বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ০১:২৮ অপরাহ্ন

মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির কারণ ও উত্তররেণর উপায় 

-হাসিবুর রহমান বুখারী* 


(২য় কিস্তি) 

[পূর্বের ২য় শিরোনামের বাকী আলোচনা] 

শায়খ আল্লামা ছালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) সঊদী আরব সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটি একটি বরকতময় রাষ্ট্র। সাউদ পরিবারের রাষ্ট্র বা কর্তৃত্বাধীন। ইসলামী তাওহীদী রাষ্ট্র এবং এখানে বিশুদ্ধ ইসলামী আইন বাস্তবায়িত হয়, ভালোর আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা হয়। এই রাষ্ট্র দু’টি মহৎ পবিত্র মসজিদের সেবা প্রদান করে অর্থাৎ তাদের যত্ন নেয়, যারা হজ্জ ও উমরাহ পালন করে এবং যারা আল্লাহর তাওফীক্বে তাদের কাছে মেহমান স্বরূপ আসেন তাদের নিরাপত্তার প্রতি ও উচ্চ মর্যাদার প্রতি সম্যক খেয়াল রাখা হয়। এটি সঊদী আরব সহ অন্যান্য ইসলামিক বিশ্বে ইসলামী দাওয়াত প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করে। এটি সর্বত্র দরিদ্র ও দুস্থ মুসলিমদের সাহায্য করার জন্য উদারভাবে ব্যয় করে এবং মুসলিমদের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতপক্ষে, এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রকৃত ইসলামী আইনের আনুগত্যের শপথের উপর, ঐক্য রক্ষা করা, অপরাধী এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শাস্তি কার্যকর করার জন্য, যা ধর্ম, সম্মান, সম্পদ, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করবে। ঐক্য ছাড়া নিরাপত্তা আসতে পারে না এবং ইসলামী শাসক ছাড়া কোন ঐক্য হতে পারে না ...’।[১]

শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি যা বলছি তা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি: প্রকৃতপক্ষে, আমি বর্তমান পৃথিবীতে এমন কোন দেশকে জানি না, যেখানে আল্লাহর আইন প্রয়োগ করা হয়, যেভাবে এই পবিত্র ভূমিতে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। আমি বলতে চাচ্ছি সঊদী আরবের আরব সাম্রাজ্যের কথা। আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে এটা আমাদের উপর আল্লাহ তা'আলার অনুগ্রহ, যে আমরা এই দেশের অধিবাসী। তাই আসুন আমরা আজ যে অবস্থায় আছি তা সংরক্ষণ করি, বরং আসুন আমরা আজকে যা করছি তার চেয়ে বেশী আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করি। আমি পরিপূর্ণতার দাবি করছি না, তবে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরাই শীর্ষে আছি। এতে কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের অনেক কিছুই বর্জিত, তবে আমরা আরও ভাল করতে পারি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, কারণ আমরা অন্যান্য দেশ সম্পর্কে যা জানি তার তুলনায় আমরা অনেকটাই এগিয়ে। আমরা দরিদ্রদের পাশে থাকি, ভীতিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করি, অজ্ঞদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করি এবং এই ইসলামী রাষ্ট্রে সকলেই সম্মানের সাথে বসবাস করি। বিশুদ্ধ ইসলাম ধর্মকে আঁকড়ে ধরার কারণে আজ আমরা অনেকেরই চক্ষুশূল। বিদ্বেষপূর্ণ লোকদের অন্তরে আমাদের প্রতি ক্রোধ জেগে ওঠে। তারা চায় আমরা যে অবস্থায় আছি তার অস্তিত্ব বন্ধ হয়ে যাক....! [২]

শায়খ আহমাদ ইবনু উমার ইবনু সালিম বাযমুল (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ ছালিহ আল-লুহাইদান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘এই দেশ ইসলামের প্রাণকেন্দ্র এবং পবিত্র স্থান। এটি শান্তি ও নিরাপত্তার অনেক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যার মিল বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বর্তমান বিশ্বের সরকারগুলোর মধ্যে এটিই সেরা। এর অর্থ এই নয় যে এটি নিখুঁত, এ কথা কেউ বলে না যে এটি নিখুঁত, বরং এর মধ্যেও ভুল রয়েছে, তবে তা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সে কারণে, দেশের মধ্যে ও বাহিরে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয, সে যেন দৃঢ়তার সাথে সত্যের উপর অটল থাকে এবং নির্যাতিতদের সাহায্য করে। তাওহীদের বিশুদ্ধ আক্বীদা গ্রহণ করে এবং নির্ধারিত ইসলামী আইন প্রণয়ন করে’।[৩]

শায়খ আব্দুল আযীয ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘আল্লাহ্ তা‘আলা বাদশাহ আব্দুল আযীযের জন্মের মাধ্যমে  মুসলিমদের সীমাহীন উপকার করেছেন। তিনি ঐক্য এনেছেন, সত্যকে উত্থাপন করেছেন, তাঁর দ্বীনকে সাহায্য করেছেন এবং তাঁর পথে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের দায়িত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার ফলে প্রচুর জ্ঞান, প্রচুর বরকত, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, সত্যকে সাহায্য করা, সত্যের প্রচার করা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আল্লাহর দিকে ডাকা অর্থাৎ তাওহীদ, সুন্নাহ্ ও সালাফদের পথে আহ্বান জানিয়েছেন। অতঃপর তাঁর পরে তাঁর সন্তানরাও এই পথেই হাঁটতে থাকে। তাঁরাও সত্য প্রতিষ্ঠায়, ন্যায়বিচারের প্রচারে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এই সঊদী রাষ্ট্র একটি বরকতময় রাষ্ট্র। আল্লাহ সত্য ধর্মকে সাহায্য করেছেন এবং তাঁর মাধ্যমে ঐক্য এনেছেন এবং দুর্নীতির পথ বন্ধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে যমীনে নিরাপত্তা আনয়ন করেন এবং সেখানে মহান নিয়ামত সংঘটিত হয়, যা আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ গণনা করতে পারে না’।[৪]

বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ আল্লামা নাছিরুদ্দীন আল-আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আরব উপদ্বীপে এবং সমস্ত মুসলিম ভূখণ্ডে নিরাপত্তা ও বরকত রক্ষা করেন এবং তিনি তাওহীদের রাষ্ট্র অর্থাৎ সঊদী আরবের সাম্রাজ্যকে সংরক্ষণ করেন’।[৫]

সঊদী বাদশাহ সাউদ ইবনু আব্দিল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘সর্ব প্রথম আমাদের যে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত তা হল: আমরা সকলেই আল্লাহর রজ্জু অর্থাৎ কিতাব ও সুন্নাহকে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরি এবং আমরা আমাদের দেশের মধ্যে সেই উপায়গুলোকে কাজে লাগাই যা সমাজের সমস্ত ব্যক্তির হৃদয়ে বিশুদ্ধ তাওহীদের চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং যাতে সবাই আন্তরিকভাবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে’।[৬]

সুতরাং আমরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে এ কথা বলতে পারি যে, কুরআনুল কারীম থেকে বিমুখতা বা কুরআন বর্জন মুসলিম সমাজের অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ। বরং এটি অধঃপতনের সবচেয়ে মারাত্মক কারণ। আফসোস! আমাদের মুসলিম সমাজের অধিকাংশ মানুষ এমনকি অল্প-স্বল্প ব্যতীত কুরআন পড়তে জানে না। আবার অনেকে জানলেও নিয়মিত তিলাওয়াত করে না, অপরদিকে যারা একটু-আধটু পড়ে তারাও ভেবে-চিন্তে পড়ে না, তার বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না এবং তার নির্দেশিত পথ মেনে চলার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে না। কুরআনুল কারীম থেকে বিমুখতার কতিপয় ধরণ রয়েছে, যেমনটা আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন। যথা:
(১) নিজে কুরআন তিলাওয়াত বর্জন করা এবং কেউ কুরআন তিলাওয়াত করলে মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ না করা।
(২) যদিও কুরআন পড়ে এবং তার উপর ঈমান রাখার দাবীও করে কিন্তু কুরআন অনুযায়ী আমল করে না এবং কুরআনে ঘোষিত হালাল ও হারাম মেনে চলে না। (৩) কুরআনিক বিচার বর্জন করা এবং দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি ও শাখা-প্রশাখার মীমাংসায় কুরআনের কাছে বিচার প্রার্থনা পরিহার করা।
(৪) কুরআনে বর্ণিত বিষয়াদি বোঝা এবং তার শেষ অবস্থা কত দূর গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে একটুও চিন্তা-গবেষণা না করা এবং কুরআনের মালিক আল্লাহ তা'আলা কুরআন থেকে কী ইচ্ছা পোষণ করেছেন তা জানার চেষ্টা না করা।
(৫) আত্মার সকল রোগ-ব্যাধির চিকিৎসায় কুরআনকে মোটেও কাজে না লাগানো এবং আল্লাহর দেয়া আত্মিক চিকিৎসা বাদ দিয়ে অন্যদের চিকিৎসার শরণাপন্ন হওয়া। এগুলোর সবই কিন্তু রাসূল (ﷺ) কর্তৃক তাঁর প্রভুর সমীপে কৃত অভিযোগের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ قَالَ الرَّسُوۡلُ یٰرَبِّ اِنَّ قَوۡمِی اتَّخَذُوۡا ہٰذَا  الۡقُرۡاٰنَ  مَہۡجُوۡرًا ‘সেদিন রাসূল বলবেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয় আমার উম্মাত এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছিল’ (সূরা আল-ফুরক্বান: ৩০)।

সত্যি সত্যিই আজ মুসলিম সমাজের বৃহৎ অংশ কুরআনকে বাদ দিয়ে আধুনিকতা ও বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে কুরআন বিরোধী নানা বিষয় নিয়ে মেতে আছে। কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় তারা কুুরআন বিরোধী বিষয় বেছে নিয়েছে। কুরআনের মোকাবেলায় মানব রচিত বই-পুস্তককে প্রাধান্য দেয়, মানুষের বক্তৃতা-ভাষণ শোনে, মানুষের রচিত কবিতা আবৃত্তি করে, মানুষের সুর দেয়া গান গায়, কিন্তু কুরআন পড়া ও শোনার কথা তারা মোটেও মনে করে না। কুরআনের সঙ্গে যারা এমন আচরণ করবে স্বাভাবিক ভাবেই কুরআনের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হবে, তাদের জীবনে বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্ট বাড়বে, সমস্যাগুলো বড় হয়ে দেখা দেবে, নেমে আসবে অধঃপতনের কালো মেঘ! সুতরাং এই মরণঘাতী ব্যাধি ও বিপজ্জনক অবস্থার প্রতিকার হিসাবে আমাদের মুসলিম সমাজকে অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহর কাছে ফিরে আসতে হবে। তারা ইসলামী বিধানকে নিজেদের জীবনে অবশ্য পালনীয় করে নিবে। তারা বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াত করবে, কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে তারা কুরআনের ভিত্তিতে প্রতিপালিত হবে।

আফসোস! আমাদের সন্তানেরা পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হয়, কিন্তু তারা কম সংখ্যকই কুরআন পড়ে। কাজেই কুরআনের ভিত্তিতে তাদের প্রতিপালিত হওয়ার প্রশ্নই এখন আর ওঠে না। অথচ প্রতিপালন সূত্রে পিতা-মাতার উপর ফরয ছিল তাদের সন্তানদের কুরআন অধ্যয়ন করানো এবং সততার সাথে পরিচালনার মাধ্যমে কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করানো। অভিভাবকদের উপর এ দায়িত্বও ফরয ছিল যে, তারা মাদরাসা (শিক্ষালয়) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করানোর মাধ্যমে তাদের কুরআনের জ্ঞান পাকাপোক্ত করাবে। ভাইয়েরা আমার, এ জাতি যদি তাদের যুবসমাজকে এবং নিজেদেরকে অবক্ষয় ও অধঃপতন থেকে বাঁচাতে চায়, উদ্ধার করতে চায় তবে এ উম্মাহর ছোট বড় সকলকেই বংশপরম্পরায় এ কাজ চালু করতে হবে।

৩- রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত থেকে বিমুখতা ও বিদ‘আতের বহুলতা মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ

অনুরূপভাবে প্রিয় নবী (ﷺ)-এর সুন্নাহ থেকে দূরত্বও আমাদের মুসলিম সমাজের অধঃপতনের অন্যতম বড় কারণ। নবী (ﷺ)-এর আনুগত্য, অনুসরণ, অনুকরণ ও তাঁর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার গুরুত্ব-মাহাত্ম্য সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা সতর্ককারী ও ভৎর্সনাকারী রূপে বলেন,

لَا تَجۡعَلُوۡا دُعَآءَ الرَّسُوۡلِ بَیۡنَکُمۡ کَدُعَآءِ  بَعۡضِکُمۡ  بَعۡضًا ؕ قَدۡ یَعۡلَمُ  اللّٰہُ  الَّذِیۡنَ  یَتَسَلَّلُوۡنَ مِنۡکُمۡ  لِوَاذًا ۚ فَلۡیَحۡذَرِ الَّذِیۡنَ یُخَالِفُوۡنَ عَنۡ اَمۡرِہٖۤ  اَنۡ تُصِیۡبَہُمۡ فِتۡنَۃٌ  اَوۡ یُصِیۡبَہُمۡ عَذَابٌ  اَلِیۡمٌ

‘তোমরা রাসূলের আহ্বানকে তোমাদের একে অপরের প্রতি আহ্বানের মত গণ্য করো না, তোমাদের মধ্যে যারা চুপি চুপি সরে পড়ে, আল্লাহ তাদের জানেন। সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় (ফিতনাহ) অথবা কঠিন শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে’ (সূরা আন-নূর: ৬৩)।

অর্থাৎ যারা রাসূল (ﷺ) প্রদর্শিত পথের বিরোধিতা করে, তাঁর প্রবর্তিত শরী‘আত ও আইন অনুসারে জীবন পরিচালনা করে না, তাঁর সুন্নাতের বিরোধিতা করে। উপরিউক্ত আয়াতে তাদের জন্য দু’টি শাস্তির ঘোষণা করা হয়েছে। যথা (১) ফিতনাহ অর্থাৎ গোলযোগ, দাঙ্গা, ফিতনা, পরীক্ষা, বিপদ, কষ্ট, আকর্ষণ, ভ্রষ্টতা ইত্যাদি। মুফাসসিরগণ বলেন, ‘তারা যেন ফিতনায় নিমজ্জিত হওয়ার ভয় করে’ অর্থাৎ তারা যেন তাদের অন্তরে শিরক, বিদ‘আত, কুফরী, নিফাক্বী ইত্যাদি লালন করার অথবা তারা তাতে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা করে এবং আরো আশঙ্কা করে যে, ‘তাদের উপর কঠোর শাস্তি আপতিত হবে’ অর্থাৎ দুনিয়াতে তাদের জন্য হত্যাযজ্ঞ, মব লিঞ্চিং (সড়ন ষুহপযরহম), অত্যাচারী শাসকের জুলুম-নির্যাতন, দণ্ডবিধি, জেল ইত্যাদি এবং আখিরাতেও তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি (তাফসীরে ইবনে কাছীর)। কেননা শিরকের পর সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক ও মারাত্মক গুনাহের নাম হল বিদ‘আত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ভয়াবহতা সম্পর্কে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, مَنْ أَحْدَثَ فيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ. ‘কেউ আমাদের এই দ্বীনের অংশ নয় এমন কিছু উদ্ভাবন করলে বা অনুপ্রবেশ ঘটালে তা পরিত্যাজ্য-প্রত্যাখ্যাত’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ. ‘যে ব্যক্তি আমাদের ধর্মীয় কাজের মধ্যে এমন বিষয় উদ্ভাবন করে যা তাতে নেই (দলীলবিহীন), তা অগ্রহণযোগ্য’।[৭] তিনি আরো বলেন, وَإِيَّاكُمْ وَمُحَدِّثَاتِ الْأُمُوْرِ فَإنَّ كُلَّ مُحَدِّثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ ‘তোমরা (দ্বীনের মধ্যে) নব প্রচলিত বিষয়সমূহ থেকে সতর্ক থাকো। কেননা প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বিষয় বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত ভ্রষ্টতা’।[৮] তিনি আরো বলেন যে,

"..مَنْ أحْدَثَ فِيْهَا حَدَثًا أوْ آوَى فِيْهَا مُحْدِثًا، فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ والمَلَائِكَةِ والنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ، لَا يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلَا عَدْلٌ

‘যে কেউ দ্বীনের ব্যাপারে বিদ‘আত উদ্ভাবণ করে কিংবা কোন বিদ‘আতীকে আশ্রয় দেয় কিংবা সাহায্য করে তার উপর আল্লাহ তা‘আলার, ফেরেশতাদের ও সকল মানব জাতির লা‘নত ও অভিসম্পাত। তার কোন ফরয কিংবা নফল ‘ইবাদাত গৃহীত হবে না’।[৯] অন্য এক হাদীছে রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

إنَّمَا مَثَلِي ومَثَلُ النَّاسِ كَمَثَلِ رَجُلٍ اسْتَوْقَدَ نارًا، فَلَمَّا أَضَاءَتْ مَا حَوْلَهُ جَعَلَ الفَراشُ وَهَذِه الدَّوَابُّ الَّتِيْ تَقَعُ في النَّارِ يَقَعْنَ فِيْهَا، فَجَعَلَ يَنْزِعُهُنَّ ويَغْلِبْنَهُ فَيَقْتَحِمْنَ فِيْهَا، فَأَنَا آخُذُ بحُجَزِكُمْ عَنِ النَّارِ، وهُمْ يَقْتَحِمُوْنَ فِيْهَا

‘আমার এবং তোমাদের মাঝে উদাহরণ হল এমন এক ব্যক্তির, যে আগুন জ্বালালো, তারপর সে আলোয় যখন চতুর্দিক আলোকিত হল, তখন দেখা গেল যে, পোকামাকড় এবং ঐসমস্ত প্রাণী যা আগুনে পড়ে, সেগুলো আগুনে পড়তে লাগলো। তখন সে ব্যাক্তি তাদেরকে আগুন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলো। কিন্তু সেগুলো তাকে ছাড়িয়ে সে আগুনে ঝাঁপ দিতে থাকল। তারপর রাসূল (ﷺ) বললেন, এটাই হলো আমার এবং তোমাদের উদাহরণ। আমি তোমাদের কোমরের কাপড়ের গিরা ধরে আগুন থেকে দূরে রাখছি এবং বলছি: আগুন থেকে দূরে থাক। কিন্তু তোমরা আমাকে ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছো’।[১০]

সুতরাং নবী (ﷺ)-এর জীবনাদর্শ তথা সুন্নাতকে পূর্ণাঙ্গরূপে মেনে নেয়াই একজন প্রকৃত মুমিনের কর্তব্য। তার জীবনাদর্শের বাইরে যাওয়ার কথা একজন মুমিন কল্পনা করতেও পারেন না। সুন্নাতের বাইরে যাওয়াকে তিনি তাঁর আখিরাত বিনষ্টের ঝুঁকি মনে করেন। মুমিন জায়েয নাজায়েযের বিতর্কে লিপ্ত না হয়ে হুবহু নবীর আদর্শের উপর অটল থাকাকেই নিজের কর্তব্য মনে করেন। নবী (ﷺ)-এর হাদীছ তাকে এক সুঁতো পরিমাণ বাইরে যেতে দেয় না। কদাচিৎ এমন হয়ে গেলে তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। নবী (ﷺ) বলেন,

مَا مِنْ نَبِيٍّ بَعَثَهُ اللهُ فِيْ أُمَّةٍ قَبْلِيْ إلَّا كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوارِيُّوْنَ، وأَصْحابٌ يَأْخُذُوْنَ بسُنَّتِهِ ويَقْتَدُوْنَ بأَمْرِهِ، ثُمَّ إنَّها تَخْلُفُ مِن بَعْدِهِمْ خُلُوْفٌ يَقُوْلُوْنَ مَا لَا يَفْعَلُوْنَ، وَيَفْعَلُوْنَ مَا لَا يُؤْمَرُوْنَ، فمَن جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ، ومَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الْإِيْمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ

‘আমার পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা যে নবীকেই কোন উম্মতের মধ্যে পাঠিয়েছেন এবং সেই নবীর জন্য তাদের মধ্য হতে এমন কিছু সংখ্যক নিবেদিত প্রাণ অনুসারী ও সহচর জুটেছিল, যারা তাঁর নির্দেশিত পথে জীবন যাপন করতেন এবং তাঁর সুন্নাতকে সমুন্নত রাখতেন’। অতঃপর তাঁদের অবর্তমানে কতগুলো মন্দ লোক স্থলাভিষিক্ত হয়। তারা মুখে যা বলে বেড়াত কাজে তা পরিণত করত না, আর সেসব কর্ম সম্পাদন করত যেগুলোর জন্য তারা আদিষ্ট ছিল না। এদের বিরুদ্ধে যারা হাত দ্বারা জিহাদ করবে তারা মুমিন, যারা এদের বিরুদ্ধে মুখের কথা দ্বারা জিহাদ করবে তারাও মুমিন এবং যারা এদের বিরুদ্ধে অন্তরের ঘৃণা দ্বারা জিহাদ করবে তারাও মুমিন। এর বাইরে সরিষার দানা পরিমানও ঈমানের স্তর নেই’।[১১]

সুন্নাতের উপর অটল থাকার গুরুত্ব এবং এর বাইরে যাওয়ার ভয়াবহতা উপলব্ধি করার জন্য এই একটি হাদীছই যথেষ্ট। ছাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন, তাবি‘তাবিঈন, অনুসৃত চার ইমাম সহ কল্যাণের সাক্ষ্যপ্রাপ্ত যুগের আলিমগণ উপরিউক্ত হাদীছের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করেছেন। আল্লাহ তাঁর দ্বীন তথা নবী (ﷺ)-এর আদর্শ রক্ষা করার জন্যই নবী (ﷺ)-এর এমন স্থলাভিসিক্ত তৈরি করেছেন। যারা যুক্তি বা বিবেক দ্বারা দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর সংযোজন, ইবাদতে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার ইত্যাদির বিরুদ্ধে সজাগ থেকে সর্বদা নবী (ﷺ)-এর সুন্নাত সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন এবং সক্ষম হয়েছেন। সুন্নাতের বাইরে যাওয়া মানেই ভ্রান্তির পথ উম্মুক্ত করা এ কথা বুঝতে তাদেরকে বেগ পেতে হয়নি। সর্বযুগেই আল্লাহ তা‘আলা এমন একদল লোকের মাধ্যমে তার নবীর সুন্নাতকে রক্ষা করবেন যারা নবীর হুবহু সুন্নাতের উপর থাকার চেষ্টা করবেন। সুন্নাতের বাইরে কিছু দেখলেই যথাসাধ্য তা প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এই দল বা তাদের সহযোগী হিসাবে ক্ববুল করুন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলবী (রাহিমাহুল্লাহ) সুন্নাতের উপর থাকার গুরুত্ব বুঝাতে উপরিউক্ত হাদীছ সহ আরো কিছু হাদীছ উল্লেখের পূর্বে লিখেছেন যে,

قد حذرنا النبي صلى الله عليه وسلم مداخل التحريف بأقسامها . وغلظ النهي عنها ، وأخذ العهود من أمته فيها ، فمن أعظم أسباب التهاون ترك الأخذ بالسنة 

‘নবী (ﷺ) আমাদেরকে সর্বপ্রকার তাহরীফ তথা দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি প্রবেশ করানো থেকে সতর্ক করেছেন, তাহরীফ থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন, উম্মাত থেকে এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন, এ ব্যাপারে শিথিলতার সবচেয়ে বড় কারণ হল, সুন্নাতের উপর আমল ছেড়ে দেয়া...’।[১২] অতঃপর তিনি হুবহু সুন্নাতের অনুকরণ না করার সতর্কতা সম্বলিত বিভিন্ন হাদীছ উল্লেখ করেন। সারকথায় তিনি সুন্নাতের মধ্যে কম-বেশ, সংযোজন, বিয়োজন, বাড়াবাড়ি সব কিছুকেই দ্বীনের তাহরীফ বা বিকৃতি গণ্য করেছেন এবং তা বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা প্রমাণ করেছেন।

সারকথা হল- নবী (ﷺ)-এর সামগ্রিক জীবন-পদ্ধতিই সুন্নাত। যা তিনি ফরয হিসাবে করেছেন তা ফরয হিসাবে পালন করা সুন্নাত। যা নফল হিসাবে করেছেন তা নফল হিসাবে পালন করা সুন্নাত। যা সর্বদা করেছেন তা সর্বদা করা, যা মাঝে মাঝে করেছেন তা মাঝে মাঝে করা সুন্নাত। যা সর্বদা বর্জন করেছেন তা সর্বদা বর্জন করা, যা মাঝে মাঝে বর্জন করেছেন তা মাঝে মাঝে বর্জন করা সুন্নাত। যেই কাজ যেই পদ্ধতিতে করেছেন তা সেই পদ্ধতিতে পালন করাই সুন্নাত। কোন কিছুতে ব্যতিক্রম হলেই খিলাফে সুন্নাত বলে গণ্য হবে। করণীয়-বর্জনীয় সকল ক্ষেত্রে তাঁরই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। আনাস ইবনে মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

جَاءَ ثَلَاثَةُ رَهْطٍ إلى بُيُوْتِ أزْوَاجِ النَّبيِّ ﷺ يَسْأَلُوْنَ عن عِبَادَةِ النَّبيِّ ﷺ فَلَمَّا أُخْبِرُوْا كَأنَّهُمْ تَقَالُّوْهَا، فَقَالُوْا: وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبيِّ ﷺ ؟! قدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ، قالَ أحَدُهُمْ: أمَّا أنَا فَإنِّيْ أُصَلِّي اللَّيْلَ أبَدًا، وقالَ آخَرُ: أنَا أصُوْمُ الدَّهْرَ ولَا أُفْطِرُ، وقالَ آخَرُ: أنَا أعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلَا أتَزَوَّجُ أبَدًا، فَجَاءَ رَسوْلُ اللهِ ﷺ إِلَيْهِمْ، فَقالَ: أنْتُمُ الَّذِيْنَ قُلتُمْ كَذَا وكَذَا؟! أَمَا واللهِ إنِّيْ لَأَخْشَاكُمْ لِلهِ وأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّيْ أصُوْمُ وأُفْطِرُ، وأُصَلِّيْ وأَرْقُدُ، وأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فمَن رَغِبَ عن سُنَّتيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ

‘তিনজনের একটি দল নবী (ﷺ)-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য নবী (ﷺ)-এর স্ত্রীদের বাড়িতে আসল। যখন তাঁদেরকে এ সম্পর্কে জানানো হলো, তখন তারা ‘ইবাদতের পরিমাণ কম মনে করল এবং বলল, নবী (ﷺ)-এর সঙ্গে আমাদের তুলনা হতে পারে না। কারণ, তাঁর আগের ও পরের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। এমন সময় তাদের মধ্য থেকে একজন বললেন, আমি সারাজীবন রাতভর ছালাত আদায় করতে থাকব। অপর একজন বললেন, আমি সর্বদা নফল ছিয়াম পালন করব এবং কখনো বাদ দেব না। অপরজন বললেন, আমি নারী সংসর্গ ত্যাগ করব, কখনও বিয়ে করব না। এরপর রাসূল (ﷺ) তাদের নিকট এলেন এবং বললেন, ‘তোমরা কি ঐ সব লোক যারা এমন এমন কথাবার্তা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি বেশি অনুগত, অথচ আমি মাঝে মাঝে নফল ছিয়াম পালন করি, আবার মাঝে মাঝে তা থেকে বিরতও থাকি। রাত্রীতে ছালাত আদায় করি এবং নিদ্রা যাই ও মেয়েদেরকে বিয়েও করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ পোষণ করবে, তারা আমার দলভুক্ত নয়’।[১৩]

সুধী পাঠক! একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করুন তো! এখানে তিনজন ছাহাবীর কেউই নাজায়েয কোন কাজের ইচ্ছা পোষণ করেননি। প্রত্যেকেই ভালো কাজের নিয়ত করেছেন। নফল ছালাত কতই না উত্তম ইবাদত, নফল ছালাতের মাধ্যমে সময় কাটানো মুমিনের উত্তম ব্যবস্থা‌। এ কথা রাসূল (ﷺ) নিজেই বলেছেন,

اَلصَّلَاةُ خَيْرٌ مَوْضُوْعٍ ، فَمَنِ اسْتَطَاعَ أنْ يَسْتكْثِرَ فَلْيَسْتَكْثِرْ

‘ছালাত সর্বাধিক উত্তম ব্যবস্থা। সুতরাং যার বৃদ্ধি করার সামর্থ্য আছে, তার বৃদ্ধি করা উচিত’।[১৪] নফল ছিয়াম পালন করা কতই না উত্তম কাজ। বেশি বেশি ইবাদতের জন্য বৈবাহিক জীবনে নিজেকে জড়িত না করা কতই না উত্তম নিয়ত বা পরিকল্পনা। তথাপি এই কর্মগুলোকে নবী (ﷺ) সুন্নাত বিরোধী বা অপসন্দ বলে আখ্যায়িত করলেন; তার কারণ কী? সাধারণ অপসন্দ নয়, এমন অপসন্দ যার কারণে তাঁর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায় না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তাদের এমন নিয়তের উপর নাবীজীর বাহবা দেয়ার কথা ছিল। মাশাআআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, এমন অনেক বাহবামুলক শব্দ প্রয়োগ করে, ‘আমি যা পারি না তোমরা তা করছ বলে তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরার কথা’। আমাদের যুক্তি বা সমাজের বাস্তব চিত্র এমনটির-ই দাবী রাখে। কিন্তু নবী (ﷺ) উল্টো তাদের উপর রাগ করলেন কেন? বাহ্যত বিষয়টি একটু উল্টো মনে হলেও একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের জন্য এর রহস্য বুঝতে কোন সমস্যা হবে না। কেননা ইবাদত মূলত কম বা বেশি করার নাম নয়। বরং আল্লাহর হুকুম তাঁর রাসূলের পদ্ধতির পূর্ণ অনুসরণ করে পালনের নাম।

এখানে যদিও মূল ইবাদতের মধ্যে পূর্ণ অনুসরণের বৈপরীত্য নেই, তথাপি রাসূল (ﷺ)-এর জীবনাদর্শের সাথে বৈপরীত্য আবশ্যই। কেননা রাত কাটানোর সুন্নাতী পদ্ধতি হল, কিছু সময় ছালাত আদায় করা, কিছু সময় ঘুমানো। যিনি সারারাত ছালাতে কাটাচ্ছেন তাঁর আমল বেশি হলেও রাত কাটানোটি রাসূল (ﷺ)-এর  সুন্নাত মোতাবেক নয়। ঠিক এমনিভাবে ছিয়াম ও বিবাহের বিষয়টিও। এমন আমলকারীর মনে ধীরে ধীরে সুন্নাতের প্রতি অবজ্ঞা জন্ম নেয়। সুন্নাত মোতাবেক চলা তার কাছে কম মনে হয়। এটি একটি বাস্তব বিষয় যা আমরা আমাদের সমাজ বা আমাদের নিজ থেকেই যাচাই করতে পারি। যেমন ধরুন, এক ব্যক্তি রাতে এশার ছালাত জামা‘আতের সঙ্গে আদায় করে ঘুমিয়ে পড়েন, রাতের শেষভাগের দিকে উঠে তাহাজ্জুদ পড়েন এবং ফজরের ছালাত জামা‘আতের সঙ্গে আদায় করেন। আরেক ব্যক্তি এশা এবং ফজর জামা‘আতের সঙ্গে আদায়ের পাশাপাশি সারারাত জেগে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করেন, স্বাভাবিকত দ্বিতীয় ব্যক্তির মনে এ কথা জড় পাকাবে যে, আমি প্রথম ব্যক্তির চেয়ে বেশি ইবাদত করছি, তার থেকে আমার কাজ উত্তম। কেননা সে কিছু সময় ঘুমিয়ে ছালাতের মত শ্রেষ্ঠ ইবাদত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আল্লাহর শোকর আমি বঞ্চিত হচ্ছি না। তার মনে এ কথার জড় না পাকালে তিনি প্রথম ব্যক্তির মত কিছু সময় ঘুমানোর কথা।

যদি আমরা ধরেই নিই যে, তিনি এমন মানুষ যার মাঝে এমন কল্পনা আসতে পারে না, তবে অন্য মানুষের মনে এ কথার বীজ অবশ্যই বপন হবে। সমাজের সাধারণ থেকে নিয়ে বড় বড় ব্যক্তিত্বের কথাবার্তা থেকে এমন বিশ্বাস পাওয়া যায়। যেমন কেউ সারা রাত জেগে ইবাদত করলে তাকে ঐ ব্যক্তির চেয়ে বেশি তুলে ধরা হয় বা বেশি পরহেযগার মনে করা হয়, যিনি রাতে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করেছেন আবার ঘুমিয়েছেন। যেমন বলা হয়, অমুক আল্লাহর ওয়ালী এত বছর ঘুমাননি, অমুক এত বছর এক ওযূ দিয়ে এশা এবং ফজর আদায় করেছেন। এবার আপনি প্রথম ব্যক্তি ও দ্বিতীয় ব্যক্তিকে নিয়ে রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতের সাথে তুলনা করুন। প্রথম জনের রাতের ইবাদত কম, তবে রাত কেটেছে সুন্নাত মোতাবেক। দ্বিতীয় জনের রাতের ইবাদত বেশি, তবে তাঁর রাত হুবহু সুন্নাত মোতাবেক কাটেনি। এই দুই ব্যক্তির মাঝে দ্বিতীয় ব্যক্তির রাত কাটানোকে উত্তম মনে করা সুন্নাতের প্রতি অবজ্ঞার নামান্তর। কেননা যার রাত কাটানো রাসূল (ﷺ)-এর সাথে মিলল তাকে অনুত্তম, আর যার রাত কাটানো তাঁর সাথে মিলেনি তাকে উত্তম মনে করা সুন্নাতকে অনুত্তম মনে করা ছাড়া কিছু নয়। এভাবে লোকটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ)-এর পদ্ধতি থেকে সরে যাওয়া এবং অন্য পদ্ধতিকে উত্তম জ্ঞান করা তাঁর মনে স্থান নিবে। রাসূল (ﷺ)-এর চেয়ে তাঁর ইবাদত বেশি এ কথা অন্তরে বদ্ধমূল হবে। আর এ কারণেই রাসূল (ﷺ) উপরিউক্ত ছাহাবীদের উপর তাদের নিয়ত মহৎ থাকা সত্ত্বেও রাগ করেছেন।

সুতরাং যে কোন ইবাদতের ক্ষেত্রে ইবাদতের সময়, পরিমাণ, স্থান, অবস্থা ইত্যাদির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবেগ তাড়িত হয়ে ফরযের মধ্যে যেমন কম বেশি করা যাবে না, তেমনি সুন্নাতের ক্ষেত্রেও রাসূল (ﷺ) -এর নির্দেশ বা তাঁর আমলের পরিবর্তন করা যাবে না। নফল ইবাদতেও কারো সময় থাকলে বা নিজের খেয়াল খুশি মত করা ইসলাম সমর্থিত নয়। ইসলামে ছালাত, ছাওমের পাশাপাশি ঘুমানো, বিয়ে করা, বাণিজ্য করা ইত্যাদিও ইবাদতের মধ্যে গণ্য যদি তা ছাওয়াবের আশায় এবং সঠিক নিয়মানুসারে পালন করা হয়। কিন্তু যদি কেউ সার্বিক দিক থেকে সমর্থ হওয়া সত্ত্বেও রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতের প্রতি অনীহা ও অবিশ্বাসের কারণে বিয়ে পরিত্যাগ করে, তাহলে সে রাসূল (ﷺ)-এর তরীকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَنۡ یُّشَاقِقِ الرَّسُوۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَہُ الۡہُدٰی وَ یَتَّبِعۡ غَیۡرَ  سَبِیۡلِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ نُوَلِّہٖ مَا تَوَلّٰی وَ نُصۡلِہٖ جَہَنَّمَ ؕ وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا

‘সুপথ স্পষ্ট হওয়ার পরও যে ব্যক্তি রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের বিপরীত পথে চলে, আমরা তাকে ঐদিকেই ফিরিয়ে দিই যেদিকে সে যেতে চায় এবং তাকে আমরা জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। আর সেটা হল নিকৃষ্ট ঠিকানা’ (সূরা আন-নিসা: ১১৫)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا، لَا يَزِيْغُ عَنْهَا بَعْدِيْ إِلَّا هَالِكٌ

‘আমি তোমাদের আলোকোজ্জ্বল দ্বীনের উপর রেখে যাচ্ছি, যার রাত তার দিনের মতই দৃশ্যমান। আমার পরে ধ্বংসোন্মাখ ব্যক্তি ছাড়া কেউ এ দ্বীন থেকে বেঁকে বসবে না’।[১৫] আরেক হাদীছে তিনি বলেছেন,

إِنِّىْ قَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوْا أَبَدًا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ

‘নিশ্চয় আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস ছেড়ে যাচ্ছি যা আঁকড়ে ধরে থাকলে তোমরা কখনই পথ হারাবে না, আর তা হল আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ’।[১৬]

শায়খ আব্দুল আযীয ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নারী হোক কিংবা পুরুষ হোক সকল মুসলিমের উপর ফরয এই পদ্ধতি অনুসারে চলা এবং হকপন্থী আলিমদের থেকে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুধাবন করা। যেমন মালিক ইবনু আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) এবং পরবর্তীতে তার অনুসরণে আরও অনেকে বলেছেন যে,  لَنْ يُصْلِحَ آخِرَ هَذِهِ الْأُمَّةِ إلَّا مَا أَصْلَحَ أَوَّلَهَا ‘এই উম্মাতের প্রথম যুগের মানুষেরা যে পদ্ধতিতে সংশোধিত হয়েছে শেষ যুগের মানুষেরাও তা অবলম্বন না করা পর্যন্ত সংশোধিত হতে পারবে না’। তিনি আরো বলেন, ‘উম্মতের প্রথম যুগের লোকেদের আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা, কুরআন ও সুন্ন্হাকে ধরে থাকার জন্য একে অপরকে উপদেশ দেয়া, এ কাজে পরস্পরে সহযোগিতা করা এবং কুরআন ও সুন্নাহর পথে জীবন পরিচালনার মাধ্যমে সংশোধন ঘটেছিল। সুতরাং ভাইয়েরা আমার, আমাদেরও সকলের কর্তব্য হবে ক্বুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার জন্য একে অপরকে উপদেশ দেয়া ও এ কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করা এবং আমাদের রবের কিতাব ও আমাদের নবীর সুন্নাহকে সবকিছুর উপর স্থান দেয়’।[১৭]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* মুর্শিদাবাদ, ভারত।

তথ্যসূত্র :
[১]. শাইখ আহমদ বাযমূল, দাওলাতু আত-তাওহীদ ওয়াস-সুন্নাহ, পৃ. ১১।
[২]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১।
[৩]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪।
[৪]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৯-১০।
[৫]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১২।
[৬]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮; আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৬; ইবনু মাজাহ, হা/১৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৯২৯, ২৪৬০৪, ২৪৯৪৪, ২৫৫০২, ২৫৬৫৯, ২৫৭৯৭।
[৮]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৪৫; ছহীহুল জামি‘, হা/২৫৪৯।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৭০, ৩১৭২, ৩১৭৯, ৬৭৫৫, ৭৩০০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৭০; আবূ দাঊদ, হা/২০৩৪।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৮৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২২৮৪।
[১১]. ছহীহ মুসলিম হা/৫০, ৮৩, ৮৪; ছহীহুল জামি‘, হা/৫৭৯০।
[১২]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ‘কিতাব ও সুন্নাত আকড়ে ধরা’ অধ্যায়, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৭।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৫৩৪।
[১৪]. ছহীহুত তারগীব, হা/৩৯০; ছহীহুল জামি‘, হা/৩৮৭০; সনদ হাসান।
[১৫]. ইবনু মাজাহ, হা/৪৩।
[১৬]. মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, হা/৩১৮।
[১৭]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২০শ খণ্ড, পৃ. ৩৭৫।




প্রসঙ্গসমূহ »: মুসলিম জাহান
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (১২তম কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (২য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সালাফী মানহাজ অনুসরণের মর্যাদা - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৫ম কিস্তি)  - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মেসবাহুল ইসলাম
সুন্নাতের রূপরেখা - মাইনুল ইসলাম মঈন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১০ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
আল-কুরআনের ব্যাপারে অমুসলিমদের মিথ্যা অভিযোগ ও তার খণ্ডন - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৭ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন

ফেসবুক পেজ