সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০২:১৬ পূর্বাহ্ন

বিদ‘আত পরিচিতি

-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


 (১৩তম কিস্তি)

বিদ‘আতের প্রকারভেদ

প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শরী‘আতে বিদ‘আতের কোন প্রকারভেদ নেই। বরং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা। এক্ষেত্রে ভাল কিংবা মন্দের কোন প্রশ্নই আসে না। কেননা উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষ ছাহাবায়ে কিরাম এবং তাবেঈগণ বিদ‘আতের ভ্রষ্টতার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবে উলামায়ে কিরাম বিভিন্ন মানদণ্ডে বিদ‘আতকে কতিপয় শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যেমন দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হওয়া না হওয়ার দিক থেকে, কর্মে বাস্তবায়ন এবং বর্জনের দিক থেকে, বিশ্বাস ও কর্মে বাস্তবায়নের দিক থেকে, বিধানগত দিক থেকে। নিম্নে বিদ‘আতের প্রকরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হল :

ক. দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হওয়া না হওয়ার দিক থেকে বিদ‘আতের প্রকার : এ প্রকার বিদ‘আত দুই প্রকার। যথা :

১. প্রকৃত বিদ‘আত (البدعة الحقيقية)

শরী‘আতের দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয় এমন বিষয়কে البدعة الحقيقية তথা প্রকৃত বিদ‘আত বলা হয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম আশ-শাত্বেবী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৭৯০ হি./১৩৮৮ খ্রি.) বলেন,

إِنَّ الْبِدْعَةَ الْحَقِيْقِيَّةَ هِيَ الَّتِيْ لَمْ يَدُلَّ عَلَيْهَا دَلِيْلٌ شَرْعِيٌّ؛ لَا مِنْ كِتَابٍ وَلَا سُنَّةٍ وَلَا إِجْمَاعٍ وَلَا قِيَاسٍ وَلَا اسْتِدْلَالٍ مُعْتَبَرٍ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ؛ لَا فِي الْجُمْلَةِ وَلَا فِي التَّفْصِيْلِ وَلِذَلِكَ سُمِّيَتْ بِدْعَةً ... لِأَنَّهَا شَىْءٌ مُخْتَرَعٌ عَلَى غَيْرِ مِثَالٍ سَابِقٍ

‘প্রকৃত বিদ‘আত হল, যার সমর্থনে শরী‘আতের কোন দলীল নেই। আল্লাহর কিতাবে নেই, (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর) সুন্নাতে নেই, ইজমা নেই, কিয়াস নেই এবং এমন কোন দলীল নেই যা বিজ্ঞজনের নিকট গ্রহণযোগ্য হিসাবে পেশ করা যায়। (এমনকি) সংক্ষিপ্তভাবেও নেই এবং বিস্তারিত আকারেও নেই। এ জন্য এর নাম ‘বিদ‘আত’ দেয়া হয়েছে...। কেননা তা মনগড়া, শরী‘আতে যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই’।[১]

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বৈরাগ্যবাদ বা সন্ন্যাসীবাদের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য কামনা করা। অর্থাৎ মানব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গলে অবস্থান, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়া ও তার নে‘মতসমূহ ত্যাগ করা ইত্যাদি। যারা এরূপ করে তারা মূলত মনগড়া ইবাদত করে থাকে এবং তা নিজের উপর বাধ্য করে নেয়। অনুরূপভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় হালাল বস্তুকে হারাম করে নেয়া ইত্যাদি।[২]

২. আপেক্ষিক তথা স্থান, সময় ও পদ্ধতিগত বিদ‘আত (البدعة الإضافية)

এ প্রকারের মধ্যে কিছু বিষয় কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়ে থাকে, যা বিদ‘আত নয়। আবার এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হলেও এর স্থান, সময় ও পদ্ধতি সুন্নাহ পরিপন্থী। ইমাম শাত্বেবী (মৃ. ৭৯০ হি./১৩৮৮ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) এর বরাতে ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহতানী (রাহিমাহুল্লাহ)  (১৯৫২-২০১৮ খ্রি.) বলেন,

وهي التي لها جهتان أو شائبتان: إحداهما: لها من الأدلة متعلق فلا تكون من تلك الجهة بدعة. والأخرى: ليس لها متعلق إلا مثل ما للبدعة الحقيقية: أي أنها بالنسبة لإحدى الجهتين سنة لاستنادها إلى دليل، وبالنسبة إلى الجهة الأخرى بدعة لأنها مستندة إلى شبهة لا إلى دليل، ولأنها مستندة إلى شيء، والفرق بينهما من جهة المعنى أن الدليل عليها من جهة الأصل قائم، ومن جهة الكيفيات، أو الأحوال، أو التفاصيل لم يقم عليها مع أنها محتاجة إليه؛ لأن الغالب وقوعها في التعبديات لا في العادات المحضة

‘এ প্রকার বিদ‘আতের দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমতঃ যে ব্যাপারে শরী‘আতের দলীল বিদ্যমান রয়েছে। এরূপ ক্ষেত্রে সেটা বিদ‘আত হবে না। দ্বিতীয়তঃ এর সাথে বিদ‘আতের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই বরং প্রকৃত বিদ‘আতের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। অর্থাৎ এক দিক বিবেচনায় দলীলের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে তা সুন্নাত হিসাবে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে অন্য দিক বিবেচনায় দলীলের সাথে সংশ্লিষ্টতা না থাকার কারণে বিদ‘আত হিসাবে গণ্য হবে। কারণ এর মাঝে সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে, গ্রহণযোগ্য কোন প্রমাণ নেই। আবার অর্থের দিক থেকেও উভয়ের মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান। মৌলিকভাবে যার দলীল আছে কিন্তু অবস্থা, পরিস্থিতি অথবা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দিক থেকে কোন দলীল নেই। কেননা তা ইবাদতের ক্ষেত্রে বিদ‘আত হবে, অভ্যাসগত হলে বিদ‘আত হবে না’।[৩]

নিম্নে কয়েকটি উদাহরণের প্রতি খেয়াল করুন-

  •  ছালাতের পর সম্মিলিতভাবে সমস্বরে যিকির করা।
  •  ছালাতের পর ইমাম কর্তৃক সম্মিলিত দু‘আকে যরূরী মনে করা।
পর্যালোচনা-১

সুধী পাঠক! যিকির করা অবশ্যই শরী‘আতসম্মত ইবাদত। কিন্তু বিশেষ পদ্ধতিতে তা আদায় করা শরী‘আত সম্মত নয়। তাই শরী‘আত সম্মত ইবাদত হয়েও পদ্ধতিগত সমস্যা থাকার কারণে সেটা বিদআত ও সুন্নাত পরিপন্থী হবে।

  •  শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘ইবাদত ও পরবর্তী দিনকে ছিয়ামের জন্য নির্ধারিত করা। অর্থাৎ শবেবরাত পালন করা।
  •    রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ছালাতুল রাগাইব আদায় করা।
পর্যালোচনা-২

সুধী পাঠক! এটা নিন্দনীয় বিদ‘আত ও আপেক্ষিক তথা স্থান, সময় ও পদ্ধতিগত বিদ‘আত। কেননা ছালাত, ছিয়াম প্রভৃতি ইবাদতগুলো মৌলিকভাবে শরী‘আতসম্মত। কিন্তু তা সময়, স্থান বা অবস্থার সাথে নির্দিষ্ট করার কারণে বিদ‘আত হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। কেননা উক্ত ইবাদতগুলো কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এভাবে বর্ণিত হয়নি।

এরূপ আরো কিছু উদাহারণ নিম্নে উল্লেখ করা হল-

  •  আযানের পরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর উচ্চৈঃস্বরে দরূদ পাঠ করা।
পর্যালোচনা-৩

সুধী পাঠক! আযানের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করা সুন্নাত।[৪] কিন্তু উচ্চৈঃস্বরে দরুদ পাঠ করা সুন্নাত নয়। এখানে আযানের পরে দরূদ পাঠের মৌলিক আমলটি নীরবে বা স্বরবে পাঠের পরিবর্তে উচ্চৈঃস্বরে পড়ায় তার মূল পদ্ধতিগত পরিবর্তন এসেছে। সুতরাং এটা বিদ‘আত হিসাবে গণ্য হয়েছে।

  •  জুমু‘আর খুত্ববাহ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে মসজিদের ভেতরে খত্বীবের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে আযান দেয়া।
পর্যালোচনা-৪

সুধী পাঠক! জুমু‘আর খুত্ববাহ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে আযান দেয়া সুন্নাত।[৫] কিন্তু মসজিদের ভেতরে খত্বীবের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে আযান দেয়া শরী‘আতসম্মত নয়। এখানে জুমু‘আর খুত্ববাহ দেয়ার পূর্বে আযান দেয়ার মৌলিক স্থানের পরিবর্তে খত্বীবের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে দেয়ায় তা স্থান ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন ঘটেছে। তাই এটা বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যা বিদ‘আতে ইযাফী বা আপেক্ষিক বিদ‘আত হিসাবে গণ্য।

  •  পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের পূর্বে ও পরে সর্বমোট ১২ রাক‘আত সুন্নাত ছালাত জামা‘আতবদ্ধভাবে আদায় করা।
পর্যালোচনা-৫

পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের পূর্বে ও পরে সর্বমোট ১২ রাক‘আত সুন্নাত ছালাত একাকী আদায় করা সুন্নাতসম্মত।[৬] যাকে সুনানুর রাওয়াতেব বলা হয়। কিন্তু উল্লেখিত ছালাতগুলো জামা‘আতবদ্ধভাবে আদায় করা সুন্নাহসম্মত নয়। এখানে সুন্নাতে রাতেবাহ একাকী আদায়ের মৌলিক পদ্ধতির পরিবর্তে জামা‘আতবদ্ধ আদায় করায় তা পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে। অতএব এরূপ কাজ করা অবশ্যই বিদ‘আত হিসাবে গণ্য হবে।

  •  ছালাতে রুকূ‘ এবং সিজদা অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত করা।
পর্যালোচনা-৬

সুধী পাঠক! কুরআন তেলাওয়াত একটি উত্তম ইবাদত, যার প্রতিটি হরফের বিনিময়ে দশটি করে নেকী হয়।[৭] কিন্তু ছালাতে রুকূ‘ এবং সিজদা অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত করা শরী‘আতসম্মত নয়। বরং এরূপ কাজ করতে শরী‘আতে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং উক্ত সময়ে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে কুরআন তেলাওয়াতের স্থান ও সময়গত মৌলিক পদ্ধতির পরিবর্তন করা হয়েছে। যা বিদ‘আতে ইযাফীর অন্তর্ভুক্ত।

  •  মৃত ব্যক্তির জন্য শোক পালনের নামে দাঁড়িয়ে এক বা দু’মিনিট নীরবতা পালন করা অথবা কিছু সংখ্যক মানুষ মৃতের বাড়িতে একত্রিত হয়ে সকলে মিলে শোক পালন করা।
পর্যালোচনা-৭

সুধী পাঠক! মৃত ব্যক্তির জন্য শোক পালন করা শরী‘আত সম্মত।[৮] কিন্তু শোক পালনের নামে দাঁড়িয়ে এক বা দু’মিনিট নীরবতা পালন করা অথবা কিছু সংখ্যক মানুষ মৃতের বাড়িতে একত্রিত হয়ে সকলে মিলে শোক পালন করা সুন্নাত পরিপন্থী। একারণেই মৌলিক পদ্ধতিগত পরিবর্তন সাধিত হওয়ার কারণে তা বিদ‘আত হিসাবে গণ্য হবে।

অতএব মূল কথা হল- এসব আমল মৌলিক দিক বিবেচনায় শরী‘আত সম্মত, তবে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে বিদ‘আত হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের কষ্টার্জিত আমল যাতে করে বিনষ্ট না হয়ে যায়, সেদিকে প্রত্যেক মুসলিমকে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

খ. কর্মগত এবং বর্জনগত দিক থেকে বিদ‘আত : এই প্রকার বিদ‘আত দুই প্রকার। যথা :

১. কর্মগত বিদ‘আত (البدعة الفعلية) : ইসলামী শরী‘আত যে সকল কর্মকে সমর্থন করে না অথচ মানুষ উক্ত কর্মসমূহের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়, তাকে কর্মগত বিদ‘আত বলে। মানুষ সবচেয়ে বেশি এই প্রকার বিদ‘আত করে থাকে। ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহতানী (রাহিমাহুল্লাহ)  (১৯৫২-২০১৮ খ্রি.) বলেন,

تدخل في تعريف البدعة فهي طريقة في الدين مخترعة تشبه الطريقة الشرعية يقصد بالسلوك عليها المبالغة في التعبد لله سبحانه

‘যা বিদ‘আতের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। এটা দ্বীনের মধ্যে নবাবিষ্কৃত ও শরী‘আতের সাথে সামঞ্জস্যশীল। এর দ্বারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ইবাদতে আধিক্য উদ্দেশ্য থাকে’।[৯] যেমন ছালাতে রাক‘আত বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।

আরো পরিষ্কার করে বলা যায় যে, কর্মগত বিদ‘আত হল- দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু প্রবেশ করা যা দ্বীনের মধ্যে নেই এবং এমন পদ্ধতিতে ইবাদত করা, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কর্তৃক বিধিবদ্ধ নয়। এছাড়া ইবাদতের জন্য এমন সময় নির্ধারণ করা যা শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত নয়।[১০] যেমন শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রি জাগরণ করা, ইবাদত বন্দেগী করা ও পরবর্তী দিনকে ছিয়ামের জন্য নির্ধারণ করা, ২৭ রজবের রাতে মি‘রাজের নিয়তে ইবাদত করা, ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা সহ বিভিন্ন দিবস পালন করা ইত্যাদি।

২. বর্জনগত বিদ‘আত (البدعة الةركية) : বিদ‘আত কখনো কোন কিছু পরিহার করার মাধ্যমে হয়, চাই তা নিজের উপর হারাম করে হোক বা না হোক। যেমন, শরী‘আত কর্তৃক হালাল বিষয়কে নিজের উপর হারাম করা অথবা ইচ্ছাপূর্বক কোন বস্তু বর্জন করা। তবে তা যদি শরী‘আত অনুমোদিত কোন বিষয়ে হয় তাহলে কোন ক্ষতি নেই। অনুরূপভাবে ক্ষতিকর বিষয় থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে সন্দেহজনক বিষয় বর্জন করাতেও কোন সমস্যা নেই। এতদ্ব্যতীত অন্য কোন কারণে যদি বর্জন করা হয়, তাহলে তা দ্বীন মনে করে বর্জন করা হবে অথবা অন্য কোন কারণে। সুতরাং যদি তা দ্বীন মনে করে না হয়, তাহলে বর্জনকারী উক্ত কাজটি নিজের উপর অহেতুক নিষিদ্ধকারী অথবা স্বেচ্ছায় পরিহারকার হিসাবে গণ্য হবে। এটাকে বিদ‘আত নামে অভিহিত করা যায় না। কেননা তা বিদ‘আতের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। তবে বর্জনকারী কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলা যা হালাল করেছেন তা হারাম মনে করার কারণে আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধাচারণকারী গণ্য হবে।

তবে যদি দ্বীন মনে করে কোন কিছু বর্জন করা হয়, তাহলে তা বিদ‘আত বলে গণ্য হবে। চাই সে বর্জিত বিষয় বৈধ হোক কিংবা আদিষ্ট, চাই তা ইবাদত, মু‘আমালাত তথা লেনদেন কিংবা অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন। এমনকি চাই তা কথা, কাজ বা বিশ্বাসগত বিষয়ের মাধ্যমে হোক না কেন। সুতরাং যখন পরিহার করাকে আল্লাহর ‘ইবাদত মনে করা হবে, তখন সে বিদ‘আতের অনুসারী হিসাবে পরিগণিত হবে।[১১] যেমন তিনজন ব্যক্তি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) এর নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইবাদতের কথা জানার পর তারা কতিপয় হালাল বিষয় নিজের উপর হারাম করে নেয়। একজন ব্যক্তি রাত্রিতে না ঘুমিয়ে রাতভর ছালাত আদায় করার প্রতিজ্ঞা করে। দ্বিতীয়জন সারা বছর ছিয়াম পালন করার এবং তা পরিত্যাগ না করার প্রতিজ্ঞা করে। আর তৃতীয়জন কখনো বিবাহ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। অতঃপর তাদের কথা শুনতে পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে,

أَنْتُمْ الَّذِيْنَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللهِ إِنِّيْ لَأَخْشَاكُمْ لِلهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ لَكِنِّيْ أَصُوْمُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّيْ وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ

‘তোমরা কি এমন এমন বলেছ? শুনে রাখ! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে অধিক ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে অধিক মুত্তাকী। তবে আমি ছিয়াম পালন করি আবার ছেড়েও দেই। রাত জেগে ছালাত আদায় করি আবার নিদ্রাও যাই তেমনি নারীদের বিবাহ করেছি। সুতরাং যে আমার সুন্নাতের প্রতি অনিহা প্রকাশ করে সে আমার দলভুক্ত নয়’।[১২] উক্ত হাদীছের فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ ‘সুতরাং যে আমার সুন্নাতের প্রতি অনিহা প্রকাশ করে সে আমার দলভুক্ত নয়’ অংশের ব্যাখ্যায় ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) (৭৭৩-৮৫২ হি./১৩৭২-১৪৪৯ খ্রি.) বলেন,

المراد بالسنة الطريقة لا التي تقابل الفرض والرغبة عن الشيء الأعراض عنه إلى غيره والمراد من ترك طريقتي وأخذ بطريقة غيري فليس مني

‘এখানে ‘সুন্নাত’ দ্বারা পথ বা আদর্শ বুঝানো হয়েছে। ফরয বুঝানো হয়নি। আর কোন জিনিসের প্রতি অনিহা থাকার অর্থ তা থেকে বিমুখ হয়ে অন্য কিছুর প্রতি আগ্রহী হওয়া। সুতরাং হাদীছের অর্থ হল, যে ব্যক্তি আমার আদর্শ থেকে বিমুখ হয়ে অন্য কোন আদর্শ গ্রহণ করল, সে আমার দলভুক্ত হবে না’।[১৩]

অতএব রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত কখনও কোন কাজ করার মাধ্যমে হতে পারে আবার কোন কিছু বর্জন করার মাধ্যমেও হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের উপর যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঐ সকল কাজের অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করেছেন, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। তেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের কাছে কামনা করেন যে, আমরা যেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বর্জন করেছেন তা বর্জন করার মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করি। সুতরাং তখন বর্জন করাটাই সুন্নাত। আবার তিনি যা করেছেন তা পালন করাটাই সুন্নাত। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা করেছেন তা বর্জন করার মাধ্যমে আমরা যেমন আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারব না; তেমনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বর্জন করেছেন সেগুলো পালন করার মাধ্যমেও আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারব না। সুতরাং বর্জিত বিষয়াবলী কর্মে পরিণতকারী কৃত বিষয়াবলী পরিহারকারীর ন্যায়। উভয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।[১৪]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. ইবরাহীম ইবনু মূসা ইবনু মুহাম্মাদ আল-লাখমী আল-গারনাত্বী আশ-শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম (সঊদী আরব : দারু ইবনি ‘আফ্ফান, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হি./১৯৯২ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬৭।
[২]. ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহতানী, ‘আক্বীদাতুল মুসলিম ফী যাউইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ (১ম সংস্করণ, ১৪২৯ হি./২০০৮ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৭২৩; আল-ই‘তিছাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১৭, ৩৩০-৪৪৫।
[৩]. ‘আক্বীদাতুল মুসলিম ফী যাউইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭২৩-৭২৪; আল-ই‘তিছাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬৭, ৪৪৫।
[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮৪, (ইফাবা হা/৭৩৩), ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭; মিশকাত, হা/৬৫৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬০৬, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৯।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৯১৫ ও ৯১৬, (ইফাবা হা/৮৬৯ ও ৮৭০, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৩)।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭২৮, (ইফাবা হা/১৫৬৪), ‘মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৫; তিরমিযী, হা/৪১৫; মিশকাত, হা/১১৫৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১০৯১, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৯০।          
[৭]. তিরমিযী, হা/২৯১০; মিশকাত, হা/২১৩৭; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩৩২৭; ছহীহুল জামে‘, হা/৬৪৬৯।          
[৮]. আবূ দাঊদ, হা/৪১৯২; নাসাঈ, হা/৫২২৭; মিশকাত, হা/৪৪৬৩, সনদ ছহীহ।
[৯]. ‘আক্বীদাতুল মুসলিম ফী যাউইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭২৫; আল-ই‘তিছাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫০-৫৬।
[১০]. আল-ই‘তিছাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬৭-৪৪৫; ড. সালিহ আস-সাহীমী, তাম্বীহু উলিল আবছার ইলা কামালিদ দ্বীন ওয়ামা ফিল বিদাঈ মিন আখত্বার, পৃ. ৯৯; সাঈদ আল-গামিদী, হাক্বীক্বাতুল বিদ‘আতি ওয়া আহকামিহা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৭; আল-‘আদাভী, উছূলুন ফিল বিদাঈ ওয়াস সুনান, পৃ. ৭০; আলী ইবনু হাসান আল-আছরী, ‘ইলমু উছূলিল বিদাঈ, পৃ. ১০৭।
[১১]. ‘আক্বীদাতুল মুসলিম ফী যাউইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭২৫-২৬; আল-ই‘তিছাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৭।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০১; নাসাঈ, হা/৩২১৭; মিশকাত, হা/১৪৫।
[১৩]. ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহিল বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ১৩৭৯ হি.), ৯ম খণ্ড, পৃ. ১০৫।
[১৪]. আল-ই‘তিছাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৭-৬০, ৪৭৯, ৪৮৫, ৪৯৮; জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী, আল-আমরু বিল ইত্তিবা‘ ওয়ান নাহিয়ু ‘আনিল ইবতিদা‘, পৃ. ২০৫; শায়খ মুহাম্মাদ আহমাদ আল-‘আদাভী, উছূলু ফিল বিদাঈ, পৃ. ৭০; সাঈদ ইবনু নাছির আল-গামিদী, হাক্বীক্বাতুল বিদ‘আতি ওয়া আহকামিহা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৭-৫৮; ড. ছালিহ আস-সাহীমী, তাম্বীহু উলিল আবছার ইলা কামালিদ দ্বীন ওয়ামা ফিল বিদাঈ মিন আখত্বার, পৃ. ৯৭; শায়খ আলী ইবনু হাসান আল-আছরী, ‘ইলমু উছূলিল বিদাঈ, পৃ. ১০৭; শায়খ আহমাদ ইবনু হাজার আলে বূত্বামী, তাহযীরুল মুসলিমীন ‘আনিল ইবতিদা‘ ওয়াল বিদাঈ ফিদ দ্বীন, পৃ. ৮৩।




আশূরায়ে মুহাররম : করণীয় ও বর্জনীয় - ইউনুস বিন আহসান
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
অল্পে তুষ্ট (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ফাযায়েলে কুরআন (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ক্যারিয়ার : শিক্ষক নিবন্ধনের প্রস্তুতির ধরন ও বিষয়াবলী - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৫ম কিস্তি)  - আব্দুল গাফফার মাদানী
ক্রোধের ভয়াবহতা ও তার শারঈ চিকিৎসা (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
সর্বশ্রেষ্ঠ আমল - হাফেয আবূ তাহের বিন মজিবুর রহমান

ফেসবুক পেজ