বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১২ অপরাহ্ন

ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন

-মাইনুল ইসলাম মঈন*


(৩য় কিস্তি)

যোহরের শেষ সময়

যোহরের শেষ সময় হল, সূর্য ঢলে যাওয়ার সময় প্রত্যেক বস্তুর মূল ছায়া ব্যতীত তার সমপরিমাণ হওয়া।[১] এ সময় আছরের ছালাত শুরু হয়। এটা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত অভিমত। ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বিপরীত মত পোষণ করে বলেন, কোন বস্তুর মূল ছায়া ব্যতীত তার দ্বিগুণ ছায়া হওয়াটাই যোহরের ছালাতের শেষ সময়।[২] তবে একগুণ ছায়ার পক্ষেও ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)-এর আরেকটি মত রয়েছে। হানাফী ফিকহ ‘হেদায়া’ গ্রন্থে বলা হয়েছে,

وقالا إذا صار الظل مثله وهو رواية عن أبي حنيفة رحمه الله

‘আর ইমামদ্বয় বলেন, যখন প্রতিটি জিনিসের ছায়া তার সমান হয়। ইহাও ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত আরেকটি মত’।[৩] কাযী ছানাউল্লাহ পানীপথী হানাফী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

وامّا اخر وقت الظهر فلم يوجد فى حديث صحيح ولا ضعيف انه يبقى بعد مصير ظل كل شىء مثليه ولذا خالف أبا حنيفة فى هذه المسألة صاحباه ووافقا الجمهور

‘যোহরের ছালাতের শেষ ওয়াক্ত সম্পর্কে কোন ছহীহ বা যঈফ হাদীছে এভাবে উল্লেখ হয়নি যে, সেটা প্রত্যেক বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ হওয়া পর্যন্ত বাকী থাকে। এ কারণেই এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দুই শিষ্য ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতও এর পরিপন্থি এবং দু’জনের অবস্থান জমহুরের (অধিকাংশ ইমাম ও মুহাদ্দিছগণের) অনুরূপ।[৪]

অধিকাংশ আলিমের দলীল নিম্নরূপ

০১. আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

وَقْتُ الظُّهْرِ إِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ وَكَانَ ظِلُّ الرَّجُلِ كَطُوْلِهِ مَا لَمْ يَحْضُرِ الْعَصْرُ

‘যোহরের ছালাতের সময় আরম্ভ হয় যখন সূর্য ঢলে যায় এবং মানুষের ছায়া যখন তার দৈর্ঘ্যের সমান হয়’।[৫]

০২. জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ আল আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

خَرَجَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَصَلَّى الظُّهْرَ حِيْنَ زَالَتِ الشَّمْسُ وَكَانَ الْفَيْءُ قَدْرَ الشِّرَاكِ ثُمَّ صَلَّى الْعَصْرَ حِيْنَ كَانَ الْفَيْءُ قَدْرَ الشِّرَاكِ وَظِلِّ الرَّجُلِ ثُمَّ صَلَّى الْمَغْرِبَ حِيْنَ غَابَتِ الشَّمْسُ ثُمَّ صَلَّى الْعِشَاءَ حِيْنَ غَابَ الشَّفَقُ ثُمَّ صَلَّى الْفَجْرَ حِيْنَ طَلَعَ الْفَجْرُ ثُمَّ صَلَّى مِنَ الْغَدِ الظُّهْرَ حِيْنَ كَانَ الظِّلُّ طُوْلَ الرَّجُلِ ثُمَّ صَلَّى الْعَصْرَ حِينَ كَانَ ظِلُّ الرَّجُلِ مِثْلَيْهِ قَدْرَ مَا يَسِيْرُ الرَّاكِبُ سَيْرَ الْعَنَقِ إِلَى ذِي الْحُلَيْفَةِ ثُمَّ صَلَّى الْمَغْرِبَ حِيْنَ غَابَتِ الشَّمْسُ ثُمَّ صَلَّى الْعِشَاءَ إِلَى ثُلُثِ اللَّيْلِ أَوْ نِصْفِ اللَّيْلِ – شَكَّ زَيْدٌ – ثُمَّ صَلَّى الْفَجْرَ فَأَسْفَرَ

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাড়ি থেকে বের হয়ে যোহরের ছালাত আদায় করলেন, যখন সূর্য ঢলে গিয়েছিল। আর তখন ছাঁয়া ছিল জুতার ফিতার সমপরিমাণ। অতঃপর আছরের ছালাত আদায় করলেন, যখন ছাঁয়া জুতার ফিতা ও কোন ব্যক্তির সমপরিমাণ হল। সূর্য ডুবলে তিনি মাগবিরের ছালাত আদায় করলেন। আর শাফাক্ব বা লালিমা দূরীভূত হলে এশার ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর ফজর উদিত হলে ফজরের ছালাত আদায় করলেন। পরের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যোহরের ছালাত আদায় করলেন, যখন কোন ব্যক্তির ছাঁয়া তার সমপরিমাণ হয়। আছরের ছালাত আদায় করলেন, যখন কোন ব্যক্তির ছাঁয়া তার দ্বিগুণ হয় এবং আছর ও মাগরিবের মাঝে এমন পরিমাণ সময় থাকে যে, একজন আরোহী ‘মদীনা’ থেকে ‘যুল হুলাইফা’ পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারে। মাগরিবের ছালাত আদায় করলেন, যখন সূর্য ডুবে যায়। এশার ছালাত আদায় করলেন রাতের এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক পর্যন্ত (বর্ণনাকারী যায়েদ সন্দেহ পোষণ করেছেন)। অতঃপর ফজরের ছালাত আদায় করল, যখন ফর্সা হল।[৬]

উক্ত হাদীছটি প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথম দিনে যোহরের ছালাত শেষ করেছেন ও আছরের ছালাত শুরু করেছেন এমন সময়, যখন প্রত্যেক বস্তুর ছাঁয়া তার সমপরিমাণ হয়। অতএব উভয় ছালাতের মাঝে কোন সময় নেই।[৭]

সুতরাং এমনটি বলা ঠিক হবে না যে, যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হয়, তখন আছরের সময়ের সূত্রপাত হয় না ও যোহরের সময় শেষ হয় না, বরং যোহর অথবা আছরের চার রাক‘আত ছালাত সঠিকভাবে আদায় করা যায় এরূপ সময় অবশিষ্ট থাকে- যা কেউ কেউ বলেন থাকেন।[৮]

ক্বাতাদাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

إِنَّمَا التَّفْرِيْطُ عَلَى مَنْ لَمْ يُصَلِّ الصَّلَاةَ حَتَّى يَجِيءَ وَقْتُ الصَّلَاةَ الْأُخْرَى

‘বাড়াবাড়ি (কঠোরতা) ঐ ব্যক্তির জন্য, যে পরবর্তী ছালাতের সময় আসার আগ পর্যন্ত ছালাত আদায় করে না’।[৯]

প্রথম ওয়াক্তে দ্রুত যোহরের ছালাত আদায় করাই শরী‘আত

জাবির ইবনু সামুরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,

كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي الظُّهْرَ إِذَا دَحَضَتِ الشَّمْسُ.

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যোহরের ছালাত আদায় করতেন, যখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ত।[১০] অর্থাৎ আকাশের মধ্যভাগ থেকে পশ্চিম দিকে ঝুঁকে যেত। অনুরূপ পূর্বে বর্ণিত আবূ বারযাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।

…عَنْ أَبِىْ بَرْزَةَ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّى الظُّهْرَ إِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ

আবূ বারযাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, যখন সূর্য ঢলে পড়ত তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যোহরের ছালাত আদায় করতেন…।[১১]

যোহরের ছালাত দেরী করে আদায় করার কোন ছহীহ দলীল নেই। উক্ত মর্মে যা বর্ণিত হয়েছে তা ত্রুটিপূর্ণ। যেমন-

عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ الْفَيْءُ ذِرَاعًا وَنِصْفًا إِلَى ذِرَاعَيْنِ فَصَلُّوْا الظُّهْرَ

ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন ছায়া দেড় হাত থেকে দুই হাত হয়, তখন তোমরা যোহরের ছালাত আদায় কর।[১২]

অনেকেই উক্ত বর্ণনা পেশ করে যোহরের ছালাত দেরীতে আদায় করার দাবী করেন। অথচ বর্ণনাটি জাল। উক্ত বর্ণনার সনদে ‘আছরাম ইবনু হাওশাব’ নামে একজন রাবী আছে। ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ, হায়ছামীসহ প্রমুখ মুহাদ্দিছগণ তাকে মিথ্যুক বলেছেন।[১৩]

গ্রীষ্মকাল বা অত্যধিক গরমে যোহরের ছালাত বিলম্বে পড়া মুস্তাহাব

عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا اشْتَدَّ الْبَرْدُ بَكَّرَ بِالصَّلَاةِ وَإِذَا اشْتَدَّ الْحَرُّ أَبْرَدَ بِالصَّلَاةِ

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পেত, তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর ছালাত তাড়াতাড়ি আদায় করতেন। আর যখন গরমের প্রকোপ বৃদ্ধি পেত, তখন (জুমু‘আর) ছালাত বিলম্ব করে আদায় করতেন।[১৪]

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَبْرِدُوْا بِالظُّهْرِ فَإِنَّ شِدَّةَ الْحَرِّ مِنْ فَيْحِ جَهَنَّمَ

আবূ সাঈদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা যোহরকে ঠাণ্ডা কর। কারণ গরমের প্রকোপ জাহান্নামের তাপ।[১৫]

عَنْ أَبِي ذَرٍّ الغِفَارِيِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ فَأَرَادَ المُؤَذِّنُ أَنْ يُؤَذِّنَ لِلظُّهْرِ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَبْرِدْ ثُمَّ أَرَادَ أَنْ يُؤَذِّنَ فَقَالَ لَهُ أَبْرِدْ حَتَّى رَأَيْنَا فَيْءَ التُّلُوْلِ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ شِدَّةَ الحَرِّ مِنْ فَيْحِ جَهَنَّمَ فَإِذَا اشْتَدَّ الحَرُّ فَأَبْرِدُوْا بِالصَّلَاةِ

আবূ যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। মুয়াযযিন যোহরের আযান দেয়ার ইচ্ছা করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, থাম, একটু ঠাণ্ডা হোক। মুয়াযযিন কিছুক্ষণ পর আবারও আযানের প্রস্তুতি নিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, থাম, একটু ঠাণ্ডা হোক। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’বার অথবা তিনবার এরূপ করলেন। এমনকি আমরা টিলাসমূহের ছাঁয়া দেখতে পেতাম। অতঃপর তিনি বলেন, অত্যধিক গরম জাহান্নামের অংশবিশেষ। অতএব প্রচণ্ড গরমে (যোহরের ছালাত) বিলম্বে আদায় করবে।[১৬]

সুধী পাঠক! উপরিউক্ত হাদীছগুলোর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলে দেখা যায়, দেরী করে যোহর ছালাত আদায় তখনই প্রযোজ্য যখন অত্যধিক গরমের ওযর পাওয়া যাবে। হাদীছে এসেছে, আবূ মাস‘ঊদ আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, صَلَّى الظُّهْرَ حِيْنَ تَزُوْلُ الشَّمْسُ وَرُبَّمَا أَخَّرَهَا حِيْنَ يَشْتَدُّ الْحَرُّ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে গেলে যোহরের ছালাত আদায় করতেন। প্রচণ্ড গরমের কারণে কখনো কখনো তিনি দেরী করতেন…।[১৭]

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীছগুলোর অপপ্রয়োগ করা হয়েছে, যার সম্পর্ক মূলত যোহরের ছালাত প্রচ- গরম ও সফরে আদায়ের সাথে। কিন্তু হানাফী মাযহাবে এই হাদীছগুলোর আলোকে জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর হাদীছ মানসুখ বিবেচনা করা হয় এবং যোহরের স্থায়ী সময় নির্ধারণ করা হয় দুই ছায়া পর্যন্ত। যা হানাফী গবেষক আলেমগণও বাতিল করেছেন।

عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ كَانَ قَدْرُ صَلَاةِ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الظُّهْرَ فِى الصَّيْفِ ثَلَاثَةَ أَقْدَامٍ إِلَىْ خَمْسَةِ أَقْدَامٍ وَفِى الشِّتَاءِ خَمْسَةَ أَقْدَامٍ إِلَىْ سَبْعَةِ أَقْدَامٍ

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যোহরের ছালাতের পরিমাণ (ছায়ার পরিমাণ) ছিল তিন হতে পাঁচ কদম পর্যন্ত এবং শীতকালে পাঁচ হতে সাত কদম পর্যন্ত।[১৮]

এই হাদীছটি গরম ও শীতকালের সূর্যকিরণের তারতম্য সুস্পষ্ট করে। কেননা পূর্বের হাদীছগুলো প্রমাণ করে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গরমকালে সফর করলে যোহরের ছালাত তুলনামূলক ঠাণ্ডা হওয়ার পর আদায় করতেন, যা শীতকালে প্রয়োজন ছিল না। অথচ হানাফী ফিকাহতে তীব্র গরমের সময়ের উক্ত হাদীছগুলোর আলোকে সারা বছরের যোহরের ওয়াক্ত নির্ধারিত হয়।

কাযী ছানাউল্লাহ পানীপথী হানাফী (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দুই ছায়া হলে আরব দেশে ঠাণ্ডা বা শিতলতা আসার যে যুক্তি দিয়েছেন তার খণ্ডনে লিখেছেন,

وهذا الاستدلال ضعيف جدّا ودلالة حديث الأبرار على بقاء وقت الظهر بعد المثل ممنوع بل الأبرار امر إضافي وشدة الحرّ انما يكون عند الزوال وبعض الأبرار يحصل قبيل بلوغ الظل مثل الشيء ولو كان الحرّ فى ديارهم حين بلوغ ظل الشيء مثله أشد مما قبله لكان مقتضى الأمر بالابرار تعجيل الصلاة فى اوّل الوقت والله اعلم

‘এভাবে দলীল গ্রহণ অত্যন্ত দুর্বল। শীতল করার হাদীছ থেকে এটা বুঝা যায় না যে, একগুণ ছায়া হওয়ার পরও যোহরের ওয়াক্ত বাকি থাকে। বরং ওয়াক্তের শীতলতা একটি আপেক্ষিক বিষয়। আসল গরমের তীব্রতা তো সূর্য ঢলে পড়ার সময় হয়ে থাকে। সূর্য ঢলে পড়ার সময়ের মোকাবেলায় একগুণ ছায়া হওয়ার কিছু পূর্বে কতকটা ঠাণ্ডা তো হয়েই থাকে। আর যদি এটা মেনেও নেয়া হয় যে, তাদের দেশে একগুণ ছায়া হওয়ার সময় পূর্ব মুহূর্ত অপেক্ষা অধিক উত্তাপ অনুভব হয়, তবে স্বয়ং শীতল করার নির্দেশের দাবি হচ্ছে আওয়াল ওয়াক্তেই (সূর্য ঢলে যাবার পরপর, ছায়া একগুণ হওয়ার অনেক পূর্বেই) যোহর আদায় করা। আল্লাহই সর্বজ্ঞ’।[১৯]

নীচের হাদীছগুলো থেকে সুস্পষ্ট হবে যে, ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) দুই ছায়া বা ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার যে রায় দিয়েছেন তা ছাহাবীগণ বুঝেননি।

عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنَّا إِذَا صَلَّيْنَا خَلْفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالظَّهَائِرِ سَجَدْنَا عَلَىْ ثِيَابِنَا اتَّقَاءَ الْحَرِّ

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা যখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পিছনে যোহরের ছালাত আদায় করতাম, তখন আমরা উত্তাপ হতে বাঁচার জন্য আমাদের কাপড়ের উপর সিজদা করতাম।[২০]

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنَّا نُصَلِّي مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْ شِدَّةِ الْحَرِّ فَإِذَا لَمْ يَسْتَطِعْ أَحَدُنَا أَنْ يُمَكِّنَ جَبْهَتَهُ مِنَ الْأَرْضِ بَسَطَ ثَوْبَهُ فَسَجَدَ عَلَيْهِ

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রচণ্ড গরমের সময়ও আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে (যোহরের) ছালাত আদায় করতাম। আমাদের কেউ যখন (গরমের প্রচণ্ডতার কারণে সিজদার সময়) কপাল মাটিতে স্থাপন করতে পারত না, তখন সে কাপড় বিছিয়ে তার উপর সিজদা করত।[২১]

বুঝা যাচ্ছে, গরমের উত্তাপ থাকাবস্থায়ও নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পিছনে ছাহাবীগণ যোহরের ছালাত আদায় করতেন। এ পর্যায়ে পূর্বের বর্ণিত হাদীছগুলোর দাবি হলো, সফরে বা গরম কালে সূর্যের তাপ বেশি হলে, যোহরের ছালাত তুলনামূলক ঠাণ্ডার সময় আদায় করা মুস্তাহাব। নীচের হাদীছটিও এক্ষেত্রে অপর একটি প্রমাণ।

عَنْ خَبَّابٍ قَالَ أَتَيْنَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَشَكَوْنَا إِلَيْهِ حَرَّ الرَّمْضَاءِ فَلَمْ يُشْكِنَا – قَالَ زُهَيْرٌ قُلْتُ لِأَبِيْ إِسْحَاقَ أَفِيْ الظُّهْرِ؟ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ أَفِيْ تَعْجِيْلِهَا؟ قَالَ نَعَمْ

খাব্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে গিয়ে প্রচণ্ড গরমের (ছালাত আদায়ের ব্যাপারে) অভিযোগ করলাম। কিন্তু তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের অভিযোগ গ্রহণ করলেন না। বর্ণনাকারী যুহায়র বললেন, আমি আবূ ইসহাককে জিজ্ঞেস করলাম, তারা (খাব্বাব ও অন্য ছাহাবীগণ) কি যোহরের ছালাত (প্রচণ্ড গরমের মধ্যে) আদায় করা সম্পর্কে অভিযোগ করেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি (যুহায়র) আবারও জিজ্ঞেস করলাম (যোহরের ছালাত) আগে ভাগে অর্থাৎ- ওয়াক্তের প্রথম দিকে আদায় করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন? তিনি এবারও বললেন, হ্যাঁ।[২২]

উল্লেখ যে, অনেকেই ‘মুওয়াত্ত্বা মালিক’-এ বর্ণিত সংক্ষিপ্ত হাদীছকে দলীয় স্বার্থে দলীল বানিয়ে বিস্তারিত হাদীছ ত্যাগ করে এক ছায়া হলে যোহরের ওয়াক্ত এবং দুই ছায়া হলে আছরের ওয়াক্ত দাবী করে থাকেন। হাদীছটি নিন্মরূপ-

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ رَافِعٍ مَوْلَى أُمِّ سَلَمَةَ زَوْجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ سَأَلَ أَبَا هُرَيْرَةَ عَنْ وَقْتِ الصَّلَاةِ.؟ فَقَالَ أَبُوْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَا أُخْبِرُكَ صَلِّ الظُّهْرَ إِذَا كَانَ ظِلُّكَ مِثْلَكَ وَالْعَصْرَ إِذَا كَانَ ظِلُّكَ مِثْلَيْكَ وَالْمَغْرِبَ إِذَا غَرَبَتِ الشَّمْسُ وَالْعِشَاءَ مَا بَيْنَكَ وَبَيْنَ ثُلُثِ اللَّيْلِ وَصَلِّ الصُّبْحَ بِغَبَشٍ يَعْنِيْ الْغَلَسَ

আব্দুল্লাহ ইবনু রাফি‘ (রাহিমাহুল্লাহ) আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট ছালাতের সময় সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। উত্তরে আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমি তোমাকে ছালাতের সময়ের সংবাদ দিব, যোহর পড় যখন তোমার ছায়া তোমার সমপরিমাণ হয়। আর আছর পড় যখন তোমার ছায়া তোমার দ্বিগুণ হয়। মাগরিব পড় যখন সূর্য অস্ত যায়। আর ইশা পড় তোমার সম্মুখ (অর্থাৎ তোমার সামনে উপস্থিত ইশার প্রথম সময়) হতে এক তৃতীয়াংশ রাত্রি পর্যন্ত। আর ফজর পড় গাবস অর্থাৎ রাত্রির অন্ধকার কিছুটা অবশিষ্ট থাকতে।[২৩]

অথচ আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত অপর হাদীছে রয়েছে-

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ لِلصَّلَاةِ أَوَّلًا وَآخِرًا وَإِنَّ أَوَّلَ وَقْتِ صَلَاةِ الظُّهْرِ حِيْنَ تَزُوْلُ الشَّمْسُ وَآخِرَ وَقْتِهَا حِيْنَ يَدْخُلُ وَقْتُ العَصْرِ وَإِنَّ أَوَّلَ وَقْتِ صَلَاةِ العَصْرِ حِيْنَ يَدْخُلُ وَقْتُهَا وَإِنَّ آخِرَ وَقْتِهَا حِيْنَ تَصْفَرُّ الشَّمْسُ وَإِنَّ أَوَّلَ وَقْتِ الْمَغْرِبِ حِيْنَ تَغْرُبُ الشَّمْسُ وَإِنَّ آخِرَ وَقْتِهَا حِيْنَ يَغِيْبُ الأُفُقُ وَإِنَّ أَوَّلَ وَقْتِ العِشَاءِ الآخِرَةِ حِيْنَ يَغِيْبُ الأُفُقُ وَإِنَّ آخِرَ وَقْتِهَا حِيْنَ يَنْتَصِفُ اللَّيْلُ وَإِنَّ أَوَّلَ وَقْتِ الفَجْرِ حِيْنَ يَطْلُعُ الفَجْرُ وَإِنَّ آخِرَ وَقْتِهَا حِيْنَ تَطْلُعُ الشَّمْسُ

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ছালাতের ওয়াক্তের শুরু ও শেষ সীমা রয়েছে। যোহরের ছালাতের শুরুর সময় হচ্ছে যখন (সূয পশ্চিম দিকে) ঢলতে শুরু করে এবং শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে আছরের ওয়াক্ত শুরু হওয়া। আছরের প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে যখন আছরের ওয়াক্ত প্রবেশ করে (যোহরের শেষ সময়) এবং তার শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে যখন সূর্যের আলো হলুদ রং ধারণ করে। মাগরিবের প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে সূর্য ডুবে যাওয়ার পর এবং তার শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে যখন শাফাক চলে যায়। ইশার প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে যখন শাফাক বিলীন হয়ে যায়, আর তার শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে যখন অর্ধেক রাত চলে যায়। ফযরের ছালাতের প্রথম ওয়াক্ত যখন ভোর শুরু হয় এবং তার ওয়াক্ত শেষ হয় যখন সূর্য উঠা শুরু হয়।[২৪]

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذَا جِبْرِيْلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ جَاءَكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِيْنَكُمْ فَصَلَّى الصُّبْحَ حِيْنَ طَلَعَ الْفَجْرُ وَصَلَّى الظُّهْرَ حِيْنَ زَاغَتِ الشَّمْسُ ثُمَّ صَلَّى الْعَصْرَ حِيْنَ رَأَى الظِّلَّ مِثْلَهُ ثُمَّ صَلَّى الْمَغْرِبَ حِيْنَ غَرَبَتِ الشَّمْسُ وَحَلَّ فِطْرُ الصَّائِمِ ثُمَّ صَلَّى الْعِشَاءَ حِيْنَ ذَهَبَ شَفَقُ اللَّيْلِ ثُمَّ جَاءَهُ الْغَدَ فَصَلَّى بِهِ الصُّبْحَ حِيْنَ أَسْفَرَ قَلِيْلًا ثُمَّ صَلَّى بِهِ الظُّهْرَ حِيْنَ كَانَ الظِّلُّ مِثْلَهُ ثُمَّ صَلَّى الْعَصْرَ حِيْنَ كَانَ الظِّلُّ مِثْلَيْهِ ثُمَّ صَلَّى الْمَغْرِبَ بِوَقْتٍ وَاحِدٍ حِيْنَ غَرَبَتِ الشَّمْسُ وَحَلَّ فِطْرُ الصَّائِمِ ثُمَّ صَلَّى الْعِشَاءَ حِيْنَ ذَهَبَ سَاعَةٌ مِنَ اللَّيْلِ ثُمَّ قَالَ الصَّلَاةُ مَا بَيْنَ صَلَاتِكَ أَمْسِ وَصَلَاتِكَ الْيَوْمَ

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ইনি জিবরীল (আলাইহিস সালাম)। যিনি তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্য এসেছিলেন। তিনি ঊষা উদিত হলে ফজরের ছালাত আদায় করেন, যোহরের ছালাত আদায় করেন সূর্য ঢলে পড়লে, তারপর আছরের ছালাত আদায় করেন যখন ছায়া তাঁর সমান দেখেন। তারঃপর যখন সূর্য অস্তমিত হল, আর ছিয়াম পালনকারীর জন্য ইফতার করা হালাল হল, তখন মাগরিবের ছালাত আদায় করলেন। তারপর ইশার ছালাত আদায় করেন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর যে শাফাক্ব দেখা যায়, তা অদৃশ্য হওয়ার পর। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আবার পরদিন আসলেন এবং নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সাথে নিয়ে ফজরের ছালাত আদায় করলেন, যখন কিছুটা ফর্সা হল। পরে তাকে নিয়ে যোহরের ছালাত আদায় করেন যখন ছায়া তার সমান হল। তারপর আছরের ছালাত আদায় করেন যখন ছায়া তার দিগুণ হল। পরে মাগরিবের ছালাত একই সময়ে পূর্বের দিনের ন্যায় আদায় করেন। যখন সূর্য অস্তমিত হল এবং ছিয়াম পালনকারীর জন্য ইফতার করা হালাল হল। এরপর রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হয়ে গেলে এশার ছালাত আদায় করেন। পরে তিনি বলেন, আপনার আজকের ছালাত ও গতকালের ছালাতের মধ্যবর্তী সময়ই হল ছালাতের সময়।[২৫]

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত অত্র হাদীছসূমহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়, সূর্য ঢলে গেলে এবং শেষ হয় আছরের ওয়াক্ত শুরু হলে। তথা এক গুণ ছাঁয়া হলে। অতএব মুওয়াত্তায় বর্ণিত হাদীছটির এ হাদীছদ্বয় (তিরমিযী, হা/১৫১; নাসাঈ, হা/৫০৩)-এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা নিতে হবে। অন্যথা সংক্ষিপ্ত হাদীছ দ্বারা অধিকাংশ ছাহাবী বর্ণিত হাদীছের বিরোধিতা করা হবে।

মুওয়াত্ত্বায় বর্ণিত সংক্ষিপ্ত হাদীছটির দাবি হল, ঐ সময়ের মধ্যে যোহর ও আছরের ছালাত অবশ্যই আদায় করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত একাধিক সূত্রে বর্ণিত বিস্তারিত হাদীছকে বর্জন করে আলোচ্য সংক্ষিপ্ত হাদীছটিকে হানাফী মাযহাবের পক্ষে দলীল বানানো হচ্ছে। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফীক দিন-আমীন!

সুধী পাঠক! হাদীছের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে সারা বছর এদেশে যোহরের ছালাত দেরী করে পড়া হয়। এটা সুন্নাতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করার শামিল। আরবের মরু এলাকায় উত্তপ্ত বালু ও মরু ঝড়ের কারণে সেখানে প্রচণ্ড গরম দেখা দিত। তাই কখনও কখনও যোহরের ছালাত কিছুটা বিলম্বে আদায় করা হত। কিন্তু আমাদের দেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ ও তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা। তাই এখানে সব সময় আওয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায়ে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। তবে অতীব গরমের সময় কিছুটা বিলম্ব করে যোহরের ছালাত আদায় করাই সুন্নাত। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মসজিদে সারা বছর আওয়াল ওয়াক্ত বাদ দিয়ে সব সময় ওয়াক্ত হয়ে যাবার অনেক পরে ছালাত আদায় করে। ফলে আওয়াল ওয়াক্তের ছওয়াব থেকে বঞ্চিত হন। মূলত মাযহাবী গোঁড়ামির কারণে এমনটি হয়েছে। অথচ হানাফী ফিকহ ‘হেদায়া’ গ্রন্থে বলা হয়েছে- والإبراد بالظهر في الصيف وتقديمه في الشتاء ‘গ্রীষ্মকালে যোহরের ছালাত সূর্যের তাপ কমে আসলে এবং শীতকালে আওয়াল ওয়াক্তে আদায় করা মুস্তাহাব’।[২৬]

শাইখ মুহাম্মাদ ইলিয়াস ফায়সাল হানাফী প্রণীত ‘নবীজীর নামায’ গ্রন্থে বলা হয়েছে- ‘ঠান্ডা মওসুমে যোহরের নামায সূর্য ঢালার পর তাড়াতাড়ি আদায় করা এবং গরমকালে রৌদ্রের প্রখরতা হ্রাস পাওয়া পর্যন্ত বিলম্বিত করা সুন্নত’।[২৭]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

*এম.ফিল গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; শিক্ষক, মহব্বতপুর দারুল উলূম আলিম মাদরাসা, মোহনপুর, রাজশাহী।

[১]. অর্থাৎ যোহরের পূর্বে প্রত্যেক বস্তুর ছাঁয়া হ্রাস পেয়ে সর্বশেষ পর্যায়ে পৌঁছে। অতঃপর তা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এটিই হচ্ছে কোন বস্তুর মূল ছাঁয়া। এমন সময়ই যোহরের ছালাতের প্রথম ওয়াক্ত শুরু হয়। কোন বস্তুর মূল ছাঁয়া যখন বৃদ্ধি পেয়ে তার সমপরিমাণ হবে, তখন যোহরের ছালাতের সময় শেষ হয়।
[২]. মাওয়াহিবুল জালিল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৮২; মুগনিল মুহতাজ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২১; আল মুগনী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭১; বাদায়েউস ছানায়েউ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৩।
[৩]. হেদায়া ফি শারহি বিদায়াতুল মুবতাদী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০।
[৪]. তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৭; সূরা নিসার ১০৩ নং আয়াতের তাফসীর।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬১২।
[৬]. নাসাঈ, হা/৫২৪; সনদ ছহীহ।
[৭]. নাইলুল আওতার, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৪।
[৮]. ইমাম নববী তাঁর ছহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, এটি ইমাম মালিক (রহিমাহুল্লাহ)-এর অভিমত। বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৫; ইবনে মুনজির, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২৭।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৮১।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬১৮; আবূ দাঊদ, হা/৪০৩; ইবনে মাজাহ, হা/৬৭৩।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪১ ও ৭৭১; আবূ দাঊদ, হা/৩৯৮।
[১২]. ইবনু হিব্বান, আল-মাজরূহীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৩; উকাইলী, আয-যু‘আফা, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৮; ইবনু আদী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৩৫।
[১৩]. সিলসিলা যঈফাহ, হা/২৬৯৭; যঈফুল জামে‘, হা/৬৪৪; মিশকাত, হা/৫৮৫; তানক্বীহুল কালাম, পৃ. ২৬৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০৬; আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ‘আহ ফী আহাদীছিল মাওযূ‘আহ, পৃ. ৩৫।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৯০৬।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৮, (ইফাবা, হা/৫১১, ২/১০ পৃ.), ‘ছালাতের ওয়াক্ত সমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৯, ছহীহ মুসলিম, হা/৬১৬; আবূ দাউদ, হা/৪০১।
[১৭]. আবূ দাউদ, হা/৩৯৪।
[১৮]. আবূ দাঊদ, হা/৪০০; নাসাঈ, হা/৫০৩, সনদ ছহীহ।
[১৯]. তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮, সূরা নিসার ১০৩ নং আয়াতের তাফসীর।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪২; ছহীহ মুসলিম, হা/৬২০।
[২১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২৯৪।
[২২]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬১৯।
[২৩]. মুওয়াত্তা মালিক, হা/৯।
[২৪]. তিরমিযী, হা/১৫১, সনদ ছহীহ।
[২৫]. নাসাঈ, হা/৫০২, সনদ হাসান।
[২৬]. হেদায়া ফি শারহি বিদায়াতুল মুবতাদী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১।
[২৭]. ড. শাইখ মুহাম্মদ ইলিয়াস ফয়সাল, নবীজীর নামায (মুমতায লাইব্রেরী, ১১ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০), পৃ. ১২৬।




যাকাত বণ্টনে সমস্যা ও সমাধান - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
সদাচরণের প্রতিদান ও দুশ্চরিত্রের পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
গোপন পাপ: ভয়াবহতা ও পরিত্রাণের উপায় অনুসন্ধান - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
বিদ‘আত পরিচিতি (৩১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সালাম প্রদানের গুরুত্ব ও মর্যাদা - মুহাম্মাদ আরিফ হুসাইন
রামাযানে দান-ছাদাক্বাহ - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩টি উপায় (শেষ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৮ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
বিদ‘আত পরিচিতি (৩২তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ