আল-কুরআনে মানুষ: মর্যাদা ও স্বরূপ বিশ্লেষণ
ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ*
(২য় কিস্তি)
প্রথমতঃ ইতিবাচক দিক
১- মানুষ দুনিয়াতে আল্লাহর খলীফা
‘খলীফা’ শব্দের অর্থ হলো প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী।[১] মহান আল্লাহ তাঁর অসংখ্য সৃষ্টির মাঝে মানুষকে স্বীয় খলীফা মনোনীত করেছেন। যাতে করে তারা দুনিয়ার তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এ মর্মে সৃষ্টির প্রারম্ভেই তিনি ফেরেশতাদের উদ্দেশ্য করে ঘোষণা দিয়েছেন যে,
وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ جَاعِلٌ فِی الۡاَرۡضِ خَلِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡۤا اَتَجۡعَلُ فِیۡہَا مَنۡ یُّفۡسِدُ فِیۡہَا وَ یَسۡفِکُ الدِّمَآءَ ۚ وَ نَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِکَ وَ نُقَدِّسُ لَکَ ؕ قَالَ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ.
‘স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতেছি; তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্তুতিগান ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, আমি জানি যা তোমরা জান না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৩০)। তিনি (আল্লাহ) শুধু খলীফা হিসাবেই সৃষ্টি করেননি; বরং তাদেরকে পরীক্ষার জন্য একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ ہُوَ الَّذِیۡ جَعَلَکُمۡ خَلٰٓئِفَ الۡاَرۡضِ وَ رَفَعَ بَعۡضَکُمۡ فَوۡقَ بَعۡضٍ دَرَجٰتٍ لِّیَبۡلُوَکُمۡ فِیۡ مَاۤ اٰتٰکُمۡ.
‘তিনিই তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি করেছেন এবং যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন সে সম্বন্ধে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তোমাদের কতজকে কতকের উপর মর্যাদায় উন্নীত করেছেন’ (সূরা আল-আন‘আম: ১৬৫)। এছাড়াও খলীফা হিসাবে একজন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিধৃত করতে গিয়ে তিনি তাঁর মনোনীত বান্দা দাঊদ (আলাইহিস সালাম)-কে লক্ষ্য করে বলেন,
یٰدَاوٗدُ اِنَّا جَعَلۡنٰکَ خَلِیۡفَۃً فِی الۡاَرۡضِ فَاحۡکُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ بِالۡحَقِّ وَ لَا تَتَّبِعِ الۡہَوٰی فَیُضِلَّکَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ.
‘হে দাঊদ! আমরা তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং খেয়াল খুশির অনুসরণ করিও না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে’ (সূরা ছোয়াদ: ২৬)।
এখানে প্রতিনিধি হিসাবে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী, তার দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা মহান আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে প্রমাণিত করতে হলে তাঁর আইনকেই শুধু মানুষের মাঝে পরিচালিত করতে হবে অন্যথা তা হবে ব্যক্তি পুজা বা প্রবৃত্তির অনুসরণ। আর দাঊদ (আলাইহিস সালাম) এ ধরনেরই একজন শাসক ছিলেন।
২- সর্বশ্রেষ্ঠ নে‘মত জ্ঞানের অধিকারী
মানুষ বোধশক্তিসম্পন্ন প্রাণী। মহান আল্লাহ মানুষকে এমন জ্ঞান দান করেছেন, যার সাহায্যে ভাল ও মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ প্রভৃতির মাঝে পার্থক্য সুচিত করা যায়। এ জ্ঞান দ্বারাই মানুষ ফিরিশতাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত করেছে। অতএব জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ সকল প্রাণীর সেরা। পবিত্র কুরআনে এসেছে,
وَ عَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ کُلَّہَا ثُمَّ عَرَضَہُمۡ عَلَی الۡمَلٰٓئِکَۃِ ۙ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ بِاَسۡمَآءِ ہٰۤؤُلَآءِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ- قَالُوۡا سُبۡحٰنَکَ لَا عِلۡمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ- قَالَ یٰۤاٰدَمُ اَنۡۢبِئۡہُمۡ بِاَسۡمَآئِہِمۡ ۚ فَلَمَّاۤ اَنۡۢبَاَہُمۡ بِاَسۡمَآئِہِمۡ ۙ قَالَ اَلَمۡ اَقُلۡ لَّکُمۡ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ غَیۡبَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۙ وَ اَعۡلَمُ مَا تُبۡدُوۡنَ وَ مَا کُنۡتُمۡ تَکۡتُمُوۡنَ.
‘আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন তারপর ফিরিশতাদের সামনে সেগুলো প্রকাশ করলেন এবং বললেন এগুলোর নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তারা বলল, আপনি মহান পবিত্র। তিনি বলেছেন, হে আদম! তুমি তাদেরকে ঐ সকলের নামসমূহ জানিয়ে দাও; অতঃপর যখন সে তাদেরকে ঐগুলো নামসমূহ জানিয়ে দিল, তখন তিনি বলেছিলেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয় আমি ভূমণ্ডল ও নভোণ্ডলের অদৃশ্য বিষয় অবগত আছি এবং তোমরা যা প্রকাশ কর ও যা গোপন কর আমি তাও পরিজ্ঞাত আছি’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৩১-৩৩)।
জ্ঞানে মাধ্যমেই মানুষ প্রভূত কল্যাণের অধিকারী হয়ে থাকে। এজন্যই পবিত্র কুরআনে বারবার জ্ঞান আহরণে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَ مَنۡ یُّؤۡتَ الۡحِکۡمَۃَ فَقَدۡ اُوۡتِیَ خَیۡرًا کَثِیۡرًا ‘যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তার প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়েছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৬৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,
وَ ہُوَ الَّذِیۡ یَتَوَفّٰىکُمۡ بِالَّیۡلِ وَ یَعۡلَمُ مَا جَرَحۡتُمۡ بِالنَّہَارِ ثُمَّ یَبۡعَثُکُمۡ فِیۡہِ لِیُقۡضٰۤی اَجَلٌ مُّسَمًّی ۚ ثُمَّ اِلَیۡہِ مَرۡجِعُکُمۡ ثُمَّ یُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ.
‘আর সেই মহা প্রভুই রাত্রিকালে নিদ্রারূপে তোমাদের নিকট এক প্রকার মৃত্যু ঘটিযে থাকেন, আর দিনের বেলা তোমরা যে পরিশ্রম করে থাক তিনি সেটাও সম্যক জ্ঞাত’। অতঃপর তিনি নির্দিষ্ট সময়কাল পূরণের নিমিত্তে তোমাদেরকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে থাকেন, তাঁর পর পরিশেষে তার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে, তখন তিনি তোমাদেরকে তোমাদের কৃত-কর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন’ (সূরা আল-আন‘আম: ৬০)।
৩- মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন
মানুষ সাধারণত স্বাধীনচেতা ও মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় চলা-ফেরা করতে পসন্দ করে। কিসে কল্যাণ এবং কিসে তাদের অকল্যাণ তা জ্ঞাত হবার পরও তা গ্রহণের ক্ষেত্রে রয়েছে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা। মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থাশীল হওয়া পয়গম্বরী মিশন পরিচালনার প্রয়োজনীয় গুণাবলীতে মানব জীবন বিমণ্ডিত। তারা দায়িত্বশীল জীব। উদ্যোগ ও কঠোর শ্রমের মাধ্যমে জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সমৃদ্ধি বা বিপর্যয় যে কোন একটিকে বেছে নেয়ার তার রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। হয় সে সঠিক পথে চলে সমৃদ্ধির পানে বাড়াবে অথবা অকৃতজ্ঞ হয়ে বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,
اِنَّا خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ اَمۡشَاجٍ ٭ۖ نَّبۡتَلِیۡہِ فَجَعَلۡنٰہُ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا- اِنَّا ہَدَیۡنٰہُ السَّبِیۡلَ اِمَّا شَاکِرًا وَّ اِمَّا کَفُوۡرًا.
‘আমরা তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুক্রবিন্দু হতে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য এজন্য আমরা তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন। আমরা তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে’ (সূরা আদ-দাহর/ইনসান: ২-৩)।
৪- মহত্ত্ব ও মর্যাদার বিভুষিত
জন্মগতভাবেই মহত্ত্ব ও মর্যাদার গুণাবলীতে মানুষ বিভুষিত। বাস্তবেই আল্লাহ অপরাপর অসংখ্য প্রাণীর উপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সে তার আসল সত্তাকে তখনই আবিষ্কার করতে পারে, যখন সে তার মহত্ত্ব ও মর্যাদাকে উপলব্ধি করতে পারবে এবং নিজকে সকল নীচতা, দাস, অধীনতা ও ভোগ লালসার ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে পারবে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ لَقَدۡ کَرَّمۡنَا بَنِیۡۤ اٰدَمَ وَ حَمَلۡنٰہُمۡ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ وَ رَزَقۡنٰہُمۡ مِّنَ الطَّیِّبٰتِ وَ فَضَّلۡنٰہُمۡ عَلٰی کَثِیۡرٍ مِّمَّنۡ خَلَقۡنَا تَفۡضِیۡلًا.
‘আমরা তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমূদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; তাদেরকে উত্তম রিযিক দান করেছি এবং আমরা যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর মানুষদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি’ (সূরা বানী ইসরাঈল: ৭০)।
৫- নৈতিক চেতনাবোধ সম্পন্ন
মানুষের নৈতিক চেতনা আছে। তারা প্রকৃতিগতভাবেই ভালো আর মন্দ বুঝে নিতে পারে। কল্যাণ ও অকল্যাণের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। মানুষের সত্তার মাঝেই এ সুপ্ত নৈতিক চেতনা লুকিয়ে আছে। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ نَفۡسٍ وَّ مَا سَوّٰىہَا ۪ۙ- فَاَلۡہَمَہَا فُجُوۡرَہَا وَ تَقۡوٰىہَا
‘শপথ মানুষের এবং যিনি তাকে সুঠাম করেছেন। তাকে (মানুষকে) তার অসৎকর্ম ও তার সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন’ (সূরা আশ-শামস: ৭-৮)।
৬- আল্লাহর স্মরণে মানসিক প্রশান্তি লাভ
আল্লাহ স্মরণ ব্যতীত মানুষের হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে না। মানুষের আকাক্সক্ষা, চাহিদা সীমাহীন। তথাপি কোন কিছুর আধিক্য তাদের মধ্যে একঘেয়েমীর সৃষ্টি করে। আধিক্য লাভে তারা প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। বিপরীত দিকে মহান আল্লাহর চিরন্তন সত্তার সাথে মিলনের পথে তারা যত এগিয়ে যায়, তাদের ব্যগ্রতা আরো বেড়ে যায়। মহান আল্লাহর স্মরণ মানুষকে এসব ক্ষেত্রে একমাত্র প্রশান্তির পায়রা হয়ে আবর্তিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَطۡمَئِنُّ قُلُوۡبُہُمۡ بِذِکۡرِ اللّٰہِ ؕ اَلَا بِذِکۡرِ اللّٰہِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়; জেনে রেখ আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়’ (সূরা আর-রা‘দ: ১৮)। অতএব মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের এবং মানুষের প্রশান্তির অন্যতম উপায় হলো আল্লাহর যিকির।
৭- আল্লাহর ইবাদত পালনকারী
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদতের জন্য এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁর আনুগত্য প্রদর্শন করার নিমিত্তে। এটাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। মহান আল্লাহ বলেন, وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ ‘আমার ইবাদতের জন্যই আমি সৃষ্টি করেছি মানুষ এবং জিনকে’ (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)। কিন্তু মানুষ যদি আল্লাহর ইবাদত না করে এবং তাঁর সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা না করে তাহলে তারা নিজেদের চিনতে পারবে না। আল্লাহর ব্যাপারে গাফেল হলে তারা নিজেদেরও ভুলে যাবে। এ পরিস্থিতিতে তারা বুঝতে পারবে না তাদের নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে; তাদের সৃষ্টি ও অস্তিত্বের পেছনে কী উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে তাও ভুলে যাবে। এ বিষয়ে সর্তক করে দিয়ে ধমকের সুরে মহান আল্লাহ বলেন, وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ نَسُوا اللّٰہَ فَاَنۡسٰہُمۡ اَنۡفُسَہُمۡ ؕ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে; ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করেছেন। তারাই তো পাপাচারী’ (সূরা আল-হাশর: ১৯)।
৮- পরকালীন সফলতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান
মানুষ ব— জাগতিক প্রেরণা বা উদ্দেশ্য নিয়েই বাঁচে না। অর্থাৎ বন্তুগত চাহিদা বা প্রয়োজনই মানুষের সকল কর্মের পেছনে একমাত্র প্রেরণা নয় বরং তারা মহত্ত্বের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। আর তা হলো পরকালীন সফলতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান। অতএব, কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতিরেকে তাদের সামনে আর কোন লক্ষ্যই থাকে না। এদিকে ইঙ্গিত করেই কুরআনুল কারীমে ঘোষিত হয়েছে মহাবাণী:
یٰۤاَیَّتُہَا النَّفۡسُ الۡمُطۡمَئِنَّۃُ- ارۡجِعِیۡۤ اِلٰی رَبِّکِ رَاضِیَۃً مَّرۡضِیَّۃً- فَادۡخُلِیۡ فِیۡ عِبٰدِیۡ-وَ ادۡخُلِیۡ جَنَّتِیۡ.
‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে আস সন্তুষ্ট ও সন্তোষ ভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (সূরা আল-ফাজর: ২৭-৩০)।
৯- মজবুত ঈমান
‘ঈমান’ মানে বিশ্বাস, প্রত্যয়, ধর্মীয় বিশ্বাস[২] অন্তরের বিশ্বাস।[৩] এক কথায় বলতে গেলে ঈমান হচ্ছে স্বীকৃতি প্রদান। পরিভাষায় ইসলামের মূল বিষয়গুলো মনে প্রাণে বিম্বাস করে মুখে স্বীকার করা এবং সে অনুযায়ী আমল করার নাম ঈমান। মানুষের মধ্যে এমন কতক মানুষ আছে যারা আল্লাহ তাঁর রাসূল, ফিরিশতা, আসমানী গ্রন্থাবলী ও সদৃশ্য বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখে। কোন অত্যাচারী শাসকের রক্ষচক্ষু ও তাদের বিন্দুমাত্র টলাতে পারে না। এমন ঈমানের এক জীবন্ত মডেল হিসাবে বিশ্বের বুকে সমাদৃত রয়েছেন, মুসলিম জাহানের প্রথম খলীফা আবূ বকর ছিদ্দীক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি তাঁর এম বেশী অগাধ আস্থা ছিল যে, মি‘রাজের ঘটনার বিবরণ শুনামাত্রই তিনি তা বিশ্বাস করে ফেলেন। পবিত্র কুরআন মানুষকে দু’ভাবে ভাগ করেছে। ১- ঈমানদার ৩ ২- যারা ঈমান আনেনি এমন। তবে যারা ঈমান আনে তাদের অধিকাংশই মজবুত ঈমানের অধিকারী হওয়া বাঞ্চনীয়। অন্যথা তারা বিশেষ বিশেষণে বিশেষিত হতে বাধ্য। তাইতো এরশাদ হয়েছে, ‘যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ; অতঃপর অবিচলিত থাতে তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফিরিশতা এবং বলে তোমার ভীত হইও না, চিন্তিত হইও না এবং তোমাদেরকে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও’ (সূরা হামীম আস-সিজদাহ: ৩০)। এ ধরনের ঈমানের অধিকারী যারা তারাই সফলকাম ও বিজয়ী হবে। তাদের জন্যই মহান আল্লাহ পরকালে মহাপুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَ لَا تَہِنُوۡا وَ لَا تَحۡزَنُوۡا وَ اَنۡتُمُ الۡاَعۡلَوۡنَ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ‘তোমরা হীনবল হইও না এবং দুঃখিত হইও না; তোমরাই বিজয়ী যদি তোমরা মুমিন হও’ (সূরা আলে ইমরান: ১৩৯)।
১০- দরিদ্র অথচ অল্পে তুষ্ট
সমাজে দু’শ্রেণীর মানুষ বাস করে। ধনী ও দরিদ্র। ধনী এবং দরিদ্রের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণার্থে ইসলামে যাকাতের বিধান রয়েছে, যা ধনীদের সম্পদ থেকে উত্তোলন করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরণ করতে হয়। কেননা ইসলাম সুসামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম। এতে যাকাতের বিধান রাখা হয়েছে যেন সম্পদ এক শ্রেণীর হাতে আবদ্ধ না হয়ে পড়ে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, کَیۡ لَا یَکُوۡنَ دُوۡلَۃًۢ بَیۡنَ الۡاَغۡنِیَآءِ مِنۡکُمۡ ‘যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই সম্পদ আবর্তন না করে’ (সূরা আল-হাশর: ৭)। এতদ্সত্ত্বেও এমন কতিপয় মানুষ রয়েছে যারা অভাবগ্রস্থ হওয়া সত্ত্বেও সন্তুষ্টচিত্তে জীবন-যাপন করে। তথাপিও মানুষের কাছে হাত পারে না এবং ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা বানায় না। পবিত্র কুরআনে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,
لِلۡفُقَرَآءِ الَّذِیۡنَ اُحۡصِرُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ لَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ ضَرۡبًا فِی الۡاَرۡضِ ۫ یَحۡسَبُہُمُ الۡجَاہِلُ اَغۡنِیَآءَ مِنَ التَّعَفُّفِ ۚ تَعۡرِفُہُمۡ بِسِیۡمٰہُمۡ ۚ لَا یَسۡـَٔلُوۡنَ النَّاسَ اِلۡحَافًا.
‘দান ছাদাক্বাহ তো ঐসব গরীব লোকদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে, দেশময় ঘুরাফিরা করতে পারে না, অথচ লোকেরা হাত না পাতার কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে; তুমি তাদের লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট কাকুতি মিনতি করে ভিক্ষা করে ভিক্ষা চায় না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৭৩)। মূলত অল্পে তুষ্টতাই শান্তির নিয়ামক। রাসূল (ﷺ) বলেন, الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ ‘অন্তরের প্রাচুর্যতাই প্রকৃত প্রাচুর্য’।[৪]
১১- তাক্বওয়া সম্পন্ন
‘তাক্বওয়া’ (تقوي) আরবী শব্দ। অর্থ হলো আল্লাহর ভয়, পরহেযগারী, দ্বীনদারী, ধার্মিকতা।[৫] যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে তাদেরকেই মুত্তাক্বী বলা হয়। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন কেবল মুত্তাক্বীদের জন্যই পথ প্রদর্শক। কুরআনের বিভিন্নস্থানে মানুষকে লক্ষ্য করে পরিপূর্ণ তাক্বওয়াবান হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ حَقَّ تُقٰتِہٖ وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যেভাবে ভয় করা উচিত সেরূপ ভয় কর এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না’ (সূরা আলে ইমরান: ১০২)। এ তাক্বওয়ার গুণে গুণান্বিত করার জন্য মানুষের উচিত, অধিক পরিমাণে তাঁকে স্মরণ করা এবং সকল কাজ তাঁর দেয়া বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করা। এ সব লোকদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰہُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُہُمۡ وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُہٗ زَادَتۡہُمۡ اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّہِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ.
‘মুমিন তো তারাই যাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। এবং যখন তাঁর আয়াতসমূহ তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপরই নির্ভর করে’ (সূরা আল-আনফাল: ২)। প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় যারা জীবন অতিবাহিত করে এবং তাঁর নিষিদ্ধ বিষয় ও কাজসমূহ থেকে নিজেকে বাঁঁিচয়ে রাখে তারাই মুত্তাক্বী। এ সব লোকদের জন্যই মহান আল্লাহ চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন।
১২- বিনয়ী ও ভদ্র
বিনয় ও নম্রতা মানুষের অন্যতম চারিত্রিক ভূষণ। বিনয় মানুষকে উচ্চ আসনে সমাসীন করতে এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে সহায়তা করে। বিনীয়কে মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে,
وَ عِبَادُ الرَّحۡمٰنِ الَّذِیۡنَ یَمۡشُوۡنَ عَلَی الۡاَرۡضِ ہَوۡنًا وَّ اِذَا خَاطَبَہُمُ الۡجٰہِلُوۡنَ قَالُوۡا سَلٰمًا.
‘রহমানের’ বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা শান্তি কামনা করে (তর্কে অবতীর্ণ হয় না)’ (সূরা আল-ফুরক্বান: ৬৩)। শুধু তাই নয়, একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত ও আল্লাহর প্রিয় বান্দা লুক্বমানও তার পুত্রকে একই আদেশ দিয়েছেন, ‘(প্রিয় বৎস) পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না’ (সূরা লুক্বমান: ১৮)।
১৩- দানশীল ও উদার
এ দু’টি উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। ইসলামে সম্পদের মালিক একমাত্র আল্লাহ। আর মানুষ হচ্ছে তার ব্যবহারকারী বা ভোক্তা মাত্র। অতএব, সম্পদকে পুঞ্জিভুত করে না রেখে মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া কতক মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। খুলাফায়ে রাশেদীন ও ছাহাবায়ে কেরাম এক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শ। দানের ক্ষেত্রে তাঁরা আমাদের জন্য ক্বিয়ামত অবধি মডেল হয়ে থাকবে। দানশীল লোকদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَ یُطۡعِمُوۡنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّہٖ مِسۡکِیۡنًا وَّ یَتِیۡمًا وَّ اَسِیۡرًا-اِنَّمَا نُطۡعِمُکُمۡ لِوَجۡہِ اللّٰہِ لَا نُرِیۡدُ مِنۡکُمۡ جَزَآءً وَّ لَا شُکُوۡرًا.
‘আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে এবং বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি। আমরা তোমাদের নিকট হতে কোন প্রতিদান চাই না। কৃতজ্ঞতাও নয়’ (সূরা আদ-দাহর: ৮-৯)।
১৪- ধৈর্যশীল
ধৈর্য একটি মহৎ গুণ। ধৈর্যশীলকে মহান আল্লাহ ভালোবাসেন। মানুষ এ পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরণের বাধা-বিপত্তি ও কষ্টের সম্মুখীন হয় যা দ্বারা মূলত তাদের পরীক্ষা করা হয়। আর তা হলো ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের ধ্বংস, জীবন ও সম্মানহানি প্রভৃতি। এক্ষেত্রে ধৈর্যশীলগণ খুব সহজেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ لَنَبۡلُوَنَّکُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ- الَّذِیۡنَ اِذَاۤ اَصَابَتۡہُمۡ مُّصِیۡبَۃٌ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّا لِلّٰہِ وَ اِنَّاۤ اِلَیۡہِ رٰجِعُوۡنَ.
‘আমরা তোমাদের কিছু ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে। যারা তাদের উপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৫৫-১৫৬)।
১৫- অপরকে অগ্রাধিকার দান
মানুষের স্বভাব হলো অন্যের উপর নিজের প্রাধান্য বিস্তার করা। তথাপিও আল্লাহর একান্ত অনুগত কতক বান্দা রয়েছে; যারা নিজেদের আমিত্বকে ভুলে গিয়ে অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দানে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়ে থাকে। ছাহাবায়ে কেরাম ছিলেন এ দৃষ্টান্তের মূর্ত প্রতীক। বিশেষত আনছারগণ সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এক্ষেত্রে নিজেদের মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
وَ الَّذِیۡنَ تَبَوَّؤُ الدَّارَ وَ الۡاِیۡمَانَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ یُحِبُّوۡنَ مَنۡ ہَاجَرَ اِلَیۡہِمۡ وَ لَا یَجِدُوۡنَ فِیۡ صُدُوۡرِہِمۡ حَاجَۃً مِّمَّاۤ اُوۡتُوۡا وَ یُؤۡثِرُوۡنَ عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ وَ لَوۡ کَانَ بِہِمۡ خَصَاصَۃٌ ؕ۟ وَ مَنۡ یُّوۡقَ شُحَّ نَفۡسِہٖ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ
‘মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এ নগরীতে বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে তারা মুহাজিরদের ভালোবাসা এবং মুহাজিরদের যা দেয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে আকাক্সক্ষা পোষণ করে না। আর তারা তাদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য হতে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম’ (সূরা আল-হাশর: ৯)।
১৬- ক্রোধ দমনকারী
ক্রোধ মানুষের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষের সৃষ্টি করে দেয়। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে মানুষের পরস্পরের প্রতি ঘৃণাবোধ জন্ম নেয়। এমনকি অন্যায় পথে পা বাড়াতেও এ ক্রোধ মানুষকে সাহায্য করে। অতএব, ক্রোধ হলো বিভ্রান্তিকর একটি মানবিক দুর্বলতার নাম। মুমিনগণ এ ক্রোধকে দমন করে স্বীয় কাজে সিদ্ধহস্ত হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ গুণটির উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা নিজেদের ক্রোধকে সংবরণ করে’ (সূরা আলে ইমরান: ১৪৩)। এ মনের অধিকারী ব্যক্তিগণই হলেন সৎকর্মপরায়ণ।
১৮- ক্ষমাশীল
ক্ষমা অন্যতম একটি মানবিক গুণাবলী। যা মানুষকে বড় মনের অধিকারী বানাতে সাহায্য করে এবং ক্রোধ সংবরণে সহায়তা করে। ক্রোধের সাথে ক্ষমা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। ক্রোধের সাথেই ক্ষমাশীলতার উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
اُولٰٓئِکَ جَزَآؤُہُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ مِّنۡ رَّبِّہِمۡ وَ جَنّٰتٌ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ وَ نِعۡمَ اَجۡرُ الۡعٰمِلِیۡنَ.
‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদেরকে ভালোবাসেন’ (সূরা আলে ইমরান: ১৩৬)। এসব গুণাবলীর অধিকারী যেসব মানুষ রয়েছে, মূলত তাদের জন্যই মহান আল্লাহ স্বীয় গুণে গুণান্বিত হয়ে ক্ষমা ও চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন। উপরোল্লিখিত আয়াতের পূর্বোক্ত আয়াতে সে বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, وَ سَارِعُوۡۤا اِلٰی مَغۡفِرَۃٍ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ جَنَّۃٍ عَرۡضُہَا السَّمٰوٰتُ وَ الۡاَرۡضُ ۙ اُعِدَّتۡ لِلۡمُتَّقِیۡنَ ‘তোমরা ধাবমান হও তোমদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের ন্যায়। যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাক্বীদের জন্য’ (সূরা আলে ইমরান: ১৩৩)।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।
[১] ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান (ঢাকা: রিয়াদ প্রকাশনী, ৪র্থ সংস্কার, ২০০২ খ্রি.), ৩২২।
[২] ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৩।
[৩] মুফতী আমীমুল ইহসান, কাওয়ায়েদুল ফিকহ, পৃ. ২০০।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৪৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫১।
[৫] ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৯।
প্রসঙ্গসমূহ »:
কুরআনুল কারীম