বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৪ অপরাহ্ন

দুর্নীতি হ্রাসে শিক্ষার ভূমিকা

-মোঃ শফিকুল ইসলাম*


ভূমিকা

আমাদের সমাজে যেসব সামাজিক সমস্যা সর্বত্র মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করে চলেছে দুর্নীতি তাদের মধ্যে অন্যতম। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে থানা দুর্নীতির কালো থাবায় বিপন্ন আজ মানব সভ্যতা। এ সর্বনাশা ব্যাধির মরণ ছোবলে বর্তমান সমাজ র্জজরিত। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য সর্বত্রই চলছে দুর্নীতি। দুর্নীতির করাল গ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ হয়ে উঠছে অনিশ্চিত ও অনুজ্জ্বল। গুরুত্বপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজের একজন সাধারণ নাগরিকের মুখে প্রায়ই দুর্নীতির অভিযোগ ও উদাহরণ শোনা যায়। দুর্নীতির অনেক রিপোর্ট বাংলাদেশের মিডিয়া, সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে সমগ্র বিশ্বে পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে শীর্ষ হয়েছে; যা দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করার পাশাাপাশি জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের সমাজে দুর্নীতি এতই ব্যাপকতা  লাভ করেছে যে, অনিয়মই যেন নিয়ম, দুর্নীতি যেন নীতি হয়ে দাড়িয়েছে। আর্থ-সামাজিক এবং প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে দুর্নীতি এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, দুর্নীতি যেন অনেকের জীবন প্রণালীর অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুর্নীতির ধারণা

দুর্নীতি একটি ব্যাপক ও জটিল ধারণা। দুর্নীতির গতি-প্রকৃতি বহুমুখী এবং বিচিত্র বলে এর সংজ্ঞা নিরুপণ জটিল কাজ। দুর্নীতি সমাজে প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থি তথা অপরাধমূলক আচরণ। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সাধারণত ঘুষ, বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব  এবং ব্যক্তিবিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গণপ্রশাসনের ক্ষমতা অপব্যবহারের দ্বারা ব্যক্তিগত সুবিধা নেয়াকে দুর্নীতি বলা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণাসুচক অনুযায়ী- দুর্নীতি হচ্ছে ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ গ্রহণ ও প্রদান, সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে মুনাফা লাভ, সরকারি সম্পত্তির আত্মসাৎ ইত্যাদি অন্তর্র্ভূক্ত। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক দুর্নীতির কোন পার্থক্য করা হয় না।

দুর্নীতির সংজ্ঞা

Robert L. Barkdr তার 'The Social Dictionary' গ্রন্থে বলেন, Corruption is in political and public service administration, the above office for  personal gain, usually through bribery, extortion, influence sedding and special treatment given to some citizens and not to others- অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সরকারি প্রশাসনে দুর্নীতি বলতে অফিসকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য অপব্যবহার করাকে নির্দেশ করে। সাধারণতঃ ঘুষ, বল প্রয়োগ বা ভয় প্রদর্শন, প্রভাব এবং ব্যক্তিবিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গণপ্রশাসনের ক্ষমতা অপব্যবহারের দ্বারা ব্যক্তিগত সুবিধা নেয়াকে দুর্নীতি বলা হয়।

Ram Nath Sharma তার 'Indian Social Problems' গ্রন্থে বলেন, In corruption a person willfully neglected his specified duty in order to have an undue advantage.  -অর্থাৎ অবৈধ সুযোগ সুবিধা লাভের জন্য কোন ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত অবহেলাই হল দুর্নীতি।

বাংলাদেশের দুর্নীতির ধরন ও ব্যাপকতা

বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি আমাদের সমাজে বিদ্যমান। দুর্নীতির প্রধান কয়েকটি ধরন হল- ঘুষ, অবৈধ উপায়ে সুবিধা লাভ, চাঁদাবাজি, সরকারি কোষাগার থেকে চুরি-ডাকাতি, অবৈধ পৃষ্ঠপোষকতা, স্বজনপ্রীতি, অবৈধভাবে চাকরি প্রদান, অর্থ আত্মসাৎ, কাউকে সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে অর্থ বা অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ, অবৈধভাবে কোন কিছু ভোগ দখল। বর্তমান বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় সবক্ষেত্রে এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। দুর্নীতি বিষয়ক জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণাসূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ পাঁচবার (২০০১-২০০৫) পরপর শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসোবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে একদিনে দুর্নীতি এ অবস্থানে আসেনি। ক্রমান্বয়ে এর শাখা- প্রশাখা ছড়িয়ে বিশাল মহীরুহ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যার শিকড় বহু গভীরে বিস্তৃত হয়ে দৃঢ়তা লাভ করেছে।

শিক্ষা সংজ্ঞা

শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসাবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সকল গুণাবলী ও দক্ষতা প্রয়োজন তা অর্জনে সহায়তা করা হয়। শিক্ষা অর্জনের দ্বারা ব্যক্তি তার আচরণের স্থায়ী ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়ন করতে পারে। ফলে প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে সকল ধরনের অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে দুরে রাখে।

বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণ ও তা প্রতিরোধে শিক্ষার ভুমিকা

দুর্নীতির কারণ অনেক। কোন ব্যক্তি এক বা একাধিক কারণেই দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে। বাংলাদেশে দুর্নীতিমূলক কাজ ও আচরণের জন্য যেসব সাধারণ কারণকে দায়ী করা যায় সেগুলো এবং সেগুলো প্রতিরোধে শিক্ষার ভুমিকা নি¤েœ আলোচনা করা হল।

১. আর্থিক অনটন : আর্থিক অনটন দুর্নীতির অন্যতম কারণ। দারিদ্র কবলিত বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র স্বল্প আয়ের কিছু ব্যক্তি আর্থিক অনটনে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত স্বল্প আয়ের যেসব ব্যক্তি অন্য কাউকে কোন কাজে অবৈধভাবে সহায়তা করে বা নীতি ও আইনের পরিপন্থি এমন কাজের বিনিময়ে বকশিশ, চা-পান বা মিষ্টি খাওয়ানোর নামে অর্থ গ্রহণ করে সেটাকে প্রকারন্তে ঘুষ গ্রহণই বলা চলে। বিষয়টি অন্যভাবেও দেখা যায়। আর্থিক অনটনের শিকার এমন ব্যক্তির হাতে যে ক্ষমতা রয়েছে সেটাকে এক শ্রেণীর মানুষ সহজেই ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে অপব্যবহার করে থাকে। এই সমস্যা সমাধানে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। আর্থিক অভাব অনটন দুর করণে বিভিন্ন কারিগরি, পশু পালন ও সবজি চাষ শিক্ষা বহুল অবদান রাখতে পারে।

২. অতিশয় উচ্চাভিলাষী মন-মানসিকতা : উচ্চাভিলাষী হওয়া অবশ্য খারাপ কোন কাজ নয়। তবে, সমাজে এমন লোকের অভাব নেই যারা উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার মানসে অবৈধ উপায় বা পন্থার আশ্রয় নেয়। এ শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে রাতারাতি সমাজে আর্থ-সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। এরা আর্থিক অনটনের কারণে নয় বরং স্বল্প সময়ের মধ্যে ধনী থেকে আরো ধনী হবার সহজ পন্থা খোঁজে। সেটা বৈধ কি অবৈধ, নীতিসম্মত কি নীতি সম্মত নয় সেটা নিয়ে এরা খুব বেশি চিন্তা-ভাবনা করে না। এই অতিশয় উচ্চাভিলাষ তথা অতিশয় সাধ মেটানোর সাধ নেই অধিকাংশরই। এমন অবস্থায় কিছু লোক নানা ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। এরা দেশের অর্থ-সম্পদ ও সুযোগ সুবিধা অবৈধভাবে আত্মসাৎ করাসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ পন্থায় ভাগ্য গড়ার কাজে নিয়োজিত। প্রকৃত শিক্ষাই পারে মানুষকে অবৈধভাবে তার উচ্চাভিলাস হতে বিরত রাখতে।

৩. কর্মসংস্থানের অভাব : দেশে বেকারত্বের হার ক্রমেই  আশংকাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। সরকারি প্রতিষ্টানগুলোতে গত কয়েকবছর যাবৎ চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। যেসব চাকরি পেলে চাকরিজীবি নিজেও ভবিষ্যতে ঘুষ গ্রহণের সুযোগ পাবেন অর্থাৎ যেখানে জনগনের সঙ্গে মোটা অংকের আর্থিক লেনদেনের প্রশ্ন জড়িত, সেসব চাকরির ক্ষেত্রে মোটা অংকের ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এর অর্থ এই যে, বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে কেউবা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করত, আবার কেউবা বেকারত্ব ঘুচাতে বাধ্য হছেন ঘুষ প্রদান করছে। কর্মসংস্থানের অভাব দূর করতে দেশে বিভিন্ন কলকারখানা তৈরি করে বেকারদের কারিগরি শিক্ষা প্রদান করতে হবে।

৪. আর্থ-সামাজিক মর্যাদা অর্জনে প্রতিযোগিতা : দুর্নীতির অন্যতম কারণ হল আর্থ-সামাজিক মর্যাদা অর্জনের প্রতিযোগিতা। সীমিত আয়ের চাকরিজীবি, ব্যবসায়ী বা অন্য কোন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের অনেকেই এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। খাদ্য গ্রহণ থেকে শুরু করে পোশাক পরিচ্ছদ, বাসা-বাড়ি, ইত্যাদির মান এবং পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যেমন, জন্মদিন, খাতনা, বিবাহ ইত্যাদির ক্ষেত্রে কে কতটা ব্যয় করে, কে কিভাবে কতটা আড়ম্বরপূর্ণ ও বিলাস জীবন কাটাতে পারে সমাজে তার সরব ও নীরব প্রতিযোগীতা অহরহই লক্ষ্য করা যায়। একইভাবে পরিবর্তিত ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করা যায়। সীমিত ও সৎ আয় দ্বারা এভাবে সামাজিক মর্যাদা আনয়নের প্রতিযোগিতায় নামা প্রায় অসম্ভব। এমতাবস্থায় কখনও সামাজিক চাহিদা মেটাতে কেউ কেউ দুর্নীতির পথে অগ্রসর হয়। একারণেই অনেক সীমিত আয়ের লোকের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সম্পর্ক দেখা যায় না। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে অহংকার থেকে বিরত রাখতে পারে এবং এভাবে দুর্নীতি কমাতে পারে।

৫. ভেজাল দ্রব্য : ভেজাল দ্রব্য বর্তমানে বাজারে সয়লাব হয়ে আছে। যা ক্রয় করে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে এবং ভোক্তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বস্তুতঃ এসব কাজে যারা জড়িত তারা আতœঘাতী প্রয়াসেই লিপ্ত। কেননা, খাদ্যে ভেজালদাতা ঔষধে ভেজাল দাতার কুকীর্তির শিকার হচ্ছে। এভাবে ভেজালদাতারাও পরষ্পরকে ঠকাচ্ছে। সাধারণ মানুষ আজ সামগ্রিকভাবে ভেজালে স্বীকার। মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করে ভেজাল দ্রব্য বর্জন করতে প্রকৃত শিক্ষা সাহায্য করে থাকে।

৬. সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের অভাব : সমাজে দুর্নীতিমূলক কাজের সাথে যারা জড়িত তারা নানাভাবে সংগঠিত। এদের সনাক্ত করা কঠিন এবং এদের বিরুদ্ধে তেমন সুস্পষ্ট অভিযোগও কেউ করে না। জেনে  শুনে কেউ সবাই যেন বিষয়টাকে হজম করে চলেছেন। কদাচিৎ কখনও যদি পত্র পক্রিকায় দু’একটি অভিযোগ দেখা যায় তথাপি তার তদন্ত কি হল, বিচারে কি শাস্তি হল সেটা আমরা আর জানতে পায় না, অনেক ক্ষেত্রে এক তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানা গেলেও তার রিপোর্ট প্রকাশিত হতে যেমন বিলম্ব হয়, তেমনি সে রিপোর্টের বিষয় জানা সম্ভব হয় না। বস্তুতঃ  দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব হেতু দুর্নীতি আরো সংক্রামক ব্যাধির মত বেড়েই চলেছে। সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচার করতে স্বজনপ্রীতি পরিহার করতে হলে খাঁটি বিচারক হতে হবে। আর শিক্ষাই মানুষকে খাঁটি মানুষ বানায়।

৭. আইনের ফাঁকফোকড় : অনেকে আইনের ফাঁক-ফোকড়ের সুযোগ নিয়ে অথবা জালিয়াতির মাধ্যমে শাস্তি এড়িয়ে যাবার কৌশল সৃষ্টি করে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ কখনোই জালিয়াতির জন্য আইনের ফাঁকফোকড় খোজ করবে না। তাই প্রত্যেক নাগরিককে প্রকৃত শিক্ষা দিতে হবে।

৮. ক্ষমতা ও দুর্নীতির মনগড়া ব্যাখ্যা : সমাজে এমন কিছূ ব্যক্তি আছে যারা ঘুষ লেন দেন, স্বজনপ্রীতি বা অন্যান্যা দুর্নীতিমূলক কাজের মনগড়া ব্যাখ্যা দাড় করায় এবং  ওটা যে দুর্নীতি নয় সেটাই প্রমাণ করতে চায়। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে বিভিন্ন খারাপ উদ্দেশ্য হাসিলে মনগড়া ব্যাখা থেকে দুরে রাখে।

৯. মূলবোধের অবক্ষয় : মূল্যবোধের অবক্ষয় দূর্নীতির অন্যতম কারণ। সামাজিক ন্যায়-নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ হল সমাজের চালিকা শক্তি। সমাজবদ্ধ মানুষ এসব মূল্যবোধের উপর আস্থাশীল হয়ে পারস্পরিক সর্ম্পকের ভিত্তিতে গড়ে তোলে সমাজ। ব্যক্তি যদি তার সংকীর্ণ স্বার্থ ও  লোভ লালসার ঊর্ধ্বে উঠে সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা গ্রহণ না করে তাহলেই সে দুর্নীতি পরায়ণ হয়ে পড়ে। তাই সবার মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। আর এতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।

১০. রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা : বাংলাদেশের অন্যান্য বহুবিদ সমস্যার মত দুর্নীতিও সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ফসল। রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার তীব্র আকাঙ্খা দুর্নীতি বিস্তারে অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করে দুর্নীতি দমাতে সাহায্য করতে পারে।

১১. আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব : সব দেশেই দুর্নীতি বা সমাজবিরোধী কার্যকলাপের জন্য আইনগত শাস্তির বিধান বলবৎ রয়েছে। দুর্নীতি বিরোধী আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে আমাদের দেশে দুর্নীতি প্রসারিত হচ্ছে। তাই শিক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগে সাহায্য করে থাকে।

১২. দুর্নীতি দমন কমিশন সরকারি নিয়ন্ত্রণযুক্ত : বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ ধরনের সমস্যা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমাধান করা কঠিন। এদেশে দুর্নীতি দমনের লক্ষে  ২০০৪ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বহুল আলোচিত ও প্রতিক্ষিত স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তা কার্যকরভাবে দুর্নীতি দমন  করতে পারেনি বা পারছে না। দুর্নীতি দমনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দুর্নীতি দমনের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা চাই। এজন্যে কমিশনকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। আর এর জন্য সকলের মধ্যে শিক্ষার আলো থাকতে হবে।

১৩. দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিকদের শাস্তি প্রদানে ব্যর্থতা : আমাদের দেশে একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করে। দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিকরা যেন রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা দরকার। জনস্বার্থেই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের শাস্তি হওয়া উচিত এবং তাঁদের রাজনীতি থেকে নির্বাসন দেয়া উচিত। তাঁরা যদি কোনক্রমে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ছাড়া পেয়ে যান, তাহলে তাঁরা আবারও জনগনের দুর্ভোগের কারণ হবেন এবং সেটা আরও ভয়ংকর হবে। শিক্ষানীতির প্রয়োগ বাধ্যতামূলক।

১৪. দুনীতি  প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনের অভাব : আমাদের দেশে সৎ ও মেধাবী সরকারি কর্মকর্তা আছেন। তাঁদের অনেকে প্রলোভন ও চাপ থাকা সত্ত্বেও সততা ও ন্যায়নীতি বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। এসব সরকারি কর্মকর্তা এবং সমাজের সুশীল শ্রেণীর লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়তে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ কোন প্রকার দুর্নীতির সঙ্গে  জড়িত নয়। তাই সর্বস্তরে যেসব শুভবুদ্ধির  লোকজন আছেন তাদের একত্রিত করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর শিক্ষাই পারে সকলের মধ্যে আন্দোলনের মনোভাব গড়ে তুলতে।

১৫. দেশপ্রেমের অভাব : দেশ প্রেম ব্যতিত কোন দেশ উন্নত হয় না। দেশপ্রেমের অভাবে মানুষ বিভিন্ন দুর্নীতি করে থাকে। তাই শিক্ষাই পারে মানুষের মধ্যে দেশ প্রেম জাগ্রত করতে।

১৬. সরকারি প্রশাসন যন্ত্রগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা : বাংলাদেশে দুর্নীতির অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারি প্রশাসন যন্ত্রগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা। একটি শিক্ষিত সমাজই এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

১৭. স্বচ্ছতা  ও জবাবদিহিতার অভাব : দেশের প্রত্যেকটি সেক্টরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে যা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করেছে। তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। আর শিক্ষাই পারে মানুষের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মনোভাব জাগ্রত করতে।

১৮. ধর্মীয় বিশ্বাসকে উজ্জীবিত করা : দুর্নীতি দমনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল ধর্মীয় শিক্ষা। মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসকে উজ্জীবিত করতে হবে। যা মানুষের দুর্নীতি দমনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। 

উপসংহার

দুর্নীতি যেকোন দেশের জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। তাই দুর্নীতি থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সর্বত্র সততার আবহ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিমন্ডল। দূর্নীতি রোধে নাগারিক সমাজ, বিশেষ করে তরুণদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে তরুণরা সবসময় সোচ্চার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে নিঃস্বার্থ ও দুঃসাহসী তারুণ্যের বলিষ্ঠ ভূমিকার কোন বিকল্প নেই। আর প্রকৃত শিক্ষা তরুণদের মধ্যে মূল্যবোধ, দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। (সংগৃহীত : ১. ইন্টারনেট; ২. নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা; ৩. মোহাম্মাদ মুজিবুর রহমান, শিক্ষার দার্শনিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি; ৪. আমেজ উদ্দীন, শিক্ষাদর্শন)।

* প্রভাষক, ইংরেজী বিভাগ, লালপুর মডেল কলেজ, তানোর, রাজশাহী।




প্রসঙ্গসমূহ »: শিক্ষাব্যবস্থা
আত্মহত্যাকারীর শারঈ বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলামী সংগঠন ও তরুণ-যুবক-ছাত্র - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ইসলামে পর্দার বিধান (শেষ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলো ও অন্ধকার (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ১১ রাক‘আতের নির্দেশ দিয়েছিলেন - ব্রাদার রাহুল হোসেন (রুহুল আমিন)
সুন্নাতের রূপরেখা (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির কারণ ও উত্তরণের উপায় (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
মহামারী থেকে বেঁচে থাকার দশটি উপদেশ - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : মুহাম্মদ ইমরান বিন ইদরিস

ফেসবুক পেজ