ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ
-ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন*
(৩য় কিস্তি)
৪). ‘আদালত
‘আদালত শব্দটি ‘আদ্ল থেকে নির্গত। যার মূল অর্থ হলো সত্যনিষ্ঠা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ইনছাফ-প্রীতি, আমানত ও ভারসাম্য ইত্যাদি। তবে শরী‘আতের পরিভাষায় এ শব্দটি অনেকগুলো গুণের সমাহার। আর সেগুলো হল, ফরয কর্তব্যগুলো পালন, উৎকৃষ্ট চরিত্র লালন, নিকৃষ্ট চরিত্র বর্জন, নিচুতা ও ছোটলোকি থেকে দূরে অবস্থান, পাপাচার থেকে বিরত থাকা এবং মুরুওত অর্থাৎ উন্নত স্বভাবযুক্ত হওয়া, মার্জিত আচরণে ব্রত ও প্রশংসনীয় চাল-চলনে অভ্যস্ত থাকা ইত্যাদি। আর এই ‘আদালতের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আছে তাক্ওয়া বা গভীর আল্লাহ্ভীতি, ছালাহ্ বা যথাযথ উপযুক্ততা এবং আমানতদারিতা।[১] আল্লামাহ্ ইবনু খালদূন এ প্রসঙ্গে বলেন :
“وأمَّا العَدالةُ؛ فَلِأنَّه مَنصبٌ دِينِي يَنظُر في سائرِ المَناصِب التي هِي شَرطٌ فِيها، فكانَ أَولَى باشتِراطِها فِيه، ولا خِلافَ في انتِفاءِ العَدالَةِ فِيه بِفِسقِ الجَوارِح مِن ارتكابِ المَحظُوراتِ وأمثالِها”
“আর ‘আদালত, এটা এজন্য শর্ত যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এমন এক দ্বীনী পদ যে, সে পদটি অন্যান্য সকল পদকে দেখা শুনা করে যেগুলোর জন্যও ঐ ‘আদালত শর্ত। সুতরাং এ শর্ত তার মধ্যে পাওয়া যেতে হবে- এটাই স্বাভাবিক। আর নিষিদ্ধ ও তৎসমতুল্য কার্যাবলীর মাধ্যমে অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গের ফাসেকী সংঘটিত করলে তার ‘আদালত বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”[২] শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ এ বিষয়ে বলেন :
وذَكر الفُقهاء: “أنّ العَدالةَ هي الصَلاحُ في الدِّينِ والمُروءَةُ؛ باستِعمالِ ما يُجَمِّلُه ويُزيِّنه وتَجنّب ما يُدنِّسُه و يَشِينُه”
“ফকীহ্গণ উল্লেখ করেছেন যে, ‘আদালত হলো, দ্বীনের ক্ষেত্রে যথার্থ পূর্ণাঙ্গতা ও উপযুক্ততা এবং মুরুওত (প্রশংসনীয় ব্যক্তিত্ব ও আচরণ); এমন কাজগুলো করার মাধ্যমে যা কাউকে আকর্ষণীয় ও নন্দিত করে এবং এমন কাজগুলো বর্জনের মাধ্যমে যা কাউকে কদর্য ও নিন্দিত করে।”[৩] তিনি আরো উল্লেখ করেছেন,
أداءُ الأماناتِ إلى أهلِها والحكمُ بالعَدل: فهَذانِ جماعُ السِّياسة العادِلةِ والوِلايةِ الصالِحَة”. وقال أيضاً: “والقوَّةُ في الحُكمِ بَينَ الناسِ والعِلمُ بالعدلِ الذي دَلّ عَليه الكِتابُ والسُّنّة”
“আমানত যথাস্থানে পৌঁছানো আর ন্যায়ানুগ শাসন-বিচার এই দুইটিই সৎ-রাজনীতি ও সুপ্রশাসনের সমন্বয়ক।”[৪] তিনি আরো বলেন, “(শাসককে) জনগণের মধ্যে সৎ-শাসন পরিচালনার দৃঢ়শক্তি এবং ন্যায়ের জ্ঞান থাকতে হবে, যে ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহ’র দলীল বিদ্যমান রয়েছে।”[৫] যার মধ্যে গভীর আল্লাহ্-ভীতি, আত্মসংশোধনের ইচ্ছা, আমানতদারি, সত্যনিষ্ঠা, মানসিক দৃঢ়তা ও মার্জিত রুচিবোধ ইত্যাদি নেই, তিনি ইসলামী জামা‘আত সংগঠনের নেতৃত্বের যোগ্য হতে পারেন না।
আমানতদারি মূলত আদালতের সাথে সম্পৃক্ত হলেও এটি নেতৃত্বের এমন এক অবিচ্ছেদ্য গুণ যা কিছুটা আলাদা অলোচনার দাবি রাখে। আমানতদারি না থাকলে তার জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করতে যাওয়া উচিত নয় এবং তাকে কোন দায়িত্ব দেয়াও সঠিক নয়। আল্লাহ্ তা’আলা ওয়াহি’র বাহক মালাক (ফেরেস্তা) জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-কে কুরআনে কারীমে একাধিক জায়গায় আমানতদার বলেছেন। যেমন-
وَ اِنَّہٗ لَتَنۡزِیۡلُ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ – نَزَلَ بِہِ الرُّوۡحُ الۡاَمِیۡنُ
“নিশ্চয়ই এই কুরআন সারা সৃষ্টি জগতের রব্-এর প্রেরিত। যা নিয়ে আমানতদার (বিশ্বস্ত) মালাক (ফেরেস্তা) অবতরণ করেছেন।” (আশ্-শু’আরা : ১৯২-১৯৩)।
اِنَّہٗ لَقَوۡلُ رَسُوۡلٍ کَرِیۡمٍ – ذِیۡ قُوَّۃٍ عِنۡدَ ذِی الۡعَرۡشِ مَکِیۡنٍ – مُّطَاعٍ ثَمَّ اَمِیۡنٍ
“নিশ্চয় ইহা সম্মানিত বার্তাবাহক মালাক (ফেরেস্তা)-এর বাহিত বাণী। যিনি (জিবরীল) শক্তিশালী, আরশের মালিকের কাছে সুপ্রতিষ্ঠিত। যিনি সেখানে মাননীয় এবং আমানতদার (বিশ্বস্ত)।” (আত-তাকভীর : ১৯-২১)।
মাদইয়ানের বৃদ্ধ নেককার[৬] ব্যক্তির কন্যা মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর ব্যাপারে তাঁর বাবার কাছে সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন,
اِنَّ خَیۡرَ مَنِ اسۡتَاۡجَرۡتَ الۡقَوِیُّ الۡاَمِیۡنُ
“আপনি যাকে কাজে নিয়োগ করেছেন (ও আশ্রয় দিয়েছেন) তার উত্তম গুণ হলো তিনি শক্তিশালী ও আমানতদার।” (আল-ক্বাছাছ : ২৬)।
আমানত-এর ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ اللّٰہَ یَاۡمُرُکُمۡ اَنۡ تُؤَدُّوا الۡاَمٰنٰتِ اِلٰۤی اَہۡلِہَا وَ اِذَا حَکَمۡتُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ اَنۡ تَحۡکُمُوۡا بِالۡعَدۡلِ اِنَّ اللّٰہَ نِعِمَّا یَعِظُکُمۡ بِہٖ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানতসমূহকে তার হক্দারের কাছে আদায় করে দাও। আর তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচার-ফয়ছালাহ্ করবে তখন তা ন্যায়-নীতির সাথে করবে। আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে উপদেশ দান করেন তা কতই না উত্তম। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মহাশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” (আন্-নিসা : ৫৮)।
ইমাম ইবনু কাছীর ও ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুমাল্লাহ) উল্লেখ করেছেন যে, এই আমানত আল্লাহ’র হক্ ও বান্দার হক্ সহ সকল প্রকার কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত।[৭]
নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে পারিবারিক, আঞ্চলিক ও অন্যান্য সকল প্রকার পিছু টানকে অগ্রাহ্য ও পরিহার করে যথাযোগ্য লোককেই নির্বাচিত করতে হবে। আবার নেতৃত্ব ও দায়িত্ব প্রাপ্তির পর তাঁকে সকল প্রকার পিছুটান ও মোহমুক্ত হয়ে যথাযোগ্যভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। হাদীসে এসেছে,
عَن أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَال قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا ضُيِّعَتْ الْأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ قَالَ كَيْفَ إِضَاعَتُهَا يَا رَسُوْلَ اللهِ! قَالَ إِذَا أُسْنِدَ الْأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন : “যখন আমানত বিনষ্ট করা হবে তখন কিয়ামতের জন্য অপেক্ষা কর।’ প্রশ্নকারী বললেন, কীভাবে আমানত নষ্ট হয়? তখন তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : ‘যখন দায়িত্ব অযোগ্য ব্যক্তির কাছে ন্যাস্ত করা হবে (তখন আমানত নষ্ট করা হবে) তখন ক্বিয়ামতের জন্য অপেক্ষা কর।”[৮] অর্থাৎ তখন আর ভাল বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না এবং তার আশাও করাটাও হবে দুরাশা।
যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমানত বহুভাগে বিভক্ত ও অনেক কিছুর সাথে সম্পৃক্ত। শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বিখ্যাত ‘আস্সিয়াসাহ্ আশ্শার‘ইয়্যাহ্’ গ্রন্থে নেতৃত্ব ও শাসকের জন্য আমানতকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করেছেন।
১. অর্থনৈতিক আমানত : রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির যথাযথ সরক্ষণ, প্রবৃদ্ধি করণ, সুষম ও ন্যায়ানুগ বণ্টন, হিসাব রক্ষণ ইত্যাদি। অপব্যবহার, অবহেলা, কুক্ষিগতকরণ, আত্মীকরণ, আত্মীয়করণ ও ভোগদখল ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকা।
اِنَّ اللّٰہَ یَاۡمُرُ بِالۡعَدۡلِ وَ الۡاِحۡسَانِ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও সদ্ব্যবহার (ও মানবিক আচরণ) করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন।” (আন-নাহল : ৯০)। আল্লাহ্ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন :
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ بِالۡقِسۡطِ شُہَدَآءَ لِلّٰہِ وَ لَوۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ اَوِ الۡوَالِدَیۡنِ وَ الۡاَقۡرَبِیۡنَ اِنۡ یَّکُنۡ غَنِیًّا اَوۡ فَقِیۡرًا فَاللّٰہُ اَوۡلٰی بِہِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الۡہَوٰۤی اَنۡ تَعۡدِلُوۡا وَ اِنۡ تَلۡوٗۤا اَوۡ تُعۡرِضُوۡا فَاِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا
“হে, যারা ঈমান এনেছে! তোমরা ন্যায়ের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহ্’র পক্ষে সাক্ষী হিসাবে। যদি তা তোমাদের নিজেদের কিংবা পিতামাতার এবং নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধেও হয়, সে ধনী হোক বা দরিদ্র; আল্লাহ্ই তাদের অধিক শুভাকাঙ্খী। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা কথার মার-পেঁচের আশ্রয় নাও কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমরা যা কর সে সম্পর্কে খুবই অবগত আছেন।” (আন্-নিসা : ১৩৫)। এ বিষয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা আরো নির্দেশ দিয়েছেন :
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ لِلّٰہِ شُہَدَآءَ بِالۡقِسۡطِ وَ لَا یَجۡرِمَنَّکُمۡ شَنَاٰنُ قَوۡمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعۡدِلُوۡا اِعۡدِلُوۡا ہُوَ اَقۡرَبُ لِلتَّقۡوٰی وَ اتَّقُوا اللّٰہَ اِنَّ اللّٰہَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ
“হে, যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহ’র জন্য ন্যায়ের সাক্ষী হিসাবে সদা দৃঢ়ভাবে কায়েম থাক, আর কোন গোষ্ঠির প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ন্যায়ানুগ ফয়ছালাহ্ থেকে বিরত থাকতে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর! সেটাই তাক্ওয়ার অধিক নিকটবর্তী। আর আল্লাহ্কে ভয় কর! নিশ্চয়ই তোমরা যা কর সে প্রসঙ্গে আল্লাহ্ খুবই ওয়াকিফহাল।” (আল-মায়িদাহ : ৮)।
উল্লেখ্য, আমানতদারী সাংগঠনিক, অর্থনৈতিক, বাচনিক এমনকি দায়িত্বশীল ও কর্মীদের পারস্পরিক সম্মান বোধের সাথেও সম্পৃক্ত। সাংগঠনিক সিষ্টেম লস, চ্যানেল মিস, নেটওয়ার্ক নষ্ট ও আচরণ ভঙ্গও কোন কোন সময় আমানতদারীর মধ্যে পড়ে যায়। অনেক সময় এ জাতীয় বিচ্যুতি অতি আবেগ, ক্রোধ, ভুল বুঝাবুঝি ও অসাবধানতা বসতই হয়ে থাকে। কিন্তু স্বেচ্ছায় বা অবহেলায় যদি এগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের জন্য তা মরণব্যাধির বার্তাবাহক। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে শূরা অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
নেতার নেতৃত্বের প্রতি সর্বজনীন শ্রদ্ধার একটি বড় ভিত্তিই হলো ইনছাফ। আর এই ইনছাফ কর্মীদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা, তাদের যোগ্যতার কদর করা, ত্যাগের স্বীকৃতি দেয়া, তাদের মূল্যায়ন করা, গুরুত্ব দেয়া, নেতৃত্ব ও দায়িত্ব বণ্টন যথাযথ ভাবে করা, হক্ ও প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া ইত্যাদি বহু কিছুর সাথে জড়িত।[৯]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।