সমকামীতার ভয়াবহতা ও তার অপকার
-হাসিবুর রহমান বুখারী*
বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশ তথাকথিত স্বাধীনতা ও আধুনিকতার নামে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় পরিপূর্ণ হয়েছে। উন্মুক্ত চিন্তাভাবনার বশবর্তী হয়ে এক শ্রেণীর বিপথগামী তরুণ-তরুণী সমকামীতার মতো ধ্বংসাত্মক পাপাচারে লিপ্ত হয়েছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণীর মানুষের নিকট কিন্তু এর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী৷ আধুনিকতার নামে মূলতঃ তারা আগ্রাসী পাশ্চাত্য সভ্যতার নোংরামির শিকারে পরিণত হচ্ছে। বিপরীত লিঙ্গের প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য ভুলে সমলিঙ্গের প্রেমে বুঁদ হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এদের শাস্তি সম্পর্কে বলেন, ‘নিশ্চয় যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না’ (সূরা আন-নূর : ১৯)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, ‘বলুন, আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, পাপাচার ও অসংগত বিদ্রোহকে এবং কোন কিছুকে আল্লাহর অংশী করাকে, যার কোন দলীল তিনি প্রেরণ করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলাকে (নিষিদ্ধ করেছেন) যে সম্পর্কে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩৩)। *
দুঃখজনক বিষয় হল ইদানীং আমাদের মুসলিম সমাজেও কিন্তু এই প্রথা অধিকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নতির নামে অধঃপতন, মনুষত্বের নামে পশুত্ব, অগ্রগতির নামে অশ্লীলতা, সভ্যতার নামে অসভ্যতা, সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি, পরিবর্তনের নামে উন্মুক্ত যৌনচার, শিক্ষার নামে যৌনশিক্ষা, পোশাকের নামে নগ্নতা; এ সবই পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণের বিষফল। বিজাতীদের দেখাদেখি নির্বোধ মুসলিমরাও এই অপসংস্কৃতির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে কিছু বিপথগামী তরুণ-তরুণী আগ্রাসী পাশ্চাত্য সভ্যতার শিকারে পরিণত হচ্ছে। এই অপসংস্কৃতি বিস্তৃতির অন্যতম কারণ হল ধর্মবিমুখতা।
আজ আমেরিকার মত উচ্চ শিক্ষিত সুসভ্য এবং সর্বদিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী দেশ যদি সমকামীতার মত নিকৃষ্ট, ঘৃণিত ও মানবতা বিরোধী অশ্লীলতাকে আইন করে বৈধতা দেয়, তাহলে মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা কিভাবে সম্ভব হবে? কাম প্রবৃত্তি ও লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে লজ্জা-শরম ও ভাল-মন্দের স্বভাবজাত পার্থক্য বিসর্জন দিয়ে আমেরিকান পার্লামেন্টে সমকামিতা বিল পাশ করেছে। বর্তমানে তা শুধুমাত্র আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং আরো বহু দেশের পার্লামেন্টে সমকামিতা বিল পাশ করা হয়েছে। যখন পার্লামেন্টে ব্যভিচারকে বৈধ ঘোষণা করা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা সমাজে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। আর তখনই সেই সমাজ আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যায়। মানুষের পাশবিক আচরণ যে কত দ্রুত সমাজ সভ্যতাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘পক্ষান্তরে যারা মন্দ কাজ করে, তারা তাদের মন্দ কাজের শাস্তি পাবে ওর অনুরূপ মন্দ। আর লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেবে। আল্লাহ (এর শাস্তি) হতে তাদের রক্ষাকর্তা কেউই থাকবে না। তাদের মুখমন্ডল যেন অন্ধকার রাত্রির আস্তরণে আচ্ছাদিত। এরাই হচ্ছে জাহান্নামের অধিবাসী, তারা ওর মধ্যে অনন্তকাল থাকবে’ (সূরা ইউনুস : ২৭)।
১৯৮৫ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৪,৭৩৯ জন এইডস্ রোগে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ১০,৬৫৩ জন রোগীই পুরুষ সমকামী। অর্থাৎ লূত (আলাইহিস সালাম)-এর সম্প্রদায় যে অপকর্ম করেছিল, তারাও সেই অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল।
সৃষ্টির অস্তিত্ব টিকে রয়েছে বিপরীত লিঙ্গের মাধ্যমে। আজ যারা সমলিঙ্গের আইনি বৈধতার দাবি করছে, তাদের বিবেককে জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, তাদের বাবা-মা একে অপরকে বিবাহ না করলে তারা কিভাবে পৃথিবীতে আসত? সম্প্রতিককালে বাংলাদেশের মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশে দু’জন সমকামী নারীর বিবাহ সত্যিই ভাবিয়ে তোলে।
কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সমকামীতার ভয়াবহতা
সমকাম বা পায়ুগমন বলতে বুঝায়, পুরুষে পুরুষে একে অপরের মলদ্বার ব্যবহারের মাধ্যমে অথবা নারীতে নারীতে একে অপরের যৌনাঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজ যৌন উত্তেজনা নিবারণের প্রচেষ্টা করা। সমকাম একটি অত্যাধিক ভয়াবহ গুনাহের কাজ। কুফরীর পর সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক ও মারাত্মক গুনাহের নাম সমকাম। যার ভয়াবহতা হত্যার চাইতেও মারাত্মক। বিশ্বে সর্বপ্রথম লূত্ব (আলাইহিস সালাম)-এর সম্প্রদায়ই এ কাজে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহ তা‘আলার ভয়ানক শাস্তির সম্মুখীন হয়। তাদেরকে তিনি এমন ভয়ঙ্কর শাস্তি প্রদান করেন যা ইতিঃপূর্বে কাউকে প্রদান করেননি। তিনি তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাদের ঘরবাড়ি তাদের উপরই উল্টিয়ে দিয়ে ভূমিতে তলিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর আকাশ থেকে পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আমি লূত্বকেও পাঠিয়েছিলাম, তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা এমন মারাত্মক অশ্লীল ও কুকর্ম করছ যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে আর কেউ করেনি। তোমরা তো যৌন উত্তেজনা নিবারণ বা কাম-তৃপ্তির জন্য নারীদেরকে ছেড়ে পুরুষের নিকট গমন করছ, তোমরা হচ্ছ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৮০-৮১)। তিনি আরো বলেন, ‘সৃষ্টিকুলের মধ্যে তোমরা তো কেবল পুরুষদের সাথেই কুকর্ম কর এবং তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যে স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করেছেন তাদেরকে তোমরা বর্জন করে থাক। বরং তোমরা তো এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়’ (সূরা আশ-শু’আরা : ১৬৫-১৬৬)।
তিনি অন্যত্র বলেন, (স্মরণ করুন) লূত্বের কথা, তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা জেনে-শুনে কেন অশ্লীল কাজ করছ? তোমরা কি কামতৃপ্তির জন্য নারীকে ছেড়ে পুরুষে উপগত হবে? তোমরা তো এক মহা অজ্ঞ সম্প্রদায়’। উত্তরে তাঁর সম্প্রদায় শুধু বলল, ‘লূত্বের পরিবারকে তোমাদের জনপদ হতে বহিষ্কার কর, এরা তো এমন লোক যারা পবিত্র সাজতে চায়। অতঃপর আমি তাঁকে ও তাঁর স্ত্রী ব্যতীত তাঁর পরিজনবর্গকে উদ্ধার করলাম। তাঁর স্ত্রীর জন্য অবশিষ্ট লোকদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলাম। তাদের উপর বিশেষ ধরনের ভয়ঙ্কর বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম, যাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল, তাদের জন্য এ বর্ষণ কতই না মারাত্মক ছিল! (সূরা আন-নামাল : ৫৪-৫৮)।
অত্র আয়াত সমূহে আল্লাহ তা‘আলা সমকামিতাকে অত্যাধিক জঘন্য, নোংরা, কদর্য, কুৎসিত, বিপদগামী ও গর্হিত কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘আমি লূত্বকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান, আর তাঁকে উদ্ধার করেছিলাম এমন এক জনপদ হতে, যার অধিবাসীরা লিপ্ত ছিল অশ্লীল কর্মে। মূলত তারা ছিল নিকৃষ্ট প্রকৃতির ফাসিক সম্প্রদায়’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৭৪)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সমকামীদেরকে জালিম বা অত্যাচারী সম্প্রদায় বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রশ্ন হল, আল্লাহ তা‘আলা সমকামীদের জালিম কেন বলেছেন? উঃ প্রকৃতপক্ষে জুলম্ বলতে বুঝায়,
(وضع الشيء في غير موضعه) অর্থাৎ কোনো জিনিসকে তার নির্দিষ্ট জায়গা ব্যতীত অন্য কোথাও রাখা।[১] যেহেতু সমকামীরা তাদের যৌনাঙ্গকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্দেশিত সঠিক জায়গায় ব্যবহার করে না, তাই তাদের জালিম বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘যখন আমার প্রেরিত ফিরিশতাগণ সুসংবাদসহ ইবরাহীমের নিকট আসল, তখন তারা বলেছিল, নিশ্চয় আমরা এ শহরের অধিবাসীদেরকে (অর্থাৎ লূত্ব (আলাইহিস সালাম)-এর এলাকাবাসীকে) ধ্বংস করব। এর অধিবাসীগণ অবশ্যই জালিম ও সীমালংঘনকারী’ (সূরা আল-আনকাবূত : ৩১)।
লূত্ব (আলাইহিস সালাম) তাঁর এলাকাবাসীকে বিশৃঙ্খল জাতি হিসাবে উল্লেখ করেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কথাই অবিকল পবিত্র কুরআন মাজীদে উল্লেখ করে বলেন, قَالَ رَبِّ انۡصُرۡنِیۡ عَلَی الۡقَوۡمِ الۡمُفۡسِدِیۡنَ ‘লূত্ব (আলাইহিস সালাম) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন’ (সূরা আল-‘আনকাবূত : ৩০)।
ক্বাওমে লূত্বকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) আল্লাহ তা‘আলার নিকট জোর সুপারিশ করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর সুপারিশ কবুল করা হয়নি। বরং তাঁকে বলা হয়েছিল,
یٰۤـاِبۡرٰہِیۡمُ اَعۡرِضۡ عَنۡ ہٰذَا ۚ اِنَّہٗ قَدۡ جَآءَ اَمۡرُ رَبِّکَ ۚ وَ اِنَّہُمۡ اٰتِیۡہِمۡ عَذَابٌ غَیۡرُ مَرۡدُوۡدٍ
‘হে ইবরাহীম! আপনি এটা থেকে বিরত হোন। নিশ্চয় আপনার প্রতিপালকের নির্দেশ এসে গেছে এবং তাদের উপর এমন এক শাস্তি আসছে যা কিছুতেই টলবার মতো নয়’ (সূরা হূদ : ৭৬)।
অতঃপর যখন তাদের শাস্তি অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেল এবং তা অতি প্রত্যুষেই আসবে বলে লূত্ব (আলাইহিস সালাম)-কে জানিয়ে দেয়া হল। তখন তিনি উদ্বিগ্নতার স্বরে আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহ এই জালিম সম্প্রদায়ের মূলোৎপাটন করতে এতো দেরি কেন? তখন আল্লাহ তাঁকে বলেন,اَلَـیۡسَ الصُّبۡحُ بِقَرِیۡبٍ ‘প্রত্যুষকাল কি অতি নিকটেই নয়? কিংবা প্রত্যুষ হতে কি এতই দেরী? (সূরা হূদ : ৮১)।
তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আসন্ন আযাব সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল, কিন্তু তারা সতর্ককারীকেও মিথ্যাবাদী মনে করেছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
کَذَّبَتۡ قَوۡمُ لُوۡطٍۭ بِالنُّذُرِ - اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ حَاصِبًا اِلَّاۤ اٰلَ لُوۡطٍ ؕ نَجَّیۡنٰہُمۡ بِسَحَرٍ
‘লূত্ব সম্প্রদায় মিথ্যা মনে করেছিল সতর্ককারীদেরকে। নিশ্চয় আমি তাদের উপর প্রেরণ করেছিলাম পাথর বর্ষণকারী ঝড়, কিন্তু লূত্ব পরিবারের উপর নয়, তাদেরকে আমি উদ্ধার করেছিলাম রাতের শেষাংশে’ (সূরা আল-ক্বামার : ৩৩-৩৪)।
পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলা লূত্ব (আলাইহিস সালাম)-এর সম্প্রদায়ের শাস্তি ও ধ্বংসের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন,
فَلَمَّا جَآءَ اَمۡرُنَا جَعَلۡنَا عَالِیَہَا سَافِلَہَا وَ اَمۡطَرۡنَا عَلَیۡہَا حِجَارَۃً مِّنۡ سِجِّیۡلٍ ۬ۙ مَّنۡضُوۡدٍ - مُّسَوَّمَۃً عِنۡدَ رَبِّکَ ؕ وَ مَا ہِیَ مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ بِبَعِیۡدٍ
‘অতঃপর যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছল, তখন আমি ঐ ভূ-খন্ডের উপরিভাগকে নীচে করে দিলাম (অর্থাৎ উল্টে দিলাম) এবং তার উপর ক্রমাগত ঝামা পাথর বর্ষণ করলাম। যা বিশেষরূপে চিহ্নিত করা ছিল আপনার প্রতিপালকের নিকট, আর ঐ (জনপদ)গুলো এই যালিমদের নিকট হতে বেশী দূরে নয়’ (সূরা হূদ : ৮২-৮৩)। আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন,
فَاَخَذَتۡہُمُ الصَّیۡحَۃُ مُشۡرِقِیۡنَ -فَجَعَلۡنَا عَالِیَہَا سَافِلَہَا وَ اَمۡطَرۡنَا عَلَیۡہِمۡ حِجَارَۃً مِّنۡ سِجِّیۡلٍ - اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّلۡمُتَوَسِّمِیۡنَ - وَ اِنَّہَا لَبِسَبِیۡلٍ مُّقِیۡمٍ - اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ
‘অতঃপর অতি প্রত্যুষেই এক বিকট আওয়াজ তাদেরকে পাকড়াও করল। এরপরই আমরা জনপদটিকে উল্টিয়ে উপর-নিচ করে দিলাম এবং তাদের উপর ঝামা পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে সূক্ষদর্শী চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য। আর উক্ত জনপদটি (উহার ধ্বংসস্তুপ) স্থায়ী তথা বহু প্রাচীন লোক চলাচলের পথি পার্শ্বেই এখনও বিদ্যমান। অবশ্যই এতে রয়েছে মুমিনদের জন্য নিশ্চিত নিদর্শন’ (সূরা আল-হিজর : ৭৩-৭৭)।
স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) সমকামীদেরকে তিন তিন বার লা‘নত বা অভিসম্পাত দিয়েছেন যা অন্য কারোর ক্ষেত্রে দেননি। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
لَعَنَ اللهُ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوْطٍ، لَعَنَ اللهُ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوْطٍ، لَعَنَ اللهُ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوْطٍ
‘আল্লাহ তা‘আলা সমকামীদেরকে (লা‘নত) অভিসম্পাত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা সমকামীদেরকে অভিসম্পাত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা সমকামীদেরকে অভিসম্পাত করেছেন।[২] আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
مَلْعُوْنٌ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوْطٍ ، مَلْعُوْنٌ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوْطٍ ، مَلْعُوْنٌ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوْطٍ
‘সমকামীরাই অভিশপ্ত। সমকামীরাই অভিশপ্ত। সমকামীরাই অভিশপ্ত’।[৩]
বর্তমান যুগে সমকামীতার বহুল প্রচার, প্রসার এবং বাড় বাড়ন্তের কথা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই রাসূল (ﷺ)-এর সেই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা স্মৃতিপটে ভেসে উঠে যেখানে তিনি বলেছেন, إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِيْ عَمَلُ قَوْمِ لُوْطٍ‘আমি যে কুকর্মটি আমার উম্মাতের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার সর্বাধিক বেশি আশঙ্কা করছি তাহল লূত্ব সম্প্রদায়ের কুকর্ম (অর্থাৎ সমকামিতা)।[৪]
জগদ্বিখ্যাত প-িত ও সাধক ফুযাইল ইবনু ইয়াজ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,لَوْ أَنَّ لُوْطِيًّا اغْتَسَلَ بِكُلِّ قَطْرَةٍ مِّنَ السَّمَاءِ لَقِيَ اللهَ غَيْرَ طَاهِرٍ ‘যদি কোন সমকামী আকাশের সমস্ত পানি দিয়ে গোসল করে, তবুও সে অপবিত্র অবস্থাতেই আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ করবে’।[৫]
কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে পুরুষ সমকামীর শাস্তি
সমকামী পুরুষ (এধু গধহ) এবং সমকামী নারী (এধু ডড়সধহ)- উভয়ের শাস্তির বিধান কিন্তু এক নয়। ইসলামী শরী‘আতে এর জন্য দু’টি পৃথক পৃথক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। পুরুষ সমকামীদের আরবীতে 'لِوَاط لِوَاطَة' (লিওয়াত্ব বা লিওয়াত্বাহ্) বলা হয়। পক্ষান্তরে মহিলা সমকামিনীদের আরবীতে 'سِحَاق' (সিহাক্ব) বলা হয়। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যেহেতু সমকামীতার অনিষ্টতা সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক, সেহেতু ইহকালে ও পরকালে এর শাস্তিও হবে সবচেয়ে ভয়াবহ’।[৬]
ইসলামী শারী‘আহ অনুযায়ী কোন পুরুষের ব্যাপারে সমকাম বা পায়ুগমন প্রমাণিত হয়ে গেলে তাকে ও তার সমকামী সঙ্গীকে শাস্তি স্বরূপ হত্যা করতে হবে। সমকামী বা পায়ুকামীকে হত্যা করার ব্যাপারে ছাহাবীগণ এবং উলামাগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তবে হত্যার পদ্ধতিগত ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কিছু মতানৈক্য রয়েছে। যেমন,
১. ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আহলুল ইলম্ বা অভিজ্ঞ আলিমদের মধ্যে সমকামীর হাদ্দ বা শাস্তির ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে।
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, উভয় সমকামীকেই রজম (অর্থাৎ পাথর মেরে হত্যা) করতে হবে; চায় সে বিবাহিত হোক অথবা অবিবাহিত হোক। এই মতের পক্ষে রয়েছেন ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমাদ ও ইসহাক্ব।
পক্ষান্তরে তাবিঈদের মধ্য হতে হাসান আল-বাছরী, ইবরাহীম নাখঈ, আতা ইবনু আবূ রাবাহ সহ অন্যান্য বিদ্বানগণ বলেছেন, সমকামীর শাস্তি ব্যভিচারীর শাস্তির মতই। একই মত পোষণ করেছেন সুফিয়ান ছাওরী ও কুফাবাসীরা।[৭]
২. শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘উভয় সমকামীকেই হত্যা করার ব্যাপারে ছাহাবীগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। কিন্তু কিভাবে হত্যা করতে হবে, সে বিষয়ে মতপার্থক্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ছাহাবী বলেছেন, পাথর মেরে হত্যা করতে হবে। আবার কিছু সংখ্যক ছাহাবী বলেছেন, সমকামীকে মহল্লার সর্বোচ্চ প্রাসাদের ছাদ থেকে উপুড় করে নিক্ষেপ করতে হবে। অতঃপর তার উপর পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে হবে। পক্ষান্তরে কিছু সংখ্যক ছাহাবী বলেছেন, তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতে হবে। তবে জামহুর সালাফে ছলিহীন ও ফিক্বাবিদদের মতানুযায়ী উভয় সমকামীকেই রজম (অর্থাৎ পাথর মেরে হত্যা) করতে হবে; চায় সে বিবাহিত হোক অথবা অবিবাহিত হোক’।[৮]
৩. ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) ও আল্লামাহ শানক্বিত্বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমাদের উস্তাদগণ বলেছেন, ‘সমকামীদের হত্যার ব্যাপারে ছাহাবীগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তাঁরা শুধুমাত্র হত্যার পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য করেছেন’।[৯]
৪. সমকামীদের বিষয়ে ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) অত্যাধিক কঠোর ছিলেন। তিনি সমকামীকে রজম (অর্থাৎ পাথর মেরে হত্যা) করা অপরিহার্য করেছিলেন, চায় সে বিবাহিত হোক অথবা অবিবাহিত হোক। আর এ বিষয়ে এটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত।[১০]
৫. ইবনু আবিদীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ব্যভিচারীর মতো সমকামীদের উপরেও হাদ্দ (শাস্তি) প্রয়োগ করা অপরিহার্য। তাদের উপর হাদ্দ অপরিহার্য হওয়ার ব্যাপারে ছাহাবীগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তবে কেউ কেউ মতপার্থক্যও করেছেন, যেমন আবূ বকর ছিদ্দীক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার কথা বলেছেন’।[১১]
দলীল
(ক) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন,مَنْ وَجَدْتُمُوْهُ يَعْمَلُ عَمَلَ قَوْمِ لُوْطٍ فَاقْتُلُوْا الْفَاعِلَ وَالْـمَفْعُوْلَ بِهِ ‘তোমরা যে মানুষকে লূত্ব সম্প্রদায়ের কুকর্মে (সমকামিতায়) নিয়োজিত পাবে সেই কুকর্মকারীকে এবং যার সাথে কুকর্ম করা হয়েছে তাদের উভয়কেই হত্যা করবে’।[১২]
(খ) আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) লূত্ব জাতির অনুরূপ অপকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন,اُرْجُمُوْا الْأَعْلَى وَالْأَسْفَلَ ، اُرْجُمُوْهُمَا جَمِيْعًا ‘তোমরা উপরের এবং নিচের উভয় ব্যক্তিকেই রজম করে অর্থাৎ প্রস্তরাঘাতে হত্যা করো।[১৩]
(গ) ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন,فِي الْبِكْرِ يُؤْخَذُ عَلَى اللُّوْطِيَّةِ، قَالَ: يُرْجَمُ ‘অবিবাহিতদের পায়ুকামে বা সমকামীতায় লিপ্ত পাওয়া গেলে রজম করা হবে (অর্থাৎ পাথর মেরে হত্যা করা হবে)।[১৪]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* মুর্শিদাবাদ, ভারত।
তথ্যসূত্র :
[১]. আন-নিহায়াহ, ৩য় খ-, পৃ. ১৬১; আল-ক্বামুসুল মুহিত্ব, পৃ. ১১৩৪; আল-মিছবাহুল মুনীর, পৃ. ১৪৬।
[২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৮১৬, ২৯১৩, ২৯১৫; ইবনু হিব্বান, হা/৪৪১৭; হাকীম, হা/৮০৫২; ত্বাবরানী আল-কাবীর, হা/১১৫৪৬; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩৪৬২; ছহীহুত তারগীব, হা/২৪২১।
[৩]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৭৫, ২৯১৪; ছহীহুত তারগীব, হা/২৪২০, ২৫১৬; তাখরীজু মিশকাতিল মাছাবীহ, হা/৩৫১৬; ছহীহুল জামি‘, হা/৫৮৯১।
[৪]. তিরমিযী, হা/১৪৫৭; ইবনু মাজাহ, হা/২৫৬৩, সনদ হাসান; ছহীহুল জামি‘, হা/১৫৫২; ছহীহুত তারগীব, হা/২৪১৭; তাখরীজু মিশকাতিল মাছাবীহ, হা/৩৫১০।
[৫]. যাম্মুল লিওয়াত্ব, দুরী, পৃ. ১৪২, ইসলাম ওয়েব, ফাতাওয়া নং-২৪৩৬৭৩।
[৬]. আল-জাওয়াবুল কাফী, ১ম খ-, পৃ. ১৬৮।
[৭]. তিরমিযী, হা/১৪৫৬।
[৮]. মাজমুঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ১১তম খ-, পৃ. ৫৪৩।
[৯]. যাদুল মা‘আদ, ৫ম খ-, পৃ. ৪০; আজওয়াউল বায়ান, ৩য় খ-, পৃ. ৩৫।
[১০]. ইগাছাতুল লাহ্ফান, ২য় খ-, পৃ. ১৪৪।
[১১]. হাশিয়াতু ইবনে আবিদীন, ৪র্থ খ-, পৃ. ৯১; আদ-দুর্রুল মুখতার, ৪র্থ খ-, পৃ. ২৭।
[১২]. আবূ দাঊদ, হা/৪৪৬২; তিরমিযী, হা/১৪৫৬; ইবনে মাজাহ, হা/২৫৬১, সনদ হাসান ছহীহ; ইরওয়াউল গালীল, হা/২৩৫০; ছহীহুত তারগীব, হা/২৪২২; তাখরীজু মিশকাতিল মাছাবীহ, হা/৩৫০৮; ছহীহুল জামি‘, হা/৬৫৮৯।
[১৩]. ইবনে মাজাহ, হা/২৫৬২, ২০৯২; হাকীম, হা/৮০৪৮; মুসনাদু আবি ইয়া‘আলা, হা/৬৬৮৭; শারহু মুশকিলিল আছার, হা/৩৮৩৩, সনদ হাসান।
[১৪]. আবূ দাঊদ, হা/৪৪৬৩, সনদ ছহীহ।