মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০২:৩৭ পূর্বাহ্ন

ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ

-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন


(৩য় কিস্তি)

তাবলীগ জামায়াতের আক্বীদা

(এক) হানাফী মাযহাবপন্থী এবং ছূফী তরীকা বা ওয়াহদাতুল ওজূদে বিশ্বাসী।

ফাযায়েলে আমল বইয়ের বহু স্থানে ছূফীদের আদর্শ গ্রহণ করা হয়েছে।[১] তারা মনে করে সবকিছুর মাঝে আল্লাহর উপস্থিতি রয়েছে। তাদের গাশতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘গাশত এর মাকসূদ বা উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর বান্দাহকে আল্লাহ পাকের সাথে জুড়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা করা এবং দুনিয়ার মাশগুলিয়াত হতে আখেরাতের মাশগুলিয়াতের দিকে আর্কষণ করা’।[২]

পর্যালোচনা : ইসলামে কোন মাযহাব, মতবাদ, তরীকা, ইজম ও দর্শনের স্থান নেই। তাই কোন থিওরি গ্রহণ করা ও বিশ্বাস করা যাবে না; বরং এগুলোকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে হবে। তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা হানাফী মাযহাবের দাবী করলেও তারা মূলত ছূফীবাদী শিরকী আক্বীদায় বিশ্বাসী।

ছূফীবাদ সমাজে শিরকী আক্বীদার প্রচার করে থাকে। তারা বান্দা আর আল্লাহকে অর্থাৎ সৃষ্টি আর স্রষ্টাকে একাকার করে থাকে। আবদ আর মা‘বূদকে এক মনে করে (নাঊযুবিল্লাহ)। তাদের ধারণা মানবদেহে যখন আল্লাহ প্রবেশ করেন, তখন মানুষ আল্লাহতে পরিণত হয় (هُوَ الْقَوْلُ بِأَنَّ اللهَ يَحِلُّ فِى الْإِنْسَانِ)।[৩]  ধ্যান করতে করতে এক সময় মানুষ আল্লাহ হয়ে যায়। ইরানের বায়েযীদ বুস্তামী (মৃ. ২৬১ হি.) বলেন, طَلَبْتُ اللهَ سِتِّيْنَ سَنَةً فَإِذَا أَنَا هُوَ ‘আমি ৬০ বছর যাবৎ আল্লাহকে খুঁজছি। এখন দেখছি আমি নিজেই আল্লাহ’।[৪] কেউ তাকে ডাকলে বাড়ীর ভিতর থেকে বলতেন, لَيْسَ فِى الْبَيْتِ غَيْرُ اللهِ ‘বাড়ীতে আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই’।[৫] আরো কঠোরভাবে নিজেকে আল্লাহ দাবী করে বলেন, سُبْحَانِىْ سُبْحَانِىْ مَا أَعْظَمَ شَأْنِىْ ‘আমি মহা পবিত্র, ‘আমি মহা পবিত্র, আমার মর্যাদা কতই না বড়’।[৬] আল্লাহ তার দেহের মধ্যে একাকার হয়ে গেছে ফলে তিনি নিজেই আল্লাহ হয়ে গেছেন। তারই অনুসারী হুসাইন বিন মানছূর হাল্লাজ (মৃ. ৩০৯ হি.) বলেন, نَحْنُ رُوْحَانِ حَلَّلْنَا بَدَنًا ‘আমরা দু’টি রূহ। এখন একটি দেহে একাকার হয়ে গেছি’। তাই জোর দিয়ে বলেন, أَنَا الْحَقُّ  ‘আমিই আল্লাহ’।[৭]

ছূফীদের একটি শ্রেণী অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী। তাদের নিকট স্রষ্টা ও সৃষ্টি (খালেক্ব ও মাখলূক্ব) বলতে কিছু নেই। সবই সৃষ্টি সবই ‘ইলাহ’। এদের পুরোধা হচ্ছে সিরিয়ার দামেস্ক-এ সমাহিত ‘ইবনুল আরাবী’। সে বলে,

العبد رب والرب عبـــد       يــا ليت شعري من المكلــف؟
إن قلت عبد فذاك حـــق      أو قلت رب فأنَّى رب يكلف؟

‘বান্দাই রব, আর রবই বান্দা, আহা যদি জানতাম কে মুকাল্লাফ (শরী‘আতের নির্দেশ মানতে বাধ্য)? যদি বলি বান্দা, তাহলে তা-ই সত্য। অথবা যদি বলি রব, তবে কোথায় সে রব, যে মুকাল্লাফ (আদেশ পালনের জন্য বলা) হবে’? [৮] ইবনুল আরাবী আরো বলে,

فَيَحْمَدُنِىْ وَأَحْمَدُهُ وَيَعْبُدُنِىْ وَأَعْبُدُهُ

‘তিনি (আল্লাহ) আমার প্রশংসা করেন এবং আমিও তার প্রশংসা করি। আর তিনি আমার ইবাদত করেন এবং আমিও তার ইবাদত করি’।[৯] সে তার ‘ফুছূছুল হুকম’ গ্রন্থে বলেছে,

إِنَّ الرِّجَالَ حِيْنَمَا يُضَاجِعُ زَوْجَتَهُ إِنَّمَا يُضَاجِعُ الْحَقَّ

‘নিশ্চয় কোন ব্যক্তি যখন তার স্ত্রীর সাথে আলিঙ্গন করে, তখন সে ‘হক’ তা‘আলাকেই আলিঙ্গন করে’।[১০] ছূফী নাবলুসী উক্ত কথার ব্যাখ্যায় বলে, إِنَّمَا يَنْكِحُ الْحَقَّ অর্থাৎ ‘সে অবশ্যই ‘হক’ তা‘আলার সাথে সহবাস করে’।[১১] নাউযুবিল্লাহ।

দেওবন্দী মতবাদের আধ্যাত্মিক গুরু ইমদাদুল্লাহ মাক্কী বলেন, ‘মা‘রেফতের অধিকারী ব্যক্তি সমগ্র পৃথিবীর উপর কর্তৃত্বশীল হয়। আল্লাহ তা‘আলার যে কোন রশ্মিকে নিজের জন্য ধরে নিতে পারে। আল্লাহর যে কোন গুণে ইচ্ছা নিজেকে বিভূষিত করে তার প্রকাশ ঘটাতে পারে। যেহেতু তার মধ্যে আল্লাহর গুণাবলী বিদ্যমান এবং আল্লাহর চরিত্রে বিলীন।[১২]

পর্যালোচনা : সুধী পাঠক! এর চেয়ে খারাপ ও নেংরা আক্বীদা আর কী হতে পারে? উক্ত দাওয়াত ও জামায়াত থেকে বিরত থাকা ছাড়া আর কোন পথ আছে কি? তাদের সাথে থাকলে হেদায়াতের আলো পাওয়া কি সম্ভব? প্রচলিত তাবলীগের সাথে থাকলে ঈমান ও আক্বীদা কিছুই থাকবে না। সবই নষ্ট হয়ে যাবে।

(দুই) আল্লাহ নিরাকার ও সর্বত্র বিরাজমান।

তারা আল্লাহকে অস্তিত্বহীন নিরাকার মনে করে। আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান এই আক্বীদা পোষণ করে থাকে।

পর্যালোচনা : আল্লাহ তা‘আলা নিরাকার নন, তাঁর আকার আছে। তিনি শুনেন, দেখেন এবং কথা বলেন। তাঁর হাত, পা, চেহারা, চোখ ইত্যাদি আছে। তবে তার সাথে সৃষ্টির কোন কিছুই তুলনীয় নয়। আল্লাহ নিজেই বলেন, لَیۡسَ کَمِثۡلِہٖ  شَیۡءٌ ۚ وَ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (সূরা আশ-শূরা : ১১)। সুতরাং তাঁর আকারের সাথে কোন কিছুর আকারের তুলনা করা যাবে না। যেমন আল্লাহ নিজেই বলেন, فَلَا تَضۡرِبُوۡا لِلّٰہِ الۡاَمۡثَالَ ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর কোন সাদৃশ্য বর্ণনা করো না’ (সূরা আন-নাহল : ৭৪)। 

অতএব আল্লাহর আকার আছে। তবে কোন কিছুর সাথে তা তুলনীয় নয়। কুরআন ও ছহীহ হাদীছে তাঁর আকৃতি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তার কোন রূপক বা বিকৃত অর্থ করা যাবে না। বরং বলতে হবে তিনি তাঁর মত। আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন এভাবে-

وَ قَالَتِ الۡیَہُوۡدُ یَدُ اللّٰہِ مَغۡلُوۡلَۃٌ غُلَّتۡ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ لُعِنُوۡا بِمَا قَالُوۡا بَلۡ یَدٰہُ مَبۡسُوۡطَتٰنِ

‘আর ইহুদীরা বলে, আল্লাহর হাত বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের হাতই বন্ধ হয়ে গেছে এবং তাদের এ উক্তির কারণে তাদের উপর অভিশাপ করা হয়েছে; বরং তাঁর (আল্লাহর) দুই হাতই প্রসারিত’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৬৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
 قَالَ یٰۤاِبۡلِیۡسُ مَا مَنَعَکَ اَنۡ تَسۡجُدَ لِمَا خَلَقۡتُ بِیَدَیَّ ‘হে ইবলীস! আমি যাকে আমার দুই হাত দ্বারা সৃষ্টি করেছি তাকে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? (সূরা ছোয়াদ : ৭৫)। এছাড়াও আরো অনেক আয়াত ও হাদীছে আল্লাহর আকারের কথা বর্ণিত হয়েছে।

সতর্কতা : উক্ত আয়াত সমূহে আল্লাহ আকার প্রমাণিত হলেও একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী আলেম রূপক অর্থ করে থাকেন। কুদরত, সত্তা ইত্যাদি অর্থ করেন। এটা আল্লাহর ছিফাতকে বিকৃত করার শামিল। ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

 وَلَهُ يَدٌ وَوَجْهٌ وَنَفْسٌ كَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِى الْقُرْآنِ فَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِى الْقُرْآنِ مِنْ ذِكْرِ الْوَجْهِ وَالْيَدِ وَالنَّفْسِ فَهُوَ لَهُ صِفَاتٌ بِلاَ كَيْفٍ وَلاَ يُقَالُ إِنَّ يَدَهُ قُدْرَتُهْ أَوْ نِعْمَتُهُ لِأَنَّ فِيْهِ إِبْطَالُ الصِّفَةِ وَهُوَ قَوْلُ أَهْلِ الْقَدْرِ وَالْاِعْتِزَالِ وَلَكِنَّ يَدَهُ صِفَتُهُ بِلاَ كَيْفٍ وَغَضَبَهُ وَرِضَاهُ صِفَتَانِ مِنْ صِفَاتِ اللهِ تَعَالَى بِلاَ كَيْفٍ

‘তাঁর (আল্লাহর) হাত, মুখমণ্ডল এবং নফস রয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ তাঁর মুখমণ্ডল, হাত ও নফসের যে কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলো তাঁর গুণ। কিন্তু কারো সাথে সেগুলোর সাদৃশ্য নেই। আর একথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর ‘কুদরত’ বা ‘নে‘মত’। কারণ এতে আল্লাহর গুণকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়। আর এটা ক্বাদারিয়া ও মু‘তাযিলাদের বক্তব্য। বরং কারো হাতের সাথে সাদৃশ্য ছাড়াই তাঁর হাত তাঁর গুণ। আর আল্লাহর রাগ ও সন্তুষ্টি কারো রাগ ও সন্তুষ্টির সাথে সাদৃশ্য ছাড়াই তাঁর দু’টি ছিফাত বা গুণ।[১৩]

অনুরূপভাবে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান এ বিশ্বাসও সঠিক নয়। বরং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ আরশে সমুন্নীত। আল্লাহ তাঁর পরিচয় দিয়ে বলেন, اَلرَّحۡمٰنُ  عَلَی الۡعَرۡشِ  اسۡتَوٰی ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশে সমুন্নীত’ (সূরা ত্ব-হা : ৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

اِنَّ رَبَّکُمُ اللّٰہُ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ

‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক হচ্ছেন সেই আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নীত হয়েছেন’ (সূরা আর-আ‘রাফ : ৫৪)।

এছাড়া সূরা ইউনুস-৩, সূরা রা‘দ-২, সূরা ফুরক্বান-৫৯, সূরা সাজদাহ-৪, সূরা হাদীদ-৪ আয়াতসহ মোট ৭টি আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় আল্লাহ তা‘আলা আরশে সমুন্নীত। হাদীছ দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ আরশের উপর।

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لَمَّا قَضَى اللهُ الْخَلْقَ كَتَبَ فِىْ كِتَابِهِ فَهُوَ عِنْدَهُ فَوْقَ الْعَرْشِ إِنَّ رَحْمَتِىْ غَلَبَتْ غَضَبِىْ

আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যখন আল্লাহ মাখলূক সৃষ্টির ইচ্ছা করলেন, তখন আরশের উপর তাঁর কাছে রক্ষিত এক কিতাবে লিপিবদ্ধ করলেন যে, অবশ্যই আমার করুণা আমার ক্রোধের উপর জয়লাভ করেছে’।[১৪] এছাড়া আরো অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[১৫] এখানে ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মন্তব্যটি লক্ষণীয়-

قَالَ أَبُوْ حَنِيفَةَ عَمَّنْ قَالَ لَا أَعْرِفُ رَبِّىْ فِي السَّمَاءِ أَمْ فِي الْأَرْضِ فَقَدْ كَفَرَ لِأَنَّ اللهَ يَقُوْلُ الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى وَعَرْشُهُ فَوْقَ سَبْعِ سَمَوَاتٍ

‘আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, যে বলে আল্লাহ আসমানে আছেন, না যমীনে আছেন আমি তা জানি না, সে কুফরী করবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, রহমান আরশের উপর সমুন্নীত’। আর তাঁর আরশ সপ্তম আসমানের উপরে অবস্থিত’।[১৬]

(তিন) মুহাম্মাদ (ﷺ) নূরের তৈরি।

তাবলীগ জামায়াতের অনুসারীরা উক্ত বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। এর পক্ষে বেশ কিছু জাল বর্ণনাও পেশ করা হয়। যেমন (ক) আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূরকে তৈরি করেছেন।[১৭] এটি জাল বর্ণনা।[১৮]

(খ) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক! আমাকে বলুন, সৃষ্টি সমূহের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা কোন্ জিনিসকে প্রথম সৃষ্টি করেছেন? তিনি বললেন, হে জাবের! নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সবকিছুর পূর্বে তাঁর নূর থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর এই নূর আল্লাহর কুদরতে স্বাধীনভাবে ঘুরতে লাগল। আর তখন লাওহে মাহফূয, কলম, জান্নাত, জাহান্নাম, ফেরেশতা, আসমান, যমীন, সূর্য, চন্দ্র, জিন, মানুষ কিছুই ছিল না। অতঃপর যখন জগৎ সৃষ্টি করার ইচ্ছা করলেন তখন তিনি ঐ নূরকে চার ভাগে ভাগ করলেন। ১ম ভাগ দ্বারা কলম, দ্বিতীয় ভাগ দ্বারা লাওহে মাহফূয, তৃতীয় ভাগ দ্বারা আরশ তৈরি করলেন। তারপর চতুর্থ ভাগকে আবার চার ভাগে ভাগ করলেন। ১ম ভাগ দিয়ে আরশ বহনকারী ফেরেশতা, দ্বিতীয় ভাগ দ্বারা কুরসী, তৃতীয় ভাগ দ্বারা অন্যান্য ফেরেশতা সৃষ্টি করলেন। তারপর উক্ত চতুর্থ ভাগকে আবার চার ভাগে ভাগ করলেন। ১ম ভাগ দ্বারা আসমান সমূহ, দ্বিতীয় ভাগ দ্বারা যমীন সমূহ, তৃতীয় ভাগ দ্বারা জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন..।[১৯]

উক্ত বর্ণনাও মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন যে, এটি গালগল্প ছাড়া কিছুই নয়। নবীর নূর দ্বারা যদি জাহান্নাম তৈরি হয়, তাহলে সেই জাহান্নামে মানুষ পুড়বে কেন? যদি মানুষকে পুড়িয়ে ফেলে তবে নবীর নূরের মর্যাদা কি থাকল? এই মিথ্যা কাহিনীটি কোন জাল হাদীছের গ্রন্থেও বর্ণিত হয়নি। মুহাদ্দিছ আলী হাশীশ বলেন,  هَذِهِ الْقِصَّةُ الْوَاهِيَةُ قِصَّةُ خَلْقِ الْعَالَمِ مِنْ نُوْرِ النَّبِىِّ ﷺ  ‘রাসূল (ﷺ) -এর নূর দ্বারা জগৎ সৃষ্টি করা হয়েছে মর্মে বর্ণিত কাহিনী একেবারে বাজে কাহিনী’।[২০] শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বাতিল হাদীছ বলে আখ্যা দিয়েছেন।[২১] আব্দুল হাই লাক্ষেèৗভী বলেন, كُلُّ ذَلِكَ كِذْبٌ مُفْتَرَى بِاتِّفَاقِ أَهْلِ الْعِلْمِ ‘মুহাদ্দিছগণের ঐকমত্যে এগুলো সবই মিথ্যা অপবাদ’।[২২]

পর্যালোচনা : এগুলো সব মিথ্যা বর্ণনা। অন্যান্য আদম সন্তানের ন্যায় মুহাম্মাদ (ﷺ)ও একজন মাটির তৈরি মানুষ। এটাই সঠিক আক্বীদা এবং সালাফে ছালেহীন ছাহাবায়ে কেরামের আক্বীদা।

(ক) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ اِنَّمَاۤ  اَنَا بَشَرٌ  مِّثۡلُکُمۡ  یُوۡحٰۤی  اِلَیَّ اَنَّمَاۤ  اِلٰـہُکُمۡ  اِلٰہٌ  وَّاحِدٌ    ‘বলুন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি অহি করা হয় যে, তোমাদের মা‘বূদ একজন’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ১১০)।

উক্ত আয়াত ছাড়াও আরো আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (ﷺ) একজন মানুষ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৯৩; সূরা হা-মীম সিজদা : ৬)। তাহলে মানুষ কিসের তৈরি? আমরা আল্লাহর ভাষায় দেখি- وَ مِنۡ اٰیٰتِہٖۤ  اَنۡ خَلَقَکُمۡ  مِّنۡ تُرَابٍ ثُمَّ اِذَاۤ   اَنۡتُمۡ  بَشَرٌ  تَنۡتَشِرُوۡنَ ‘আর তাঁর নিদর্শন সমূহের মধ্যে হচ্ছে- তিনি তোমাদেরকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমরা মানুষ হিসাবে ছড়িয়ে গেছ’ (সূরা আর-রূম : ২০; সূরা আলে ইমরান : ৫৯)। হাদীছেও বহু স্থানে বলা হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) মাটির তৈরি-

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ خُلِقَتِ الْمَلاَئِكَةُ مِنْ نُوْرٍ وَخُلِقَ الْجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ وَخُلِقَ آدَمُ مِمَّا وُصِفَ لَكُمْ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘ফেরেশতাদেরকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেই সমস্ত ছিফাত দ্বারা, যে ছিফাতে তোমাদের ভূষিত করা হয়েছে’। অর্থাৎ মানব জাতিকে মাটি ও পানি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।[২৩] অন্য বর্ণনায় সরাসরি বলা হয়েছে, وَالنَّاسُ بَنُوْ آدَمَ وَخَلَقَ اللهُ آدَمَ مِنْ تُرَابٍ ‘মানুষ আদমের সন্তান। আর আল্লাহ আদম (আলাইহিস সালাম)-কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন’।[২৪]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)  

তথ্যসূত্র :
[১]. ফাযায়েলে আমল, ফাযায়েলে নামায অংশ (বাংলা), পৃ. ১৮৯-১৯০; (উর্দূ), পৃ. ৮৭-৮৮। 
[২]. ইসলামী দাওয়াহ ও তাবলীগ জামায়াত, পৃ. ১২৩।  
[৩]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-জাওয়াবুছ ছহীহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩২৯।  
[৪]. আব্দুর রহমান দেমাষ্কী, আন-নকশাবন্দিয়াহ (রিয়ায : দারু ত্বাইয়েবাহ, ১৯৮৮), পৃ. ৬২।  
[৫]. মাওসূ‘আতুর রাদ্দি আলাছ ছূফিয়াহ, ৬৮তম খণ্ড, পৃ. ৭১।-جاء الى بيته رجل فدق بابه فقال أبو يزيد من تطلب؟ فقال الطارق أريد أبا يزيد. فقال له أبو يزيد ليس في البيت غير الله
[৬]. ড. সাফার আব্দুর রহমান, উছূলুল ফিরাক ওয়াল আদইয়ান ওয়াল মাযাহিবুল ফিকরিয়া (মিশর : দারুর রুউওয়াদ, ২০১৩), পৃ. ৮৫। 
[৭]. আব্দুর রহমান দেমাষ্কী, আন-নকশাবন্দিইয়াহ (রিয়ায : দারু ত্বাইয়েবাহ, ১৯৮৮), পৃ. ৬২; মাসিক আত-তাহরীক, জানুয়ারী ’৯৯, পৃ. ৭।  
[৮]. ইবনুল আরাবী, আল-ফুতূহাতুল মাক্কিয়্যাহ।
[৯]. ড. মুহাম্মাদ জামীল গাযী, আছ-ছূফিয়্যাতু ওয়াল ওয়াজহুল আখর, পৃ. ১২; ড. মাহমূদ আব্দুর রাাযযাক (সংকলক), আল-মু‘জামুছ ছূফী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৬২; আব্দুর রহমান আল-উকীল, হাযিহি ইয়াছ ছূফীয়্যাহ, পৃ. ৩৯।
[১০]. ড. মুহাম্মাদ জামীল গাযী, আছ-ছূফিয়্যাতু ওয়াল ওয়াজহুল আখর, পৃ. ৪৪।
[১১]. ড. মুহাম্মাদ জামীল গাযী, আছ-ছূফিয়্যাতু ওয়াল ওয়াজহুল আখর, পৃ. ৪৫; একদল উলামা কর্তৃক লিখিত, মাওসূ‘আতুর রাদ্দি আলাছ ছূফিয়্যাহ, ৫৮তম খণ্ড, পৃ. ৪৬।
[১২]. যিয়াউল কুলূব (উর্দূ), পৃ. ২৭-২৮; (বাংলা), পৃ. ৫১।
[১৩]. আল-ফিক্বহুল আকবার, পৃঃ ৬৬-৬৭।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৯৪, ‘সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; মিশকাত, হা/২৩৬৪, ‘দু‘আ’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর রহমতের প্রশস্ততা’ অনুচ্ছেদ।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪২০, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২০।
[১৬]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৭।
[১৭]. আল-আছারুল মারফূ‘আহ ফিল আখবারিল মাওযূ‘আহ, পৃ. ৪৩।
[১৮]. ইমাম সুয়ূত্বী, আল-লাইলিল মাছনূ‘আহ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আহ, পৃ. ২৪৯।
[১৯]. ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ আল-জারাহী আল-আজলূনী, কাশফুল খাফা মুযীলুল ইলবাস আম্মা ইশতাহারা আলা আলসিনাতিন নাস হা/৮২৭, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৬।
[২০]. সিলসিলাতুল আহাদীছিল ওয়াহেয়াহ, পৃ. ১৫৭।
[২১]. সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৪৫৮-এর আলোচনা দ্রঃ-خلقت الملائكة من نور وخلق إبليس من نار السموم وخلق آدم عليه السلام مما قد وصف لكم . رواه مسلم وغيره . وفيه إشارة إلى بطلان الحديث المشهور على ألسنة الناس : أول ما خلق الله نور نبيك يا جابر! ونحوه من الأحاديث التي تقول بأنه ﷺ خلق من نور
[২২]. আল-আছারুল মারফূ‘আহ ফিল আখবারিল মাওযূ‘আহ, পৃ. ৪৩।
[২৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৯৬, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪১৩, (ইফাবা হা/৭২২৫), ‘যুহদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১১; মিশকাত, হা/৫৭০১।
[২৪]. তিরমিযী, হা/৩২৭০, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬৩, ‘তাফসীর’ অধ্যায়, সূরা হুজুরাতের ১৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।




প্রসঙ্গসমূহ »: দাওয়াত
ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ (শেষ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
বাউল মতবাদ - গোলাম রহমান
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
যাকাত বণ্টনে সমস্যা ও সমাধান - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (শেষ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর আগমন সংশয় নিরসন (৬ষ্ঠ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
আশূরায়ে মুহাররম : করণীয় ও বর্জনীয় - ইউনুস বিন আহসান
বিদ‘আত পরিচিতি (১৫তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ