পরনিন্দা চর্চা ও তার পরিণাম
-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর*
গীবত বা পরনিন্দা একটি জঘন্য স্বভাব। অগোচরে অন্যের দোষ চর্চা করা ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ। যা বড় পাপের অন্তর্ভুক্ত। এসব পরচর্চার মাধ্যমে সমাজের কোন উপকার হয় না। বরং এর দ্বারা যা হয় তার সবই অকল্যাণ। এমন নোংরা কাজ বহু আগেই ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। একে অপরের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ তৈরি হয়। ঝগড়া থেকে মারামারি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তা ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করে। ইসলামে এ ধরনের গর্হিত কর্ম থেকে বেঁচে থাকার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। মুসলিমদের মধ্যে অন্যায় কর্ম ছড়ানোকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। এমর্মে এরশাদ হচ্ছে-
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُحِبُّوۡنَ اَنۡ تَشِیۡعَ الۡفَاحِشَۃُ فِی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ۙ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ
‘যারা মুমিনদের মাঝে অশ্লীলতা প্রসার কামনা করে তাদের জন্য ইহকালে ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে’ (সূরা আন-নূর : ১৯)।
গীবত মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়ার ন্যায় অপরাধ
পরনিন্দাকে ইসলামে মহা অপরাধ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন কর্মকে মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এমর্মে মহান আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اجۡتَنِبُوۡا کَثِیۡرًا مِّنَ الظَّنِّ ۫ اِنَّ بَعۡضَ الظَّنِّ اِثۡمٌ وَّ لَا تَجَسَّسُوۡا وَ لَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا ؕ اَیُحِبُّ اَحَدُکُمۡ اَنۡ یَّاۡکُلَ لَحۡمَ اَخِیۡہِ مَیۡتًا فَکَرِہۡتُمُوۡہُ ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ تَوَّابٌ رَّحِیۡمٌ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা বহুবিধ ধারণা হতে বিরত থাক; কারণ কোনো কোনো ধারণা পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে ভালোবাসবে? বস্তুত তোমরাও এটাকে ঘৃণাই করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী, দয়ালু’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১২)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَیۡلٌ لِّکُلِّ ہُمَزَۃٍ لُّمَزَۃِۣ ۙ ‘সামনে ও পশ্চাতে নিন্দাকারীর জন্য ধ্বংস সুনিশ্চিত’ (সূরা আল-হুমাযাহ : ১)।
কারো দোষের খবর অনুসন্ধান করা ও তা প্রচার করা অন্যায়। এরূপ কর্ম গীবতের মধ্যে শামিল। আর কারো পরনীন্দা করা আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার ন্যায় অপরাধ। এমন নিন্দনীয় জিনিসের সাথে উদাহরণ দেয়া হয়েছে যেন মানুষ এ কাজগুলো বর্জন করে। তাছাড়া পশ্চাতে নিন্দাকারী অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে। অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا یَسۡخَرۡ قَوۡمٌ مِّنۡ قَوۡمٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنُوۡا خَیۡرًا مِّنۡہُمۡ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنۡ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُنَّ خَیۡرًا مِّنۡہُنَّ ۚ وَ لَا تَلۡمِزُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ وَ لَا تَنَابَزُوۡا بِالۡاَلۡقَابِ ؕ بِئۡسَ الِاسۡمُ الۡفُسُوۡقُ بَعۡدَ الۡاِیۡمَانِ ۚ وَ مَنۡ لَّمۡ یَتُبۡ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ
‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে বিদ্রƒপ না করে; কেননা তারা তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর কোনো নারীকেও যেন বিদ্রƒপ না করে। কেননা সে তাদের অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা এক অপরকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পরে মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ পরিত্যাগ করে না, তারাই অত্যাচারী’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১১)।
وَ اِذَا سَمِعُوا اللَّغۡوَ اَعۡرَضُوۡا عَنۡہُ وَ قَالُوۡا لَنَاۤ اَعۡمَالُنَا وَ لَکُمۡ اَعۡمَالُکُمۡ ۫ سَلٰمٌ عَلَیۡکُمۡ ۫ لَا نَبۡتَغِی الۡجٰہِلِیۡنَ
‘ওরা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে তখন ওরা তা পরিহার করে চলে। আর বলে, আমাদের কাজের ফল আমরা পাব, তোমাদের কাজের ফল তোমরা পাবে। তোমাদের প্রতি সালাম। জাহেলদের সাথে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫৫)।
কোনো ব্যক্তিকে বিদ্রƒপ করা ঠিক না। কেননা সে বিদ্রƒপকারীর চেয়ে উত্তম হতে পারে। আবার কাউকে মন্দ নামে ডাকা নিষেধ। কাউকে অহেতুক দোষারোপ করা উচিত নয়। এগুলো কোনো মুমিনের কাজ নয়। প্রকৃত মুসলিম ব্যক্তি এসব কর্মে জড়িত হতে পারে না। এসব নোংরা কাজ থেকে প্রতিটি মুসলিমকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ জঘন্য কর্ম পরিহার করার সাথে যেখানে এগুলোর চর্চা হয় সেখান থেকে সরে যেতে বলা হয়েছে। যে সব জায়গায় গীবত করা হয় সে জায়গা থেকে চলে যেতে বলা হয়েছে। গীবতকারীর নিকটে থাকাও এক প্রকারের অপরাধ। তার কাছে থাকা তাকে গীবতে সহযোগিতার শামিল। গীবতকারীর শ্রোতা হওয়াও অন্যায়।
গীবত-এর পরিচয়
গীবত হল কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে। হাদীছে গীবতের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ مَا الْغِيْبَةُ قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ قَالَ أَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِيْهِ مَا أَقُوْلُ قَالَ إِنْ كَانَ فِيْهِ مَا تَقُوْلُ فَقَدْ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيْهِ مَا تَقُوْلُ فَقَدْ بَهَتَّهُ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল, গীবত কী? তিনি বললেন, ‘তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কথা বল, যা সে অপছন্দ করে’। ঐ ব্যক্তি বলল, আমি যা বলি যদি তা আমার ভাইয়ের মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাহলে আপনার কী অভিমত? তখন তিনি বললেন, ‘তুমি যা বল তার মধ্যে তা থাকলে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তার মধ্যে তা না থাকে যা তুমি বল, তখন তুমি তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে’।[১]
গীবতের পরিচয় হাদীছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। কারো অগচরে তার এমন কথা নিয়ে আলোচনা করা যা শুনলে সে কষ্ট পাবে। যদি ঐ সমস্যা তার মধ্যে আসলেই থাকে তাহলেও গীবত হবে। আর যদি তার মধ্যে ঐ সমস্যা না থাকে তাহলে অপবাদ হবে। এরূপ কথা নিয়ে আলোচনা করার কোনো সুযোগ নেই। ঐ সমস্যা থাকার কারণে আলোচনা করলে অপরাধ। আবার না থাকায় আলোচনা করলেও অপরাধ। এরূপ নিন্দনীয় কর্মের নিকটে যাওয়াই মহা অপরাধ।
গীবতের ভয়াবহতা
গীবত অত্যন্ত ভয়াবহ একটি অপরাধ। মানুষ এ অপরাধের মর্ম অনুধাবন করলে এরূপ জঘন্য কর্মে যুক্ত হতো না। কাজটি দেখতে খুবই হালকা মনে হলেও অপরাধ হিসাবে তা অনেক বড়। এর ভয়াবহতার বিবরণ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قُلْتُ لِلنَّبِيِّ ﷺ حَسْبُكَ مِنْ صَفِيَّةَ كَذَا وَكَذَا تَعْنِيْ قَصِيْرَةً فَقَالَ لَقَدْ قُلْتِ كَلِمَةً لَوْ مُزِجَتْ بِهَا الْبَحْرَ لَمَزِجَتْهُ
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বললাম, ছাফিয়্যা সম্পর্কে আপনাকে এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে, সে এইরূপ এইরূপ। তিনি এটা দ্বারা বুঝাতে চাইলেন যে, তিনি বেঁটে (খাটো)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘যদি তোমার এ কথাকে সমুদ্রের পানিতে মিশিয়ে দেয়া হয়, তবে তা সমুদ্রের রং পরিবর্তন করে দেবে’।[২]
অত্র হাদীছে বর্ণিত مَزِجَتْهُ-এর ভাবার্থ হল- তার সাংঘাতিক দুর্গন্ধ ও নিকৃষ্টতার কারণে সমুদ্রের পানিতে মিশে তার স্বাদ অথবা গন্ধ পরিবর্তন করে দেয়। এই উপমাটি গীবত নিষিদ্ধ হওয়া ও তা থেকে সতর্কীকরণের ব্যাপারে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও পরিণত বাক্য।[৩]
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) যে কথাটি বলেছেন তা কিন্তু মিথ্যা ছিল না। তার পরও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরূপ কথাকে অপছন্দ করেছেন। কারণ সেটি তার দোষ প্রকাশ করার জন্যই বলা হয়েছিল। বিধায় কারো মধ্যে কোনো দোষ থাকলেও তাকে খাটো বা হেয় করার জন্য তা বলে বেড়ানো অন্যায়। বিধায় এধরনের গীবত বর্জন করা উচিত।
অন্যের দোষ অনুসন্ধান করা ও প্রচার করা কাবীরাগুনাহ
অন্যের কোনো দোষের সংবাদ অনুসন্ধান করা ও তা লোক সমাজে প্রচার করা অন্যায়। যা কাবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ صَعِدَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ الْمِنْبَرَ فَنَادَى بِصَوْتٍ رَفِيْعٍ فَقَالَ يَا مَعْشَرَ مَنْ أَسْلَمَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يُفْضِ الْإِيْمَانُ إِلَى قَلْبِهِ لَا تُؤْذُوْا الْمُسْلِمِيْنَ وَلَا تُعَيِّرُوْهُمْ وَلَا تَتَّبِعُوْا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنْ تَتَبَّعَ عَوْرَةَ أَخِيْهِ اَلْمُسْلِمِ تَتَبَّعَ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ تَتَبَّعَ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ وَلَوْ فِىْ جَوْفِ رَحْلِهِ
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বারে আরোহন করে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘হে ঐ সকল লোক! যারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে প্রোথিত হয়নি, তোমরা মুসলিমদেরকে কষ্ট দিয়ো না, তাদেরকে ভর্ৎসনা করো না এবং তাদের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করো না। কেননা যে তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করে বেড়ায়, আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করবেন। আর আল্লাহ যার দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করবেন, তাকে অপদস্থ করবেন, সে তার বাহনের পেটের মধ্যে অবস্থান করলেও’।[৪] অনুরূপ অপর এক বর্ণনা রয়েছে-لَا تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِيْنَ وَلَا تَتَّبِعُوْا عَوْرَاتِهِمْ ‘তোমরা মুসলিমদের গীবত করো না এবং তাদের দোষ খুঁজে বেড়ায়ো না’।[৫]
অন্যের দোষ অনুসন্ধান করা ইসলামের দৃষ্টিতে বড় অপরাধ। মুসলিমদের কষ্ট দেয়া, ভর্ৎসনা করা, গীবত করা ও গালি দেয়া নোংরা কাজ। কেউ যদি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দোষ খুঁজতে মাঠে নামে, তাহলে আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করে প্রকাশ করে দিবেন। এমনকি সে তার বাহন তথা উটের পেটের মধ্যে লুকালেও মুক্তি পাবে না। মানে অসম্ভব কোথাও অত্মগোপন করলেও মহান আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিবেন। তিনি কারো দোষ প্রকাশ করে দিলে কিভাবে সে রেহায় পাবে? তিনি তো গায়েবের সকল খবর রাখেন। কোনো মানুষের পিছনে লাগা বড় অন্যায়। যদিও বর্তমান সমাজে এক শ্রেণির মানুষের পিছনে লাগা স্বভাব খুবই বেশি। তারা অহেতুক একজন অপর জনের দোষ অনুসন্ধান করে বেড়ায়। কারো পিছনে লাগলে আল্লাহ তাকে লঞ্ছিত করেই ছাড়বেন। বিধায় অপর মানুষের পিছনে লাগা বা দোষ খুঁজে বের করার স্বভাব বর্জন করা অপরিহার্য।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يَخْذُلُهُ وَلَا يَحْقِرُهُ التَّقْوَى هَا هُنَا وَيُشِيْرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। কাজেই তার উপর যুলুম করবে না, তাকে লজ্জিত করবে না এবং তাকে তুচ্ছ মনে করবে না। আল্লাহভীতি এখানে- একথা বলে তিনি তিনবার নিজের বুকের দিকে ইশারা করলেন। (নবী করীম (ﷺ) আরো বলেছেন) কোনো ব্যক্তির মন্দ কাজ করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে নিজের কোনো মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করে। একজন মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের জান, মাল ও মান-সম্মান বিনষ্ট করা হারাম’।[৬]
কোনো মুসলিম ব্যক্তির উপর অত্যাচার করা ও তাকে বিপদে ফেলা গর্হিত অপরাধ। কাউকে হেয় বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ইসলামে নিষেধ। যে ব্যক্তি অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করে সে প্রকৃতপক্ষেই মন্দ স্বভাবের মানুষ। নোংরা আচরণের মানুষেরাই অন্যকে তুচ্ছ ভাবে। বরং সকল মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করবে। অপর মুসলিম ব্যক্তির রক্ত, সম্পদ ও সম্মান-মর্যাদা নষ্ট করা হারাম। এগুলো একে অপরের প্রতি গচ্ছিত আমানত স্বরূপ। এসব নষ্ট করা আমানতের খিয়ানতের ন্যায়। কেউ কারো সম্মান ও মর্যাদায় আঘাত হানতে পারবে না। একজন আরেক জনের মর্যাদা রক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يُبْصِرُ أَحَدُكُمُ الْقَذَاةَ فِيْ عَيْنِ أَخِيْهِ وَيَنْسَى الْجِذْعَ فِيْ عَيْنِهِ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের চোখে কুটা দেখতে পায়, কিন্তু নিজের চোখে গাছের গুঁড়ি দেখতে ভুলে যায়’।[৭]
কোনো মানুষ ভুলের ঊর্দ্ধে নয়। মানুষ মাত্রই ভুল হবে। ভুল হওয়া বা ভুল করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। অন্যের দোষ অনুসন্ধানের আগে নিজের দোষ অনুসন্ধান করা উচিত। অন্যের বিন্দু পরিমাণ দোষও চোখে পড়ে। তখন সে তা প্রচারে ব্যস্ত হয়ে যায়। তাকে লাঞ্ছিত করার জন্য উন্মাদ হয়ে পড়ে। অথচ গাছের বিশাল গুঁড়ির মতো দোষও তার মধ্যে অনেক সময় থাকে। যা তার চোখে পড়ে না। অন্যের দোষ সহজে চোখে পড়লেও নিজের দোষ সহজে চোখে পড়ে না। তাই কারো দোষ প্রকাশ না করে তাকে ব্যক্তিগতভাবে সংশোধন করে দেয়ায় প্রকৃত মুমিনের কর্তব্য। তাহলে পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা বাড়বে না। বরং তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হবে। ভুল সংশোধন করতে হবে মার্জিত ভাষা ও উত্তম পন্থায়। আর নিজের দোষ বিশ্লেষণ করে তা সত্বর বর্জন করতে হবে।
গীবতকারী জান্নাতে যাবে না
গীবত বা পরনিন্দাকারীর শেষ পরিণাম জাহান্নাম। হাদীছে এসেছে, হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[৮]
অগোচরে অন্যের দোষ চর্চাকারী ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না। তার দ্বারা সমাজের বেহিসাব ক্ষতি হয়। এমন সমাজ বিধ্বংসী ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে দিবেন না। যার শেষ ফলাফল বেদানাদায়ক জাহান্নাম এমন কর্মে যুক্ত হওয়া কোনো জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য শোভনীয় নয়। বিধায় সকল ধরনের গীবত বর্জন করা একান্ত কর্তব্য।
গীবতকারীর ভয়াবহ শাস্তি
গীবতকারীর শাস্তিও খুবই ভয়ঙ্কর। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ مَرَّ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ عَلَى قَبْرَيْنِ فَقَالَ إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِىْ كَبِيْرٍ أَمَّا هَذَا فَكَانَ لَا يَسْتَتِرُ مِنْ بَوْلِهِ وَأَمَّا هَذَا فَكَانَ يَمْشِى بِالنَّمِيْمَةِ
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দু’টি কবরের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় এ দু’জন কবরবাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তবে বড় কোনো গুনাহের কারণে নয়। সে পেশাব করার সময় সর্তক থাকত না। আর মানুষের গীবত করে বেড়াত’।[৯]
عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله ﷺ لَمَّا عُرِجَ بِيْ رَبِّيْ مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمِشُوْنَ وُجُوْهَهُمْ وَصُدُوْرَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هؤُلَاءِ يَا جِبْرِيْلُ؟ قَالَ هؤُلَاءِ الَّذِيْنَ يَأكُلُوْنَ لُحُوْمَ النَّاسِ وَيَقَعُوْنَ فِيْ أعْرَاضِهِمْ
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আমার প্রতিপালক যখন আমাকে মি‘রাজে নিয়ে গেলেন, তখন আমি কতিপয় লোকের নিকট দিয়ে গমন করলাম, যাদের নখ ছিল তামার। তা দ্বারা তারা নিজেদের মুখমণ্ডল ও বক্ষ আঁচড়াতে ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এরা কারা? তিনি বললেন, ঐ সকল লোক যারা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের ইয্যত আব্রুর হানি করত’।[১০]
গীবতকারী ব্যক্তিকে ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হয়। কবর থেকেই তার আযাব শুরু হয়ে যায়। গীবত করার জন্য কবরে তাকে ভয়ংকর শাস্তির মুখে পড়তে হয়। আর জাহান্নামের কঠিন আযাব তো আছেই। জাহান্নামে গীবতকারীকে তামার নখ দেয়া হবে। এ নখ দ্বারা নিজেদের মুখমণ্ডল এবং বক্ষ আঁচড়াতে থাকবে। যারা অন্যের গীবত করতে অভ্যস্ত তাদের সাবধান হওয়া উচিত। অন্যথায় এরূপ শাস্তি ভোগ করতে হবে।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* পরিচালক, ইয়াসিন আলী সালাফী কমপ্লেক্স, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৯; আবূ দাঊদ, হা/৪৮৭৪; তিরমিযী, হা/১৯৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৯৭৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৭৫৯; দারেমী, হা/২৭১৪; মিশকাত, হা/৪৮২৮।
[২]. আবূ দাঊদ, হা/৪৮৭৫; তিরমিযী, হা/২৫০২; ছহীহুল জামে‘, হা৯২৭১; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৮৩৪; মিশকাত, হা/৪৮৫৩, সনদ ছহীহ।
[৩]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ মুহাম্মাদ আল-উছায়মীন, শারহু রিয়াযিছ ছালেহীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৭৫৫।
[৪]. তিরমিযী, হা/২০৩২; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১০৬৮২; ছহীহুল জামে‘, হা/৭৯৮৪; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২৩৩৯, মিশকাত, হা/৫০৪৪; সনদ হাসান।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/৪৮৮০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৭৯১; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৬২৭৮; মুসনাদে আবী ইয়ালা, হা/১৬৭৫; ছহীহ আত-তরাগীব, হা/২৩৪০, সনদ ছহীহ।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হ/২৫৬৪; ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হ/৭৭১৩; ছহীহুল জামে‘, হা/৭২৪২; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২২৩২; মিশকাত, হা/৪৯৫৯।
[৭]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৭৬১; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৯২; ছহীহুল জামে‘, ৮০১৩; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩৩১, সনদ ছহীহ।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৫৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫; আবূ দাঊদ, হা/৪৮৭১; তিরমিযী, হা/২০২৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩২৯৫; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৭৬৫; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৪১৯২; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১১১০২; মিশকাত, হা/৪৮২৩।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯২; নাসাঈ, হা/২০৬৯; আহমাদ, হা/১৯৮০; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩১২৮; দারেমী, হা/৭৩৯; মিশকাত, হা/৩৩৮।
[১০]. আবুদাউদ, হা/৪৮৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৩৬৪; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৮; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৫৩৩; মিশকাত ,হা/৫০৪৬, সনদ ছহীহ।