সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন

প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান

-মূল : আব্দুল আযীয ইবনু রাইস আল-রাইস
-অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক্ব বিন আব্দুল ক্বাদির*


(শেষ কিস্তি) 

দাওয়াতের মাধ্যম অবলম্বনের বিধান

দাওয়াতের মাধ্যম অবলম্বনের ক্ষেত্রে মানুষ দ্বিমুখী পক্ষ অবলম্বন করেছে। যথা :

প্রথম পক্ষ : তারা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছে যে, দাওয়াতের মাধ্যম গ্রহণ করার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে শরী‘আতের বিধানের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং দাওয়াতের পন্থাসমূহের মধ্য থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে পন্থাকে দাওয়াত প্রদানের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেননি, তার জন্য সে সময়ে উক্ত পন্থা অবলম্বন করা সম্ভবপর না হলেও তা বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। এমনকি তাদের কেউ কেউ অডিও ক্যাসেড বাজানো, ছাত্রদের পাঠদান করা ও মাইকের সাহায্যে ওয়ায পরিবেশন করাকেও হারাম বলেছেন।

দ্বিতীয় পক্ষ : তারা স্পষ্টভাবে বলেছে যে, দাওয়াতের ক্ষেত্রে যে সকল পন্থা ও মাধ্যম অবলম্বন করা আমাদের জন্য সম্ভব তার সবগুলোই জায়েয। বরং মুস্তাহাব বলে গণ্য হবে। যদিও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর ছাহাবীগণের জন্য উক্ত পন্থা অবলম্বন করা সম্ভব থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তা করেননি।

নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দ্বিতীয় পক্ষ বিষয়টিকে অতীব সহজ করে ফেলেছে। বিপরীতে প্রথম পক্ষ বিষয়টিকে অনেক সংকীর্ণ করে দিয়েছে। যার কোনটিই সন্তোষজনক নয়। বরং এ দু’য়ের মাঝেই মধ্যমপন্থা রয়েছে। ইনশাআল্লাহ এটিই ছিরাতে মুস্তাক্বীম এবং এর মাধ্যমেই উভয় পক্ষের মাঝে সমন্বয় করা সম্ভব। আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনু তাইমিয়াহ ঢ় উক্ত মতটিকে সমর্থন করেছেন। কারণ তিনি বলেন যে, ‘আল্লাহ সর্বাধিক জ্ঞানী। এই ব্যাপারে মূলনীতি হিসাবে বলা যায় যে,

মানুষেরা এমন কিছু বর্ণনা করতেন, যার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। যখন দেখতেন তা অকল্যাণকর, তাহলে বর্ণনা করতেন না। কেননা তার প্রতি বিবেক ও দ্বীন কোনটাই সাড়া দেয় না। সুতরাং যাতে মানুষ কল্যাণ দেখতেন, তাতে কল্যাণের কারণ অনুসন্ধান করতেন। যদি কারণটা এমন হয়, যা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে কোনরূপ বাড়াবাড়ি ছাড়ায় তৈরি হয়েছে; তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী সেই নতুন জিনিসটা তৈরি করা জায়েয। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময়ে যে কাজের প্রয়োজন বিদ্যমান ছিল, কিন্তু তিনি তা কোন কারণে বর্জন করেছিলেন, যদিও তাঁর মৃত্যুর পরে তা আর বিদ্যমান থাকে না। এমন কাজের নতুন করে সূচনা করা জায়েয। তবে যে কাজের যরূরী কোন কারণ ঘটেনি অথবা যরূরী কারণটি যদি বান্দার কোন অপরাধ হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে তা উদ্ভাবন করা জায়েয নয়। সুতরাং ঐ প্রত্যেক কাজ যা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে তার প্রয়োজন বিদ্যমান ছিল, কিন্তু কল্যাণকর হওয়া সত্ত্বেও তা সম্পাদন করা হয়নি। তাহলে বুঝতে হবে যে, সেটা প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকর নয়। তবে তাঁর মৃত্যুর পরে যে বিষয়ের প্রয়োজন হয়েছে কিন্তু সৃষ্টির কোন অপরাধের কারণে নয় তাহলে সেটা কল্যাণকর হতে পারে।

এ ব্যাপারে বিজ্ঞজনের দু’টি মত রয়েছে

১. এইরূপ কাজের ব্যাপারে যতক্ষণ না শরী‘আতে নিষেধ পাওয়া যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত উক্ত কাজ সম্পাদন করা যাবে। উক্ত মতটি ঐ সকল বিদ্বানদের, যারা (মাছলাহা মুরসালা) এর নীতির আলোকে শরী‘আতের হুকুম সাব্যস্ত করে। (আর মাছলাহা মুরসালা অর্থ হল- যে ব্যাপারে শরী‘আতের দলীল নেই। বরং কাজটিকে অকল্যাণমুক্ত এবং কল্যাণকর প্রমাণ করার মাধ্যমে সেটিকে শরী‘আতের দলীল হিসাবে গণ্য করা)।

২. শরী‘আহ এইরূপ কাজের নির্দেশ প্রদান না করলে তা সম্পাদন করা যাবে না। উক্ত মতটি ঐ সকল বিদ্বানদের, যারা মাছলাহা মুরসালার নীতির আলোকে শরী‘আতের হুকুম সাব্যস্ত করেন না। এ প্রকার বিদ্বান দুই শ্রেণীর। যথা :

ক. ক্বিয়াছকে অস্বীকারকরী অর্থাৎ যারা শরী‘আহ প্রণেতার কথা, কাজ ও সমর্থন ব্যতীত অন্য কোন মাধ্যমে শরী‘আতের হুকুম সাব্যস্ত করেন না।

খ. ক্বিয়াছপন্থী অর্থাৎ যারা শরী‘আহ প্রণেতার কথা ও তাঁর ভাবার্থের মাধ্যমে শরী‘আতের হুকুম সাব্যস্ত করেন।

সুতরাং যে কাজের প্রয়োজন বিদ্যমান ছিল এবং তা কল্যাণকর হওয়া সত্ত্বেও তাকে শরী‘আহ হিসাবে গণ্য করা হয়নি, এমন কাজ প্রবর্তন করা আল্লাহর দ্বীনকে পরিবর্তন করার শামিল। রাজা-বাদশা, আলেম সম্প্রদায় ও আবেদ শ্রেণীর মানুষ অথবা তাদের মধ্যে যার ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ভুল করেছেন, তারা আল্লাহর দ্বীনকে পরিবর্তনকারী হিসাবে গণ্য হবেন। যেমন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর ছাহাবীগণ থেকে বর্ণিত আছে যে,

إنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ زَلَّةُ عَالِمٍ وَجِدَالُ مُنَافِقٍ بِالْقُرْآنِ وَأَئِمَّةٌ مُضِلُّوْنَ

‘নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি যারা বেশি ভয় পাচ্ছি তা হল আলেমের ভ্রান্তি, কুরআন দ্বারা মুনাফিকের বিতর্ক করা ও বিভ্রান্তকারী নেতারা’।[১]

এই প্রকারের উদাহরণ হিসাবে পেশ করা যায় দুই ঈদের আযান প্রদান করাকে। কেননা যখন কিছু শাসক এই কাজটি নতুন করে চালু করেছিলেন, তখন তা বিদ‘আত হওয়ার করণে মুসলিমগণ তার প্রতিবাদ করেছিলেন। উল্লেখিত কাজটি বিদ‘আত হওয়া যদি তার ঘৃণিত হওয়ার প্রমাণ না হয়, তাহলে নিম্নোক্ত আল্লাহর বাণীর সাধারণ ব্যাপক অর্থের আলোকে উক্ত আযানকে আল্লাহর যিকির বা সৃষ্টিকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করা নামে চালিয়ে দেয়া যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন, اذۡکُرُوا اللّٰہَ  ذِکۡرًا کَثِیۡرًا ‘তোমরা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর’ (‘সূরা আল-আহযাব : ৪১)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করে এবং সৎ কর্ম করে’ (সূরা আল-ফুছছিলাত/হামিম আস-সিজদাহ : ৩৩)।

মানুষের অবহেলা বা ত্রুটির কারণে নতুন করে যে বিদ‘আতের সূচনার প্রয়োজন হয়েছিল, তার উদাহরণ হিসাবে দুই ঈদে ছালাতের আগে খুত্ববা প্রদান করাকে পেশ করা যায়। কেননা কিছু শাসক যখন উক্ত কাজটি নতুন করে চালু করেছিলেন, তখন মুসলিমগণ তা বিদ‘আত হওয়ার কারণে তার প্রতিবাদ করেছিলেন। আর যারা উক্ত বিদ‘আতের সূচনা করেছিল তারা এই ওজর পেশ করেছিল যে, খুত্ববা ছালাতের পরে দিলে লোকজন খুত্ববা না শুনেই চলে যায়। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে সকলেই অথবা অধিকাংশ মানুষ খুত্ববা না শুনে যেত না। সে ক্ষেত্রে তার প্রতিবাদে বলা হবে যে, এটা তোমারই ত্রুটির কারণে হয়েছে। কেননা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুত্ববা দিতেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল জনগণের কল্যাণ করা, তাদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়া ও তাদেরকে হেদায়াত করা। আর তোমার খুত্ববা দেয়ার উদ্দেশ্য হল, তোমার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং যখন তাদের দ্বীন সংস্কারেরই ইচ্ছা কর, তখন তাদের উপকারী বিষয় শিক্ষা দাও না। অতএব এটা তোমারই অপরাধ, যা তোমার জন্য আরেকটি অপরাধ ঘটানোর বৈধতা দিবে না। বরং এক্ষেত্রে উচিত হল, আল্লাহর নিকট তোমার তওবাহ করা এবং তাঁর নবীর সুন্নাতের অনুসরণ করা। ফলে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি ঠিক নাও হয়, তাহলে আল্লাহ তো শুধু তোমাকে তোমার আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তাদের আমল সম্পর্কে নয়। এই দু’টি অর্থ যে ব্যক্তি বুঝতে সক্ষম হবে, তার নিকট থেকে নব-উদ্ভাবিত বিদ‘আতের বহু সংশয় দূর হয়ে যাবে।[২]

হে মুমিন ভাই! আপনি খেয়াল করুন যে, ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন যে, বান্দাদের অপরাধ নতুন কোন কল্যাণকর বিষয় তথা দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে উদ্ভাবন করার জন্য যৌক্তিক কারণ হতে পারে না। বরং এই অবস্থায় মানুষকে পাপ ও অবাধ্যতা পরিহার করার নির্দেশ দিতে হবে।

কিছু উপদেশ বা পথ-নির্দেশনা

হে কল্যাণময় দাঈ ভাই! আপনার উদ্দেশ্যে নিম্নে কিছু উপদেশ বা পরামর্শ উল্লেখ করা হল-

১. পূর্বের আলোচনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হল যে, তাবলীগ জামা‘আত দাওয়াতের ব্যাপারে শারঈ পন্থার উপর বিদ্যমান নেই। তাই বলে আমরা শরী‘আতের সীমারেখার মাঝে থেকে, মহব্বত ও দয়ার খাতিরে সকল মুসলিমের জন্য নিজেকে নিবেদিত করার পাশাপাশি সুন্দর পন্থা ও সুমহান চরিত্র দ্বারা দাওয়াত প্রদান করব না, তা হতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَسَوۡفَ یَاۡتِی اللّٰہُ بِقَوۡمٍ یُّحِبُّہُمۡ وَ یُحِبُّوۡنَہٗۤ ۙ اَذِلَّۃٍ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَعِزَّۃٍ عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ

‘আল্লাহ সত্বরই (তাদের স্থলে) এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালোবাসবে। তারা মুসলিমদের প্রতি মেহেরবান থাকবে, কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৫৪)।

তাদের শারঈপন্থার বিপরীত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, মুসলিমদের মধ্য যারা অবাধ্য ও পাপী তাদেরকে আমরা আহ্বান করব না এবং আল্লাহর পথে আহ্বানের জন্য সফর করব না, তা কখনো হতে পারে না। বরং মুসলিম-অমুসলিম সকলকেই আমরা আল্লাহর দিকে আহ্বান করব। প্রয়োজনে এলাকার বাইরেও সফর করব। তবে যখন ইলম শিক্ষায় ব্যস্ত থাকি বা ইলম শিক্ষার্থীদের সহবতে থাকি তার কথা ভিন্ন। কারণ এসব কিছুই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর পরবর্তী সালাফীগণ দাওয়াতের মধ্যে শামিল। আর যখন তাবলীগ জামা‘আত পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়নি, তার অস্তিত্বও ছিল না, তখন আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক সকল প্রকার সুন্দর বিষয় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর অনুসারীদের দাওয়াতের মাঝে বিদ্যমান ছিল।

তাই আমি তাবলীগ জামা‘আতের প্রতি সম্বন্ধকারীদেরকে এই জামা‘আতকে দ্রুত পরিহার করে, ঐ ব্যক্তিদের দিকে নিজেকে সম্বন্ধ করার প্রতি আহ্বান করছি, যাদের আক্বীদা ও মানহাজ পূর্ববর্তী সালাফ ও বিজ্ঞ ওলামার পন্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। সাথে সাথে সকল মানুষকে দাওয়াত প্রদানের প্রতি তাদের আগ্রহ চলমান রাখার আহ্বান করছি। তবে তা যেন আক্বীদা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সহকারে শরঈ নীতিমালার আলোকে হয়।

২. আমাদের প্রতি আবশ্যক যে, দ্বীনের এমন বহু বিষয় পরিহার করে তার মধ্য থেকে শুধু একটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া কখনো উচিত নয। সুতরাং সাধারণ মুসলিমদের মাঝে ইলমের প্রচার ও প্রসার, দাওয়াতী কাজের প্রতি শিক্ষা প্রদান করা এবং বক্তব্য প্রদান ও অন্যান মাধ্যমে  পথভ্রষ্ট ও ইসলাম বিরোধীদের প্রতিবাদ না করে শুধু ইলম শিক্ষার জন্য গোটা জীবনকে আবদ্ধ রাখা কোন মুসলিমের জন্য সমীচীন নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اِذۡ اَخَذَ اللّٰہُ مِیۡثَاقَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ لَتُبَیِّنُنَّہٗ لِلنَّاسِ وَ لَا تَکۡتُمُوۡنَہٗ ‘আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ যাদেরকে কিতাব দিয়ে তাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তোমরা নিশ্চয় এটা লোকদের মধ্যে ব্যক্ত করবে এবং তা গোপন করবে না’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৮৭)। অন্যত্র তিনি বলেন,

اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡتُمُوۡنَ مَاۤ اَنۡزَلۡنَا مِنَ الۡبَیِّنٰتِ وَ الۡہُدٰی مِنۡۢ بَعۡدِ مَا بَیَّنّٰہُ لِلنَّاسِ فِی الۡکِتٰبِ  ۙ  اُولٰٓئِکَ یَلۡعَنُہُمُ اللّٰہُ  وَ  یَلۡعَنُہُمُ  اللّٰعِنُوۡنَ- اِلَّا الَّذِیۡنَ تَابُوۡا وَ اَصۡلَحُوۡا وَ بَیَّنُوۡا...

‘আমরা যেসব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, আমরা ঐ গুলোকে মানুষের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা ঐসব বিষয়কে গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিসম্পাতকারীরাও তাদেরকে অভিসম্পাত করে থাকে। কিন্তু যারা তওবা করে ও সংশোধন করে নেয় এবং সত্য প্রকাশ করে (তারা ব্যতীত)’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৫৯-১৬০)।

নিশ্চয় মানুষের মাঝে যুগের সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণ হল, ফৎওয়া দানকারী পূণ্যবান বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরাম। যাঁরা ইলম শিক্ষা করা, অপরকে শিক্ষা দেয়া এবং আমল করার মত বহু কল্যাণকর বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। তাঁরা টেলিফোন বা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রশ্নকারীদের উত্তর দেয়া, পরামর্শ দেয়া ও আমলি জিন্দেগী গঠনের কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁদের পুরোটা জীবন ও সাধ্য ব্যয় করে থাকেন। মুসলিমদের মাঝে কতই না সমস্যা অবতীর্ণ করে, যে গুলোকে আল্লাহ তা‘আলা কোন একজন আলেম বা এক সম্প্রদায় আলেমের ফাতওয়ার মাধ্যমে সমাধান করেন। সুতরাং একাকী ও সম্মিলিতভাবে মুসলিম উম্মাহের পথ-নির্দেশনামূলক তাঁদের বহু ফাতাওয়া বিদ্যমান আছে।

হে ভাগ্যবান ব্যক্তি! আপনি দুনিয়াবী কল্যাণের জন্য বিদ‘আতীকে তোষামোদী করা হতে সাবধান থাকুন। যেমন ভক্ত বা অনুসারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং আরো অনুরূপ কিছু করা। বরং আপনার উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা, অন্য কারো নয়। আপনি কবরের জীবন ও পুনরুত্থানের দিন আমল ছড়িয়ে যাওয়ার মুহূর্তকে স্মরণ করুন এবং জেনে রাখুন যে, বিদ‘আতপন্থীদের অনুসরণ করা বা তাদের বিদ‘আত থেকে নীরব থাকা ব্যতীত তারা আপনার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না। পক্ষান্তরে একজন মুসলিমের জন্য আরেকটি বিষয় খেয়াল করা জরুরী যে, মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করার ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুমগুলো বিস্তারিতভাবে জেনে নেয়ার আলেমগণের নিকট না যাওয়া এবং শরী‘আতের যে বিষয়গুলো প্রত্যেক মুসলিমের জানা আবশ্যক সেগুলো শিক্ষান করে কোন মুসলিম তার পুরোটা জীবন আল্লাহর পথে আহ্বান করার কাজে নিয়োগ করা মোটেই উচিত নয়।

৩. একটি মারাত্মক ভুল বিষয় লক্ষ্য করার যায় যে, আল্লাহর পথে আহ্বানকারী কিছু ব্যক্তি, আহ্বান করার পন্থাসমূহ সে নিজেই আবিষ্কার করে। অথবা দেশের ভিতর বা বাহিরের কারো নিকট থেকে কোন পন্থা গ্রহণ করে। অতঃপর সেই পন্থাকেই আল্লাহর পথে দাওয়াতের ক্ষেত্রে অনুসরণ করে। আর যখন তার প্রতিবাদ করা হয়, তখন সে যদি মুক্তমনা ও আল্লাহর সন্তুষ্টিকামী হয়ে থাকে, তাহলে সে ঐ পন্থার বৈধতার পক্ষে যারা ফাতাওয়া দেয় এমন কিছু আলেমের দারস্থ হয়ে তার বৈধতা তালাশ করে। নতুবা তাদের কেউ আলেমের নিকট না গিয়েই নিজের মতের প্রতি স্বনির্ভর হয়। (এমন অবস্থা হওয়া থেকে আমরা আল্লাহ নিকট মুক্তি চাই)। অথচ তার জরুরী কর্তব্য ছিল যে, কোন পন্থা গ্রহণ করে তার বৈধতার ফাতাওয়া না খুঁজে, আলেমদের ফাতাওয়ার আলোকে পন্থা গ্রহণ করা। কারণ আলেমগণই আল্লাহ, তাঁর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ সম্পর্কে ভাল জানেন। আর সে কারণেই আল্লাহ বলেছেন, فَسۡـَٔلُوۡۤا اَہۡلَ الذِّکۡرِ  اِنۡ  کُنۡتُمۡ  لَا تَعۡلَمُوۡنَ ‘তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৭)।

৪. হে কল্যাণের পথে আহ্বানকারী ও অন্যের জন্য হেদায়াতকামী বন্ধুগণ! রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর ছাহাবীগণের পথ আপনাদের সামনেই রয়েছে। সুতরাং আপনারা সে পথেই চলুন। সে পথ আপনাদেরকে রবের সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌঁছে দিবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلۡ ہٰذِہٖ سَبِیۡلِیۡۤ  اَدۡعُوۡۤا  اِلَی اللّٰہِ ۟ؔ عَلٰی بَصِیۡرَۃٍ  اَنَا  وَ مَنِ اتَّبَعَنِیۡ ؕ وَ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ  وَ مَاۤ   اَنَا مِنَ  الۡمُشۡرِکِیۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন! ইহাই আমার পথ, আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে, জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র এবং আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (সূরা ইউসুফ : ১০৮)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اَنَّ  ہٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡہُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ  فَتَفَرَّقَ  بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ

‘আর এ পথই আমার সরল পথ; সুতরাং তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। এ পথ ছাড়া অন্যান্য কোন পথের অনুসরণ কর না, অন্যথা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিছিন্ন করে দূরে সরিয়ে দেবে’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৩)।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর ছাহাবীগণের দাওয়াতী কাজের সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য বা রূপরেখা হল, তাওহীদকে দৃঢ়ভাবে সাব্যস্ত করা, শিরক এবং সকল প্রকার উপায় বা মাধ্যম থেকে সাবধান করা এবং বিদ‘আত ও বিদ‘আতীদের সাথে সংগ্রাম করা। কেননা বিদ‘আতীরা দ্বীনকে ধ্বংস করে এবং ধর্মের নামে দ্বীন ইসলামের রশ্মিগুলো একটি একটি করে ছিন্ন করে। অতঃপর জনগণ তা বুঝতেই পারে না। বরং তাদের অনুসরণ করতে থাকে। শিরক ও বিদ‘আত দু’টি সংযুক্ত বিষয় এবং শিরকপন্থী ও বিদ‘আতপন্থী তারা সকলেই হকপন্থীদেরকে ঘৃণা করার ব্যাপারে একজোট থাকে।

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আপনি প্রত্যেক শিরকপন্থীকে আল্লাহকে অসম্মানকারী হিসাবে পাবেন। যদিও সে তার শিরকের মাধ্যমে আল্লাহকে সম্মান করার ধারণা করে এবং প্রত্যেক বিদ‘আতীকে আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসম্মানকারী হিসাবে পাবেন। যদিও সে তার বিদ‘আতের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্মান করার ধারণা করে। কেননা সে যদি জাহেল অন্ধবিশ্বাসী হয়, তাহলে সে বিদ‘আতকে সুন্নাত ধারণা করে। আর যদি সে তার বিদ‘আত সম্পর্কে স্পষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে সে বিদ‘আত করার কারণে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিরোধিতাকারী। সুতরাং অসম্মানকারীরাই আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর প্রিয় বান্দাদের নিকট অসম্মানী বলে গণ্য। আর তারা হল শিরকপন্থী ও বিদ‘আতী সম্প্রদায়’। অতঃপর তিনি বলেন যে, ‘এ কারণেই আল্লাহ কিতাবে বিদ‘আতের আলোচনা শিরকের সাথে সংযুক্ত আকারে রয়েছে’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلۡ  اِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّیَ الۡفَوَاحِشَ مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا وَ  مَا بَطَنَ وَ الۡاِثۡمَ وَ الۡبَغۡیَ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ وَ اَنۡ تُشۡرِکُوۡا بِاللّٰہِ مَا لَمۡ یُنَزِّلۡ بِہٖ سُلۡطٰنًا وَّ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا عَلَی  اللّٰہِ  مَا لَا  تَعۡلَمُوۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমার প্রতিপালক প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা, পাপকাজ, অসংগত-বিরোধিতা ও বাড়াবাড়ি এবং আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করা, যার পক্ষে আল্লাহ কোন দলীল-প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি, আর আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে সম্বন্ধে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই; (ইত্যাদি কাজ ও বিষয়সমূহ) হারাম করেছেন’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩৩)। সুতরাং পাপ ও অত্যাচার করা একটি প্রাসংগিক সংযুক্ত বিষয়।

অতঃপর তিনি আরো বলেন যে, ‘মুশরিক ব্যক্তি তাওহীদপন্থী ব্যক্তির উপর বিদ্বেষ পোষণ করে। কারণ হল যে, সে তাওহীদকে খাঁটিভাবে সাব্যস্ত করে। কোন শিরকের সাথে মিশ্রণ করে না। তেমনিভাবে বিদ‘আতপন্থী ব্যক্তি সুন্নাহপন্থী ব্যক্তির উপর বিদ্বেষ পোষণ করে। কারণ হল যে, সে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণকে খাঁটিভাবে সাব্যস্ত করে, ব্যক্তিদের মতামত বা অনুসরণ বিরোধী কোন বিষয়ের সাথে মিশ্রণ করে না। শিরক ও বিদ‘আতপন্থীদের সমর্থন দেয়ার কারণে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বান্দার প্রতি নাখোশ হন। অতএব তাওহীদপন্থী, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসারী ব্যক্তি শিরক ও বিদ‘আতপন্থীদের কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করা তার জন্য অতীব কল্যাণকর ও উপকারী হবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট ঘৃণার পাত্র হওয়ার চেয়ে কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করা তার প্রতি বেশি সহজ হওয়া উচিত। ধৈর্যধারণ ছাড়া যদি কোন উপায় না থাকে, তাহলে সত্যের উপর ধৈর্যধারণ করুন। সেই ধৈর্যই পরিণামে প্রশংসনীয় হবে’।[৩]

সুতরাং এই তাবলীগ জামা‘আতের মাধ্যমে যারা ধোঁকায় পড়েছে, তারা কখন জেগে উঠবে? অতঃপর সালাফে-ছালিহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহকে অজ্ঞ তাবলীগীদের আকর্ষণীয় আবেগের উপর প্রাধান্য দিবে? এই তাবলীগ জামা‘আত ও তার অনুসারীদের থেকে মুক্ত হয়ে সালাফে ছালিহীন এবং তাঁদের পন্থার অনুসারী ওলামায়ে কেরামের বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহের দিকে ফিরে আসার তাদের কি সময় হয়নি?

(সমাপ্ত)

* মুহাদ্দিছ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।

 তথ্যসূত্র : 
[১]. ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৫।
[২]. ইক্বতিযাউস ছিরাতিল মুস্তাক্বীম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৯৮।
[৩]. ইগাছাতুল লাহফান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬২-৭৬।




ইখলাছই পরকালের জীবনতরী - আব্দুল গাফফার মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল-কুরআন এক জীবন্ত মু‘জিযা - আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস
বিদ‘আত পরিচিতি (১৪তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১৪তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
সালাম প্রদানের গুরুত্ব ও মর্যাদা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আরিফ হুসাইন
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৩য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা - সাজ্জাদ সালাদীন
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী

ফেসবুক পেজ