, সহীহ আল বুখারী, ‘আল-ওয়াছাআ’ অধ্যায়, ‘আল ওয়াছিয়্যাতু বিছ ছুলুছ’ অনুচ্ছেদ, হাদীছ নং-২৭৪৪, পৃ. ২২০।
[১৯]. গাজী শামসুর রহমান, ফারায়েজ আইন, (ঢাকা: খোশরোজ কিতাব মহল, ২০০১), পৃ. ৬।
[২০]. আনাস ঝারকা, ইসলামিক ইকনমিকস: এন এপ্রোচ টু হিউম্যান ওয়েলফেয়ার, গাজালী ও ওমর সম্পাদিত রিডিংস ইন দি কনসেপ্ট এন্ড মেথডলজী অফ ইসলামিক ইকনমিকস (মালয়েশিয়া: পিলানদুক পাবলিকেসন্স, ১৯৯২), পৃ. ১৫১।
প্রসঙ্গসমূহ »:
বিধি-বিধান