বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৬ অপরাহ্ন

ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ

- ড. মেসবাহুল ইসলাম বিন মাহতাবুদ্দীন*


(৩য় কিস্তি)

ইসলামের যুব প্রচারকের বৈশিষ্ট্যাবলী

প্রত্যেক যুব প্রচারকের দায়িত্ব হল তার জ্ঞান ও কৌশল অনুযায়ী সাধ্যমত মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে কোনভাবেই তাড়াহুড়া না করা। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসেছেন তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাদের দায়িত্ব হল দাওয়াতী কাজ করা, রিসালাতের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানো, মানুষকে জানানো, সংশোধনের চেষ্টা করা। ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির ন্যায় তাড়াহুড়া মোটেই করা যাবে না। মহান আল্লাহ নবী-রাসূলদের ধৈর্যধারণ করতে এবং তাড়াহুড়া না করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, فَاصۡبِرۡ کَمَا صَبَرَ اُولُوا الۡعَزۡمِ مِنَ الرُّسُلِ وَ لَا تَسۡتَعۡجِلۡ  لَّہُمۡ ‘অতএব আপনি ছবর করুন, যেমন উচ্চ সাহসী নবীগণ ছবর করেছেন। আর তাদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবেন না’ (সূরা আল-আহক্বাফ : ৩৫)। হেদায়াত কে পাবে আর কে পাবে না, হক্ব মেনে নিলে কার মাধ্যমে ইসলামের উপকার হবে আর কার কারণে ইসলামের ক্ষতি হবে এটা কেবল আল্লাহর হাতে। সুতরাং এই মানসিকতা মোটেই রাখা যাবে না যে, অমুক ব্যক্তি দাওয়াত গ্রহণ করলে ইসলামের বেশি উপকার হত, অমুক নেতা হক্ব মেনে নিলে দাওয়াতী কাজে সুবিধা পাওয়া যেত। তাই তার কাছে বার বার যাওয়া এবং তাকেই বেশি মূল্যায়ন করা। মহান আল্লাহ এমন কাজ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, اِنَّکَ لَا تَہۡدِیۡ مَنۡ  اَحۡبَبۡتَ وَ لٰکِنَّ اللّٰہَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُہۡتَدِیۡنَ ‘আপনি যাকে পসন্দ করেন, তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫৬)। নিম্নে যুব প্রচারকের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:

(১) হিকমত অবলম্বন করা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اُدۡعُ  اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ بِالۡحِکۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ  الۡحَسَنَۃِ ‘আপনি মানুষকে হিকমত ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিন’ (সূরা আন-নাহল: ১২৫)।

(২) নম্র ও বিনয়ীভাবে কথা বলা

আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আলাইহিস সালাম) ও হারূন (আলাইহিস সালাম)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন,

اِذۡہَبَاۤ  اِلٰی  فِرۡعَوۡنَ  اِنَّہٗ  طَغٰی -فَقُوۡلَا لَہٗ  قَوۡلًا لَّیِّنًا لَّعَلَّہٗ  یَتَذَکَّرُ اَوۡ یَخۡشٰی ‘তোমরা দু’ভাই ফেরআউনের নিকট যাও, নিশ্চয় সে সীমালংঘন করেছে। তোমরা খুব বিনয়ী হয়ে নম্রভাবে তকে দাওয়াত দাও, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে’ (সূরা ত্বো-হা: ৪৩-৪৪)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ ۚ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ۪ فَاعۡفُ عَنۡہُمۡ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ وَ شَاوِرۡہُمۡ فِی الۡاَمۡرِ ۚ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُتَوَکِّلِیۡنَ

‘আল্লাহর অসীম দয়া যে, আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় এবং নম্র স্বভাবের হয়েছেন। যদি আপনি তাদের প্রতি রূঢ় ও কঠোর স্বভাবের হতেন তাহলে তারা আপনার নিকট হতে সরে যেত। সুতরাং আপনি তাদের ক্ষমা করুন এবং তাদের জন্য (আল্লাহর নিকট) ক্ষমা প্রার্থনা করুন; প্রয়োজনে তাদের সাথে পরামর্শ করুন এবং যখন কোন কজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীকে ভালোবাসেন’ (সূরা আলে ‘ইমরান: ১৫৯)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ إِنَّ اللهَ تَعَالَى رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَ يُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَالاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা নম্র স্বভাবের অধিকারী, তিনি নম্র স্বভাব ভালোবাসেন। তিনি নম্র স্বভাবের উপর যত অনুগ্রহ করেন, কঠোর স্বভাবের উপর তত অনুগ্রহ করেন না’।[১]

عَنْ جَرِيْرِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ اللهِ ﷺ مَنْ يُحْرَمُ الرِّفْقَ يُحْرَمُ الْخَيْرَ

জারীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যাকে নম্র স্বভাব হতে বঞ্চিত রাখা হয়, তাকে কল্যাণ হতে বঞ্চিত রাখা হয়’।[২]

(৩) উত্তম পন্থায় জওয়াব দেয়া

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِدۡفَعۡ  بِالَّتِیۡ  ہِیَ  اَحۡسَنُ فَاِذَا الَّذِیۡ بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَہٗ  عَدَاوَۃٌ کَاَنَّہٗ  وَلِیٌّ حَمِیۡمٌ ‘আপনি উত্তম পন্থ’ায় জওয়াব দিয়ে মন্দকে প্রতিহত করুন, দেখবেন যে ব্যক্তির সাথে আপনার শত্রুতা রয়েছে সেও যেন আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছে’ (সূরা হা মীম আস-সাজদাহ : ৩৪)। এখানে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ﷺ)-কে উত্তম পন্থ’ায় প্রত্যুত্তর করতে উপদেশ দিয়েছেন। যার ফলে চরম শত্রুও অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হবে।  আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَ لَا تُجَادِلُوۡۤا اَہۡلَ الۡکِتٰبِ اِلَّا بِالَّتِیۡ ہِیَ  اَحۡسَنُ ‘আহলে কিতাবদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করার সময় উত্তম পন্থা অবলম্বন করবে। তবে যারা যুলম-অত্যাচার করে, তাদের সাথে নয়’ (সূরা আল-‘আনকাবূত : ৪৬)। মহান আল্লাহ বলেন, وَ جَادِلۡہُمۡ بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ  ‘আপনি তাদের প্রত্যুত্তর উত্তম পন্থ’ায় দিন’ (সূরা আন-নাহল : ১২৫)।

(৪) দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি না করা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَاۤ اِکۡرَاہَ فِی الدِّیۡنِ ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই (সূরা আল-বাকারাহ : ২৫৬)।  তিনি আরো বলেন,

فَذَکِّرۡ ۟ؕ  اِنَّمَاۤ  اَنۡتَ مُذَکِّرٌ- لَسۡتَ عَلَیۡہِمۡ  بِمُصَۜیۡطِرٍ

‘আপনি উপদেশ দিন, আপনি উপদেশদাতা মাত্র। আপনি তাদের শাসক বা দারোগা নন’ (সূরা আল-গাশিয়াহ: ২১-২২)। অন্যত্র তিনি বলেন, فَذَکِّرۡ  اِنۡ  نَّفَعَتِ الذِّکۡرٰی ‘আপনি উপদেশ দান করুন, যদি উপদেশ ফলপ্রসূ হয় (সূরা আল-আ‘লা : ৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, ذَکِّرۡ فَاِنَّ  الذِّکۡرٰی تَنۡفَعُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ  وَّ  ‘আপনি উপদেশ দান করুন, নিশ্চয় উপদেশ মুমিনকে উপকৃত করে’ (সূরা আয-যারিয়াত : ৫৫)।

(৫) সর্বদা দাওয়াতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা

দাওয়াত দেয়া প্রতিটি মানুষের জন্য যরূরী। দাওয়াত দানের কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অবিরাম দাওয়াতের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর দাওয়াত সর্বাবস্থায় চলত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قَالَ  رَبِّ  اِنِّیۡ  دَعَوۡتُ قَوۡمِیۡ لَیۡلًا وَّ نَہَارًا ۙ... ثُمَّ   اِنِّیۡ  دَعَوۡتُہُمۡ  جِہَارًا-  ثُمَّ  اِنِّیۡۤ  اَعۡلَنۡتُ لَہُمۡ وَ اَسۡرَرۡتُ لَہُمۡ اِسۡرَارًا

‘(নূহ (আলাইহিস সালাম) বলেন) হে আমার পালনকর্তা! আমি আমার জাতিকে দিবা-রাত্রি দাওয়াত দিয়েছি। ... অতঃপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়েছি, তারপর আমি তাদেরকে ঘোষণা সহকারে দাওয়াত দিয়েছি এবং গোপনে গোপনেও দাওয়াত দিয়েছি’ (সূরা আন-নূহ : ৫, ৮-৯)। দাঈ যখনই সময় পাবেন তখনই দাওয়াত দিবেন প্রকাশ্যে-গোপনে, ব্যক্তিগতভাবে-সমষ্টিগতভাবে এবং রাতে ও দিনে। সর্বাবস্থায়ই দাওয়াত দান যরূরী। দাঈর কাজ হচ্ছে শুধু দাওয়াত দেয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَا عَلَی الرَّسُوۡلِ  اِلَّا الۡبَلٰغُ  الۡمُبِیۡنُ ‘রাসূলের কাজ হচ্ছে সুস্পষ্টভাবে দাওয়াত পৌঁছে দেয়া’ (সূরা আল-‘আনকাবূত : ১৮)।

(৬)  কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর মাধ্যমে দাওয়াত দেয়া

দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করতে হবে কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنۡ  اَتَّبِعُ اِلَّا مَا یُوۡحٰۤی اِلَیَّ ۚ اِنِّیۡۤ  اَخَافُ اِنۡ عَصَیۡتُ رَبِّیۡ  عَذَابَ  یَوۡمٍ  عَظِیۡمٍ ‘আমি (মুহাম্মাদ) আমার উপর যা ‘অহি’ অবতীর্ণ হয় তারই অনুসরণ করি। যদি আমি আমার প্রতিপালকের নাফরমানী করি তাহলে ক্বিয়ামতের কঠিন শাস্তি  ভয় করি’ (সূরা ইউনুস : ১৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ  الۡہَوٰی -  اِنۡ  ہُوَ   اِلَّا  وَحۡیٌ   یُّوۡحٰی

‘তিনি (মুহাম্মাদ) নিজের পক্ষ থেকে মনগড়া কিছুই বলেন না, তার নিকট যা অহি অবতীর্ণ হয় তাই বলেন’ (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)।

(৭) মুখলিছ বা একনিষ্ট হওয়া 

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَاۤ  اُمِرُوۡۤا  اِلَّا لِیَعۡبُدُوا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ  الدِّیۡنَ ۬ۙ حُنَفَآءَ ‘তাদেরকে নিদের্শ দেয়া হয়েছে তারা যেন একাগ্রচিত্তে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করে’ (সূরা আল-বাইয়্যিনাহ : ৫)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ  اِنَّ صَلَاتِیۡ  وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ   لِلّٰہِ   رَبِّ  الۡعٰلَمِیۡنَ ‘হে নবী! আপনি বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৬২)। এ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ أخْلِصُ أَعْمَلَكُمْ فَإِنَّ اللهَ تَبَارَكَ وَ تَعَالَى لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْأَعْمَالِ إِلاَّ مَا خُلِّصَ لَهُ

‘হে মানব জাতি! তোমরা একনিষ্ঠভাবে আমল কর, নিশ্চয়ই আল্লাহতা‘আলা একনিষ্ঠ আমল ছাড়া কোন আমল কবুল করেন না’।[৩]

(৮) নিয়ত পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ করা

রাসূল (ﷺ) বলেন, إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى ‘আমল সমূহ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। নিশ্চয় মানুষ যা নিয়ত করে তাই প্রতিফলিত হয়’।[৪]

(৯) জ্ঞানার্জন করা

দাওয়াত দেয়ার পূর্বে কুরআন-হাদীছের জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক দাঈর জন্য প্রয়োজন। অন্যথা সে সঠিকভাবে প্রচার-প্রসার করতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ ‘পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা আল-‘আলাক : ১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَاعۡلَمۡ  اَنَّہٗ  لَاۤ اِلٰہَ  اِلَّا اللّٰہُ  وَ اسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۡۢبِکَ ‘আপনি এই জ্ঞানার্জন করুন যে, আল্লাহব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই এবং আপনি আপনার পাপের জন্য ক্ষমা চান’ (সূরা মুহাম্মাদ : ১৭)। ইমাম বুখারী (ﷺ) বলেন, أَلْعِلْمُ قَبْلَ الْقَوْلِ والْعمَلِ  ‘কথা ও কর্মের পূর্বে ইলম’।[৫]

(১০) ধৈর্যশীল হওয়া

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ  ‘আর যারা পরস্পরে ধৈর্যধারণ করার উপদেশ দেয়’ (সূরা আল-‘আসর : ৩)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَ اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ  ‘তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৪৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَ اصۡبِرۡ عَلٰی مَاۤ اَصَابَکَ ؕ اِنَّ  ذٰلِکَ مِنۡ عَزۡمِ  الۡاُمُوۡرِ ‘(লুক্বমান (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় পুত্রকে উপদেশ দেন) তুমি ধৈর্যধারণ কর, নিশ্চয় এ সাহসিকতাপূর্ণ কাজের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা লুক্বমান : ১৭)।

(১১) আল্লাহর উপর ভরসা রাখা

আল্লাহ বলেন, قُلۡ حَسۡبِیَ اللّٰہُ ؕ عَلَیۡہِ یَتَوَکَّلُ الۡمُتَوَکِّلُوۡنَ  ‘হে রাসূল! আপনি বলুন, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, ভরসাকারীরা তাঁর উপর ভরসা করে’ (সূরা আয-যুমার : ৩৮)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ  یَّتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ  فَہُوَ حَسۡبُہٗ ؕ اِنَّ اللّٰہَ  بَالِغُ  اَمۡرِہٖ ؕ قَدۡ جَعَلَ اللّٰہُ  لِکُلِّ شَیۡءٍ  قَدۡرًا ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটা পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন’ (সূরা আত্ব-ত্বালাক্ব: ৩)। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْ أمَّتِىْ سَبْعُوْنَ أَلْفًا بِغَيْرِ حِسَابٍ هُمُ الَّذِيْنَ لاَ يَسْتَرْقُوْنَ وَلاَ يَتَطَيَّرُوْنَ وَ عَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আমার উম্মতের সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে। যারা ঝাঁড়-ফুঁক গ্রহণ করে না, অশুভ লক্ষণে বিশ্বাস করে না এবং তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’।[৬]

(১২) দাওয়াত অনুযায়ী আমল করা

মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا  الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا  لِمَ  تَقُوۡلُوۡنَ مَا لَا  تَفۡعَلُوۡنَ- کَبُرَ  مَقۡتًا عِنۡدَ  اللّٰہِ  اَنۡ  تَقُوۡلُوۡا مَا  لَا تَفۡعَلُوۡنَ

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা এমন কথা বল না, যা তোমরা নিজেরাই কর না। তোমরা যা কর না তা বলা আল্লাহর নিকট কঠিন গোনাহের কাজ’ (সূরা আছ-ছফ্ফ : ২-৩)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَتَاۡمُرُوۡنَ النَّاسَ بِالۡبِرِّ وَ تَنۡسَوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ تَتۡلُوۡنَ الۡکِتٰبَ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ‘তোমরা কি মানুষকে সৎকাজের আদেশ কর, যা তোমরা নিজেরাই কর না। অথচ তোমরা কিতাব পাঠ করছ। তোমরা কি বুঝ না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৪৪)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أسَمَةَ بْنِ زَيْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يُجَاءُ يِالرَّجُلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُلْقِى فِي النَّارِ فَتَنْدَلِقُ أقْتَابُهُ فِيْ النَّارِ فَيُطْحَنُ فِيْهَا كَطَحَنِ الْحِمَارِ بِرَحَاهُ فَيَجْمَعُ أهْلُ النَّارِ عَلَيْهِ فَيَقُولُوْنَ أيْ فُلاَنُ مَا شَانُكَ ألَيْسَ كُنْتَ تَاْمُرُوْنَا بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَانَا عَنِ الْمُنْكَرِ قَالَ كُنْتُ آمُرَكُمْ بِالْمَعْرُفِ وَلاَآتِيْهِ وَأنْهَاكُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَآتِيْهِ

ওসামা ইবনু যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, এক ব্যক্তিকে ক্বিয়ামতের দিন নিয়ে আসা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এতে করে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে ঝুলতে থাকবে। আর সে তা নিয়ে ঘুরতে থাকবে যেমনিভাবে গাধা (আটা পেষা) জাঁতার সাথে ঘুরতে থাকে। জাহান্নামীরা তার নিকট একত্রিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবে, আপনি কি আমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ হতেনিষেধ করতেন না? সে বলবে, হ্যাঁ আমি তোমাদেরকে ভাল কাজ করতে আদেশ করতাম, কিন্তু নিজেই তা করতাম না। আর খারাপ কাজ হতে নিষেধ করতাম, কিন্তু আমি নিজেই তা করতাম’।[৭]

(১৩) হক্ব প্রকাশ করা এবং বাতিলের সাথে আপোস না করা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡتُمُوۡنَ مَاۤ  اَنۡزَلَ اللّٰہُ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ یَشۡتَرُوۡنَ بِہٖ ثَمَنًا قَلِیۡلًا  ۙ اُولٰٓئِکَ مَا یَاۡکُلُوۡنَ فِیۡ بُطُوۡنِہِمۡ  اِلَّا النَّارَ وَ لَا یُکَلِّمُہُمُ اللّٰہُ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ لَا  یُزَکِّیۡہِمۡ ۚۖ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ

‘যারা সেসব বিষয় গোপন করে যা আল্লাহ তা‘আলা কিতাবে নাযিল করেছেন, তারা অল্প মূল্যে কুরআন বিক্রি করে আগুন দ্বারা পেট পূর্ণ করে। আল্লাহ ক্বিয়ামাতের দিন তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (সূরা আল-বাকারাহ : ১৭৪)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَ لَا تَلۡبِسُوا الۡحَقَّ بِالۡبَاطِلِ وَ تَکۡتُمُوا الۡحَقَّ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ‘তোমরা হক্বের সাথে বাতিলের সংমিশ্রণ কর না, আর তোমরা জেনে শুনে হক্বকে গোপন কর না’ (সূরা আল-বাকারাহ : ৪২)।

(১৪) সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া

মহান আল্লাহ বলেন, لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ  فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ  اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মাঝে অনুসরণীয় আদর্শ’ (সূরা অল-আহযাব : ২১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَ  اِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ  ‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (সূরা আল-ক্বলাম : ৪)। উত্তম চরিত্র হচ্ছে মানুষের অমূল্য সম্পদ। উত্তম চরিত্র দিয়ে চরম শত্রুকেও ঘায়েল করা যায়। যা অর্থ-কড়ি দিয়ে সম্ভব নয়।

عَنِ النَّوَّاسِ بْنِ سَمْعَانَ قَالَ سَأَلْتُ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ عَنِ الْبِرِّ وَالْإثْمِ فَقَالَ الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ وَالْإِثْمُ مَا حَاكَ فِيْ صَدْرِكَ وَكَرَهْتَ أنْ يَّطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ

নাওয়াস ইবনু সাম‘আন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে নেকি ও পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘নেকি হল উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া। আর পাপ হচ্ছে যে কাজ করলে তোমার অন্তরে খটকা লাগে, আর মানুষের নিকট প্রকাশ হওয়াকে তুমি অপসন্দ কর’। [৮]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إنَّ مِنْ أحَبِّكُمْ إلَيَّ أحسَنُكُمْ أخْلَاقًا

আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে আমার নিকট ঐ ব্যক্তি বেশি প্রিয় যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম। ইবন ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ঐ ব্যক্তি যার চরিত্র উত্তম’। [৯]

عَنْ رَجُلٍ مِنْ مُزَيْنَةَ قَالَ قَالُوا يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ مَا خَيْرُ مَا أعْطِيَ الإِنْسَانُ قَالَ الْخُلُقُ الحَسَنُ

মুযায়না গোত্রের জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! মানুষকে সবচেয়ে উত্তম জিনিস কী প্রদান করা হয়েছে? তিনি বললেন, উত্তম চরিত্র’। [১০]

عَنْ أَبِى الدَّرْدَاءِ أَنَّ النَّبِىَّ قَالَ «مَا شَىْءٌ أَثْقَلُ فِى مِيزَانِ الْمُؤْمِنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ خُلُقٍ حَسَنٍ وَإِنَّ اللهَ لَيَبْغَضُ الْفَاحِشَ الْبَذِىءَ».


আবূ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের দাঁড়িপাল্লায় সবচেয়ে যে জিনিসটি বেশি ভারি হবে তা হচ্ছে তার উত্তম চরিত্র। আল্লাহ অশ্লীল ভাষা প্রয়োগকারীকে পসন্দ করেন না’।[১১]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)


* প্রভাষক, দেওগাঁ রহমানিয়া ফাযিল ডিগ্রী মাদরাসা, ঘোড়াঘাট, দিনাজপুর।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯৩; আবূ দাঊদ, হা/৪৮০৭; মিশকাত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৯৯, হা/৫০৬৮।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯২; আবূ দাঊদ, হা/৪৮০৯; মিশকাত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৯৯ হা/৫০৬৯।
[৩]. দারাকুৎনী, হা/১৩৬; সনদ ছহীহ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/১; মিশকাত, হা/১।
[৫]. ছহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩০, হা/১০।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৭২; মিশকাত, হা/৫২৯৫।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৬৭; মিশকাত, হা/৫১৩৯।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫২; মিশকাত, হা/৫০৭৩ ।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৫৯; মিশকাত, হা/৫০৭৪।
[১০]. মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, হা/৮২০৬; মিশকাত, হা/৫০৭৮।
[১১]. তিরমিযী, হা/২০০২; মিশকাত, হা/৫০৮১, সনদ ছহীহ।




প্রসঙ্গসমূহ »: যুবসমাজ
বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ১১ রাক‘আতের নির্দেশ দিয়েছিলেন (শেষ কিস্তি) - ব্রাদার রাহুল হোসেন (রুহুল আমিন)
বিদ‘আত পরিচিতি (১৩তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
তওবার গুরুত্ব ও ফযীলত (২য় কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
রামাযানের খুঁটিনাটি - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
চোগলখোরী করা ও তার পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বিদ‘আত পরিচিতি (১৪তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সন্ত্রাসবাদ : ইসলামের দিকে শ্যেনদৃষ্টি - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ (৫ম কিস্তি) - ড. মেসবাহুল ইসলাম

ফেসবুক পেজ