মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৪ পূর্বাহ্ন

কুসংস্কার প্রতিরোধে সুন্নাহর ভূমিকা 

-ড. সাদীক মাহমুদ* 


ভূমিকা

কুসংস্কার হলো নিছক ধারণা ও কল্পনাভিত্তিক প্রমাণহীন বিশ্বাস এবং ঐ বিশ্বাস অনুযায়ী ভিত্তিহীন প্রথা ও কর্ম। মূলত শিরক ও বিদ‘আতই সমাজে কুসংস্কারের নামে চালু আছে। অথচ কুসংস্কার ঈমানকে নষ্ট করে দেয়। ইসলামী শরী‘আতে কুসংস্কারের কোন স্থান নেই। আখিরাতে বিশ্বাসী প্রতিটি মুসলিমের উচিত অন্ধভাবে কোন কিছুর অনুসরণ করার ভয়াবহতা সম্বন্ধে সচেতন ও সাবধান হওয়া। কারণ শয়তান মানুষের সামনে মিথ্যাকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَوَسۡوَسَ اِلَیۡہِ الشَّیۡطٰنُ قَالَ یٰۤـاٰدَمُ ہَلۡ اَدُلُّکَ عَلٰی شَجَرَۃِ الۡخُلۡدِ وَ مُلۡکٍ لَّا یَبۡلٰی ‘অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। সে বলল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দিব অনন্তকাল জীবিত থাকার বৃক্ষের কথা এবং অক্ষয় রাজ্যের কথা?’ (সূরা ত্বোহা: ১২০)।

বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে মঙ্গল-অমঙ্গল, কল্যাণ-অকল্যাণ ও শুভ-অশুভ কামনায় অসংখ্য কুসংস্কার বিদ্যমান। বিভিন্ন দিবস ও প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদ্যাপন করা হয়। ১লা বৈশাখে ‘মঙ্গল শোভা যাত্রা’ বের করা ও ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার উদ্দেশ্য হল, বৈশাখ জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে। শুভ নববর্ষ, নববর্ষের শুভেচ্ছা, নববর্ষ উদযাপন ইত্যাদি অনুষ্ঠান করা হয় মঙ্গলের বার্তাবাহক হিসাবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, জন্ম দিবস, মৃত্যু দিবস, বালাকোট দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস যেভাবে পালন করা হয়, তাতে মূলত দিবসের কৃতিত্বই স্মরণ করা হয়। এই দিনগুলোতে আয়োজন করা হয় দু‘আ মাহফিল, মীলাদ মাহফিল ও মিসকীন খাওয়ানোর অনুষ্ঠান। এছাড়া ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ইট-বালি-সিমেন্ট দ্বারা তৈরি শহীদ মিনার ও বেদীতে। ইসলামী দলের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন বার্ষিকীতে শববেদারী পালন করেন অর্থাৎ ‘ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করেন। দলের পক্ষ থেকে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয় এবং অত্যন্ত বিনয় ও আদবের সাথে গুরু গম্ভীরভাবে দিবসটাকে মর্যাদা দান করা হয়। মূলত দিবস বা প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনের ক্ষেত্রে সাধারণত দু’টি দিক লক্ষ্য করা যায়। এক- দিনটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় এবং কল্যাণবহ মনে করা হয়। সেই সাথে এমন কিছু কর্মসূচী পালন করা হয়, যেগুলো পরিষ্কার শিরক। এই দিক থেকে এগুলো শিরকের আওতায় পড়ে যায়। দুই- কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক কুসংস্কার হিসাবে তা পালন করা হয়, যার অধিকাংশই বিধর্মীদের আবিষ্কার করা। এগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে বিদ‘আত এবং অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ সমস্ত অপসংস্কৃতিকে ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কুসংস্কার দূরীকরণে যে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন তার কতিপয় বিষয় নিম্নে তুলে ধরা হল:

১. অশুভ বা কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই

মুসলিম কিংবা অমুসলিম সকল সমাজে অশুভ বা কুলক্ষণের উপস্থিতি ব্যাপকহারে লক্ষ্য করা যায়। ইসলামে এটাকে শিরক ও তাওয়াক্কুল পরিপন্থী হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

لَا طِيَرَةَ، وَخَيْرُهَا الْفَأْلُ. قَالُوْا وَمَا الْفَأْلُ قَالَ الْكَلِمَةُ الصَّالِحَةُ يَسْمَعُهَا أَحَدُكُمْ

‘অশুভ বা কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই, বরং তা শুভ বলে মনে করা ভাল। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! শুভ লক্ষণ কী? তিনি বললেন, এরূপ অর্থবোধক কথা, যা তোমাদের কেউ শুনতে পায়’।[১]

অপর এক বর্ণনায়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ. ثَلَاثًا وَمَا مِنَّا إِلَّا وَلَكِنَّ اللهَ يُذْهِبُهُ بِالتَّوَكُّلِ ‘যে কোন বিষয়কেই অশুভ ও কুলক্ষণে মনে করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। তিনি এ বাক্যটি তিনবার উল্লেখ করেছেন। আর আমাদের মধ্যে কারো মনে যেন অশুভ ধারণার উদ্রেক না হয়, কিন্তু আল্লাহর উপরে পূর্ণ তাওয়াক্কুল করলে তিনি তা দূরীভূত করে দেন’।[২] ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, مَنْ رَدَّتْهُ الطِّيَرَةُ مِنْ حَاجَةٍ فَقَدْ أَشْرَكَ ‘কুলক্ষণ বা দুর্ভাগ্যের ধারণা যে ব্যক্তিকে তার স্বীয় প্রয়োজন, দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে দূরে রাখল, সে মূলত শিরক করল’।[৩] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেছেন, لَا عَدْوَى وَلَا طِيَرَةَ وَلَا هَامَةَ وَلَا صَفَرَ، وَفِرَّ مِنَ الْمَجْذُوْمِ كَمَا تَفِرُّ مِنَ الْأَسَدِ ‘রোগের কোন সংক্রমণ নেই, কুলক্ষণ বলে কিছু নেই, পেঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, সফর মাসের কোন অশুভ নেই। কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাক, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাক’।[৪]

আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لَا عَدْوَى وَلَا هَامَةَ وَلَا نَوْءَ وَلَا صَفَرَ ‘সংক্রামক বলতে কিছু নেই। তারকার (উদয় বা অস্ত যাওয়ার) কারণে বৃষ্টি হওয়া ভিত্তিহীন এবং ছফর মাসে অশুভ বলতে কিছু নেই!’[৫]

২. দিবস পালন নিষিদ্ধ

ইসলামে দিবস পালনের কোন প্রমাণ নেই, অনুমোদনও নেই। অথচ পালন করার মত অনেক কিছুই রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং ছাহাবায়ে কিরাম কখনো আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম দিবস পালন করেননি, যদিও এক শ্রেণির মুসলিম বর্তমানে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ নামে দিবস পালন করে থাকে। এসবের কোন প্রমাণ সোনালী যুগের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বরং এগুলোর বিরুদ্ধেই ইসলামের অবস্থান। যেমন শুক্রবার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন। কিন্তু এই দিনে বিশেষ কোন ‘ইবাদত করা বা ছিয়াম পালন করার জন্য নির্দিষ্ট করা নিষেধ।[৬] এছাড়া কোন স্থান তো দূরের কথা, বিশেষ নেকীর আশায় তিনটি মসজিদ ছাড়া কোন মসজিদেও ভ্রমণ করা যাবে না।[৭]

৩. তাক্বদীরের মালিক একমাত্র আল্লাহ

তাক্বদীর নির্ধারণের মালিক একমাত্র আল্লাহ। যার ভাগ্যে যা নির্ধারণ করা আছে, তার জন্য সেটিই ঘটবে। তাই যে কোন সমস্যায় পতিত হলে একজন মুসলিমের উচিত শুধু আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করা। কারণ আল্লাহ তা‘আলা কারো কোন উপকার বা ক্ষতি করার নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كُنْتُ خَلْفَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ يَوْمًا فَقَالَ يَا غُلَامُ احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ احْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ وَإِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوِ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوْكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ لَكَ وَلَوِ اجْتَمَعُوْا عَلَى أَنْ يَضُرُّوْكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوْكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ عَلَيْكَ رُفِعَتِ الْأَقْلاَمُ وَجُفَّتِ الصُّحُفُ

ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘আমি একদিন রাসূল (ﷺ)-এর পিছনে ছিলাম। তিনি বললেন, হে বৎস! আল্লাহর অধিকার সংরক্ষণ কর, আল্লাহ তোমাকে সংরক্ষণ করবেন। তুমি আল্লাহর উপর ভরসা কর, তোমার প্রয়োজনে তাঁকে পাবে। যখন তুমি চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন সাহায্য চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। তুমি জেনে রাখ! সমস্ত মানুষ যদি তোমার উপকার করার চেষ্টা করে তারা সক্ষম হবে না, যদি আল্লাহ তা তোমার জন্য নির্ধারণ না করেন। আর যদি সকলে মিলে কোন বিষয়ে তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে, আর আল্লাহ যদি তা নির্ধারণ না করেন, তাহলে তারা তা করতে পারবে না। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং খাতা বন্ধ করা হয়েছে’।[৮] অর্থাৎ আল্লাহর বিধান মত যা হবার তা হবেই। কারো কিছু করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই।

৪. ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করা নিষেধ

কুসংস্কারে বিশ্বাস করা মানে ভ্রষ্টতায় বিশ্বাস করা ও তার দিকে মানুষকে আহ্বান করা। অথচ কেউ যদি মানুষকে গোমরাহী করে আর তাদের দেখানো পথ যতজন অনুসরণ করবে, ততজনের গোনাহের অংশ গোমরাহকারীর ‘আমলনামায় লেখা হবে। এজন্য মানুষকে গোমরাহীর দিকে পরিচালিত না করে হেদায়াতের পথ দেখানো উচিত। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

عَنْ أَبِىٍْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلَالَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا

আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কাউকে সৎ পথের দিকে আহ্বান করে, তার জন্য সেই পরিমাণ ছওয়াব রয়েছে, যা তার অনুসারীদের জন্য রয়েছে। অথচ এতে তাদের নিজস্ব ছওয়াবে কোনরূপ কমতি হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কাউকে পথভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করে, তার জন্যও ঠিক সেই পরিমাণ গোনাহ রয়েছে, যা তার অনুসারীদের জন্য রয়েছে। অথচ তাদের নিজস্ব গোনাহে কোনরূপ কমতি হবে না’।[৯]

৫. কবরকেন্দ্রিক কুসংস্কার নিষিদ্ধ

এদেশের কোটি কোটি মানুষ বিভিন্ন অলী-আওলিয়ার মাজারে কবরে শায়িত পীরদের কাছে মানত করে মাক্বছূদ পূরণের চেষ্টা করে থাকে। এসব মাজার থেকে তারা বরকত হাসিল করতে পারবে বলে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস শিরকে আকবার বা বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত। কারণ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনকিছু বা কারো নামে মানত করা ও যব্হ করা হারাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে উপমহাদেশে মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ মাযার তৈরি হয়েছে। আর সেগুলোতে একাধিক মসজিদও আছে, যা কবরে শায়িত পীরকে বেষ্টন করে রেখেছে। সেখানে প্রত্যেক বছর ওরস করা হয়। লাখ লাখ মানুষের ভীড় জমে থাকে। আর এই তীর্থস্থানেই মানুষ কোটি কোটি টাকা, গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যাদি নযর-নেওয়ায করছে। যার মূল উদ্দেশ্যই থাকে কবরে শায়িত পীরকে খুশি করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং জান্নাত লাভ করা। আরো দুঃখজনক হল, উক্ত স্থানগুলোতে মসজিদ তৈরি করে ছালাত আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। অথচ এ সমস্ত স্থানে ছালাত আদায় করা পরিষ্কার হারাম। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ الْأَرْضُ كُلُّهَا مَسْجِدٌ إِلَّا الْمَقْبَرَةَ وَالْحَمَّامَ

আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘পৃথিবীর পুরোটাই মসজিদ। তবে কবরস্থান ও গোসলখানা ব্যতীত’।[১০] তাছাড়া কবরের মাঝে ছালাত আদায় করা যাবে না মর্মে স্পষ্ট ছহীহ হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ نَهَى رَسُوْلُ اللهِ ﷺ عَنِ الصَّلَاةِ بَيْنَ القُبُوْرِ

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কবরের মাঝে ছালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন।[১১] 

বিশ্ব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূল (ﷺ) তাঁর কবরস্থানকে বানানো ওরস বা এর নামে বার্ষিক মেলায় পরিণত করতে কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন।[১২] নবী-রাসূল ও সৎকর্মশীল বান্দাদের কবরকে মসজিদে পরিণত করতে নিষেধ করেছেন এবং যারা এ ধরনের জঘন্য কাজ করবে, তাদেরকে কঠোর শাস্তি দানের জন্য আল্লাহর নিকট বদ দু‘আ করেছেন।[১৩] তাহলে সাধারণ লোকদের কবরকে কিভাবে মসজিদের স্থান হিসাবে নির্ধারণ করা যায়? তাদের কবরস্থানে কিভাবে ওরস করা যায়?

এ সমস্ত কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মৃত ব্যক্তির কবরকে কেন্দ্র করে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল লক্ষ লক্ষ মাযার-খানকা তৈরি করেছে। এরই সাথে সেখানে মসজিদ তৈরি করে কোটি কোটি মানুষের ঈমান হরণ করা হচ্ছে। কবরকে সিজদা করে, সেখানে মাথা ঠুকে আল্লাহর তাওহীদী চেতনাকে নস্যাৎ করা হচ্ছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে তাদের কর্ণকুহরে এই সমস্ত বাণী প্রবেশ করে না। কারণ হলো, প্রতিনিয়ত তাদেরকে জিন শয়তান নফস মূর্তিপূজা করতে উৎসাহিত করছে। ‘উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, مَعَ كُلِّ صَنَمٍ جِنِّيَّةٌ ‘প্রত্যেক মূর্তির সাথে একজন করে নারী জিন থাকে’।[১৪] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنۡ یَّدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِہٖۤ  اِلَّاۤ اِنٰثًا ۚ وَ اِنۡ یَّدۡعُوۡنَ  اِلَّا شَیۡطٰنًا مَّرِیۡدًا ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা কেবল নারীদের আহ্বান করে। বরং তারা বিদ্রোহী শয়তানকে আহ্বান করে’ (সূরা আন-নিসা : ১১৭)।

৬. মূর্তি পূজা হারাম

ধর্মের ছদ্মাবরণে অনেক কুসংস্কার যে ছড়িয়ে পরে, তার প্রমাণ হলো রাসূল (ﷺ)-এর আগমনের সময় পবিত্র কা‘বাঘরে ৩৬০টি মূর্তির অবস্থান। আরবের মানুষগুলো ধর্মীয় বিধান মনে করে এ সকল মূর্তির পূজা করতো। এ প্রসঙ্গে রাসূল (ﷺ) বলেন,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ دَخَلَ النَّبِىُّ ﷺ مَكَّةَ وَحَوْلَ الْكَعْبَةِ ثَلَاثُمِائَةٍ وَسِتُّوْنَ نُصُبًا فَجَعَلَ يَطْعَنُهَا بِعُوْدٍ فِىْ يَدِهِ وَجَعَلَ يَقُوْلُ (جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ)

‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, (মক্কা বিজয়ের দিনে) রাসূল (ﷺ) মক্কায় প্রবেশ করলেন। তখন কা‘বার চারপাশে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করা ছিল। রাসূল (ﷺ) তাঁর হাতের লাঠি দ্বারা মূর্তিগুলোকে আঘাত করতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, ‘হক্ব এসেছে বাতিল চুরমার হয়েছে’।[১৫] অন্য হাদীছে রাসূল (ﷺ) বলেন,  أَرْسَلَنِىْ بِصِلَةِ الْأَرْحَامِ وَكَسْرِ الْأَوْثَانِ وَأَنْ يُوَحَّدَ اللهُ لَا يُشْرَكُ بِهِ شَىْءٌ ‘আমাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে মূর্তি ভেঙ্গে খান খান করার জন্য এবং আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য, যেন তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করা হয়’।[১৬]

৭. বাড়াবাড়ি বা সীমালঙ্ঘন নিষিদ্ধ

শিরকের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, নবী, রাসূল, সৎব্যক্তি বা কারো সম্মান-মর্যাদার ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। আল-কুরআনের ভাষায় এটিকে غلو বলা হয়। ইংরেজীতে এর অর্থ করা হয়েছে Exceeding of proper bounds. সম্মান, মর্যাদা এবং ভক্তি-শ্রদ্ধার সীমালঙ্ঘন শিরকের দিকে ঠেলে দেয়ার অন্যতম কারণ। কুরআন মাজীদে দু’টি স্থানে মহান আল্লাহ غلو অর্থ বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।

(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَہۡلَ الۡکِتٰبِ لَا تَغۡلُوۡا فِیۡ دِیۡنِکُمۡ وَ لَا تَقُوۡلُوۡا عَلَی اللّٰہِ  اِلَّا الۡحَقَّ ؕ اِنَّمَا الۡمَسِیۡحُ عِیۡسَی ابۡنُ مَرۡیَمَ رَسُوۡلُ اللّٰہِ وَ کَلِمَتُہٗ ۚ اَلۡقٰہَاۤ اِلٰی مَرۡیَمَ وَ رُوۡحٌ مِّنۡہُ ۫ فَاٰمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رُسُلِہٖ ۚ۟ وَ لَا تَقُوۡلُوۡا ثَلٰثَۃٌ ؕ اِنۡتَہُوۡا خَیۡرًا  لَّکُمۡ ؕ اِنَّمَا اللّٰہُ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ ؕ سُبۡحٰنَہٗۤ اَنۡ یَّکُوۡنَ لَہٗ  وَلَدٌ ۘ لَہٗ  مَا  فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا  فِی  الۡاَرۡضِ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰہِ  وَکِیۡلًا

‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি বা সীমালঙ্ঘন করো না এবং আল্লাহর ব্যাপারে সঙ্গত বিষয় ছাড়া কথা বলো না। নিঃসন্দেহে মারইয়াম পুত্র ‘ঈসা মাসীহ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর বাণী, যা তিনি মারইয়ামের নিকট প্রেরণ করেছেন এবং রূহ তাঁর কাছ থেকেই আগত। অতএব তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনো। আর এ কথা বলো না যে, আল্লাহ তিনের এক। এ কথা পরিহার কর।  তোমাদের জন্য কল্যাণকর হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ একক ইলাহ। সন্তান হওয়া থেকে তিনি পবিত্র। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে সব তাঁরই জন্য, আর কর্ম বিধানে আল্লাহই যথেষ্ট’ (সূরা আন-নিসা: ১৭১)।

(২) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لاَ تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلاَ تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيراً وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ

‘বল, হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা নিজেদের ধর্মে বাড়াবাড়ি বা সীমালঙ্ঘন করো না এবং তোমরা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যারা পূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে। আর তারা সঠিক-সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৭৭)।

এখানে লক্ষণীয় যে, প্রথম আয়াতে ‘সীমালঙ্ঘন’ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তারপর ‘ঈসা ইবনু মারইয়ামকে আল্লাহর রাসূল বলা হয়েছে। আল্লাহকে তিনের এক বলতে বারণ করা হয়েছে। আল্লাহই একমাত্র ইলাহ বলা হয়েছে। এতে এ বিষয়টি স্পষ্ট হলো যে, সীমালঙ্ঘনই ‘ঈসা ইবনু মারইয়ামকে ঘিরে বিভ্রান্ত আক্বীদার মূল কারণ।

দ্বিতীয় আয়াতে সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করা হয়েছে। তারপর যারা ভ্রান্ত ও যারা ভ্রান্ত করে তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এতে বুঝা গেল যে, সীমালঙ্ঘন বা বাড়াবাড়িই হচ্ছে গোমরাহীর কারণ। পুরো কুরআন মাজীদ غلو তথা বাড়াবাড়ি বা সীমালঙ্ঘন বিষয়ক আয়াত এ দু’টোই। ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান-মর্যাদায় অতিরঞ্জন এক ভয়ানক মানসিক ব্যাধি, যা মানুষকে শিরকের দিকে ঠেলে দেয়। আর এ কারণে রাসূল (ﷺ) এ ধ্বংসাত্মক ব্যাধি থেকে উম্মাতকে সতর্ক ও সাবধান করে বলেছেন, إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِي الدِّيْنِ، فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ ‘তোমরা বাড়াবাড়ির ব্যাপারে সতর্ক ও সাবধানতা অবলম্বন করবে। কেননা এ বাড়াবাড়িই তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করে দিয়েছে’।[১৭]

এ ভক্তি-শ্রদ্ধার সীমালঙ্ঘনই খ্রিষ্টানদের ভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টাতায় নিক্ষেপ করেছিল ফলে তারা আল্লাহর বান্দা ও নবী ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে মানুষ ও নবীর সীমানা থেকে বের করে নিয়ে ইলাহ তথা প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। আল্লাহর মত তারও উপাসনা শুরু করেছে। এ অতিরঞ্জনের কারণেই আহলে কিতাবরা আল্লাহর স্থলে আহবার ও রুহবান তথা জ্ঞানী ও দরবেশদেরকে রব বানিয়েছে। ভক্তি-শ্রদ্ধার আতিশয্যেই বুযুর্গ লোকদেরকে তাদের মূল অবস্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে আরো উপরে তাদের অধিষ্ঠিত করা হয়। তাদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করা হয় যে, তারা উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন। তারা যেমন কারো কল্যাণ করতে পারেন, আবার তাকে বিপদমুক্তও করতে পারেন। এ বিশ্বাসেই মানুষ তাদের কাছে ফরিয়াদ ও প্রার্থনা করে যেমনটি করে আল্লাহর কাছে, বিপদ মুক্তির জন্য তাদের সাহায্য চায় যেমনটি চায় আল্লাহর কাছে, তাদের কবরগুলোক তারা তাদের প্রয়োজন পূরণের আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়ে নিয়েছে। তাই ভক্তি-শ্রদ্ধার এ বাড়াবাড়ি অতীত ও বর্তমান মুসলিম উম্মাহর জন্য এক ভয়াবহ বিপদ, যা অতীতেও তাদের বিভিন্ন ধরনের শিরকের আবর্তে নিক্ষেপ করেছে এবং এখনো করছে। দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে মানা ঈমানের অনিবার্য দাবী। ইসলামের মূলভিত্তি শাহাদাতাইন মানে দু’টি বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়া। তার দ্বিতীয়টি হচ্ছে মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তাঁর রিসালাতে বিশ্বাস, তাঁকে মানা, তাঁকে সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা ঈমান ও ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই তাকে ঘিরেই সম্মান-মর্যাদা এবং ভক্তি-শ্রদ্ধার সীমালঙ্ঘন ও অতিরঞ্জনের সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। কোন অবস্থাতেই যেন তাঁকে তাঁর সম্মান-মর্যাদার মূল অবস্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে আল্লাহর সাথে শরীক করা না হয়। তাই আল্লাহ বলেছেন, قُلۡ اِنَّمَاۤ  اَنَا بَشَرٌ  مِّثۡلُکُمۡ  یُوۡحٰۤی  اِلَیَّ اَنَّمَاۤ  اِلٰـہُکُمۡ  اِلٰہٌ  وَّاحِدٌ ‘(হে নবী!) আনি বলুন, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি অহি করা হয় যে, তোমাদের ইলাহ একমাত্র একজনই’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ১১০)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلۡ  لَّاۤ  اَقُوۡلُ لَکُمۡ عِنۡدِیۡ خَزَآئِنُ اللّٰہِ وَ لَاۤ  اَعۡلَمُ الۡغَیۡبَ وَ لَاۤ  اَقُوۡلُ لَکُمۡ  اِنِّیۡ مَلَکٌ ۚ اِنۡ  اَتَّبِعُ  اِلَّا مَا یُوۡحٰۤی  اِلَیَّ ؕ قُلۡ ہَلۡ  یَسۡتَوِی الۡاَعۡمٰی وَ الۡبَصِیۡرُ ؕ اَفَلَا  تَتَفَکَّرُوۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে রয়েছে আল্লাহর ভাণ্ডারসমূহ। আমি গায়েব তথা অদৃশ্য বিষয়ে অবগত নই। আমি এমনও বলি না যে, আমি মালাক (ফেরেশতা)। আমি তো শুধু আমার কাছে প্রেরিত অহির অনুসরণ করি। তুমি বল, অন্ধ ও দৃষ্টিসম্পন্ন কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা কর না’ (সূরা আল-আন‘আম: ৫০)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

قُلۡ لَّاۤ  اَمۡلِکُ  لِنَفۡسِیۡ  نَفۡعًا وَّ لَا  ضَرًّا  اِلَّا مَا شَآءَ اللّٰہُ ؕ وَ لَوۡ کُنۡتُ اَعۡلَمُ الۡغَیۡبَ لَاسۡتَکۡثَرۡتُ مِنَ الۡخَیۡرِۚۖۛ وَ مَا مَسَّنِیَ  السُّوۡٓءُ ۚۛ اِنۡ  اَنَا  اِلَّا  نَذِیۡرٌ وَّ بَشِیۡرٌ  لِّقَوۡمٍ  یُّؤۡمِنُوۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধন ও অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, তবে আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি গায়েব তথা অদৃশ্য বিষয় জানতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করতে পারতাম। কোন অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি তো শুধু ঈমানদার গোষ্ঠীর জন্য একজন ভীতি প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদদাতা’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৮৮)।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজেও নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ وَاللهِ مَا أُحِبُّ أَنْ تَرْفَعُوْنِىْ فَوْقَ مَنْزِلَتِى الَّتِىْ أَنْزَلَنِى اللهُ عَزَّ وَجَلَّ

‘আমি ‘আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহর কসম! মহান আল্লাহ আমাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, তোমরা আমাকে তাঁর উপরে উঠাও তা আমি পসন্দ করি না’।[১৮] ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

لَا تُطْرُوْنِىْ كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ

‘খ্রিষ্টানরা মারইয়াম পুত্রকে নিয়ে যেভাবে অতিরঞ্জন করেছে তোমরা আমাকে নিয়ে সেভাবে অতিরঞ্জন করো না। আমি তো শুধু আল্লাহর একজন বান্দা। তাই তোমরা (আমার ক্ষেত্রে বল যে,) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[১৯] মহান আল্লাহ বলেন,

وَ لَا تَقُوۡلُوۡا لِمَا تَصِفُ اَلۡسِنَتُکُمُ الۡکَذِبَ ہٰذَا حَلٰلٌ وَّ ہٰذَا حَرَامٌ لِّتَفۡتَرُوۡا عَلَی اللّٰہِ  الۡکَذِبَ ؕ اِنَّ  الَّذِیۡنَ یَفۡتَرُوۡنَ عَلَی اللّٰہِ الۡکَذِبَ لَا یُفۡلِحُوۡنَ

‘তোমাদের মুখ যেসব মিথ্যা রচনা করে, তার ভিত্তিতে আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম। নিশ্চয় যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করে তারা সফলকাম হবে না’ (সূরা আন-নাহল: ১১৬)।

এ কারণেই অতীতের স্বনামধন্য ইসলামী ব্যক্তিত্বগণ ফাতাওয়া প্রদানকে ভয় পেতেন। ফাতাওয়া দেয়ার মত কাউকে পাওয়া না গেলে খুবই প্রয়োজনের সময় ছাড়া তারা ফাতাওয়া দিতেন না। কিন্তু বর্তমান সময়ে ফাতাওয়া যেন প্রতিযোগিতার একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে অবতরণ করে অনেকে খ্যাতি অর্জনের চেষ্টা করছে। এমনকি কেউ কেউ আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে হলেও মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়।

৮. কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকার দু‘আ

শায়খ ছালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, এই তিনটি জিনিসের মাধ্যমে কুসংস্কার মোকাবেলা করা যেতে পারে।

  • আল্লাহর উপর পূর্ণ এবং সঠিকভাবে ভরসা রাখুন।
  • আপনি যা করতে চান তা নিয়ে এগিয়ে যান এবং এটিতে দেরি করবেন না বা আপনার মন পরিবর্তন করবেন না।
  • শয়তানের এই ফাঁদ থেকে আপনাকে মুক্ত করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন এবং তাঁর কাছে যা ভাল তা চান এবং মন্দ থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করুন।[২০]

আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

مَنْ رَدَّتْهُ الطِّيَرَةُ مِنْ حَاجَةٍ فَقَدْ أَشْرَكَ. قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ مَا كَفَّارَةُ ذَلِكَ قَالَ أَنْ يَقُوْلَ أَحَدُهُمْ: اللَّهُمَّ لَا خَيْرَ إِلَّا خَيْرُكَ وَلَا طَيْرَ إِلَّا طَيْرُكَ وَلَا إِلَهَ غَيْرُكَ

‘অশুভ, অযাত্রা বা অমঙ্গল ভেবে যে তার কর্ম বা যাত্রা পরিত্যাগ করল, সে শিরক করল। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এর কাফফারা কী? তিনি বলেন, একথা বলবে যে, হে আল্লাহ! আপনার কল্যাণ ছাড়া কোন কল্যাণ নেই, আপনার শুভাশুভ ছাড়া কোন শুভ বা অশুভ নেই এবং আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই’।[২১]

মোটকথা অন্তরে কুসংস্কার লালনের ফলে মানব মনে যে প্রভাব বিস্তার করে, তা একজন মানুষকে ঈমানহারা বানায় এবং শিরকের দিকে ধাবিত করে। বাংলাদেশে মুসলিম সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের প্রভাবে সুন্নাতী রীতি-নীতি বিলুপ্ত হতে চলেছে। এক্ষণে কুসংস্কারের প্রতি মানুষের বদ্ধমূল বিশ্বাসের কারণে সমাজ ব্যবস্থায় যে সকল প্রভাব বিস্তার করে আছে, সেগুলো নির্মূল করা সময়ের অনিবার্য দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমাদের সব ধরনের কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে জীবন পরিচালনা করতে হবে। আমাদের সমাজ থেকে যাবতীয় কুসংস্কার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন ও সজাগ করতে ‘আলেম-উলামা, মসজিদের ইমাম, খত্বীব, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সমাজ উন্নয়ন কর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষকে দ্বীন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে এমন অলীক ও ধরাণাপ্রসূত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবের পরিবর্তন অতীব যরূরী।

উপসংহার

আমাদের উচিত ব্যক্তি জীবনে, সমাজ জীবনে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে যেসব কুসংস্কার, অন্যায় ও অপসংস্কৃতি প্রবেশ করেছে, তা উৎখাত করার চেষ্টা চালানো। এজন্য বিশ্ববাসীর এক অনুপম আদর্শ হলেন বিশ্ব মানবতার সংস্কারক নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ), যাঁর নবুঅতী জীবনের সকল কথা, কাজ, সমর্থন ও অনুমোদন নিদ্রিত ও জাগ্রত সব কর্মকাণ্ডই অনুসরণীয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘নিশ্চয় রাসূল (ﷺ)-এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (সূরা আল-আহযাব: ২১)।


* ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মাসিক আল-ইখলাছ।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৫৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২২২৩।
[২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৬৮৭।
[৩]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৭০৪৫।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭০৭।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২২০।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৪৪।
[৭]. যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لَا تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ: المَسْجِدِ الحَرَامِ، وَمَسْجِدِ الرَّسُولِ ﷺ، وَمَسْجِدِ الأَقْصَى -দ্র. ছহীহ বুখারী, হা/১১৮৯, পৃ. ১৯৭।
[৮]. তিরমিযী, হা/২৫১৬।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৪।
[১০]. তিরমিযী, হা/৩১৭; ইবনু মাজাহ, হা/৭৪৫।
[১১]. ইবনু হিব্বান, হা/২৩১৩। উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিছগণ বলেন, কবর ক্বিবলার সামনে থাক কিংবা ডানে থাক, বামে থাক বা পিছনে থাক সে স্থানে সালাত হবে না। দ্র.: শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী, আহকামুল জানাইয, পৃ. ২১৪; আস-সামারুল মুস্তাত্বাব, পৃ. ৩৫৭- وَسَوَاءٌ فِىْ ذَلِكَ أَ كَانَ الْقَبْرُ قِبْلَتَهُ أَوْ عَنْ يَمِيْنِهِ أَوْ عَنْ يَسَارِهِ وَ خَلْفَهُ لَكِنَّ اسْتِقْبَالَهُ بِالصَّلاَةِ أَشَدُّ لِقَوْلِهِ ﷺ  لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارَى اِتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ
[১২]. আবূ দাঊদ, হা/২০৪২।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৩২।
[১৪]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২১২৬৯।
[১৫]. সহীহুল বুখারী, হা/২৪৭৮।
[১৬]. সহীহ মুসলিম, হা/১৯৬৭।
[১৭]. ইবনু মাজাহ, হা/৩০২৯।
[১৮]. আহমাদ, হা/১২৫৫১।
[১৯]. সহীহুল বুখারী, হা/৩৪৪৫।
[২০]. ছালিহ বিন ফাওযান বিন ‘আব্দুল্লাহ আল-ফাওযান, ই‘আনাতুল মুস্তাওফীদ বিশারহি কিতাবিত তাওহীদ, ২য় খণ্ড (স্থান বিহীন, মুওয়াসসাসাতুর রিসালা, ২০০২ খ্রি.), পৃ. ১৪।
[২১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৭০৪৫; তাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৩৮। 




আশূরায়ে মুহাররম : করণীয় ও বর্জনীয় - ইউনুস বিন আহসান
মসজিদ: ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল-কুরআনে বর্ণিত জাহেলি সমাজের দশটি চিত্র - তানযীল আহমাদ
আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
রামাযানের খুঁটিনাটি - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৩য় কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১০ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
রামাযান মাসে প্রচলিত বিদ‘আত সমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
হেদায়াত লাভের অনন্য মাস রামাযান - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মসজিদ: ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র (১০ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (১২তম কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন

ফেসবুক পেজ