মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০১:৪১ অপরাহ্ন
সচ্চরিত্রই মানব উন্নতির চাবিকাঠি
ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ভূমিকা
চরিত্র মানব জীবনের সর্বশ্রষ্ঠ সম্পদ। মানুষের মান-সম্মান ও মর্যাদা চরিত্রের উপর নির্ভরশীল। তার প্রকৃত পরিচয় চরিত্রের মধ্যেই নিহিত; ধন-সম্পদ, শক্তি-সামর্থ্য বা রূপ-সৌন্দর্যের মধ্যে নয়। মানুষকে ন্যায় ও সত্যের পথে পরিচালিত করতে যেসব জিনিস কার্যকর ভূমিকা পালন করে তন্মধ্যে চরিত্র অন্যতম। চরিত্র মানুষকে সত্য-ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। চরিত্রই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। তাই বিখ্যাত ইংরেজ লেখক সেমুয়্যাল স্মাইলস বলেন, ‘The crown and glory of life is character’. অর্থাৎ ‘চরিত্র মানব জীবনের গৌরব ও মুকুট স্বরূপ’।[১] আমরা বিভিন্ন প্রকার যানবাহনে চলাচলের সময় সেগুলোতে লেখা দেখতে পাই ‘ব্যবহারেই বংশের পরিচয়’। এর অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তির চরিত্র দ্বারাই তার বংশের পরিচয় পাওয়া যায়। কেননা ব্যক্তির চরিত্রে স্বীয় বংশের প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। আর সচ্চরিত্র মানুষকে মর্যাদার উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। চরিত্রবান ব্যক্তি সমাজের সর্বস্তরে সমাদৃত। তার বন্ধু-বান্ধবের অভাব হয় না। সকলেই তাকে হৃদয়ের গহীন থেকে ভালবাসে। যার মধ্যে কৃত্রিমতার কোন ছাপ পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু সচ্চরিত্র সোনার হরিণ, যা আকাশ থেকে পৃথিবী পৃষ্ঠে নেমে আসে না; বরং তা কঠোর সাধনার মাধ্যমে জীবনের বাঁকে বাঁকে অল্প অল্প করে অর্জন করতে হয়। এই বিন্দু বিন্দু চারিত্রিক গুণাগুণের সমাহার হয়ে এক সময় অথৈ জলরাশিতে পরিণত হয়। তখনই ব্যক্তি সচ্চরিত্রবান বিশেষণে ভূষিত হন।

সচ্চরিত্রের গুরুত্ব ও মর্যাদা
পশু-পাখি সহজেই পশু-পাখি, তরুলতা সহজেই তরুলতা; কিন্তু মানুষ সহজেই মানুষ নয়। অনেক সাধনার পরে তাকে মানুষ হতে হয়। আর এই সাধনার প্রথম পদক্ষেপ হল চরিত্র গঠন। চরিত্রের মাধ্যমেই দেদীপ্যমান হয় জীবনের গৌরব। চরিত্র দ্বারা জীবনের যে গৌরবময় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তা আর কিছুতেই সম্ভব নয়। যিনি সৎ চরিত্রের অধিকারী তিনি সমাজের অহংকার ও প্রজ্জ্বলিত দীপ শিখা। চরিত্রবান ব্যক্তির মধ্যে যাবতীয় মানবীয় গুণাবলীর সমাবেশ ঘটে বলে তিনি মানব জাতির সম্পদ। মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উত্তম স্বভাবের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,

فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ فَاعۡفُ عَنۡہُمۡ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ وَ شَاوِرۡہُمۡ فِی الۡاَمۡرِ

‘আল্লাহর অনুগ্রহেই আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছেন। যদি আপনি রুক্ষ স্বভাব ও কঠোরপ্রাণ হতেন, তবে তারা আপনার কাছ থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত। অতএব আপনি তাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করুন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং তাদের সাথে কাজে-কর্মে পরামর্শ করুন’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৫৯)। অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ উত্তম চরিত্রের বাস্তব ফলাফল চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। এই সৎ স্বভাবের বর্ণনা অনেক হাদীছেও পরিলক্ষিত হয়।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحْسَنَكُمْ أَخْلَاقًا

‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহ আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা উত্তম, যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম’।[২] অপর এক বর্ণনায় আছে,

إٍنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَىَّ أَحَسَنَكُمْ أَخْلاَقًا

‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আমার কাছে অধিক প্রিয়, যার চরিত্র সর্বাধিক উত্তম’।[৩]
উত্তম চরিত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তা মীযানের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী। যেমন হাদীছে এসেছে-

عَنْ أَبِى الدَّرْدَاءِ رضى الله عنه عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ أَثْقَلَ شَيْئٍ يُوْضَعُ فِىْ مِيْزَانِ الْمُؤْمِنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ خُلُقٌ حَسَنٌ وَإِنَّ اللهَ يُبْغِضُ الْفَاحِشَ الْبَذِىءَ

আবুদ্দারদা (রাযিয়াল্লাহ আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের জন্য ওযনের পাল্লায় সর্বাপেক্ষা ভারী যে জিনিসটি রাখা হবে, তা হল উত্তম চরিত্র। আর আল্লাহ তা‘আলা অশ্লীলভাষী দুশ্চরিত্রকে ঘৃণা করেন’।[৪] অন্য হাদীছে এসেছে,

وَإِنَّ صَاحِبَ حُسْنِ الْخُلُقِ لَيَبْلُغُ بِهِ دَرَجَةَ صَاحِبِ الصَّوْمِ وَالصَّلَاةِ

‘সচ্চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি তা দ্বারা ছালাত ও ছাওমের অধিকারী ব্যক্তির মর্যাদায় পৌঁছে যায়’।[৫]
কোন আমল দ্বারা মানুষ বেশী জান্নাতে প্রবেশ করবে এ প্রশ্নের উত্তরে মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

تَقْوَى اللهِ وَحُسْنُ الْخُلُقِ

‘তাক্বওয়া তথা আল্লাহভীতি ও উত্তম চরিত্র’।[৬]

عَنْ رَجُلٍ مِّنْ مُّزَيْنَةَ قَالَ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَا خَيْرُ مَا أُعْطِىَ الْإِنْسَانُ قَالَ الْخُلُقُ الْحَسَنُ

মুযায়না গোত্রের এক ব্যক্তি বলেন, একদা ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! মানবজাতিকে সর্বোত্তম কোন জিনিসটি দেয়া হয়েছে? তিনি বললেন, উত্তম চরিত্র’।[৭]
ইসলামে উত্তম চরিত্রের গুরুত্ব অত্যধিক। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ যার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। এর প্রয়োজনীয়তাও ইসলামে ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কারণ চরিত্র মানুষকে সুষমামণ্ডিত করে। তাইতো চরিত্রবান মানুষের কদর সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নিকট পরিলক্ষিত হয়।

কোমলতা : সচ্চরিত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ
কোমলতা হচ্ছে বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সহচরদের সাথে নরম ও কোমল আচরণ করা। কাউকে কোন জিনিস প্রদান করতে বা কারো নিকট হতে কিছু গ্রহণ করতে নম্র ব্যবহার আবশ্যক। কোমলতা সম্পর্কে হাদীছে এসেছে-

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ اللهَ تَعَالَى رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِىْ عَلَى الرِّفْقِ مَالَا يُعْطِىْ عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لَا يُعْطِىْ عَلَى مَا سِوَاهُ

‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আল্লাহ কোমল। তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। আর তিনি কঠোরতা এবং অন্য কিছুর কারণে যা দেন না, তা কোমলতার জন্য দান করেন’। ছহীহ মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে বললেন, ‘কোমলতা নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা হতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখ। বস্তুত যে জিনিসে নম্রতা ও কোমলতা থাকে সেটাই তার শ্রীবৃদ্ধির কারণ হয়। আর যে জিনিস হতে তা প্রত্যাহার করা হয় তা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে’।[৮]

عَنْ جَرِيْرٍ رضى الله عنه عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ يُّحْرَمِ الرِّفْقَ يُحْرَمِ الْخَيْرَ

জারীর (রাযিয়াল্লাহ আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যাকে কোমলতা বা নম্রতা হতে বঞ্চিত করা হয়, তাকে যাবতীয় কল্যাণ হতে বঞ্চিত করা হয়’।[৯]

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم مَنْ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالْأَخِرَةِ وَمَنْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ حُرِمَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالْأَخِرَةِ

‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যাকে নম্রতার কিছু অংশ প্রদান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণের অংশ দেয়া হয়েছে। আর যাকে সেই কোমলতা হতে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে ইহকাল ও পরকালের বিরাট কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে’।[১০] অন্য হাদীছে আছে, একদা মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি ছাদাক্বার উট আরোহণের জন্য পাঠান এবং ‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে উপদেশ দেন,

يَا عَائِشَةُ ارْفُقِى فَإِنَّ الرِّفْقَ لَمْ يَكُنْ فِى شَىْءٍ قَطُّ إِلَّا زَانَهُ وَلَا نُزِعَ مِنْ شَىْءٍ قَطُّ إِلاَّ شَانَهُ

‘হে ‘আয়েশা! তুমি তার সাথে কোমল ব্যবহার করবে। কেননা যার মধ্যে এ কোমল স্বভাব থাকে, তা তার মর্যাদাকে বাড়িয়ে দেয়। আর যার মধ্যে এ স্বভাব থাকে না, তা তাকে ত্রুটিযুক্ত করে’।[১১]
কোমলতা সচ্চরিত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা চরিত্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উল্লিখিত হাদীছগুলোতে কোমলতার গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে সকল ধরনের কল্যাণ কোমলতার মাঝেই নিহিত রয়েছে। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষ তো বটেই, এমনকি চতুষ্পদ জীব বা প্রাণীকুলের সাথেও নরম তথা কোমল আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

পূর্ণ মুমিনের লক্ষণ
উত্তম চরিত্র পূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য শর্ত। যার মধ্যে সচ্চরিত্র নেই সে কখনো পূর্ণ মুমিন হতে পারে না। তাই ঈমানদার ব্যক্তিকে চরিত্রবান হতে হবে। কেননা ঈমান ও মন্দ চরিত্র বিপরীতধর্মী দু’টি বিষয়। একটি অপরটির প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। একই সাথে এই দু’টি গুণ কোন মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকতে পারে না। কেউ মন্দ চরিত্রের অধিকারী হলে আপনা হতেই ঈমান নামক মহৎ গুণটি তার থেকে বিদায় নিবে। এ সম্পর্কে একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِيْنَ إِيْمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا

আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহ আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যার চরিত্র উত্তম সেই পূর্ণ ঈমানদার’।[১২]
মুমিন ব্যক্তি সাধারণত সহজ-সরল হয়। তার মধ্যে ষড়যন্ত্র ও কুটিল স্বভাব পরিলক্ষিত হয় না। অনেক সময় মানুষ তাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে। অথচ সে তা বুঝতে পারে না। কেননা তার মানসিকতা হয় একদম স্বচ্ছ। যেমন মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

الْمُؤْمِنُ غِرٌّ كَرِيْمٌ وَالْفَاجِرُ خِبٌّ لَئِيْمٌ

‘মুমিন ব্যক্তি ভদ্র ও মনভোলা হয় এবং পাপী ব্যক্তি ধোঁকাবাজ ও হীন প্রকৃতির হয়’।[১৩]
উল্লিখিত হাদীছগুলোর দ্বারা পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে ঈমানের সাথে চরিত্রের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। কোন ঈমানদার ব্যক্তির মধ্যে চরিত্র না থাকলে সে পূর্ণ মুমিন নয়।

চরিত্রবানদের জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম
সচ্চরিত্র এমনি এক মহৎগুণ যার মধ্যে তা বিদ্যমান থাকবে তার উপর মহান আল্লাহ জাহান্নামের আগুনকে হারাম করে দিবেন।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَّحْرُمُ عَلَى النَّارِ أَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ النَّارُعَلَيْهِ عَلَى كُلِّ هَيِّنٍ لَيِّنٍ قَرِيْبٍ سَهْلٍ

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহ আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন লোকের সংবাদ দিব না, যার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায়, আর আগুনও তাকে স্পর্শ করতে পারবে না? এমন প্রত্যেক ব্যক্তি যার মেযাজ নরম, স্বভাব কোমল, মানুষের নিকটতম (মিশুক) এবং আচরণ সহজ-সরল’।[১৪]
উপরিউক্ত হাদীছ থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে উত্তম চরিত্রের অধিকারীদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না। অর্থাৎ মহান আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে নিরাপদ রাখবেন। পক্ষান্তরে অসৎ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।

عَنْ حَارِثَةَ بْنِ وَهْبٍ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ الْجَوَّاظُ وَلَا الْجَعْظَرِىُّ قَالَ وَالْجَوَّاظُ الْغَلِيْظُ الْفَظُّ

হারেছা ইবনু ওহাব (রাযিয়াল্লাহ আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কঠোর ও রুক্ষ স্বভাবের ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। বর্ণনাকারী বলেন, الجواظ অর্থ কঠিন ও মন্দ স্বভাবের ব্যক্তি।[১৫]

উত্তম আচরণ দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করণ
মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি হল কেউ খারাপ ব্যবহার করলে তার সাথেও অনুরূপ আচরণ করা। আমাদের উপর কথা, কাজ ও আচার-আচরণে কেউ চড়াও হলে পাল্টা আমরাও তার উপর আরো কড়া মেযাজে চড়াও হই। এক কথায় আমরা মন্দের প্রতিবাদ মন্দ দিয়েই করি। মন্দকে মন্দ দিয়েই নির্মূল করতে চাই। অথচ এক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে মন্দের প্রতিবাদ ভালর দ্বারা করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

اِدۡفَعۡ بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ السَّیِّئَۃَ نَحۡنُ اَعۡلَمُ بِمَا یَصِفُوۡنَ

‘তোমরা মন্দের মুকাবিলা কর যা উত্তম তা দ্বারা। তারা যা বলে, আমি সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত’ (সূরা আল-মুমিনূন : ৯৬)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

وَ قُلۡ لِّعِبَادِیۡ یَقُوۡلُوا الَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ اِنَّ الشَّیۡطٰنَ یَنۡزَغُ بَیۡنَہُمۡ اِنَّ الشَّیۡطٰنَ کَانَ لِلۡاِنۡسَانِ عَدُوًّا مُّبِیۡنًا

‘আমার বান্দাদেরকে বলুন, তারা যেন যা উত্তম তা বলে। শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উসকানি দেয়। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৫৩)। উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে মন্দের প্রতিবাদ উত্তম দ্বারা করতে হবে এ মর্মে জোর তাকীদ দেয়া হয়েছে। অন্য এক আয়াতে এর ফলাফল বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِدۡفَعۡ بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ فَاِذَا الَّذِیۡ بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَہٗ عَدَاوَۃٌ کَاَنَّہٗ وَلِیٌّ حَمِیۡمٌ

‘তোমরা মন্দকে ভালর দ্বারা প্রতিহত কর। তাহলে দেখবে তোমার সাথে যার শত্রুতা রয়েছে, সে অস্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে’ (সূরা হা-মীম সাজদাহ : ৩৪)।
এখানে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন চমৎকারভাবে এর ফলাফল তুলে ধরেছেন। তা হল- মন্দের প্রতিবাদ ভাল দ্বারা করা হলে এর প্রভাবে হয়ত সে একদিন ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হবে। কারণ সে ভাববে, আমি তার সাথে এরূপ দুর্ব্যবহার করার পরও আমার সাথে দুর্ব্যবহার করার পরিবর্তে সে উত্তম ব্যবহার করল। এ মহৎ গুণের প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়বে। এর ফলে এক সময় সে তাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে শুরু করবে। কিন্তু যদি সে সময় তার সাথে দুর্ব্যবহার করা হয় তাহলে সে আরো দূরে সরে যাবে। তাকে শত্রু এবং প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করবে। ঠিক এরই সূত্র ধরে তখন ব্যক্তি হতে পরিবার, এরপর সামাজিকভাবে বিষয়টি সমস্যায় রূপ নেয়। কোন এক সময় এর বিষময় ফল জটিল আকার ধারণ করে। শুরু হয় পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, খুন-খারাবী। যা দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের রূপ পরিগ্রহ করে। কোন কোন সময় বিষয়টি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সমস্যা বলে পরিগণিত হয়। তখন এর ফলাফল হয় আরো ভয়াবহ। এক্ষেত্রে ইসলামের সুমহান শিক্ষা হচ্ছে, যে আমার সাথে অশালীন আচরণ করেছে, আমি তার সাথে শালীন আচরণ করব। তাহলে সে আমার বন্ধুতে পরিণত না হলেও এটি নিয়ে আর বাড়াবাড়ির সুযোগ পাবে না। এ মর্মে হাদীছে এসেছে-

أَحْبِبْ حَبِيْبَكَ هَوْنًا مَّا عَسَى أَنْ يَّكُوْنَ بَغِيْضَكَ يَوْمًا مَّا وَأَبْغِضْ بَغِيْضَكَ هَوْنًا مَّا عَسَى أَنْ يَّكُوْنَ حَبِيْبَكَ يَوْمًا مَّا

‘তোমরা বন্ধুর ভালবাসায় আতিশয্য দেখাবে না, কারণ একদিন হয়ত সে তোমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। আবার তোমরা শত্রুকে শত্রুতার ক্ষেত্রে আতিশয্য প্রদর্শন করবে না, কারণ একদিন হয়ত সে তোমার বন্ধুতে পরিণত হবে’।[১৬]
এখানে দু’টি জিনিস ফুটে উঠেছে তা হল- বন্ধুর ভালবাসার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত বা মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসা প্রদর্শন করা ঠিক নয়। কেননা কখনও উক্ত বন্ধুর সাথে কোন বিষয় নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়ে এক সময়ে শত্রুতার পর্যায় পর্যন্ত গড়াতে পারে। তখন তাকে পূর্ববর্তী আচরণের জন্য খুব কষ্ট পেতে হবে। সাথে সাথে তাকে এর খেসারতও দিতে হতে পারে। পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তির সাথে শত্রুতা থাকলে তার সাথে মাত্রাতিরিক্ত শত্রুতা প্রদর্শন করাও ঠিক নয়। কেননা কোন দিন তার সাথে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়ে সে বন্ধুতে পরিণত হলে অতীতের খারাপ আচরণের জন্য তাকে অনেক কষ্ট পোহাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে তাকে এর প্রায়শ্চিত্তও করতে হতে পারে। মোটকথা বন্ধুত্ব বা শত্রুতা কোন ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জন করা ঠিক নয়। এটাই ইসলামের মহান শিক্ষা। কেউ মেহমানদারী না করলে পাল্টা তারও মেহেমানদারী করা হবে না। এ নীতি ঠিক নয়।
এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, আবুল আহওয়াছ (রাযিয়াল্লাহ আনহু) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কোন ব্যক্তির নিকট দিয়ে আমি যাই কিন্তু সে ব্যক্তি আমার মেহমানদারী করে না। সে যদি আমার নিকট আসে, তবে কি আমি তার সাথে অনুরূপ আচরণ করে প্রতিশোধ নিতে পারি? তিনি বললেন, না, বরং তুমি তার মেহমানদারী করবে’।[১৭]
মোদ্দাকথা, ইসলামের মহান আদর্শই হল মন্দের জবাব দিতে হবে উত্তম দ্বারা। অন্যায়কে অন্যায় দিয়ে প্রতিহত করার ফল ভাল হয় না। বরং অন্যায়কে ন্যায়সঙ্গত পন্থায় প্রতিহত করলে তার চূড়ান্ত ফলাফল ভাল হবে বলে আশা করা যায়। ইসলামের এই সুমহান শিক্ষা আমরা সমাজে বাস্তবায়ন করতে পারলে সুশীল সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ এটা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মহান শিক্ষা।
মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে গ্রহণ
সর্বশ্রেষ্ঠ মানব নবীকুল শিরোমণি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। এমন কোন মানবীয় গুণ নেই যার সমাহার তাঁর চরিত্রে ছিল না। পৃথিবীর ইতিহাসে তাই তিনি এক আদর্শ মহাপুরুষ। তাঁর চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ

‘নিশ্চয়ই আপনি মহত্তম চরিত্রে অধিষ্ঠিত’ (সূরা আল-ক্বল্ম : ৪)। এই মহত্তম চরিত্রের ব্যক্তির জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে জীবন পরিচালনা করার ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ

‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহ্র রাসূলের মধ্যে সর্বোত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে’ (সূরা আল-আহযাব : ২১)। তাই আমাদেরকে মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শে জীবন গড়তে হবে। এর বিকল্প পথ অন্বেষণের কোন সুযোগ নেই।
মহান আল্লাহ আরো বলেন,

وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ اِلَّا رَحۡمَۃً لِّلۡعٰلَمِیۡنَ

‘(হে নবী!) আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ১০৭)। উল্লিখিত আয়াতগুলোতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্র-মাধুর্য বিধৃত হয়েছে। মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্রে শুধু মুসলিম জাতির কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা নয়; বরং সকল ধর্মের সকল মানুষের তথা বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণ রয়েছে।
উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,

عَنْ مَالِكٍ بَلَغَهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ حُسْنَ الْأَخْلَاقِ

মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তাঁর নিকট এই হাদীছ পৌঁছেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘উত্তম চরিত্রের পূর্ণতার জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি’।[১৮] অন্য এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضى الله عنه قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَحْسَنَ النَّاسِ خُلُقًا

আনাস ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লাহ আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সকল মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী’। অন্য এক হাদীছে এসেছে, আনাস (রাযিয়াল্লাহ আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবচেয়ে উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। একদিন তিনি আমাকে একটি কাজে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন, তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি যাব না। অথচ আমার অন্তরে ছিল, যে কাজে আমাকে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশ দিয়েছেন, আমি সে কাজে যাব। তারপর আমি বের হয়ে ছেলেদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তারা বাজারে খেলা করছিল। হঠাৎ করে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছন দিয়ে এসে আমার ঘাড় ধরলেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহ আনহু) বলেন, আমি তাঁর দিকে তাকালাম, তখন তিনি হাসছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে উনায়স! তুমি কি ওখানে গিয়েছিলে, যেখানে তোমাকে যাওয়ার আদেশ দিয়েছিলাম? তিনি বলেন, আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি অবশ্যই যাচ্ছি। আনাস বলেন, আল্লাহ্র কসম! আমি নয় বছর তাঁর খিদমত করেছি। কিন্তু আমার জানা নেই, কোন কাজ আমি করলে সে সম্পর্কে বলেননি, এমন এমন কেন করলে কিংবা কোন কাজ না করলে, সে সম্পর্কে তিনি বলেননি, অমুক অমুক কাজ কেন করলে না’।[২০] আপর একটি হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَنَسٍ رضى الله عنه قَالَ خَدَمْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم عَشْرَ سِنِيْنَ فَمَا قَالَ لِى أُفٍّ قَطٌّ

আনাস (রাযিয়াল্লাহ আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি দশ বছর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খেদমত করেছি। তিনি কখনও আমাকে ‘উফ’ পর্যন্ত বলেননি।[২১]

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ لَمْ يَكُنْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَاحِشًا وَلَا مُتَفَحِّشًا وَلَا صَخَّابًا فِى الْأَسْوَاقِ وَلَا يَجْزِىْ بِالسَّيِّئَةِ السَّيِّئَةَ وَلَكِنْ يَعْفُوْ وَيَصْفَحُ

‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অশ্লীল বা কটুভাষী ছিলেন না। ভান করেও অশ্লীল কথা তিনি বলেননি। তিনি বাজারে চিৎকার করতেন না। অন্যায় আচরণের মাধ্যমে অন্যায়ের বদলা নিতেন না; বরং তিনি তা ক্ষমা করে দিতেন এবং তা উপেক্ষা করতেন।[২২] আনাস (রাযিয়াল্লাহ আনহু) বলেন,

كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَحْسَنَ النَّاسِ وَأَجْوَدَ النَّاسِ وَأَشَجَعَ النَّاسِ

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকদের মধ্যে সকলের চেয়ে সুন্দর, সর্বাপেক্ষা অধিক দানশীল এবং সকলের চেয়ে বেশী সাহসী ছিলেন।[২৩] অন্যত্র জাবের (রাযিয়াল্লাহ আনহু) বলেন,

مَا سُئِلَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم شَيْئًا قَطٌّ فَقَالَ لَا

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট যখনই কোন জিনিস চাওয়া হয়েছে, তিনি কখনো ‘না’ বলেননি। আনাস (রাযিয়াল্লাহ আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

لَمْ يَكُنْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَاحِشًا وَلَا لَعَّانًا وَلَا سَبَّابًا كَانَ يَقُوْلُ عِنْدَ الْمَعْتَبَةِ مَا لَهُ تَرِبَ جَبِينُهُ

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অশালীন বাক্য উচ্চারণকারী, লা‘নতকারী এবং গালি-গালাজকারী ছিলেন না। তিনি কখনো কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হলে, তখন কেবল এতটুকুই বলতেন যে, ‘তার কি হল? তার কপাল ভূলুণ্ঠিত হোক’।[২৫] একবার রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট প্রস্তাব করা হল, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কাফের-মুশরিকদের উপর বদ-দু‘আ করুন। উত্তরে তিনি বললেন,

إِنِّى لَمْ أُبْعَثْ لَعَّانًا وَإِنَّمَا بُعِثْتُ رَحْمَةً

‘আমাকে অভিসম্পাতকারী রূপে পাঠান হয়নি। বরং আমাকে রহমত স্বরূপ পাঠান হয়েছে’।[২৬] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,

مَا ضَرَبَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم شَيْئًا قَطٌّ بِيَدِهِ وَلَا امْرَأَةً وَلَاخَادِمًا إِلَّا أَنْ يُّجَاهِدَ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَمَا نِيْلَ مِنْهُ شئٌ قَطٌّ فَيَنْتَقِمُ مِنْ صَاحِبِهِ إِلَّا أَنْ يُّنْتَهَكَ شَئٌ مِنْ مَحَارِمِ اللهِ فَيَنْتَقِمُ لِلهِ

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ব্যতীত কখনো কাউকে নিজ হাতে প্রহার করেননি। নিজের স্ত্রীগণকেও না, খাদেমকেও না। আর যদি তাঁর দেহে বা অন্তরে কারো পক্ষ হতে কোন প্রকার কষ্ট বা ব্যথা লাগত, তখন নিজের ব্যাপারে সে ব্যক্তি হতে কোন প্রকারের প্রতিশোধ নিতেন না। কিন্তু যদি কেউ আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ করে বসত, তখন আল্লাহর উদ্দেশ্যে শাস্তি দিতেন।[২৭]
উপরিউক্ত আলোচনায় সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে যে, সারা জাহানে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেয়ে উত্তম চরিত্রের অধিকারী কেউ ছিলেন না, বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। তাই এই মহান ব্যক্তির আদর্শ অনুসরণ করার জন্য মহান আল্লাহ আমাদেরকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন। আর এরই মাঝে রয়েছে ইহ ও পরকালীন মুক্তি ও সর্বপ্রকার কল্যাণ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক, বিশ্বশান্তির অগ্রনায়ক মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে মাইকেল এইচ. হার্ট যথার্থই বলেছেন,

“My choice of Muhammad to led the list of the worlds most influential persons may  surprise some readers and may  be history who was supremely successful on both the religious and secular levels”.

‘আমার দৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচাইতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাম সর্বাগ্রে স্থান পাওয়ায় অনেক পাঠক বিস্মিত হতে পারে এবং হতে পারে এটা ঐতিহাসিক ব্যাপার। তিনি ধর্মীয় ও পার্থিব উভয় ক্ষেত্রেই ছিলেন পৃথিবীর সর্বাধিক সফল ব্যক্তিত্ব’।[২৮] অনুরূপই জর্জ বার্নার্ড শ’ বলেন,

“I believe if a man like Mohammad were to assume the dictatorship of modern world, he would succed in solving its problem in a way that would bring its much needed peace and happiness”.

‘আমি বিশ্বাস করি যে, মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মত একজন লোক যদি এই আধুনিক বিশ্বের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন, তবে এর জটিল সমস্যাবলীর এমন সুন্দর সমাধান করতেন, যা এনে দিত অত্যাবশ্যক সুখ ও শান্তি’।[২৯]
অস্থিতিশীল অধুনা বিশ্বকে সুশৃংখল করে শান্তির ফল্গুধারা প্রবাহিত করার জন্য এবং সকল সমস্যার সমাধানের জন্য মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মত একজন আর্দশ মানুষের আজ বড়ই প্রয়োজন। আর আদর্শ মানব গড়ার জন্য চাই তাঁর আদর্শ ও স্বভাব-চরিত্রের হুবহু অনুকরণ ও অনুসরণ। তাহলেই এ সকল সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব, নচেৎ নয়।
তিনি স্বীয় চরিত্রগুণেই সকলের হৃদয় জয় করেছিলেন। ঘোর শত্রু তাঁকে হত্যার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে অবসন্ন দেহমন নিয়ে যখন তাঁকে পেয়েছে, তখন তাঁর চরিত্র-মাধুর্যে বিমুগ্ধ না হয়ে পারেনি। ভুলে গেছে জীবন নাশের পূর্ব নির্ধারিত সকল পরিকল্পনা। তাঁর হাতে হাত রেখে ইসলামের স্বর্গীয় সুধা পান করে ধন্য হয়েছে। ইসলামের স্বর্ণ যুগের ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি ফেরালে এরূপ দু’একটি নয়; বরং শত শত ঘটনা দৃষ্টিগোচর হবে। আর এর মূল কারণই ছিল মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসাধারণ চরিত্র মাধুর্য। তাই আদর্শ ব্যক্তি, আদর্শ জাতি ও দেশ গড়ার জন্য মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণের কোন বিকল্প নেই।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।
১. ডঃ হায়াৎ মামুদ, ভাষা-শিক্ষা (ঢাকা : দি এ্যাটলাস পাবলিশিং হাউস, ২০০১), পৃ. ১৬৭।
২. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৩৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩২১; মিশকাত, হা/৫০৭৫।
৩. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৭৬৭; মিশকাত, হা/৫০৭৪।
৪. তিরমিযী, হা/২০০২; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৬৯৩; মিশকাত, হা/৫০৮১, সনদ ছহীহ ।
৫. তিরমিযী, হা/২০০৩; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৮৭৬, সনদ ছহীহ।
৬. তিরমিযী, হা/২০০৪; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/২৯৪; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৭৭; মিশকাত, হা/৪৮৩২, সনদ হাসান।
৭. বায়হাক্বী, মুসতাদরাকে হাকেম, হা/৮২০৬; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/২৯১; মিশকাত, হা/৫০৭৯, সনদ ছহীহ।
৮. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৫২; মিশকাত, হা/৫০৬৮।
৯. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯২; আবূ দাঊদ, হা/৪৮০৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯২৭২; ইবনু মাজাহ, হা/৩৬৮৭; মিশকাত, হা/৫০৬৯।
১০. তিরমিযী, হা/২০১৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫২৯৮; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৪৬৪; মিশকাত, হা/৫০৭৬, সনদ ছহীহ।
১১. আবূ দাঊদ, হা/৪৮০৮; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৫০; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৫২৪; সনদ ছহীহ।
১২. আবূ দাঊদ, হা/৪৬৮২; তিরমিযী, হা/১১৬২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৩৯৬; দারেমী, হা/২৭৯২; মিশকাত, হা/৫১০১, সনদ হাসান।
১৩. আবূ দাউদ, হা/৪৭৯০; তিরমিযী, হা/১৯৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯১০৭; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৪১৮; মিশকাত, হা৫০৮৫; সনদ হাসান।
১৪. তিরমিযী, হা/২৪৮৮; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৩৮; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৭০; মিশকাত, হা/৫০৮৪, সনদ ছহীহ।
১৫. আবূ দাঊদ, হা/৪৮০১; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৯০২; বায়হাক্বী, হা/৮১৭৩; মিশকাত, হা/৫০৮০, সনদ ছহীহ।
১৬. তিরমিযী, হা/১৯৯৭; বায়হাক্বী, হা/৬৫৯৩; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/১৩২১; সনদ ছহীহ।
১৭. তিরমিযী, হা/২০০৬; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৩২০; সনদ ছহীহ।
১৮. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৩৩৫৭; মিশকাত, হা/৫০৯৭, সনদ হাসান।
১৯. ছহীহ বুখারী, হা/৬২০৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১০; আবূ দাঊদ, হা/৪৭৭৩; তিরমিযী, হা/২০১৫; মিশকাত, হা/৫৮০২।
২০. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩০৯; আবূ দাঊদ, হা/৪৭৭৩; মিশকাত, হা/৫৮০২।
২১. তিরমিযী, হা/২০১৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৭০০; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/২৮৯৪; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/২৭৭, সনদ ছহীহ।
২২. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮৩৮; তিরমিযী, হা/২০১৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৪৫৬; মিশকাত, হা/৫৮২০।
২৩. ছহীহ বুখারী, হা/৩০৪০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩০৭; তিরমিযী, হা/১৬৮৭; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩০৩; মিশকাত, হা/৫৮০৪।
২৪. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৩৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৩৩৩; দারেমী, হা/৭০; মিশকাত, হা/৫৮০৫।
২৫. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৪৬; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৪৩০; মিশকাত, হা/৫৮১১।
২৬. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯৯; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩৯৪৫; মিশকাত, হা/৫৮১২।
২৭. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩২৮; মিশকাত, হা/৫৮১৮।
২৮. মাইকেল এইচ. হার্ট, দি হান্ড্রেড, বঙ্গানুবাদ : শ্রেষ্ঠ ১০০ (ঢাকা: পরশ পাবলির্শাশ, ১৯৯৪ইং), পৃ. ১।
২৯. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম, বৈজ্ঞানিক মুহাম্মাদ (ছাঃ) (কলকাতা : মল্লিক ব্রাদার্স, ১৯৯৫ইং), ১ম খণ্ড. পৃ. ২৩।




মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২১তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আশূরায়ে মুহাররম - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ - ড. মেসবাহুল ইসলাম
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (শেষ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসলামী সংগঠন ও তরুণ-যুবক-ছাত্র (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আশূরায়ে মুহাররম - ছাদীক মাহমূদ
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৮ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
তওবার গুরুত্ব ও ফযীলত (শেষ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
হজ্জের শিক্ষা ও হজ্জ পরবর্তী করণীয় - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির

ফেসবুক পেজ