ইসলামে রোগ ও আরোগ্য
-মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী*
(৪র্থ কিস্তি)
ছোঁয়াছে রোগ বলে কিছু আছে কি?
অনেকের প্রশ্ন, ছোঁয়াচে রোগ আছে বলে আমরা বাস্তবে দেখতে পাই। অথচ ছহীহুল বুখারীতে বলা হয়েছে, ‘ইসলামে ছোঁয়াচে রোগ বলে কিছু নেই’; তাহলে ইসলাম কি ছোঁয়াচে রোগকে অস্বীকার করে? উত্তরে বলতে হয়, ইসলামের কোন বিষয়ই বাস্তবতার পরিপন্থী নয়। যিনি বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তো নীতিমালা দিয়েছেন। পরিপন্থী হলে বিষয়টি সাংঘর্ষিক হবে। বাহ্যিক কোন কারণ থাকলেও বিশ্বজগতে যা কিছু হয় তা সবই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার ফায়সালাতেই হয়ে থাকে। পুড়িয়ে ফেলা আগুনের ধর্ম হলেও আগুন তার সৃষ্টিকর্তার আদেশ মেনেই ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর কোন ক্ষতি করেনি (সূরা আল-আম্বিয়া : ৬৯)। সুস্থতা-অসুস্থতা আল্লাহর পক্ষ থেকে হলেও দু’টারই কোন না কোন কারণ থাকেই। পায়ের কাছে দা ছিল তাতে পা কেটে গেছে। আমরা বলি না যে, আল্লাহ কেটে দিয়েছেন। অর্থাৎ অসুস্থ হওয়ার যত কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি হল- সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে যাওয়া। এর বাস্তবতা রয়েছে আবার শরী‘আতও এর বিপক্ষে না। এর মানে এটা নয় যে, সংস্পর্শে আসলেই অসুস্থ হবে। পাঁচজন কিশোর ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করলে প্রত্যেকের ঠাণ্ডাজনিত রোগ হবে এটা নয়। কারো হয়ে যেতে পারে। অনুরূপ সংক্রমণ রোগও তাই। নিম্নের হাদীছটি লক্ষণীয়-
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ لَا عَدْوَى وَلَا صَفَرَ وَلَا هَامَةَ فَقَالَ أَعْرَابِىٌّ يَا رَسُوْلَ اللهِ فَمَا بَالُ إِبِلِى تَكُوْنُ فِى الرَّمْلِ كَأَنَّهَا الظِّبَاءُ فَيَأْتِى الْبَعِيْرُ الْأَجْرَبُ فَيَدْخُلُ بَيْنَهَا فَيُجْرِبُهَا فَقَالَ فَمَنْ أَعْدَى الْأَوَّلَ.
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, রোগের কোন সংক্রমণ নেই, সফরের কোন অশুভ আলামত নেই, পেঁচার মধ্যেও কোন অশুভ আলামত নেই। তখন এক বেদুঈন বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তাহলে আমার উটের এ অবস্থা কেন হয়? সেগুলো যখন চারণ ভূমিতে থাকে তখন সেগুলো যেন মুক্ত হরিণের পাল। এমন অবস্থায় চর্ম রোগাগ্রস্ত উট এসে সেগুলোর পালে ঢুকে পড়ে এবং এগুলোকেও চর্ম রোগে আক্রান্ত করে ফেলে? রাসলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাহলে প্রথমটিকে চর্ম রোগাক্রান্ত কে করেছে?[১]
সুধী পাঠক! হাদীছের শাব্দিক অর্থ দেখেই আমরা অনেক কিছু ফায়সালা দিতে পারি না। নিয়ম হল, হাদীছ যারা সংগ্রহ করেছেন, তারাই তথা সালাফে ছালিহীনরাই হাদীছের প্রেক্ষাপট, মর্মার্থ ভাল বুঝেন। সম্ভবপর হাদীছের বুঝ তাদের নিকট থেকেই গ্রহণ করা উচিত। নয়লে যুগের তালে তালে হাদীছের মর্মার্থও পরিবর্তন হতে থাকবে যুগের বুঝ অনুযায়ী। শাব্দিক অর্থ ‘সংক্রমণ রোগ নেই’। এর অর্থ যদি আমরা নেই, তাহলে পরের অংশ দু’টিরও শাব্দিক অর্থেই অনুবাদ হবে না। সফর মাসে বলে কিছু নেই এবং পেঁচা বলতে কিছু নেই। কিন্তু বাস্তবতা হল হিজরী বছরের ২য় মাস সফর আছে এবং পাখিদের মধ্যে একটি জাত পেঁচাও আছে। তাই হাদীছের বুঝ নেয়ার জন্য আগে-পিছে দেখে এবং আরো অন্যান্য হাদীছের দিকে দেখেই অর্থ করতে হবে। নয়লে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। নিম্নের কয়েকটি হাদীছ অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পাঠ করুন-
হাদীছ নং-১
মা‘মার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, অতঃপর এক ব্যক্তি আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে বর্ণনা করে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, لَا يُوْرَدُ مُمْرِضٌ عَلَى مُصِحٍّ ‘রোগাক্রান্ত উটকে যেন সুস্থ উটের সাথে একত্রে পানি পানের জায়গায় না আনা হয়’।[২]
হাদীছ নং-২
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, وَفِرَّ مِنَ الْمَجْذُوْمِ كَمَا تَفِرُّ مِنَ الْأَسَدِ ‘কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাক, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাক’।[৩]
হাদীছ নং-৩
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
لَا عَدْوَى وَلَا هَامَةَ وَلَا صَفَرَ فَقَالَ أَعْرَابِيٌّ يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ فَمَا بَالُ الْإِبِلِ تَكُوْنُ فِي الرَّمْلِ لَكَأَنَّهَا الظِّبَاءُ فَيَخَالِطْهَا الْبَعِيْرُ الأَجْرَبُ فَيُجْرِبُهَا؟ فَقَالَ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ فَمَنْ أَعْدَى الْأَوَّلَ
‘রোগে সংক্রমণ বলতে কিছু নেই। পেঁচার মধ্যে কুলক্ষণের কিছু নেই এবং সফর মাসেও অশুভ নেই। তখন এক বেদুইন বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তাহলে উটের এই দশা কেন হয়? যে উটের পাল ময়দানে হরিণের মত বিচরণ করে। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে চর্ম রোগাক্রান্ত একটি উট এসে মিশল এবং তাদেরকেও চর্মরোগী বানিয়ে দিল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাহলে প্রথম উটটির চর্মরোগ কোথা হতে আসল’।[৪]
হাদীছ নং-৪
মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় একটু ভিন্নভাবে এসেছে। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لَا يُعْدِىْ شَىْءٌ شَيْئًا لَا يُعْدِىْ شَىْءٌ شَيْئًا ثَلَاثًا قَالَ فَقَامَ أَعْرَابِىٌّ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ النُّقْبَةَ تَكُوْنُ بِمِشْفَرِ الْبَعِيْرِ أَوْ بِعَجْبِهِ فَتَشْمَلُ الإِبِلَ جَرَبًا. قَالَ فَسَكَتَ سَاعَةً فَقَالَ مَا أَعْدَى الْأَوَّلَ لَا عَدْوَى وَلَا صَفَرَ وَلَا هَامَةَ خَلَقَ اللهُ كُلَّ نَفْسٍ فَكَتَبَ حَيَاتَهَا وَمَوْتَهَا وَمُصِيبَاتِهَا وَرِزْقَهَا
‘কোন কিছুই নিজ থেকে অন্য কিছুকে সংক্রমিত করতে পারে না। এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার বললেন। একজন বেদুঈন বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! উটের যে চর্মরোগ হয় সেটা তো সব উটকেই আক্রান্ত করে ফেলে? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই মুহূর্তের জন্য থামলেন। এরপর বললেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে আক্রান্ত করেছিল? রোগের কোন সংক্রমণ নেই, সফরের কোন অশুভ আলামত নেই, পেঁচার মধ্যেও কোন অশুভ আলামত নেই। সকল প্রাণকেই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তার জীবন, মৃত্যু, বিপদাপদ, জীবিকা সবকিছুকেই তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন’।[৫]
হাদীছ নং-৫
ইসলামের বায়‘আত নেয়ার জন্য হাতে হাত রেখে বায়‘আত নিতে হত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাক্বীফ গোত্রের প্রতিনিধি দলের বায়‘আত নিচ্ছিলেন। দলের মাঝে একজন কুষ্ঠ রোগী ছিলেন- ‘আমর ইবনু শারীদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সূত্রে তার পিতা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ فِىْ وَفْدِ ثَقِيْفٍ رَجُلٌ مَجْذُوْمٌ فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ النَّبِىُّ ﷺ إِنَّا قَدْ بَايَعْنَاكَ فَارْجِعْ
‘ছাক্বীফ গোত্রীয় প্রতিনিধি দলের মাঝে একজন কুষ্ঠ রোগী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কাছে সংবাদ পাঠালেন যে, আমরা তোমার বায়‘আত নিয়ে নিয়েছি। তুমি ফিরে যাও’।[৬] অথচ আমরা অনেকেই বলে থাকি রোগ কখনোই ছড়ায় না, সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন নেই’।
হাদীছ নং-৬
উসামা ইবনু যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি সা‘দের কাছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِذَا سَمِعْتُمْ بِالطَّاعُوْنِ بِأَرْضٍ فَلَا تَدْخُلُوْهَا وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلَا تَخْرُجُوْا مِنْهَا
‘যখন তোমরা কোন অঞ্চলে প্লেগের বিস্তারের সংবাদ শোন, তখন সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান কর, সেখানে প্লেগের বিস্তার ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না’।[৭]
হাদীছ নং-৭
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘রোগা উটকে সুস্থ উটের সাথে রেখো না। অবশ্য সুস্থ উটকে যেখানে ইচ্ছা রাখতে পার। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, এমনটি কেন করা হবে? তিনি বললেন, কারণ তা ক্ষতিকর’।[৮]
হাদীছ নং-৮
ইবনু আবী মুলাইকা (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত,
أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ مَرَّ بِامْرَأَةٍ مَجْذُوْمَةٍ وَهِيَ تَطُوْفُ بِالْبَيْتِ فَقَالَ لَهَا يَا أَمَةَ اللهِ لَا تُؤْذِي النَّاسَ لَوْ جَلَسْتِ فِيْ بَيْتِكِ فَجَلَسَتْ
‘ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বায়তুল্লাহ ত্বাওয়াফরত কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত এক মহিলার নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় মহিলাকে বললেন, হে আল্লাহর দাসী! অন্য মানুষকে কষ্ট দিও না। হায়, তুমি যদি তোমার বাড়িতেই বসে থাকতে! পরে মহিলাটি নিজের বাড়িতেই বসে থাকত’।[৯]
হাদীছ নং-৯
মহামারী বা সংক্রমক জাতীয় কোন সংকটের ব্যাপারে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সময়ের একটি ঘটনা আমাদের এ বিষয়ে শিক্ষা হতে পারে। ১৭ হিজরী সনে শামের বৃহত্তর অঞ্চলে ভয়াবহ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসে এটি চষধমঁব ড়ভ ঊসসধঁং (طاعون عمواس) নামে পরিচিত।[১০] দীর্ঘ হাদীছটি নিম্নে তুলে ধরা হল-
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। ওমর ইবনু খাত্তাব (রাহিমাহুল্লাহ) সিরিয়ার দিকে রওয়ানা করেছিলেন। তিনি যখন র্সাগ এলাকায় গেলেন, তখন তাঁর সঙ্গে সৈন্য বাহিনীর প্রধানগণ তথা আবূ ‘উবাইদাহ ইবনু জাররাহ ও তাঁর সঙ্গীগণ সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা তাঁকে জানালেন যে, সিরিয়া এলাকায় প্লেগের বিস্তার ঘটেছে। ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমার নিকট প্রবীণ মুহাজিরদের ডেকে আন। তখন তিনি তাঁদের ডেকে আনলেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁদের সিরিয়ার প্লেগের বিস্তার ঘটার কথা জানিয়ে তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। তখন তাঁদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হল। কেউ বললেন, আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বের হয়েছেন; কাজেই তা থেকে প্রত্যাবর্তন করা আমরা পসন্দ করি না। আবার কেউ কেউ বললেন, বাকী লোক আপনার সঙ্গে রয়েছেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছাহাবীগণ। কাজেই আমরা সঠিক মনে করি না যে, আপনি তাদের এই প্লেগের মধ্যে ঠেলে দিবেন।
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, তোমরা আমার নিকট থেকে চলে যাও। এরপর তিনি বললেন, আমার নিকট আনছারদের ডেকে আন। আমি তাদের ডেকে আনলাম। তিনি তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইলে তাঁরাও মুহাজিরদের পথ অবলম্বন করলেন এবং তাঁদের মতই মতপার্থক্য করলেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, তোমরা উঠে যাও। এরপর আমাকে বললেন, এখানে যে সকল বয়োজ্যেষ্ঠ কুরাইশী আছেন, যাঁরা মক্কা বিজয়ের বছর হিজরত করেছিলেন, তাঁদের ডেকে আন। আমি তাঁদের ডেকে আনলাম, তখন তাঁরা পরস্পরে মতভেদ করলেন না। তাঁরা বললেন, আপনার লোকজনকে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করা এবং তাদের প্লেগের মধ্যে ঠেলে না দেয়াই আমরা ভাল মনে করি। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) লোকজনের মধ্যে ঘোষণা দিলেন যে, আমি ভোরে সাওয়ারীর পিঠে আরোহণ করব ফিরার জন্য। অতএব তোমরাও সকালে সওয়ারীর পিঠে আরোহণ করবে।
আবূ ওবাইদাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাক্বদীর থেকে পালানোর জন্য ফিরে যাচ্ছেন? ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আবূ ‘উবাইদাহ! যদি তুমি ব্যতীত অন্য কেউ কথাটি বলত! হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাক্বদীর থেকে আল্লাহর আরেকটি তাক্বদীরের দিকে ফিরে যাচ্ছি। তুমি বল তো, তোমার কিছু উটকে যদি তুমি এমন কোন উপত্যকায় নিয়ে যাও যেখানে আছে দু’টি মাঠ। তন্মধ্যে একটি হল সবুজ শ্যামল, আর অন্যটি হল শুষ্ক ও ধূসর। এবার বল ব্যাপারটি কি এমন নয় যে, যদি তুমি সবুজ মাঠে চরাও তাহলে তা আল্লাহর তাক্বদীর অনুযায়ীই চরিয়েছ। আর যদি শুষ্ক মাঠে চরাও, তাহলে তাও আল্লাহর তাক্বদীর অনুযায়ীই চরিয়েছ। বর্ণনাকারী বলেন, এমন সময় ‘আবদুর রহমান ইবনু ‘আওফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আসলেন। তিনি এতক্ষণ যাবৎ তাঁর কোন প্রয়োজনের কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে আমার নিকট একটি তথ্য আছে, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি,
إِذَا سَمِعْتُمْ بِهِ بِأَرْضٍ فَلَا تَقْدَمُوْا عَلَيْهِ وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلَا تَخْرُجُوْا فِرَارًا مِنْهُ
‘তোমরা যখন কোন এলাকায় প্লেগের বিস্তারের কথা শোন, তখন সেখানে প্রবেশ কর না। আর যদি কোন এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাক, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না’। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তারপর প্রত্যাবর্তন করলেন’।[১১]
অতএব আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীلَا عَدْوَى وَلَا طِيَرَةَ وَلَا هَامَةَ وَلَا صَفَرَ-এর অনুবাদ যদি আমরা ব্যাখ্যা স্বরূপ এভাবে করি যেমন, রোগ-ব্যাধি (তার নিজস্ব ক্ষমতায়) একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে লেগে যায় না। তাই পুরো বর্ণনার মূল বিষয় উপস্থাপন আমরা এভাবে করতে পারি- কোন রোগ নিজ থেকে ছড়াতে পারে না; বরং মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতিক্রমে ছড়ায়। ‘রোগ আদৌ ছড়ায় না’ বা সংক্রমিত হতে পারে না’ এমন উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য ‘রোগ নিজ থেকে ছড়ায় না’।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
*এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭১৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২২২০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৬০৯।
[২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৯২৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/২২২১।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭০৭।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৭০; ছহীহ মুসলিম, হা/২২২০; মিশকাত, হা/৪৫৭৮।
[৫]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৩২৫; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১১৫২।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৩১; মিশকাত, হা/৪৫৮১।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭২৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২২১৮; তিরমিযী, হা/১০৬৫।
[৮]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/১৪২৩৯-১৪২৪০।
[৯]. মুওয়াত্ত্বা ইমাম মালেক, হা/১৬০৩।
[১০]. ইবনু মাজাহ, হা/২৭৩২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৯৭, সনদ হাসান।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭২৯; ছহীহ মুসলিম হা/২২১৯।