কুরআনী প্রবাদ সংকলন : তাৎপর্য ও শিক্ষা
-প্রফেসর ড. লোকমান হোসাইন*
(গত সংখ্যার পর)
৮. আল-আমছালু ফিল কুরআনিল কারীম (الأمثال فى القرآن الكريم)
গ্রন্থটি রচনা করেছেন ইমাম ইবন কায়্যিম আল-জাওযিয়া (মৃ. ৭৫১ হি.)। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গ্রন্থটি একটি প্রামাণ্য দলীল। কুরআনী প্রবাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রায় সকল লেখক ও গবেষকই করেছেন। কিন্তু ইবন কায়্যিম এ গ্রন্থে প্রবাদগুলো উপস্থাপন করেছেন একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে। প্রবাদের অর্থ, তাৎপর্য, শিক্ষা ও প্রয়োগিক বাস্তবতাসহ প্রাসঙ্গিক অনেক বিষয় নিয়ে এখানে কথা বলা হয়েছে। গ্রন্থটি মাঝারি আকারের। এটি ‘আমছালুল কুরআন’ নামে মক্কা শরীফ থেকে ১৯৮২ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। পা-ুলিপির পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনা করেছেন নাসির ইবন সা‘দ। এটি মিসরের তান্তা থেকেও ১৯৮৬ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদনা করেছেন ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ। এ সংস্করণে এর নাম দেয়া হয়েছে- ‘আল-আমছালু ফিল কুরআনিল কারীম’।
গ্রন্থকার ইমাম শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবন আবু বকর ইবন কায়্যিম আল-জাওযিয়া দামেশক শহরে ৬৯১ হি. জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৭৫১ হি. মৃত্যুবরণ করেন।[১] তার জন্ম হয়েছিল এমন এক সন্ধিক্ষণে যখন তাতারগণ মুসলিম সাম্রাজ্য দখল করে নিয়েছিল। ফলে মুসলিমগণ নিজ দেশে পরবাসী হয়ে যায়। অন্য দিকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাদের এমন দৈন্যতা দেখা দেয় যে, দু’চারজন ছাড়া প্রায় সবাই নিজ ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যায়। কোনটা তাওহীদ আর কোন্টা শিরক কিংবা কোন্টা সুন্নাত আর কোন্টা বিদ‘আত তা ভেবে দেখার মত অবকাশ তাদের ছিল না। ধর্ম-অর্ধম সব একাকার হয়ে যায়। ঠিক এ সময় ইমাম ইবন তাইমিয়া[২] ও তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী ইবন কায়্যিম জাওযিয়ার মাধ্যমে আল্লাহ পাক তাওহীদ ও সহীহ সুন্নাত এর পুনর্জাগরণের ব্যবস্থা করেছিলেন।[৩] তাঁর অমর কীর্তির মধ্যে আছে- ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, যাদুল মা‘আদ, ইগাছাতুল লাহফান, আল-আমছাল ফিল কুরআনিল কারীম, আকসামুল কুরআন, হাদিউল আরওয়াহ, আস্ সাওয়াইকুল মুরসালাহ ইত্যাদি।[৪]
৯. ‘আমছালুল কুরআন’ (أمثال القرآن)
‘আমছালুল কুরআন’ নামের এগ্রন্থটি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে একটি প্রামাণ্য দলীল।[৫] কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে গ্রন্থটি প্রকাশ লাভ করতে পারেনি। তবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরবর্তীতে যারা আলোচনা করেছেন তারা সবাই এ থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছেন। এগ্রন্থটির লেখকের নাম হচ্ছে ইসমাইল ইবন আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ। তার ডাক নাম ছিল আবু আব্দুর রহমান। তিনি শাফেয়ী মাযহাবের ফকীহদের অন্যতম ছিলেন। সমকালীন সময়ে তার নিকটই ফতোয়া চাওয়া হতো। তিনি ৪৩০হি./১০৯৩ইং সনে মৃত্যুবরণ করেন।[৬]
১০. ‘আমছালুল কুরআন’ (أمثال القرآن)
গ্রন্থটি রচনা করেছেন জনাব আলী আসগর হিকমত। কুরআনী প্রবাদের উপরে লেখা জনাব হিকমতের আমছালুল কুরআন নামীয় গ্রন্থটি খুবই প্রসিদ্ধ। ফার্সী ভাষায় লেখা গ্রন্থটি মাঝারী আকারের। গ্রন্থটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি ১৩৩৩হি./১৯১৪ইং সনে তেহরানের কুম শহর থেকে প্রকাশিত হয়। ফার্সী ভাষায় লেখা ‘আমছালুল কুরআন, গ্রন্থটির লেখক আলী আসগর ছিলেন ইরানের একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও গবেষক। কুরআন গবেষণায় তার বেশ সুনাম আছে।[৭]
১১. ‘ইযাতুদ্ দীনীয়া ফিল-আমছালিল কুরআনিয়াতি ওয়ান্-নাবাভিয়াতি ওয়াল আরাবিয়াহ’ (العظات الدينية فى الأمثال القرآنية والنبوية والعربية)
গ্রন্থটি রচনা করেছেন জনাব আল-ফিকরী (১৩৭২হি./১৯৫৩ই.)। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গ্রন্থটি একটি প্রামাণ্য দলীল। কুরআনী প্রবাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অনেকেই করেছেন। কিন্তু এ গ্রন্থে গ্রন্থকার প্রবাদগুলো উপস্থাপন করেছেন এক নতুন আঙ্গিকে। প্রবাদের অর্থ, তাৎপর্য, শিক্ষা ও প্রয়োগিক বাস্তবতাসহ প্রাসঙ্গিক অনেক বিষয় নিয়ে এখানে কথা বলা হয়েছে। এর একটি সংস্করণ ১৩১৭হি./১৯৩৭ইং সনে মিসরের হালবী প্রেসে ছাপা হয়। ‘ইযাতুদ্ দীনীয়া ফিল-আমছালিল কুরআনিয়া...’ নামীয় এ মূল্যবান গ্রন্থটির লেখকের নাম হচ্ছে আলী আল-ফিকরী। তার পিতা ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ছিলেন মিসরের প-িতদের মধ্যে অন্যতম। জনাব ফিকরী বহু গ্রন্থ প্রনেতা। তিনি কায়রোতে ১৩৭২হি./১৯৫৩ইং সনে মৃত্যুবরণ করেন।[৮]
১২. ‘আল-আমছালুল কামিনাতু ফিল কুরআন’ (الأمثال الكامنة فى القرآن)
এগ্রন্থটি কুরআনী প্রবাদ বিষয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনের এমন অনেক আয়াত আছে, যাতে ‘মাছাল’ (প্রবাদ) শব্দটির উল্লেখ নেই অথবা যাতে উপমা স্পষ্ট নয় অথচ সেগুলো প্রবাদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এমন সব প্রবাদ নিয়ে ধর্ম ও সাহিত্যের আলোকে খুব সুন্দর আলোচনা করা হয়েছে এগ্রন্থে। এর একটি সংস্করণ ১৩৮৩হি./১৯৬৩ইং সনে বৈরূত থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এগ্রন্থের লেখকের নাম হচ্ছে হাসান ইবন ফযল।[৯]
১৩. ‘আল-আমছাল ফিল কুরআন’ (الأمثال فى القرآن)
গ্রন্থটিতে প্রবাদের অর্থ, তাৎপর্য, শিক্ষা ও প্রয়োগিক বাস্তবতাসহ প্রাসঙ্গিক অনেক বিষয় নিয়ে বিস্তারিতভাবে কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গ্রন্থটি একটি প্রামাণ্য দলীল। ‘আল-আমছাল ফিল কুরআন’ গ্রন্থটির একটি সংস্করণ মিসরের দারুল মা‘আরিফ প্রেস হতে ১৩৮৫হি./১৯৬৫ইং. সনে প্রকাশিত হয়। এগ্রন্থের লেখক হচ্ছেন ড. মাহমূদ ইবন শরীফ। তিনি একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। সমসাময়িককালের মিসরীয় সাহিত্যিক ও গবেষকদের মাঝে তাঁর বেশ সুনাম ছিল।[১০]
১৪. ‘আল-আমছাল ফিল কুরআন ওয়াল কিতাবিল মুকাদ্দাস’ (الأمثال فى القرآن و الكتاب المقدس)
গ্রন্থটি রচনা করেছেন আব্দুর রহমান মাহমূদ আব্দুল্লাহ। তার এ গ্রন্থটি ১৩৯১হি./১৯৭১ইং. সনে বাগদাদ থেকে প্রকাশিত হয়। লেখক এতে পবিত্র কুরআন এবং তৌরাত ও ইন্জিলে ব্যবহৃত প্রবাদসমূুহ নিয়ে খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন। ক্ষেত্র বিশেষে তুলনামূলক পর্যালোচনাও করেছেন।[১১]
১৫. ‘আল আমছাল ফিল কুরআনিল কারীম’ (الأمثال فى القرآن الكريم)
গ্রন্থটির রচয়িতা ড. ফায়্যায (মৃ. ১৪০৭হি./১৯৮৭ইং)। আধুনিক যুগের চাহিদাকে সামনে রেখে গ্রন্থটি লেখা হয়েছে। এতে গ্রন্থকার ‘মাছাল’ (প্রবাদ) শব্দের বিশ্লেষণ, সংজ্ঞা, গুরুত্ব ও প্রকারভেদ বলার পরে কুরআনী প্রবাদের তাৎপর্য, গুরুত্ব, প্রকারভেদ, সংখ্যা, বিশেষ বিশেষ প্রবাদের ব্যাখ্যা, তৌরাত - ইঞ্জিলে ব্যবহৃত প্রবাদের সাথে কুরআনী প্রবাদের তুলনা, ইত্যাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। গ্রন্থটি সঊদী আরবের রিয়াদে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ইসলামী প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক ১৪১৫হি./১৯৯৫ ইং সনে প্রকাশিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয় ও সাহিত্যের বিচারে গ্রন্থটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
লেখকের পূর্ণ নাম মুহাম্মদ জাবির আল ফায়্যায। তিনি ইরাকের ফাল্লুজা শহরে ১৯৩২ ইং সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৭ ইং সনে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৮ সনে ‘আল আমছাল ফিল হাদীছিশ শরীফ’ অভিসন্দর্ভ রচনা করে তিনি পি-এইচ.ডি. ডিগ্রী লাভ করেন। তার অনেক মূল্যবান বই ও অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আল মাজায ফিল কুরআনিল কারীম, আল মাআজিমুল আরাবিয়াতি ওয়া তুরুকুল ইস্তিফাদাতি মিনহা, মাফহুমুল বালাগা, আল-আমছাল ফিল কুরআনিল কারীম ইত্যাদি।[১২]
কুরআনী প্রবাদের উপর লিখিত কিছু উল্লেখযোগ্য পাণ্ডুলিপি
১৬. ‘আল-আমছাল মিনাল কুরআনি ওয়াস-সুন্নাহ’ (الأمثال من القرآن والسنة)
আবূ মুহাম্মদ যকীউদ্দীন আব্দুল আযীম (মৃ.৬৫৬ হি.) ‘আল-আমছাল মিনাল কুরআন ওয়াস-সুন্নাহ’ নামক এপাণ্ডুলিপিটি রচনা করেন। আরবী প্রবাদ সাহিত্য নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের অনেকেই এই পান্ডুলিপিটির কথা বেশ গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন।[১৩]
১৭. ‘তাশবীহাতুল কুরআনি ওয়া আমছালুহু’ (تشبيهات القرآن وأمثاله)
ইবন কায়্যিম আল-জাওযিয়া[১৪] (মৃ.৭৫১হি./১৩৫৩ইং)-এর ‘তাশবীহাতুল কুরআন ওয়া আমছালুহু’ নামে একটি পাণ্ডুলিপি দারুল কুতুবিল মিসরিয়াতে সংরক্ষিত আছে। পাণ্ডুলিপি নং ২৬৯৮৭ (তাফসীর)।[১৫]
১৮. ‘আমছালুল কুরআনি ওয়া আছরুহা ফিল আদাবিল আরাবী হাত্তা নিহায়াতিল কারনিছ ছালিছিল হিজরী’ (أمثال القران وأثرها في الأدب العربي حتي نهاية القرن الثالث الهجري)
এ পাণ্ডুলিপির লেখক জনাব নূরুল হক তানভীর। কুরআনী প্রবাদ সম্পর্কে লেখা এ পাণ্ডুলিপিটি কায়রোর দারুল উলূম কলেজ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। রিসালা নং ৭।[১৬]
১৯. ‘ফিল আমছালিস সাইরাতি মিনাল কুরআন’(في الأمثال السائرة من القران)
লেখক অজ্ঞাত। ‘আমছালুস সাইরা মিনাল কুরআন’ নামক এ পাণ্ডুলিপিটি দারুল কুতুবিল মিসরিয়া নামক লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। পা-ুলিপি নং তাফসীর-৬৪।[১৭]
কুরআনী প্রবাদের আলোচনা রয়েছে এমন কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ[১৮]
২০. ‘আত্-তামছীল ওয়াল মুহাযারা’ (التمثيل والمحاضرة)
গ্রন্থটির লেখক আবু মন্সূর মালিক ইবন মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল আছ ছাআলিবী (মৃ.৪২৯হি./১০৩৭ইং)। বিশেষ চারটি রিসালা (অধ্যায়) নিয়ে ‘মুন্তাখাবুত্ তামছীল ওয়াল মুহাযারা’ নামে গ্রন্থটি কনস্টান্টিনোপাল হতে ১৩০২হি./১৮৮৫ইং. সনে প্রকাশিত হয়। আর পূর্ণ গ্রন্থটি আব্দুল ফাত্তাহ এর সম্পাদনায় ঈসা আল-হালবী, মিসর হতে ১৩৮১হি./১৯৬১ইং. সনে প্রকাশিত হয়। এগ্রন্থে গ্রন্থকার যবুর, তওরাত, ইঞ্জিল এবং কুরআন থেকে বহু প্রবাদ উল্লেখ করেছেন।[১৯] এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী/প্রবাদ, প্রাক-ইসলামী ও ইসলামী যুগের বহু প্রবাদ, জ্ঞানগর্ভ বাণী, রাজা-বাদশাহ এবং দার্শনিক ও মনীষীদের উক্তির সমাহার ঘটেছে এ-গ্রন্থে।[২০]
২১. ‘খাস্সুল খাস’ (خاص الخاص)
আবূ মান্সূর মালিক ইবন মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল আছ ছাআলিবী (মৃ.৪২৯হি./১০৩৭ইং)- এর এটি দ্বিতীয় গ্রন্থ। গ্রন্থটির ১ম সংস্করণ ড. সাদিক তাওয়াবের সম্পাদনায় ১৪০৮হি./ ১৯৮৪ইং. সনে হায়দরাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়। এগ্রন্থের ২য় অধ্যায়ে ‘ফী আমছালিল আরাবি ওয়াল-আজামি ওয়াল খাস্সাতি ওয়াল আম্মাতি জাআত ফী মাআনীহা আলফাযুম মিনাল কুরআনি বি-আহসানি মাআনিহা’ শিরো-নামের অধীনে আরব-অনারবের প্রবাদ, লোগোক্তি ও প্রাজ্ঞোক্তির সাথে তুলনাপূর্বক কুরআনী প্রবাদ নিয়ে অতি চমৎকার আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ফী মা জা-আ মিনাল আমছালি আলা ওযনি আফআলু মিন কাযা’-এর অধীনে লেখক ‘আফআলু মিন’(দু’টি বিষয়ের মধ্যে তুলনাপূর্বক আধিক্য বুঝায়) জাতীয় প্রবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।[২১]
২২. ‘ছিমারুল কুলূব ফিল মুযাফি ওয়াল মানসূব’: (ثمار القلوب فى المضاف والمنسوب)
এটিও আবু মন্সূর আছ ছাআলিবীর লিখিত একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এর একটি সংস্করণ ১৯৬৫ খৃস্টাব্দে কায়রোর দারুল মা‘আরিফ প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এতে তিনি অন্যান্য প্রবাদের সাথে কুরআনী প্রবাদ, হাদীছে ব্যবহৃত প্রবাদ ও মহানবী (ﷺ)-এর প্রজ্ঞাপূর্ণ কথামালা নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা করেছেন।[২২]
২৩. ‘কিতাবুল আদাব’ (كتاب الأدب)
জাফর ইবন শামসুল খিলাফা[২৩] (মৃ. ৬২২হি./১২২৫ইং) তার ‘কিতাবুল আদাব’ গ্রন্থে আরবী সাহিত্যের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তিনি অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি কুরআনী প্রবাদের উপরও আলোচনা করেছেন।[২৪]
২৪. ‘ই’লামুল মুওয়াক্কিঈন’ ( إعلام الموقعين)
এটি ইবন কায়্যিম আল-জওযিয়া[২৫] (মৃ.৭৫৪হি./১৩৫৩ইং) এর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। গ্রন্থটি ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে কায়রোর কুল্লিয়াতুল আযহারিয়া লাইব্রেরী থেকে প্রকাশিত হয়। এগ্রন্থে তিনি অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি কুরআনী প্রবাদ সম্পর্কেও বেশ আলোচনা করেছেন।[২৬]
২৫. ‘আল-বুরহান ফী উলূমিল কুরআন’ (البرهان فى علوم القرآن)
এটি বদরুদ্দীন মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহ যারাকশী[২৭] (মৃ.৭৯৪হি./ ১৩৯২ইং)-এর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। গ্রন্থটির একটি সংস্করণ আবুল ফযল ইব্রাহীমের সম্পাদনায় ১৩৭৬হি./১৯৫৭ইং. সনে প্রকাশিত হয়। প্রকাশনায় ঈসা আল-হলবী, কায়রো, মিসর। লেখক তার ‘আল-বুরহান ফী উলূমিল কুরআন’ গ্রন্থে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ‘আমছালুল কুরআন’ (কুরআনী প্রবাদ) সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা করেছেন।[২৮]
২৬. ‘আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন’ (الإتقان فى علوم القرآن)
ইমাম জালালুদদীন সুয়ূতী[২৯] (মৃ.৯১১হি./১৫০৫ইং.) এর লেখা ‘আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন’ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে একটি সমধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এটি পৃথিবীর বহু দেশ থেকে কয়েকবার করে প্রকাশিত হয়েছে। এর একটি সংস্করণ ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মিসরের হালবী প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। লেখক ‘ফী আমছালিল কুরআন’ শিরোনামের অধীনে কুরআনী প্রবাদ কী ও কেন, কুরআনে প্রবাদ বর্ণনার কারণ, এর প্রকারভেদ এবং কুরআনী প্রবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু আরবী প্রবাদ নিয়ে সুন্দর আলোচনা করেছেন।[৩০]
২৭. ‘আল-মাবাহিছ ফী উলূমিল কুরআন’ (المباحث فى علوم القرآن)
কুরআন গবেষক মান্না খলীল আল-কাত্তান ‘আল মাবাহিস ফী উলূমিল কুরআন’ নামক গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটির নবম সংস্করণ ১৪০০হি./১৯৮০ইং. সনে দারুল কিতাবিল আরাবী, বৈরূত থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ‘আমছালুল কুরআন’ শিরোনামে কুরআনী প্রবাদসহ বিভিন্ন প্রবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এতে তিনি কুরআনী প্রবাদের শাব্দিক বিশ্লেষণ, সাহিত্যের পরিভাষায় এর সংজ্ঞা, গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা প্রকারভেদ, উদাহরণসহ প্রত্যেক প্রকারের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এবং প্রবাদের উপকারিতা ইত্যাদি সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।[৩১]
২৮. ‘ইকদুল ফুরকান ওয়াল-কুরআন’ (عقد الفرقان والقرآن)
শায়খ খালিদ আব্দুর রহমান তার ‘ইকদুল ফুরকান ওয়াল-কুরআন’ গ্রন্থে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ‘আমছালুল কুরআন’ শিরোনামের অধীনে প্রবাদের সংজ্ঞা, কুরআনী প্রবাদের প্রকারভেদ, এর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।[৩২] গ্রন্থটির একটি সংস্করণ ১৪১৪হি./১৯৯৪ইং. সনে বৈরূত থেকে প্রকাশিত হয়।
২৯. ‘জাওয়াহিরুল আদাব’ (جواهر الأدب)
প্রখ্যাত সাহিত্যিক আহমদ আল-হাশিমীর ‘জাওয়াহিরুল আদাব’ গ্রন্থের ৩য় অধ্যায়ে আরবী প্রবাদের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। কুরআনী প্রবাদ সম্পর্কে এগ্রন্থে লেখক বেশ সুন্দর আলোচনা করেছেন।[৩৩] গ্রন্থটি বৈরূত থেকে (তা.বি.) প্রকাশিত হয়েছে।
৩০. ‘আল-আমছালুল আরাবিয়া’ (الأمثال العربية)
ড. আব্দুল মজীদ কাতামিশ তার ‘আল-আমছালুল আরাবিয়া’ গ্রন্থে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি কুরআনী প্রবাদ ও হাদীসে ব্যবহৃত প্রবাদ সম্পর্কে অনেক আলোচনা করেছেন।[৩৪] গ্রন্থটি দামিশকের দারুল ফিকর প্রকাশনা হতে ১৪০৬হি./১৯৮৬ইং. সনে প্রকাশিত হয়।
৩১. ‘আল-আমছাল ফিন্ নাছরিল আরাবিয়্যিল কাদীম’ (الأمثال فى النثر العربى القديم)
ড. আব্দুল মজীদ আবেদীন তার ‘আল-আমছাল ফিন্ নাছরিল আরাবিয়্যিল কাদীম’ গ্রন্থে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি কুরআনী প্রবাদ ও হাদীছে ব্যবহৃত প্রবাদ সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন।[৩৫] গ্রন্থটি আলেকজান্দ্রিয়ার দারুল ম‘রিফাতিল জামিইয়্যা হতে ১৪০৯হি./১৯৮৯ইং. সনে প্রকাশিত হয়।
উপসংহার
কুরআনী প্রবাদ সংকলন বিষয়ে আমরা এপর্যন্ত যা আলোচনা পর্যালোচনা করলাম তাতে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম যে,-
কুরআনী প্রবাদ বলতে বুঝায় এমন সব আয়াত যাতে উপমার মাধ্যমে বলিষ্ঠ উপদেশ প্রদানের নিমিত্তে কোন ব্যক্তি, বস্তু বা ঘটনাকে বাস্তবমুখী ও মনোহারী চিত্রে চিত্রিত করা হয়েছে।
কুরআনী প্রবাদের মূল লক্ষ্য হল গণমনুষের হেদায়াত বা সুপথের সন্ধান দেয়া।
এহেদায়াত প্রদানের বিষয়কে কেন্দ্র করেই কুরআনী প্রবাদে যেকোন জটিল বিষয়কে অতিসহজ, অবোধগম্য বিষয়কে বোধগম্য এবং চিন্তার জগতে সীমাবদ্ধ বিষয়কে একেবারে বাস্তবমূখী চরিত্রে রূপায়ন করে তোলা হয়।
প্রবাদ জ্ঞানী-গুনী, কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত তথা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নজর কাড়তে সক্ষম হয় বলে ধর্ম ও সাহিত্য- উভয় বিচারেই সমাজ জীবনে প্রবাদের গুরুত্ব যেমন অনস্বীকার্য তেমন প্রয়োজনীয়তাও অপরিসীম।
প্রয়োজনের তাগিদে কুরআনী প্রবাদ কালক্রমে জ্ঞাণ-বিজ্ঞাণের একটি বিশেষ শাখা তথা পৃথক শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করেছে। সঙ্গত কারণেই কুরআনী প্রবাদের উপর প্রচুর গ্রন্থাদি রচিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। একজন শুধু পৃথকভাবে কুরআনী প্রবাদের বর্ণনা দিয়েছেন তো অন্যজন এসবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। অন্যদিকে কেউ কেউ যেমন এসবের উপর যুগজিজ্ঞাসার জবাব বা প্রায়োগিক বাস্তবতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন তেমন অন্যরা আবার তুলনামূলক আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন।
সময়ের চাহিদার কারণেই আজ কুরআনী প্রবাদ বিষয়ক পা-ুলিপিগুলির প্রকাশের ব্যবস্থা করত: সকল গ্রন্থসমূহকে সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে আনা দরকার।
কুরআনী প্রবাদকে নতুন আঙ্গিকে আরো সহজ পাঠ্য করে পেশ করা প্রয়োজন। এতে করে সাধারণ মানুষ যেমন উপকৃত হবেন তেমন প-িতগণও সহজেই তাদের গবেষণার খোরাক পাবেন।
বক্ষমান প্রবন্ধের মাধ্যমে কুরআনী প্রবাদের বহুল প্রচার ও প্রসারের জন্য এবিষয়ে নতুন নতুন গ্রন্থাদির রচনা কামনা করছি। সাথে সাথে পুরাতন পা-ুলিপি ও গ্রন্থাদির প্রকাশ ও পুন:প্রকাশের আবেদন রাখছি।
* আল-কুরআন এ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
তথ্যসূত্র :
[১]. আল-আ’লাম, খ. ২, পৃ. ৩২৮।
[২]. আহমদ ইবন আব্দুল হালিম ইবন তাইমিয়া আল-হাররানী আল-দিমাশকী ৬৬১ হি. জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭২৮ হি. মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তাফসীর, হাদীছ, ফিকহ, গনিত, ফারায়েয, দর্শনশাস্ত্রসহ সে যুগের প্রায় সকল বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। হাদীছ শাস্ত্রের পা-িত্বে তিনি ছিলেন প্রবাদ পুরুষ। একথা স্বীকৃত যে, ‘যে হাদীছ ইবন তাইমিয়ার জানা নাই সেটা মূলত হাদীছ ই নয়’। তাঁর রচিত শুধু বড় বড় গ্রন্থের সংখ্যাই তিন শতাধিক। মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই ইসলামের একজন সংস্কারক হিসাবে তাঁর সুখ্যাতি আছে। - দেখুন, তাবাকাতুল হুফফাজ : সুয়ূতী, ইমাম জালালুদ্দীন (কায়রো : মাকতাবাতু ওয়াহবা, ১৯৭৩ ইং), পৃ. ৫১৬-৫১৮; কিতাবুয যায়ল আলা তাবাকাতিল হানাবিলা :ইবন রাজাব ( বৈরুত : দারুল মা’রিফা,১৯৪৩ ইং) খ.৪, পৃ.৩৮৭-৪০৮।
[৩]. মা’আ ইবনিল কায়্যিম : ইবন আলী, ড. আব্দুর রহমান (মদীনা মুনাওয়ারা : আর রাইদ প্রকাশনী, ২০০৫ খৃ.) ভূমিকা দ্র.; আরবী প্রবাদ সাহিত্য , পৃ. ৩৫১ ; হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাস, পৃ. ১০৪ ।
[৪]. মা’আ ইবনিল কায়্যিম : ইবন আলী, ড. আব্দুর রহমান (মদীনা মুনাওয়ারা : আর রাইদ প্রকাশনী, ২০০৫ খৃ.) ভূমিকা দ্র.; আরবী প্রবাদ সাহিত্য , পৃ. ৩৫১ ; হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাস, পৃ. ১০৪ ।
[৫]. আরবী প্রবাদ সাহিত্য, পৃ. ৩৫৩।
[৬]. আল-আ’লাম, খ. ১, পৃ. ৩০৯।
[৭]. আল-আমছাল ফিল কুরআনিল কারীম, আল-ফায়্যায, ড. জাবের (রিয়াদ : আন্তর্জাতিক ইসলাশী প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৫ই), পৃ. ৮৭; আরবী প্রবাদ সাহিত্য, পৃ. ৩৫২।
[৮]. আল-আ’লাম, খ. ৪, পৃ. ৩১৯।
[৯]. আরবী প্রবাদ সাহিত্য, পৃ. ৩৫৩।
[১০]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫১।
[১১]. দেখুন, পৃ. ১২১-১২৭।
[১২]. আল-আমছাল ফিল কুরআনিল কারীম, লেখক পরিচিতি দ্র.।
[১৩]. আরবী প্রবাদ সাহিত্য, পৃ. ৩৫৩-৩৫৪।
[১৪]. তাঁর সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন এ প্রবন্ধের ৮ নং গ্রন্থ আলোচনা।
[১৫]. আরবী প্রবাদ সাহিত্য, পৃ. ৩৫৪।
[১৬]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৩।
[১৭]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫০।
[১৮]. এ ধরণের গ্রন্থ আছে ৩০ এরও অধিক। -দেখুন, আরবী প্রবাদ সাহিত্য, পৃ. ৩৬৪-৩৬৮,৩৭৩-৩৭৮ ; আল-আমছালুল কুরআনিয়াতুল কিয়াসিয়া ,ভূমিকা ।
[১৯]. দেখুন, পৃ. ২৭-৪৪।
[২০]. দেখুন, পৃ. ৫৭-৬৪।
[২১]. দেখুন, পৃ. ১৩,১৪,১৭,২০, ইত্যাদি।
[২২]. দেখুন, পৃ. ১০-১৩,১৭-১৯, ইত্যাদি।
[২৩]. তার পুরা নাম আবুল ফযল জাফর ইবন শামস আল-খিলাফা আল আফযালী। তিনি একজন প্রখ্যাত মিসরীয় কবি ছিলেন। - আল-আ’লাম, খ.২,পৃ. ১২৮।
[২৪]. আরবী প্রবাদ সাহিত্য, পৃ. ৩৭৬।
[২৫]. তাঁর সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন তথ্যসূত্র নং ৩৬।
[২৬]. দেখুন, পৃ. ২৮১-২৮৯।
[২৭]. তিনি হলেন,মুহাম্মদ ইবন বাহাদুর ইবন আব্দুল্লাহ বদরুদ্দীন আল-মিনহাজী আয-যারাকশী। মিসরেই তার জন্ম ও মৃত্যু হয়। তিনি শাফেয়ী মতাদর্শের একজন বড় পণ্ডিত ছিলেন। - আল-আ’লাম,খ.৩,পৃ.৪৪।
[২৮]. দেখুন, পৃ. ২৬৩-৩০০।
[২৯]. তিনি হলেন, আব্দুর রহমান ইবন আবু বকর জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতী। তাফসীর, হাদীছ, ফিকহ, ভাষা,ইতিহাস, দর্শনসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সকল শাখায়ই তাঁর নজর কাড়া পাণ্ডিত্ব ছিল । মিসরেই তাঁর জন্ম ও মৃত্যু হয়। তিনি ছোট বড় মিলে প্রায় ৭২৫ এরও অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। - তাবাকাতুল হুফফায, ইমাম সুয়ূতী, (কায়রো ; মাকতাবাতু ওয়াহবা, ১৯৭৩ইং) ভূমিকা দ্র.।
[৩০]. দেখুন, খ.১, পৃ.১৫১-১৫৮।
[৩১]. পৃ. ২৮১-২৮৯ দ্র.।
[৩২]. আরবী প্রবাদ সাহিত্য, পৃ. ৩৭৬।
[৩৩]. পৃ. ২৬৩-২৮২ দ্র.।
[৩৪]. গ্রন্থের ২য় ও ৩য় অধ্যায় দ্র.।
[৩৫]. দেখুন, গ্রন্থের ৩য় অধ্যায়।
প্রসঙ্গসমূহ »:
কুরআনুল কারীম