সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১২:২০ অপরাহ্ন

বিদ‘আত পরিচিত

-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


(২১তম কিস্তি) 

১০. বিদ‘আতী অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া প্রসঙ্গে

ইসলামী শরী‘আতে অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহমূলক অনেক বর্ণনা রয়েছে। যা ইসলামের সৌন্দর্যের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। নবী করীম (ﷺ) বলেন, ‘একজন মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের ছয়টি অধিকার রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হল إِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ ‘যখন সে অসুস্থ হবে, তখন তাকে দেখতে যাবে’।[১] অন্যত্র তিনি বলেন,عُوْدُوا الْمَرِيْضَ وَاتَّبِعُوا الْجَنَازَةَ تُذَكِّرُكُمُ الْآخِرَةَ ‘তোমরা রোগীকে দেখতে যাও এবং জানাযার ছালাতে অংশগ্রহণ কর, যা তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে’।[২] হাদীছে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে,

إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ يَوْمَ القِيَامَةِ يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِي قَالَ يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُوْدُكَ؟ وَأَنْتَ رَبُّ العَالَمِيْنَ قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِيْ فُلَانًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِيْ عِنْدَهُ

‘ক্বিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম। কিন্তু তুমি আমার সেবা-শুশ্রƒষা করনি। সে বলবে, হে রব! আমি কীভাবে আপনার সেবা করব, অথচ আপনি বিশ্ব চরাচরের অধিপতি? তখন আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল, কিন্তু তুমি তার সেবা করনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তার সেব-শুশ্রƒষা করতে, তাহলে তার কাছেই আমাকে পেতে’।[৩] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘একবার আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পুত্র হাসান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে দেখার জন্য আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়িতে গেলেন। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে বললেন, আপনি রোগীকে দেখতে এসেছেন, না-কি অন্য কোন উদ্দেশ্যে এসেছেন? আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমি আপনার অসুস্থ ছেলে হাসানকে দেখতে এসেছি। তখন আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন,

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَعُوْدُ مَرِيْضًا إِلَّا خَرَجَ مَعَهُ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ كُلُّهُمْ يَسْتَغْفِرُ لَهُ إِنْ كَانَ مُصْبِحًا حَتَّى يُمْسِيَ وَكَانَ لَهُ خَرِيْفٌ فِي الْجَنَّةِ وَإِنْ كَانَ مُمْسِيًا خَرَجَ مَعَهُ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ كُلُّهُمْ يَسْتَغْفِرُ لَهُ حَتَّى يُصْبِحَ وَكَانَ لَهُ خَرِيْفٌ فِي الْجَنَّةِ

‘কোন মুসলিম ব্যক্তি সকাল বেলা কোন রোগীকে দেখতে গেলে সত্তর হাযার ফেরেশতা তার সাথে রওয়ানা দেয়। প্রত্যেক ফেরেশতাই সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। উপরন্তু তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান তৈরি করা হয়। আর সে যদি সন্ধ্যা বেলা কোন রোগীকে দেখতে বের হয়, তাহলে সত্তর হাযার ফেরেশতা তার সাথে রওয়ানা দেয়। প্রত্যেক ফেরেশতাই সকাল পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান বরাদ্দ করে রাখা হয়’।[৪]

সুধী পাঠক! ইসলাম অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে যেমন উৎসাহিত করেছে, তেমনি এ কাজে অনেক মর্যাদার কথাও বর্ণিত হয়েছে। এমনকি শুধু মুসলিম রোগী নয়, বরং অমুসলিম ও কাফের রোগীদের দেখতে যাওয়ার ব্যাপারেও স্পষ্ট দিক-নির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং অসুস্থ অমুসলিমকে দেখতে যেতেন।[৫] অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে ইসলামে এরূপ মর্যাদা ও উৎসাহব্যঞ্জক আলোচনা থাকার পরেও যারা দ্বীনের নামে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যাশায় যেসব আমল করে, যার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোন নির্দেশনা নেই; এরূপ আমলকারী তথা বিদ‘আতীদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। অর্থাৎ কোন বিদ‘আতী অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া যাবে না এবং তার সুস্থতার জন্য দু‘আও করা যাবে না। উল্লেখ্য, বিদ‘আতটি অবশ্যই কুফরী পর্যায়ের হতে হবে।

বিদ‘আতী অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে ‘আম জনসাধারণ দু’ভাগে বিভক্ত। যথা : (ক) অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে শরী‘আতে যে দলীলসমূহ বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যে কোন অবস্থায় অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাওয়া এবং সাক্ষাৎ করা যাবে। সে বিদ‘আতী হোক বা না হোক, মুসলিম হোক কিংবা কাফির হোক (খ) আরেক শ্রেণীর মতে, অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সকল অবস্থায় অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাওয়া যাবে না বরং বিরত থাকতে হবে। তাকে দেখতে যাওয়া যাবে না। কিন্তু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মতে, প্রচলিত উভয় পদ্ধতিই ভুল। এ প্রসঙ্গে সঠিক মতামত হল, সকল রোগীকে দেখতে যাওয়া শরী‘আতসম্মত। কিন্তু বিদ‘আতীকে তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তার বিদ‘আত থেকে তাকে মুক্ত করার জন্য নির্ধারিত কিছু সময় তার থেকে দূরে থাকতে হবে। যাতে করে সে বিদ‘আত থেকে ফিরে এসে তার দ্বীনকে সংশোধন করতে পারে। এমতাবস্থায় যদি সে বিদ‘আত থেকে ফিরে আসে, তাহলে তো কোন সমস্যাই থাকবে না। যদিও তার বিদ‘আত কুফরী পর্যায়ের হোক না কেন। পক্ষান্তরে যদি সে বিদ‘আত থেকে ফিরে না আসে, তাহলে সর্বোতভাবে কাফিরদের ন্যায় তাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং তাকে কখনো দেখতে যাওয়া যাবে না। আর এটাই শরী‘আত। অতএব অসুস্থ বিদ‘আতীকে দেখতে যাওয়া যাবে, তবে উদ্দেশ্য হবে তার সংশোধন। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তো অসুস্থ মুশরিক ও ইহুদীকে দেখতে গিয়েছিলেন। যাতে করে তিনি তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করতে পারেন। নি¤েœ হাদীছ দু’টি মনোযোগের সাথে পাঠ করুন!

১. আবূ তালিবের মৃত্যুজনিত অসুস্থ অবস্থায় রাসূল (ﷺ)-এর দেখতে যাওয়া : সাঈদ ইবনু মুসাইয়্যাব (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ তালিবের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তার নিকট আসলেন। তিনি সেখানে আবূ জাহল ইবনু হিশাম ও ‘আব্দুল্লাহ‌ ইবনু আবূ উমাইয়্যা ইবনু মুগীরাকে উপস্থিত দেখতে পেলেন। (রাবী বলেন) আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আবূ তালিবকে লক্ষ্য করে বললেন,

يَا عَمِّ قُلْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ كَلِمَةً أَشْهَدُ لَكَ بِهَا عِنْدَ اللهِ. فَقَالَ أَبُوْ جَهْلٍ وَعَبْدُ اللهِ بْنُ أَبِىْ أُمَيَّةَ يَا أَبَا طَالِبٍ أَتَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَلَمْ يَزَلْ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يَعْرِضُهَا عَلَيْهِ وَيَعُوْدَانِ بِتِلْكَ الْمَقَالَةِ حَتَّى قَالَ أَبُوْ طَالِبٍ آخِرَ مَا كَلَّمَهُمْ هُوَ عَلَى مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ وَأَبَى أَنْ يَقُوْلَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ্রأَمَا وَاللهِ لأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ مَا لَمْ أُنْهَ عَنْكَ.

‘চাচাজান! ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ’ কালিমা পাঠ করুন, তাহলে এর অসীলায় আমি আল্লাহর সমীপে আপনার জন্য সাক্ষী দিতে পারব। আবূ জাহল ও আব্দুল্লাহ‌ ইবনু আবূ উমাইয়্যা বলে উঠল, ওহে আবূ তালিব! তুমি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম হতে বিমুখ হবে? অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তার নিকট কালিমা পেশ করতে থাকেন, আর তারা দু’জনও তাদের উক্তি পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। অবশেষে আবূ তালিব তাদের সামনে শেষ কথাটি যা বলল, তা এই যে, সে আব্দুল মুত্তালিবের ধর্মের উপর অবিচল রয়েছে, সে ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ’ বলতে অস্বীকার করল। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন, আল্লাহর কসম! তবুও আমি আপনার জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকব, যতক্ষণ না আমাকে তা হতে নিষেধ করা হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন, مَا کَانَ لِلنَّبِیِّ ‘নবীর জন্য সঙ্গত নয়...’ অর্থাৎ مَا کَانَ لِلنَّبِیِّ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡ یَّسۡتَغۡفِرُوۡا لِلۡمُشۡرِکِیۡنَ وَ لَوۡ  کَانُوۡۤا  اُولِیۡ  قُرۡبٰی مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَہُمۡ اَنَّہُمۡ اَصۡحٰبُ  الۡجَحِیۡمِ ‘নবী ও অন্য মুমিনদের জন্য জায়েয নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, যদিও তারা আত্মীয়ই হোক না কেন, একথা প্রকাশ হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী’ (সূরা আত-তাওবাহ : ১১৩)।[৬]

২. অসুস্থ ইহুদী বালককে রাসূল (ﷺ)-এর দেখতে যাওয়া : আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ غُلَامٌ يَهُوْدِىٌّ يَخْدُمُ النَّبِىَّ ﷺ فَمَرِضَ فَأَتَاهُ النَّبِىُّ ﷺ يَعُوْدُهُ فَقَعَدَ عِنْدَ رَأْسِهِ فَقَالَ لَهُ (أَسْلِمْ). فَنَظَرَ إِلَى أَبِيْهِ وَهْوَ عِنْدَهُ فَقَالَ لَهُ أَطِعْ أَبَا الْقَاسِمِ ﷺ. فَأَسْلَمَ فَخَرَجَ النَّبِىُّ ﷺ وَهْوَ يَقُوْلُ (الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِىْ أَنْقَذَهُ مِنَ النَّارِ)

‘এক ইয়াহূদী বালক নবী করীম (ﷺ)-এর খিদমত করত, সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী করীম (ﷺ) তাকে দেখার জন্য আসলেন। তিনি তার মাথার নিকট বসে তাকে বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ কর, সে তখন তার পিতার দিকে তাকাল, সে তার নিকটেই ছিল, পিতা তাকে বলল, আবুল কাসেম (নবী করীম (ﷺ)-এর কুনিয়াত) এর কথা মেনে নাও, তখন সে ইসলাম গ্রহণ করল। নবী করীম (ﷺ) সেখান হতে বের হয়ে যাওয়ার সময় বললেন, যাবতীয় প্রশংসা সে আল্লাহর, যিনি তাকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দিলেন’।[৭]

উক্ত হাদীছদ্বয় থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় যে, কোন অমুসলিম অসুস্থ হলে কেবল তার দ্বীনের সংস্কারের জন্য তাকে দেখতে যাওয়া বৈধ। অন্যথা নয়। মুনযীরী (১১৮৫-১২৫৮ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বলা হয়ে থাকে (অসুস্থ) মুশরিককে দেখতে যাওয়া তাকে ইসলামের দিকে আহ্বানের জন্য যখন সে তার আহ্বানে সাড়া দেয়। নবী করীম (ﷺ) ইহুদীকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং তার নিকট ইসলামকে পেশ করেছিলেন। আর যদি সে ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী না হয় এবং তার আহ্বানে সাড়া দেয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে তাকে দেখতে যাওয়া উচিত নয়’।[৮] ইবনু বাত্তাল (মৃ. ৪৪৯ হি./১০৫৭ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) একই কথা বলেছেন।[৯] উল্লেখ্য, ভালোবাসা, হৃদ্যতা এবং মানবীয় কারণে অসুস্থ মুশরিকদেরকে দেখতে যাওয়া যাবে না। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

لَا تَجِدُ قَوۡمًا یُّؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ  یُوَآدُّوۡنَ مَنۡ حَآدَّ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ  وَ لَوۡ کَانُوۡۤا  اٰبَآءَہُمۡ  اَوۡ اَبۡنَآءَہُمۡ  اَوۡ  اِخۡوَانَہُمۡ  اَوۡ عَشِیۡرَتَہُمۡ

‘তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায়, যারা ভালোবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর বিরুদ্ধচারীদেরকে, হোক না এই বিরুদ্ধচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের জ্ঞাতি-গোত্র’ (সূরা আল-মুজাদালাহ : ২২)। উক্ত আয়াত নিকটাত্মীয়-স্বজন হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম ও মুশরিকদের মাঝে বন্ধুত্বকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যেমন ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (১৬৪-২৪১ হি./৭৮০-৮৫৫ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট এমন ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল, যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, ইহুদী ও খ্রিস্টান। তখন তিনি বললেন, তাকে দেখতে যাওয়া যাবে না এবং তাকে সম্মানও করা যাবে না’।[১০]

উক্ত আলোচনায় কোন মুশরিক অসুস্থ হলে তাকে কখন দেখতে যাওয়া বৈধ আর কখন নিষিদ্ধ সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং বিদ‘আতীর বিদ‘আত যদি কুফরী পর্যায়ের হয়, তাহলে অসুস্থ মুশরিক, কাফির এবং তাদের অনুসারীদেরকে দেখতে যাওয়ার যে বিধান, তাদের অসুস্থদেরকে দেখতে যাওয়াও একই বিধান। সুতরাং কুফরী পর্যায়ের বিদ‘আতী অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া শরী‘আতসিদ্ধ নয়। তবে তার দ্বীনের সংস্কার করার উদ্দেশ্য যদি বিজয় লাভ করে অর্থাৎ ছহীহ সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিলে যদি সে তা কবুল করে, বিদ‘আত থেকে মুক্ত হয় এবং শরী‘আতের বিভিন্ন বিষয় বাস্তবায়ন করে যেমন, আত্মীয় হিসাবে সদ্ব্যবহার করা এবং প্রতিবেশী হিসাবে ইহসান করা ইত্যাদি; তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু কুফরী বিদ‘আতীকে দেখতে যাওয়ার সময় তার সদ্ব্যবহার ও উত্তম প্রতিবেশী সম্পর্কে অবগত হওয়ার পরেও সে যদি বিদ‘আতের দিকে আহ্বানকারী হয়, তাহলে তাকে পরিত্যাগ করা শরী‘আতসম্মত। তার অসুস্থ অবস্থায় তাকে পরিত্যাগের মাধ্যমে সে যদি বিদ‘আত থেকে ফিরে আসে এবং তাওবাহ করে ফিরে আসে তাহলে সমস্যা নেই। অন্যথা দেখতে যাওয়া যাবে না।[১১]

অতএব কুফরী পর্যায়ের বিদ‘আতী অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়ার বিষয়টির দু’টি অবস্থা। যথা :

ক. বিদ‘আত থেকে তওবাহ করে ফিরে আসা এবং তাওহীদ ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা।

খ. শরী‘আতের অন্যান্য বৈধ বিষয়গুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। যেমন আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখা, প্রতিবেশীর সাথে উত্তম ব্যবহার করা ইত্যাদি। এমতাবস্থায়ও উভয়ের মধ্যে যেটা কল্যাণকর সেটাকে অগ্রগামী করতে হবে। অর্থাৎ পরিস্থিতি বিবেচনা করে হয় তাকে দেখতে যেতে হবে অনথ্যা পরিত্যাগ করতে হবে। কেননা শরী‘আতের মূলনীতি হল, সংশোধনের জন্য দু’টি বিষয়ের মধ্যে যেটা বেশি কল্যাণকর ও উপকারী সেটাকেই গ্রহণ করা উচিত।[১২] উপরিউক্ত দুই অবস্থা ব্যতীত আর অন্য কোন অবস্থায় অসুস্থ কুফরী পর্যায়ের বিদ‘আতীদেরকে দেখতে যাওয়া বৈধ নয়। এ ব্যাপারে শরী‘আতের বর্ণনা ও সালাফদের বক্তব্য সুস্পষ্ট। যেমন,

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ্রإِنَّ مَجُوْسَ هَذِهِ الْأُمَّةِ الْمُكَذِّبُوْنَ بِأَقْدَارِ اللهِ إِنْ مَرِضُوْا فَلَا تَعُوْدُوْهُمْ وَإِنْ مَاتُوْا فَلَا تَشْهَدُوْهُمْ

জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, এ উম্মতের তারা মাজূসী তথা অগ্নিপূজক, যারা আল্লাহর নির্ধারিত তাক্বদীরকে অস্বীকার করে। এরা রোগাক্রান্ত হলে তোমরা তাদের দেখতে যেও না এবং তারা মারা গেলে তোমরা তাদের জানাযায় হাজির হয়ো না।[১৩]

عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِيِّ ﷺ إِنَّ الْقَدَرِيَّةَ مَجُوْسٌ هَذِهِ الْأُمَّةُ إِنْ مَرَضُوْا فَلَا تَعُوْدُهُمْ وَإِنْ مَاتُوْا فَلَا تَشْهَدُوْهُمْ

ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) নবী করীম (ﷺ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তাক্বদীরকে অস্বীকারকারী ক্বাদারিয়ারা এই উম্মতের মাজূসী তথা অগ্নিপূজক। তারা অসুস্থ হলে তাদেরকে দেখতে যাবে না এবং তারা মারা গেলে তাদের জানাযায় উপস্থিত হবে না।[১৪] আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) ক্বাদারিয়াদের সম্পর্কে বলেছেন যে, أولئك شرار هذه الأمة لا تعودوا مرضاهم ولا تصلوا على موتاهم ‘এরাই হল এই উম্মতের মন্দ লোক। তাদের অসুস্থতায় তাদেরকে দেখতে যাবে না এবং তাদের মৃতদের জানাযার ছালাত আদায় করবে না’।[১৫]

বিশর ইবনুল হারিছ (রাহিমাহুল্লাহ) জাহমিয়্যাহদের সম্পর্কে বলেন, لَا تُجَالِسُوْهُمْ وَلَا تُكَلِّمُوْهُمْ وَإِنْ مَرِضُوْا فَلَا تَعُوْدُوْهُمْ وَإِنْ مَاتُوْا فَلَا تَشْهَدُوْهُمْ ‘তাদের সাথে বসবে না, তাদের সাথে কথা বলবে না। আর তারা রোগাক্রান্ত হলে তাদেরকে দেখতে যাবে না এবং তারা মারা গেলে তাদের জানাযায় উপস্থিত হবে না’।[১৬] আর-রাবী‘ ইবনু সুলাইমান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

اَلْقُرْآنُ كَلَامُ اللهِ غَيْرَ مَخْلُوْقٍ فَمَنْ قَالَ غَيْرَ هَذَا فَإِنْ مَرِضَ فَلَا تَعُوْدُوْ وَإِنْ مَاتَ فَلَا تَشْهَدُوْا جَنَازَتَهُ كَافِرٌ بِاللهِ الْعَظِيْمِ

‘কুরআন আল্লাহর কালাম বা কথা, সৃষ্ট নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি এর বিপরীত কিছু বলে আর যদি সে অসুস্থ হয়, তাহলে তাকে দেখতে যাবে না এবং সে মারা গেলে তার জানাযায় উপস্থিত হবে না; কেননা সে মহান আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে’।[১৭]

পক্ষান্তরে বিদ‘আত যদি কুফরী পর্যন্ত না পৌঁছায়, তাহলে এক্ষেত্রে সাধারণ রোগীদের দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে ইসলাম যে বিধান প্রদান করেছে সেই বিধান কার্যকর হবে। অর্থাৎ তাকে দেখতে যাওয়া জায়েয, বরং অসুস্থকে দেখতে যাওয়া কিংবা সেবা-শুশ্রƒষা করা এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের অধিকার। যেমন হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ رَدُّ السَّلَامِ وَعِيَادَةُ الْمَرِيْضِ وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ وَإِجَابَةُ الدَّعْوَةِ وَتَشْمِيْتُ الْعَاطِسِ

‘এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের পাঁচটি হক্ব রয়েছে। (ক) তার সালামের উত্তর দেয়া, (খ) অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, (গ) জানাযায় যোগদান করা, (ঘ) দাওয়াত কবুল করা এবং (ঙ) হাঁচির জওয়াব দেয়া।[১৮] অন্য বর্ণনায় ছয়টি অধিকারের কথা বণিত হয়েছে। তন্মধ্যে إِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ ‘যখন সে অসুস্থ হবে, তখন তাকে দেখতে যাবে’ অন্যতম।[১৯]

উক্ত হাদীছদ্বয়ে বিদ‘আতী (যা কুফর পর্যন্ত পৌঁছায়নি) হলেও সে অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে। কেননা সে মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট থেকে স্পষ্ট বর্ণনা না পাওয়া পর্যন্ত কোন পাপ, ফিসক, কুফর নয় এমন বিদ‘আত ইত্যাদির কারণে তাকে দেখতে যাওয়া থেকে বারণ করা যাবে না।[২০]

 (ইনশাআল্লাহ চলবে)


* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র : 
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১৬২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৮৩২; মিশকাত, হা/১৫২৫।
[২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১১২৮৮, সনদ ছহীহ।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৯; মিশকাত, হা/১৫২৮।
[৪]. আবূ দাঊদ, হা/৩০৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৭৬; মুসতাদরাক হাকিম, হা/১২৯৪; ছহীহুল জামে‘, হা/৫৭১৭; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৩৬৭।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৫৬, ১৩৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/৪০; আবূ দাঊদ, হা/৩০৯৫।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৫৬; মিশকাত, হা/১৫৭৪।
[৮]. মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ আশ-শাওকানী, নায়লুল আওত্বার, তাহক্বীক্ব : ঈছামুদ্দীন আছ-ছাবাবীত্বী (মিশর : দারুল হাদীছ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৩ হি./১৯৯৩ খ্রি.), ৮ম খ-, পৃ. ৭৭।
[৯]. ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহিল বুখারী, ১০ম খ-, পৃ. ১১৯।
[১০]. মাওক্বিফু আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতি মিন আহলিল আহওয়া ওয়াল বিদাঈ, ১ম খ-, পৃ. ৪১১।
[১১]. প্রাগুক্ত, ১ম খ-, পৃ. ৪১১-৪১২।
[১২]. প্রাগুক্ত, ১ম খ-, পৃ. ৩৬৭-৩৬৮, ৪১২।
[১৩]. ইবনু মাজাহ, হা/৯২; সনদ হাসান, যিলালুল জান্নাহ লিল আলবানী, হা/৩২৮।
[১৪]. লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আত, ১ম খ-, পৃ. ৬৩৯, আছার নং-১১৫০।
[১৫]. প্রাগুক্ত, ১ম খ-, পৃ. ৬৪৩, আছার নং-১১৬২।
[১৬]. ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আস-সুন্নাহ, তাহক্বীক্ব : ড. মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ ইবনু সালিম আল-ক্বাহতানী (দাম্মাম, সঊদী আরব : দারু ইবনিল ক্বাইয়িম, ১ম সংস্করণ, ১৪০৬ হি./১৯৮৬ খ্রি.), ১ম খ-, পৃ. ১২৫, আছার নং-৬১।
[১৭]. লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আত, ১ম খ-, পৃ. ৩২২, আছার নং-৫২০।
[১৮]. ছহীহ বুখারী হা/১২৪০, ‘জানাযা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২; ছহীহ মুসলিম হা/২১৬২, ‘সালাম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩; মিশকাত, হা/১৫২৪।  
[১৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১৬২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৮৩২; মিশকাত, হা/১৫২৫।
[২০]. মাওক্বিফু আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতি মিন আহলিল আহওয়া ওয়াল বিদাঈ, ১ম খ-, পৃ. ৪১৪-৪১৫।




ইসলামের দৃষ্টিতে প্রেম ও ভালোবাসা - আব্দুল গাফফার মাদানী
ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (৫ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ এবং তার প্রতিদান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মাহে রামাযানে শিশু-কিশোর প্রতিপালন - আব্দুর রশীদ
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৭ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
অল্পে তুষ্ট - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ - অনুবাদ : মুহাম্মদ ইমরান বিন ইদরিস
ফিতনা পরিচিতি ও আমাদের করণীয় (শেষ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন

ফেসবুক পেজ