মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৯:২০ পূর্বাহ্ন

ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা

-মূল : শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল ওয়াহহাব
-ব্যাখ্যা : শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছাইমীন
-অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক্ব বিন আব্দুল ক্বাদীর*


(শেষ কিস্তি)

মূলনীতি-৬

কুরআন সুন্নাহকে পরিহার করা এবং বিভিন্ন মতামত ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করার ক্ষেত্রে শয়তানের উদ্ভাবিত সন্দেহের নিরসন প্রসঙ্গে। আর তাহল- সাধারণত মুজতাহিদ আলেম ছাড়া কুরআন ও সুন্নাহকে কেউ বুঝতে সক্ষম নয়। আর মুজতাহিদ (বিজ্ঞ আলেম)-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তাকে এমন গুণে ভূষিত করা হয় সম্ভবত সেগুলো পরিপূর্ণভাবে আবূ বকর ও ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর মাঝেও পাওয়া যাবে না। অতঃপর কোন মানুষ অনুরূপ গুণ সম্পন্ন না হলে সে নিঃসন্দেহে কোন প্রশ্ন ছাড়াই অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দূরে থাকবে। (শয়তান আরো সন্দেহ সৃষ্টি করে যে) কেউ যদি এ দু’টি (কুরআন ও হাদীছ) থেকে হেদায়াত তালাশ করতে চায় সে অবিশ্বাসী বেদ্বীন অথবা পাগল বলে গণ্য হবে; কুরআন ও হাদীছ বুঝতে জটিলতা হওয়ার কারণে।

সুবহানাল্লাহ ওয়াবিহামদিহী কী আশ্চর্য! আল্লাহ তা‘আলা এই অভিশপ্ত সন্দেহের নিরসন করার ক্ষেত্রে বহুবিধ পদ্ধতি অবলম্বন করার বর্ণনা দিয়েছেন যা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সাধারণত কেউ বুঝিনা বলার সুযোগ নেই। তারপরও বহু মানুষ জানে না। মহান আল্লাহ বলেন,

لَقَدۡ حَقَّ الۡقَوۡلُ عَلٰۤی  اَکۡثَرِہِمۡ  فَہُمۡ  لَا یُؤۡمِنُوۡنَ  - اِنَّا جَعَلۡنَا فِیۡۤ  اَعۡنَاقِہِمۡ  اَغۡلٰلًا فَہِیَ  اِلَی  الۡاَذۡقَانِ فَہُمۡ  مُّقۡمَحُوۡنَ  - وَ جَعَلۡنَا مِنۡۢ بَیۡنِ اَیۡدِیۡہِمۡ سَدًّا وَّ مِنۡ خَلۡفِہِمۡ سَدًّا فَاَغۡشَیۡنٰہُمۡ فَہُمۡ لَا یُبۡصِرُوۡنَ  - وَ سَوَآءٌ عَلَیۡہِمۡ ءَاَنۡذَرۡتَہُمۡ اَمۡ لَمۡ تُنۡذِرۡہُمۡ  لَا  یُؤۡمِنُوۡنَ   - اِنَّمَا تُنۡذِرُ مَنِ اتَّبَعَ  الذِّکۡرَ  وَ خَشِیَ الرَّحۡمٰنَ بِالۡغَیۡبِ  فَبَشِّرۡہُ  بِمَغۡفِرَۃٍ وَّ اَجۡرٍ  کَرِیۡمٍ

‘তাদের অধিকাংশের জন্য সেই বাণী অবধারিত হয়েছে; সুতরাং তারা ঈমান আনবে না। আমরা তাদের গলদেশে চিবুক (থুতনি) পর্যন্ত বেড়ি পরিয়েছি, ফলে তারা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে গেছে। আমরা তাদের সম্মুখে প্রাচীর ও পশ্চাতে প্রাচীর স্থাপন করেছি এবং তাদেরকে আবৃত্ত করেছি, ফলে তারা দেখতে পায় না। আপনি তাদেরকে সতর্ক করুন বা না করুন, তাদের পক্ষে উভয়ই সমান; তারা ঈমান আনবে না। আপনি শুধু তাকেই সতর্ক করতে পারেন যে উপদেশ মেনে চলে এবং না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে। অতএব আপনি তাকে ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের সংবাদ দিন’ (সূরা ইয়াসীন : ৭-১১)।

পরিশেষে জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য প্রশংসা জ্ঞাপন করছি এবং আমাদের নেতা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি এবং তাঁর পরিবার ও ছাহাবীগণের প্রতি ক্বিয়ামত পর্যন্ত অফুরন্ত (আল্লাহর) রহমত ও শান্তি কামনা করছি।

ব্যাখ্যা

ইজতিহাদ অর্থ : আভিধানিক অর্থ ‘কঠিন বিষয়কে অনুধাবন করার জন্য চেষ্টা ব্যয় করা’। পারিভাষিক অর্থ ‘শরী‘আতের কোন বিধান জানার জন্য শ্রম ব্যয় করা’।

ইজতিহাদের শর্তসমূহ : ইজতিহাদের জন্য কিছু শর্ত রয়েছে।

১).  মুজতাহিদ ব্যক্তিকে তার ইজতিহাদ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রয়োজনীয় আহকাম সংক্রান্ত শরী‘আতের দলীল জানা।
২). হাদীছের সনদ, রাবী এবং অন্যান্য বিষয় সহ হাদীছ ছহীহ ও যঈফ হওয়ার জ্ঞান থাকা।
৩). নাসিখ, মানসূখ ও ইজমা বিষয়ে জ্ঞান থাকা। যাতে করে তিনি মানসূখ ও ইজমা বিরোধী ফায়ছালা না করেন।
৪). বিশেষ বা শর্তারোপকারী দলীল সম্পর্কে জ্ঞান রাখা, যার কারণে শরী‘আতের হুকুম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। যাতে করে তিনি এর বিপরীত ফায়ছালা না করেন।
৫). তিনি ভাষা ও ফিক্বহী মূলনীতির জ্ঞান রাখবেন, যা শব্দের বিভিন্ন অর্থের পরিভাষা সংক্রান্ত হয়ে থাকে। যেমন আম, খাছ, মুতলাক্ব, মুুকাইয়্যাদ, মুজমাল, মুবাইয়্যান ইত্যাদি। যাতে তিনি শব্দের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ছালা করতে পারেন।
৬). তার এমন সক্ষমতা থাকবে যার দ্বারা তিনি শারঈ দলীল থেকে হুকুম বা সমাধান বের করতে সক্ষম হবেন।

আর ইজতিহাদ খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়। কখনো ইলমী বিভিন্ন বিষয়ের মধ্য হতে এক প্রকার অধ্যায় হয়। আবার মাসআলায় এক প্রকার অধ্যায় হয়। তবে মুজতাহিদ এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল যে, তিনি সত্যকে জানার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। তারপর তার নিকট যা প্রকাশ পাবে, সে অনুযায়ী তিনি ফায়সালা দিবেন। অতঃপর তিনি সঠিক করলে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ নেকি। একটি নেকি সত্য অনুসন্ধানে চেষ্টা করার জন্য। আর একটি নেকি সত্যের সঠিকতার কারণে। কেননা সত্যের সঠিকতার মাঝে সত্যের প্রকাশ করাও তার প্রতি আমল নিহীত রয়েছে। আর যদি তিনি ইজতিহাদে ভুল করেন তাহলেও তার জন্য একটি নেকি রয়েছে এবং তার ভুল ক্ষমা করা হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘কোন বিচারক ইজতিহাদে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তার জন্য রয়েছে দু’টি নেকি। আর বিচারক ইজতিহাদে ভুল করলে তার জন্যও রয়েছে একটি নেকি।[১]

আর যদি ইজতিহাদ করতে গিয়ে তার নিকট কোন ফায়সালা প্রকাশ না পায়, তাহলে তার জন্য অপরিহার্য হল সেখানে থেমে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে তার জন্য নিরুপায় হয়ে অন্যের অনুকরণ করা জায়েয। আল্লাহ তা‘আলার বাণী, فَسۡـَٔلُوۡۤا اَہۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ ‘তোমরা যদি না জান তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (সূরা আন-নাহল : ৪৩)।

এ কারণে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন যে, ‘তাক্বলীদ হল নিরুপায় হয়ে মৃতপ্রাণী আহার করার মত। সুতরাং ব্যক্তি যখন নিজে দলীল বের করতে সক্ষম হবে তখন তার জন্য তাক্বলীদ করা হালাল হবে না’।[২] ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘প্রকৃত জ্ঞান হল দলীলের মাধ্যমে হেদায়াতের পরিচয় লাভ করা। ইহা এবং তাক্বলীদ কি সমান হতে পারে’?[৩] তাক্বলীদ দুই স্থানে হয়ে থাকে-

১). মুক্বাল্লীদ এমন সাধারণ ব্যক্তি হবে, যার শরী‘আতের হুকুম জানার ক্ষেত্রে নিজের কোন যোগ্যতা নেই। তার জন্য তাক্বলীদ করা অপরিহার্য। আল্লাহ তা‘আলার বাণী, فَسۡـَٔلُوۡۤا اَہۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ ‘তোমরা যদি না জান তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (সূরা আন-নাহল : ৪৩)।

সে ক্ষেত্রে তিনি জ্ঞান ও তাক্বওয়ায় যাকে সর্বোত্তম পাবেন তার অনুকরণ করবেন। আর যদি তার নিকট দু’জন ব্যক্তি সমান বলে মনে হয়, তাহলে দু’জনের যে কোন একজনের অনুকরণ করবেন।

২). মুজতাহিদ ব্যক্তির নিকট এমন ঘটনা উপস্থিত হল যার দ্রুত সমাধান দেয়ার প্রয়োজন। কিন্তু তিনি তাৎক্ষণিক সে ব্যাপারে ইজতিহাদ করতে সক্ষম নন। সে সময় তার জন্যও অন্যের তাক্বলীদ করা জায়েয।

তাক্বলীদের প্রকার : তাক্বলীদ দু’ প্রকার। ১. আম বা সাধারণ তাক্বলীদ, ২. খাছ বা বিশেষ তাক্বলীদ।

১). আম বা সাধারণ তাক্বলীদ : আম বা সাধারণ তাক্বলীদ হল, ব্যক্তি তার ধর্মীয় সকল ব্যাপারে মাযহাবের শিথিল ও জটিল বিষয়গুলোকে গ্রহণ করে নির্দিষ্ট মাযহাবকে আঁকড়ে ধরবে। এ ব্যাপারে আলেমগণের মতানৈক্য রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীদের মাঝে ইজতিহাদ করার ক্ষমতা না থাকার অজুহাত পেশ করে এই প্রকার তাক্বলীদকে ওয়াজিব বলে উল্লেখ করেছেন। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই প্রকার তাক্বলীদকে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া অন্য ব্যক্তির অনুসরণ করার কারণে হারাম বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘নিশ্চয় নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া অন্য ব্যক্তির সকল আদেশ ও নিষেধকে মেনে নেয়া ওয়াজিব বলার মতটি হল ইজমা বিরোধী কথা। তবে ইজমা রয়েছে এমন বিষয়ে তাকে মান্য করা জায়েয।

২). খাছ বা বিশেষ তাক্বলীদ : আর খাছ বা বিশেষ তাক্বলীদ হল, কোন নির্দিষ্ট ঘটনায় কোন নির্দিষ্ট কথাকে গ্রহণ করা। এ তাক্বলীদ করা ব্যক্তির জন্য তখনই জায়েয হবে যখন সে ইজতিহাদের মাধ্যমে সত্য জানতে অক্ষম হবে। হতে পারে সে ইজতিহাদ করতে একেবারে অক্ষম অথবা বহু কষ্টের সাথে সক্ষম হতে পারে।
 

* মুহাদ্দিছ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩৫২।
[২]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ২০তম খণ্ড, পৃ. ২০৩।
[৩]. ইবনুল ক্বাইয়িম, নূনিয়াহ (আল-কাফিয়াতুশ শাফিয়াহ ফিল ইনতিছার লিল ফের্কাতিন নাজিয়াহ, দ্র.)।




ইসলামী সংগঠন ও তরুণ-যুবক-ছাত্র - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
রজব মাসের বিধানসমূহ - অনুবাদ : ইউনুস বিন আহসান
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৩য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য (৪র্থ কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১৪তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
তাক্বওয়াই মুক্তির সোপান (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুর রশীদ
বিদ‘আত পরিচিতি (১২তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৭ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৩য় কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
বিদ‘আত পরিচিতি (২৮তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ