ক্রোধের ভয়াবহতা ও তার শারঈ চিকিৎসা
-হাসীবুর রহমান বুখারী*
(শেষ কিস্তি)
৮). ধর্মীয় ক্ষতি
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ بِالۡحِکۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ وَ جَادِلۡہُمۡ بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ ؕ اِنَّ رَبَّکَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَنۡ ضَلَّ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُہۡتَدِیۡنَ
‘জ্ঞান-বুদ্ধি আর উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আপনি (মানুষকে) আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান জানান আর লোকেদের সাথে উত্তম পন্থায় তর্ক-বিতর্ক করুন। আপনার প্রতিপালক ভালোভাবেই জানেন কে তাঁর পথ ছেড়ে গুমরাহ হয়ে গেছে। আর কে সঠিক পথে আছে তাও তিনি সর্বাধিক জ্ঞাত’ (সূরা আন-নাহল : ১২৫)।
উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে একটা বড় চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন যে ‘তর্ক-বিতর্কের সময় ভাষা সংযত রাখবে, অনিয়ন্ত্রিত হবে না। কেননা এটা মুনাফিক্বের নিদর্শন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أَرْبَعٌ مَّنْ كُنَّ فِيْهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا وَمَنْ كَانَتْ فِيْهِ خَصْلَةٌ مِّنْهُنَّ كَانَتْ فِيْهِ خَصْلَةٌ مِّنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ
‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হচ্ছে খাঁটি মুনাফিক্ব। যার মধ্যে এর কোন একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিক্বের একটি স্বভাব থেকে যায়। ১. আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে ২. কথা বললে মিথ্যা বলে ৩. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে এবং ৪. বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীলভাবে গালাগালি দেয়।[১]
আর এটা তখনই সম্ভব যখন আপনার মধ্যে কোন রাগ থাকবে না। কেননা ক্রোধান্বিত অবস্থায় মস্তিস্ক ও জিহ্বা দুটোই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। ফলে মানুষ আপনার থেকে দূরে সরে যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ ۚ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ۪ فَاعۡفُ عَنۡہُمۡ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ وَ شَاوِرۡہُمۡ فِی الۡاَمۡرِ ۚ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُتَوَکِّلِیۡنَ
‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ এই যে, আপনি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত; আর আপনি যদি কর্কশভাষী, কঠোর হৃদয়ের হতেন তাহলে নিশ্চয় তারা আপনার সংসর্গ হতে অন্তর্হিত হত। অতএব আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজ-কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন, অতঃপর যখন (কোন ব্যাপারে) সংকল্প করেছেন, তখন আল্লাহরই প্রতি ভরসা করুন; নিশ্চয় আল্লাহ ভরসাকারীদেরকে পছন্দ করেন’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৫৯)।
উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বিশ্ব নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এক মহৎ গুণের কথা বলেছেন, আর তাহল তিনি মৃদুভাষী ও কোমল প্রকৃতির ছিলেন, খুব সহজেই তিনি তাঁর যাদু মিশ্রিত মধুর ভাষা দ্বারা মানুষের মন জয় করে নিতেন। আর আজ সেই নবীর ওয়ারিছ (উত্তরাধিকারী) নামী আলেমদের কর্কশ ও অমসৃণ ভাষা, রূঢ়, নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণের কারণে মানুষ কাছেও ঘেঁষতে চায় না। এমতাবস্থায় কি দ্বীনের প্রচার সম্ভবপর হবে?
সুধী পাঠক! ক্রোধের ভয়াবহ ক্ষতিসমূহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর আমাদের অনেকেই মনে একটা প্রশ্ন উঁকি মারতে শুরু করেছে, এছাড়া বুঝতে তো পারলাম যে ক্রোধ একটা ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক জিনিস, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, আমি তো রাগবনা ভাবি কিন্তু আবার রেগে যাই, তাহলে ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করবটা কিভাবে?
আবার অনেকে বলবেন, রাগ না করে কি থাকা যায় নাকি? একজন খামোখা গালিগালাজ করল, অহেতুক অপমান করল, তখনও কি প্রোঅ্যাকটিভ (প্ররোচক) থাকা যায়? উত্তর অনায়াসে থাকা যায়। শুধু স্বার্থের অভিমুখটা পরিবর্তন করুন। দুনিয়াবী স্বার্থান্বেষণের ইন্দ্রজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করে পরকালের প্রতি স্বার্থোন্মত্ত হয়ে যান। পার্থিব জগতের সুখ, সমৃদ্ধ ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবন-যাপনের জন্য আমরা শত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করতে প্রস্তুত, কিন্তু পরকালের স্বার্থে Impossible (অসম্ভব)।
উদাহরণ স্বরূপ : ‘আব্দুল্লাহ নামক ব্যক্তি নিশ্চিন্তপুর এলাকার বিডিও (Block Development Officer) সাহেব। তিনি সময় সম্পর্কে খুবই সচেতন, একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ঘুষ, অন্যায় ও পক্ষপাতিত্ব থেকে শত কোষ দূরে থাকেন। স্থানীয় নেতারা পঞ্চায়েত সমিতির কাজে টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে তিনি বেশ কিছু বিল মুলতবী করে রেখেছেন। প্রতিদিনের মত আজও তিনি সঠিক সময়ে বিডিও অফিসে এসেছেন, নির্ধারিত সময়ে মনোযোগ সহকারে কর্ম করে যাচ্ছেন। এদিকে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মহাশয় আজ বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছেন, মন-মেজাজ খুব-ই খারাপ, কারণে-অকারণে যাকে তাকে বকাঝকা করছেন। কারণ স্ত্রীকে তো আর বকা যায় না। এমতাবস্থায় উপর মহল থেকে সভাপতির কাছে সভাধিপতি সাহেবের ফোন, তিনি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মত সভাপতি সাহেবকে বললেন, আমার কাছে আপনার ব্লকের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ আসছে। আপনার ব্লকে না-কি ঠিকমত কাজকর্ম হচ্ছে না? আর এতগুলো কাজ অনিষ্পন্ন (Pending) হয়ে আছে কেন? এ কথা শুনে তো সভাপতি সাহেব তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, এ যেন গোঁদের উপর বিষফোঁড়া। তিনি আব্দুল্লাহ সাহেবের কক্ষে প্রবেশ করে ধমকানির সুরে যা ইচ্ছে তাই বলে তুলোধোনা অপমান করলেন। আব্দুল্লাহ সাহেব খুবই মনঃক্ষুন্ন হলেন, তিনি তো নিরাপরাধ! তবুও তাকে একজন গণ্ড-মূর্খ নেতার অপমান সহ্য করতে হল। বারংবার তার বিবেক আন্দোলিত হচ্ছিল, প্রতিবাদী মন প্রতিবাদ করতে চাচ্ছিল, কিন্তু ভয়ও হচ্ছিল ‘যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায়, যদি চাকরী নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যায় ‘যদি প্রাণে মেরে দেয়? সাতপাঁচ ভেবে নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলেন, মনের রাগ মনের মধ্যেই দমিয়ে রাখলেন।
শিক্ষণীয় বিষয় : এখানে আব্দুল্লাহ সাহেব পার্থিব জগতের তুচ্ছ স্বার্থ রক্ষার্থে নিরাপরাধ হয়েও চুপ থাকলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে অপমানিত হয়ে প্রতিবাদ পর্যন্ত করলেন না। কারণ একটাই দুনিয়াবী স্বার্থ। আব্দুল্লাহ তো একটা উদাহরণ মাত্র এরকম আমরা লাখো আব্দুল্লাহ আছি যারা দুনিয়াবী স্বার্থের জন্য নিজের ক্রোধ, রাগ সবকিছুকে অনায়াসে হজম করতে পারি। কিন্তুু পরকালের স্বার্থে? আমরা কারো চোখ গরমও সহ্য করতে নারাজ। অথচ এটাই প্রকৃত, নির্ভেজাল স্বার্থ যা অনন্তকালের জন্য। রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا تَغْضَبْ وَلَكَ الْجَنَّةُ ‘তুমি রাগকে নিয়ন্ত্রণ কর, তোমার জন্য জান্নাত অবধারিত’।[২]
এতো বড় ওপেন অফার পাওয়ার পরও আমরা তা গ্রহণ করতে পারছি না। নিজের ক্রোধকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। এর মানে কি এই নই যে, আমরা পরকালে বিশ্বাসী নই। ঝগড়া হচ্ছে মসজিদ কমিটির কোন এক ব্যক্তির সঙ্গে, আমরা বলে বসি যা .... শা .... তোর মসজিদে নামায পড়তেই যাবো না। কে বুঝাবে মসজিদ আল্লাহর ঘর, কমিটির নয়। আর তাছাড়া এখানে তো কোন দুনিয়াবী স্বার্থ নেই যে আমরা কারো গরম সহ্য করব!! বুঝা গেল ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করা না করা সবটাই আমাদের ইচ্ছা।
ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার শারঈ পদ্ধতি
রাগ মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে রাগ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অপ্রীতিকর কিছু দেখলে বা শ্রবণ করলে রাগ হতেও পারে, কিন্তু উভয় জগতে উত্তীর্ণ ঐ ব্যক্তি যে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই এখানে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার কিছু ইসলামী পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১). শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া
عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ صُرَدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنْتُ جَالِسًا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَرَجُلَانِ يَسْتَبَّانِ فَأَحَدُهُمَا احْمَرَّ وَجْهُهُ وَانْتَفَخَتْ أَوْدَاجُهُ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنِّيْ لَاعْلَمُ كَلِمَةً لَوْ قَالَهَا ذَهَبَ عَنْهُ مَا يَجِدُ لَوْ قَالَ أَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ الشَّيْطَانِ ذَهَبَ عَنْهُ مَا يَجِدُ فَقَالُوْا لَهُ إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ تَعَوَّذْ بِاللهِ مِنْ الشَّيْطَانِ فَقَالَ وَهَلْ بِيْ جُنُوْنٌ
সুলাইমান ইবনু ছুরাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন দু’জন লোক গালাগালি করছিল। তাদের এক জনের চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল এবং তার শিরাগুলো ফুলে গিয়েছিল। তখন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি এমন একটি দু‘আ জানি, যদি এ লোকটি তা পড়ে তবে তার রাগ দূর হয়ে যাবে। সে যদি পড়ে ‘আ‘ঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তান’ (আমি শয়তান হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই) তবে তার রাগ চলে যাবে। তখন ছাহাবীগণ লোকটিকে বললেন, তুমি কি শুনছ না, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কী বলছেন? সে বলল, আমি পাগল নই।[৩]
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِذَا غَضِبَ الرَّجُلُ فَقَالَ أَعُوْذُ بِاللهِ سَكَنَ غَضَبُهُ ‘কোন ব্যক্তি রেগে গেলে সে যেন আ‘ঊযুবিল্লাহি পাঠ করে, এতে তার রাগ ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।[৪]
২). চুপ থাকা
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ وَإِذَا غَضِبَ أَحَدُكُمْ فَلْيَسْكُتْ
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ রেগে গেলে সে যেন চুপ থাকে।[৫]
শিক্ষনীয় বিষয় : ক্রোধান্বিত অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্ক ও জিহ্বা দুটোই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়, ফলে আমরা পূর্বাপর চিন্তা-ভাবনা না করেই হুটহাট কিছু করে বসি বা বলে দিই-যেমন ‘ত্বালাকের মত ভয়ঙ্কর সম্পর্ক বিচ্ছেদকারী শব্দ, গালাগালি করা’ ইত্যাদি। এই অবস্থায় আমাদের মুখমণ্ডল শয়তান দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। তাই শরীরে রাগ অনুভূত হলেই চুপ হয়ে যাওয়া ইসলামের বিধান। এতে আপনার দ্বীন এবং দুনিয়া দুটোই অক্ষত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
৩). রাগ কন্ট্রোল করা তাক্বওয়ার নিদর্শন
মহান আল্লাহ বলেন,
وَ سَارِعُوۡۤا اِلٰی مَغۡفِرَۃٍ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ جَنَّۃٍ عَرۡضُہَا السَّمٰوٰتُ وَ الۡاَرۡضُ ۙ اُعِدَّتۡ لِلۡمُتَّقِیۡنَ - الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الۡکٰظِمِیۡنَ الۡغَیۡظَ وَ الۡعَافِیۡنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ
‘তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে ও সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি হচ্ছে আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, শর্ত হচ্ছে তা শুধু মুত্তাক্বীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। আর মুত্তাক্বি তো তারাই যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয়াবস্থাতেই (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল, আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৩৩-১৩৪)।
৪). ক্রোধ সংবরণকারীর জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার
عَنْ سَهْلِ بْنِ مُعَاذٍ عَنْ أَبِيْهِ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ كَظَمَ غَيْظًا وَهُوَ قَادِرٌ عَلَى أَنْ يُنْفِذَهُ دَعَاهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى رُءُوْسِ الْخَلَائِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ اللهُ مِنَ الْحُوْرِ الْعِيْنِ مَا شَاءَ
সাহল ইবনু মু‘আয ইবনু আনাস আল-জুহানী (রাহিমাহুল্লাহ) হতে তার বাবার সূত্রে বর্ণিত আছে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে লোক তার ক্রোধকে বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রেখেও তা নিয়ন্ত্রণ করে- আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত দিবসে তাকে সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডেকে এনে জান্নাতের যে কোন হুর নিজের ইচ্ছামত বেছে নেয়ার অধিকার দিবেন।[৬]
৫). ক্রোধ নিয়ন্ত্রণকারী সর্বাধিক বীর
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْسَ الشَّدِيْدُ بِالصُّرْعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيْدُ الَّذِيْ يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, প্রকৃত বীর সে নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়। বরং সেই আসল বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।[৭] যেমন,
(ক) এক্ষেত্রে আমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন শিক্ষণীয় আদর্শ
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنْتُ أَمْشِيْ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَلَيْهِ بُرْدٌ نَجْرَانِيٌّ غَلِيْظُ الْحَاشِيَةِ فَأَدْرَكَهُ أَعْرَابِيٌّ فَجَبَذَ بِرِدَائِهِ جَبْذَةً شَدِيْدَةً قَالَ أَنَسٌ فَنَظَرْتُ إِلَى صَفْحَةِ عَاتِقِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَدْ أَثَّرَتْ بِهَا حَاشِيَةُ الرِّدَاءِ مِنْ شِدَّةِ جَبْذَتِهِ ـ ثُمَّ قَالَ يَا مُحَمَّدُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُرْ لِيْ مِنْ مَالِ اللهِ الَّذِيْ عِنْدَكَ. فَالْتَفَتَ إِلَيْهِ فَضَحِكَ ثُمَّ أَمَرَ لَهُ بِعَطَاءٍ.
আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে হাঁটছিলাম। তখন তাঁর গায়ে একখানা গাঢ় পাড়যুক্ত নাজরানী চাদর ছিল। এক বেদুঈন তাঁকে পেয়ে চাদরখানা ধরে খুব জোরে টান দিল। আমি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাঁধের উপর তাকিয়ে দেখলাম যে, জোরে চাদরখানা টানার কারণে তাঁর কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। তারপর বেদুঈনটি বলল, হে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তোমার কাছে আল্লাহর দেয়া যে সম্পদ আছে, তাত্থেকে আমাকে দেয়ার আদেশ কর। তখন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন এবং তাকে কিছু দান করার আদেশ করলেন।[৮]
(খ) এক্ষেত্রে ওমর ফারুক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর আদর্শ অতুলনীয়
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَدِمَ عُيَيْنَةُ بْنُ حِصْنِ بْنِ حُذَيْفَةَ فَنَزَلَ عَلَى ابْنِ أَخِيْهِ الْحُرِّ بْنِ قَيْسٍ وَكَانَ مِنْ النَّفَرِ الَّذِيْنَ يُدْنِيْهِمْ عُمَرُ وَكَانَ الْقُرَّاءُ أَصْحَابَ مَجَالِسِ عُمَرَ وَمُشَاوَرَتِهِ كُهُوْلًا كَانُوْا أَوْ شُبَّانًا فَقَالَ عُيَيْنَةُ لِابْنِ أَخِيْهِ يَا ابْنَ أَخِيْ هَلْ لَكَ وَجْهٌ عِنْدَ هَذَا الْأَمِيْرِ فَاسْتَأْذِنْ لِيْ عَلَيْهِ قَالَ سَأَسْتَأْذِنُ لَكَ عَلَيْهِ قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ فَاسْتَأْذَنَ الْحُرُّ لِعُيَيْنَةَ فَأَذِنَ لَهُ عُمَرُ فَلَمَّا دَخَلَ عَلَيْهِ قَالَ هِيْ يَا ابْنَ الْخَطَّابِ فَوَاللّٰهِ مَا تُعْطِيْنَا الْجَزْلَ وَلَا تَحْكُمُ بَيْنَنَا بِالْعَدْلِ فَغَضِبَ عُمَرُ حَتَّى هَمَّ أَنْ يُوْقِعَ بِهِ فَقَالَ لَهُ الْحُرُّ يَا أَمِيْرَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِنَّ اللهَ تَعَالَى قَالَ لِنَبِيِّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ { خُذِ الۡعَفۡوَ وَ اۡمُرۡ بِالۡعُرۡفِ وَ اَعۡرِضۡ عَنِ الۡجٰہِلِیۡنَ } وَإِنَّ هَذَا مِنَ الْجَاهِلِيْنَ وَاللهِ مَا جَاوَزَهَا عُمَرُ حِيْنَ تَلَاهَا عَلَيْهِ وَكَانَ وَقَّافًا عِنْدَ كِتَابِ اللهِ
ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, ‘উয়াইনাহ ইবনু হিছন ইবনু হুযাইফাহ এসে তাঁর ভাতিজা হুর ইবনু ক্বাইসের কাছে অবস্থান করলেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যাদেরকে পার্শ্বে রাখতেন হুর ছিলেন তাদের একজন। কারীগণ, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই ওমর ফারূক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মজলিসের সদস্য এবং উপদেষ্টা ছিলেন। এরপর ‘উয়াইনাহ তাঁর ভাতিজাকে ডেকে বললেন, এই আমীরের কাছে তো তোমার একটা মর্যাদা আছে, সুতরাং তুমি আমার জন্য তাঁর কাছে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে দাও।
তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি তাঁর কাছে আপনার প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করব।
ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, এরপর হুর অনুমতি প্রার্থনা করলেন উয়াইনাহর জন্য এবং ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অনুমতি দিলেন। উয়াইনাহ ওমরের কাছে গিয়ে বললেন, হ্যাঁ আপনি তো আমাদেরকে অধিক অধিক দানও করেন না এবং আমাদের মাঝে সুবিচারও করেন না। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাগান্বিত হলেন এবং তাঁকে কিছু একটা করতে উদ্যত হলেন। তখন হুর বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তা‘আলা তো তাঁর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেছেন, ‘ক্ষমা অবলম্বন করুন, সৎকাজের আদেশ দান করুন এবং মূর্খদেরকে উপেক্ষা করুন’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৯৯) আর এই ব্যক্তি তো অবশ্যই মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর কসম ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আয়াতের নির্দেশ অমান্য করেননি। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর কিতাবের বিধানের সামনে চুপ হয়ে যেতেন।[৯]
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সামনে কয়েকটি বিষয় আয়নার মত স্বচ্ছ হল : ১. ক্রোধ উভয় জগতের জন্যই ধ্বংসাত্মক বিষয়। ২. এটা পেশাব-পায়খানার মত কোন অনিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক চাপ নয় যা সংযত করা যাবে না, বরং আমরা চাইলেই ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। ৩. ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় জীবনে অগণিত কল্যাণ হয়েছে। পরিশেষে আল্লাহর কাছে করুণ আবেদন করি, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সকলকে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার তাওফীক্ব দান করে উভয় জীবনকে কল্যাণময় করে তুলুন- আল্ল-হুম্মা আমীন!!
* মুর্শিদাবাদ, ভারত।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪, ২৪৫৯, ৩১৭৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৫৮।
[২]. ত্বাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১৭৬২; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/২৩৫৩, সনদ ছহীহ লি গায়রিহি; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৭৪৯।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৮২, ৬১১৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬১০।
[৪]. ছহীহুল জামে‘, হা/৬৯৫; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৩৭৬, সনদ ছহীহ। সাহমী তাঁর ‘তারীখু জুরজান’ বইয়ে ইবনু ‘আদীর রেওয়ায়েতে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন; আল-কামিল, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৭।
[৫]. আদাবুল মুফরাদ, হা/ ২৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩৬; ছহীহুল জামে‘, হা/৬৯৩; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৩৭৫, সনদ ছহীহ।
[৬]. আবূ দাঊদ, হা/৪৭৭৭, তিরমিযী, হা/২০২১, ২৪৯৩; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৮৬, সনদ হাসান।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১১৪; ছহীহ মুসলিম ,হা/২৬০৯।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৪৯, ৫৮০৯, ৬০৮৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫৭।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৬৪২, ৭২৮৬।