বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১২:১৯ পূর্বাহ্ন

ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের ঈমান বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ঈমান : একটি পর্যালোচনা

-ড. আব্দুল্লাহিল কাফী বিন লুৎফর রহমান মাদানী*


(শেষ কিস্তি) 

মাসআলা-২ : কাবীরা গুনাহগার ব্যক্তির হুকুম।

ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, আমল পরিপূর্ণ না হলে অথবা কাবীরা গুনাহ করলে ঈমান সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে যায় এবং কাফের হয়ে যায় বলে খারেজীদের বিশ্বাস। যার ফলে দুনিয়ায় তাদের রক্ত হালাল এবং আখেরাতে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। মু‘তাযিলারাও একই আক্বীদাহ পোষণ করে, তবে দুনিয়ায় মুসলিম বা কাফের কোনটিই তারা বলে না। বরং এ দুইয়ের মাঝে একটি স্তর আছে বলে তাদের দাবী। যে কারণে খারেজীদের মত তাদের রক্ত হালাল বলে মনে করে না।[১]

া যাদের নিকট কাবীরা গুনাহগার ব্যক্তি কাফের তাদের দলীল ও জবাব

(এক) মহান আল্লাহ বলেন, ہُوَ  الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ  فَمِنۡکُمۡ کَافِرٌ وَّ مِنۡکُمۡ  مُّؤۡمِنٌ  ‘তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় কাফের এবং কেউ হয় মুমিন’ (তাগাবুন ২)।

উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ ঈমান এবং কুফরীর মধ্যে কোন হুকুম সাব্যস্ত করেননি। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে, মানুষ হয় মুমিন হবে, নয়তো কাফের। আর আল্লাহ্র অবাধ্য ব্যক্তি কখনো মুমিন হতে পারে না। বিধায় সে কাফের।

(দুই) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, فَرِیۡقٌ فِی الۡجَنَّۃِ  وَ فَرِیۡقٌ فِی السَّعِیۡرِ ‘একদল থাকবে জান্নাতে আরেক দল জলন্ত আগুনে’ (শূরা ৭)।

এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা দু’টি আবাসস্থল নির্ধারণ করে দিয়েছেন। জান্নাত নয়তো জাহান্নাম। আর পাপী ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। তাহলে জাহান্নাম ছাড়া তার আর কোন স্থান নেই।

(তিন) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰہُ مِنَ الۡمُتَّقِیۡنَ  ‘আল্লাহ তো কেবল মুত্তাক্বীদের পক্ষ হতে কবুল করেন’ (মায়েদাহ ২৭)।

কাবীরা গুনাহগার ব্যক্তি মুত্তাক্বী হতে পারে না। আর যে মুত্তাক্বী না, তার আমল আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। অতএব সে কাফের এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামী।

জবাব

ক. আল্লাহ তা‘আলা কাবীরা গুনাহগার ব্যক্তিকে দ্বীন থেকে খারিজ করে দেননি। তবে কাবীরা গুনাহর কারণে তার ঈমান হ্রাস পাবে। কারণ মহান আল্লাহ কাবীরা গুনাহগার ব্যক্তিকে ‘মুমিন’ বলে অভিহিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِنۡ طَآئِفَتٰنِ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اقۡتَتَلُوۡا فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَہُمَا فَاِنۡۢ  بَغَتۡ اِحۡدٰىہُمَا عَلَی الۡاُخۡرٰی فَقَاتِلُوا الَّتِیۡ تَبۡغِیۡ  حَتّٰی تَفِیۡٓءَ  اِلٰۤی  اَمۡرِ اللّٰہِ.

‘মুমিনদের দু’দল যদি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে; যদি তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে তবে তোমরা বাড়াবাড়িকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহ্র নির্দেশের দিকে ফিরে আসে’ (সূরা আল-হুজুরাত : ৯)। উক্ত আয়াতে লড়াই করা কাবীরা গুনাহ হওয়া সত্ত্বেও ‘মুমিন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ আরো বলেন,   فَمَنۡ عُفِیَ لَہٗ مِنۡ اَخِیۡہِ شَیۡءٌ فَاتِّبَاعٌۢ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ‘তবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কোন ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে যথাযথ বিধির অনুসরণ করা’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭৮)।

উক্ত আয়াতে হত্যাকারীকে (হত্যার মত নিকৃষ্ট কাবীরা গুনাহ করা সত্ত্বেও) নিহত ব্যক্তির ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এ ভ্রাতৃত্ব ঈমানী ভ্রাতৃত্ব। অতএব বুঝা গেল, কাবীরা গুনাহগার ব্যক্তি কাফের হয় না। বরং তার ঈমান বলবৎ থাকে।

খ. কাবীরা গুনাহর কারণে কেউ কাফের হয়ে যায় না। কারণ কোন কাবীরা গুনাহগার ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তওবাহ করে নতুন ভাবে ঈমান আনতে বলেছেন বলে তাঁর থেকে প্রমাণিত হয়নি।

গ. কাবীরা গুনাহগার ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে কুফরীর কথা এসেছে সেটি ছোট কুফরী, বড় কুফরী নয়, যা ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। কারণ আমরা জানি চুরি করা, ব্যভিচার করা কাবীরা গুনাহ। কিন্তু ইসলামে চুরির শাস্তি হাত কাটা এবং ব্যভিচারের শাস্তি রজম করা। সুতরাং কাবীরা গুনাহের কারণে কেউ কাফের হয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চোরকে, ব্যভিচারকারীকে হত্যার নির্দেশ দিতেন। কারণ তিনি বলেছেন, مَنْ بَدَّلَ دِيْنَهُ فَاقْتُلُوْهُ ‘যে ব্যক্তি দ্বীন পরিবর্তন করল, তাকে হত্যা কর’।[২] হাদীছে কুদসীতে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেছেন,

أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِيْ مُؤْمِنٌ بِيْ وَكَافِرٌ فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِيْ كَافِرٌ بِالكَوْكَبِ وَأَمَّا مَنْ قَالَ بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَلِكَ كَافِرٌ بِيْ مُؤْمِنٌ بِالكَوْكَبِ.

‘আমার কিছু সংখ্যক বান্দা বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী হয়ে গেল। যে ব্যক্তি বলে, আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও দয়ায় আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, সে আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী। আর যে ব্যক্তি বলে, অমুক অমুক নক্ষত্র উদয়ের ফলে বৃষ্টি হয়েছে সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী’।[৩] উক্ত হাদীছে কুফরী বলতে ছোট কুফরী বুঝানো হয়েছে। তা না হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে তওবাহ করে নতুন ভাবে ঈমান আনতে বলতেন।

(চার) মহান আল্লাহ বলেন, اِنَّ اللّٰہَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِہٖ وَ یَغۡفِرُ  مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন’ (সূরা আন-নিসা : ৪৮)। হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ كُنَّا نُمْسِكُ عَنِ الِاسْتِغْفَارِ لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ حَتَّى سَمِعْنَا رَسُولَ اللهِ ﷺ يَقُولُ إِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ قَالَ إِنِّي ادَّخَرْتُ دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِي قَالَ فَأَمْسَكْنَا عَنْ كَثِيرٍ مِمَّا كَانَ فِي أَنْفُسِنَا ثُمَّ نَطَقْنَا بَعْدُ وَرَجَوْنَا.

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, আমরা কাবীরা গুনাহকারীর জন্য ইস্তেগফার করা থেকে বিরত থাকতাম। শেষ পর্যন্ত যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এ আয়াত শুনলাম এবং আরো শুনলাম যে, তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার দু‘আকে গচ্ছিত রেখেছি আমার উম্মতের কাবীরা গুনাহগারদের সুপারিশ করার জন্য’। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, এরপর আমাদের অন্তরে যা ছিল, তা অনেকটা কেটে গেল; ফলে আমরা ইস্তেগফার করতে থাকলাম ও আশা করতে থাকলাম।[৪]

উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীছ থেকে বুঝা গেল, কাবীরা গুনাহগার ব্যক্তি কাফের নয়। কারণ কাফের হলে তার জন্য ইস্তেগফার করা বৈধ হত না এবং আল্লাহ তাকে ক্ষমাও করবেন না।

মাসআলা-৩ : ঈমানের কি  হ্রাস-বৃদ্ধি হয়?

খারেজী, মুরজি‘আ এবং জাহমিয়াদের মতে, ঈমান কম-বেশি হয় না।[৫] এ বিশ্বাস সঠিক নয়। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হল, ঈমান বাড়ে ও কমে। আল্লাহ্র আনুগত্যের মাধ্যমে বাড়ে এবং শয়তানের আনুগত্যের মাধ্যমে কমে। যেমন-

(এক) মহান আল্লাহ বলেন,  لِیَزۡدَادُوۡۤا  اِیۡمَانًا مَّعَ اِیۡمَانِہِمۡ  ‘যেন তারা তাদের ঈমানের সাথে ঈমান বৃদ্ধি করে নেয়’ (সূরা আল-ফাত্হ : ৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,  وَ الَّذِیۡنَ اہۡتَدَوۡا زَادَہُمۡ ہُدًی وَّ اٰتٰہُمۡ تَقۡوٰىہُمۡ ‘যারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে আল্লাহ তাদের হেদায়াত বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে তাদের তাক্বওয়া প্রদান করেন’ (সূরা মুহাম্মাদ : ১৭)। তিনি আরো বলেন, وَ یَزۡدَادَ  الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِیۡمَانًا ‘আর যারা ঈমান এনেছে তাদের ঈমান বেড়ে যায়’ (সূরা আল-মুদ্দাছছির : ৩১)।

উপরিউক্ত আয়াতগুলোতে ঈমান বৃদ্ধির কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আর তা হবে আল্লাহ্র আনুগত্যের মাধ্যমে।

(দুই) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,لَا يَزْنِي الزَّانِيْ حِيْنَ يَزْنِيْ وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَا يَشْرَبُ الخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَا يَسْرِقُ السَّارِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ ‘ব্যভিচারী ব্যভিচার করার সময় মুমিন থাকে না। মদপানকারী মদ পান করার সময় মুমিন থাকে না। চোর চুরি করার সময় মুমিন থাকে না’।[৬]

এ হাদীছে ‘মুমিন থাকে না’-এর অর্থ তারা কাফের হয়ে যায়, এমনটি নয়। বরং পাপ কাজ করার কারণে তার ঈমানের হ্রাস হয়। পাপ কাজ করার কারণে পাপী ব্যক্তি যদি কাফেরই হত, তাহলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের উপর ‘হদ্দ’ কায়েম করতেন না। কারণ ‘হদ্দ’ হচ্ছে কাফ্ফারা স্বরূপ। এর মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তির আখেরাতের শাস্তি মাফ হয়। আর আমরা জানি, কাফেরের জন্য আখিরাতের শাস্তি নিশ্চিত।

ঈমান বিষয়ে ভ্রান্ত আক্বীদার কুপ্রভাব

১. কাবীরা গুনাহ করলে ঈমান বিনষ্ট হয়ে যায় বলে যাদের বিশ্বাস, তাদের কাছে কাবীরা গুনাহগার প্রত্যেক ব্যক্তিই কাফের। দুনিয়াতে তাদের রক্ত হালাল এবং আখিরাতে তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী। বর্তমান বিশ্বে এ ভ্রান্ত আক্বীদাহ পোষণকারী বিভিন্ন নামের বিভিন্ন দল ও সংগঠন মহা ফিৎনা সৃষ্টি করছে এবং মুসলিমদের রক্ত হালাল মনে করে তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করছে। তারা নিজেদেরকে খারেজী বলে পরিচয় না দিলেও মূলত এ ভ্রান্ত ধারণায় তাদের এ সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এমনকি সারা বিশ্বের খ্যাতনামা ওলামায়ে কেরামও তাদের কবল থেকে রক্ষা পাননি। এ ধরনের আক্বীদাহ পোষণকারীরা সঠিক ইসলাম থেকে সরে গিয়ে পবিত্র এ দ্বীনকে বিকৃত করে অমুসলিমদের নিকট সন্ত্রাসী ধর্ম বলে পরিচয় করাতে দ্বিধাবোধ করছে না। অথচ ইসলামই একমাত্র শান্তির ধর্ম, যার মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, দূর হয়েছে অন্যায়-অনাচার, কায়েম হয়েছে ন্যায় বিচার। কিন্তু হতভাগাদের নির্বুদ্ধিতা ও মূর্খতার কারণে সঠিক ইসলামের চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে না।

২. কাবীরা গুনাহগার ব্যক্তি যখন জানবে, সে কাবীরা গুনাহের কারণে কাফের হয়ে গেছে, তখন সে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যাবে। আর সে নিরাশ হলে পাপাচার থেকে বিরত হবে না। এভাবেই সমাজে পাপাচার, অন্যায়-অনাচার, শত্রুতা, হানা-হানি, বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে। যার ফলে সমাজে ভয়-ভীতি, উৎকন্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করবে।

৩. একজন মুমিন যখন জানবে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না, তখন সে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের চেষ্টা থেকে দূরে চলে যাবে। শারঈ বিধি-বিধান পালনের কোন গুরুত্ব থাকবে না। কারণ সে মনে করবে তার অন্তরের বিশ্বাসই তার জন্য যথেষ্ট, যার কোন পরিবর্তন নেই এবং কখনও কমে না। এভাবেই ইসলাম ধর্ম খ্রিষ্টানদের মত রূপ লাভ করবে।

৪. পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, কয়েকটি ভ্রান্ত ফেরক্বার নিকট ঈমান হল- শুধু অন্তরে বিশ্বাস। আর এ বিশ্বাসের ফলে একজন ব্যক্তি ধারণা করে, সে ইসলামের অত্যাবশকীয় কাজগুলো না করেও পূর্ণ ঈমানদার হতে পারে। যার কারণে সে ইসলামের কোন বিধি-বিধান পালনের প্রতি মনযোগী হয় না; বরং বিভিন্ন পাপাচারের মাধ্যমে আল্লাহ্র অবাধ্যতায় ব্রত হয়। মুখে দাবী ছাড়া তাদের জীবনে ইসলামের কোন আলামত প্রকাশ পায় না।

ঈমান বিষয়ে সঠিক আক্বীদাহ পোষণের ইতিবাচক প্রভাব

প্রথমতঃ ব্যক্তিগত জীবনে

একজন ব্যক্তি যখন জানবে أعمال বা কর্মসমূহ ঈমানের অন্তর্ভুক্ত, তখন সে ইসলামের বিধি-নিষেধগুলো পালনের জন্য সদা সচেষ্ট থাকবে। কারণ সে জানে এর মাধ্যমেই তার ঈমান পরিপূর্ণতা লাভ করবে এবং ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভে সক্ষম হবে।

সে যখন জানবে, কোন ব্যক্তি শিরক ছাড়া অন্য পাপাচারে লিপ্ত হলে সে কাফের হয়ে যায় না; বরং সে ফাসেক্ব এবং তওবাহ-ইস্তেগফার করে তার ঈমানের এ অপূর্ণতা দূর করার সুযোগ রয়েছে, তখন সে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়ে দ্রুত তওবাহ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হবে। শুধু তাই নয়, ফাসেক্বী কর্মকা-ের কারণে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কষ্টও তাকে এ পথ থেকে ফিরিয়ে ইসলামের সঠিক পথে আনতে সহায়ক হবে।

সে যখন জানবে, ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি রয়েছে তখন পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ার জন্য বেশি বেশি সৎ আমল করবে এবং আল্লাহ্র নৈকট্য কামনা করবে, যাতে ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর লাভে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির কথা স্মরণ করে কাবীরা গুনাহসমূহ থেকে বিরত থাকবে।

দ্বিতীয়তঃ সামাজিক জীবনে

ব্যক্তি সংশোধন হলে সমাজ সংশোধন হওয়া স্বাভাবিক। কারণ ব্যক্তিদের সমন্বয়েই সমাজ গঠিত হয়। ছাহাবায়ে কেরামদের দিকে লক্ষ্য করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। তারা নিজে পরিশুদ্ধ হয়ে সমস্ত পৃথিবীকে পরিশুদ্ধ করেছেন। তাঁরা তাঁদের একনিষ্ঠতা ও সুন্দর আচরণের মাধ্যমে অমুসলিম রাষ্ট্রগুলো জয় করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর মাদানী জীবনে শুধু পাঁচজনের উপর হদ্দ কায়েম করেছেন। এগুলো থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, তারা কত মহান চরিত্রের অধিকারী ছিলেন।

সবাই যখন জানতে পারবে, আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে ঈমান বাড়ে এবং শয়তানের আনুগত্যের মাধ্যমে ঈমান কমে, তখন তাদের মধ্যে ভাল কাজের প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। সমাজ থেকে দূর হবে পাপাচার, হিংসা-বিদ্বেষ, সর্বক্ষেত্রে শান্তির সুবাতাস বইবে। মহান আল্লাহ বলেন,

سَابِقُوۡۤا  اِلٰی مَغۡفِرَۃٍ  مِّنۡ رَّبِّکُمۡ  وَ جَنَّۃٍ عَرۡضُہَا کَعَرۡضِ السَّمَآءِ  وَ الۡاَرۡضِ اُعِدَّتۡ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رُسُلِہٖ  ذٰلِکَ فَضۡلُ اللّٰہِ یُؤۡتِیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ   وَ اللّٰہُ  ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ .

‘তোমরা অগ্রণী হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও সেই জান্নাত লাভের প্রয়াসে, যা প্রশস্ততায় আকাশ ও পৃথিবীর মত; যা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাসীদের জন্য। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি এটা দান করেন; আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল’ (সূরা আল-হাদীদ : ২১)।

উপসংহার

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়, ঈমান বিষয়ে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাই সঠিক। ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈগণসহ সালাফে ছালেহীন এমন আক্বীদাই পোষণ করেছেন। মধ্যমপন্থী এ আক্বীদাহ পোষণই মুসলিমদের জীবনে নিয়ে আসতে পারে প্রকৃত ঈমানের স্বাদ। আখেরাতে পেতে পারে মহান আল্লাহর নিকট সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা। আল্লাহ আমাদেরকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাহ পোষণ করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!


* প্রিন্সিপ্যাল, হেরিটেজ আইডিয়াল একাডেমী, শেরপুর, বগুড়া।

[১]. কাযী আব্দুল জাব্বার, শারহুল উছুল আল-খামসা, পৃঃ ৬৬৬-৬৭২।

[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০১৭, ৬৯২২।

[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১০৩৮, ৪১৪৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৭১।

[৪]. মুসনাদে আবী ইয়ালা, হা/৫৮১৩, সনদ হাসান।

[৫]. আল জুওয়াইনী, আল-ইরশাদ, পৃ. ৩৩৫।

[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৭৮, ৬৭৮২, ৬৮১০; ছহীহ মুসলিম, হা/৫৭।




প্রসঙ্গসমূহ »: ভ্রান্ত মতবাদ
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৭ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ইসলামী সংগঠন ও তরুণ-যুবক-ছাত্র - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
বিদ‘আত পরিচিতি (১৮তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
আশূরায়ে মুহাররম - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ (শেষ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বাউল মতবাদ - গোলাম রহমান
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য (৩য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী

ফেসবুক পেজ