সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০২:২৩ অপরাহ্ন

ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৪র্থ কিস্তি)

-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন



কুরআন এবং সুন্নাহ উভয়টিই আল্লাহ প্রদত্ত অহী :
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ উভয়টিই আল্লাহর নাযিলকৃত অহী। একটি সরাসরি আল্লাহর কালাম। অন্যটি আল্লাহর বিধান, তবে ভাষা রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর। আল্লাহ বলেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ ‘নিশ্চয় আমি স্বয়ং এই যিকির অবতীর্ণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষণ করব’ (আল-হিজর : ৯)। ইমাম ইবনু হাযাম (৩৮৪-৪৫৬ হি.) প্রমাণাদিসহ আলোচনা করে বলেন,

فَصَحَّ أَنَّ كَلَامَ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم كُلَّهُ فِىْ الدِّيْنِ وَحْىٌ مِنْ عِنْدِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَشَكَّ فِىْ ذَلِكَ وَلاَخِلاَفَ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ أَهْلِ اللُّغَةِ وَالشَّرِيْعَةِ فِىْ أَنَّ كُلَّ وَحْىٍ نَزَلَ مِنْ عِنْدِ اللهِ تَعَالَى فَهُوَ ذِكْرٌ مُنَزَّلٌ فَالْوَحْىُ كُلُّهُ مَحْفُوْظٌ بِحِفْظِ اللهِ تَعَالَى لَهُ بِيَقِيْنٍ

‘সুতরাং বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হল যে, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রত্যেকটি কথাই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত, যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী করা হয়েছে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর অহীর সবকিছুই যে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, সে বিষয়ে ভাষাবিদ ও শরী‘আত অভিজ্ঞ কোন একজনের মধ্যেও মতানৈক্য নেই। আর সেটাই হল নাযিলকৃত যিকির। সুতরাং অহীর সবকিছুই আল্লাহর বিশেষ সংরক্ষণে সংরক্ষিত’।[১]

রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মতকে শরী‘আত হিসাবে যা কিছু দিয়েছেন, তার সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অভ্রান্ত বিধান। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করা যাবে না। নিম্নের হাদীছটি তারই সাক্ষ্য বহন করে।

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا تَوَضَّأَ أَخَذَ كَفًّا مِنْ مَاءٍ فَأَدْخَلَهُ تَحْتَ حَنَكِهِ فَخَلَّلَ بِهِ لِحْيَتَهُ وَقَالَ هَكَذَا أَمَرَنِىْ رَبِّىْ عَزَّ وَجَلَّ

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ওযূ করতেন, তখন হাতে এক চুল্লু পানি নিতেন এবং থুতনির নীচে দিতেন। অতঃপর এর দ্বারা তাঁর দাড়ি খিলাল করতেন। তিনি বলতেন, এভাবেই আমার আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দান করেছেন’।[২] রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওযূর সময় দাড়ির নীচে এক চুল্লু পানি নিজ ইচ্ছায় দিবেন এমন অধিকার তাঁর ছিল না। অন্য হাদীছে রয়েছে,

عَنْ غُضَيْفِ بْنِ الْحَارِثِ قَالَ قُلْتُ لِعَائِشَةَ أَرَأَيْتِ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَغْتَسِلُ مِنَ الْجَنَابَةِ فِىْ أَوَّلِ اللَّيْلِ أَوْ فِىْ آخِرِهِ قَالَتْ رُبَّمَا اغْتَسَلَ فِىْ أَوَّلِ اللَّيْلِ وَرُبَّمَا اغْتَسَلَ فِىْ آخِرِهِ قُلْتُ اللهُ أَكْبَرُ الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِىْ جَعَلَ فِى الأَمْرِ سَعَةً قُلْتُ أَرَأَيْتِ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يُوْتِرُ أَوَّلَ اللَّيْلِ أَمْ فِىْ آخِرِهِ قَالَتْ رُبَّمَا أَوْتَرَ فِىْ أَوَّلِ اللَّيْلِ وَرُبَّمَا أَوْتَرَ فِىْ آخِرِهِ قُلْتُ اللهُ أَكْبَرُ الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِىْ جَعَلَ فِى الأَمْرِ سَعَةً قُلْتُ أَرَأَيْتِ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَجْهَرُ بِالْقُرْآنِ أَمْ يَخْفِتُ بِهِ قَالَتْ رُبَّمَا جَهَرَ بِهِ وَرُبَّمَا خَفَتَ قُلْتُ اللهُ أَكْبَرُ الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِىْ جَعَلَ فِى الأَمْرِ سَعَةً

‘গুযায়ফ ইবনু হারিছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি একদা আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে বললাম, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি অপবিত্রতার গোসল প্রথম রাত্রে করতেন, না শেষ রাতে করতেন? তিনি উত্তরে বললেন, কখনো প্রথম রাতে আবার কখনো শেষ রাতে করতেন। আমি বললাম, আল্লাহ মহান। ঐ আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা, যিনি এই আমলে প্রশস্ততা রেখেছেন। আমি বললাম, তিনি বিতর ছালাত রাতের প্রথমে আদায় করতেন, না শেষে আদায় করতেন? তিনি উত্তরে বললেন, কখনো রাত্রের প্রথমে পড়তেন, কখনো রাতের শেষে পড়তেন। আমি বললাম, আল্লাহ মহান। ঐ আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা, যিনি এই আমলে প্রশস্ততা রেখেছেন। আমি বললাম, তিনি রাত্রে কুরআন সরবে পড়তেন, না নীরবে পড়তেন? তিনি উত্তরে বললেন, কখনো সরবে পড়তেন, কখনো নীরবে পড়তেন। আমি বললাম, আল্লাহ মহান। ঐ আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা, যিনি এই আমলে প্রশস্ততা রেখেছেন’।[৩]

উক্ত হাদীছও প্রমাণ করে যে ছোট-বড় যাবতীয় বিধান সবই আল্লাহ প্রদত্ত। এখানে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন এখতিয়ার নেই। আর ছাহাবায়ে কেরামও এই বিশ্বাস পোষণ করতেন। সে জন্য উক্ত ছাহাবী রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রশংসা না করে, সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করলেন।

তাই শরী‘আতের আধ্যাত্মিক বিষয়কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। অন্যথা মানব জীবনে কল্যাণ আশা করা যাবে না। কারণ আধ্যাত্মিক মূল্যবোধশূন্য ধর্মহীন ব্যক্তি পশুত্বের বেশ ধারণ করে। তাই পশ্চিমা বিশ্বে আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষ উচ্চমার্গে পৌঁছলেও আধ্যাত্মিকতাশূন্য হওয়ায় তা মূল্যহীন হয়ে গেছে। তাই ড. ইকবাল মনে করেন, পাশ্চাত্য সমাজ এমন এক সংগঠন, যার পিছনে কেবল পশুসুলভ দড়ি টানাটানি কার্যকর রয়েছে। এটা এমন এক সভ্যতা যা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে নিজের আধ্যাত্মিক ঐক্য হারিয়ে ফেলেছে। তিনি বলেন, বস্তুবাদী মনোভাবের ক্রমোন্নতি তাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে অবশ করে দিয়েছে।[৪]

মূলনীতি-৪ : কর্মসাধনের মাধ্যমে ইসলামী জীবনাদর্শের বাস্তব রূপ উপস্থাপন
কর্ম ও সাধনার মাধ্যমে আদর্শের রূপ ফুটে উঠে। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ছাহাবায়ে কেরাম স্বর্ণ যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ হলেও তাঁরা নযীর বিহীন পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করে ইবাদত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন। তাই উত্তম চরিত্র, নম্র ব্যবহার, আমানতদারি, উদারতা, মহানুভবতা ইত্যাদি গুণাবলীর বাস্তব রূপ সর্বত্র তুলে ধরার মাধ্যমে ইসলামী পুনর্জাগরণের পথকে প্রশস্ত করতে হবে। অনুরূপ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রসমূহে ইসলাম যে রূপরেখা প্রদান করেছে, তার সম্পর্কে বাস্তব সচেতনতা তুলে ধরতে হবে। ইসলামে শুধু আনুষ্ঠানিকতার স্থান নেই। ড. ইকবাল বলেন, ‘The Quran is a book which emphasizes ‘deed’ rather than ‘idea’. ‘কুরআন এমনি একটি গ্রন্থ, যা ভাবনার চেয়ে আমলের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেছে’।[৫] তাই ঈদের দিন খুশির দিন হলেও শুধু আনুষ্ঠানিকতার বিধান দেয়া হয়নি। এখানে তাকবীর, দু‘আ, ছালাত, ছাদাক্বা ও কুরবানী ইত্যাদি ইবাদতে ভরপুর। যেমন শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬২ খৃ.) বলেন,

فيهما تنويه بشعائر الملة الحنيفية وضم مع التجميل فيهما ذكر الله وأبوابا من الطاعة لئلا يكون اجتماع المسلمين بمحض اللعب ولئلا يخلوا اجتماع منهم من إعلاء كلمة الله

‘এই দুই ঈদের মধ্যে বিশুদ্ধ মিল্লাতের নিদর্শনসমূহের সুউচ্চ প্রশংসা রয়েছে। আর এই দুই দিনের সৌন্দর্যের সাথে আল্লাহর স্মরণ ও আনুগত্যের মাধ্যমসমূহ সম্পৃক্ত হয়েছে। যাতে মুসলিমদের সমাবেশ কেবল খেলাধুলার জন্য না হয় এবং সমাবেশ যেন আল্লাহর কালেমাকে সুউচ্চ করা থেকে শূন্য না হয়’।[৬]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِيْنَ وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ  ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করুন এবং সিজদাকারীদের মধ্যে শামিল হৌন। আর মৃত্যু আসা পর্যন্ত আপনি আপনার রবের ইবাদত করুন’ (আল-হিজর : ৯৮ ও ৯৯)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেন,

فإن الأنبياء عليهم السلام كانوا هم وأصحابهم أعلم الناس بالله وأعرفهم بحقوقه وصفاته، وما يستحق من التعظيم وكانوا مع هذا أعبد الناس وأكثر الناس عبادة ومواظبة على فعل الخيرات إلى حين الوفاة

‘নিশ্চয় নবী-রাসূলগণ এবং তাঁদের সাথীরা আল্লাহ সম্পর্কে বেশী জানতেন, তাঁর অধিকার, গুণাবলী এবং তাঁর যথাযথ সম্মান সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী উপলব্ধি করতেন। এছাড়া তাঁরা অন্যান্য মানুষের মধ্যে বেশী ইবাদতগুযার ছিলেন, তারা বেশী বেশী ইবাদত করতেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাঁরা নিয়মিত বেশী বেশী ভাল কাজের আঞ্জাম দিতেন’।[৭]

রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং ছাহাবায়ে কেরাম তাওহীদের বাণী প্রচারে যেমন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তেমনি তাক্বওয়া বৃদ্ধি ও আল্লাহর রেযামন্দী হাছিলের জন্য ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, দান, ছাদাক্বার ক্ষেত্রেও কঠিন সাধনা করেছেন। সামাজিক জীবনে উত্তম চরিত্র ও সদাচরণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামের বদান্যতারও প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সেই সাথে ইসলামের কালেমা সমুন্নত রাখতে এবং মুসলিম উম্মাহর অধিকার অক্ষুন্ন রাখতে জিহাদের ময়দানে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছেন। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইবাদতের সাধনার স্বরূপ নিম্নের হাদীছে ফুটে উঠেছে-

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ نَبِىَّ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَقُوْمُ مِنَ اللَّيْلِ حَتَّى تَتَفَطَّرَ قَدَمَاهُ فَقَالَتْ عَائِشَةُ لِمَ تَصْنَعُ هَذَا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَقَدْ غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ قَالَ أَفَلاَ أُحِبُّ أَنْ أَكُوْنَ عَبْدًا شَكُوْرًا فَلَمَّا كَثُرَ لَحْمُهُ صَلَّى جَالِسًا فَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَرْكَعَ قَامَ فَقَرَأَ ثُمَّ رَكَعَ

‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাত্রিতে ছালাত আদায় করতেন। এমনকি তাঁর দু’পা ফুলে যায়। তখন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি এটা করেন কেন? আপনার তো পূর্বের ও পরের সমস্ত পাপই ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তরে বলেন, আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হতে ভালবাসি না? যখন তিনি মোটা হয়ে গেলেন, বসে বসে ছালাত আদায় করতেন। যখন রুকূ‘ করার ইচ্ছা করতেন তখন দাঁড়াতেন। অতঃপর ক্বিরাআত করতেন এবং রুকূ‘ করতেন’।[৮]

সম্রাট হেরাক্লিয়াস সিরিয়ার যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ জানার জন্য এক গুপ্তচরকে মুসলিম সেনাবাহিনীর মধ্যে পাঠিয়েছিলেন। গুপ্তচর একদিন এক রাত থাকার পর এসে নিম্নের রিপোর্ট পেশ করেন-

هم فرسان بالنهار رهبان بالليل لا يأكلون في ذمتهم إلا بثمن ولا يدخلون إلابسلام يقفون على من حاربوه حتى يأتوا عليه

‘তাঁরা দিনের বেলায় ঘোড়সওয়ার বীর, রাতের বেলায় ইবাদতগুযার। তাদের আয়ত্বে থাকা সম্পদ মূল্য ছাড়া ভক্ষণ করেন না, শান্তির বার্তা না দিয়ে কোন এলাকায় প্রবেশ করেন না। তাঁরা তার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন, যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, যতক্ষণ তারা তার উপর বিজয় লাভ না করেন’।[৯] উক্ত স্বীকারুক্তি শুনে হিরাক্লিয়াস বলেন, لئن كنت صدقتني ليملكن موضع قدمي هاتين ‘তুমি যদি সত্য বলে থাক, তবে অবশ্যই অচিরেই তারা আমার এই দুই পায়ের সিংহাসনটারও অধিপতি হয়ে যাবে’।[১০] অন্য বর্ণনায় এসেছে, بالليل رهبان وبالنهار فرسان ولو سرق ابن ملكهم قطعوا يده ولو زنى رجم لإقامة الحق فيهم ‘দিনের বেলায় ঘোড়সওয়ার বীর, রাতের বেলায় ইবাদতগুযার। আর যদি তাদের রাজপুত্রও চুরি করে, তবুও তারা তার হাত কেটে দেয়। আর যদি কেউ যেনা করে, তবে তাকে রজম করা হয় তাদের মাঝে হক্ব প্রতিষ্ঠার জন্য’।[১১] উক্ত কথা শুনে স¤্রাট বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! তুমি যদি সত্য বলে থাক, তবে পৃথিবীর চেয়ে আমাদের জন্য কবরই উত্তম’।[১২]

তাঁদের তাক্বওয়া ও ইবাদতের সাধনাই ইসলামী পুনর্জাগরণের দ্বার উন্মোচন করেছে। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাঁদের ত্যাগের কথা তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর তাঁর সাথে যারা আছেন, তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি রহম দিল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকূ‘ ও সিজদায় অবনত দেখতে পাবেন। তাদের মুখম-লে সিজদার চিহ্ন থাকবে। তাওরাত ও ইঞ্জীলে তাদের বর্ণনা এভাবেই দেয়া হয়েছে। তাদের দৃষ্টান্ত একটি শস্য ক্ষেতের মত, যার চারা গাছগুলো অঙ্কুরিত হয়। পরে সেগুলো শক্ত ও পুষ্ট হয়ে কা-ের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, যা চাষীকে আনন্দিত করে। এভাবে কাফেরদের মধ্যে অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন’ (আল-ফাতহ : ২৯)। অন্য আয়াতে ছাহাবীদের সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,

إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُوْنَ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فَيَقْتُلُوْنَ وَيُقْتَلُوْنَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِى التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيْلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللهِ فَاسْتَبْشِرُوْا بِبَيْعِكُمُ الَّذِىْ بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ

‘নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের যান ও মালকে ক্রয় করে নিয়েছেন যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা মরে এবং মারে। এর সত্য অঙ্গীকার করা হয়েছে তাওরাত, ইঞ্জীল এবং কুরআনে। আর আল্লাহ অপেক্ষা কে আছে অধিক অঙ্গীকার পূরণকারী? অতএব তোমরা আনন্দ করতে থাক তোমাদের এই ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে, যা সম্পাদন করেছ। আর এটা বিরাট সফলতা’ (আত-তাওবাহ : ১১১)।

তাছাড়া পবিত্র কুরআনের অধিকাংশ স্থানে যেখানে ঈমানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে সৎ আমলের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমলহীন জীবন যাপন করতে বলেননি। আবার বছরে একটি অনুষ্ঠান করলে আর কোন ইবাদত করা লাগবে না এমন কোন অনুষ্ঠানসর্বস্ব রীতিও পেশ করেননি।

মূলনীতি-৫ : ইসলামী স্কলার ও দাঈদের জন্য এক ও অভিন্ন দাওয়াতী মূলনীতি প্রণয়ন
দাওয়াত ইসলামী আদর্শকে জাগরুক রাখে। সর্বত্র এর প্রচার ও প্রসার ঘটে দাওয়াতের মাধ্যমে। তাই ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য একান্ত জরুরী হল অভিজ্ঞ দাঈ ও পরিকল্পিত দাওয়াতী মূলনীতি।[১৩] রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং ছাহাবায়ে কেরাম যে নির্দিষ্ট মূলনীতির আলোকেই দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতেন, তা আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আল্লাহ বলেন,

قُلْ هَذِهِ سَبِيْلِىْ أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيْرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِىْ وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ

‘আপনি বলুন! এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে, জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ মহা পবিত্র এবং আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ : ১০৮)।

উক্ত আয়াতে কয়েকটি মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেখানো পথ বা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের উপর অটল থাকা, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া, দলীল ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করে আদর্শ পেশ করা। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর ছাহাবীগণ সবাই দাওয়াতের কাজ করতেন। অন্য আয়াতে তিনি বলেন,

اُدْعُ إِلَى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِىْ هِىَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيْلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ

‘আপনি মানুষকে আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন সর্বোত্তম পন্থায়। কোন্ ব্যক্তি আল্লাহর পথ ছেড়ে বিপথগামী হয়, সে সম্পর্কে আপনার প্রতিপালক অধিক অবহিত এবং কে হেদায়াতের পথে আছে সে সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত’ (আন-নাহল : ১২৫)।

উক্ত আয়াতেও আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দাওয়াতের মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন। প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে দাওয়াত দেয়া এবং সর্বোত্তম পন্থায় বিতর্ক করা। দাঈর কর্তব্য দাওয়াত পেশ করা। হিদায়াত দেয়ার বিষয়টি আল্লাহর ইখতিয়ার। মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য দাঈদেরকে নিম্নোক্তভাবে আহ্বান করেছেন,

فاقول لإخوانى من شباب الصحوة الإسلامية إذا كنا نريد أن نوقظ الأمة الإسلامية من رقدتها ومن غفلتها فإنه يجب علينا أن نسير بخطط ثابتة و على أسس راسحة لأننا نريد أن يكون الحكم لله ونريد أن يثبت دين الله فى الأرض على عباد الله وهذه غاية عظيمة

‘ইসলামী জাগরণ প্রত্যাশী যুবকদের বলব, আমরা যদি মুসলিম উম্মাহকে তার নিদ্রা ও অলসতা থেকে জাগাতে চাই, তবে আমাদেরকে স্থায়ী পরিকল্পনা ও দৃঢ় ভিত্তির উপর চলতে হবে। কারণ আমরা চাই আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত হোক এবং চাই আল্লাহর দ্বীন পৃথিবীতে স্থায়ী হোক। আর এটা মহান লক্ষ্য’।[১৪]

এই সমস্ত মূলনীতির মাধ্যমে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ একজন দাঈ হিসাবে ভূষিত করেছেন। আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيْرًا- وَدَاعِيًا إِلَى اللهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيْرًا

‘হে নবী! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসাবে। এছাড়া তাঁর নির্দেশে তাঁর দিকে আহ্বানকারী হিসাবে এবং উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে’ (আল-আহযাব : ৪৫-৪৬)।

অতএব ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য বাস্তবসম্মত আধুনিক মূলনীতি প্রণয়নের বিকল্প নেই। আর এই মূলনীতি বাস্তবায়নের জন্য দরকার গভীর জ্ঞানের অধিকারী দক্ষ দাঈদের শক্তিশালী কাফেলা, যাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হবে দাওয়াত।

দাওয়াতের মূলনীতি সমূহ :
(এক) আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দাওয়াত পেশ করা :
দাওয়াতের অন্যতম মূলনীতি হল, কেবল আল্লাহর বিধান মানুষের সামনে পেশ করা। অন্য কোন মতবাদ, আইন বা আদর্শের দিকে আহ্বান জানানো যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিয়ে বলেন,

يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللهِ لَا يَهْدِى الْقَوْمَ الْكَافِرِيْنَ

‘হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, আপনি তা পৌঁছে দিন। আর যদি এরূপ না করেন, তবে আপনি আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাননি বলে বিবেচিত হবে। আর আল্লাহ আপনাকে মানুষের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হেদায়াত দান করেন না’ (আল-মায়িদাহ : ৬৭)। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শও আল্লাহর বিধান। তাই হাদীছের ভা-ারকে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে পেশ করার তাকীদ এসেছে।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَلِّغُوْا عَنِّىْ وَلَوْ آيَةً وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِىْ إِسْرَائِيْلَ وَلاَحَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

‘আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘একটি আয়াত (কথা) হলেও তোমরা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও। আর বাণী ইসরাঈলদের সম্পর্কেও বর্ণনা কর, তাতে সমস্যা নেই। তবে কেউ যদি আমার উপর ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করে, তাহলে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে বানিয়ে নেয়’।[১৫]

(দুই) সর্বাগ্রে তাওহীদী আক্বীদার দাওয়াত দেয়া :
নবী-রাসূলগণ তাঁদের উম্মতদেরকে সর্বপ্রথম দাওয়াত দিয়েছেন তাওহীদের। কারণ তাওহীদ হল দ্বীনের মূল ভিত্তি। আর ভিত্তি বিহীন কোনকিছুই প্রতিষ্ঠিত হয় না। আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُوْلٍ إِلَّا نُوْحِىْ إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُوْنِ ‘আমরা আপনার পূর্বে যে রাসূলকেই প্রেরণ করেছি, তাঁর কাছেই অহি করেছি যে, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা একমাত্র আমারই ইবাদত কর’ (আল-আম্বিয়া : ২৫)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِىْ كُلِّ أُمَّةٍ رَسُوْلًا أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ ‘আমরা প্রত্যেক উম্মতের মাঝে রাসূল পাঠিয়েছি এই জন্য যে, তারা যেন নির্দেশ দেন- তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূতকে বর্জন কর’ (আন-নাহল : ৩৬)। নিম্নের হাদীছটি থেকেও সর্বাগ্রে তাওহীদের দাওয়াতের কথাই প্রমাণিত হয়-

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ইয়ামানে পাঠালেন, তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ। সুতরাং তাদেরকে প্রথম আহ্বান করবে, তারা যেন আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদকে মেনে নেয়। যদি তারা তা স্বীকার করে, তবে তাদেরকে বলবে, আল্লাহ তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতকে ফরয করেছেন। তারা যদি ছালাত আদায় করে, তবে তাদেরকে জানাবে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা ধনীদের নিকট থেকে আদায় করা হবে এবং গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হবে। তারা যদি এটা মেনে নেয়, তাহলে তাদের নিকট থেকে তা গ্রহণ করবে। তবে মানুষের সম্পদের মূল্যের ব্যাপারে সাবধান থাকবে।[১৬]

(তিন) সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ উভয় ধারা প্রতিষ্ঠিত রাখা :
সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ দাওয়াতী কাজের একটি বিশেষ মূলনীতি। আল্লাহ এই দু’টি দায়িত্বকে এক সংগে উল্লেখ করেছেন। তাই দু’টি ধারাকে একই সংগে পরিচালনা করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ

‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি শ্রেণী থাকা উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং ভাল কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজে নিষেধ করবে। আর তারাই হবে সফলকাম’। তোমরা তাদের মত হয়ো না, যাদের নিকট প্রকাশ্য দলীল আসার পরও বিভক্ত হয়েছে ও মতানৈক্য করেছে। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (আলে ইমরান : ১০৪-১০৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ

‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত। তোমাদের উত্থান ঘটান হয়েছে মানবজাতির জন্য। তোমরা ভাল কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে’ (আলে ইমরান : ১১০)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ حُذَيْفَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوشِكَنَّ اللهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِنْ عِنْدِهِ ثُمَّ لَتَدْعُنَّهُ وَلَا يُسْتَجَاب لكم

হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ঐ আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে! তোমরা অবশ্যই অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করবে, তাছাড়া অচিরেই আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন। তখন তোমরা তাঁর নিকট দু‘আ করবে, কিন্তু আল্লাহ তোমাদের দু‘আ কবুল করবেন না’।[১৭]

(চার) দলীলভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করে দাওয়াতী কাজ করা :
দাঈ যে বিষয়ে মানুষকে দাওয়াত দিবেন, সে বিষয়ে দলীলভিত্তিক জ্ঞান থাকা তার জন্য আবশ্যক। অন্যথা নিজেও পথভ্রষ্ট হবেন, অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবেন। আল্লাহ বলেন, فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ ‘জেনে রাখুন যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই’ (সূরা মুহাম্মাদ : ১৯)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হি.) বলেন, اَلْعِلْمُ قَبْلَ الْقَوْلِ وَالْعَمَلِ ‘কথা বলা ও আমল করার পূর্বেই জ্ঞানার্জন করা’।[১৮] অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে আপনার জ্ঞান নেই, অনুমান করে সে বিষয়ে পরিচালিত হবেন না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে’ (সূরা বাণী ইসরাঈল : ৩৬)। অন্য আয়াতে এসেছে,

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوْحِىْ إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ. وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ

‘আপনার পূর্বে আমি অনেক ব্যক্তিকে প্রেরণ করেছিলাম। আমি তাদের নিকট অহি প্রেরণ করেছি যে, তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর। নাযিল করেছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন ও গ্রন্থ সমূহ। আপনার প্রতি যিকির নাযিল করেছি, মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। যাতে তারা চিন্তা করে’ (সূরা আন-নাহল : ৪৩-৪৪)।

দ্বীনের পূর্ণজ্ঞান ও বুঝ না থাকলে সৎকাজ কী, আর অন্যায় কাজ কী তা জানা যাবে না। অনেকে সঠিক জ্ঞানের অভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ বুঝার ক্ষেত্রে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং ছাহাবায়ে কেরাম যেভাবে বুঝেছেন, তার বিপরীত বুঝেন। তাই দলীলভিত্তিক দ্বীনের গভীর জ্ঞান লাভ করা সৌভাগ্যের প্রতীক। কারণ আল্লাহ ঐ ব্যক্তির কল্যাণ চান। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّيْنِ ‘মহান আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের বুঝ দান করেন’।[১৯]

যখন কোন ব্যক্তির দাওয়াতের মজলিসে দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য মানুষ সমবেত হবে, তখন বুঝতে হবে আল্লাহ ঐ ব্যক্তির কল্যাণ চান। তখন ঐ দাঈর উপর জরুরী কর্তব্য হল, এই দাওয়াতকে শক্ত করে আঁকড়ে থাকা এবং তাঁর ইলমী গবেষণাকে আরো গভীর করা। এক্ষেত্রে কোনভাবেই যেন তার বিরক্তি ও দুর্বলতা প্রকাশ না পায়। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য একটি হাদীছে বলেন,مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَلْتَمِسُ فِيْهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيْقًا إِلَى الْجَنَّةِ ‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণ করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন’।[২০]

দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম কুরআনুল কারীম। কারণ কুরআনই ইলমের মূল উৎস। এটি সৎকাজের দিকে আহ্বান ও অসৎকাজ থেকে বারণের উত্তম কৌশল। এর মধ্যেই পথ-নির্দেশনা ও আলোকরশ্মি রয়েছে। আল্লাহ বলেন, إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ ‘এই কুরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,

كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ

‘এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসাবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানরা যেন তা অনুধাবন করে’ (সূরা ছোয়াদ : ২৯)। তিনি আরো বলেন, أَفَلَا يَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوْبٍ أَقْفَالُهَا  ‘তারা কি কুরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’ (সূরা মুহাম্মাদ : ২৪)। ড. ইসরার আহমাদ বলেন,

“It would be essential for them to study the Holy Qur’an, the last and most comprehensive Divine Revelation, in order to discover its truths.” [২১]

‘আর তাদের (তরুণদের) জন্য আবশ্যক হল, সত্য উদঘাটনের জন্য সর্বাধিক বিষয় ও তথ্য সম্বলিত স্বর্গীয় ওহী পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করা’।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

তথ্যসূত্র : 
[১]. ইমাম আবু মুহাম্মাদ আলী ইবনু আহমাদ ইবনু সাঈদ ইবনু হাযাম, আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ১ম খণ্ড (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খৃ.), পৃ. ১৩৩।
[২]. সুলায়মান বিন আশ‘আছ আবুদাঊদ আস-সিজিস্তানী আল-আযদী, সুনানু আবী দাঊদ (রিয়ায : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১৯৯৮ খৃ./১৪১৯ হি.), পৃ. ২৯, হাদীছ সংখ্যা-১৪৫, সনদ ছহীহ।
[৩]. সুনানু আবী দাঊদ, পৃ. ৪৩, হা/২২৬, সনদ ছহীহ।
[৪]. সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী, অনুবাদ : মাওলানা ওবাইদুল হক, মুসলিম বিশ্বে ইসলামী আদর্শ ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জুন ২০০৪ খৃ.), পৃ. ৯৪।
[৫]. Sir Muhammad Iqbal, The Reconstruction of Islamic Thought in Islam (New Delhi : Kitab Bhavan, 2012 AD), preface, p. v.
[৬]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৩।
[৭]. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু ওমর ইবনু কাছীর আল-ক্বারশী আদ-দিমাষ্কী, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৪র্থ খণ্ড (বৈরুত : দারুল কিতাব আল-‘আরাবী, ২০১১ খৃ.), পৃ. ৫৫৪।
[৮]. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ৬১৫, হা/৪৮৩৭।
[৯]. আবুল ফিদা আল-হাফেয ইবনু কাছীর আদ-দিমাষ্কী, আল-বিদাইয়া ওয়ান নিহায়াহ, ৪র্থ খণ্ড, ৭ম অংশ (কায়রো : দারুল হাদীছ, ২০০৬ খৃ.), পৃ. ৫১।
[১০]. তদেব, ৪র্থ খণ্ড, ৭ম অংশ, পৃ. ৫১।
[১১]. মুহাম্মাদ ইবনু জারীর ইবনু ইয়াযীদ ইবনু কাছীর ইবনু গালিব আল-আমালী আবু জা‘ফর আত-ত্বাবারী, তারীখুল উমাম ওয়াল মুলূক, ২য় খণ্ড (বৈরুত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪০৭ হি.), পৃ. ৩৪৭।
[১২]. তদেব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৭।
[১৩]. ড. আব্দুল করীম যায়দান, উছূলুদ দাওয়াহ (বৈরুত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খৃ.), পৃ. ৪৭০।
[১৪]. আছ-ছাহওয়াতুল ইসলামিয়াহ : যাওয়াবিত ওয়া তাওজীহাত, পৃ. ৫২।
[১৫]. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ৪৩৬, হা/৩৪৬১; ‘নবীদের ঘটনাবলী’ অধ্যায়; মিশকাতুল মাছাবীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭০, হা/১৯৮, ‘ইলম’ অধ্যায়।
[১৬]. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ৯০০, হা/৭৩৭২, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ১; ছহীহ মুসলিম, পৃ. ২৩, হা/১৯।
[১৭]. সুনানুত তিরমিযী, পৃ. ৪৯০, হা/২১৬৯, ‘ফিতনা’ অধ্যায়।
[১৮]. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ২০, ‘ইলম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১০।
[১৯]. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ২১, হা/৭১; মিশকাতুল মাছাবীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭০, হা/২০০।
[২০]. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবুন ইয়াযীদ আল-ক্বাযবীনী ইবনু মাজাহ, সুনানু ইবনে মাজাহ (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১৪২৯ হি./২০০৮ খৃ.), পৃ. ৫৬, হা/২২৩; সুনানুত তিরমিযী, পৃ. ৫৯৬, হা/২৬৪৬, সনদ ছহীহ।
[২১]. Dr. Israr Ahmad, ISLAMIC RENAISSANCE : THE REAL TASK AHEAD (Lahore : MARKAZI ANJUMAN KHUDDAM-UL-QUR’AN, 2001), p. 24.




প্রসঙ্গসমূহ »: মুসলিম জাহান
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
যাকাত বণ্টনে সমস্যা ও সমাধান - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামে ব্যবসায়িক মূলনীতি - ছাদীক মাহমূদ
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
আল-কুরআন এক জীবন্ত মু‘জিযা - আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
বিদ‘আত পরিচিতি (৮ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৫ম কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
হজ্জ মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব সম্মেলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

ফেসবুক পেজ