সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৮:১৪ পূর্বাহ্ন
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায়
-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*

(৩য় কিস্তি)

(ঘ) মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশ, নিষেধ, অতীত, ভবিষ্যৎ এবং অন্যান্য বিষয়ের গায়েবের ব্যাপারে যে সংবাদ প্রদান করেছেন তা সত্যায়ন করা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡہُ وَ مَا نَہٰىکُمۡ عَنۡہُ فَانۡتَہُوۡا

‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাক’ (সূরা আল-হাশর : ৭)। আবূ সাঈদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

أَلَا تَأْمَنُوْنِىْ وَأَنَا أَمِيْنُ مَنْ فِى السَّمَاءِ يَأْتِيْنِىْ خَبَرُ السَّمَاءِ صَبَاحًا وَمَسَاءً

‘তোমরা আমাকে আমানতদার মনে করবে না? অথচ যিনি আসমানে আছেন, আমি তাঁর পক্ষ থেকে আমানতদার। আমার কাছে সকাল-সন্ধ্যায় আসমানের খবর আসে’।[১]

(ঙ) মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে নিজের জীবন, সম্পদ, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং অন্যান্য মানুষের চেয়েও বেশি ভালবাসা :
আনাস (রাযিয়াল্লাহ আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَّالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ

‘তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকটে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হব’।[২]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ هِشَامٍ رضى الله عنه قَالَ كُنَّا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَهْوَ آخِذٌ بِيَدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رضى الله عنه فَقَالَ لَهُ عُمَرُ رضى الله عنه يَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ إِلَّا مِنْ نَفْسِىْ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لَا وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْكَ مِنْ نَفْسِكَ فَقَالَ لَهُ عُمَرُ رضى الله عنه فَإِنَّهُ اَلْآنَ وَاللهِ لَأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ نَفْسِىْ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم اَلْآنَ يَا عُمَرُ

আব্দুল্লাহ ইবনু হিশাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একবার নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি তখন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর হাত ধরেছিলেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার জীবন ব্যতীত আপনি আমার কাছে সব কিছুর চেয়ে অধিক প্রিয়। তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, না, যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম! যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমার কাছে তোমার জীবনের চেয়েও প্রিয় না হই। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে বললেন, আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে আমার জীবনের চেয়েও বেশি প্রিয়। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হে ওমর! এখন (তুমি সত্যিকার ঈমানদার হলে)।[৩]

(চ) মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথাকে সকল মানুষের কথার উপর অগ্রগামী করা এবং তাঁর সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُقَدِّمُوۡا بَیۡنَ یَدَیِ اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ اِنَّ اللّٰہَ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ

‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে তোমরা কোন বিষয়ে অগ্রগামী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১)।

(ছ) মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা করা এবং মর্যাদা প্রদান করা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ شَاہِدًا وَّ مُبَشِّرًا وَّ نَذِیۡرًا- لِّتُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ تُعَزِّرُوۡہُ وَ تُوَقِّرُوۡہُ

‘আমরা আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন, তাঁকে সাহায্য কর ও সম্মান কর’ (সূরা আল-ফাত্হ : ৮-৯)।

২. তাক্বওয়া অর্জন করা
تقوي (তাক্বওয়া) শব্দটি আরবী।وقاية (বিকায়াহ) হতে এর উৎপত্তি। অর্থ হল অনিষ্টকর ও কষ্টদায়ক বস্তু হতে আত্মরক্ষা করা, দূরে থাকা, মুক্তি, নিষ্কৃতি, সতর্কতা ও ভয়ভীতি।[৪] আল্লাহর ভয়, আল্লাহভীতি, পরহেজগারী, দ্বীনদারি, ধার্মিকতা ইত্যাদি।[৫] সাধারণ অর্থে আল্লাহভীতিকে ‘তাক্বওয়া’ বলা হয়। শারঈ অর্থে- আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর নির্র্দেশিত ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনা করা, জীবনের কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার হুকুম যেন লংঘিত না হয়, এরকম সতর্কতার  সাথে চলার নামই তাক্বওয়া। ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তাক্বওয়া’ হল,

فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ

‘আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা প্রতিপালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা’।[৬] আবু বকর আল-জাযায়েরী বলেন,

فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ وَرَسُوْلُهُ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ وَرَسُوْلُهُ.

‘তাক্বওয়া’ হল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা আদেশ করেছেন তা প্রতিপালন করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা’।[৭] অতএব তাক্বওয়া হচ্ছে নিষিদ্ধ ও পাপ কাজ হতে বিরত থাকার নাম। অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে সকল পাপাচার, অন্যায়, অত্যাচার, অনাচার, অবিচার এবং এ জাতীয় সকল কাজ হতে নিজেকে বিরত রেখে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুসারে সার্বিক জীবন পরিচালনার নাম ‘তাক্বওয়া’।
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট তাক্বওয়ার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কি কখনও এমন পথ অতিক্রম করেছেন, যেটি খুবই সংকীর্ণ এবং যে পথের দুই দিকেই কাঁটাপূর্ণ গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত? তদুত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তখন বললেন, এমতাবস্থায় আপনি কিভাবে পথ অতিক্রম করেছেন? জবাবে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, খুবই সতর্কতার সাথে কাপড় ও শরীর বাঁচিয়ে সে পথ অতিক্রম করেছি। উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, এটাই ‘তাক্বওয়া’।[৮] অর্থাৎ আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিষেধের ব্যাপারে সর্তকতা অবলম্বন এবং তা থেকে বিরত থাকার নাম তাক্বওয়া। আর মুত্তাক্বী হল ‘যারা শিরক এবং মূর্তি পূজা থেকে দূরে থাকে এবং ইবাদতকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ট করে’।[৯]
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় হল তাক্বওয়া অর্জন। কেননা মানুষের ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনে ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন সম্পূর্ণরূপে তাক্বওয়ার উপর নির্ভরশীল। তাক্বওয়া ব্যতীত কোন ব্যক্তির পক্ষে দুনিয়াতে সৎ ও কল্যাণকর কাজ সম্পাদন করা ও পরকালে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ মানব মন সর্বক্ষণ অসৎ ও অনিষ্টকর কার্যাদি সম্পাদন করতে প্রলুব্ধ করে এবং আল্লাহদ্রোহীতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّ النَّفۡسَ لَاَمَّارَۃٌۢ بِالسُّوۡٓءِ

‘নিশ্চয় মানব মন সর্বদা অনিষ্টকর কাজ করার জন্য নির্দেশ দেয়’ (সূরা ইউসুফ : ৫৩)।
আর এই নফসকে উদ্ধত আচরণ হতে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাক্বওয়া। কোন ব্যক্তি যখন তার নফসকে নিষ্কলুষ করার উদ্দেশ্যে তাক্বওয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়, তখন নফস তার মজ্জাগত স্বভাব অর্থাৎ অনিষ্টকর কাজের প্রতি নির্দেশ করার যোগ্যতা পরিত্যাগ করে মন্দ কাজের প্রতি তিরস্কার করার যোগ্যতা অর্জন করে। এমতাবস্থায় সে আর মন্দ কাজের প্রতি প্ররোচনা যোগায় না, বরং নফস মন্দ কাজ করতে উদ্যত হলে সে বিরত রাখার জন্য তিরস্কার করতে থাকে। মনের এ অবস্থাকে আল-কুরআনে ‘নফসে লাউওয়ামাহ’(نفس لوامة) অর্থাৎ ‘তিরস্কারকারী মন’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ لَاۤ اُقۡسِمُ بِالنَّفۡسِ اللَّوَّامَۃِ

‘আরো শপথ করছি তিরস্কারকারী আত্মার’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ৫৩)।
যখন কোন ব্যক্তি নফসের এ অবস্থার প্রতি সন্তুষ্ট না হয়ে তাকে আরও সঠিক এবং নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস অব্যাহত রাখে, তখন নফস তিরস্কারের স্তর অতিক্রম করে এমন স্তরে উপনীত হয় যে, সেখানে সে প্রশান্ত ও নিরুদ্বেগ মন-মানসে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় সে শুধু সৎ ও কল্যাণকর কাজের প্রতি অনুপ্রেরণা প্রদান করতে থাকে। মনের এ অবস্থাকে আল-কুরআনে (نفس مطمئنة) ‘নফসে মুত্বমাইন্নাহ’ অর্থাৎ ‘প্রশান্ত মন’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও প্রিয়পাত্র হয়ে। অনন্তর তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (সূরা আল-ফজর : ২৭)।

৩. ইবাদতকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করা
ইবাদত অর্থ অনুগত হওয়া, অবনত হওয়া।[১০] আভিধানিক অর্থে ইবাদত হল অবনত হওয়া, অনুগত হওয়া, আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যে আত্মসমর্পণ করা, তাঁর নিষেধকে বর্জন করা, তাঁর নৈকট্য লাভ করা, তাঁর প্রতিদানের আশা করা, তাঁর ত্রেুাধ ও শাস্তির ব্যাপারে সর্তক থাকা ইত্যাদি।[১১] আল্লাহর নিকটে বিনয়, নম্রতা ও বশ্যতা স্বীকার করা। আল্লাহকে সর্বাধিক ভালবেসে তাঁর নিকট নত হওয়া এবং তাঁর বশ্যতা স্বীকার করাই ইবাদত।[১২]
শরী‘আতের পরিভাষায় ইবাদত হচ্ছে আল্লাহকে একক জেনে তাঁর নিকট অবনত হওয়া এবং ঐ কর্মের প্রতি আত্মসমর্পণ করা, যার ব্যাপারে তিনি আদেশ করেছেন এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা।[১৩] এছাড়া আল্লাহ তা‘আলা ভালবাসেন এবং পসন্দ করেন এমন সব প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজের নাম ইবাদত।[১৪] শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেছেন,

العبادة إسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأعمال والأقوال الأفعال الظاهرة الباطنة

‘ইবাদত এমন কতগুলো প্রকাশ্য ও গোপনীয় কাজ, কথা এবং আমলের নাম, যা আল্লাহ ভালবাসেন ও তাতে সন্তুষ্ট থাকেন’।[১৫] তিনি আরো বলেন,

هى طاعة الله بإمتثال ما أمر الله به على ألسنة الرسل

‘ইবাদত হল রাসূলগণের দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী আল্লাহর নির্দেশিত যাবতীয় ব্যাপারে আনুগত্য করা’।[১৬]
ইবাদতের প্রকার অনেক। তার মধ্যে অন্যতম হল- ছালাত, ছিয়াম, দু‘আ, কুরবানী, ভয়, তাওয়াক্কুল, ইস্তিগফার, ইনাবাহ, আশ্রয়, জিহাদ ইত্যাদি। এগুলো যখনই একক ইলাহ অর্থাৎ আল্লাহর জন্য করা হবে এবং অন্য মা‘বূদের জন্য নাকচ করা হবে তখনই তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত হবে। আর যদি আল্লাহর জন্য ইবাদত করা হয় এবং অন্যান্যদের জন্যও ইবাদত করা হয়, তাহলে (কালেমার রুকন অনুপস্থিত থাকার কারণে) সে কাফির-মুশরিকে পরিণত হবে। যদিও সে মুখে তা উচ্চারণ করে থাকে।[১৭] যেমন ছালাত। ছালাত একটি ইবাদত। তাওহীদ হল- মুসলিম ব্যক্তি ছালাতকে আল্লাহর জন্য আদায় করবে এবং অন্য কার জন্য আদায় করবে না। ছালাত যখন একক মা‘বূদ আল্লাহর জন্য আদায় করবে এবং অন্য কোন মা‘বূদের জন্য আদায় করাকে নাকচ করবে, তখন সে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করল। আর যদি সে আল্লাহর জন্য ছালাত আদায় করে এবং অন্যান্য মা‘বূদের জন্যও ছালাত আদায় করে, তাহলে সে কাফির-মুশরিকে পরিণত হবে। যদিও সে মুখে তা উচ্চারণ করে থাকে।
এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা ইবাদতকে তাঁরই জন্য একনিষ্ঠ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَاعۡبُدِ اللّٰہَ مُخۡلِصًا لَّہُ الدِّیۡنَ

‘অতএব আল্লাহর ইবাদত কর তাঁরই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে’ (সূরা আয-যুমার : ২)।
অন্যদিকে ইবাদত যদি তাঁরই জন্য একনিষ্ঠ না হয় তাহলে আমল হবে মূল্যহীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُوْرً

‘আমরা তাদের কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণারূপে করে দিব’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ২৩)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু হাজার হাইছামী (৯০৯-৯৭৪ হি./১৫০৪-১৫৬৭ হি.) বলেছেন,

اَلْأَعْمَالُ الَّتِيْ قُصِدَ بِهَا غَيْرُ اللهِ تَعَالَى يَبْطُلُ ثَوَابُهَا صَارَتْ كَالْهَبَاءِ الْمَنْثُوْرِ

‘ঐ সমস্ত আমল যেগুলো আল্লাহ ছাড়া অন্যের উদ্দেশ্যে করা হয়, সেগুলোর ছওয়াব বাতিল হবে এবং তা হবে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণার মত’।[১৮] আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

مُنِيْبِيْنَ إِلَيْهِ وَاتَّقُوْهُ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَلَا تَكُوْنُوْا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ

‘বিশুদ্ধ চিত্তে তাঁর অভিমুখী হয়ে তাকে ভয় কর, ছালাত কায়েম কর এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (সূরা আর-রূম : ৩১)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

أن العبادة لا تنفع إلا مع الإخلاص

‘নিশ্চয় ইখলাছ শূন্য ইবাদত কোন উপকারে আসবে না’।[১৯]
অতএব ইবাদতকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ না করার পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। ইখলাছ বিহীন প্রদর্শনেচ্ছা ও লোকশ্রুতির উদ্দেশ্যে কৃত কোন আমল আল্লাহ কবুল করবেন না। এমনকি তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত লাঞ্ছিত ও অপমানকর অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।[২০] তাছাড়া ইখলাছ বিহীন আমল বাতিল বলে গণ্য হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

إِنَّ اللهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ

‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল কবুল করবেন না, যদি তাঁর জন্য তা খালেছ হৃদয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য না করা হয়’।[২১]
অন্যদিকে ইবাদতকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করার একমাত্র প্রতিদান জান্নাত লাভ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘কিন্তু যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে ও সংশোধিত হয় এবং আল্লাহকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে ও আল্লাহর জন্য তাদের দ্বীনকে বিশুদ্ধ করে। বস্তুত তারাই মুমিনদের সঙ্গী এবং অচিরেই আল্লাহ মুমিনদেরকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করবেন’ (সূরা আন-নিসা : ১৪৬)। উক্ত আয়াতে ‘উত্তম প্রতিদান’ বলতে জান্নাতকে বুঝানো হয়েছে।[২২] অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তবে তারা নয়, যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা’, তাদের জন্য রয়েছে নির্ধারিত রিযিক- ফলমূল এবং তারা হবে সম্মানিত; থাকবে নে‘মতপূর্ণ জান্নাতে’ (সূরা আছ-ছাফফাত : ৪০-৪৩)।

* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
১. ছহীহ বুখারী, হা/১৪, ৪৩৫১, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬১; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৪।
২. ছহীহ বুখারী, হা/১৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৪।
৩. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬৩২।
৪. ইবন মানযূর, লিসানুল আরব, ১ম খণ্ড (কায়রো : দারুল হাদীছ, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৬১৫।
৫. ইবরাহীম মুছত্বফা ও সাথীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (ইস্তাম্বুল, তুরস্ক : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, তা.বি.), পৃ. ১০৫২; ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ৫ম সংস্করণ, ২০০৩), পৃ. ২১৯।
৬. মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ, আত-তাক্বওয়া (জেদ্দা : মাজমূ‘আ যাদ, ১৪৩০ হি.), পৃ. ৭।
৭. জাবির ইবনু আবু বকর আল-জাযায়েরী, আইসারুত তাফাসীর লি-কালামিল উ‘লা আল-কাবীর (মদীনা মুনাওয়ারা : মাকতাবাতুল ‘উলূম ওয়াল হিকাম, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৪ হি./২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৫৮৬।
৮. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (দারু তাইয়েবা, ১৪২০ হি.), ১ম খ-, পৃ. ১৬৪।
৯. প্রাগুক্ত।
১০. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১০ম খণ্ড, পৃ. ১৫৩; কালিমার মর্মকথা, পৃ. ৭৭।
১১. আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ লিল-বুহূছ আল-ইলমিইয়া ওয়াল-ইফতা, সংগ্রহ ও বিন্যাস : শাইখ আহমাদ ইবন আব্দুর রাযযাক আদ-দুয়াইশ (রিয়াদ : দারুল ‘আছিমাহ, ৩য় সংস্করণ, ১৪১৯ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৬।
১২. আক্বীদাতুত তাওহীদ, পৃ. ৫৬।
১৩. আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ লিল-বুহূছ আল-ইলমিইয়া ওয়াল-ইফতা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৬।
১৪. কিতাবু উসূলিল ঈমান ফী যূইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, পৃ. ৩৪।
১৫. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১০ম খণ্ড, পৃ. ১৪৯; মাজমূঊল ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১৮।
১৬. আহমাদ ইবনু হাজার আল-বাত্বামী আলী ইবনু আলী, তাতহীরুল জিনান ওয়াল ফুরকান ‘আন দারানিশ শিরকি ওয়াল কুফরান (কুয়েত : দারুস সালাফিয়া, ১১তম সংস্করণ, ১৯৮৪ হি.), পৃ. ১৬।
১৭. আল-জামে‘ঊল মুফীদ লি-দুরুসি তা‘আল্লুমিত তাওহীদ, পৃ. ১২৩।
১৮. আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু হাজার আল-হায়তামী, আয-যাওয়াজিরু আন ইক্বতিরাফিল কাবাইর (দারুল ফিকর, ১৪০৭ হি./১৯৮৭ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৯।
১৯. আল-জামে‘ঊ লি আহকামিল কুরআন, ১৪ তম খণ্ড, পৃ. ৩২।
২০. তিরমিযী, হা/২৩৮২; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪০৮; সনদ ছহীহ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২২ ।
২১. নাসাঈ, হা/৩১৪০, সনদ ছহীহ।
২২. মুহাম্মাদ আলী আছ-ছাবূনী, ছাফওয়াতুত তাফাসীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ২০৩।




প্রসঙ্গসমূহ »: তাওহীদ দাওয়াত
রামাযানে দান-ছাদাক্বাহ - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৪র্থ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৫ম কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
হজ্জ ও ওমরার সঠিক পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৮ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৫ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২৪তম কিস্তি)   - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ