বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:১৯ পূর্বাহ্ন

ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায়

- ড. মুযাফফর বিন মুহসিন


(৬ষ্ঠ কিস্তি)

(৬) শারঈ অপব্যাখ্যা ও উছূলী বিতর্কের কুপ্রভাব :

ইসলামী পুনর্জাগরণের পথে ইস্পাত কঠিন বাধা হল, ইসলামের নামে শারঈ অপব্যাখ্যা ও উছূলী বিতর্ক। শরী‘আতের ব্যাখ্যাগত এই মতপার্থক্য ও উছূলী বিতর্ক মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল ও বিভক্ত করেছে। রাসূল (ﷺ)-এর মৃত্যুর পর পরই উক্ত বিতর্ক শুরু হয়। শরী‘আতকে নবী করীম (ﷺ) ও ছাহাবায়ে কেরামের মত না বুঝে নিজেদের মত বুঝতে গিয়ে এই পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা ছাহাবায়ে কেরামের ব্যাখ্যা ও বুঝের অনুসরণকে আবশ্য করেছেন। সালাফদের মানহাজ অনুসরণ না করলে আল্লাহ তা‘আলা কাউকে হেদায়াত দিবেন না। লোকেরা যতদিন ছাহাবী ও তাবেঈদের অনুসরণের বাইরে থাকবে, তাঁদের নীতিকে অবজ্ঞা করবে, ততদিন তারা বিভক্তি ও গোমরাহীর মধ্যেই থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

فَاِنۡ اٰمَنُوۡا بِمِثۡلِ مَاۤ  اٰمَنۡتُمۡ  بِہٖ فَقَدِ اہۡتَدَوۡا  وَ اِنۡ تَوَلَّوۡا فَاِنَّمَا ہُمۡ فِیۡ  شِقَاقٍ

‘অতএব তারা যদি তোমাদের ঈমান আনার মত ঈমান আনে, তবেই তারা হেদায়াত পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তারা ভ্রষ্টতার মধ্যেই থাকবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৩৭)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ত্বাবারী বলেন,

فإن صدقوا مثل تصديقكم بجميع ما أنزل عليكم من كتب الله وأنبيائه، فقد اهتدوا

‘তোমরা যেভাবে সমস্ত কিতাব ও নবীগণকে সত্যায়ন করেছ, ঐভাবে যদি অন্যরাও সত্যায়ন করে, তবে তারা হেদায়াত পাবে।[১] ইমাম কুরতুবী বলেন,

فَإِنْ آمَنُوْا مِثْلَ إِيْمَانِكُمْ، وَصَدَّقُوْا مِثْلَ تَصْدِيْقِكُمْ فَقَدِ اهْتَدَوْا.

‘তারা যদি তোমাদের মত ঈমান আনয়ন করে এবং তোমাদের সত্যায়ন করার মত যদি তারাও সত্যায়ন করে, তাহলে তারাও হেদায়াত পাবে’।[২]

এছাড়া যারা সালাফী মানহাজের অনুসর না করে বিভক্তি ও গোমরাহীর মধ্যে থাকবে, আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  

وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا

‘হিদায়াত প্রকাশিত হওয়ার পর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের বিপরীত পথে চলে, সে যেদিকে চলতে চায়, আমি তাকে সেদিকেই প্রত্যাবর্তিত করব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর এটা নিকৃষ্টতর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (সূরা আন-নিসা : ১১৫)।

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সালাফদের মানহাজকে আঁকড়ে ধরা আবশ্যক করেছেন। যে তাঁদের নীতিকে প্রত্যাখ্যান করবে সে কুফরী করবে। ইমাম ত্বাবারী উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,

ويتبع طريقًا غير طريق أهل التصديق، ويسلك منهاجًا غير منهاجهم، وذلك هو الكفر بالله،  لأن الكفر بالله ورسوله غير سبيل المؤمنين وغير منهاجهم.

‘যে ব্যক্তি সালাফদের তরীক্বা ছাড়া অন্য কোন তরীক্বার অনুসরণ করবে এবং তাদের মানহাজের বিরোধী কোন মানহাজে পরিচালিত হবে, সেটা আল্লাহর সাথে কুফরী হিসাবে সাব্যস্ত হবে। কারণ সালাফদের রাস্তার বাইরে চলা এবং তাদের মানহাজের বিপরীত চলাই হল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করা’।[৩]

অতএব পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুসরণের ক্ষেত্রে ঐভাবে বুঝতে হবে, যেভাবে রাসূল (ﷺ) ও ছাহাবায়ে কেরাম বুঝেছেন। কারণ তাঁরাই হলেন প্রথম সারির আমলকারী। নি¤েœ আমরা উক্ত অপব্যাখ্য ও উছূলী বিতর্কের উদাহরণ তুলে ধরব :

শারঈ অপব্যাখ্যার স্বরূপ

(এক) পবিত্র কুরআনের যে সমস্ত আয়াতের অপব্যাখ্যা করা হয়, তার মধ্যে একটি প্রসিদ্ধ আয়াত হল, وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারা কাফের’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৪)। সুতরাং শাসকগোষ্ঠী যে কোন অন্যায় করলে, অন্যায় কর্ম প্রতিরোধ না করলে এবং ইলাহী বিধান প্রতিষ্ঠা না করলে, কাফের বলে গণ্য হবে  এবং তাদেরকে হত্যা করা বৈধ হবে।

পর্যালোচনা : ইতিহাসে যারা খারেজী বলে পরিচিত, তারাই উক্ত ব্যাখ্যা করে থাকে। কুরআন-সুন্নাহ এবং ছাহাবীদের বুঝ অনুযায়ী উক্ত ব্যাখ্যা সঠিক নয়। কারণ উক্ত আয়াতের পরে অনুরূপ আরও দু’টি আয়াত রয়েছে। যেমন- وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারা যালিম’ এবং وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ  الۡفٰسِقُوۡنَ ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারা ফাসিক’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৫ ও ৪৭)। বুঝা যাচ্ছে যে, একই অপরাধের কারণে একশ্রেণীর মানুষকে কাফের, একশ্রেণীর মানুষকে যালেম, আর একশ্রেণীর মানুষকে ফাসিক বলা হয়েছে। তাহলে বিষয়টি অনুধাবন করা আবশ্যক যে, কোন্ শ্রেণীর মানুষ কাফের আর কোন্ শ্রেণীর মানুষ যালেম আর কারা ফাসিক। কারণ সবার হুকুম এক নয়। মূলত যারা আল্লাহ্র বিধানকে বিশ্বাস করে না, অনুসরণ করে না এবং অন্যকে অনুসরণ করতে বাধা দেয়, তারা পরিষ্কার কাফের। আর যারা বিশ্বাস করে, কিন্তু নিজেরা অনুসরণ করে না, কাউকে করতেও দেয় না, তারা যালেম। আর যারা বিশ্বাস করে কিন্তু মানে না, কেউ অনুসরণ করলে বাধা দেয় না, তারা ফাসিক।[৪] মুসলিম ব্যক্তি দ্বীনকে অস্বীকার করে মুরতাদ হয়ে গেলে তাকে কাফের হিসাবে হত্যা করার বিধান শরী‘আতে আছে। কিন্তু যালেম ও ফাসিককে হত্যা করার বিধান শরী‘আতে নেই। সবাইকে এক সঙ্গে কাফের বলে আখ্যায়িত করা উচিত নয়।

উক্ত মৌলিক পার্থক্য না জানার কারণে চরমপন্থী খারেজীরা মুসলিম দেশের শাসকগোষ্ঠীকে কাফের সাব্যস্ত করে এবং তাদেরকে হত্যা করাই এর একমাত্র সামাধান মনে করে।[৫] এছাড়া সামান্য অপরাধের জন্য তারা যে কোন সাধারণ ব্যক্তিকেও কাফের, মুরতাদ সাব্যস্ত করে, জান-মালকে হালাল মনে করে নৃশংসভাবে হত্যা করে, ধন-সম্পদ লুট করে। শুধু তাই নয় তাকে সরাসরি মুশরিক ও জাহান্নামী পর্যন্ত মনে করে।[৬] উক্ত বুঝ অনুযায়ী তারা ওছমান, আলী, ইবনু খাব্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) সহ কতিপয় ছাহাবীকে তারা হত্যা করেছে। 

এছাড়া তাদের দৃষ্টিতে যে সমস্ত মুসলিম ব্যক্তি চারিত্রিক স্খলনের দোষে দুষ্ট এবং যারা সূদ-ঘুষ, গান-বাজনার মত বিভিন্ন সামাজিক অপরাধের সাথে জড়িত, তারা কাফের ও হত্যাযোগ্য অপরাধী। যারা বিধর্মীদের কর্তৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত, মানব রচিত মতবাদে বিশ্বাসী, শরী‘আত বিরোধী সংবিধানের অধীনে রয়েছে, তারাও সরাসরি কাফের অথবা মুশরিক। তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব, তাদের ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া বৈধ।

উক্ত আয়াতের মৌলিক ব্যাখ্যা কী তা আমরা সালাফী বিদ্বানগণের নিকট থেকে অনুধাবন করব। ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী (৩৮৪-৪৫৬ হি.) বলেন,

وَأَمَّا نَحْنُ فَنَقُوْلُ إِنَّ كُلَّ مَنْ كَفَرَ فَهُوَ فَاسِقٌ ظَالِمٌ عَاصِىٌ وَلَيْسَ كُلُّ فَاسِقٌ ظَالِمٍ عَاصٍ كَافِرًا بَلْ قَدْ يَكُوْنُ مُؤْمِنًا بِاللهِ التَّوْفِيْقِ.

‘আমরা বলি, প্রত্যেকেই যারা কুফরী করে তার ফাসিক, যালেম, পাপী। আর প্রত্যেক ফাসিক, যালিম পাপী কাফের নয়; বরং আল্লাহ্র মর্জি অনুযায়ী কিছুটা হলেও মুমিন থাকে’।[৭] অন্যত্র তিনি বলেন,

ذَهَبَ أَهْلُ السُّنَّةِ مِنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ وَالْفُقَهَاءِ إِلَى أَنّهُ مُؤْمِنٌ فَاسِقٌ نَاقِصُ الْإِيْمَانِ.

‘আহলেহাদীছগণ এবং ফক্বীহগণের নিকটে ঐ ব্যক্তি ফাসেক্ব মুমিন ও অপূর্ণাঙ্গ ঈমানদার’।[৮] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বক্তব্যই মধ্যমপন্থী। তাই আমরা বলি, هُوَ مُؤْمِنٌ نَاقِصُ الْإِيْمَانِ أَوْ مُؤْمِنٌ بِإِيْمَانِهِ فَاسِقٌ بِكَبِيْرَتِهِ ‘ঐ ব্যক্তিও মুমিন। তবে অপূর্ণাঙ্গ মুমিন অথবা তার ঈমানের কারণে সে মুমিন, আর কাবীরা গোনাহের কারণে সে ফাসিক’।[৯] আল্লামা ছিদ্দীক্ব হাসান খান ভূপালী (১৮০৫-১৯০২ খৃ.) বলেন,

فَهُوَ مُؤْمِنٌ نَاقِصُ الْإِيْمَانِ أَوْ مُؤْمِنٌ بِالْإِيْمَانِ فَاسِقٌ بِالْكَبِيْرَةِ.... فَلَا يُشْهَدُ عَلَى أَحَدٍ مِّنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ أَنَّهُ فِى النَّارِ لِذَنْبٍ عَمِلَهُ وَلَا لِكَبِيْرَةٍ أَتَاهَا وَلَانُخْرِجُهُ عَنِ الْإِسْلَامِ بِعَمَلٍ.

‘ঐ ব্যক্তিও মুমিন তবে পূর্ণাঙ্গ মুমিন নয় অথবা ঈমানের কারণে সে মুমিন এবং কাবীরা গোনাহের কারণে ফাসিক। .... সুতরাং আহলে ক্বিবলার কারো উপর কোন পাপের কারণে জাহান্নামী বলে সাক্ষ্য দেয়া যাবে না। এমনকি সে কাবীরা গোনাহ করলেও। আমরা তাকে কোন অপকর্মের জন্য ইসলাম থেকেও বের করে দেই না’।[১০] অন্যত্র তিনি বলেন, لَايُكْفَرُ أَهْلُ الْقِبْلَةِ بِمُطْلَقِ الْمَعَاصِىْ وَالْكَبَائِرِ ‘কাবীরা গোনাহ বা অন্যান্য পাপের কারণে আহলে ক্বিবলার কাউকে কাফের আখ্যায়িত করা যায় না’।[১১] ইমাম ত্বাহাবী (২৩৯-৩২১ হি.) বলেন,

 وَلَانَكْفُرُ أَحَدًا مِّنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ بِذَنْبٍ مَّالَمْ يَسْتَحِلَّهُ وَلَانَقُوْلُ لَايَضُرُّ مَعَ الْإِيْمَانِ ذَنْبٌ لِمَنْ عَمِلَهُ

‘আমরা এমন কোন অপরাধের কারণে আহলে ক্বিবলার কাউকে কাফের আখ্যায়িত করি না, যে অপরাধ তার (জান-মাল) হালাল করে না। আবার এটাও বলি না যে, সে যে অপরাধ করে তা তার ঈমানের ক্ষতি করে না’।[১২]

ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) কাবীরা গোনাহগার ব্যক্তিদের সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন,

اِتَّفَقَ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ أَنَّهُ يَشْفَعُ فِىْ أَهْلِ الْكَبَائِرِ وَأنَّهُ لَايَخْلُدُ فِى النَّارِ مِنْ أَهْلِ التَّوْحِيْدِ.

‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ঐকমত্য পোষণ করেছে যে, রাসূল (ﷺ) কাবীরা গোনাহগার ব্যক্তিদের জন্য সুপারিশ করবেন। আর আল্লাহকে এক বলে স্বীকারকারী তাওহীদপন্থীদের একজনও জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে না’।[১৩] তিনি রাসূল (ﷺ)-এর যুগের উপমা পেশ করতে গিয়ে সালাফী বিদ্বানগণের কথা তুলে ধরে বলেন,

يَقُوْلُ عَلَمَاءُ السَّلَفِ فِى الْمُقَدَّمَاتِ الْاِعْتِقَادِيَّةِ لَانَكْفُرُ أَحَدًا مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ بِذَنْبٍ وَلَانُخْرِجُهُ مِنَ الْإِسْلَامِ بِعَمَلٍ وَقَدْ ثَبَتَ الزِّنَا وَالسَّرِقَةُ وَشُرْبُ الْخَمَرِ عَلَى أُنَاسٍ فِىْ عَهْدِ النَّبِىِّ ﷺ وَلَمْ يُحْكَمُ فِيْهِمْ مِنْ كُفْرٍ... بَلْ جُلِّدَ هَذَا.

‘সালাফী বিদ্বানগণ আক্বীদার ক্ষেত্রে ভূমিকাতেই বলে থাকেন যে, আমরা কোন অপরাধের কারণে আহলে ক্বিবলার কাউকে কাফের আখ্যায়িত করি না এবং কোন অপকর্মের জন্যও তাকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেই না। রাসূল (ﷺ)-এর যুগে অনেক মানুষের দ্বারা ব্যভিচার, চুরি ও মদ্যপানের মত ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তাদের ব্যাপারে কাফের হওয়ার বিধান জারি করা হয়নি। ... বরং এক্ষেত্রে শাস্তির বিধান করা হয়েছে’।[১৪]

উক্ত আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, মুসলিম ব্যক্তিকে কোন পাপের কারণে কাফের বলে আখ্যায়িত করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা, রাসূল (ﷺ) এবং কুরআন-সুন্নাহকে অস্বীকার না করবে। এরপরও কেউ যদি আমলগত কুফরী করে আর আক্বীদাগতভাবে ইসলামকে গ্রহণ করে তবুও তাকে হত্যার হুকুম দেয়া যাবে না। তাই কুফরী দু’প্রকার।

কুফরীর প্রকার

কুফর দু’প্রকার : (১) كُفْرٌ اِعْتِقَادِىٌّ বা বিশ্বাসগত কুফরী, যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। (২) كُفْرٌ عَمَلِىٌّ আমলগত কুফরী, যা ইসলাম থেকে বের করে দেয় না। তবে সে মহাপাপী হয়, যা তওবা ব্যতীত মাফ হয় না। প্রথমটি বড় কুফ্র (كفر أكبر) এবং দ্বিতীয়টি ছোট কুফর (كفر أصغر)। তাই কেউ আক্বীদাগতভাবে কাফের না হলে তাকে কুফরীর বা হত্যার হুকুম দেওয়া যাবে না। এটাই পূর্বসুরি বিদ্বানদের আক্বীদা। অতএব কাবীরা গোনাহের কারণে কোন মুসলিম শাসককে কাফের আখ্যা দেয়া যাবে না, যদি আল্লাহকে, দ্বীন ইসলামকে এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) প্রদর্শিত শরী‘আতকে বিশ্বাস করে।[১৫] উক্ত মর্মে কুরআন ও হাদীছে অনেক দলীল বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

এক যুদ্ধে জুহায়না গোত্রের এক ব্যক্তিকে উসামা বিন যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আঘাত করতে গেলে সে কালেমা পাঠ করে। এরপরও তিনি তাকে আঘাত করেন এবং হত্যা করেন। এ বিষয়টি রাসূল (ﷺ)-এর নিকট বলা হলে তিনি হতবাক হয়ে বলেন,

أَقَتَلْتَهُ وَقَدْ شَهِدَ أَنْ لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ؟ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّمَا فَعَلَ ذَلِكَ تَعَوُّذًا قَالَ فَهَلاَّ شَقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ؟ وَفِىْ رِوَايَةٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ كَيْفَ تَصْنَعُ بِلَا إِلَهَ إلَّا اللهُ إذَا جَاءَتْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ قَالَهُ مِرَارًا.

‘কালেমা পড়ার পরও কি তুমি তাকে হত্যা করেছ? উসামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, সে জান বাঁচানোর জন্য কালেমা পড়েছে। রাসূল (ﷺ) বললেন, ‘তুমি কেন তার হৃদয় চিরে দেখলে না? অতঃপর রাসূল (ﷺ) বারবার বলতে লাগলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন সে যখন কালেমা নিয়ে আসবে, তখন তুমি কী করবে’?[১৬] এমনকি কোন কাফের যদি কোন মুসলিম ব্যক্তির হাত কেটে নেয় এবং সে কালেমা পাঠ করে, তবুও তাকে হত্যা করা যাবে না।

عَنِ الْمِقْدَادِ بْنِ الْأَسْوَدِ أَنَّهُ قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَرَأَيْتَ إِنْ لَقِيْتُ رَجُلاً مِنَ الْكُفَّارِ فَاقْتَتَلْنَا فَضَرَبَ إِحْدَى يَدَىَّ بِالسَّيْفِ فَقَطَعَهَا ثُمَّ لاَذَ مِنِّى بِشَجَرَةٍ فَقَالَ أَسْلَمْتُ لِلهِ آأَقْتُلُهُ يَا رَسُوْلَ اللهِ بَعْدَ أَنْ قَالَهَا فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ৎ لاَ تَقْتُلْهُ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّهُ قَطَعَ إِحْدَى يَدَىَّ ثُمَّ قَالَ ذَلِكَ بَعْدَ مَا قَطَعَهَا فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ৎ لاَ تَقْتُلْهُ فَإِنْ قَتَلْتَهُ فَإِنَّهُ بِمَنْزِلَتِكَ قَبْلَ أَنْ تَقْتُلَهُ وَإِنَّكَ بِمَنْزِلَتِهِ قَبْلَ أَنْ يَقُوْلَ كَلِمَتَهُ الَّتِىْ قَالَ.

‘মিক্বদাদ বিন আসওয়াদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি একদা রাসূল (ﷺ)-কে বলেন, আমি যদি কোন কাফেরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হই এবং সে আমাকে তরবারি দ্বারা আমার এক হাত কেটে ফেলে অতঃপর সে আমার নিকট থেকে সরে গিয়ে গাছের আড়ালে আশ্রয় নেয় আর বলে, আমি আল্লাহ্র জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছি। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমি যদি তাকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হই আর সে বলে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু’ তখন আমি কি তাকে হত্যা করতে পারব? রাসূল (ﷺ) উত্তরে বললেন, না তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না। মিক্বদাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, সে তো আমার একটি হাত কেটে ফেলেছে? রাসূল (ﷺ) আবারও বললেন, তুমি তাকে হত্যা কর না। কারণ এখন তুমি যদি তাকে হত্যা কর তবে সে কিন্তু তোমার মর্যাদায় রয়েছে। আর তুমি হবে তার স্থানে যে অবস্থায় কালেমা বলার পূর্বে সে ছিল’।[১৭]

অনেকে মৌখিকভাবে স্বীকার করলেও অন্তরে কুফরী করে মর্মে রাসূল (ﷺ)-এর নিকট অভিযোগ করলে তিনি বলেন, إِنِّىْ لَمْ أُوْمَرْ أَنْ أَنْقُبَ عَنْ قُلُوْبِ النَّاسِ وَلَا أَشُقَّ بُطُوْنَهُمْ  ‘নিশ্চয়ই আমাকে মানুষের হৃদয় চিরা এবং পেট ফাঁড়ার নির্দেশ দেয়া হয়নি’।[১৮] খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দ্বারাও অনুরূপ ঘটনা ঘটলে রাসূল (ﷺ) আল্লাহ্র কাছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।[১৯]  

এ জন্যই ওহোদ যুদ্ধ থেকে তিনশ’ ব্যক্তি মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের নেতৃত্বে ফিরে আসলেও রাসূল (ﷺ) তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেননি। মানুষ হত্যা ও নানা নির্যাতন করলেও ফাসিক শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সহ কোন ছাহাবী কাফের ফৎওয়া দেননি। তাই হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) ফাসিক শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সম্পর্কে বলেন,

 إِنَّ الْحَجَّاجَ عَذَابُ اللهِ فَلَا تَدْفَعُوْا عَذَابَ اللهِ بِأَيْدِيْكُمْ وَلَكِنْ عَلَيْكُمُ الْاِسْتِكَانَةُ وَالتَّضَرُّعُ

‘হাজ্জাজ আল্লাহ্র গযব। সুতরাং তোমরা তোমাদের হাত দ্বারা আল্লাহ্র গযবকে প্রতিহত কর না। বরং তোমাদের উচিত বিনীত ও বিনম্র হওয়া’।[২০]

(দুই) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنِ الۡحُکۡمُ  اِلَّا لِلّٰہِ ‘আল্লাহ ছাড়া কারোও হুকুম নেই’ (সূরা ইউসুফ : ৪০, ৬৭)। উক্ত আয়াতের আলোকে বলা হয় যে, আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান চলবে না। তাই কোন বিষয়ে পরস্পরে বসে মীমাংসা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।

পর্যলোচনা : আয়াতটি পবিত্র কুরআনের তিন জায়গায় এসেছে (সূরা আল-আন‘আম : ৫৭; সূরা ইউসুফ : ৪০ ও ৬৭)। এর সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনা হল, ইহুদীদের ষড়যন্ত্রের কারণে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মাঝে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দল যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কায় আপোষ করার আহ্বান জানায়। তখন মীমাংসার জন্য আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষে আবু মূসা আশ‘আরী আর মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষে আমর ইবনুল ‘আছকে শালিস নিযুক্ত করা হয়। এটাকে একশ্রেণীর লোক প্রত্যাখ্যান করে এবং উক্ত সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার কারণে তারা আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে অপরাধী সাব্যস্ত করে। তারা দাবী করল আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কুরআনের হুকুম লংঘন করে কাবীরা গোনাহ করেছেন। দলীল হিসাবে তারা কুরআন থেকে উক্ত আয়াত পেশ করে এবং আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষ ত্যাগ করে। এরাই ইতিহাসে খারেজী বলে পরিচিত।[২১]

চরমপন্থীরা উক্ত আয়াতের মর্ম না বুঝেই আলী, মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও অন্যান্য ছাহাবীদেরকে কাফের বলে ফৎওয়া দিয়েছিল। তাই আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছিলেন,  كَلِمَةُ حَقٍّ أُرِيْدَ بِهِ بَاطِلٌ কথাটি ঠিক, কিন্তু বাতিল অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে।[২২] অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, يَقُوْلُوْنَ الْحَقَّ بِأَلْسِنَتِهِمْ لاَ يَجُوْزُ هَذَا مِنْهُمْ ‘তারা মুখে হক্ব কথা বললেও এটা তাদের পক্ষ থেকে (অপব্যাখ্যা হিসাবে) আসায় গ্রহণযোগ্য নয়’।[২৩] খারেজীরা যে উক্ত আয়াতের মর্ম বুঝেনি, তা আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কথায় স্পষ্ট হয়েছে। কারণ কুরআনেই তৃতীয় পক্ষ নির্ধারণ করে মীমাংসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা আল-মায়িদাহ : ৯৫; সূরা আন-নিসা : ৩৫)। অনুরূপ বনু কুরায়যার যুদ্ধের সময় সা‘আদ বিন মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ফায়সালা মেনে নেওয়ার শর্তে রাসূল (ﷺ) বিবাদ মীমাংসা করেন।[২৪] উক্ত আয়াতের মৌলিক উদ্দেশ্য হল- বিধানদাতা আল্লাহ এবং তার চূড়ান্ত ফায়সালাকারীও তিনি। তাঁর সৃষ্টি হিসাবে এই বিধান মেনে চলবে সকল মানুষ। আর কেউ প্রজাসাধারণের উপর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করবে।[২৫]

দ্বিতীয়তঃ মুসলিম শাসক কাবীরা গোনাহ করলেই তাকে কাফের বলে আখ্যায়িত করতে হবে এর কোন দলীল নেই। কারণ রাসূল (ﷺ)-এর বক্তব্য অনুযায়ী শাসক কখনও ভালও হতে পারে, খারাপও হতে পারে।[২৬] এ জন্য খারেজীদের উক্ত অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছিলেন, [২৭] يَقُوْلُوْنَ لَا إِمَارَةَ وَلَا بُدَّ مِنْ إِمَارَةٍ مِنْ بِرٍّ وَفَاجِرٍ ‘তারা বলছে কোন ইমারত বা প্রতিনিধিত্ব নেই। অথচ শাসকের জন্য ভাল ও মন্দ হওয়া আবশ্যক’। অর্থাৎ শাসক কখনও খারাপও হতে পারে। তাই বলে তাকে কাফের আখ্যায়িত করা যাবে না।

উক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হল যে নিজের বুঝ অনুযায়ী কুরআনের অর্থ করা যাবে না। এতে পথভ্রষ্ট হবে। এর পরিণাম ভয়াবহ।[২৮] তাই রাসূল (ﷺ) ও ছাহাবীদের বুঝ অনুযায়ী কুরআন বুঝতে হবে (সূরা আন-নিসা : ১১৫)।

(তিন) মহান আল্লাহ বলেন, وَ قَاتِلُوۡہُمۡ حَتّٰی لَا تَکُوۡنَ فِتۡنَۃٌ وَّ یَکُوۡنَ الدِّیۡنُ کُلُّہٗ  لِلّٰہِ ‘তোমরা তাদের (কাফেরদের) বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাক, যতক্ষণ না ফিৎনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহ্র দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়’ (সূরা আল-আনফাল : ৩৯; সূরা আল-বাক্বরাহ : ১৯৩)। উক্ত আয়াতের আলোকে ব্যাখ্যা দেয়া হয় যে, যাবতীয় অবৈধ কর্মকা- দূরীভূত করে আল্লাহ্র দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হবে।

পর্যালোচনা : উক্ত আয়াতে ‘ফিৎনা’ বলতে কাফের-মুশরিকদের শিরকী কর্মকা-ের প্রভাব বুঝানো হয়েছে। এই প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ যতক্ষণ কালেমা ত্বাইয়েবার স্বীকৃতি প্রদান না করবে, অথবা কর না দিবে, ততক্ষণ এই সংগ্রাম চলবে।[২৯] তবে এটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন সেখানে মুসলিমরা সামগ্রিকভাবে প্রভাব বিস্তার ও শক্তি প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশে কার বিরুদ্ধে এই আয়াত প্রয়োগ করবে?

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহ্র পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; কিন্তু সীমালংঘন কর না....’। ‘তোমরা তাদেরকে যেখানে পাবে, সেখানে হত্যা করবে এবং যে স্থান হতে তারা তোমাদেরকে বহিষ্কার করেছে, তোমরাও তাদেরকে সে স্থান হতে বহিষ্কার করবে। ফিৎনা হত্যা অপেক্ষাও গুরুতর। মসজিদে হারামের নিকট তোমরা ততক্ষণ যুদ্ধ করবে না, যতক্ষণ না তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে। যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তবে তোমরাও তাদেরকে হত্যা করবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯০-৯১)। একটু পর অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে কেউ তোমাদের উপর আক্রমণ করবে, তোমরাও তার উপর অনুরূপ আক্রমণ করবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৪)। নি¤েœর হাদীছে আসল রূপ ফুটে উঠেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا أَتَاهُ رَجُلَانِ فِىْ فِتْنَةِ ابْنِ الزُّبَيْرِ فَقَالَا إِنَّ النَّاسَ صَنَعُوْا وَأَنْتَ ابْنُ عُمَرَ وَصَاحِبُ النَّبِيِّ ﷺ فَمَا يَمْنَعُكَ أَنْ تَخْرُجَ فَقَالَ يَمْنَعُنِىْ أَنَّ اللهَ حَرَّمَ دَمَ أَخِىْ فَقَالَا أَلَمْ يَقُلِ اللهُ وَقَاتِلُوْهُمْ حَتَّى لَا تَكُوْنَ فِتْنَةٌ فَقَالَ قَاتَلْنَا حَتَّى لَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ وَكَانَ الدِّيْنُ لِلهِ وَأَنْتُمْ تُرِيْدُوْنَ أَنْ تُقَاتِلُوْا حَتَّى تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ لِغَيْرِ اللهِ.

ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, একদা তার নিকট দু’জন ব্যক্তি এসে বলল, লোকেরা ফেৎনা সৃৃষ্টি করছে, অথচ আপনি ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পুত্র এবং রাসূল (ﷺ)-এর অন্যতম সাথী। তাদের বিরুদ্ধে বের হতে আপনাকে কিসে বাধা দিচ্ছে? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার উপর আমার মুসলিম ভাইয়ের রক্তকে হারাম করে দিয়েছেন। তখন তারা বলল, আল্লাহ কি বলেননি, ‘যতক্ষণ ফেৎনা দূরীভূত না হবে, ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর’? তখন ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করেছি যতক্ষণ না ফেৎনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহ্র দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর তোমরা যুদ্ধ করতে চাচ্ছ ফেৎনা সৃষ্টির জন্য এবং গায়রুল্লাহ্র দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য’।[৩০]

এ ধরনের আরো অনেক আয়াত ও হাদীছের অপব্যাখ্যা সমাজে বিদ্যমান। যার কারণে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হল, রাসূল (ﷺ), ছাহাবী ও তাবেঈদের ব্যাখ্যার দিকে ফিরে যাওয়া।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

তথ্যসূত্র :
[১]. তাফসীরে ত্বাবারী ৩/১১৪ পৃ.। 
[২]. তাফসীরে কুরতুবী ২/১৪২ পৃ.।
[৩]. তাফসীরে ত্বাবারী, ৯ম খ-, পৃ. ২০৪।
[৪]. তাফসীরে কুরতুবী, ৩য় খ-, ৬ষ্ঠ অংশ, পৃ. ৫৪৪-৫৪৫; তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩য় খ-, পৃ. ১২০। 
[৫]. আব্দুল কারীম আশ-শাহরাস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল (বৈরুত : মুওয়াসসাসাতুর রিাসালাহ, ১৪৩২ হি./২০১১ খৃ.), পৃ. ১৩৩; আল-ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, ৩য় খ-, পৃ. ১২৭, ‘খারেজীদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মকা-ের বর্ণনা’ অধ্যায়।
[৬]. আল-মাযাহিবুল ইসলামিয়াহ (মিসর : ইদারতুছ ছাক্বাফিয়াহ আল-আম্মাহ, তাবি), পৃ. ১২০।
[৭]. আল-ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, ২য় খ-, পৃ. ২৫৫।
[৮]. আল-ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, পৃ. ২য় খ-, ২৫০।
[৯]. শায়খুল ইসলাম তাক্বিউদ্দীন আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ আল-হাররানী, মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া, ২য় খ-, ৩য় অংশ (বৈরুত : দারু ইবনে হাযম, ১৪৩২ হি./২০১১ খৃ.), পৃ. ১০০।  
[১০]. মুহাম্মাদ ছিদ্দীক হাসান খান আল-কুনূজী, ক্বাৎফুছ ছামার ফী আক্বীদাতি আহলিল আছার (সঊদী আরব : ওযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামিয়াহ ওয়াল আওক্বাফ ওয়াদ দা‘ওয়াত ওয়াল ইরশাদ, ১৪২১ হি.), পৃ. ৮৫।
[১১]. ক্বাৎফুছ ছামার, পৃ. ৮৪।
[১২]. ইবনু আবীল ইযয আল-হানাফী, শারহুল আক্বীদাহ আত-ত্বহাবীয়াহ (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৩৯১ হি.),  পৃ. ৩১৬।
[১৩]. মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া, ১ম খ-, ১ম অংশ, পৃ. ৮৩।
[১৪]. মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া, ৪র্থ খ-, ৭ম অংশ, পৃ. ৪০৯।
[১৫]. ফিতনাতুত তাকফীর ওয়াল হাকিমিয়াহ, পৃ. ৩৩।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, পৃ. ৫২৯, হা/৪২৬৯, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৪; মিশকাত হা/৩৪৫০-৫১, ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, পৃ. ৫০০, হা/৪০১৯, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; মিশকাত হা/৩৪৪৯।
[১৮]. ছহীহ মুসলিম, পৃ. ২৯৮, হা/১০৬৪।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, পৃ. ৫৩৭।
[২০]. মাসিক আল-ফুরক্বান (কুয়েত : জমঈয়াতু এহইয়াত তুরাছ আল-ইসলামী, সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮০ খৃ.), ১০ম বর্ষ, পৃ. ১৬।
[২১]. ইমাম যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ওয়া ওয়াফিয়াতুল মাশাহীর ওয়াল আ‘লাম, ৩য় খ- (বৈরুত : দারুল কিতাব আল-‘আরাবী, ১৪০৭ হি./১৯৮৭ খৃ.), পৃ. ৫৯০।   
[২২]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৬৬, ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[২৩]. ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৩০০, হা/১০৬৬, ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[২৪]. ছহীহ বুখারী, পৃ. ৩৮২, হা/৩০৪৩; মিশকাত হা/৩৯৬৩।
[২৫]. ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৫৭৪, হা/১৮৩৫; মিশকাত হা/৩৬৬১-৬৪।
[২৬]. ছহীহ বুখারী, পৃ. ৮৬৪, হা/৭০৫২; মিশকাত হা/৩৬৭১ ‘নেতৃত্ব ও পদ মর্যাদা’ অধ্যায়।
[২৭]. আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, পৃ. ১২১; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, ১০ খ-, পৃ. ১৪৯, হা/১৮৬৫৪।
[২৮]. ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৮২, হা/২২৩; মিশকাত, হা/২৮১।
[২৯]. তাফসীর ফাতহুল ক্বাদীর, ১ম খ- (ছাপার নাম ও তারিখ বিহীন), পৃ. ২৫৩।
[৩০]. ছহীহ বুখারী, পৃ. ৫৫৯, হা/৪৫১৩; মিশকাত, হা/৬০০৪।




প্রসঙ্গসমূহ »: সমাজ-সংস্কার
সালাফী মানহাজের বৈশিষ্ট্য (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ফাযায়েলে কুরআন - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১৩তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (শেষ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবূ সাঈদ
বিদ‘আত পরিচিতি - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বরূপ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
বাংলাদেশে সমকামিতার গতি-প্রকৃতি : ভয়াবহতা, শাস্তি ও পরিত্রাণের উপায় অনুসন্ধান - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ

ফেসবুক পেজ