মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১১:০৮ পূর্বাহ্ন

ইখলাছই পরকালের জীবনতরী

-আব্দুল গাফফার মাদানী*


ইখলাছ হল দ্বীনের মূল ভিত্তি ও সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ। এটি ছাড়া বান্দার ইসলাম অসম্পূর্ণ। ইখলাছ ছাড়া আল্লাহ কোন ফরয বা নফল ইবাদত কবুল করেন না। তাই মুমিন জীবনে ইখলাছের গুরুত্ব সর্বাগ্রে।

ইখলাছ (اَلْإِخْلَاصُ) শব্দটি আরবী। এটি أَخْلَصَ ক্রিয়ামূল থেকে উদ্ভূত, যা বাবে إِفْعَالْ এর মাছদার। আভিধানিক অর্থ- تَصْفِيَةُ الشَّيْئِ وَتَنْقِيَتُهُ ‘কোন বস্তুকে পরিষ্কার করা বা স্বচ্ছ করা’। যেমন বলা হয়-

خَلَّصُ الشَّيْئِ مِنَ الشَّرَائِبِ إِذَا صَفَا وَخَلَّصَهُ أَزَالَ عَنْهُ مَا يَكْدُرُهُ

‘সংমিশ্রিত বস্তু থেকে কোন বস্তুকে মুক্ত করা হলে সেটা খাঁটি বা নির্ভেজাল হয়’।[১] অতএব, اَلْإِخْلَاصُ অর্থ হল- খাঁটি করা, বিশ্বস্ত হওয়া, নিবেদিত হওয়া ও আন্তরিক হওয়া।[২]

ইখলাছের পারিভাষিক অর্থ, هُو قَصْدٌ لِمَعْبُوْدٍ وَحْدَهُ بِالْعِبَادِةِ ‘ইবাদতের মাধ্যমে শুধু আল্লাহকেই সংকল্প করা’। আল্লাহ বলেন, وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ  رَبِّہٖۤ  اَحَدًا  ‘আর সে যেন তাঁর রবের ইবাদতের ক্ষেত্রে কাউকে শরীক না করে’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ১১০)।

মুহাম্মদ আত-তাহের ইবনু ‘আশূর (রাহিমাহুল্লাহ) (১২৯৬-১৩৯৩ হি./১৮৭৯-১৯৭৩ খ্রি.) বলেন,

أَنْ يَّكُوْنَ الدَّاعِىْ إِلَى الْإِتْيَانِ بِالْمَأْمُوْرِ وَإِلَى تَرْكِ الْمَنْهِىِّ إِرْضَاءً لِله تَعَالَى

‘নির্দেশিত কাজ সম্পাদন ও নিষেধকৃত কাজ বর্জন করার মুখ্য উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি হওয়াকে ইখলাছ বলে’।[৩]

ইসলামে ইখলাছের অবস্থান

ইখলাছ হচ্ছে দ্বীনের মূল বস্তু। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  وَ مَاۤ  اُمِرُوۡۤا  اِلَّا لِیَعۡبُدُوا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ  الدِّیۡنَ ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহ্র আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে’ (সূরা আল-বাইয়েনাহ: ৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

قُلۡ  اِنِّیۡۤ  اُمِرۡتُ اَنۡ  اَعۡبُدَ اللّٰہَ  مُخۡلِصًا  لَّہُ الدِّیۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন! আমি তো আদিষ্ট হয়েছি আল্লাহর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ইবাদত করতে’ (সূরা আয-যুমার: ১১)।  তিনি আরো বলেন,

فَاعۡبُدِ اللّٰہَ  مُخۡلِصًا لَّہُ  الدِّیۡنَ- اَلَا لِلّٰہِ الدِّیۡنُ الۡخَالِصُ

‘সুতরাং আপনি আল্লাহর ইবাদত করুন তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে। জেনে রাখুন অবিমিশ্র আনুগত্য একমাত্র আল্লাহ্রই প্রাপ্য’ (সূরা আয-যুমার: ২-৩)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, وَ مَاۤ  اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ  اِلَّا نُوۡحِیۡۤ  اِلَیۡہِ اَنَّہٗ  لَاۤ  اِلٰہَ  اِلَّاۤ  اَنَا فَاعۡبُدُوۡنِ ‘আমরা তো আপনার পূর্বে এমন কোন রাসূল প্রেরণ করিনি, যার প্রতি এই অহী ব্যতীত যে, আমি ব্যতীত সত্য কোন ইলাহ নেই; সুতরাং আমারই ইবাদত কর’ (সূরা আল-আম্বিয়া: ২৫)।

ইখলাছ হল নবী-রাসূলগণের দাওয়াতের চাবি, যা নিয়ে তাঁরা প্রেরিত হয়েছিলেন। তাদের দাওয়াতের এটিই ছিল মহান মূলনীতি। আল্লাহ বলেন, وَ لَقَدۡ بَعَثۡنَا فِیۡ کُلِّ اُمَّۃٍ  رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ  وَ اجۡتَنِبُواالطَّاغُوۡتَ ‘আল্লাহর ইবাদত করার ও ত্বাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি’ (সূরা আন-নাহল: ৩৬)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে মানব জাতির কল্যাণে নবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। এ পৃথিবীর বুকে শিরকের প্রচলনকারী জাতির নিকট আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম রাসূল হিসাবে নূহ (আলাইহিস সালাম)-কে প্রেরণ করেছিলেন। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মাধ্যমে সে মিশনের পরিসমাপ্তি ঘটে। সকল নবী-রাসূলই তাদের জাতিদের ইখলাছের সাথে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছেন’।[৪]

অন্তরের আমলের মেরুদণ্ড হল ইখলাছ, যার ফলে বান্দার আমলগুলোর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৯১-৭৫১ হি.) আরো সুস্পষ্ট করে বলেন, ‘অন্তরের আমল হচ্ছে ইবাদতের রূহ ও শ্রেষ্ঠাংশ। যখন দৈহিক আমল তা থেকে মুক্ত হবে, তখন সেটা রূহ ব্যতীত মৃত দেহের ন্যায় পরিগণিত হয়। আর নিয়তই হচ্ছে অন্তরের আমল’।[৫] তিনি আরো বলেন, ‘প্রকৃত পক্ষে দৈহিক ইবাদত নিয়তের অনুগামী ও পরিপূরক। কেননা নিয়তটা হচ্ছে রূহের স্থলাভিষিক্ত এবং আমল হচ্ছে দেহের ন্যায়। যেমনভাবে শরীর থেকে আত্মা বের হয়ে গেলে তার কোন মূল্য নেই, তেমনই নিয়ত ব্যতীত কোন আমল করলে তা অনর্থক। তাই দৈহিক বিধিবিধান জানার চেয়ে আত্মীক (অন্তর সংশ্লিষ্ট) বিধি-বিধান জানা অধিকতর যরূরী। অতএব নিয়ত হল আসল আর আমল হল তার শাখা। অন্তরের আমল দৈহিক আমলের চেয়ে অধিকতর বড় ফরয। কেননা একজন মুমিনকে মুনাফিক্ব থেকে অন্তরের আমল ব্যতীত বাছাই করা কি সম্ভব? আর অন্তরের আমলের পরিশুদ্ধতা ছাড়া শুধু দৈহিক আমলের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে মুসলিম মনে হলেও আল্লাহর দরবারে সে মুসলিম হিসাবে স্বীকৃতলাভ করবে না। এই কারণেই অন্তরের ইবাদত দৈহিক ইবাদতের চেয়ে সুমহান, বরং ওয়াজিব। এজন্য সর্বদা অন্তরের ঈমান থাকা ওয়াজিব এবং কিছ কিছু সময়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ইসলাম থাকা ওয়াজিব। তাই ঈমানের ঘাঁটি হল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ’।[৬]

রাসূল (ﷺ) বলেন, إِنَّ اللهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পাদিত ও খাঁটি আমল ছাড়া অন্য কোন আমল কবুল করেন না’।[৭]

আল্লাহ তা‘আলা এ গুণে গুণান্বিতদের প্রশংসা করেছেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে তিনি বলেন, وَ اذۡکُرۡ فِی الۡکِتٰبِ مُوۡسٰۤی ۫ اِنَّہٗ  کَانَ مُخۡلَصًا وَّ کَانَ رَسُوۡلًا  نَّبِیًّا ‘স্মরণ করুন এই কিতাবে মূসার কথা, তিনি ছিলেন বিশেষ মনোনীত এবং তিনি ছিলেন রাসূল ও নবী’ (সূরা মারইয়াম: ৫১)।

ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, کَذٰلِکَ لِنَصۡرِفَ عَنۡہُ السُّوۡٓءَ  وَ الۡفَحۡشَآءَ ؕ اِنَّہٗ  مِنۡ  عِبَادِنَا الۡمُخۡلَصِیۡنَ ‘আমরা তাকে মন্দকর্ম ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখার জন্যই এভাবে নির্দেশ দিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন আমার বিশুদ্ধচিত্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা ইউসুফ: ২৪)।

মুহাম্মদ (ﷺ) সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلۡ اَتُحَآجُّوۡنَنَا فِی اللّٰہِ وَ ہُوَ رَبُّنَا وَ رَبُّکُمۡ ۚ وَ لَنَاۤ اَعۡمَالُنَا وَ لَکُمۡ اَعۡمَالُکُمۡ ۚ وَ نَحۡنُ لَہٗ  مُخۡلِصُوۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন! আল্লাহর ব্যাপারে তোমরা কি আমাদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও? অথচ তিনি আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক! আমাদের কর্মসমূহ আমাদের এবং তোমাদের কর্মসমূহ তোমাদের এবং তাঁর প্রতি আমরা একনিষ্ঠ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৩৯)। উক্ত আয়াতগুলো থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, ইখলাছ হচ্ছে নবী ও রাসূলগণের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ও নিদর্শন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইখলাছমুক্ত আমল করবে তার জন্য পরকালে অতি ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ বলেন,

وَ قَدِمۡنَاۤ اِلٰی مَا عَمِلُوۡا مِنۡ عَمَلٍ فَجَعَلۡنٰہُ  ہَبَآءً  مَّنۡثُوۡرًا

‘আমরা তাদের কৃতকর্মের প্রতি লক্ষ্য করব, অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (সূরা আল-ফুরক্বান: ২৩)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,اِنَّ اللّٰہَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِہٖ وَ یَغۡفِرُ  مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করা ক্ষমা করেন না। এ ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন’ (সূরা আন-নিসা: ৪৮)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৯১-৭৫১ হি.) বলেন, ‘ঐ সমস্ত আমল, যেগুলো সুন্নাত অনুপাতে ছিল না অথবা তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি কাম্য ছিল না’।[৮]

ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেন, ‘ঐ সব মুশরিকদের আমল, যেগুলোকে তারা মনে করত এই আমলগুলো তাদের নাজাতের মাধ্যম হবে। অথচ সেগুলো গ্রহণযোগ্য শারঈ শর্ত মোতাবেক ছিল না।[৯] শর্ত দু’টি হল, ইখলাছ ও রাসূল (ﷺ)-এর নিঃশর্ত অনুসরণ। হাদীছে কুদসীতে এসেছে,

أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِي غَيْرِي تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ

‘আমি শিরককারীদের শিরক হতে মুক্ত। যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল, যাতে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করল, তাহলে আমি তাকে ও তার শিরককে পরিত্যাগ করলাম’।[১০] অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেন,

مَنْ طَلَبَ العِلْمَ لِيُجَارِيَ بِهِ العُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوْهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ

‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করে আলেমদের উপর গৌরব করার জন্য অথবা জাহেল-মূর্খদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করার জন্য অথবা মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করাবেন’।[১১] তাই প্রত্যেক প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ইবাদতে ইখলাছ হচ্ছে মৌলিক অনুষঙ্গ। ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৯১-৭৫১ হি.) ইখলাছের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে বলেন, ‘ইখলাছ বিহীন আমল ঐ মুসাফিরের ন্যায়, যে তার ব্যাগ বালি দ্বারা পূর্ণ করে বহন করে, অথচ তা তার কোন উপকারে আসে না’।[১২]

ইখলাছের প্রয়োজনীয়তা

ইখলাছের গুরুত্ব সুস্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কেন যেন নফসের উপর এটি সবচেয়ে কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ইখলাছ ও প্রবৃত্তি নফসের মাঝে ঘুর্ণায়মান। তাই ইখলাছ বাস্তবায়ন করতে এবং অটুট রাখতে প্রয়োজন অঢেল সাধনা ও বিরামহীন প্রচেষ্টা। আর এই প্রচেষ্টা শুধু জনসাধারণের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং আলেম-ওলামা, আবেদ, জনসাধারণ সকলেই এর মুখাপেক্ষী। সুফিয়ান ছাওরী (রাহিমাহুল্লাহ) (৭১৬-৭৭৮ হি.) বলেন,مَا عَالَجْتُ شَيْئًا أَشَدُّ عَلَيَّ مِنْ نِيَّتِي إِنَّهَا تَقَلَّبُ عَلَيَّ ‘আমার নিয়তের চেয়ে অধিকতর কঠিন কোন বিষয় সংশোধনের চেষ্টা করিনি, কারণ তা আমার বিপরীত হয়’।[১৩]  ইউসুফ ইবনুল হুসায়ন আল-রাযী (১৮৮২-১৯২৭ খ্রি.) বলেন,

أَعَزُّ شَيْءٍ فِي الدُّنْيَا الْإِخْلَاصُ وَكَمْ أَجْتَهِدُ فِيْ إِسْقَاطِ الرِّيَاءِ عَنْ قَلْبِي وَكَأَنَّهُ يَنْبُتُ فِيْهِ عَلَى لَوْنٍ آخَرَ

‘পৃথিবীর বুকে সর্বোৎকৃষ্ট বস্তু হল ইখলাছ। আমি কতই না চেষ্টা করেছি আমার অন্তর থেকে রিয়া দূর করতে। কিন্তু সেটি অন্যরূপে আবার তাতে আবির্ভুত হয়’।[১৪] ইউসুফ ইবনু আসবাত্ব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, تَخْلِيْصُ النِّيَّةِ مِنْ فَسَادِهَا أَشَدُّ عَلَى الْعَامِلِيْنَ مِنْ طُوْلِ الِاجْتِهَادِ ‘আমলকারীদের উপর নিয়তকে তার বিভ্রান্তি থেকে স্বচ্ছ রাখা দীর্ঘ পরিশ্রম করার চেয়েও সর্বাধিক কঠিন’।[১৫]

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুর্তারাফ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, تَخْلِيْصُ الْنِّيَّةِ أَشَدُّ مِنْ تَخْلِيْصِ الْعَمَلِ ‘নিয়ত পরিশুদ্ধ করা আমল পরিশুদ্ধ করার চেয়ে অধিক কঠিন’।[১৬] একদা সাহল ইবনু আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হল যে, আপনার উপর কোন্ বস্তু সর্বাপেক্ষা কঠিন? উত্তরে তিনি বলেন, ইখলাছ। অতঃপর তিনি বলেন, اَلنَّفْسُ اَلْأمَّارَةُ بِالسُّوْءِ ‘বান্দার ইখলাছ বিকৃত করে, যা তুমি স্বচক্ষে দেখতে পাও’।[১৭] এ কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেশি বেশি নিম্নোক্ত দু‘আটি পাঠ করতেন। يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِىْ عَلَى دِيْنِكَ ‘হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আপনি আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর অটল রাখুন’।[১৮] রাসূল (ﷺ) শপথের সময়েও এ দু‘আটি পাঠ করতেন, لَا وَمُقَلِّبِ الْقُلُوْبِ ‘(ইহার বিপরীত) নয়, অন্তরের পরিবর্তনকারীর কসম’।[১৯]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* শিক্ষক, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. আহমাদ ইবনু ফারেস ইবনু যাকারিয়া আল-ক্বাযভীনী আর-রাযী, তাহক্বীক্ব : আব্দুস সালাম মুহাম্মাদ হারূন, মু‘জামু মাক্বায়িসিল লুগাহ (দারুল ফিকর, ১৩৯৯ হি./১৯৭৯ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৮।
[২]. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আল-মু‘জামুল ওয়াফী (আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান), (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ১১তম সংস্করণ, ২০০২ খ্রি.), পৃ. ৫৫।
[৩]. মুহাম্মাদ আত-তাহের ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ‘আশূর, আত-তাহরীর ওয়াত তানবীর (দারুত তিউনেশিয়া, ১৯৮৪ হি.), ২৩শ খণ্ড, পৃ. ৩৮।
[৪]. আবুল ফিদা মুহাম্মাদ ইসমাঈল ইবনু কাছীর আদ-দিমাস্কী, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (দারু তাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫৭০।
[৫]. মুহাম্মাদ ইবনু আবূবকর শাসসুদ্দীন ইবনু ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ, বাদাইঊল ফাওয়ায়েদ (বৈরূত : দারুল কিতাবিল আরাবী, তাবি), ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৯২।
[৬]. বাদাইউল ফাওয়ায়েদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৮৭-১৯৩।
[৭]. সুনানুন নাসাঈ, হা/৩১৪০; সনদ ছহীহ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৩৩১; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৫২।
[৮]. মুহাম্মাদ ইবনু আবুবকর শামসুদ্দীন ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ আল-মু‘তাছিম বিল্লাহ আল-বাগদাদী, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত : দারুল কিতাবিল আরাবী, ৩য় সংস্করণ, ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৯।
[৯]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১০৩।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৮৫।
[১১]. তিরমিযী, হা/২৬৫৪, সনদ ছহীহ।
[১২]. মুহাম্মাদ ইবনু আবূবকর শামসুদ্দীন ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ, আল-ফাওয়ায়েদ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ, ১৩৯৩ হি./১৯৭৩ খ্রি.), পৃ. ৪৯।
[১৩]. আবূবকর আহমাদ ইবনু আলী আল-খত্বীব আল-বাগদাদী, ড. মাহমূদ আত-ত্বাহহান, আল-জামি‘ঊ লিআখলাক্বির রাবী ওয়া আদাবিস সামি‘ (রিয়ায : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, তাবি), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৭।
[১৪]. যায়নুদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনু আহমাদ ইবনু রজব আল-বাগদাদী, তাহক্বীক্ব : শু‘আয়ব আরনাঊত্ব, জামি‘ঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম ফী শারহি খামসীনা হাদীছান মিন জাওয়ামিঈল কালাম (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ৭ম সংস্করণ, ১৪২২ হি./২০০১ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৪।
[১৫]. জামি‘ঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম ফী শারহি খামসীনা হাদীছান মিন জাওয়ামিঈল কালাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭০।
[১৬]. আবূ নু‘আইম আহমাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আল-ইস্পাহানী, হিলইয়াতুল আওলিয়া ওয়া ত্ববাক্বাতুল আছফিয়া (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, ১৪০৯ হি.),  ১০ম খণ্ড, পৃ. ১২১।
[১৭]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ, আর-রূহ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি,) পৃ. ৩৯২ ।
[১৮]. তিরমিযী, হা/২১৪০; মিশকাত, হা/১০২; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২০৯১, সনদ হাসান।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬১৭।




প্রসঙ্গসমূহ »: আত্মশুদ্ধি
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৮ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবূ সাঈদ
বিদ‘আত পরিচিতি (৭ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন (শেষ কিস্তি) - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৩য় কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ঈদে মীলাদুন্নবী : একটি পর্যালোচনা - আল-ইখলাছ ডেস্ক
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
আশূরায়ে মুহাররম - আল-ইখলাছ ডেস্ক
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
বিদ‘আত পরিচিতি (১৫তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ