রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০৯:০৮ অপরাহ্ন

বিদ‘আত পরিচিতি

-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


(২৯তম কিস্তি)

খ. বিদ‘আত প্রতিরোধে অন্যান্য ছাহাবীর ভূমিকা

১- মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) (মৃ. ১৮ হি.)

মু‘আয ইবনু জাবাল ইবনু আমর ইবনু আউস আবূ আব্দির রহমান আল-আনছারী আল-খাযরাজী আল-বাদরী। তিনি শরী‘আতের হালাল-হারাম সম্পর্কিত পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, وَأَعْلَمُهُمْ بِالْحَلاَلِ وَالْحَرَامِ مُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ ‘আর উম্মতের মধ্যে হালাল ও হারাম সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানী মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)’।[১] তিনি ‘আক্বাবায় উপস্থিত যুবক ছাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে আল-কুরআন একত্রিতকারীদের অন্যতম ছিলেন। এমনকি যে চারজনের নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআন গ্রহণ করা বা শিখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি ছিলেন তার অন্যতম।[২] তিনি আনছার যুবক ছাহাবী ছিলেন। সহনশীলতা, লজ্জাশীলতা ও বদান্যতা ছিল তার চরিত্রের চৌম্বকাংশ। উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যেসকল ছাহাবীদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে শলা-পরামর্শ করতেন তন্মধ্যে মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)ও ছিলেন। কেউ যদি ফিক্বহ জানতে চাইত, তাহলে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর কাছে যেতে বলতেন। প্লেগ মহামারীর সময়ে ১৮ হিজরীতে শাম তথা সিরিয়াতে তিনি ইন্তেকাল করেন।[৩] মুশরিক ও বিদ‘আতীদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন রুদ্ধ কঠোর। নিচে বিদ‘আত প্রতিরোধে তার চেতনা তুলে ধরা হলো-

(১) ইবনু শিহাব (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, আবূ ইদরীস আল-খাওলানী ‘আয়িযুল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ) তাকে জানিয়েছে, মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সহচর ইয়াযীদ ইবনু ‘আমীরাহ তাকে জানিয়েছে। তিনি বলেন, মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কোন ওয়াযে বসলেই বলতেন, আল্লাহ মহা ন্যায়বিচারক, সন্দেহকারীরা ধ্বংস হয়েছে। অতঃপর মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একদিন বলেন,

إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ فِتَنًا يَكْثُرُ فِيْهَا الْمَالُ وَيُفْتَحُ فِيْهَا الْقُرْآنُ حَتَّى يَأْخُذَهُ الْمُؤْمِنُ وَالْمُنَافِقُ وَالرَّجُلُ وَالْمَرْأَةُ وَالصَّغِيْرُ وَالْكَبِيْرُ وَالْعَبْدُ وَالْحُرُّ فَيُوْشِكُ قَائِلٌ أَنْ يَقُوْلَ مَا لِلنَّاسِ لَا يَتَّبِعُوْنِىْ وَقَدْ قَرَأْتُ الْقُرْآنَ مَا هُمْ بِمُتَّبِعِىَّ حَتَّى أَبْتَدِعَ لَهُمْ غَيْرَهُ فَإِيَّاكُمْ وَمَا ابْتُدِعَ فَإِنَّ مَا ابْتُدِعَ ضَلَالَةٌ وَأُحَذِّرُكُمْ زَيْغَةَ الْحَكِيْمِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ يَقُوْلُ كَلِمَةَ الضَّلَالَةِ عَلَى لِسَانِ الْحَكِيْمِ وَقَدْ يَقُوْلُ الْمُنَافِقُ كَلِمَةَ الْحَقِّ

‘তোমাদের পরবর্তী যুগে ফিতনা সৃষ্টি হবে, তখন প্রচুর সম্পদ থাকবে। মুমিন, মুনাফিক, পুরুষ-নারী, ছোট-বড়, স্বাধীন গোলাম সকলে কুরআন খুলে পাঠ করবে (কিন্তু অর্থ বুঝবে না)। অচিরেই কেউ বলবে, লোকদের কী হলো, তারা কেন আমার অনুসরণ করবে না যতক্ষণ না আমি তাদের জন্য এছাড়া নতুন কিছু প্রবর্তন করতে পারি? অতএব তোমরা তার এ বিদ‘আত হতে বেঁচে থাকবে। কারণ দ্বীনের মধ্যে যা নতুন প্রবর্তন করা হয় তা গোমরাহী। আমি তোমাদেরকে জ্ঞানী ব্যক্তিদের পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে সতর্ক করছি। কেননা শয়তান পণ্ডিতদের মুখ দিয়ে গোমরাহী কথা বলায়। আবার মুনাফিকরাও মাঝে মাঝে হক কথা বলে’।

বর্ণনাকারী বলেন, আমি মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললাম, আল্লাহ‌ আপনার উপর সদয় হোন, জ্ঞানী ব্যক্তি যে পথভ্রষ্টতাপূর্ণ কথা বলে আর মুনাফিক সত্য কথা বলে এটা আমি কিভাবে বুঝবো? তিনি বললেন, হ্যাঁ, জ্ঞানী ব্যক্তিদের সেসব ভ্রান্তিপূর্ণ কথা বর্জন করবে যা লোকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে এবং বলবে, এ আবার কেমন কথা। তবে এসব কথায় তোমরা জ্ঞানীদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করবে না। কেননা হয়ত জ্ঞানী ব্যক্তি এসব ভ্রান্তিপূর্ণ কথা থেকে ফিরে আসবে। আর তুমি হক কথা শুনামাত্র তা গ্রহণ করো, কেননা হকের মধ্যে নূর আছে। ইবনু ইসহাক্ব (রাহিমাহুল্লাহ) যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ) সূত্রে বলেন, মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, হ্যাঁ, তুমি যদি জ্ঞানী ব্যক্তির বক্তব্যে সন্দেহ করো, যতক্ষণ না বলো, তিনি এর দ্বারা কী বুঝাচ্ছেন’।[৪]

(২) মায়মূন আবী হামযাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি আবূ ওয়ায়েলের সাথে বসে ছিলাম, তখন আবূ আফীফ নামক এক ব্যক্তি আমাদের মধ্যে প্রবেশ করল। শাক্বীক্ব ইবনু সালামাহ তাকে বললেন, হে আবূ আফীফ! আপনি কি আমাদেরকে মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কথা বলেননি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি তাকে বলতে শুনেছি,

يَحْبِسُ النَّاسَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ فِيْ صَعِيْدٍ وَاحِدٍ فَيُنَادَى : أَيْنَ الْمُتَّقُوْنَ؟ فَيَقُوْمُوْنَ فِيِ كَنَفِ الرَّحْمَنِ لَا يَحْتَجِبَ اللهِ مِنْهُمْ وَلَا يَسْتَتِرُ، فَقِيْلَ لَهُ : مَنِ الْمُتَّقُوْنَ؟ قَالَ : قَوْمُ اتَّقُوا الشَّرْكَ وَعِبَادَةُ الْأَوْثَانِ وَأخْلَصُوا للهِ الْعِبَادَةِِ، فَيَمُرُّوْنَ مِنَ الْجَنَّةِ

‘ক্বিয়ামতের দিন মানুষ এক উঁচু জায়গায় বন্দী থাকবে। অতঃপর (এক গায়েবী আওয়াজে) ঘোষণা হবে যে, মুত্তাক্বীরা কোথায়? তখন তারা পরম করুণাময়ের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে যাবে, (এমতাবস্থায়) আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিকট থেকে আড়ালে থাকবেন না এবং গোপনেও থাকবেন না। (রাবী) বললেন, তাঁকে (মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু)) বলা হল- কারা মুত্তাক্বী? তিনি বললেন, এমন সম্প্রদায়, যারা শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকে এবং তাঁদের ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক গণ্য করে। ফলে তারা জান্নাতে চলে যাবে’।[৫]

সুধী পাঠক! মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উক্ত বর্ণনার দ্বারা তিনি জাহমিয়াদের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। কেননা ক্বিয়ামতের দিন মুমিনদের আল্লাহর দিদার বা সাক্ষাৎ লাভকে জাহমিয়ারা অস্বীকার করে থাকে।

(৩) পথভ্রষ্ট বিদ‘আতী ফের্কা মুরজিয়াদের প্রতিরোধ

আসওয়াদ ইবনু হিলাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু) জনৈক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলেন,

اجْلِسْ بِنَا فَلْنُؤْمِنْ سَاعَةً ، فَيَجْلِسَانِ يَتَذَاكَرَانِ اللهَ وَيَحْمَدَانِهِ

‘আমাদের সাথে বসুন। আমরা কিছুক্ষণ ঈমান নবায়ন করি। অতঃপর তারা দু’জনে বসলেন এবং আল্লাহর যিকির ও তাঁর প্রশংসা করলেন’।[৬] সুফিয়ান (রাহিমাহুল্লাহ) আব্দুল মালিক ইবনু উমায়ের (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন,

ما ملاك أمرنا الذي نقوم به؟ قال: الإخلاص، وهي الفطرة والصلاة وهي الملة والسمع والطاعة وهي العصمة وسيكون بعدك اختلاف

‘আমাদের কোন্ ভিত্তির উপর নির্দেশ প্রদান করছেন, যার উপর আমরা প্রতিষ্ঠিত থাকব? তিনি বললেন, ইখলাছ তথা একনিষ্ঠতা। আর তা হল- স্বভাবগত বিষয়, ছালাত, মিল্লাত, শ্রবণ, আনুগত্য ও পবিত্রতা এবং তোমার পরে যে মতবিরোধ হবে সে ক্ষেত্রে (একনিষ্ঠতা অর্জন করতে হবে)’।[৭]

সুধী পাঠক! মুরজিয়াদের অন্যতম ভ্রান্ত আক্বীদা হল আমল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত নয়।[৮] অথচ উক্ত দু’টি বক্তব্যে মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর যিকির, তাঁর প্রশংসা ও প্রতিটি ক্ষেত্রে ইখলাছ অবলম্বনকে ঈমান বলে আখ্যায়িত করেছেন। মূলত তিনি মুরজিয়াদের ভ্রান্ত বিদ‘আতী আক্বীদার বিরোধিতা করেছেন।

২- উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) (মৃ. ১৯ হি.)

উবাই ইবনু কা‘ব ইবনু কায়স আল-আনসারী আল-খাযরাজী আলাল-বাদরী। তিনি বাদরী ছাহাবী ছিলেন। তিনি রাসূল (ﷺ)-এর যুগে কুরআন জমাকারীদের মধ্যে ছিলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তা পেশ করেন এবং তাঁর নিকট থেকে কুরআন হেফয করেন। তিনি ইলম ও আমলে অগ্রগামী ছিলেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমাকে কুরআন পড়ে শুনাতে। উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কি আপনাকে আমার নাম করে বলেছেন? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, হ্যাঁ। উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর নিকট কি আমি উল্লিখিত হয়েছি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, হ্যাঁ। তখন উবায় ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দুই চক্ষু হতে অশ্রু ঝরতে লাগল।

অপর বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তোমার নিকট لَمۡ  یَکُنِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ‘লাম ইয়াকুনিল্লা-যীনা কাফারু’ সূরা পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। তখন উবাই (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন,  আল্লাহ আমার নাম করেছেন কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি কেঁদে ফেললেন।[৯] অন্যত্র উবাই  ইবনু  কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে বললেন, হে আবুল মুনযির! তুমি কি জান যে, আল্লাহর কিতাবের মধ্যে তোমার জানা কোন্ আয়াতটি সর্বশ্রেষ্ঠ? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি আবার বললেন, হে আবুল মুনযির! তুমি কি জান যে, আল্লাহ্র কিতাবের মধ্যে তোমার জানা কোন্ আয়াতটি সর্বশ্রেষ্ঠ? এবার আমি বললাম, اَللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَۚ اَلۡحَیُّ الۡقَیُّوۡمُ ‘আল্লাহু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যূম’ অর্থাৎ আয়াতুল কুরসী। উবাই (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার বুকে আঘাত করে করলেন এবং বললেন, হে আবুল মুনযির! জ্ঞান তোমাকে পরিতৃপ্ত করুক।[১০]

উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) দ্বিতীয় আক্বাবায় উপস্থিত ছিলেন। উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে সাইয়িদুল মুসলিমীন তথা মুসলিমদের সরদার নামে ডাকতেন। তাঁর মৃতুর বছর নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেছেন ১৯ হি., কেউ ২২ হি. আবার কেউ ৩০ হিজরীর কথা বলেছেন। বিদ‘আত প্রতিরোধে তার অবদানও অনস্বীকার্য। যেমন,

বিদ‘আতী মতবাদ ক্বাদারিয়্যাদের ব্যাপারে উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অবস্থান সুস্পষ্ট। যেমন, ইবনুল দায়লামী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমার মনে এই তাক্বদীর সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহ দানা বাঁধে। তাই আমি এই ভেবে শঙ্কিত হই যে, তা আমার দ্বীন ও অন্যান্য কার্যক্রম নষ্ট করে দেয় কিনা। তাই আমি উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললাম, হে আবুল মুনযির! আমার মনে এই তাক্বদীর সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহ দানা বেঁধেছে, তাই আমি এই ভেবে শঙ্কিত হই যে, তা আমার দ্বীন ও অন্যান্য কার্যক্রমকে নষ্ট করে দেয় কিনা। অতএব এ সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন। আশা করি আল্লাহ তা দ্বারা আমার উপকার করবেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা ঊর্ধ্বলোকের ও ইহলোকের সকলকে শাস্তি দিতে চাইলে তিনি অবশ্যই তাদের শাস্তি দিতে পারেন। তথাপি তিনি তাদের প্রতি যুল্মকারী নন। আর তিনি তাদেরকে দয়া করতে চাইলে তাঁর দয়া তাদের জন্য তাদের কাজকর্মের চেয়ে কল্যাণময়। যদি তোমাদের নিকট উহূদ পাহাড় পরিমাণ বা উহূদ পাহাড়ের মত সোনা থাকত এবং তুমি তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে থাক, তবে তোমার সেই দান কবুল হবে না, যতক্ষণ যাবৎ তুমি তাক্বদীরের উপর ঈমান আনয়ন না কর। অতএব তুমি জেনে রাখো! যা কিছু তোমার উপর আপতিত হয়েছে তা তোমার উপর আপতিত হতে কখনো ভুল হত না এবং যা তোমার উপর আপতিত হওয়ার ছিল না তা ভুলেও কখনো তোমার উপর আপতিত হবে না। তুমি যদি এর বিপরীত বিশ্বাস নিয়ে মারা যাও তবে তুমি জাহান্নামে যাবে’।
আমি মনে করি তুমি আমার ভাই ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর নিকট গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে তোমার কোন ক্ষতি হবে না। (ইবনুদ দাইলামী বলেন), অতঃপর আমি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর নিকট এসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনিও উবাই (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অনুরূপ বললেন। তিনি আরো বললেন, তুমি হুযাইফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলে তোমার ক্ষতি নেই। অতঃপর আমি হুযাইফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনিও তাদের দু’জনের অনুরূপ বলেন। তিনি আরও বলেন, তুমি যায়দ ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট গিয়ে তাকেও জিজ্ঞেস কর। অতএব আমি যায়দ ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট এসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,

«لَوْ أَنَّ اللهَ عَذَّبَ أَهْلَ سَمَوَاتِهِ وَأَهْلَ أَرْضِهِ لَعَذَّبَهُمْ وَهُوَ غَيْرُ ظَالِمٍ لَهُمْ وَلَوْ رَحِمَهُمْ لَكَانَتْ رَحْمَتُهُ خَيْرًا لَهُمْ مِنْ أَعْمَالِهِمْ وَلَوْ كَانَ لَكَ مِثْلُ أُحُدٍ ذَهَبًا أَوْ مِثْلُ جَبَلِ أُحُدٍ ذَهَبًا تُنْفِقُهُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ مَا قَبِلَهُ مِنْكَ حَتَّى تُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ كُلِّهِ فَتَعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ وَمَا أَخْطَأَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيْبَكَ وَأَنَّكَ إِنْ مُتَّ عَلَى غَيْرِ هَذَا دَخَلْتَ النَّارَ».


‘আল্লাহ‌ তা‘আলা আসমান ও যমীনের সকল অধিবাসীকে শাস্তি দিতে চাইলে অবশ্যই তাদের শাস্তি দিতে পারবেন এবং তিনি তাদের প্রতি যুলমকারী নন। আর তিনি তাদের প্রতি দয়া করতে চাইলে তাঁর দয়া তাদের সমস্ত সৎ কাজের চাইতেও তাদের জন্য অধিক কল্যাণকর। তোমার নিকট উহূদ পাহাড় পরিমাণ সোনা থাকলেও এবং তুমি তা আল্লাহর পথে ব্যয় করলেও তিনি তা কবুল করবেন না, যতক্ষণ যাবৎ তুমি সম্পূর্ণরূপে তাক্বদীরের উপর ঈমান আনয়ন না কর। অতএব তুমি জেনে রাখো! তোমার উপর যা কিছু আপতিত হওয়ার আছে তা তোমার উপর আপতিত হয়েছে, তা কখনো ভুলেও এড়িয়ে যেত না এবং যা তোমার উপর আপতিত হওয়ার ছিল না, তা তোমার উপর ভুলেও কখনো আপতিত হত না। তুমি যদি এর বিপরীত বিশ্বাস নিয়ে মারা যাও তাহলে তুমি জাহান্নামে যাবে’।[১১]

সুধী পাঠক! এটা আক্বীদার ছহীহ বুঝ, যা ছাহাবায়ে কেরামকে বৈমিষ্ট্যমণ্ডিত করে। তাওহীদী আক্বীদার বিশুদ্ধ ইলমে তাদের কোন ঘাটতি ছিল না। কিন্তু বিদ‘আতীরা ছাহাবায়ে কেরামের উপর এই মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকে যে, এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞান নেই। অথচ এটা জ্ঞান না হলে আর কোন্টাকে জ্ঞান বলে? তাক্বদীরের ব্যাপারে উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সহ অন্যান্য ছাহাবীর যে বিশ্বাস ও বক্তব্য, তা দ্বারা তাক্বদীরকে অস্বীকারকারী ক্বাদারিয়্যাদের তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছে।

৩- আবূ যার গিফারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) (মৃ. ৩২ হি.)

আবূ যার গিফারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একজন বিখ্যাত ও সম্মানিত ছাহাবী ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে রাসূল (ﷺ)-এর মন্তব্য ছিল অতি উচ্চাঙ্গের। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, আবূযার গিফারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অপেক্ষা সত্যবাদী আর কাউকেই নীল আকাশ ছায়া দান করেনি এবং ধূলা-ধূসর যমীনও তার পৃষ্ঠে বহন করেনি।[১২] তিনি আবূ বকর, ‘উমার ও উছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর খেলাফতের সময়ে ফাতাওয়া প্রদান করতেন। তিনি একাধারে দুনিয়াবিমুখতা, সত্যবাদিতা, ইলম ও আমলে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। সর্বদা সত্য কথা বলা তাঁর চারিত্রিক ভূষণ। এ ব্যাপারে কারো কোন চোখ রাঙ্গানোকে তিনি পরোয়া করতেন না। তিনি ৩২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।[১৩]

রাফেযী শী‘আ আক্বীদার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : আবূ যার গিফারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বিদ‘আতের প্রতিবাদ করতেন। তিনি নিকৃষ্ট ও পথভ্রষ্ট মতবাদ রাফেযী (শী‘আদের) বিরোধিতামূলক বক্তব্য প্রদান করেন। সাঈদ ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু আবযা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি আবূ যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললাম,

لو أتيت برجل يسب أبا بكر عليه السلام ما كنت صانعا قال : اضرب عنقه قلت: فعمر قال: أضرب عنقه

‘যদি এমন কোন ব্যক্তি আগমন করে যে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে গালিগালাজ করে, তাহলে আপনি কী কববেন? তিনি বলেন, আমি তার গর্দান কেটে ফেলব। আমি উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কেও বলেছিলাম। তিনিও বলেন, আমি তার গর্দান কেটে ফেলব’।[১৪]

খারেজীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : আব্দুল্লাহ ইবনু ছামিত (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আবূ যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলেন,

يَا أَمِيْرَ المُؤْمِنِيْنَ! افْتَحِ البَابَ، لَا تَحْسَبُنِيْ مِنْ قَوْمٍ يَمْرُقُوْنَ مِنَ الدِّيْنِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ

‘হে আমীরুল মুমিনীন! দরজা খুলুন। আমাকে এমন লোক মনে করবেন না, যারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে গেছে যেমন তীর শিকারের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যায়’।[১৫]

৪- আবূ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) (মৃ. ৩২ হি.)

আবূ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর মূল নাম- ‘উয়াইমির ইবনু যায়েদ ইবনু কায়স। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একজন ছাহাবী ও দামেস্কের বিখ্যাত বিচারক ছিলেন। তিনি এই উম্মাহর একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি আর দামেস্কের ক্বারীদের প্রধান ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট থেকে অনেক হাদীছ বর্ণনা করেছেন। হিজরতের পরে সালমান ফারসী এবং তার মাঝে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ভ্রাতৃত্বের বন্ধন করে দিয়েছিলেন। ইসলাম ধ্বংসকারী বিদ‘আতের বিরুদ্ধে প্রখ্যাত এই ছাহাবীর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। তিনি হিজরী ৩২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।[১৬] নিম্নে তার ছিঁটেফোটা উল্লেখ করা হল:

১- হাসান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আবূ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

كن عالما أو متعلما أو مستمعا أو محبا، ولا تكن الخامسة فتهلك، قال: فقلت للحسن: من الخامسة قال: المبتدع

‘তুমি আলেম, শিক্ষক, শ্রোতা ও বন্ধু হও। তবে পঞ্চমটা হয়ো না, তাহলে তোমাকে ধ্বংস করে দিবে। রাবী বলেন, বলেন, আমি হাসান (রাহিমাহুল্লাহ)-কে বললাম, পঞ্চম কে? তিনি বললেন, বিদ‘আতী (হয়ো না)’।[১৭]

২- আবূ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

اقتصادٌ في سنّة خيرٌ مِن اجتهادٍ في بدعةٍ، إنَّك إنْ تتَّبعْ خيرٌ مِن أنْ تبتدع، ولن تخطئَ الطريقَ ما اتَّبعْتَ الأثرَ

‘একটি সুন্নাতের জন্য প্রচেষ্টা করা একটি বিদ‘আত করার চেয়ে উত্তম। বিদ‘আত করার চেয়ে (সুন্নাহর) অনুসরণ করা তোমার জন্য উত্তম। আর যতক্ষণ আপনি আছার তথা ছাহাবীদের বক্তব্যের অনুসরণ করবেন ততক্ষণ আপনি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হবেন না’।[১৮]

৩- উম্মুদ্দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

دَخَلَ عَلَيَّ أَبُو الدَّرْدَاءِ وَهُوَ مُغْضَبٌ فَقُلْتُ مَا أَغْضَبَكَ؟ قَالَ وَاللهِ مَا أَعْرِفُ مِنْ أَمْرِ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ ﷺ شَيْئًا إِلَّا أَنَّهُمْ يُصَلُّوْنَ جَمِيْعًا

‘একদা আবূ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাগান্বিত অবস্থায় আমার নিকট উপস্থিত হলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ জিনিস আপনাকে এত রাগান্বিত করল? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উম্মতের কোন বিষয় সম্পর্কে অবগত নয়, তবে তাদের সকলে একত্রে ছালাত আদায় করা ব্যতীত।[১৯] অর্থাৎ শরঈ আমলের মধ্যে কেবল ছালাত ব্যতীত কোন আমলই সঠিকভাবে পালিত হত না।

৪- আবূ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

لَا تَهْلَكُ أُمَّةٌ حَتَّى يَتَّبِعُوْا أَهْوَاءَهُمْ وَيَتْرُكُوْا مَا جَاءَتْهُمْ بِهِ أَنْبِيَاؤُهُمْ مِنْ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى

‘কোন জাতি ধ্বংস হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের কামনা-বাসনার অনুসরণ করে এবং তাদের নবীগণ তাদের কাছে যে দলীল ও হেদায়াত নিয়ে এসেছেন তা পরিত্যাগ না করে’।[২০]

৫- মুরজিয়াদের ভ্রান্ত চিন্তা-চেতনার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, اَلْإِيْمَانُ يَزْدَادُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান বাড়ে ও কমে’।[২১] কেননা মুরজিয়ারা ঈমান বাড়ে ও কমে আক্বীদায় বিশ্বাসী নয়।

৬- ক্বাদারিয়্যাদের বিরোধিতা করে তিনি বলেন,

ذُرْوَةُ الْإِيْمَانِ أَرْبَعُ الصَّبْرِ لِلْحُكْمِ، وَالرَّضَا بِالْقَدْرِ، وَالْإِخْلَاصِ لِلتَّوَكُّلِ، وَالْاِسْتِسْلَامِ لِلرَّبَّ

‘ঈমানের সর্বোচ্চ চূড়া চারটি। যথা : শাসনের জন্য ধৈর্য, তাক্বদীর বা ভাগ্যের প্রতি সন্তুষ্টি, আস্থার প্রতি আন্তরিকতা এবং প্রভুর কাছে আত্মসমর্পণ’।[২২]

৫- আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৩২ হি.)

আব্দুর রহমান ইবনু আওফ ইবনু আওফ ইবনু আব্দুল হারিছ ইবনু যাহরাহ আবূ মুহাম্মাদ। জাহেলী যুগে তাঁর নাম ছিল আব্দু আমর অথবা আব্দুল কা‘বা। নবী (ﷺ) তাঁর নাম রাখেন আব্দুর রহমান। তিনি কা‘বা হস্তি বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার দশ বছর পরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি মজলিসে শুরার দশ জন ও ছয় জনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বদরী ছাহাবীদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম সারীর একজন এবং নবী করীম (ﷺ)-এর দারুল আরক্বামে প্রবেশে পূর্বে যে দশজন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তিনি তার মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন প্রথম হিজরতকারীদের একজন। দুই হিজরতকে একত্রিত করেছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি আবিসিনিয়ার ভূমিতে হিজরত করেন, তারপর তিনি হিজরতের আগে আসেন এবং মদীনায় হিজরত করেন এবং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তাঁর সাথে সা‘দ ইবনুর রাবী‘ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দেন। এতদ্ভিন্ন তিনি বদর যুদ্ধে উপস্থিত থেকে সমস্ত দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে দূমাতুল জান্দালে কলব গোত্রে পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা বিজয় দান করেছিলেন। অতঃপর সেখানার বাদশার মেয়ে তামাযুর বিনতে আছবাগকে বিবাহ করেন। তিনি রাসূল (ﷺ) ও উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর নিকট থেকে তাঁর সন্তানগণ, ইবরাহীম, হামীদ, উমার, মুছ‘আব প্রমুখ ছাহাবী হাদীছ বর্ণনা করেছেন। রাসূল (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় তিনি তাঁর সমুদয় সম্পত্তির অর্ধেক ৮০ হাজার দীনার ছাদাক্বাহ করে দেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর রাস্তায় পাঁচশ’ ঘোড়া অর্পণ করেন। তারপর তিনি আল্লাহর আল্লাহর রাস্তায় পাঁচশ’ উট অর্পণ করেন। আর তাঁর অধিকাংশ অর্থই ছিল ব্যবসা থেকে। তিনি ৭২ বছর বয়সে ৩২ হিজরীতে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে বাকীয়ে গারক্বাদে দাপন করা হয় এবং উছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর জানাযার ছালাত আদায় করান।[২৩]

সুধী পাঠক! এই জালীলুল ক্বদর ছাহাবী আল-কুরআন ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। এভাবে কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীতে তিনি বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেমন, আরূবাহ আস-সাদূসিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

لقيت عبد الرحمن -تعني ابن عوف- فقلت: ما أعظم الإسلام؟ فقال: إقام الصلاة وإيتاء الزكاة واسألي إن بقيت، فسيأتي زمان تذهب العرب ويجيء ناس من الإسحاقية فيجيئون بأقذار من الدين فإذا رأيتيهم فتمسكي بالقرآن والسنة

আমি আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে জিজ্ঞেস করি যে, ইসলামের সবচেয়ে বড় স্তর কোন্টি? তিনি বলেন, ছালাত কায়েম করা, যাকাত দেয়া এবং বাকীগুলো তিনি আমাকে বললেন। অতঃপর এমন এক সময় আসবে যখন আরবরা চলে যাবে এবং ইসহাকিয়ার লোকেরা আসবে। তারা দ্বীন থেকে কলুষতা তথা বিদ‘আত নিয়ে আসে। সুতরাং আপনি যদি তাদের দেখতে পান তবে আল-কুরআন এবং সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে থাকুন’।[২৪]

রাফেযী (শী‘আদের) প্রতিরোধে তিনি ভূমিকা পালন করেছেন। আফলাহ ইবনু সা‘আদ ইবনু কা‘ব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

وَاللهِ مَا بَايَعْتُ لِعُثْمَانَ حَتَّى سَأَلْتُ صِبْيَانَ الْكِتَابِ فَقَالُوْا عُثْمَانَ خَيْرٌ مِّن عَلِيٍّ

‘আল্লাহর কসম! আমি উছমানের আনুগত্য করিনি যতক্ষণ না আমি কিতাবের ছেলেদের জিজ্ঞাসা করি এবং তারা বলে, উছমান আলীর চেয়ে উত্তম’।[২৫]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. তিরমিযী, হা/৩৭৯০; ইবনু মাজাহ, হা/১৫৪; মিশকাত, হা/৬১১১, সনদ ছহীহ।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮০৮, ৪৯৯৯; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৬৪।
[৩]. আবূ সাহল মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান আল-মাগরাভী, মাওসূ‘আতু মাওয়াক্বিফুস সালাফ ফিল ‘আক্বীদাতি ওয়াল মানহাজি ওয়াত তারবিয়াহি (কায়রো: আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, তাবি), পৃ. ২৭।
[৪]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬১১; হাকিম, আলÑমুসতাদরাকু ‘আলাছ ছহীহাইন, হা/৮৪২২, মাওকূফ সূত্রে ছহীহ।
[৫]. লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৯৯; শামসুদ্দীন আবুল আওন মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু সালিম আস-সাফফারীনী আল-হাম্বালী, লাওয়ামিঊল আনওয়ার আল-বাহিয়্যাহ ওয়া সাওয়াতিঊল আসরার আল-আছরিয়্যাহ (দামেস্ক : মুওয়াসসাসাতুল খাফিক্বীন ওয়া মাকতাবিহা, ২য় সংস্করণ, ১৪০২ হি./১৯৮২ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৪।
[৬]. মুছান্নাফু ইবনু আবী শায়বা, হা/৩০৩৬৫, সনদ ছহীহ।
[৭]. আবূ আব্দিল্লাহ ওবাইদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু বাত্তাহ আল-‘আবকারী আল-হাম্বালী, আল-ইবানাহ আন শারী‘আতিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াহ ওয়া মুজানিবাতিল ফিরাক্বিল মাযমূমাহ (রিয়াদ : দারুল রাইয়াহ, ২য় সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৯৮।
[৮]­. ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিয়াহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭৩৬।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮০৯; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৯৯; মিশকাত, হা/২১৯৬।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮১০; মিশকাত, হা/২১২২।
[১১]. ইবনু মাজাহ, হা/৭৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৬২৯, সনদ ছহীহ।
[১২]. তিরমিযী, হা/৩৮০১; মিশকাত, হা/৬২২৯, সনদ হাসান।
[১৩]. মাওসূ‘আতু মাওয়াক্বিফুস সালাফ ফিল ‘আক্বীদাতি ওয়াল মানহাজি ওয়াত তারবিয়াহি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭০।
[১৪]. মাওসূ‘আতু মাওয়াক্বিফুস সালাফ ফিল ‘আক্বীদাতি ওয়াল মানহাজি ওয়াত তারবিয়াহি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৪।
[১৫]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, ২য় খণ্ড (বৈরূত: মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় সংস্করণ, ১৪০৫ হি./১৯৮৫ খ্রি.), পৃ. ৭১।
[১৬]. মাওসূ‘আতু মাওয়াক্বিফুস সালাফ ফিল ‘আক্বীদাতি ওয়াল মানহাজি ওয়াত তারবিয়াহি, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৬-১১৭।
[১৭]. আল-ইবানাহ আন শারী‘আতিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াহ ওয়া মুজানিবাতিল ফিরাক্বিল মাযমূমাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪১।
[১৮]. আব্দুল মুহসিন ইবনু হামাদ আল-‘আব্বাদ আল-বদর, ক্বাত্বফুল জানিইয়িদ দানী, পৃ. ১৮১।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫০; মিশকাত, হা/১০৭৯।
[২০]. ইমাম আহমাদ ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৬৩।
[২১]. ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আস-সুন্নাহ (দাম্মাম: দারু ইবনিল ক্বাইয়িম, ১ম সংস্করণ, ১৪০৬ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৪, আছার নং-৬২৩।
[২২]. লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৭৬, আছার নং-১২৩৮।
[২৩]. মাওসূ‘আতু মাওয়াক্বিফুস সালাফ ফিল ‘আক্বীদাতি ওয়াল মানহাজি ওয়াত তারবিয়াহি, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৪-১২৫।
[২৪]. আল-ইবানাহ আন শারী‘আতিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াহ ওয়া মুজানিবাতিল ফিরাক্বিল মাযমূমাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪১।
[২৫]. মাওসূ‘আতু মাওয়াক্বিফুস সালাফ ফিল ‘আক্বীদাতি ওয়াল মানহাজি ওয়াত তারবিয়াহি, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৫।




তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ এবং তার প্রতিদান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৯ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
হজ্জ ও ওমরার সঠিক পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
আল-কুরআনের ব্যাপারে অমুসলিমদের মিথ্যা অভিযোগ ও তার খণ্ডন - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আল-কুরআন সম্পর্কে অমুসলিম মনীষীদের মূল্যায়ন - রাফিউল ইসলাম
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
বিদ‘আত পরিচিতি - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের ঈমান বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ঈমান : একটি পর্যালোচনা - ড. আব্দুল্লাহিল কাফী বিন লুৎফর রহমান মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি (১১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১০ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ