মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৪:২০ অপরাহ্ন

তাক্বওয়া অর্জনে ছিয়াম

– ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম* 


 ভূমিকা

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের মৌল ভিত্তি হচ্ছে- ঈমান, ছালাত, যাকাত, ছিয়াম ও হজ্জ। এ সকল মৌল ভিত্তির মধ্যে ছিয়াম হচ্ছে ইসলামের চতুর্থ রুকন এবং অন্যতম বুনিয়াদী ইবাদত। ইসলাম মানুষের জীবনে যেসব মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটাতে চায়, এর বুনিয়াদী ইবাদতগুলোই সে সব মূল্যবোধকে মানব জীবনে  দৃঢ়মূল করতে যথেষ্ট সাহায্য করে। ছিয়ামও এর ব্যতিক্রম নয়। ইবাদত হিসাবে ছিয়ামের স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। ছিয়াম মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলী অর্জনের এক অন্যতম প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। এটি আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি ও তাক্বওয়া অর্জনসহ মানবীয় উন্নতি সাধনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বিশেষ করে তাক্বওয়া অর্জনে ছিয়ামের ভূমিকা অনন্য।

ছিয়ামের মৌলিক উদ্দেশ্য তাক্বওয়া অর্জন

এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ  ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৩)। এখানে ছিয়াম পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে তাক্বওয়া অর্জন করা। তাই আমাদের প্রথমেই জানতে হবে তাক্বওয়ার পরিচয় ও গুরুত্ব।

তাক্বওয়া (تقوي)-এর অর্থ :

تقوي (তাক্বওয়া) শব্দটি আরবী। وقاية   (বিকায়াহ) হতে এর উৎপত্তি। অর্থ : অনিষ্টকর ও কষ্টদায়ক বস্তু হতে আত্মরক্ষা করা, দূরে থাকা, মুক্তি, নিষ্কৃতি, সতর্কতা ও ভয়ভীতি ইত্যাদি।[১] সাধারণ অর্থে আল্লাহভীতিকে ‘তাক্বওয়া’ বলা হয়। শারঈ অর্থে- আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর নির্র্দেশিত ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনা করা, জীবনের কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার হুকুম যেন লংঘিত না হয়, এরকম সতর্কতার সাথে চলার নামই তাক্বওয়া।[২]

কেউ কেউ বলেন, ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনে ইসলামী বিধানে নিষিদ্ধ সকল প্রকার বাক্য, কার্য ও চিন্তা পরিহার করে আখিরাতে পরিত্রাণ লাভের আশায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন করাকে ‘তাক্বওয়া’বলা হয়। তাত্ত্বিক অর্থে তাক্বওয়া বলা হয়, আল্লাহভীতি জনিত মানব মনের সেই অনুভূতিকে, যা তার জীবনের সকল ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলেন, যে সকল ভাব, প্রবৃত্তি অথবা কর্ম আধ্যাত্মিক অথবা পরজগতে ক্ষতিকর এবং যে সমস্ত কার্র্যকলাপ দৃশ্যত অবৈধ বলে মনে না হলেও পরিণতিতে মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে, সে সকল ভাব, প্রবৃত্তি ও কার্র্যকলাপ হতে নিজেকে রক্ষা করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করাকে তাক্বওয়া বলে। আর তাক্বওয়ার গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিকে ‘মুত্তাক্বী’ বলা হয়।[৩]

إِنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ سَأَلَ أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ عَنِ التَّقْوَى فَقَالَ لَهُ أَمَا سَلَكْتَ طَرِيْقًا ذَا شَوْكٍ؟ قَالَ بَلَى قَالَ فَمَا عَمِلْتَ؟ قَالَ شَمَّرْتُ وَاجْتَهَدْتُ قَالَ فَذَلِكَ التَّقْوَى

একবার ওমর (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর নিকট তাক্বওয়ার ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কি কখনও এমন পথ অতিক্রম করেছেন, যেটি খুবই সংকীর্ণ কাঁটাপূর্ণ? তদুত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। উবাই ইবন কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) তখন বললেন, এমতাবস্থায় আপনি কিভাবে পথ অতিক্রম করেছেন? জবাবে ওমর (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন, খুবই সতর্কতার সাথে কাপড় ও শরীর বাঁচিয়ে সে পথ অতিক্রম করেছি। উবাই ইবন কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন, এটাই ‘তাক্বওয়া’।[৪]

তাক্বওয়ার গুরুত্ব

মানুষের ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনে ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন সম্পূর্ণরূপে তাক্বওয়ার উপর নির্ভরশীল। তাক্বওয়া ব্যতীত কোন ব্যক্তির পক্ষে ইহজগতে সৎ ও কল্যাণকর কার্য সম্পাদন করা ও পরজগতে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ মানব মন সর্বক্ষণ অসৎ ও অনিষ্টকর কার্যাদি সম্পাদন করতে প্রলুব্ধ করে এবং আল্লাহদ্রোহীতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, اِنَّ  النَّفۡسَ لَاَمَّارَۃٌۢ بِالسُّوۡٓءِ  ‘নিশ্চয় মানব মন সর্বদা অনিষ্টকর কাজ করার জন্য নির্দেশ দেয়’ (সূরা ইউসুফ : ৫৩)। আর এই নফসকে উদ্ধত আচরণ হতে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাক্বওয়া। অর্থাৎ তাক্বওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে মানবজাতি নফসকে সংযত করে যাবতীয় মানবিক গুণে গুণান্বিত হতে পারে।

তাক্বওয়া অর্জনে ছিয়ামের ভূমিকা

তাক্বওয়া অর্জনে ছিয়াম সাধনার ভূমিকা অনন্য। ছিয়াম পালনের উদ্দেশ্য শুধু না খেয়ে কষ্ট পাওয়া নয়, বরং এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের মাঝে ‘তাক্বওয়ার’ গুণ সৃষ্টি করা। যারা তাক্বওয়ার গুণে গুণান্বিত হতে চায়, তাদের মধ্যে কতিপয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ  مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ  یُنۡفِقُوۡنَ-  وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ  اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ

‘যারা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, ছালাত কায়েম করে এবং আল্লাহর দেয়া রিযিক হতে ব্যয় করে। যারা শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং পূর্ববর্তী নবীদের উপর নাযিলকৃত হেদায়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩-৪)।

সুধী পাঠক! তাক্বওয়া অবলম্বনকারীদের গুণাবলী আরো বর্ণিত হয়েছে। যেমন- (১) আল্লাহ, আখিরাত, ফেরেশতা, কিতাব, নবী-রাসূলদের প্রতি ঈমানের যথাযথ ঘোষণা দান (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৮৫), (২) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিকটাত্মীয়, গরীব-দুঃখীদের  মাঝে অকাতরে অর্থদান,  (৩)  ছালাত কায়েম করা  ও  যাকাত দেয়া , (৪) ওয়াদা পূর্ণ করা এবং (৫) ছবর বা ধৈর্যধারণ করা। এছাড়া যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে চায়, তাদের মধ্যে আরও কতিপয় গুণ থাকা বিশেষ প্রয়োজন। সেগুলো হল- ঈমানের দৃঢ়তা, ঐকান্তিকতা, আত্মসংযম, ছবর, সহানুভূতি ও  ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, আমানতদারী, পাপ ও প্রদর্শনেচ্ছা থেকে বিরত থাকা এবং আখলাক্বে ইলাহী গঠন প্রভৃতি। সর্বাবস্থায় যারা এগুলোর অধিকারী তারাই মূলত ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী এবং তাক্বওয়ার অধিকারী। তাই ছিয়াম পালনের সাথে সাথে মুমিনদেরকে উপরোল্লেখিত গুণাবলী অর্জনে সদা তৎপর  থাকতে  হবে। তাহলেই ছিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য সফল হবে।

(১) লৌকিকতা মুক্ত

ইসলামে যে সব ইবাদত রয়েছে তার মধ্যে ছিয়াম সাধনা সম্পূর্ণরূপে লৌকিকতা মুক্ত। অন্য যে কোন শারীরিক ইবাদত যথা ছালাত, হজ্জ ইত্যাদি লৌকিকতা রক্ষার খাতিরেও  আমরা অনেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে থাকি, কিন্তু ছিয়ামের ব্যাপার সম্পূর্ণটাই স্বতন্ত্র। যার আচার অন্য লোকের দেখার কথা নয়, শুধু আল্লাহ তা‘আলার ভয়ই মুমিনকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখে। দুনিয়ার সকল লোককে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হলেও আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে এবং তাকে ফাঁকি দেয়া কোন রকম সম্ভব হবে না। এ বিশ্বাস তাকে তারই নির্দেশিত পথে চলতে বাধ্য করে। ছিয়ামের মাধ্যমে অর্জিত তাক্বওয়ার গুণের প্রভাব মুমিনের গোটা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যার ফলে সে কখনও অন্যায় কাজ করতে পারে না। সর্বদা অদৃশ্য এক শক্তির ভয় তাকে অন্যায়-অবিচারের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে এবং ন্যায় ও সত্য পথে পরিচালিত করে। এ ধরনের গুণ বিশিষ্ট লোকের হাতে যদি সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব আসে, তবেই সে সমাজে পূর্ণ নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।[৫]

(২) আত্মসংযমের শিক্ষা

মানুষের মধ্যে যেরূপ মালাকুতি বৈশিষ্ট্য বা ফেরেশতা স্বভাব থাকে, তদ্রুপ তার মধ্যে পাশবিক এবং ইবলীসী স্বভাবও থাকে। এ স্বভাব তাকে স্বেচ্ছাচারিতার পথে পরিচালিত ও সংযমহীন করে গড়ে তোলে। এর ফলেই সমাজে নানা দ্বন্দ্ব, ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়। কেননা এক শ্রেণীর অসংযমী-উচ্ছৃঙ্খল লোক অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে এবং সীমালংঘন করে। অতএব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের স্বীয় উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তিকে সংযমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা বিশেষ প্রয়োজন। ছিয়াম মানুষকে এ সংযম শিক্ষা দেয়।

(৩) আন্তরিকতা

রামাযানের ছিয়াম সাধনা ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহর হুকুম পালনে এবং ইসলাম অনুশীলনে আন্তরিকতা সৃষ্টি করে। আন্তরিকতা বিহীন ইবাদত ইসলামে অন্তঃসারশূন্য এবং মূল্যহীন। এসম্পর্কে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلَّا الْجُوْعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلَّا السَّهَرُ

আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, এমন অনেক ছিয়াম পালনকারী আছে, যাদের ছিয়াম দ্বারা শুধু পিপাসাই লাভ হয়। আর কিছু এমন ছালাত আদায়কারী আছে, যাদের রাত জেগে ছালাত আদায় করা দ্বারা শুধু রাত জাগরণই হয়।[৬]

এ হাদীছ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, শুধু ক্ষুধার্ত আর পিপাসায় কাতর থাকাটাই ইবাদত নয়, বরং আল্লাহর ভয়ে আল্লাহ্র আইন ভঙ্গ না করা, যে কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় আল্লাহকে ভালবেসে সেসব কাজ ঐকান্তিকতার সাথে করার নামই ইবাদত। অতএব ছিয়াম পালনকারীর উচিত বেশী বেশী নেক কাজ করা।

(৪) ছবর

সাধারণত মানুষের চিত্ত থাকে চঞ্চল। সে সব সময় লোভনীয় জিনিস পাওয়ার জন্য অস্থির থাকে। তার এ চাহিদা পূরণে সে বৈধ-অবৈধ, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য পর্যন্ত ভুলে যায়। সে জন্য চিত্তের চাহিদা পূরণের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। একমাত্র ছবর বা ধৈর্যের শিক্ষার মাধ্যমেই তা সম্ভব। ছিয়াম সাধনার মাধ্যমে এ ছবরের শিক্ষা লাভ করা যায়।

(৫) সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ব

যে কখনও অভুক্ত থাকেনি, সে কিরূপে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির জ্বালা বুঝবে? যে কখনও রোগাক্রান্ত হয়নি, সে রোগীর দুঃখ-জ্বালা কী করে বুঝবে? সুদীর্ঘ এক মাসের ছিয়াম সাধনা ধনী-গরীব নির্র্র্র্র্বিশেষে পানাহার ও ইন্দ্রিয় বাসনা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে সকলকেই এ উপলব্ধি করতে শিখায় যে, ক্ষুৎপিপাসার জ্বালা কী? তাই ছিয়ামের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে এমন সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের সৃষ্টি করা হয় যে, যার নযীর বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। ইয়ারমুকের যুদ্ধে আহত মুসলিম সৈন্যদের পানি পান করানোর এবং মৃত্যুর সময়ও ভাইয়ের জন্য ত্যাগের নযীর পৃথিবীর অন্য কোন জাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে কী? প্রত্যহ ইফতারের সময় একই প্লেটে বসে ইফতার গ্রহণের চেয়ে বড় সাম্যের শিক্ষা আর কী হতে পারে? [৭]

(৬) পাপ থেকে বিরত থাকা

পাপ প্রবণতা বা নিষিদ্ধ কাজের প্রতি মানুষের আসক্তি এক সহজাত ব্যাপার। আল্লাহভীতির মাধ্যমে ছিয়াম সাধনা মানুষকে এ পাপ থেকে বিরত থাকতে শিক্ষা দেয়। কেননা ছিয়াম পালনরত অবস্থায় অন্যায় করলে সে ছিয়াম পালনের কোন মূল্য নেই। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّوْرِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ فِىْ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ

আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ছিয়াম পালন অবস্থায় মিথ্যা কথা ও বর্জনীয় কাজ থেকে নিজেকে বিরত থাকতে সক্ষম হবে না, তার পানাহার ত্যাগ করার আল্লাহর নিকট কোন প্রয়োজন নেই।[৮] ছিয়াম পালনকারী কখনও অযথা ও বেহুদা কথা বলবে না এবং চিৎকার ও খেল-তামাশায় লিপ্ত হবে না। এ সম্পর্কে  হাদীছে  বর্ণিত  হয়েছে, আবু হুরায়রা(রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِى وَأَنَا أَجْزِى بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّى امْرُؤٌ صَائِمٌ

‘আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার জন্য কিন্তু ছিয়াম শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দিব। ছিয়াম ঢালস্বরূপ, যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই-ঝগড়া করতে চায়, তবে সে তাকে বলবে, আমি ছায়েম তথা ছিয়ামপালনকারী’।[৯]

(৭) শারীরিক ও আত্মিক উন্নতি

আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) ছিয়ামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, ছিয়ামের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক অভ্যাস থেকে মুক্ত করা এবং জৈবিক চাহিদাসমূহের মধ্যে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠিত করা। ছিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে, চিরন্তন জীবনের অনন্ত সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে। পশুত্ব নিস্তেজ হয়ে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। দারিদ্র পীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করে। ছিয়াম মানুষের শারীরিক ও আত্মিক শক্তির উন্নতি সাধন করে। পাশবিক চাহিদার প্রাবল্য, যা মানুষের স্বাস্থ্য ধ্বংস করে তা থেকে মুক্তি দান করে। ক্বলবের ইছলাহ ও চরিত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে ছিয়াম কার্যকর ভূমিকা পালন করে।[১০]

(৮) রিয়ামুক্ত মনোবৃত্তি গঠন

সকল ইবাদতের মধ্যে রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছার সুযোগ থাকে, কিন্তু ছিয়াম সাধনাই হচ্ছে একমাত্র রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা মুক্ত ইবাদত। একারণে হাদীছে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اللهُ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلَّا الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِىْ وَأَنَا أَجْزِى بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ

আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার জন্য কিন্তু ছিয়াম শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দিব। ছিয়াম ঢালস্বরূপ।[১১] ছালাত, যাকাত, হজ্জ প্রভৃতি সকল ইবাদত মানুষ দেখতে পায় কিন্তু একমাত্র ছিয়াম, যা ছিয়াম পালনকারী এবং  আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কারোর জানার উপায় নেই। সুতরাং ছিয়াম হচ্ছে রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা মুক্ত ইবাদত, যা শুধু আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশেই সম্পাদিত হয়ে থাকে।

আল-কুরআন ও ছিয়াম

আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন রামাযান মাসেই যে ছিয়াম ফরয করেছেন এবং রামাযান মাসের সাথেই যে ছিয়ামকে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করে দিয়েছেন এর একটা বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে বারটি মাসের মধ্যেই রামাযানই একমাত্র মাস, যে মাসে আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। বস্তুত ছিয়াম ও আল-কুরআনের মধ্যে গভীরতম সম্পর্ক বিদ্যমান। মহান আল্লাহ বলেন,

شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ  فَمَنۡ شَہِدَ مِنۡکُمُ الشَّہۡرَ فَلۡیَصُمۡہُ

‘রামাযান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা (কুরআন) মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক, হেদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং (ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে) পার্থক্যকারী (কষ্টিপাথর)। সুতরাং যে এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে, তাকেই ছিয়াম পালন করতে হবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)।

এ আয়াতের মাধ্যমে এটা বুঝা যায় যে, আসলে ছিয়ামের হুকুম এজন্য হয়েছে যে, এ মাসে আল-কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। বস্তুত মানুষের জন্য আল্লাহ তা‘আলার দেয়া রহমত ও নে‘মতের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হল কুরআনুল কারীম। আর ছিয়ামের তাৎপর্য হল এখানেই যে, এ মাসেই কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ হওয়া আরম্ভ করে। আল-কুরআন ও ছিয়ামের এ গভীর সম্পর্কের কারণে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযান মাসে আল-কুরআন তিলাওয়াতে বিশেষভাবে যত্নবান হতেন। এ সম্পর্কে হদীছে বর্ণিত হয়েছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُوْنُ فِىْ رَمَضَانَ حِيْنَ يَلْقَاهُ جِبْرِيْلُ وَكَانَ يَلْقَاهُ فِىْ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ

ইবন আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক উদার, মহৎ ও দানশীল ছিলেন; কিন্তু রামাযান মাসে যখন জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসতেন, তখন তাঁর উদারতা ও দানশীলতার মাত্রা অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে যেত। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রামাযানের প্রত্যেক রাতেই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কুরআন মাজীদের  দাওর (পুনরালোচনা) করতেন।[১২]

তাইতো কুরআন মাজীদের সাথে এ মাসটির (রামাযান মাস) গভীর সামঞ্জস্য রয়েছে। আর এ সামঞ্জস্যের কারণেই আল্লাহ তা‘আলা এ মাসেই  কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। এ মাসটি যাবতীয় মঙ্গল ও কল্যাণের সমষ্টি। এ মাসে মানসিক স্থিরতা লাভ করতে পারলে তা সমস্ত বছরের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘যখন রামাযান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়’।[১৩]

উপসংহার

ইসলামের প্রত্যেকটি ইবাদত শুধু ব্যক্তি জীবনের উন্নতির জন্যই নয়, বরং সেগুলোর মাধ্যমে যে শিক্ষা ও ট্রেনিং লাভ হয়, তা যেন গোটা সমাজের উপরই প্রভাব বিস্তার করে। গোটা মানব সমাজে যেন এর দ্বারা পরিবর্তন সূচিত হয়। এটিই এর লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাহলে ইবাদতকারী নিজে যেমন উপকৃত হবে, তেমনি বহু ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত সমাজ একটি আদর্শ, শান্তি ও কল্যাণের সমাজ রূপে গড়ে উঠবে; যার মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং পরকালে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে। ছিয়ামের উপরিউক্ত শিক্ষার বাস্তব রূপ যদি আমাদের জীবনে ফুটে ওঠে, তবেই ছিয়াম পালনের উদ্দেশ্য তাক্বওয়া অর্জন করা সম্ভব হবে। ইনশাআল্লাহ।


*  প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. ইবন মানযূর, লিসানুল আরব, ১ম খণ্ড (কায়রো : দারুল হাদীছ, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৬১৫।
[২]. অধ্যাপক মাওলানা এ.কিউ.এম. ছিফাতুল্লাহ, সিয়ামে রমযান ও তাক্ওয়া (অগ্রপথিক সংকলন-৩, সিয়াম ও রমযান, মুহাম্মদ আবূ তাহের সিদ্দিকী সম্পাদিত, ই.ফা.বা. ২০১২ খ্রি.), পৃ. ৫৬ ।
[৩]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫।
[৪]. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড (দারু তাইয়েবা, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), পৃ. ১৬৪।
[৫]. অধ্যাপক এ.এম. মোহাম্মদ মোসলেম, সিয়ামের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব, সিয়াম ও রমযান (সংকলন), প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৬।
[৬]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬৯০; ছহীহুল জামে‘, হা/৩৪৮৮, সনদ ছহীহ।
[৭]. অধ্যাপক এ.এম. মোহাম্মদ মোসলেম, সিয়ামের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব, সিয়াম ও রমযান (সংকলন), পৃ. ৫৭-৫৮।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৩ ও ৬০৫৭; আবূ দাঊদ, হা/২৩৬২; তিরমিযী, হা/৭০৭; মিশকাত, হা/১৯৯৯।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৬৭৯।
[১০]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, ৪র্থ খণ্ড (দিমাশ্ক : মাওকাউল ইসলাম, তা.বি.), পৃ. ২২।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৬৭৯।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬ ও ৩২২০; নাসাঈ,  হা/২০৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬১৬।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৭৭; নাসাঈ, হা/২০৯৮।




মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
হাদীছ বর্ণনায় আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অবদান - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
আশূরায়ে মুহাররম - ছাদীক মাহমূদ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মুছীবতে ধৈর্যধারণ করার ফযীলত - শায়খ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম
বিদ‘আত পরিচিতি (২৫ তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবূ সাঈদ
রামাযান মাসে প্রচলিত বিদ‘আত সমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (৮ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ক্যারিয়ার : শিক্ষক নিবন্ধনের প্রস্তুতির ধরন ও বিষয়াবলী - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ

ফেসবুক পেজ