সচ্চরিত্রই মানব উন্নতির চাবিকাঠি
-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর*
[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
উত্তম চরিত্রের জন্য দু‘আ
মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বীয় প্রভুর নিকট সচ্চরিত্রের জন্য প্রতিনিয়ত দু‘আ করতেন। এ মর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ اللَّهُمَّ حَسَّنْتَ خَلْقِىْ فَأَحْسِنْ خُلُقِىْ
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে উত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন, অতএব আমার স্বভাব-চরিত্রকে উত্তম করুন’।[১] মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন উত্তম স্বভাবের জন্য মহান আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করেছেন, তখন আমাদের কী পরিমাণ এ দু‘আ করা উচিত তা প্রত্যেক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির বিবেচ্য বিষয়। অবশ্য এ দু‘আটি তিনি আয়না দেখার সময় বলতেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা তাঁর উম্মত হওয়া সত্ত্বেও কয়জন ব্যক্তি আয়না দেখার সময় উক্ত দু‘আ পড়ি তা বলা ভার। গণনা করলে হয়তবা শতকরা দশজনও হবে না। এরূপ একটি সুন্দর দু‘আ পাঠ করা থেকে বিরত থাকলে মানুষের চারিত্রিক অধঃপতন কেন ঘটবে না? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অলসতা বা অবহেলাবশত এসব বিষয়কে এড়িয়ে চলার ফলে মানুষের চরিত্র সুন্দর তো নয়ই; বরং অধঃপতনের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত। অতএব এ দুরবস্থার কি কোন পরিবর্তন হবে না? আমাদের স্বভাব-চরিত্র সুন্দর করার নিমিত্তে আয়না দেখার সময় উক্ত দু‘আটি পাঠ করা উচিত। হতে পারে এরূপ একটি সুন্নাতের অনুসরণের কারণেই মহান আল্লাহ খুশি হয়ে আমাদের চরিত্র সুন্দর করে দিবেন। নতুবা পরকালে ছওয়াব তো আছেই।
সচ্চরিত্রের উপাদান
সততা, সত্যনিষ্ঠা, সম্প্রীতি-সদ্ভাব, পরোপকারিতা, দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা, অধ্যবসায় এবং কর্তব্য পালন হল চরিত্রের মৌলিক উপাদান। এগুলো যখন মানুষ তার নিজের মধ্যে বিকশিত করে তোলে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার প্রতিটি কথা ও কাজের মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়, তখন উত্তম চরিত্র তার স্বভাবের সাথে একীভূত হয়ে যায়। ফলে দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক আচরণও উত্তম চরিত্রের বৈশিষ্ট্যাবলী প্রকাশ পেতে থাকে। আর এ পর্যায়ে গিয়ে ব্যক্তির চরিত্র তার জন্য সম্পদ হিসাবে পরিগণিত হয়। সর্বোপরি ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলী বিকাশের ক্ষেত্রে নীচের বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।[২]
১. মানবিক গুণাবলী হিসাবে ধৈর্য, সাহস, আনুগত্য, সততা, সৌজন্য, নির্ভরযোগ্যতা, কৃতজ্ঞতাবোধ ইত্যাদি।
২. শৃংখলা, সময়ানুবর্তিতা, সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি সামগ্রিক আচার-আচরণের অভ্যাস।
৩. দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবোধ, আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ববোধ, মানবপ্রেম ইত্যাদির সমন্বিত ভাবাবেগ।
৪. হিংসা-বিদ্বেষ, কুটিলতা ইত্যাদি পরিহার এবং কু-প্রবৃত্তি দমন।
৫. ন্যায়বিচার, মানবকল্যাণ ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীকে জীবনের চালিকাশক্তি হিসাবে গ্রহণ।
চারিত্রিক কিছু মহৎ গুণের বর্ণনা দিতে গিয়ে মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র ও ব্যবহার ভাল সে ব্যক্তি আমার নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় এবং ক্বিয়ামত দিবসে সে আমার সবচেয়ে নিকটে অবস্থান করবে। আর আমার নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি ক্বিয়ামত দিবসে যারা আমার থেকে দূরে থাকবে তারা হল যারা অনর্থক বকবক করে, উপহাস করে এবং অহংকার প্রদর্শন করে’।[৩]
আলোচিত উপাদান বা বৈশিষ্ট্যগুলো কোন ব্যক্তি নিজের চরিত্রের সাথে সমন্বয় ঘটাতে পারলে আশা করা যায় সে সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিদের স্তরে উন্নীত হবে। বিধায় এসব গুণাবলী অর্জনে আমাদের সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। চরিত্র-এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Character আর এই Character শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও তার মধ্যে সচ্চরিত্রের যথেষ্ট উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন-
C দ্বারা Calmness বা শান্ত-শিষ্ট। মানুষের স্বভাব চরিত্রে অবশ্যই শান্ত মনোভাব থাকতে হবে নতুবা কোন কাজে সফলতা লাভ করা সম্ভব নয়। তাড়াহুড়া করে কোন কাজে সুফল পাওয়া যায় না। ধীরস্থিরতার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। তাই সচ্চরিত্রের মডেল বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اَلتَّوَدَةُ فِىْ كُلِّ شَيْئٍ خَيْرٌ إِلَّا فِىْ عَمَلِ الْأَخِرَةٍ
‘প্রত্যেক কাজই ধীরে-সুস্থে করার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে, তবে আখেরাতের আমল ব্যতীত’।[৪]
H-তে Honesty বা সততা। সততা তথা ন্যায়পরায়ণতা মানুষের এক অনন্য গুণ। যা মানুষকে মহৎ করে তোলে। সততার গুণে মানুষ স্বচ্ছ স্ফটিকের ন্যায় নির্মল চরিত্রের অধিকারী হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। ব্যবসা-বাণিজ্য সহ সর্বপ্রকার কাজে সততার অভাব থাকলে সুফল আশা করা যায় না। যেখানেই সততার অভাব রয়েছে, সেখানেই ব্যর্থতা ঘনীভূত হয়েছে। সততার গুণগান আমরা প্রবাদ বাক্যেও দেখতে পাই। যেমন- Honesty is the best policy ‘সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা’। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, إِنَّ الصِّدْقَ بِرٌّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِى إِلَى الْجَنَّةِ ‘নিশ্চয় সত্যনিষ্ঠা পুণ্যের পথ দেখায়। আর পুণ্য জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়’।[৫] যার মধ্যে সততা রয়েছে তার চরিত্র ভাল একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
A- Attendance বা সেবা। সেবা মানব জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কোন মানুষই স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। তারা সকলেই একে অপরের মুখাপেক্ষী। একজন স্বীয় দুঃখ-কষ্টের সময় অপরের সাহায্য-সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করে। একজন অপরজনের উপকার সাধন করবে, সাহায্য-সহযোগিতা করবে এটাই তো সেবার প্রকৃত রূপ বা পরিচয়।
মানুষের সেবা করা সম্পর্কে হাদীছে পাওয়া যায়, হাশরের দিন আল্লাহ মানুষকে লক্ষ্য করে বলবেন, তুমি আমার সেবা করনি। তারা বলবে, কিভাবে আপনার সেবা করব। তিনি বলবেন, তোমরা অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করলে আমার সেবা করা হত।[৬]
R- Religion বা ধর্মবিশ্বাস। শিক্ষার সাথে ধর্মের তথা ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশী। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া চরিত্রের পূর্ণ বিকাশ লাভ প্রায় অসম্ভব। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে আদর্শ মানবে পরিণত করে। যার প্রমাণ ভুরি ভুরি। ধর্মীয় শিক্ষার দ্বারা মানুষের নৈতিক অবক্ষয় রোধ যতটা সম্ভব তা অন্যকোন শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা সম্ভব নয়। ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে Stanly Hall বলেন,
If you teach there the three R’s Reading, writing and Arithmetic and don’t teach the forth R Religion, they are sure to become fifth R Rascal.
‘যদি তুমি তাদেরকে তিনটি ‘আর’ তথা লিখতে, পড়তে এবং অংক কষতে শিখাও আর চতুর্থ ‘আর’ তথা ধর্ম না শিখাও, তাহলে অবশ্যই তারা পঞ্চম ‘আর’ তথা বদমাশ’ হয়ে যাবে’।[৭] আরো সহজে বলা যায়, ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু পড়তে লিখতে এবং অংক কষতে শিখালে এবং ধর্ম না শিখালে তারা দুষ্ট হয়ে পড়বেই। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। স্রষ্টাকে চিনতে এবং তাঁর দেয়া দায়িত্ব পালন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
A-Assistance উপকার বা সাহায্য-সহযোগিতা করা। বিভিন্ন বিপদে-আপদে মানুষ সব সময়েই অপরের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। আর যে তাকে এই সাহায্য করে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের নিগূঢ় বন্ধন সৃষ্টি হয়। একে অপরকে সহজেই কাছে টেনে নিতে পারে।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ اَلْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِىْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ اللهُ فِىْ حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةًّ فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِّنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর যুল্ম করবে না। তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে না (অর্থাৎ তাকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিবে না)। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তার অভাব মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্ট লাঘব করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন’।[৮]
C- Cordiality আন্তরিকতা। কোন কাজ করলে সেটা আন্তরিকতা সহকারে করতে হবে। অন্য মনষ্ক হয়ে কাজ করলে সে কাজে সময়, শ্রম, মেধা তুলনামূলক বেশী ব্যয় করতে হয়। তারপরও সে কাজে ভাল ফলাফল পাওয়া যায় না। মনোযোগ সহকারে কাজ করার গুরুত্ব অপরিসীম।
T-Tolerance সহনশীলতা। সহনশীলতা মানব চরিত্রের এক অন্যতম গুণ। সহনশীলতা মানুষকে ভদ্র করে তোলে। যাদের মধ্যে এগুণের সমাহার ঘটেছে তারাই তো সমাজের সবার প্রিয় পাত্র হতে পেরেছেন। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে সহনশীলতার প্রশংসা করার পাশাপাশি তা অর্জন করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। যেমন- মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনৈক ছাহাবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,
إِنَّ فِيْكَ لَخَصْلَتَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللهُ الْحِلْمُ وَالْإِنَأَةُ
‘তোমার মধ্যে এমন দু’টি উত্তম গুণ বিদ্যমান যা আল্লাহ তা‘আলা পসন্দ করেন, তাহল সহনশীলতা ও গাম্ভীর্য’।[৯]
E- Education বা শিক্ষা। মানব জাতির উন্নয়নের জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। কোন জাতির উন্নতি-অগ্রগতি নির্ভর করে শিক্ষার উপর। তাই আজ সারা বিশ্বে জোর তৎপরতা চলছে নিরক্ষরতা দূরীকরণের। এ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশ আরো অনেক আগের। মানুষের চারিত্রিক গুণাবলী বিকাশের অন্যতম মাধ্যম শিক্ষা। বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্যটি এক্ষেত্রে উপস্থাপন না করলেই নয়, Education is the backbone of a nation অর্থাৎ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। যদিও এটিকে ‘সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ বললে আরো ভাল হয়। আজ থেকে বহু বছর পূর্বে শিক্ষার গুরুত্ব বর্ণনায় মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা দেন,
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلىَ كُلِّ مُسْلِمٍ
‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরয’।[১০] তাছাড়া ইসলামের প্রথম বাণী হচ্ছে ‘পড়’ অর্থাৎ বিদ্যার্জন করা সম্পর্কে।
R- Reformation বা সংস্কার, সংশোধন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের ভুল হবে এটা স্বাভাবিক। কোন মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ মানুষ নেই, যার কোনই ভুল হয়নি। তবে এরূপ অনেক মানুষ আছেন যারা ভুল করার সাথে সাথেই তা সংশোধন করে নিয়েছেন। এ সম্পর্কে মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, كُلُّ بَنِىْ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِيْنَ التَّوَّابُوْنَ ‘প্রত্যেক মানুষেরই ভুল হয়। আর তাদের মধ্যে সর্বোত্তম হল যে স্বীয় ভুলের সংশোধন করে নেয়’।[১১]
মানুষের ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এরও ভুল হয়েছে এবং তিনি তা সংশোধন করে নিয়েছেন।[১২] চার খলীফা সহ ছাহাবীদেরও অনেক ভুল হয়েছে।[১৩] তবে তাঁরা তা জানার সাথে সাথে বিনা শর্তে তাৎক্ষণিক সংশোধন করে নিয়েছেন। যার প্রমাণ হাদীছের কিতাব সমূহে বিদ্যমান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজের মানুষের মানসিকতা এমনই যে ভুল করার পর সংশোধন করা তো দূরের কথা অনেক সময় তা স্বীকারই করতে চায় না। এ ধরনের কাজকে সে তার সম্মানহানী মনে করে। যা শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধাও বটে। অথচ মানুষের মানসিকতা এমন হওয়া উচিত ছিল যে, ভুল হওয়ার পর তা জানার সাথে সাথেই সংশোধন করে নিবে। প্রমাণিত কোন ভুলের সংশোধন না করা কোন সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না। ভুল সংশোধনের জন্য আল্লাহ প্রতি শতাব্দীতে একজন সংস্কারক এ পৃথিবীতে পাঠিয়ে থাকেন। তবে বাস্তবতা হল তারও দু’একটি ভুল হতে পারে। যা পরবর্তী সংস্কারক সংশোধন করবেন।[১৪]
ছাত্র জীবন চরিত্র গঠনের উপর্যুক্ত সময়
ছাত্র জীবন হল চরিত্র গঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এটা হল মানুষের প্রস্তুতিপর্ব। এর উপর নির্ভর করে মানুষের পরবর্তী জীবনের সফলতা-ব্যর্থতা। নির্মিত হয় বাকী জীবনের গতি-প্রকৃতি। এটাই হল শিষ্টাচার ও সৌজন্য অর্জনের যথার্থ সময়। যখন একজন ছাত্রের চরিত্রে বিনয়-নম্রতা, ভদ্রতা-শালীনতা, সৌজন্যবোধ ইত্যাদি মহৎ গুণগুলো পরিলক্ষিত হয়, তখন স্বভাবতই শিক্ষক-ছাত্র সকলেই তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তাকে খুব কাছে টেনে নেয়। মূলত ছাত্র জীবন শিক্ষা অর্জনেরই সময়। এ সময় চরিত্র সংশোধনেরও সময়। পক্ষান্তরে তার আচার-ব্যবহার যদি রূঢ় হয়, তাহলে সবাই তাকে ঘৃণা করতঃ দূরে ঠেলে দেয়। আর তার এই রূঢ় আচরণের প্রভাব সারা জীবনের মত থেকে যায়। কেননা স্বভাব সহজে বদলায় না। সেজন্য বলা হয়, ‘ইল্লাত যায় না ধুলে আর খাছলত যায় না মলে’। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোন কোন মানুষের স্বভাব পরিবর্তন হয় না।
ছাত্র জীবন চরিত্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ বিষয়টি বাংলা, ইংরেজী ও আরবী সাহিত্যসহ বিভিন্ন সাহিত্যেই আলোচিত হয়েছে। সকল সাহিত্যে ছাত্রদেরকে চরিত্র গঠনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ছাত্রসমাজ যেভাবে অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে এবং এদের যে নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে তা আদৌ কাম্য নয়। তাই ছাত্রদের উচিত এ সময়ের মধ্যেই সচ্চরিত্রের সকল উপাদান অর্জনের চেষ্টা করা। তবেই তো মরেও অমর হয়ে থাকা যাবে। যেমন কবি বলেন,
এমন জীবন তুমি করিবে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।
সমাপনী
আলোচনার শেষপ্রান্তে বলা যায়, সচ্চরিত্রের নিকট মানব জীবনের বিত্ত-বৈভবও অতি নগণ্য। এটা অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে কেনা যায় না। এটা সাধনা ও ত্যাগের বিনিময়ে তিলে তিলে অর্জন করতে হয়। কেউ রাতারাতি এ মহৎ গুণ অর্জন করতে পারে না। এজন্যই চরিত্র মানব জীবনের অমূল্য রতন। ইসলামের সোনালী যুগে শত-সহস্র বছরের জাহেলী সমাজের মূলোৎপাটন করে ইসলাম স্রোতের বেগে পৃথিবীর অলি-গলিতে পৌঁছে যাওয়ার পিছনেও ছিল মুসলিমদের উন্নত চরিত্রের প্রভাব। তাদের চরিত্রে বিমুগ্ধ হয়ে বাধভাঙ্গা স্রোতের ন্যায় মানুষ ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আজ মুসলিমরা সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে সবখানে লাঞ্ছিত হচ্ছে মুসলিম বিশ্ব পশ্চাৎপদ হচ্ছে। ঘটছে তাদের অধঃপতন।[১৫]
সকল অমুসলিম তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিনিয়ত তাদের উপর চালাচ্ছে অত্যাচারের ষ্টীম রোলার, নিধন করছে হাযার হাযার মুসলমানকে। কিন্তু তাদেরকে পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসতে হলে পুনরায় সেই সোনালী যুগের মুসলিমদের ন্যায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে।
বর্তমান সময়ে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে আইনের পরে আইন প্রণয়ন করেও সমাজে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ইসলাম নির্দেশিত পথেই সমাজের মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ সম্পর্কে ইমাম গাযযালী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল-কুরআন ও হাদীছ মারফত ইসলাম ব্যক্তি চরিত্রে যে সকল গুণাবলীর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে, তাহল চারিত্রিক আদর্শ। কোন দেশ বা জাতি যতক্ষণ পর্যন্ত নৈতিক মূল্যবোধের বা আদর্শের ভিত্তিতে নিজের সংসারযাত্রা নির্বাহ করবে, তারা ততদিন পর্যন্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে না। এটাই আল্লাহর চিরন্তন বিধান।[১৬] বিলাসবহুল গাড়ী-বাড়ী, ধন-সম্পদের উঁচু স্তূপের মধ্যে কোন জাতির কল্যাণ নেই। সুখ ও শান্তি নেই। সুখ ও শান্তি সমৃদ্ধ দেশ গঠনে চাই চরিত্রবান জাতি। এ প্রসঙ্গে লুথার কিং যথার্থই মন্তব্য করেছেন,
‘The prosperity of a country does not consist in its fabulous wealth or magnificent buildings but in its men of education, culture and character’ ‘বিপুল সম্পদ ও মনোরম প্রাসাদের মধ্যে কোন দেশের উন্নতি নিহিত থাকে না; বরং তা নির্ভর করে শিক্ষা-দীক্ষায় ও উন্নত চরিত্রবান অধিবাসীদের উপর’।[১৭]
মোটকথা উন্নত দেশ ও জাতির জন্য চাই উন্নত চরিত্র। যে চরিত্র মানুষ বছরের পর বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলে তা সামান্য সময়ের ব্যবধানে নিমেষেই হারিয়ে যেতে পারে। আসলে চরিত্র গঠন করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন কিন্তু তা ধ্বংস করতে সময় লাগে না। আর একবার চরিত্র নষ্ট হলে সাধারণত আর ফিরে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত প্রবাদ বাক্যটি উল্লেখযোগ্য-
If money is lost nothing is lost, if health is lost something is lost, but if character is lost everything is lost.
‘যদি টাকা হারায় তাহলে কিছুই হারায়নি, যদি স্বাস্থ্য হারায় তাহলে সামান্য কিছু হারিয়েছে। কিন্তু যদি চরিত্র হারায় তাহলে সবকিছুই হারিয়েছে’।[১৮]
পরিশেষে বলতে হয়, সচ্চরিত্রের বিকল্প কিছু নেই। বর্তমান সামাজিক দুরাবস্থা নিরসনের একমাত্র পথ হচ্ছে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া। অন্যথা কোন প্রচেষ্টা সফল হবে না।
* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৮২৩; ছহীহ আত-তারগীব ওয়া তারহবী, হা/২৬৫৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৯৫৯; মিশকাত, হা/৫০৯৯, সনদ ছহীহ।
[২]. ভাষা শিক্ষা, পৃ. ১৬৭।
[৩]. তিরমিযী, হা/২০১৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৭৬৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৫৫৭; মিশকাত, হা/৪৭৯৭, সনদ ছহীহ।
[৪]. আবু দাঊদ, হা/৪৮১০; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/২১৩; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৭৯৪; মিশকাত, হা/৫০৫৮, সনদ ছহীহ।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৯৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৮০৪; আবু দাউদ, হা/৪৯৮৯; তিরমিযী, হা/১৯৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৬৩৮; মিশকাত, হা/৪৮২৪।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৯; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫১৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/২৬৯; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৪৬৮; মিশকাত, হা/১৫২৮।
[৭]. মাহমুদ জামাল, প্রাথমিক শিক্ষা সংগঠন : একটি প্রস্তাবনা (রাজশাহী : নীলুফা, মে ২০০০ ইং), পৃ. ৩৬।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৪২; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৭৪৩; আবু দাউদ, হা/৪৮৯৩; তিরমিযী, হা/১৪২৬; মিশকাত, হা/৪৯৫৮।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২৬; তিরমিযী, হা/২০১১; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৮৫; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৮৮; মিশকাত, হা/৫০৫৪।
[১০]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৪; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তাহরীব, হা/৭২; মিশকাত, হা/২১৮, সনদ ছহীহ।
[১১]. তিরমিযী, হা/২৪৯৯; ইবনু মাজাহ, হা/৪২৫১; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৭৬১৭; দারেমী, হা/২৭২৭; মিশকাত, হা/২৩৪১, সনদ হাসান।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮২; মিশকাত, হা/১০১৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৬২৭৬; মিশকাত, হা/১৪৭।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৫৪; ইবনুল ক্বাইয়িম, ইলামুল মুয়াককেঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৭০-২৭২
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৫৮৪; মিশকাত, হা/৩৭৩২; আবু দাঊদ, হা/৪২৯১, সনদ ছহীহ।
[১৫]. আব্দুর রহমান, কাওয়াকীব (ইস্তাম্বুল : উম্মুল কুরা, ১৯৫৯ইং), পৃ. ১৬১।
[১৬]. ইমাম গাযযালী, খুলুকে মুসলিম, অনুবাদ : মাওলানা মোঃ শহীদুল্লাহ, (ঢাকা : নওমুসলিম কল্যাণ সংস্থা, ৫ম সংস্করণ, ১৯৯০ ইং), পৃ. ৬৬।
[১৭]. সৈয়দ বদরুদ্দোজা, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) : তাঁহার শিক্ষা ও অবদান (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৭ইং), পৃ. ১০৪।
[১৮]. ভাষা শিক্ষা, পৃ. ১৬৮।