শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
(৫ম কিস্তি)
সালাফদের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আত বুঝা যে আবশ্যক এবং তাঁদের বুঝকে প্রত্যাখ্যান করলে মুসলিমরা যে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে, তার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে পেশ করা হল-
(১) আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পরিচয় দিয়ে বলেন, الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশের উপর সমুন্নত’ (ত্ব-হা ৫)। অন্যত্র বলেন, إِنَّ رَبَّكُمُ اللهُ الَّذِىْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِىْ سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ ‘নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক হচ্ছেন সেই আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হয়েছেন’ (আ‘রাফ ৫৪)। এছাড়াও সূরা ইউনুস-৩, সূরা রা‘দ-২, সূরা ফুরক্বান-৫৯, সূরা সাজদাহ-৪, সূরা হাদীদ-৪ আয়াতসহ মোট ৭টি আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশে সমুন্নত। তাছাড়া আল্লাহ আসমানে আছেন এ মর্মে আরো অনেক আয়াতে আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছেন (সূরা মুলক ১৬-১৭; সূরা আলে ইমরান-৫৫ এবং নিসা-১৫৮)।
পথভ্রষ্ট ফের্কাগুলো উক্ত আয়াতগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছে, আল্লাহ আরশের মালিক হলেন, কর্তৃত্ব গ্রহণ করলেন ইত্যাদি। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদূদী (রহঃ) অর্থ করেছেন ‘শাসন কর্তৃত্ব’। যেমন- ‘তিনি পরম দয়াবান। (বিশ্ব-জাহানের) শাসন কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন’।[১]
ভ্রান্ত ফের্কাগুলো আল্লাহর ছিফাতকে স্বীকার করতে চায় না। কারণ ‘আল্লাহ আরশের উপর সমুন্নত’ এই অর্থ করলে আল্লাহর আকার প্রমাণিত হয়। আর এটা তারা সরাসরি অস্বীকার করে। তাদের বিশ্বাস আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান, তিনি প্রতিটি মানুষ ও প্রত্যেক বস্তুর মাঝে বিরাজিত (নাঊযুবিল্লাহ)। আল্লাহর শানে এ ধরনের অর্থ ও ব্যাখ্যা করা হারাম। উক্ত আয়াতগুলোর ভুল অর্থ ও মনগড়া ব্যাখ্যা করার কারণেই অধিকাংশ মানুষ উক্ত ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করে থাকে। বিশেষ করে বাতিল ফের্কা জাহমিয়্যাহরা এটা বেশী প্রচার করে থাকে।
এক্ষণে আমরা যদি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযাম অর্থাৎ সালাফে ছালেহীনের ব্যাখ্যা ও বুঝ গ্রহণ করি, তাহলে এ সমস্ত মারাত্মক বিভ্রান্তিকর আক্বীদা থেকে মুসলিম উম্মাহ নিরাপদ থাকবে। আমরা রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছ থেকে যদি দলীল গ্রহণ করি, তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। যেমন-
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا قَضَى اللهُ الْخَلْقَ كَتَبَ فِىْ كِتَابِهِ فَهُوَ عِنْدَهُ فَوْقَ الْعَرْشِ إِنَّ رَحْمَتِىْ غَلَبَتْ غَضَبِىْ
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যখন আল্লাহ মাখলূক সৃষ্টির ইচ্ছা করলেন, তখন আরশের উপর তাঁর কাছে রক্ষিত এক কিতাবে লিপিবদ্ধ করলেন যে, অবশ্যই আমার করুণা আমার ক্রোধের উপর জয়লাভ করেছে’।[২]
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ يَقُوْلُ مَنْ يَّدْعُوْنِىْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِىْ فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِىْ فَأَغْفِرَ لَهُ
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, এমন কোন ব্যক্তি আছে- যে আমাকে ডাকবে, আর আমি তার ডাকে সাড়া দিব? এমন কোন ব্যক্তি আছে- যে আমার কাছে কিছু চাইবে, আর আমি তাকে তা দান করব। এমন কোন ব্যক্তি আছে- যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আর আমি তাকে ক্ষমা করব’।[৩] মু‘আবিয়া বিন হাকাম আস-সুলামী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَتْ لِىْ جَارِيَةٌ تَرْعَى غَنَمًا لِىْ قِبَلَ أُحُدٍ وَالْجَوَّانِيَّةِ فَاطَّلَعْتُ ذَاتَ يَوْمٍ فَإِذَا الذِّئْبُ قَدْ ذَهَبَ بِشَاةٍ مِنْ غَنَمِهَا وَأَنَا رَجُلٌ مِنْ بَنِىْ آدَمَ آسَفُ كَمَا يَأْسَفُوْنَ لَكِنِّىْ صَكَكْتُهَا صَكَّةً فَأَتَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَظَّمَ ذَلِكَ عَلَيَّ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَفَلاَ أُعْتِقُهَا؟ قَالَ ائْتِنِىْ بِهَا فَأَتَيْتُهُ بِهَا فَقَالَ لَهَا أَيْنَ اللهُ؟ قَالَتْ فِي السَّمَاءِ قَالَ مَنْ أَنَا؟ قَالَتْ أَنْتَ رَسُوْلُ اللهِ قَالَ أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ
‘আমার একজন দাসী ছিল। ওহুদ ও জাউওয়্যানিয়্যাহ নামক স্থানে সে আমার ছাগল চরাত। একদিন দেখি, নেকড়ে বাঘ একটি ছাগল ধরে নিয়ে গেছে। আমি একজন আদম সন্তান হিসাবে অনুরূপ রাগান্বিত হই, যেভাবে তারা হয়। ফলে আমি তাকে এক থাপ্পড় মারি। অতঃপর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আসলে একে তিনি বড় অন্যায় মনে করলেন। তাই আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি কি তাকে আযাদ করে দিব না? তিনি বললেন, তাকে আমার নিকট নিয়ে আস। আমি তাকে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট নিয়ে আসলাম। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আসমানে। তিনি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? তখন সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও, কারণ সে একজন ঈমানদার মেয়ে’।[৪]
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّاحِمُوْنَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ ارْحَمُوْا مَنْ فِى الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِى السَّمَاءِ
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, দয়াশীল মানুষদের উপর দয়াময় আল্লাহ রহম করেন। সুতরাং তোমরা পৃথিবীবাসীর উপর দয়া কর, যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের উপর অনুগ্রহ করবেন।[৫]
রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা মি‘রাজে নিয়ে গিয়েছিলেন সপ্তম আসমানের উপরে এবং বার বার মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর নিকট থেকে আল্লাহর কাছে যাওয়ার বিষয়টি সবারই জানা।[৬] এই মি‘রাজের ঘটনা থেকেও বুঝা যায় আল্লাহ কোথায় আছেন। কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আরো অনেক দলীল আছে যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ আরশের উপর সমুন্নত।[৭] তাছাড়া মানুষের স্বভাবজাতও প্রমাণ করে আল্লাহ উপরে আছেন। কারণ কোন বিষয়ে আল্লাহকে সাক্ষী রাখতে চাইলে মানুষ আগে উপরের দিকে হাত উঠায়। দুই হাত তুলে দু‘আ করার সময়ও উপরের দিকে হাত তুলে।[৮]
এ বিষয়ে ছাহাবায়ে কেরামের আক্বীদা :
আনাস ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)বলেন,
كَانَتْ زَيْنَبُ تَفْخَرُ عَلَى أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَقُوْلُ زَوَّجَكُنَّ أَهَالِيْكُنَّ وَزَوَّجَنِى اللهُ تَعَالَى مِنْ فَوْقِ سَبْعِ سَمَاوَاتٍ
‘যয়নব (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্যান্য স্ত্রীগণের উপর গর্ব করে বলতেন, তাঁদের বিয়ে তাঁদের পরিবার দিয়েছে। আর আমার বিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ সপ্তম আসমানের উপর থেকে’।[৯]
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ لَمَّا قُبِضَ رَسُوْلُ اللهِ قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كَانَ مُحَمَّدٌ إِلَهَكُمْ الَّذِىْ تَعْبُدُوْنَ فَإِنَّ إِلَهَكُمْ قَدْ مَاتَ وَإِنْ كَانَ إِلَهُكُمُ اللهَ الَّذِىْ فِى السَّمَاءِ فَإِنَّ إِلَهَكُمْ لَمْ يَمُتْ
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যখন উঠিয়ে নেয়া হল, তখন আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)বললেন, হে মানবমণ্ডলী! মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যদি তোমাদের মা‘বূদ হন- যার তোমরা ইবাদত কর। মনে রেখ, তাহলে তোমাদের মা‘বূদ মারা গেছেন। আর তোমাদের মা‘বূদ যদি আল্লাহ হন- যিনি আসমানে আছেন, তাহলে নিশ্চয় তোমাদের মা‘বূদ মারা যাননি। অতঃপর তিনি সূরা আলে ইমরানের ১৪৪ নং আয়াত তেলাওয়াত করেন।[১০]
أَنَّ ابْنَ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا دَخَلَ عَلَى عَائِشَةَ وَهِيَ تَمُوْتُ فَقَالَ لَهَا كُنْتُ أُحِبُّ نِسَاءَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ وَلَمْ يَكُنْ رَسُوْلُ اللهِ يُحِبُّ إِِلَّا طَيِّبًا وَأَنْزَلَ اللهُ بَرَاءَتَكَ مِنْ فَوْقِ سَبْعِ سَمَوَاتٍ
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর যখন মুমূর্ষ অবস্থায় রয়েছে, তখন ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) তার কাছে গিয়ে তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভালবাসার কারণে আমি তাঁর স্ত্রীদেরকে ভালবাসি। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র ব্যক্তিকে ছাড়া ভালবাসতেন না। আর আপনার ব্যাপারে তো আল্লাহ তা‘আলা নিজেই সাত আসমানের উপর থেকে পবিত্রতা ঘোষণা করে আয়াত নাযিল করেছেন।[১১]
عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ مَا بَيْنَ سَمَا الْقَصْوَى وَبَيْنَ الْكُرْسِىِّ خَمْسُمِائَةِ سَنَةٍ وَمَا بَيْنَ الْكُرْسِىِّ وَالْمَاءِ خَمْسُمِائَةِ سَنَةٍ وَالْعَرْشُ فَوْقَ الْمَاءِ وَاللهُ فَوْقَ الْعَرْشِ لَا يَخْفَى عَلَيْهِ شَيْءٌ مِنْ أَعْمَالِ بَنِىْ آدَمَ
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আসমানের প্রান্তসীমা আর কুরসীর মাঝের দূরত্ব হল পাঁচশ’ বছর। আর কুরসী ও পানির মাঝের দূরত্বও পাঁচশ’ বছর। আরশ পানির উপর, আর আল্লাহ আরশের উপর। বনী আদমের আমলসমূহের কোন কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয় (আলে ইমরান ৫)।[১২]
عَنْ قَيْسٍ قَالَ لَمَّا قَدِمَ عُمَرُ الشَّامَ اسْتَقْبَلَهُ النَّاسُ وَهُوَ عَلَى بَعِيْرِهِ فَقَالُوا يَا أَمِيْرَ الْمُؤْمِنِيْنَ لَوْ رَكِبْتَ بِرْذَوْنًا يَلْقَاك عُظَمَاءُ النَّاسِ وَوُجُوْهُهُمْ قَالَ فَقَالَ عُمَرُ أَلاَّ أَرَاكُمْ هَاهُنَا إنَّمَا الأَمْرُ مِنْ هَاهُنَا وَأَشَارَ بِيَدِهِ إِلَى السَّمَاءِ
ক্বায়েস বলেন, যখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সিরিয়ায় আগমন করলেন, তখন মানুষ তাকে অভিনন্দন জানাল। আর তখন তিনি উটের উপর ছিলেন। লোকেরা বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি যদি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আসতেন তাহলে আপনার সাথে নেতৃবৃন্দ এবং মর্যাদাবান ব্যক্তিবর্গ সাক্ষাৎ করতেন। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, তোমাদের এখানে আমি কোন সম্মান পাওয়ার আশা করি না। বরং সম্মান আসে ঐ জায়গা থেকে। এ সময় তিনি তাঁর হাত দিয়ে আসমানের দিকে ইশারা করলেন।[১৩]
قَالَتْ عَائِشَةُ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا وَأَيْمُ اللهِ إِنِّىْ لَأَخْشَى لَوْ كُنْتُ أُحِبُّ قَتْلَهُ لَقَتَلْتُ تَعْنِىْ عُثْمَانَ وَلَكِنْ عَلِمَ اللهُ مِنْ فَوْقِ عَرْشِهِ أَنِّىْ لَمْ أُحِبُّ قَتْلَهُ
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আল্লাহর কসম! নিশ্চয় আমি অত্যধিক ভয় করি! আমি যদি উছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে হত্যা করা পসন্দ করতাম, তবে তাঁকে হত্যা করতাম। কিন্তু আল্লাহ তাঁর আরশের উপর থেকে জানেন যে, নিশ্চয় আমি তাঁর হত্যাকাণ্ড চাইনি।[১৪]
عَنْ كَعْبٍ قَالَ قَالَ اللهُ تَعَالَى فىْ التَّوْرَاةِ أَنا اللهُ فَوْقَ عِبَادِىْ وَعَرْشِىْ فَوْقَ جَمِيْعِ خَلْقِلىْ وَأَنَا عَلَى عَرْشِىْ أُدَبِّرُ أَمْرَ عِبَادِىْ فِي سَمَائِي وَأَرْضِي
কা‘বা আল-আহবার বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাওরাতের মধ্যে বলেছেন, ‘আমি আল্লাহ, আমি আমার সকল বান্দার উপরে, আমার আরশ সমস্ত সৃষ্টির উপরে। আর আমি আরশের উপরে। আসমান-যমীনে আমি আমার সমস্ত বান্দার কার্যাবলী পরিচালনা করি’।[১৫]
ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হিঃ) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে,
عَنْ أَبِى مُطِيْعٍ الْحَكَمِ بْنِ عَبْدِ اللهِ الْبَلَخِىِّ صَاحِبِ الْفِقْهِ الْأَكْبَرِ قَالَ سَأَلْتُ أَبَا حَنِيْفَةَ عَمَّنْ يَقُوْلُ لَا أَعْرِفُ رَبِّىْ فِي السَّمَاءِ أَمْ فِي الْأَرْضِ فَقَالَ قَدْ كَفَرَ لِأَنَّ اللهَ تَعَالَى يَقُوْلُ الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى وَعَرْشُهُ فَوْقَ سَبْعِ سَمَوَاتِهِ فَقُلْتُ إِنَّهُ يَقُوْلُ أَقُوْلُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى وَلَكِنْ قَالَ لَا يَدْرِى الْعَرْشَ فِي السَّمَاءِ أَوْ فِى الْأَرْضِ قَالَ إِذَا أَنْكَرَ أَنَّهُ فِي السَّمَاءِ فَقَدْ كَفَرَ
‘আল-ফিক্বহুল আকবার’-এর সংকলক আবু মুত্বী‘ হাকাম ইবনু আব্দুল্লাহ আল-বালখী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)-কে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, যে বলে আমার রব আসমানে আছেন না-কি যমীনে আছেন, তা আমি জানি না। তিনি উত্তরে বললেন, সে কুফরী করল। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, রহমান আরশের উপর সমুন্নত’। আর তাঁর আরশ তাঁর সপ্তম আসমানের উপরে। অতঃপর আমি বললাম, সে বলে যে, আমি বলি, তিনি আরশের উপর সমুন্নত। কিন্তু আরশ আসমানে না যমীনে তা সে জানে না। আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) বললেন, আরশ আসমানে এই কথা যে অস্বীকার করল, সে কুফরী করল’।[১৬]
ইমাম আওযাঈ (৮৯-১৫৮ হিঃ/৭০৭-৭৭৪ খৃঃ) বলেন,
كُنَّا وَالتَّابِعُوْنَ مُتَوَافِرُوْنَ نَقُوْلُ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى عَرْشِهِ وَنُؤْمِنُ بِمَا وَرَدَتْ بِهِ السُّنَّةُ مِنْ صِفَاتِهِ
‘আমরা এবং সকল তাবেঈ বলি, নিশ্চয় মহা সম্মানিত আল্লাহ তাঁর আরশের উপরে এবং আল্লাহর ছিফাতের ব্যাপারে সুন্নাহ যা বর্ণনা করেছে, তার প্রতি আমরা দৃঢ় ঈমান পোষণ করি’।[১৭] ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হিঃ) বলেন,
اَللهُ فِى السَّمَاءِ وَعِلْمُهُ فِىْ كُلِّ مَكَانٍ لَا يَخْلُوْ مِنْهُ شَيْءٌ
‘আল্লাহ আসমানে আছেন। আর তাঁর ইলম প্রত্যেকটি স্থানে। কোন কিছুই তাঁর ইলমের বাইরে নয়’।[১৮] একদা আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হিঃ)-কে আলী ইবনু হাসান জিজ্ঞেস করেন,
كَيْفَ نَعْرِفُ رَبَّنَا عَزَّ وَجّلَّ قَالَ فِى السَّمَاءِ السَّابِعَةِ عَلَى عَرْشِهِ وَلَا نَقُوْلُ كَمَا تَقُوْلُ الْجَهْمِيَّةُ إِنَّهُ هَاهُنَا فِى الْأَرْضِ
‘আমরা মহান রবকে কিভাবে চিনতে পারব? তিনি উত্তরে বললেন, তিনি সপ্তম আসমানে তাঁর আরশের উপরে আছেন। আর আমরা জাহমিয়্যাদের মত বলব না যে, তিনি পৃথিবীর সর্বত্র আছেন’।[১৯] বিশর ইবনু ওমর বলেন,
سَمِعْتُ غَيْرَ وَاحِدٍ مِنَ الْمُفَسِّرِيْنَ يَقُوْلُوْنَ الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى قَالَ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى : اِرْتَفَعَ
‘আমি বহু মুফাসসিরকে বলতে শুনেছি, তারা বলতেন, রহমান আরশের উপর সমুন্নত। বলতেন, আরশের উপর সমুন্নত অর্থ তিনি সুউচ্চ হয়েছেন।[২০]
ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিঃ) ছহীহ বুখারীতে আল্লাহর ছিফাত প্রমাণ করা জন্য বহু স্থানে অধ্যায় রচনা করেছেন। যেমন এক স্থানে বলেন,
قَالَ أَبُو الْعَالِيَةِ ( اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ ) ارْتَفَعَ وَقَالَ مُجَاهِدٌ ( اسْتَوَى ) عَلاَ عَلَى الْعَرْشِ
আবু ‘আলিয়াহ (মৃ. ৯০ হিঃ) বলেন, ‘আসমানে সমুন্নত হলেন’ (বাক্বারাহ ২৯; ফুছছিলাত ১১) অর্থ সুউচ্চ হলেন। … মুজাহিদ (২১-১০৪ হিঃ) বলেন, ‘তিনি সমুন্নত হলেন’ অর্থ আরশের উপর আরোহণ করলেন।[২১]
সালাফে ছালেহীনের উপরিক্ত আলোচনায় বুঝা গেল আল্লাহ ত‘আলা তাঁর আরশের উপর সমুন্নত। তিনি সবকিছুর মধ্যে সর্বত্র বিরাজমান নন। তাঁর ইলম ও দৃষ্টি সর্বত্র রয়েছে। এটাই সালাফদের চূড়ান্ত বক্তব্য, যা শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ উল্লেখ করেছেন।[২২] ‘তিনি কর্তৃত্ব গ্রহণ করলেন’ বা ‘তিনি আরশের মালিক হলেন’ আল্লাহর কালামের এ ধরনের বিকৃত অর্থ করা হারাম। এই অপব্যাখ্যা নিয়ে সামনে আমরা আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)