বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২১ অপরাহ্ন

 চোগলখোরী করা ও তার পরিণাম

-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর* 



চোগলখোর হচ্ছে একজনের কোনো কথা অন্যজনের কাছে লাগানো। সেখানে উদ্দেশ্য থাকবে উভয়ের মধ্যে ফিতনা বা বিরোধ সৃষ্টি করা। এরূপ কর্ম ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। এই চোগলখোরী করা কাবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এমন জঘন্য কর্মের জন্য সমাজে বিশৃঙ্খলা ও কোলাহল বেশি ঘটে থাকে। ছোট কোনো সমস্যা চোগলখোরদের তদবিরে বিশাল আকার ধারণ করে। এদের তথ্য বিভ্রাটের ফলে উভয়ের মধ্যে হিংসা ও বিভেদের জন্ম দেয়। এরূপ বহুবিধ কারণে চোগলখোরী করতে ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। চোগলখোরদের পরিহার করার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, *

وَ لَا  تُطِعۡ  کُلَّ حَلَّافٍ مَّہِیۡنٍ - ہَمَّازٍ مَّشَّآءٍۭ  بِنَمِیۡمٍ - مَّنَّاعٍ  لِّلۡخَیۡرِ مُعۡتَدٍ اَثِیۡمٍ

‘আপনি তার অনুসরণ করবেন না, যে বেশি বেশি কসম খায়, আর যে (বার বার মিথ্যা কসম খাওয়ার কারণে মানুষের কাছে) লাঞ্ছিত। যে পশ্চাতে নিন্দা করে একের কথা অপরের কাছে লাগিয়ে (চোগলখোরী করে) ফিরে। যে ভাল কাজে বাধা দেয়, সীমালঙ্ঘনকারী ও পাপিষ্ঠ’ (সূরা আল-ক্বলম : ১০-১২)।

অত্র আয়াতে পশ্চাতে নিন্দা তথা গীবত ও চোগলখোরী স্বভাবকে ঘৃণ্য অপরাধ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। এ প্রকৃতির লোক নিজেদের কথা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য কথায় কথায় কসম করে থাকে। আল্লাহ এদেরকে এড়িয়ে চলতে বলেছেন। কেননা তাদের দ্বারা সমাজের মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির মধ্যে পতিত হয়।

চোগলখোরের পরিচয়

চোগলখোর কে? কী তার পরিচয়? এমন প্রশ্ন আমাদের মনে জাগাটাই স্বাভাবিক। এদের পরিচয় কী তা ইসলামী শরী‘আতে বহু পূর্বে তুলে ধরেছে। এরা সমাজের জন্য কতটা ক্ষতিকর তাও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ إِنَّ مُحَمَّدًا ﷺ قَالَ أَلَا أُنَبِّئُكُمْ مَا الْعَضْهُ هِىَ النَّمِيْمَةُ الْقَالَةُ بَيْنَ النَّاسِ

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘মিথ্যা ও অপবাদ কী জিনিস আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব না? তা হচ্ছে চোগলখোরী করা। লোকালয়ে কারো সমালোচনা করা’।[১] অন্যত্র রয়েছে-

عَنْ أَبِى الأَحْوَصِ أَنَّ عَبْدَ اللهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ هَلْ أُنَبِّئُكُمْ مَا الْعَضْهُ وَإِنَّ الْعَضْهَ هِىَ النَّمِيْمَةُ الَّتِى تُفْسِدُ بَيْنَ النَّاسِ

আবুল আহওয়াছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব না, ‘আযহা বা চোগলখোরী কী? তা হচ্ছে কুৎসা রটনা করা, যা মানুষের মাঝে শত্রুতার সৃষ্টি করে’।[২]

হাদীছে উল্লেখিত نَمَّامٌ বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে, যে প্রকাশ্যে থেকেই কারো কথা শুনে এবং তা অপরের কাছে পৌঁছে দেয়। গীবত ও চোগলখোর এ উভয় কর্ম হারাম ও নিন্দনীয়। কেননা এতে উদ্দেশ্য থাকে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ সৃষ্টি করা অথবা অনিবার্য কারণেই এতে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া কলহ সৃষ্টি হয়ে যায়। এরূপ কর্ম সম্পূর্ণরূপে হারাম।

ইমাম গাযযালী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যার কাছে গীবত বা পরের কথা নিয়ে কেউ উপস্থিত হবে তার উচিত হল তাকে সত্য বলে না জানা এবং তার কথা বিশ্বাস না করা। আর যার সস্পর্কে যা কিছু বলেছে তা নিয়ে তত্ত্ব অনুসন্ধানে লিপ্ত না হওয়া এবং বহনকারীকে এরূপ কর্মকাণ্ড থেকে বারণ করা। এরূপ কাজকে সে খারাপ জানবে এবং ঘৃণাও করবে, কখনো এরূপ কাজের প্রতি সন্তুষ্ট হবে না’।[৩]

উপরের হাদীছদ্বয়ে চোগলখোরদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। তারা এক প্রকারের মিথ্যুক ও অপবাদ আরোপকারী। তারা একের কথা অন্যকে বলতে গিয়ে নিজের মতো রং মাখিয়ে উপস্থাপন করে। অনেক সময় তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কুৎসা রটনা করে। তারা এসব করে থাকে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েই। উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধানো তাদের মূল লক্ষ্য থাকে। দ্বন্দ্ব বেধে গেলে তারা আনন্দ উপভোগ করে। যা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত নোংরা কাজ। কারো কোনো গোপন কথা শোনার চেষ্টা করাও ইসলামে বৈধ নয়। অন্যকে লাগানো তো বহুদূরের কথা। বরং কারো দোষের কোনো কথা অনাকাক্সিক্ষতভাবে জেনে গেলে তা প্রচার না করে ঢেকে রাখা অনেক ফযীলতপূর্ণ কাজ। তবে যে গোপন সংবাদ প্রচার করলে দ্বীন তথা শরী‘আতের কল্যাণ হবে তা প্রচার করাতে কোনো দোষ নেই।

ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘একজনের গোপন কথা অপরকে বলার মধ্যে যদি দ্বীনের কোনো কল্যাণ নিহিত থাকে, তাহলে তা নিষেধ বা হারাম তো নয়ই বরং প্রকাশ করাটাই মুস্তাহাব। এমনকি কখনো তা ওয়াজিব হয়ে যেতে পারে’।[৪]

চোগলখোর সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি

চোগলখোরী করা অত্যন্ত নিন্দনীয় স্বভাব। কোনো রুচিশীল মানুষ এরূপ কাজে জড়িত হতে পারে না। রুচিহীন নোংরা প্রকৃতির মানুষেরা এমন কাজ করে থাকে। চোগলখোর ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ تَجِدُوْنَ شَرَّ النَّاسِ ذَا الْوَجْهَيْنِ الَّذِيْ يَأْتِيْ هَؤُلاَءِ بِوَجْهٍ وَيَأْتِيْ هَؤُلاَءِ بِوَجْهٍ

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমরা ক্বিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মন্দ লোক ঐ ব্যক্তিকে পাবে, যে দ্বিমুখী স্বভাবের। সে এক মুখ নিয়ে এদের কাছে আসে এবং আরেক মুখ নিয়ে তাদের কাছে যায়’।[৫] অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ غَنْمٍ يَبْلُغُ بِهِ النَّبِىَّ ﷺ خِيَارُ عِبَادِ اللهِ الَّذِيْنَ إِذَا رُءُوْا ذُكِرَ اللهُ وَشِرَارُ عِبَادِ اللهِ الْمَشَّاءُوْنَ بِالنَّمِيْمَةِ الْمُفَرِّقُوْنَ بَيْنَ الأَحِبَّةِ الْبَاغُوْنَ الْبُرَآءَ الْعَنَتَ

আব্দুর রহমান ইবনু গানম ও আসমা বিনতু ইয়াযীদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যাদেরকে দেখলে আল্লাহকে স্মরণ হয়। আর আল্লাহ তা‘আলার নিকৃষ্ট বান্দা তারা, যারা মানুষের পরোক্ষ নিন্দা করে বেড়ায় তথা চোগলখোরী করে, বন্ধুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং পূত-পবিত্র লোকদের পদস্খলন প্রত্যাশা করে’।[৬]

চোগলখোর ব্যক্তিকে ইসলামে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত হিসাবে ধরা হয়েছে। তারা আল্লাহর নিকট সর্ব নিকৃষ্ট ব্যক্তি। তারা যে কাজে জড়িত হয় তা কোনো বিবেকবান মানুষ করতে পারে না। এরূপ কর্ম দ্বারা তারা খুব নোংরা পরিকল্পনা এঁটে থাকে। এর মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে বিভেদ ও শত্রুতা তৈরি করে। তাছাড়া তারা অনেক ভালো মানুষকে ফাঁসিয়ে ছাড়ে। তারা পরহেযগার মানুষেরও পদস্খলন কামনা করে। তারা এরূপ কর্মে পুরোটাই অন্যায় পথে ব্যয় করে।

চোগলখোর জান্নাতে যাবে না

চোগলখোর ব্যক্তিকে ইহকালে মানুষ সম্মান করে না। বরং সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। আর পরকালে তারা সুখে থাকার সুযোগও পাবে না।

عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ نَمَّامٌ

হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[৭]

যারা চোগলখোরী করে বেড়ায় তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। কেননা তারা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার নিকট ঘৃণিত ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত। যাদের তিনি ঘৃণা করেন তারা কিভাবে তাঁর নে‘মত ভোগ করার সুযোগ পাবে। চোগলখোররা যে কাজে জড়িত থাকে তাতে তারা মানুষের কাতারে পড়ে না। তাদের জন্য সমাজে অনেক সমস্যা তৈরি হয়। তাই তাদের শেষ পরিণতিও খুবই খারাপ।

চোগলখোরের ভয়াবহ শাস্তি

চোগলখোরদের ভয়াবহ শাস্তির কথা হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।

عَنْ عَمَّارِ بْنِ يَاسِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ مَنْ كَانَ ذَا وَجْهَيْنِ فِي الدُّنْيَا كَانَ لَهُ لِسَانَانِ مِنْ نَارٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

আম্মার ইবনু ইয়াসার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে দ্বিমুখী স্বভাবের, ক্বিয়ামতের দিন তার (মুখে) আগুনের দু’টি জিহ্বা লাগানো হবে’।[৮]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ مَرَّ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ عَلَى قَبْرَيْنِ فَقَالَ إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِىْ كَبِيْرٍ أَمَّا هَذَا فَكَانَ لَا يَسْتَتِرُ مِنْ بَوْلِهِ وَأَمَّا هَذَا فَكَانَ يَمْشِى بِالنَّمِيْمَةِ

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দু’টি কবরের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় এ দু’জন কবরবাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তবে বড় কোনো গুনাহের কারণে নয়। একজন পেশাব করার সময় সর্তক থাকত না। আর অপরজন মানুষের চোগলখোরী করে বেড়াত’।[৯]

হাদীছদ্বয়ে চোগলখোরদের শাস্তির চিত্র ফুটে উঠেছে। তাদেরকে কবরেই ভয়াবহ শাস্তি দেয়া আরম্ভ হয়। যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অহী মারফতে জানতে পেরেছিলেন। তাছাড়া জাহান্নামে তাদের কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে। তারা দ্বিমুখী স্বভাবের হওয়ার দরুন ক্বিয়ামতের দিন তাদের মুখের ভিতর আগুনের দু’টি জিহ্বা স্থাপন করা হবে। যা তাদেরকে সারাক্ষণ প্রজ্জ্বলিত করতে থাকবে। বিষয়টি একটু গভীরভাবে ভাবলে যে কেউ আঁতকে উঠতে বাধ্য হবেন। প্রথমত : জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চেয়ে ৬৯ গুণ অধিক উত্তাপ সম্পন্ন।[১০]

দ্বিতীয়ত : ‘জাহান্নামীদের মধ্যে সবচেয়ে হালকা শাস্তি ঐ ব্যক্তির হবে যাকে আগুনের ফিতাসহ দু’টি জুতা পরানো হবে। এতে তার মাথার মগজ এমনভাবে ফুটতে থাকবে যেমন জ্বলন্ত চুলার উপর তামার পাত্র ফুটতে থাকে। সে মনে করবে তার চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কেউ ভোগ করছে না। অথচ সেই হবে জাহান্নামে সহজতর শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি’।[১১]

এক্ষণে একটু মনোযোগ দিয়ে ভাবা প্রয়োজন যে, একজন জাহান্নামীকে আগুনের জুতা ও জুতার ফিতা পরানো হবে। এতে তার মাথার মগজ পর্যন্ত টগবগ টগবগ করে ফুটতে থাকবে। মাথার মগজ থেকে জুতা তথা পায়ের দূরত্ব অনেক নিচে। তা-ই মাথার মগজ ফুঠছে। আর চোগলখোরের মাথার মগজের সামান্য নিচেই আগুনের দু’টি জিহ্বা লাগানো হবে। তাহলে সেদিন তার কী অবস্থা হবে? অত্যন্ত কঠিন এ শাস্তির চিন্তা করে হলেও চোগলখোরী পন্থা ছেড়ে দেয়া উচিত।

কারো মুখের উপরে প্রশংসা করাও অন্যায়

কারো মুখের উপর অতিরিক্ত প্রশংসা করাও ইসলামে বৈধ নয়। এরূপ তোষামোদী করার কারণে ঐ ব্যক্তির হৃদয়ে অহংকার সৃষ্টি হয়। তাই এমন কাজ ইসলামে নিষেধ। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-

عَنِ الْمِقْدَادِ بْنِ الْأَسْوَدَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِذَا رَأَيْتُمُ الْمَدَّاحِيْنَ فَاحْثُوْا فِىْ وُجُوْهِهِمُ التُّرَابَ

মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্ল­াহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যখন তোমরা অত্যধিক প্রশংসাকারীদের দেখবে, তখন তাদের মুখে মাটি নিক্ষেপ করবে’।[১২]

عَنْ أَبِىْ بَكْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَثْنَى رَجُلٌ عَلَى رَجُلٍ عِنْدَ النَّبِىِّ ﷺ فَقَالَ وَيْلَكَ قَطَعْتَ عُنُقَ أَخِيْكَ ثَلَاثًا مَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَادِحًا لَا مَحَالَةَ فَلْيَقُلْ أَحْسِبُ فُلَانًا وَاللهُ حَسِيْبُهُ وَلَا أُزَكِّى عَلَى اللهِ أَحَدًا

আবূ বাকরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর সম্মুখে আরেক ব্যক্তির প্রশংসা করল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমার অমঙ্গল হোক। তুমি তো তোমার ভাইয়ের গলা কেটে দিলে। এই কথাটি তিনি তিনবার বললেন। তারপর বললেন, যদি তোমাদের কেউ কারও প্রশংসা করতে হয়, তখন এইরূপ বলবে, আমি অমুক ব্যক্তি সম্পর্কে এইরূপ ধারণা পোষণ করি। তবে প্রকৃত অবস্থা আল্ল­াহ জানেন। আর ইহাও তখন বলবে যখন প্রকৃতভাবে বিশ্বাস করবে যে, ঐ ব্যক্তি এইরূপ। আর কারও পূত-পবিত্রতা বর্ণনায় আল্লাহ তা‘আলার উপর বাড়াবাড়ি করবে না।[১৩]

উপরিউক্ত হাদীছদ্বয়ে কারো প্রশংসায় অতিরঞ্জণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। সামনা সামনি প্রশংসাকারী প্রকারন্তরে ঐ ব্যক্তির ক্ষতিই করে থাকে। তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। তাই এরূপ কাজকে ইসলামে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। মূলত চোগলখোর ব্যক্তিরা প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতে পটু। তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আত্মপক্ষের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়ে। আর অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তার প্রশংসামূলক কথা শুনতে খুব পছন্দ করে। ভক্তদের নিকট থেকে প্রশংসা শুনে ফুলে ফেঁপে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। প্রশংসাকারীর উপর খুশি হয়ে যায়। তার সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করে দেয়ার চেষ্টা করে। ফলে তার প্রমোশন কিংবা স্থায়িত্ব নিশ্চিত হতে থাকে। প্রশংসাপ্রিয় ব্যক্তির এই দুর্বলতাকে তখন তার অধিনস্তরা মোক্ষম সুযোগ হিসাবে কাজে লাগায়। শুরু হয় তোষামদ, চাটুকারিতা, চামচামী, চাপাবাজি ও প্রশংসায় অতিরঞ্জনের প্রতিযোগিতা। ফলে প্রকৃত হক্বদার তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আর চাটুকার ও দোষামদকারীরা হক্বদার না হয়েও খুব সহজেই স্বার্থ হাছিল করে আনন্দ উপভোগ করে। এসব বহুবিধ কারণে ইসলামে মুখের উপর প্রশংসা করতে উৎসাহ দেয়নি।

সুধী পাঠক! ইসলাম মানুষের জন্য সবর্দা কল্যাণকর সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। মানুষকে সকল প্রকার অমঙ্গল থেকে বাঁচানোর দিক নির্দেশনা প্রদান করে। চোগলখোরী স্বভাব উভয় জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে। পক্ষ-প্রতিপক্ষ উভয়ই এদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এমন নিচু মনের কাজ বর্জন করা অপরিহার্য কর্তব্য। কেননা সত্য মানুষকে মুক্তি দেয়। আর মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِنَّ الصِّدْقَ بِرٌّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِيْ إِلَى الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيْقًا وَإِنَّ الْكَذِبَ فُجُوْرٌ وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِيْ إِلَى النَّارِ وَإِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ كَذَّابًا

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘নিশ্চয় সত্যবাদিতা একটি পুণ্যময় কাজ। আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্যের উপর দৃঢ় থাকে তাকে আল্লাহর খাতায় সত্যনিষ্ঠ বলে লিখে নেয়া হয়। পক্ষান্তরে মিথ্যা হচ্ছে পাপকাজ। পাপাচার জাহান্নামের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তাকে আল্লাহর খাতায় মিথ্যুক বলে লিখে নেয়া হয়’।[১৪]

عَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدَبٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فِىْ حَدِيْثِ الرُّؤْيَا قَالَ قَالَ لِيْ... وَأَمَّا الرَّجُلُ الَّذِى أَتَيْتَ عَلَيْهِ يُشَرْشَرُ شِدْقُهُ إِلَى قَفَاهُ وَمَنْخِرُهُ إِلَى قَفَاهُ وَعَيْنُهُ إِلَى قَفَاهُ فَإِنَّهُ الرَّجُلُ يَغْدُو مِنْ بَيْتِهِ فَيَكْذِبُ الْكَذْبَةَ تَبْلُغُ الآفَاقَ

সামুরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বপ্নের ঘটনায় বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, তারা উভয় (ফেরেশতাগণ) আমাকে প্রশ্ন করলেন যে, সর্বপ্রথম আপনি যেদিক দিয়ে অতিক্রম করেছেন, যার জিহ্বা, নাক ও চোখ ঘাড় পর্যন্ত বিদীর্ণ করা হচ্ছিল সে হল ঐ ব্যক্তি, যে সকালে ঘর থেকে বের হতো এবং মিথ্যা সংবাদ প্রচার করতে থাকত। যা পুরা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ত।[১৫]

যারা চোগলখোরীর মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করছে তাদের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। ইহকালে আল্লাহ তাদেরকে মানুষের কাছে লাঞ্ছিত করবেন। আর পরকালে তাদের জন্য ভয়ংকর শাস্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। তাছাড়া এরূপ নোংরামী করতে করতে তারা এক সময় চোগলখোর হিসাবে সমাজে চিহ্নিত হয়ে যায়। তখন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অভিশাপও তাদের ঘাড়ে চাপতে থাকে। সকলেই তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে। সাক্ষাতে কিছু বলতে না পারলেও আড়ালে ঠিকই তাকে অভিশাপ দেয়। ফলে তাকে মানুষের কাছে মান-সম্মান হারাতে হয়। তার পরিবারের লোকদেরকেও লাঞ্ছিত হতে হয়। চোগলখোর পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে তারা মর্যাদার সাথে সমাজে চলতে পারে না। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে এ সকল নিন্দনীয় স্বভাব বর্জন করা উচিত। পরিহারের দৃঢ় মনোবল নিয়ে অগ্রসর হলে বাকিটা আল্লাহ সহজ করে দিবেন। ইনশা আল্লাহ!

* পরিচালক, ইয়াসিন আলী সালাফী কমপ্লেক্স, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪১৬০; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১১১০৩; ছহীহুল জামে‘, হা/২৬৩০।
[২]. দারেমী, হা/২৭১৫; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৭৮৭১; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৮৪৬, সনদ ছহীহ।
[৩]. ফাৎহুল বারী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৪৭৩; শারহুন নববী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১২।
[৪]. শারহুন নববী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১২।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৯৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৮; মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৩৬৩৩; আবূ দাঊদ, হা/৪৮৭২; তিরমিযী, হা/২০২৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৩৩৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৭৫৭; ত্বাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৫০৮৫; মিশকাত, হা/৪৮২২।
[৬]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮০২৭; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৮২৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হা/১৩১৩৯; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৮৪৯; মিশকাত, হা/৮৪৭১, সনদ হাসান লিগাইরিহী।
[৭]. ছহীহ  মুসলিম, হা/১০৫; তিরমিযী, হা/২০২৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৩৭৩; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১১১০১; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৮২১; মিশকাত, হা/৪৮২৩।
[৮]. দারেমী, হা/২৭৬৪; আদাবুল মুফরাদ, হা/১৩১০; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৭৫৬; ত্বাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৬৬৮৫; মিশকাত, হা/৪৮৪৬, সনদ হাসান।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯২; নাসাঈ, হা/২০৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৮০; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩১২৮; দারেমী, হা/৭৩৯; মিশকাত, হা/৩৩৮।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৪৩; তিরমিযী, হা/২৫৮৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮১১১।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৯; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৬৪; মিশকাত, হা/৫৬৬৭।
[১২]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩০০২; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৩৪০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৮৭৪; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৭৭০; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/২৪৯৩; মিশকাত, হা/৪৮২৬।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৬২; মিশকাত, হা/৪৮২৭।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৯৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০৭; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৮৯; তিরমিযী, হা/১৯৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪১০৮; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/২৭৩; দারেমী, হা/২৭১৫; মুসতাদরাকে হাকেম, হা/৪৪০; মিশকাত, হা/৪৮২৪।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৭৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০১০৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬৫৫।




প্রসঙ্গসমূহ »: পাপ আত্মশুদ্ধি
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের  হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৫ম কিস্তি)  - আব্দুল গাফফার মাদানী
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (২য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
মাদক : সুশীল সমাজ ধ্বংসের অন্যতম হাতিয়ার - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মেসবাহুল ইসলাম
ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ধারা (২য় কিস্তি) - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৭ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ (শেষ কিস্তি) - ড. মেসবাহুল ইসলাম

ফেসবুক পেজ