পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব
- মূল : ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ)
- অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান*
(৩য় কিস্তি)
আল্লাহর ছিফাত অস্বীকারকারীদের প্রকারভেদ
আল্লাহর সত্তার ব্যাপারে মন্তব্যকারীরা দু’ভাগে বিভক্ত :
১). যে কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত আল্লাহর সত্তাগত একাধিক বিষয়কে অস্বীকার করে। কেননা সে মনে করে এতে করে আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়া আবশ্যক হয়ে যাবে। যেমন- মু‘তাযিলারা বলে থাকে, لو رؤي لكان جسما لأنه لايرى إلا في جهة ‘যদি আল্লাহকে দেখা সম্ভব হয়, তাহলে অবশ্যই তার শরীর আছে, কেননা শরীর ছাড়া তো আর দেখা সম্ভব নয়’। তারা আরো বলে, لو كان له كلام يسمع لكان جسما ‘তার কালাম যদি শ্রবণ যোগ্য হয়, তাহলে অবশ্যই তার শরীর আছে’।
আর যারা আল্লাহর আরশে সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করে, তারাও তাদের সাথে একমত পোষণ করেছে, এজন্য তারা সাদৃশ্যকে অস্বীকার করে, আর এটা হল মু‘তাযিলা ও জাহমিয়্যাহদের রীতিনীতি।
সালাফগণ তাদের বিদ‘আতী ও ভ্রষ্ট হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরবর্তীদের এমন অনেকেই তাদের পদ্ধতিকে অনুসরণ করেছেন, যাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে সম্পৃক্ত করা হয়।
২). যে আল্লাহর সত্তাকে নিজের বিবেক দ্বারা সাব্যস্ত করতে চায়, যে ব্যাপারে কোন আছার বর্ণিত হয়নি, তাই তাদের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। যেমন মুক্বাতিল[১] ও তার অনুসারী নূহ ইবনু আবূ মারইয়ামের[২] পদ্ধতিও এ রকম ছিল, যাদেরকে অতীত ও বর্তমানের একদল মুহাদ্দিছও অনুসরণ করেছেন। তাছাড়া কারামিয়্যাদের[৩] পদ্ধতিও এ রকম। আবার শারীরিক ছিফাত সাব্যস্ত থাকার কারণে তাদের কেউ কেউ শাব্দিক বা অর্থগতভাবে সেটা সাব্যস্ত করে থাকে। আবার কেউ কেউ আল্লাহর জন্য এমন ছিফাতকে সাব্যস্ত করে, যা কুরআন ও সুন্নাহয় একেবারেই বর্ণিত হয়নি। যেমন আল্লাহর নাড়াচাড়া করা এবং অন্যান্য এমন ছিফাত যা তাঁর ব্যাপারে সাব্যস্ত হয়নি।
জাহামের বিরুদ্ধে মুক্বাতীলের দেয়া বিবেক প্রসূত দলীলকে সালাফগণ প্রত্যাখ্যান করে তাকে খুব কঠিনভাবে দোষারোপ করেছেন, এমনকি তাকে হত্যা করা জায়েয বলেও ফাৎওয়া দিয়েছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে ইমাম বুখারীর শায়েখ মাক্কী ইবনু ইবরাহীম[৪] এবং অন্যরাও আছেন।
এখানে সালাফগণ যে মতের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন সেটিই সঠিক, তারা আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছগুলোকে কোনরকম তাফসীর[৫], তাকয়ীফ[৬] এবং তামছীল[৭] ছাড়াই যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই সাব্যস্ত করেছেন। এর বিপরীত কোন বক্তব্য তাদের থেকে কোনভাবেই প্রমানিত হয়নি, বিশেষ করে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ব্যাপারে। তারা এগুলোর অর্থ নিয়ে খোঁজাখোজিও করেননি বা কোন ধরনের উদাহরণও পেশ করেননি।
যদিও ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) (১৬৪-২৪১ হি.) এর নিকটবর্তী সময়ের কিছু লোক মুক্বাতীলের অনুসরণ করে তার মত উল্টা পাল্টা কিছু মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করা যাবে না; বরং ইসলামের মহান ইমামদের অনুসরণ করতে হবে। যেমন- ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হি.), ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হি.), আস-সাওরী (৯৭-১৬১ হি.), আওযাঈ (৮৮-১৫৭ হি.), ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হি.), ইমাম আহমাদ (১৬৪-২৪১ হি.), ইসহাক্ব, আবু উবাইদ (রাহিমাহুমুল্লাহ) (১৫৭-২২৪ হি.) এবং তাদের মত যারা আছেন। তাদের কথায় দার্শনিক বক্তব্য তো দূরের কথা ধর্মতত্ত্ববিদদের বক্তব্য থেকেও কোন কিছু পাওয়া যায় না। যারা সব ধরনের দুর্নাম ও অপবাদ থেকে মুক্ত থেকেছেন তাদের বক্তব্যের মধ্যেও এমন কিছু প্রবেশ করেনি। আবূ যুর‘আহ আর-রাযী (রাহিমাহুল্লাহ) (২০০-২৬৪ হি.) বলেন, ‘যার নিকট ইলম আছে, আর সে তার ইলমকে সংরক্ষণ না করে তা প্রকাশের জন্য কোন মতবাদের দ্বারস্থ হয়, তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত নও’।
আরো কিছু নব-আবিষ্কৃত ইলম
আহলুর রায়ের ফক্বীহগণ যুক্তি নির্ভর যে সকল নিয়ম-নীতি আবিষ্কার করেছে এবং ফিক্বহের শাখা-প্রশাখাগত বিষয়াদীকে সেসব নিয়ম-নীতির দিকেই ধাবিত করেছে। এসব নির্ধারিত নিয়ম-নীতিগুলো সুন্নাহর বিরোধী হোক বা তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক উভয়াবস্থায় তা প্রত্যাখ্যাত হবে। যদিও সেগুলোর মূলকথা তাদের ব্যাখ্যানুযায়ী কুরআর ও সুন্নাহ থেকেই হয়। কিন্তু এসব ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অনেকেই তাদের বিরোধিতা করেছেন। তাদের মতামতগুলো ইমামগণ দারুণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর এসব প্রত্যাখ্যাত ফক্বীহরা হচ্ছে ইরাক ও হেযাজ অঞ্চলের। সাথে সাথে ইমামগণ তাদের ব্যাপারে নিন্দাও করেছেন।
ইমামগণ ও আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের বিদ্যানদের অবস্থা হল, তারা সর্বত্রই ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করতেন, যখন তা ছাহাবী ও তাবেঈদের নিকট বা তাদের কোন এক দলের নিকট আমলযোগ্য হত। আর সালাফগণ যে বিষয়কে পরিত্যাগ করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, সে বিষয়ে আমল করা জায়েয নেই। কেননা তারা এটা আমলযোগ্য নয় জেনেই পরিত্যাগ করেছেন।
ওমর বিন আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) (৬১-১০১ হি.) বলেন,خُذُوْا مِنَ الرَّأْىِ مَا يُوَافِقُ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ, فَإِنَّهُمْ كَانُوْا أَعْلَمَ مِنْكُمْ ‘রায় থেকে তোমরা ততটুকুই গ্রহণ করবে, যতটুকু তোমাদের পূর্ববর্তীদের সাথে মিলে যায়। কেননা অবশ্যই তারা তোমাদের থেকে অধিক জ্ঞানী ছিলেন’।
ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) (৯৩-১৭৯ হি.)-এর নিয়ম ছিল যে, কোন হাদীছ যদি মদীনাবাসীদের আমলের বিপরীত হত তাহলে তিনি মদীনাবাসীদের আমল গ্রহণ করতেন। তবে অধিকাংশ লোকেরা হাদীছই গ্রহণ করতেন।
হালাল-হারামের মাসআলা নিয়ে ঝগড়া করা উচিত নয়
সালাফগণ যে সকল বিষয়ে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তার মধ্যে ‘হালাল ও হারামের মাসআলার ক্ষেত্রে ঝগড়া-বিবাদ করা’ বিষয়টি অন্যতম।
তাছাড়া এটা ইমামগণের নিয়মও ছিল না। অর্থাৎ তারা হালাল-হারামের মাসআলা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করতেন না; বরং এসব ঝগড়া-বিবাদ তাদের পরে সৃষ্টি হয়েছে। যেমনটি শাফেঈ ও হানাফীদের মধ্যে মতানৈক্যপূর্ণ মাসআলার ক্ষেত্রে ইরাকের ফক্বীহরা সৃষ্টি করেছে। এমনকি তারা এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র কিতাবও রচনা করেছে এবং ব্যাপক বিতর্ক করেছে। এ সবই আবিস্কৃত, যার কোন ভিত্তি নেই। আর এগুলোই পরবর্তীতে তাদের ইলমের মূল বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যার কারণে এগুলো তাদেরকে উপকারী ইলম অর্জন করা থেকে বিরত রেখেছে। অথচ সালাফগণ এ বিষয়গুলো সর্বদা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সুনান গ্রন্থে মারফূ‘ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَا ضَلَّ قَوْمٌ بَعْدَ هُدًى إِلَّا أُوْتُوْا الْجَدَلَ ثُمَّ قَرَأَ ) مَا ضَرَبُوۡہُ لَکَ اِلَّا جَدَلًا بَلۡ ہُمۡ قَوۡمٌ خَصِمُوۡنَ
‘কোন সম্প্রদায় হেদায়াতের রাস্তা পেয়ে আবার পথভ্রষ্ট হয়ে থাকলে, তা শুধু তাদের বিতর্কের কারণেই হয়েছে। তারপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করেন, ‘এরা শুধু বিতর্কের উদ্দেশ্যেই আপনাকে এ কথা বলে। বস্তুত এরাত এক ঝগড়াটে সম্প্রদায়’ (সূরা আয-যুখরুফ : ৫৮)।[৮]
কোন কোন সালাফ বলেন,
إِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدٍ خَيْرًا فَتَحَ لَهُ بَابَ الْعَمَلِ وَ أَغْلَقَ عَنْهُ بَابَ الْجَدَلِ وَإِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدٍ شَرًّا أَغْلَقَ عَنْهُ بَابَ الْعَمَلِ وَفَتَحَ لَهُ بَابَ الْجَدَلِ
‘মহান আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণ চান, তখন তার জন্য আমলের দরজা উন্মুক্ত করে দেন এবং ঝগড়ার দরজা বন্ধ করে দেন। আর আল্লাহ যখন কোন বান্দার অমঙ্গল চান, তখন তার জন্য আমলের দরজা বন্ধ করে ঝগড়ার দরজা উন্মুক্ত করে দেন’।[৯]
অধিক সমালোচনার ব্যাপারে নিন্দা
ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) (৯৩-১৭৯ হি.) বলেন,أَدْرَكْتُ أَهْلَ هَذِهِ الْبَلْدَةِ وَ إِنَّهُمْ لَيَكْرَهُوْنَ هَذَا الْإِكْثَارَ الَّذِيْ فِيْهِ النَّاسُ الْيَوْمُ ‘আমি মদীনা শহরের অধিবাসীদেরকে এমতাবস্থায় পেয়েছি যে, তারা বর্তমান মানুষের ন্যায় অতিরঞ্জিত করাকে অপসন্দ করতেন’।[১০] এ কথার দ্বারা তিনি মাসআলার বিষয়টিকে উদ্দেশ্য করেছেন।[১১] তিনি অতিরিক্ত কথা ও অধিক ফৎওয়া দেয়াকে অপসন্দ করতেন। তিনি বলেন,يتكلم أحدهم كأنه جمل مغتلم يقول هو كذا هو كذا يهدر في كلامه ‘কেউ কেউ এমনভাবে কথা বলে যে, মনে হয় সে যেন উত্তেজিত উট। যেমন সে বলে, এটা এমন, এটা এমন, এভাবে কথা বলতে বলতে সে গর্জন করে উঠে’।[১২] অধিক প্রশ্নের উত্তর দেয়াকেও তিনি অপসন্দ করতেন, তিনি বলতেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
وَ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الرُّوۡحِ قُلِ الرُّوۡحُ مِنۡ اَمۡرِ رَبِّیۡ
‘আর তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, বলুন, রূহ আমার পালনকর্তার আদেশ থেকে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৮৫)। এক্ষেত্রে কোন উত্তর আসেনি।[১৩] তাকে বলা হল, সুন্নাহ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তি কি সে বিষয়ে বিতর্ক করতে পারবে? তিনি বললেন, لَا وَلَكِنْ سَيُخْبِرُ بِالسُّنَّةِ فَإِنْ قُبِلَ مِنْهُ وَ إِلَّا سَكَتْ ‘না, তবে সে সুন্নাহ্ জানিয়ে দিবে, গ্রহণযোগ্য হলে হবে, অন্যথায় চুপ থাকবে’।[১৪] তিনি আরো বলেন,المِرَاءُ وَالْجِدَالُ فِيْ الْعِلْمِ يُذْهِبُ بِنُوْرِ الْعِلْمِ ‘ইলমের ক্ষেত্রে ঝগড়া-বিবাদ, ইলমের জ্যোতি নষ্ট করে দেয়’।[১৫] তিনি আরো বলেন,المِرَاءُ فِيْ الْعِلْمِ يُقَسِّي الْقَلْبَ وَ يُوْرِثُ الضَّغْنَ ‘ইলমের ক্ষেত্রে ঝগড়া-বিবাদ অন্তরকে কঠোর করে ফেলে এবং হিংসা-বিদ্বেষের জন্ম দেয়’।[১৬]
ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ)-কে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হলে অধিকাংশ সময় তিনি বলতেন, ‘আমি জানি না’। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)ও তাঁর এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন।
অধিক প্রশ্ন, কঠিন মাসাআলা এবং কোন কিছু ঘটার পূর্বেই ফৎওয়া জিজ্ঞেস করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। আর এ ব্যাপারে এত অধিক বর্ণনা এসেছে, যা উল্লেখ করলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে।
ইমাম ও সালাফগণের মধ্য থেকে যারা অধিক তর্ক-বিতর্ক করা থেকে বিরত হয়ে চুপ থেকেছেন, তারা অজ্ঞতা ও অপারগতার কারণে চুপ থাকেননি; বরং সুদৃঢ় ইলম ও আল্লাহভীতির কারণেই চুপ থেকেছেন। তাদের পরে যারা অধিক হারে বক্তব্য দিয়েছে, ঝগড়া-বিবাদের ব্যাপকতা ঘটিয়েছে, তারা মূলত সালাফদের থেকে বেশি জ্ঞানের কারণে এমনটি করেনি; বরং যুক্তি-তর্কের প্রতি মোহ এবং আল্লাহ-ভীতি কম থাকার কারণেই এমনটি করেছে। যেমন হাসানুল বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) কিছু লোককে ঝগড়া করতে শুনে বলেন,
هَؤُلَاءِ قَوْمٌ مَلُّوْا الْعِبَادَةَ وَخَفَّ عَلَيْهِمُ الْقَوْلُ وَقَلَّ وَرَعُهُمْ فَتَكَلَّمُوْا
‘এরা এমন সম্প্রদায় যারা ইবাদত করতে ক্লান্তবোধ করছে, অথচ কথা বলা তাদের জন্য সহজ হয়েছে। তাদের আল্লাহ-ভীতি কমে গেছে, তাই তারা ঝগড়া করা শুরু করেছে’।[১৭]
মাহদী বিন মাইমুন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, অতি বুদ্ধিমান ব্যক্তি মুহাম্মাদ ইবনু সীরীনকে আমি বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘আমি জানি সে কী চায়, তোমার সাথে ঝগড়া করতে চাইলে আমি ঝগড়াটে আলেম হয়ে যাব’।[১৮] তিনি আরো বলেন,أَنَا أَعْلَمُ بِالْمِرَاءِ مِنْكَ وَلَكِنِّيْ لَا أُمَارِيْكَ ‘তর্ক-বিতর্ক আমি তোমার থেকে বেশিই জানি, তবে আমি তোমার সাথে তর্ক-বিতর্ক করব না’।[১৯]
ইবরাহীম আন-নাখয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, مَا خَاصَمْتُ قَطُّ ‘আমি কখনো (ইলম নিয়ে) ঝগড়া করিনি’।[২০] আব্দুল কারীম আল জাযারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, مَا خَاصَمَ وَرَعٌ قَطُّ ‘আল্লাহভীরু ব্যক্তি কখনো ঝগড়া করে না’।[২১] জা‘ফর ইবনু মুহাম্মাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলতেন,
إِيَّاكُمْ وَالْخُصُوْمَاتِ فِيْ الدِّيْنِ, فَإِنَّهَا تَشْغَلُ الْقَلْبَ, وَتُوْرِثُ النِّفَاقَ
‘তোমরা দ্বীনের ক্ষেত্রে ঝগড়া করা থেকে বিরত থাক, কেননা তা অন্তরকে ব্যস্ত রাখে এবং কপটতার জন্ম দেয়’।[২২] ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) বলতেন, إِذَا سَمِعْتَ الْمِرَاءَ فَأَقْصِرْ ‘যখন তুমি তর্ক-বিতর্ক শুনবে তখন থেমে যাবে’।[২৩] তিনি আরো বলতেন, مَنْ جَعَلَ دِيْنَهُ غَرَضًا لِلْخُصُوْمَاتِ أَكْثَرَ التَّنَقُّلَ ‘যে ব্যক্তি তার দ্বীনকে ঝগড়ার লক্ষ্য-বস্তু বানিয়ে নেয়, সে দ্বীন ও সুন্নাহর উপর স্থির না থেকে বেশি বেশি মত পরিবর্তন করে’।[২৪] তিনি আরো বলতেন,
إِنَّ السَّابِقِيْنَ عَنْ عِلْمٍ وَقَفُوْا وَبِبَصَرٍ نَاقِدٍ كَفُّوْا وَكَانُوْا هُمْ أَقْوَى عَلَى الْبَحْثِ لَوْ بَحَثُوْا
‘নিশ্চয় পূর্ববর্তীগণ জেনে শুনেই চুপ থেকেছেন। দূরদর্শী হয়েও তারা বিরত থেকেছেন। অনুসন্ধানের জন্য তো তারাই বেশি উপযুক্ত ছিলেন, যদি তারা অনুসন্ধান করতেন’।[২৫] এই বিষয়ে সালাফ থেকে অনেক বক্তব্য পাওয়া যায়।
বক্তব্য কম মানেই জ্ঞান কম, বক্তব্য বেশি মানেই জ্ঞান বেশি- এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ
পরবর্তীদের মধ্য থেকে অনেকেই এর দ্বারা ফেতনায় পড়েছেন, তারা ধারণা করে যে, দ্বীনের মাসআলার ক্ষেত্রে যার আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-বিবাদ যত বেশি হবে, সে তত বেশি জ্ঞানী। তাদের এ ধারণা মূর্খতা বৈ কিছু নয়’।
মহান ছাহাবী এবং তাঁদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তাদের প্রতি লক্ষ্য করুন, যেমন আবূ বকর, ওমর, আলী, মু‘আয, ইবনু মাসঊদ ও যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)। তারা কেমন ছিলেন? তাদের সকলের বক্তব্য ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে কম ছিল অথচ তারা সকলেই ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর চেয়ে বেশি জ্ঞানী ছিলেন। এমনিভাবে তাবেঈদের বক্তব্য ছাহাবীদের বক্তব্যের চেয়ে বেশি, অথচ ছাহাবীরাই তাদের থেকে বেশি জ্ঞানী ছিলেন। একইভাবে তাবেঈ-তাবেঈদের বক্তব্য তাবেঈদের থেকে বেশি, অথচ তাবেঈরা তাদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী ছিলেন।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* অধ্যয়নরত, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা মুনাওয়ারাহ, সঊদী আরব।
তথ্যসূত্র :
[১]. মুক্বাতীল ইবনু সুলাইমান ইবনু বশির আল-আযদী আল-বালখী, তিনি ছিলেন তাফসীরের ইমাম, তবে তিনি ‘মাতরুকুল হাদীছ’ ছিলেন। ১৫০ হিজরীতে মৃত্যবরণ করেন-তাহযীবুত তাহযীব, ১০ম খণ্ড, পৃ. ২৭৯।
[২]. নূহ ইবনু ইয়াজিদ (আবূ মারইয়াম) ইবনু জা‘ঊনাহ্ আল-মারওয়াযী, আবূ ইসমাহ্। তিনি মারবের একজন বিচারক ছিলেন, বহু বিদ্যা সংকলন করার কারণে তাকে জামে‘ উপাধি দেয়া হয়। কিন্তু তিনি মুরজিয়্যা এবং হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে দোষী ছিলেন। আবূ হাতেম (রাহিমাহুল্লাহ) তাকে ‘মাতরুকুল হাদীছ’ বলেছেন- তাহযীবুল কামাল, ৩০তম খণ্ড, পৃ. ৫৬।
[৩]. এরা মুহাম্মদ ইবনু কেরামের অনুসারী। যিনি ২৫৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের আক্বীদা হচ্ছে : ঈমান হল কেবল মুখের স্বীকৃতি, ঈমান বাড়েও না এবং কমেও না, কাবীরা গোনাহকারীও পরিপূর্ণ ঈমানদার, আল্লাহর ক্ষেত্রে শরীর শব্দ ব্যবহার করা, আল্লাহর জন্য দিক সাব্যস্ত করা, আল্লাহর সত্তার দ্বারা ঘটনাপ্রবাহ প্রতিষ্ঠিত থাকা জায়েয- আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০৮।
[৪]. মাক্কী এর পরিচয় : মাক্কী ইবনু ইবরাহীম ইবনু বাশির ইবনু ফারক্বাদ (রাহিমাহুল্লাহ)। তাকে মাক্কী ইবনু ফারক্বাদ ইবনু বাশির আত-তামীমী আল-হানযালী আবুস সাকান অ াল-বালখী আল-হাফেযও বলা হয়। ইমাম আল-আজলী (রাহিমাহুল্লাহ) তাকে ছিক্বাহ বলেছেন। আবূ হাতেম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, তার অবস্থা ঠিক আছে, ইমাম নাসাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, তার কোন সমস্যা নেই। ইমাম দারুকুতনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ছিক্বাহ্, মা’মুন। তিনি ২১৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন-তাহযীবুত তাহযীব, ১০ম খণ্ড, পৃ. ২৯৩।
[৫]. অর্থাৎ এমন তাফসীর ছাড়া যা তার প্রকাশ্য অর্থের বিপরীত হয়, আর তা হল নিন্দীত তা‘বীল যার প্রকৃত অবস্থা হল তাহরীফ।
[৬]. তাকয়ীফ হল- সাদৃশ্য না দিয়ে কোন বস্তুকে নির্দিষ্ট একটা অবস্থার উপর নির্ধারণ করা, কুরআন-সুন্নাহ এবং বিবেকের দলীল দ্বারা এই আক্বীদা বাতিল বলে প্রমানিত। কুরআনের দলীল : আল্লাহ তাআলা বলেন, وَ لَا یُحِیۡطُوۡنَ بِہٖ عِلۡمًا ‘আর তারা জ্ঞান দিয়ে তাকে বেষ্টন করতে পারে না’ (সূরা ত্ব-হা : ১১০)। বিবেকের দলীল : কোন জিনিসের ছিফাতের অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ের কোন একটির জ্ঞান থাকা আবশ্যক। ১. জিনিসের সত্তা বা ২. তার সমতুল্যের সত্তা অথবা ৩. তার সম্পর্কে সত্যবাদীর সংবাদ। আর এগুলো পদ্ধতিই আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতের অবস্থার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ। সুতরাং তাকয়ীফ বাতিল বলে গণ্য হওয়া আবশ্যক। (মাওসূ‘আতুল আক্বীদা ফি মাওক্বিউদ দুরার আস-সানিয়্যা।)
[৭]. তামছীল : আল্লাহর গুণ সাব্যস্তকারীদের বিশ^াস যে, সে আল্লাহর যে গুণাবলী সাব্যস্ত করে তা সৃষ্টির গুণাবলীর অনুরূপ। কুরআন-সুন্নাহ এবং বিবেকের দলীল দ্বারা এই আক্বীদা বাতিল বলে প্রমানিত। কুরআনের দলীল : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَیۡسَ کَمِثۡلِہٖ شَیۡءٌ ‘তাঁর অনুরূপ কিছুই নেই’ (সূরা আশ-শূরা : ১১)। বিবেকের দলীল : এটা সুস্পষ্ট যে, ¯্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যে সত্তাগতভাবে বিশাল পার্থক্য আছে। আর এটাই আবশ্যক করে দেয় যে, তাদের গুণাবলীর মধ্যেও বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান থাকা উচিত। (মাওসূ‘আতুল আক্বীদা ফি মাওক্বিউদ দুরার আস-সানিয়্যা)।
[৮]. তিরমিযী, হা/৩২৫৩; ইবনু মাজাহ, হা/৪৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২১৬৪ এবং অন্যরাও আবূ উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীছ হাসান ছহীহ, শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)ও ছহীহ বলেছেন, ছহীহুল জামে‘, হা/৫৬৩৩; মুসনাদের তাহক্বীক্ব কারীগণ বিভিন্ন সনদ এবং শাওয়াহেদের মাধ্যমে হাদীছটিকে হাসান বলেছেন।
[৯]. আবূ নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৩২১, মা‘রূফ আল-কারখী থেকে; ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামীন নুবালা, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৩৪০।
[১০]. খতিব আল-বাগদাদী, আল-ফাক্বীহ্ ওয়াল-মুতাফাক্বিহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫; ইবনু আব্দুল বার্র, জামে‘ বায়ানিল ইলম ওয়া ফাযলিহ্, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৬৬।
[১১]. ‘মাসআলাকে উদ্দেশ্য করেছেন’ কথাটি ইমাম মালেক থেকে বর্ণনাকারী ইবনু ওয়াহাব বলেছেন। খত্বীব বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কথার উপর পর্যালোচনা করে বলেন, এটা কোন বিষয় ঘটার পূর্বে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হতে নিষেধাজ্ঞার সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহর ইচ্ছা ও তার সাহায্যে আমরা তার উত্তর এভাবে দিব যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মতের উপর দয়া, অনুকম্পা এবং সহানুভূতি প্রদশর্নের জন্য অধিক প্রশ্ন করাকে অপসন্দনীয় মনে করতেন। আর এই ভয়ে যে আল্লাহ তা‘আলা প্রশ্নকারীর প্রশ্নের মাধ্যমে এমন বিষয়কে হারাম করে দিবেন, যা প্রশ্ন করার পূর্বে হালাল ছিল। অতঃপর প্রশ্নটাই এমন বস্তু নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ হবে যার বৈধতার মধ্যেই উম্মতের জন্য উপকার নিহিত। সুতরাং এই প্রশ্নই তাদের কষ্ট এবং ক্ষতির কারণ হল। আর এই বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুর মাধ্যমে দূর হয়ে গেছে এবং শরী‘আতের বিধিবিধান সমূহ সুদৃঢ় হয়েছে। তাই এর পরে আর হারামও হবে না এবং বৈধও হবে না। দ্রষ্টব্য : আল-ফাক্বীহ ওয়াল মুতাফাক্বীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫-১৮। ইবনু রজব এই মাসআলার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম’-এ (১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৮)।
[১২]. ক্বাজী ইয়ায, তারতীবুল মাদারীক ওয়া তাক্বরীবুল মাসালীক, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯০।
[১৩]. এটি লেখক তার ‘জামেঊল ‘উলুম ওয়াল হিকাম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪৮।
[১৪]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামে‘ বায়ানিল ‘ইলম ও ফাযলিহ্, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৩৫; ক্বাজী ইয়ায, তারতীবুল মাদারীক ওয়া তাক্বরীবুল মাসালীক, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯।
[১৫]. তারতীবুল মাদারীক ওয়া তাক্বরীবুল মাসালীক, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯; সিয়ারু আ‘লামীন নুবালা, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১০৬।
[১৬]. ইবনু বাত্তাহ, আল-ইনাবাতুল কুবরায়, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৩০; ইমাম মালেক এর উক্তি থেকে, ইমাম বায়হাক্বী, আল-ই‘তিক্বাদ, পৃ. ২৩৯; ইমাম বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান, ইমাম শাফেয়ীর উক্তি হিসাবে বর্ণনা করেছেন, ১১তম খণ্ড, পৃ. ৪১।
[১৭]. ইমাম আহমাদ, আয-যুহুদ, পৃ. ২২০; আবূ নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫৬; আবুল ফজল আল- বাগদাদী, হাদীছুয যুহুরী, পৃ. ৫২০।
[১৮]. আল-ইনাবাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫২২।
[১৯]. আল-আজরী, শারী‘আহ্, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫৩; আল-ইনাবাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫২২, সনদ ছহীহ।
[২০]. আল-ইনাবাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫২৪।
[২১]. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫২৫।
[২২]. আল-লালিকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৫।
[২৩]. ইবনু আবিদ-দুনিয়া, আস-সামত, পৃ. ১০০; আল-ইনাবাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫২৭; আল হারভী, যাম্মুল কালাম ওয়া আহলিহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩২।
[২৪]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৯১৮, মুহাম্মাদ ইবনু হাসান সূত্রে; দারেমী, ‘সুনান’, হা/৩২০, সনদ ছহীহ।
[২৫]. উল্লিখিত শব্দে ইমাম আহমাদ যুহুদে বর্ণনা করেছেন (পৃ. ২৪০); ‘আল-ইনাবাতুল কুবরায়’ نَاقِدٍ এর স্থানে نَافِذٍএবং শেষে وَلَمْ يَبْحَثُوْا শব্দে বর্ণনা করেছেন, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫২৪।
প্রসঙ্গসমূহ »:
শিক্ষা ও সংস্কৃতি