অহংকার করা ও তার পরিণাম
-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
অহংকার মানব জীবনের এক জঘন্য স্বভাব, যা মানুষে আত্মোপলব্ধিকে ভুলিয়ে দেয়। মানুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও অন্যকে হেয় জ্ঞান করতে থাকে। ব্যক্তির হৃদয়ে আমিত্ববোধ প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। কথায় কথায় বলতে থাকে এটা আমি করেছি, ওটা আমি করেছি, এসব আমারই করা ইত্যাদি। প্রতিটা কর্মে নিজের বড়ত্ব প্রকাশের চেষ্টা করে। কোনো কোনো কাজে অন্যেরও অবদান রয়েছে তা সে ভুলে যায়। কর্মে অন্যের অবদানকে অস্বীকার করে। এজন্য অহংকার করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এমর্মে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেন,لَاجَرَمَ اَنَّ اللّٰہَ یَعۡلَمُ مَا یُسِرُّوۡنَ وَ مَا یُعۡلِنُوۡنَ ؕ اِنَّہٗ لَا یُحِبُّ الۡمُسۡتَکۡبِرِیۡنَ ‘এটা নিঃসন্দেহ যে, আল্লাহ জানেন যা তারা গোপন করে এবং যা তারা প্রকাশ করে; তিনি অহংকারীকে পছন্দ করেন না’ (সূরা আন-নাহল : ২৩)।
অহংকার বর্জন করা আল্লাহর নির্দেশ
অহংকারী স্বভাব কোনো মানুষের মধ্যে থাকা উচিত নয়। এ স্বভাব মানুষের ভালো গুণগুলো নষ্ট করে দেয়। মানুষকে অহংকারমুক্ত জীবনযাপন করতে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন। এমর্মে এরশাদ হচ্ছে- وَ لَا تَمۡشِ فِی الۡاَرۡضِ مَرَحًا ۚ اِنَّکَ لَنۡ تَخۡرِقَ الۡاَرۡضَ وَ لَنۡ تَبۡلُغَ الۡجِبَالَ طُوۡلًا ‘তুমি পৃথিবীতে অহংকার করে চলো না। নিশ্চয় তুমি যমীনকে ধ্বংস করতে পারবে না এবং পাহাড়ের উচ্চতায়ও পৌঁছতে পারবে না’ (সূরা বনী ইসরাঈল : ৩৭)। লুক্বমান (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় সন্তানকে যমীনে অহংকার মুক্তভাবে চলতে বলেছিলেন। আল্লাহ সে নির্দেশনা কুরআন মাজীদে তুলে ধরেছেন।
وَ لَا تُصَعِّرۡ خَدَّکَ لِلنَّاسِ وَ لَا تَمۡشِ فِی الۡاَرۡضِ مَرَحًا ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یُحِبُّ کُلَّ مُخۡتَالٍ فَخُوۡرٍ
‘অহংকারবশত তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে অহংকার করে বিচরণ করো না, কারণ আল্লাহ কোনো অহংকারীকে পছন্দ করেন না’ (সূরা লুক্বমান : ১৮)।
অহংকার থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মানুষের জন্য আবশ্যিক। মানুষের অহংকার করার কী-বা রয়েছে। সামান্য এক বিন্দু পানি থেকে মানুষের জন্ম। মানুষ সৃষ্টিগতভাবে খুবই দুর্বল। সে তো আর যমীনকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে না। কোনো উপকরণ ব্যতীত কিছু তৈরি করতে পারে না। বিধায় মানুষের জন্য অহংকার করা সাজে না। তাই আল্লাহ মানুষকে অহংকারী স্বভাব বর্জন করতে বলেছেন। কেননা তিনি অহংকারীকে ভালোবাসেন না।
অহংকারী ব্যক্তি অতিশয় জঘন্য
অহংকারী ব্যক্তিরা অত্যন্ত জঘন্য প্রকৃতির মানুষ। এ স্বভাবের মানুষকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ ثَلَاثُ مُنَجِّيَاتٍ وَثَلَاثُ مُهْلِكَاتٍ فَأَمَّا الْمُنَجِّيَاتُ فَتَقْوَى اللهِ فِي السِّرِ وَالْعَلَانِيَةِ وَالْقَوْلُ بِالْحَقِّ فِي الرِّضَا وَالسَّخْطِ وَالْقَصْدِ فِي الْغِنَى وَالْفَقْرِ وَأَمَّا الْمُهْلِكَاتُ فَهَوَى مُتَّبِعٌ وَشُحُّ مُطَاعٍ وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِهِ وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘তিনটি জিনিস মুক্তিদানকারী এবং তিনটি জিনিস ধ্বংসসাধনকারী। মুক্তিদানকারী জিনিসগুলো হল, প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহকে ভয় করা। খুশী ও অখুশী উভয় অবস্থায় সত্য কথা বলা এবং ধনী ও দরিদ্র উভয় অবস্থায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। আর ধ্বংসসাধনকারী জিনিসগুলো হল, প্রবৃত্তির অনুসারী হওয়া, লোভ-লালসার দাস হওয়া বা কৃপণ হওয়া এবং কোনো ব্যক্তির আত্ম অহমিকায় লিপ্ত হওয়া এবং তাহল সর্বাপেক্ষা জঘন্য’।[১]
মানুষকে তিনটি জিনিস ধ্বংস করে দেয়, তাহল- প্রবৃত্তির অনুসরণ, লোভ-লালসা ও অহংকার। তন্মধ্যে অহংকার ধ্বংস করার দিক দিয়ে সবচেয়ে জঘন্য। এমর্মে হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
أصول الخطايا كُلّهَا ثلاثة الكبر وَهُوَ الَّذِي أصار إبلَيْس إلي ما أصاره والحرص وَهُوَ الَّذِي أخرج آدم من الجنة والحسد وَهُوَ الَّذِي جرأ أحد ابني آدم عَلَى أخيه فمن وقي شر هذه الثلاثة فقَدْ وقي الشر فالكفر من الكبر والمعاصي من الحرص والبغي والظلم من الحسد
‘সমস্ত পাপের উৎস হল তিনটি। (১) অহংকার, যা ইবলীসের পতন ঘটিয়েছিল। (২) লোভ, যা জান্নাত থেকে আদম (আলাইহিস সালাম)-কে বের করে দিয়েছিল। (৩) হিংসা, যা আদম (আলাইহিস সালাম)-এর এক সন্তানের বিরুদ্ধে অপর সন্তানকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিল। যে ব্যক্তি উক্ত তিনটি বস্তুর অনিষ্ট হতে বেঁচে থাকতে পারবে সে যাবতীয় অনিষ্ট হতে বাঁচতে পারবে। কেননা কুফরীর মূল উৎস হল অহংকার। পাপকর্মের উৎস হল লোভ। আর বিদ্রোহ ও সীমালংঘনের উৎস হল হিংসা’।[২]
অহংকার লোভ ও হিংসার কবলে যে যখন পতিত তখন সে ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব জীবন ধ্বংসের অনিবার্য কারণ। ইবলীসের সারা জীবনের সাধনা অহংকার করার দরুন নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে। ইবলীস মানুষকে অহংকার করতে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ সে মানুষের ধ্বংস কামনা করে। সে সর্বদা তার দলে লোক সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। আর মানুষ বুঝে কিংবা না বুঝেই অহংকার করে তার কাতারে শামিল হচ্ছে। এসব নোংরা স্বভাব থেকে বেঁচে থাকলে যাবতীয় অকল্যাণ থেকে বেঁচে যাবে।
অহংকার আল্লাহর ক্রোধ বাড়িয়ে দেয়
অহংকার এমনি জঘন্য স্বভাব যা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অহংকারী ব্যক্তির উপর আল্লাহ রাগান্বিত থাকবেন। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ قَالَ اللهُ الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِىْ وَالْعَظَمَةُ إِزَارِىْ فَمَن نَازَعَنِىْ وَاحِداً مِنْهُمَا أَدْخَلْتُهُ جَهَنَّمَ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অহংকার আমার চাদর আর আত্মম্ভরিতা আমার লুঙ্গী। এই দু’টির কোনো একটি কেউ গ্রহণ করলে আমি তাকে জাহান্নামে দেব’।[৩]
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ مَنْ تَعَظَّمَ فِىْ نَفْسِهِ أَوِ اخْتَالَ فِىْ مِشْيَتِهِ لَقِىَ اللهَ وَهُوَ عَلَيْهِ غَضْبَانُ
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মনে মনে গর্বিত হবে অথবা চলনে অহমিকা প্রকাশ করবে, সে ব্যক্তি যখন আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন তিনি তার উপর ক্রোধান্বিত থাকবেন’।[৪] অপর এক হাদীছে এসেছে- الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ ‘অহংকার হল, হক্বকে অহংকার করে পরিত্যাগ করা এবং মানুষকে হীন ও তুচ্ছ মনে করা’।[৫]
অহংকার করা বিশ্ব জাহানের মালিক আল্লাহর জন্যই মানানসই। তিনি দোজাহানের সব কিছুর একচ্ছত্র স্রষ্টা। সকল জিনিসের নিরংকুশ মালিক। অহংকার করা একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। অহংকার তাঁর পোশাক সদৃশ। চরম আবেগে বেরিয়ে আসা সামান্য এক ফোঁটা পানি থেকে মানুষকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন। সে মানুষের অহংকার করা বড়ই হাস্যকর। সে ব্যক্তিই সবচেয়ে জঘন্য যে অহংকার করে হক্বকে প্রত্যাখ্যান করে। ইসলামী শরী‘আতকে গুরুত্ব দেয় না। বরং বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। এরূপ ব্যক্তি মুশরিকের চেয়ে খারাপ। কেননা সে আল্লাহর দাসত্ব করাকে অহংকার করে ত্যাগ করে। আর মুশরিক আল্লাহর ইবাদতকে অস্বীকার করে না। কিন্তু তার অপরাধ হল সে প্রভুর সাথে অন্যের দাসত্ব করতে থাকে। এমর্মে বিদগ্ধ পণ্ডিত শায়খুল ইসলাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
التكبر شر من الشرك فإن المتكبر يتكبر عن عبادة الله تعالى والمشرك يعبد الله وغيره
‘অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্ব করে এবং সাথে অন্যেরও করে’।[৬]
অহংকারীদের প্রতি আল্লাহ দৃষ্টি দিবেন না
অহংকারী স্বভাবের মানুষকে আল্লাহ করুণা করবেন না। তাদের দিকে বিচার দিবসে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمْ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيْهِمْ قَالَ أَبُوْ مُعَاوِيَةَ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ شَيْخٌ زَانٍ وَمَلِكٌ كَذَّابٌ وَعَائِلٌ مُسْتَكْبِرٌ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তিন শ্রেণীর লোকের সাথে ক্বিয়ামতের দিন কথা বলবেন না। তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের দিকে দৃষ্টি দিবেন না ও তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা। তারা হল- (১) বয়স্ক যেনাকারী (২) মিথ্যুক শাসক (৩) অহংকারী দরিদ্র’।[৭]
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ لَا يَنْظُرُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَى مَنْ جَرَّ إِزَارَهُ بَطَرًا
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে অহংকারবশত পায়ের নিচে লুঙ্গি ঝুলিয়ে রাখে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তার প্রতি দৃষ্টি দিবেন না’।[৮]
অহংকারের অপরাধ এতই কঠিন যে, আল্লাহ তা‘আলা বিচারের মাঠে তাদের সাথে কথা বলবেন না। তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের দিকে দেখবেন না। বরং তাদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করবেন। প্রতিটি অহংকারীর এ হাদীছ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। যদি মহান বিচারক সে আসামীর দিকে না তাকান, তাহলে পরিবেশ কেমন ভয়াবহ হতে পারে। যিনি বিচার করবেন তিনিই তাদের সাথে কথা বলা প্রয়োজন মনে করবেন না। এরূপ ব্যক্তিদের অবস্থা হবে খুবই ভয়ানক। বিধায় সময় থাকতেই তওবা করা উচিত।
অহংকারী ব্যক্তির শেষ পরিণাম
অহংকারীদের শেষ পরিণাম অত্যন্ত ভয়ংকর। তারা দুনিয়ায় অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল করায় এর ফলাফল তাদের শেষ দিবসে ভোগ করতে হবে। তাদের শেষ পরিণতি নিম্নে তুলে ধরা হলো-
(ক) অহংকারী জান্নাতে যাবে না
যখন অহংকারীদের দিকে মহান স্রষ্টা দৃষ্টি দিবেন না, তখন তার ফলাফলই বা ভালো হবে কিভাবে? তাদের শেষ পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। এরশাদ হচ্ছে
اِنَّ الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا وَ اسۡتَکۡبَرُوۡا عَنۡہَا لَا تُفَتَّحُ لَہُمۡ اَبۡوَابُ السَّمَآءِ وَ لَا یَدۡخُلُوۡنَ الۡجَنَّۃَ حَتّٰی یَلِجَ الۡجَمَلُ فِیۡ سَمِّ الۡخِیَاطِ ؕ وَ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُجۡرِمِیۡنَ
‘নিশ্চয় যারা আমাদের আয়াতসমূহ মিথ্যারোপ করে, তা থেকে অহংকারবশে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাদের জন্য আকাশের দুয়ারসমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না ছুঁচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে। এভাবেই আমরা পাপীদের বদলা দিয়ে থাকি’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৪০)।
অহংকারী ব্যক্তিদের জন্য আসমানের দরজা খোলা হবে না। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আল্লাহ অত্যন্ত কঠিন একটি উদাহরণ পেশ করেছেন। আর তাহল- ছুচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করা যেমন অসম্ভব তাদের জান্নাতে যাওয়া তেমনি অসম্ভব। এই একটি কথায় অহংকার বর্জনের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لَا يَدْخُلُ النَّارَ أَحَدٌ فِيْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةِ خَرْدَلٍ مِنْ إِيْمَانٍ وَلَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ أَحَدٌ فِيْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةِ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ كِبْرٍ
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যার অন্তরে সরিষা সমপরিমাণ ঈমান আছে, সে জাহান্নামে যাবে না। আর যার অন্তরে সরিষা সমপরিমাণ অহংকার আছে সে জান্নাতে যাবে না’।[৯]
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِىْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِّنْ كِبْرٍ قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُوْنَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً قَالَ إِنَّ اللهَ جَمِيْلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তখন এক ব্যক্তি বলল, কেউ তো পছন্দ করে যে তার পোশাক ভাল হোক, তার জুতা সুন্দর হোক, এটাও কি অহংকার? তিনি বললেন, আল্লাহ নিজে সুন্দর এবং সুন্দরকে পছন্দ করেন। অহংকার হল, হক্বকে অহংকার করে পরিত্যাগ করা এবং মানুষকে হীন ও তুচ্ছ মনে করা’।[১০]
অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। কারো হৃদয়ে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকলে তা হবে জান্নাতের জন্য প্রতিবন্ধক। সামান্য পরিমাণ অহংকারও ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে ভালো পোশাক পরা বা ভালো জিনিস ব্যবহার করা অহংকার নয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে পরিপাটি থাকা অহংকার নয়। প্রকৃত অহংকারী সেই ব্যক্তি যে, সত্যকে গ্রহণ করে না। দম্ভভরে হক্বকে পরিত্যাগ করে। তার কাছে সত্যের দাওয়াত নিয়ে গেলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। দ্বীনকে হেয় প্রতিপন্ন করে। ইসলামকে হীনভাবে উপস্থাপন করে। এরূপ স্বভাবের ব্যক্তিরাই মূলত অহংকারী। তারাই যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করে। আত্ম অহমিকায় বা গর্বে বুক ফুলিয়ে চলে। অন্য মানুষকে তুচ্ছ ভাবে। তাদের এই নোংরা স্বভাবের পরিবর্তন করা খুবই যরূরী।
(খ) অহংকারীদের শেষ ঠিকানা জাহান্নাম
অহংকারী ব্যক্তির জান্নাতে ঠাঁয় হবে না। বিধায় তার দম্ভের ফলাফল হবে জাহান্নাম। আর সেটাই তার জন্য উপযুক্ত বাসস্থান। সেই যন্ত্রণাদায়ক স্থানে তাকে যুগযুগ ধরে বসবাস করতে হবে। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ حَارِثَةَ بْنَ وَهْبٍ الْخُزَاعِىِّ يَقُوْلُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيْفٍ مُتَضَعَّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ جَوَّاظٍ زَنِيْمٍ مُتَكَبِّرٍ
হারিছা ইবনু ওহাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী লোকের কথা বলব না? তারা হল সরলতার দরুণ দুর্বল, যাদেরকে লোকেরা হীন, তুচ্ছ ও দুর্বল মনে করে। আল্লাহ তাদেরকে এত ভালোবাসেন যে, তারা কোনো বিষয়ে কসম করলে তাদেরকে সত্যে পরিণত করেন। তারপর নবী করীম (ﷺ) বললেন, আমি তোমাদেরকে কি জাহান্নামীদের কথা বলব না? তারা হল, যারা অনর্থক কথা নিয়ে বিবাদ করে, আর যারা বদমেযাজী অহংকারী’।[১১] অপর এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ ‘আমি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সম্পর্কে অবহিত করব না কি? (তারা হল) প্রত্যেক রূঢ় স্বভাব, কঠিন হৃদয় ও দাম্ভিক (অহংকারী) ব্যক্তি’।[১২]
عَنْ أَبِى سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ احْتَجَّتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ فَقَالَتِ النَّارُ فِىَّ الْجَبَّارُوْنَ وَالْمُتَكَبِّرُوْنَ وَقَالَتِ الْجَنَّةُ فِىَّ ضُعَفَاءُ النَّاسِ وَمَسَاكِينُهُمْ قَالَ فَقَضَى بَيْنَهُمَا إِنَّكِ الْجَنَّةُ رَحْمَتِىْ أَرْحَمُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ وَإِنَّكِ النَّارُ عَذَابِىْ أُعَذِّبُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ وَلِكِلاَكُمَا عَلَىَّ مِلْؤُهَا
আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘জান্নাত ও জাহান্নাম পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া করল। জাহান্নাম বলল, আমার মধ্যে বড় উদ্ধত এবং অহংকারীরা বসবাস করবে। আর জান্নাত বলল, আমার মধ্যে দুর্বল ও মিসকীনরা বসবাস করবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের মধ্যে মীমাংসা করলেন যে, হে জান্নাত! তুমি আমার অনুগ্রহ, আমি তোমার দ্বারা যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করব। আর হে জাহান্নাম! তুমি আমার শাস্তি, আমি তোমার দ্বারা যাকে ইচ্ছা তাকে শাস্তি দেব। আর তোমাদের দু’টোকেই পরিপূর্ণ করা আমার দায়িত্ব’।[১৩]
হাদীছগুলোতে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, অহংকারীদের শেষ ঠিকানা হবে জাহান্নাম। সেখানে তাদেরকে অনন্তকাল বসবাস করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম তৈরি করেছেন শাস্তি দেয়ার জন্য। তিনি যাকে ইচ্ছা এই ভীষণ কষ্টের জায়গায় শাস্তি দিবেন। যা রবের সাথে জাহান্নামের কথোপকথন-এর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। তিনি প্রত্যেক উদ্ধত, দাম্ভিক ও অহংকারীকে এই জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। যা তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য বহু পূর্ব থেকে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। যে সতর্কবাণী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বার বার উচ্চারণ করেছেন। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে স্পষ্ট নিষেধ থাকা সত্বেও তারা দম্ভভরে তা প্রত্যাখ্যান করেছিল।
* পরিচালক, ইয়াসিন আলী সালাফী কমপ্লেক্স, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৭২৫২; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হা/৩১৪; ছহীহুল জামে‘, হা/৩০৩৯; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৮০২; মিশকাত, হা/৫১২২, সনদ হাসান।
[২]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ (বৈরূত : দরুল কুতুবিল ‘ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ, ১৯৭৩ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৮।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮০; আবূ দাঊদ, হা/৪০৯০; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৭৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৮৮১; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৬৭২; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৯২৫৩; মিশকাত, হা/৫১১০।
[৪]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৯৯৫; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৪৯; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হা/৩৫৬; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৫৪৩, সনদ ছহীহ।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/৯১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৭৮৯; মিশকাত, হা/৫১০৮।
[৬]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৯৭৩ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩২; আব্দুল মালেক আল-ক্বাসেম, আশ-শারহুল মুয়াস্সার লিকিতাবিত তাওহীদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪৮।
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০২৩২; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৫০২২; মুসনাদে আবু আওয়ানাহ, হা/১১৪; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩৯৬; মিশকাত, হা/৫১০৯।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৮৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২০৮৫; আবূ দাঊদ, হা/৪০৯৩; মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৩৩৯০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১০২৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৪৪৭; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৯৭৭; ছহীহুল জামে‘, হা/৭৮০৪; মিশকাত, হা/৪৩১১।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/৯১; আবুদাউদ, হা/৪০৯১; তিরমিযী, হা/১৯৯৮; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৭৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪৩১০; মুসতাদরাকে হাকেম, হা/৫৭৫৭; মিশকাত, হা/৫১০৭।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/৯১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৭৮৯; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৪৬৬; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৮১৫২; মুসনাদে আবু আওয়ানাহ, হা/৮৫; মিশকাত, হা/৫১০৮।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৭১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৫৩; মিশকাত, হা/৫১০৬।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯১৮; ইবনু মাজাহ, হা/৪১১৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৫৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৭৫২; বায়হাক্বী, হা/৮১৭৪; মিশকাত, হা/৫১০৬।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৪৬; তিরমিযী, হা/২৫৬১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৭৭১; আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৫৪; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৭৪৭৭; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৯০৫।
প্রসঙ্গসমূহ »:
পাপ