বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৭ অপরাহ্ন

আল-কুরআনে মানুষ: মর্যাদা ও স্বরূপ বিশ্লেষণ 

ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ* 



মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মানব জাতির কল্যাণের আঁধার। মানুষের সঠিক পথের দিশা দিতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ হলো আল-কুরআন। এটি সুদীর্ঘ তেইশ বছর যাবৎ বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতির আবর্তে মানুষের কল্যাণ সাধনের নিমিত্তে গাইডবুক হিসাবে নাযিল হয়েছে। এর আলোচ্য বিষয় হলো মানুষ। এতে মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সমস্যা ও তার সমাধানের বর্ণনা বিবৃত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, مَا فَرَّطۡنَا فِی الۡکِتٰبِ مِنۡ شَیۡءٍ ‘কিতাব (কুরআনে) কোন কিছুই আমি বাদ দেইনি’ (সূরা আল-আন‘আম: ৩৮)।[১] মানুষ আল্লাহ তা‘আলার অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে এক অনন্য ও অসাধারণ সৃষ্টি। মানুষই একমাত্র সৃষ্টিজীব যাদের রয়েছে বিবেক ও বোধশক্তি। এ বিবেকই তাদের চালিকাশক্তি এবং আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণের অনুসন্ধানী। ফলে মানুষকে তিনি আশরাফুল মাখলুক্বাত বা সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীবরূপে ঘোষণা দিয়েছেন (সূরা বনী ইসরাইল: ৭০)।

এ পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে, তার সবই মানুষের কল্যাণের জন্য। মহান আল্লাহ আপন কৃপায় সেসব সৃষ্টিজীবকে মানুষের অনুগত ও বশ্য করে দিয়েছেন। যদিও তারা আকার-আকৃতিতে, শক্তি ও দেহাবয়বের দিক থেকে মানুষের চেয়ে অনেক বড়। এ মর্মে তিনি ইরশাদ করেন, اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ سَخَّرَ لَکُمۡ مَّا فِی الۡاَرۡضِ وَ الۡفُلۡکَ ‘তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে তৎসমূদয়কে’ (সূরা আল-হজ্জ: ৬৫)।

সৃষ্টিগত উপাদান

মানুষের সৃষ্টি মূলে যে মহান আল্লাহর একক ইচ্ছার প্রতিফলন মাত্র, সেই মহান আল্লাহ দু’ধরনের উপাদান দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।[২]

প্রথমতঃ মাটি থেকে

আদম (আলাইহিস সালাম)-এর সৃষ্টির উপাদান সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ  اِنِّیۡ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنۡ صَلۡصَالٍ مِّنۡ  حَمَاٍ  مَّسۡنُوۡنٍ- فَاِذَا سَوَّیۡتُہٗ  وَ نَفَخۡتُ فِیۡہِ  مِنۡ  رُّوۡحِیۡ فَقَعُوۡا  لَہٗ   سٰجِدِیۡنَ.  

‘(স্মরণ করুন) যখন আপনার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘আমি ছাঁচে ঢালা শুষ্ক ঠনঠনে মাটি হতে মানুষ সৃষ্টি করেছি। যখন আমরা তাকে সুঠাম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব তখন তোমরা সিজাদ করবে’ (সূরা আল-হিজর: ২৮-২৯)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

الَّذِیۡۤ  اَحۡسَنَ کُلَّ شَیۡءٍ خَلَقَہٗ  وَ بَدَاَ خَلۡقَ الۡاِنۡسَانِ مِنۡ طِیۡنٍ - ثُمَّ جَعَلَ نَسۡلَہٗ  مِنۡ سُلٰلَۃٍ مِّنۡ مَّآءٍ مَّہِیۡنٍ- ثُمَّ سَوّٰىہُ  وَ نَفَخَ فِیۡہِ مِنۡ رُّوۡحِہٖ وَ جَعَلَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ ؕ قَلِیۡلًا  مَّا  تَشۡکُرُوۡنَ.

‘যিনি তাঁর সকল কিছু সৃজন করেছেন উত্তমরূপে এবং কাঁদা মাটি হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর তার বংশ উৎপন্ন করেছেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস থেকে। পরে তিনি তাকে করেছেন সুঠাম এবং ওতে ফুঁকে দিয়েছেন রূহ তাঁর নিকট হতে এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ, তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (সূরা আল-হিজর: ৭-৯)।

দ্বিতীয়তঃ বীর্ষ থেকে

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ سُلٰلَۃٍ  مِّنۡ طِیۡنٍ- ثُمَّ  جَعَلۡنٰہُ  نُطۡفَۃً  فِیۡ قَرَارٍ مَّکِیۡنٍ- ثُمَّ خَلَقۡنَا النُّطۡفَۃَ عَلَقَۃً  فَخَلَقۡنَا الۡعَلَقَۃَ مُضۡغَۃً فَخَلَقۡنَا الۡمُضۡغَۃَ عِظٰمًا فَکَسَوۡنَا الۡعِظٰمَ لَحۡمًا ٭ ثُمَّ اَنۡشَاۡنٰہُ خَلۡقًا اٰخَرَ ؕ فَتَبٰرَکَ اللّٰہُ  اَحۡسَنُ  الۡخٰلِقِیۡنَ.

‘আমরা তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার উপাদান হতে, অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে স্থাপন করি ‘আলাক্ব-এ, অতঃপর ‘আলাক্বকে পরিণত করি পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে পরিণত করি অস্থি-পাঞ্জরে অতঃপর অস্থি পাঞ্জরকে ঢেকে দেই গোশত দ্বারা; অবশেষে তাতে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান’ (সূরা আল-মুমিনূন: ১২-১৪)। অন্যত্র মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে,

یَخۡلُقُکُمۡ  فِیۡ بُطُوۡنِ اُمَّہٰتِکُمۡ  خَلۡقًا مِّنۡۢ بَعۡدِ خَلۡقٍ فِیۡ ظُلُمٰتٍ ثَلٰثٍ ؕ ذٰلِکُمُ اللّٰہُ رَبُّکُمۡ لَہُ الۡمُلۡکُ ؕ لَاۤ اِلٰہَ  اِلَّا ہُوَ ۚ فَاَنّٰی تُصۡرَفُوۡنَ.

‘তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃ-গর্ভের ত্রিবিধ অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আল্লাহ; তোমাদের প্রতিপালক; সর্বময় কর্তৃত্ব তারই; তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তবে তোমরা মুখ ফিরিয়ে কোথায় চলছ?’ (সূরা আয-যুমার: ৬)। মূলত মানুষকে একটি প্রাণ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারপর তা থেকে তার সঙ্গীর সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর তাদের উভয়ের মাধ্যমে অসংখ্য নারী-পুরুষের বিস্তৃৃতি লাভ করেছে। মহান আল্লাহ সূরা আন-নিসার শুরুতে ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ خَلَقَ مِنۡہَا زَوۡجَہَا وَ بَثَّ مِنۡہُمَا رِجَالًا کَثِیۡرًا وَّ نِسَآءً.

‘হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন। যিনি তাদের দু’জন হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন’ (সূরা আন-নিসা: ১)। মানুষ সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ ক্লান্ত হননি বরং তাদের দিয়েছেন ভাল ও মন্দের মাঝে পার্থক্য করার ক্ষমতা, মুক্ত ও স্বাধীনভাবে যমীনে বিচরণের অধিকার, চিন্তার স্বাধীনতা প্রভৃতি। তিনি বলেন,

وَ نَفۡسٍ وَّ مَا سَوّٰىہَا- فَاَلۡہَمَہَا فُجُوۡرَہَا وَ تَقۡوٰىہَا - قَدۡ  اَفۡلَحَ  مَنۡ  زَکّٰىہَا- وَ  قَدۡ خَابَ مَنۡ  دَسّٰىہَا.

‘শপথ মানুষের এবং তার, যিনি তাকে সুঠাম করিয়েছেন, অতঃপর তিনি তাকে অবহিত করেছেন তার পাপ সমূহ এবং তার তাক্বওয়া সম্পর্কে। নিশ্চয় সে-ই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে এবং সে-ই ব্যর্থ হবে যে নিজেকে কলুসাচ্ছন্ন করবে’ (সূরা আশ-শামস: ৭-১০)। প্রকৃতপক্ষে মানুষের শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার মূলে যে বৈশিষ্ট্যটি খুবই গুরুত্বের দাবীদার তা হলো জ্ঞান। তিনি মানুষকে জ্ঞানের ভাণ্ডার দান করেছেন, শুধু তাই নয়, এ জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ ফিরিশতাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এ মর্মে তিনি ইশরাদ করেন,

اِقۡرَاۡ وَ رَبُّکَ الۡاَکۡرَمُ- الَّذِیۡ عَلَّمَ بِالۡقَلَمِ-عَلَّمَ الۡاِنۡسَانَ مَا لَمۡ  یَعۡلَمۡ  

‘পাঠ করুন, আর আপনার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না’ (সূরা আল-‘আলাক্ব: ৩-৫)। সূরা আল-বাকারাতে এসেছে,

وَ عَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ کُلَّہَا ثُمَّ عَرَضَہُمۡ عَلَی الۡمَلٰٓئِکَۃِ ۙ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ بِاَسۡمَآءِ ہٰۤؤُلَآءِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ- قَالُوۡا سُبۡحٰنَکَ لَا عِلۡمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ.

‘আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তৎপর সে সমুদয় ফিরিশতাদের সামনে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, ‘এই সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তারা বলল ‘আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তাছাড়া আমাদেরতো কোন জ্ঞান নেই’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৯-১০)। এতদ্ব্যতীত জ্ঞানের যেসব উপদান রয়েছে, তা সবই তিনি স্বীয় অনুগ্রহে মানুষকে দিয়েছেন। এ মর্মে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন: وَّ جَعَلَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ ۙ لَعَلَّکُمۡ  تَشۡکُرُوۡنَ ‘তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয়, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (সূরা আন-নাহল: ৭৮)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلَمۡ  نَجۡعَلۡ لَّہٗ عَیۡنَیۡنِ- وَ  لِسَانًا وَّ  شَفَتَیۡنِ

‘আমরা কি তার জন্য সৃষ্টি করিনি দুই চক্ষু? আর জিহ্বা ও দুই ওষ্ঠ?’ (সূরা আল-বালাদ: ৮-৯)। এছাড়াও তিনি মানুষকে বয়ান বা কথা বলা শিখিয়েছেন। সূরা আর-রহমানে এসেছে,

اَلرَّحۡمٰنُ -عَلَّمَ  الۡقُرۡاٰنَ- خَلَقَ  الۡاِنۡسَانَ- عَلَّمَہُ  الۡبَیَانَ.

‘দয়াময় আল্লাহ তিনিই শিক্ষা দিয়েছে কুরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে’ (সূরা আর-রহমান: ১-৪)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে নে‘মত দ্বারা মানুষকে ভূষিত করা হয়েছে তা হলো যুগে যুগে প্রেরিত আসমানী গ্রন্থসমূহ। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী গ্রন্থের ধারণ করা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

اِنَّا عَرَضۡنَا الۡاَمَانَۃَ عَلَی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ الۡجِبَالِ فَاَبَیۡنَ اَنۡ یَّحۡمِلۡنَہَا وَ اَشۡفَقۡنَ مِنۡہَا وَ حَمَلَہَا الۡاِنۡسَانُ ؕ اِنَّہٗ کَانَ ظَلُوۡمًا جَہُوۡلًا.

‘আমরা তো আসমান, যমীন ও পবর্তমালার প্রতি এই আমানত পেশ করেছিলাম, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শংকিত হলো, কিন্তু মানুষ তা বহন করল; সে তো অতিশয় যালিম, অতিশয় অজ্ঞ’ (সূরা আল-আহযাব: ৭২)। এসকল নে‘মতের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন, তাঁর বিধি-বিধানের আনুগত্য করা, তাঁকে সিজদা করা প্রভৃতি। এসব অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে স্বয়ং রাসূল (ﷺ) সিজদায় অবনত হয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন বলেন,

سَجَدَ وَجْهِي لِلَّذِي خَلَقَهُ، وَصَوَّرَهُ، وَشَقَّ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ، تَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِيْنَগ্ধ

‘আমার চেহারা সিজদা করেছে ঐ সত্তার জন্য যিনি তা সৃষ্টি করেছেন, অবয়ব দিয়েছেন এবং দিয়েছেন তাকে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি। আল্লাহ অতীব বরকতময়, সবচেয়ে উত্তম স্রষ্টা’।[৩] কিন্তু মানুষ অতিশয় অকৃতজ্ঞ। মহান আল্লাহ এসব অনুগ্রহের স্বীকৃতি দিতে চায় না এবং চেষ্টাও করে না। মহান আল্লাহ বলেন, اِنَّ  الۡاِنۡسَانَ لَکَفُوۡرٌ ‘মানুষ তো অতিমাত্রায় অকৃতজ্ঞ’ (সূরা আল-হজ্জ: ৬৬)। আল-কুরআন নানা ধরনের দ্বীনী বিষয়ের বর্ণনার সাথে সাথে মানুষের বিভিন্ন প্রকারের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য সর্ম্পকেও সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান চিত্র তুলে ধরেছে। যা সর্ব যুগের সর্বকালের সকল মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। মানুষের এ স্বরূপগুলো স্থায়ী। কোন জাতি বা কোন গোত্রই এ সকল বৈশিষ্ট্যের বাইরে নয়।

পবিত্র কুরআনে যেমন মানুষের প্রশংসা করা হয়েছে, তেমনি নিন্দাও করা হয়েছে। তাকে একদিকে যেমন আসমান, যমীন ও ফিরিশতার চাইতেও মহীয়ান-গরীয়ান করা হয়েছে, অপরদিকে তেমনি তাকে চতুষ্পদ জন্তু, শয়তানের চেয়েও হীন ও নিকৃষ্টতর প্রাণীরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। ফিরিশতার উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারে এরাই। তথাপি এরা এতই দুর্বল যে, নিকৃষ্টতম অবস্থানেও নেমে যেতে পারে। তাই কুরআনে তাদেরকে অত্যন্ত স্বৈরাচারী ও মূর্খরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে,

وَ لَقَدۡ ذَرَاۡنَا لِجَہَنَّمَ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ ۫ۖ  لَہُمۡ قُلُوۡبٌ لَّا یَفۡقَہُوۡنَ بِہَا ۫ وَ لَہُمۡ اَعۡیُنٌ لَّا یُبۡصِرُوۡنَ بِہَا ۫ وَ لَہُمۡ اٰذَانٌ لَّا یَسۡمَعُوۡنَ بِہَا ؕ اُولٰٓئِکَ کَالۡاَنۡعَامِ بَلۡ ہُمۡ اَضَلُّ ؕ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡغٰفِلُوۡنَ.

‘আমরা তো বহু জিন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তদের কর্ণ আছে তা দ্বারা তারা শ্রবণ করে না, তারা পশুর ন্যায় বরং তারা অধিক বিভ্রান্ত, তারাই গাফিল’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৭৯)। কুরআনের অন্যত্র আরো বলা হয়েছে:

لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡۤ  اَحۡسَنِ تَقۡوِیۡمٍ- ثُمَّ  رَدَدۡنٰہُ  اَسۡفَلَ سٰفِلِیۡنَ-  اِلَّا  الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَلَہُمۡ  اَجۡرٌ غَیۡرُ  مَمۡنُوۡنٍ.

‘আমরা তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে, অতঃপর আমি তাদেরকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে পরিণত করি। কিন্তু তাদেরকে নয় যারা মুমিন ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার’ (সূরা আত-ত্বীন: ৪-৬)।

অতএব উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের স্বরূপ নির্ণয়ে পবিত্র কুরআন দু’ধরণের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছে। যেমন (১) ভাল বৈশিষ্ট্য এবং (২) মন্দ বৈশিষ্ট্য। এগুলোকে আমরা দু’ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি। প্রথমতঃ ইতিবাচক দিক, যা কল্যাণকর ও অজর্নীয় এবং দ্বিতীয়তঃ নেতিবাচক দিক, যা অকল্যাণকর ও বর্জনীয়।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।

[১]. অন্যত্র আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে: وَ نَزَّلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ تِبۡیَانًا  لِّکُلِّ شَیۡءٍ  وَّ  ہُدًی  وَّ  رَحۡمَۃً   وَّ  بُشۡرٰی  لِلۡمُسۡلِمِیۡنَ ‘আমি আত্মসম্পর্ণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ পথ নির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করলাম’ (সূরা আন-নাহল: ৮৯)।

[২]. আব্দুর রহমান আন-নাহলাভী, উছূলুত তারবিয়াতিল ইসলামিয়্যাহ ওয়া আসালিবুহা (দামেশক: দারুল ফিকর, ১৯৭৯ খ্রি.), পৃ. ৩০।

[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৭১।




প্রসঙ্গসমূহ »: কুরআনুল কারীম
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
বিদ‘আত পরিচিতি (১৯তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (শেষ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
হজ্জের শিক্ষা ও হজ্জ পরবর্তী করণীয় - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ - ড. মেসবাহুল ইসলাম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন - হাসিবুর রহমান বুখারী
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ

ফেসবুক পেজ