বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৬ অপরাহ্ন

মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ

-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*


(৭ম কিস্তি) 

আক্বীদা-৩ : আল্লাহর কথা

মাতুরীদীরা আল্লাহর কথা বলাকে অস্বীকার করে। তারা যুক্তি পেশ করে যে, যদি আল্লাহ কথা বলে, তাহলে আল্লাহর কথা বলার জন্য জিহ্বা, মুখ, ঠোঁট, দাঁতের প্রয়োজন। এ কারণে তারা আল্লাহর কথা বলাকে অপব্যাখ্যা করে। তারা বলে, আল্লাহর কালাম আল্লাহ সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত বা আল্লাহ সত্তার সাথে যুক্ত। আল্লাহর কালামের ব্যাপারে মাতুরীদী এবং মু‘তাযিলাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এ কারণে তারা আল্লাহর কথা শ্রবণ করাকে অস্বীকার করে।[১]

তারা বলে, আল্লাহর কথা শুনতে পাওয়া যায় না। তারা আল্লাহর কথাকে এভাবে ব্যাখ্যা করে যে, আল্লাহর কথার অর্থ হল অবহিত করা বা জ্ঞাত করা। যেমনভাবে তিনি আমাদেরকে তাঁর কুদরাত ও রুবূবিয়্যাহ সম্পর্কে অবহিত করেছেন। আর এটা জ্ঞাত বিষয় যে, أن قدرة الله تعالي وربوبيته من المعلومات لا من المسموعات ‘আল্লাহর কুদরাত ও রুবূবিয়্যাহ জ্ঞাত বিষয়সমূহ। শ্রবণযোগ্য বিষয় নয়’।[২]

জাহমিয়্যাহ, মুরজিয়া, রাফিযী, মু‘তাযিলা এবং ক্বাদারিয়্যারাও আল্লাহর কথা বলাকে অস্বীকার করে।[৩] সর্বপ্রথম ‘জা‘দ ইবনু দিরহাম’ এ বিদ‘আতী কথার প্রচলন করেন। পরবর্তীতে তার নিকট হতে ‘জাহম ইবনু ছাফওয়ান’ তা গ্রহণ করেন। তিনি এ কথা প্রচার ও প্রসার করেন এবং এর উপর বিতর্কও করেন। জাহম ইবনু ছাফওয়ানের নিকট থেকে জাহমিয়্যারা এ মত গ্রহণ করেন। জাহমিয়্যাদের নিকট হতে মু‘তাযিলা অনুসারী ‘আমর ইবনু ‘ঊবাইদ এ আক্বীদা গ্রহণ করে এবং সে খলীফা মামুনের সময় এ আক্বীদা প্রকাশ করে। প্রকৃতপক্ষে এ আক্বীদা মুশরিক এবং ছাবিয়ীদের নিকট হতে গ্রহণ করা হয়েছে। তারা আল্লাহর কথা বলাকে অস্বীকার করে।[৪]

পর্যালোচনা

মাতুরীদীদের এই আক্বীদা বাতিল এবং স্পষ্ট বিদ‘আত। তাদের এই আক্বীদা কুরআন, সুন্নাহ এবং সালাফদের আক্বীদার বিপরীত। কেননা ধরন ও প্রকৃতির দিক থেকে কথা বলা আল্লাহর যাতী গুণ এবং প্রত্যেক কথার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি কার্যগত গুণ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যখন ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা শ্রুত বাক্য দ্বারা কথা বলেন। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হল, আল্লাহ কথা বলেন, কথা ব্যক্ত করেন, আহ্বান করেন। তিনি শব্দ এবং হরফের মাধ্যমে কথা বলেন। আল-কুরআন হল তাঁরই কথা।[৫] হাফিয তাক্বীউদ্দীন আব্দুল গনী ইবনু আব্দুল ওয়াহেদ আল-মাক্বদিসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আহলুল হক্ক-এর মাযহাব হল, أن الله عز وجل لم يزل متكلما بكلام مسموع، مفهوم، مكتوب ‘নিশ্চয় মহান আল্লাহ শ্রবণযোগ্য, বোধগম্য এবং লিখিত শব্দে কথা বলেন। মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে সরাসরি কথা বলেছেন’ (সূরা আন-নিসা : ১৬৪)।[৬] কথা বলার এ গুণটির উপর কুরআন ও সুন্নাহর বহু দলীল রয়েছে। মহান আল্লাহ কোন মাধ্যম ছাড়াই মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে কথা বলেছেন। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) মহান আল্লাহর কথা শ্রবণ করেছেন। ফেরেশতা, রাসূলদের মধ্যে তিনি যাকে অনুমতি দিয়েছেন, তাঁদের সাথে কথা বলেছেন। তিনি ক্বিয়ামতের দিন মুমিনদের সাথে কথা বলবেন এবং মুমিনরাও তাঁর সাথে কথা বলবে।

মহান আল্লাহ মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে কথা বলেছেন

মহান আল্লাহ বলেন, وَ کَلَّمَ اللّٰہُ مُوۡسٰی تَکۡلِیۡمًا ‘আল্লাহ মূসার সাথে কথা বলেছেন ঠিক যেমনভাবে কথা বলা হয়’ (সূরা আন-নিসা : ১৬৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَمَّا جَآءَ مُوۡسٰی لِمِیۡقَاتِنَا وَ کَلَّمَہٗ رَبُّہٗ ۙ قَالَ رَبِّ اَرِنِیۡۤ  اَنۡظُرۡ اِلَیۡکَ ‘আর মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলেন এবং তাঁর রব্ব তাঁর সাথে কথা বললেন, তখন মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, হে আমার রব্ব! আমাকে দর্শন দান করুন, আমি আপনাকে দেখব’ (সূরা আল-‘আরাফ : ১৪৩)।

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন, আদম ও মূসা (আলাইহিস সালাম) বাদানুবাদ করেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) বলেন, হে আদম (আলাইহিস সালাম)! আপনি আমাদের পিতা। আপনি আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন এবং জান্নাত থেকে আমাদেরকে বের করেছেন। আদম (আলাইহিস সালাম) তাঁকে বললেন, يَا مُوْسَى اصْطَفَاكَ اللهُ بِكَلَامِهِ ‘হে মূসা! আল্লাহ আপনাকে তো নিজ কথার মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন’।[৭]

মহান আল্লাহ নবী-রাসূলদের সাথে কথা বলেছেন

মহান আল্লাহ অসংখ্য নবী-রাসূলদের সাথে কথা বলেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, تِلۡکَ الرُّسُلُ  فَضَّلۡنَا بَعۡضَہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ ۘ مِنۡہُمۡ مَّنۡ کَلَّمَ اللّٰہُ ‘এই সকল রাসূল, আমরা যাদের কারো উপর কাউকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছি, তাদের মধ্যে কারও সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫৩)। তিনি জান্নাতে আদম (আলাইহিস সালাম) ও হাওয়া (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে কথা বলেছেন। ইবলীস যখন তাঁদের উভয়কে প্রতারণা ও ছলনা দ্বারা নিষিদ্ধ গাছের স্বাদ গ্রহণ করাল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং জান্নাতের গাছের পাতা দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগলেন। সেই সময় মহান আল্লাহ তাঁদেরকে সম্বোধন করে বলেন, اَلَمۡ اَنۡہَکُمَا عَنۡ تِلۡکُمَا الشَّجَرَۃِ وَ اَقُلۡ لَّکُمَاۤ  اِنَّ الشَّیۡطٰنَ لَکُمَا عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ ‘আমি কি এ বৃক্ষ সম্পর্কে তোমাদেরকে নিষেধ করিনি? আর শয়তান যে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু তা কি আমি তোমাদেরকে বলিনি?’ (সূরা আল-‘আরাফ : ২২)।

মহান আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন বান্দাদের সাথে কথা বলবেন

আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন আদম সন্তানের সাথে কথা বলবেন। নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,

يَقُوْلُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَا آدَمُ فَيَقُوْلُ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ فَيُنَادَى بِصَوْتٍ إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكَ أَنْ تُخْرِجَ مِنْ ذُرِّيَّتِكَ بَعْثًا إِلَى النَّارِ

‘আল্লাহ তা‘আলা (ক্বিয়ামতের দিন) আদম (আলাইহিস সালাম)-কে বলবেন, হে আদম! আদম (আলাইহিস সালাম) জবাবে বলবেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকটে উপস্থিত, আপনার প্রতি আমি বহু ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অতঃপর আল্লাহ তাকে এ শব্দে (بِصَوْتٍ)[৮] ডাকবেন, আল্লাহ তোমাকে নির্দেশ করেছেন, তোমার সন্তানদের মধ্য থেকে জাহান্নামে পাঠানোর জন্য একটি দলকে তুমি বের কর।[৯] নবী করীম (ﷺ) আরো বলেছেন, مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا وَسَيُكَلِّمُهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَيْسَ بَيْنَ اللهِ وَبَيْنَهُ تُرْجُمَانٌ ‘ক্বিয়ামতের দিন তোমাদের প্রত্যেক লোকের সাথে আল্লাহ কথা বলবেন। আর সেদিন আল্লাহ ও বান্দার মাঝে কোন দোভাষী[১০] থাকবে না’।[১১] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেন, يَحْشُرُ اللهُ العِبَادَ، فَيُنَادِيْهِمْ بِصَوْتٍ يَسْمَعُهُ مَنْ بَعُدَ كَمَا يَسْمَعُهُ مَنْ قَرُبَ: أَنَا المَلِكُ، أَنَا الدَّيَّانُ ‘আল্লাহ সকল বান্দাকে হাশরে সমবেত করে এমন আওয়াজে ডাকবেন যে, নিকটবর্তীদের মত দূরবর্তীরাও শুনতে পাবে। আল্লাহ বলবেন আমিই মহা সম্রাট, আমিই প্রতিদানকারী’।[১২]

মহান আল্লাহ জান্নাতীদের সাথে কথা বলবেন

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِنَّ اللهَ تَعَالَى يَقُوْلُ لِأَهْلِ الْجَنَّةِ يَا أَهْلَ الْجَنَّةِ فَيَقُوْلُوْنَ لَبَّيْكَ رَبَّنَا وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ كُلُّهُ فِيْ يَدَيْكَ فَيَقُوْلُ هَلْ رَضِيْتُمْ؟ فَيَقُوْلُوْنَ وَمَا لَنَا لَا نَرْضَى يَا رَبِّ وَقَدْ أَعْطَيْتَنَا مَا لَمْ تُعْطِ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ؟ فَيَقُوْلُ أَلَا أُعْطِيْكُمْ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ؟ فَيَقُولُوْنَ يَا رَبِّ وَأَيُّ شَيْءٍ أَفْضَلُ مِنْ ذَلِكَ؟ فَيَقُوْلُ أُحِلُّ عَلَيْكُمْ رِضْوَانِيْ فَلَا أَسْخَطُ عَلَيْكُمْ بَعْدَهُ أَبَدًا

আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতবাসীগণকে লক্ষ্য করে বলবেন, হে জান্নাতবাসীগণ! তখন তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা উপস্থিত আপনার নিকট থেকেই সৌভাগ্য অর্জিত এবং যাবতীয় কল্যাণ আপনারই হাতে। তখন আল্লাহ বলবেন, তোমরা কি সন্তুষ্ট? তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা কেন সন্তুষ্ট হব না! আপনি তো আমাদের এমন জিনিস দান করেছেন, যা আপনার সৃষ্টি জগতের আর কাউকেই দান করেননি। তখন আল্লাহ বলবেন, আমি কি এর চেয়ে উত্তম জিনিস তোমাদেরকে দান করব না? তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! এর চেয়ে উত্তম কী হতে পারে? তখন আল্লাহ বলবেন, আমি তোমাদের উপর আমার সন্তুষ্টি দান করছি, এরপর থেকে আমি আর কখনও অসন্তুষ্ট হব না।[১৩]

জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পিতা আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে মহান আল্লাহ কথা বলেছেন

عَنْ جَابِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ لَقِيَنِيْ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فَقَالَ يَا جَابِرُ مَا لِيْ أَرَاكَ مُنْكَسِرًا قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ اسْتُشْهِدَ أَبِيْ قَتْلَ يَوْمِ أُحُدٍ وَتَرَكَ عِيَالًا وَدَيْنًا قَالَ أَفَلَا أُبَشِّرُكَ بِمَا لَقِيَ اللهَ بِهِ أَبَاكَ قُلْتُ بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ مَا كَلَّمَ اللهُ أَحَدًا قَطُّ إِلَّا مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ وَأَحْيَ أَبَاكَ فَكَلَّمَهُ كِفَاحًا فَقَالَ يَا عَبْدِيْ تَمَنَّ عَلَيَّ أُعْطِكَ قَالَ يَا رَبِّ تُحْيِيْنِيْ فَأُقْتَلُ فِيْكَ ثَانِيَةً قَالَ الرَّبُّ تَبَارَكَ وَتَعَالَى إِنَّهُ قَدْ سَبَقَ مِنِّيْ أَنَّهُمْ لَا يَرْجِعُوْنَ فَنَزَلَتْ " وَ لَا تَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ قُتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ اَمۡوَاتًا "

জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়, তখন তিনি বললেন, হে জাবির! কী ব্যাপার আমি তোমাকে চিন্তাযুক্ত দেখছি? আমি বললাম, আমার পিতা শহীদ হয়েছেন এবং রেখে গেছেন পরিবার-পরিজন ও ঋণ। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আমি কি তোমাকে এই সুসংবাদ দেব না যে, আল্লাহ তা‘আলা তোমার পিতার সাথে যে ব্যবহার করেছেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! হ্যাঁ। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা এ যাবৎ যার সাথেই কথাবার্তা বলেছেন, পর্দার আড়াল হতে বলেছেন। কিন্তÍ তিনি তোমার পিতাকে জীবিত করেছেন এবং তার সাথে সামনা-সামনি কথাবার্তা বলেছেন এবং আল্লাহ বলেছেন, হে আমার বান্দা! তোমার মনে যা ইচ্ছা তা আমার কাছে চাও, আমি তোমাকে তা প্রদান করব। তোমার পিতা বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জীবিত করে দেন, যাতে দ্বিতীয়বার আপনার রাস্তায় শহীদ হই। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা বললেন, আমার এই বিধান পূর্বেই সাব্যস্ত রয়েছে যে, একবার মৃত্যুর পর কোন ব্যক্তি পুনরায় দুনিয়াতে ফিরে আসবে না। অতঃপর কুরআনের এই আয়াত নাযিল হয়, وَ لَا تَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ قُتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ اَمۡوَاتًا ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে, তোমরা তাদেরকে মৃত মনে কর না’ (সূরা আলে ইমরান : ১৬৯)।[১৪]

মহান আল্লাহ আল-কুরআনে তাঁর কথাকে ‘কথা’ হিসাবে নামকরণ করেছেন

মহান আল্লাহ আল-কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় তাঁর কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেই কথাকে ‘কথা’ হিসাবেই নামকরণ করেছেন। তিনি তাঁর কথাকে সৃষ্ট বলেননি। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, فَتَلَقّٰۤی اٰدَمُ مِنۡ رَّبِّہٖ کَلِمٰتٍ  ‘অতঃপর আদম স্বীয় পালনকর্তার নিকট থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিলেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩৭)। মহান আল্লাহ বলেন, وَ قَدۡ کَانَ فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ یَسۡمَعُوۡنَ کَلٰمَ اللّٰہِ ‘তাদের মধ্যে একদল ছিল, যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৭৫)। মহান আল্লাহ মূসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে বলেন,قَالَ یٰمُوۡسٰۤی اِنِّی اصۡطَفَیۡتُکَ عَلَی النَّاسِ بِرِسٰلٰتِیۡ وَ بِکَلَامِیۡ ‘আমি তোমাকে আমার বার্তা পাঠানোর এবং কথা বলার মাধ্যমে লোকদের উপর বিশিষ্টতা দান করেছি’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৪৪)।

মহান আল্লাহ বলেন, یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یُّبَدِّلُوۡا کَلٰمَ  اللّٰہِ ‘তারা আল্লাহর কালাম পরিবর্তন করতে চায়’ (সূরা আল-ফাতহ : ১৫)। মহান আল্লাহ বলেন, قُلۡ لَّوۡ کَانَ الۡبَحۡرُ مِدَادًا لِّکَلِمٰتِ رَبِّیۡ لَنَفِدَ الۡبَحۡرُ  قَبۡلَ اَنۡ تَنۡفَدَ کَلِمٰتُ رَبِّیۡ وَ لَوۡ  جِئۡنَا بِمِثۡلِہٖ  مَدَدًا ‘আপনি বলুন, আমার প্রতিপালকের কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য সমুদ্র যদি কালি হয়, তবে আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হবার পূর্বেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে’ (সূরা আল-কাহফ : ১০৯)। মহান আল্লাহ বলেন, وَ اِنۡ  اَحَدٌ مِّنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ اسۡتَجَارَکَ فَاَجِرۡہُ حَتّٰی یَسۡمَعَ کَلٰمَ اللّٰہِ ‘আর যদি মুশরিকদের মধ্য হতে কেউ আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে তাকে আশ্রয় দান করুন, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়’ (সূরা আত-তাওবা : ৬)।

ফেরেশতাগণ আল্লাহর কথাকে ‘কথা’ হিসাবেই নামকরণ করেছেন

ফেরেশতাগণও আল্লাহর কথাকে ‘কথা’ হিসাবেই নামকরণ করেছেন। তাঁরা মহান আল্লাহর কথাকে সৃষ্টি বলেননি। মহান আল্লাহ বলেন, وَ لَا تَنۡفَعُ الشَّفَاعَۃُ عِنۡدَہٗۤ  اِلَّا لِمَنۡ اَذِنَ لَہٗ ؕ حَتّٰۤی  اِذَا فُزِّعَ عَنۡ قُلُوۡبِہِمۡ قَالُوۡا مَاذَا ۙ قَالَ رَبُّکُمۡ ؕ قَالُوا الۡحَقَّ ۚ وَ ہُوَ  الۡعَلِیُّ   الۡکَبِیۡرُ ‘যাকে অনুমতি দেয়া হয় তার ছাড়া আল্লাহর নিকট কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। পরে যখন তাদের অন্তর হতে ভয় বিদূরিত হবে তখন তারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তোমাদের প্রতিপালক কী বললেন? তদুত্তরে তারা বলবে, যা সত্য তিনি তাই বলেছেন। তিনি সর্বোচ্চ, মহান’ (সূরা সাবা : ২৩)।

আল্লাহর কথার উপর নবী করীম (ﷺ) ঈমান এনেছেন

মহান আল্লাহ আমাদেরকে সংবাদ প্রদান করেছেন যে, নবী করীম (ﷺ) আল্লাহর এবং তাঁর কথার উপর ঈমান এনেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, فَاٰمِنُوۡا  بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہِ النَّبِیِّ  الۡاُمِّیِّ  الَّذِیۡ یُؤۡمِنُ بِاللّٰہِ وَ کَلِمٰتِہٖ ‘সুতরাং তোমরা সবাই বিশ্বাস স্থাপন করো আল্লাহর উপর তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর উপর, যিনি বিশ্বাস রাখেন আল্লাহর এবং তাঁর সমস্ত কালামের উপর’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৫৮)।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. আদা’ঊ মাতুরীদীয়াতি লিল আক্বীদাতিত সালাফিয়্যা আল-মাতুরীদীয়্যা- আল-মাতুরীদীয়া ওয়া মাওক্বিফুহুম মিন তাওহীদিল আসমা’ই ওয়াছ ছিফাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১৭-৫১৮।
[২]. প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬৪।
[৩]. আবূল হুসাইন ইয়াহইয়া ইবনু আবিল খাইর ইবনু সালিম, আল-ইনতিছার ফির রদ্দি ‘আলাল মু‘তাযিলাতিল ক্বদরিয়্যাতিল আশরার, ২য় খণ্ড (রিয়াদ : আযওয়াউস সালাফ, ১৪১৯ হি.) ৫৪০; আবূ মুহাম্মাদ আফীফুদ্দীন আব্দুল্লাহ ইবনু আস‘আদ ইবনু আলী ইবনু সুলাইমান, মারহামুল ‘ইলালিল মু‘যিলাতি ফির রদ্দি ‘আলা আয়্যিম্মাতিল মু‘তাজিলা (বৈরূত : দারুল জীল, ১৪১২ হি.), পৃ. ১৪৮।
[৪]. ইবনু আবিল ইয আল-হানাফী, শারহুল আক্বীদা আত-ত্বাহাবী, তাহক্বীক্ব : আহমাদ শাকির (ওযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামিয়্যা ওয়াল আওক্বাফ ওয়াদ দাওয়াত ওয়াল ইরশাদ, ১৪১৮ হি.), পৃ. ২৭৩।
[৫]. আলাবিয়্যু ইবনু আব্দিল ক্বাদির আস-সিক্বাফ, ছিফাতুল্লাহি আযযা ওয়া জাল্লা আল-ওয়ারিদাতু ফিল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ (দারুল হিজরা, ১৪২৬ হি.), পৃ. ২৯৬।
[৬]. হাফিয তাক্বীউদ্দীন আব্দুল গনী ইবনু আব্দুল ওয়াহেদ আল-মাক্বদিসী, আল-ইক্বতিছাদু ফিল ই‘তিক্বাদ (মদীনা : মাকতাবাতুল ‘ঊলূম  ওয়াল হাকাম, ১৪১৪ হি. ), পৃ. ১৩০।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬১৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫২; আবূ দাঊদ, হা/৪৭০১; তিরমিযী, হা/২১৩৪; ইবনু মাজাহ, হা/৮০।
[৮]. উল্লিখিত হাদীছে بِصَوْتٍ তাকীদ বা গুরুত্ব বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা صَوْت বা (উচ্চৈঃস্বরে) শব্দ ছাড়া কখনো ডাকা সম্ভব হয় না। -মুহাম্মাদ ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া লি শাইখিল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, তাহক্বীক : সা‘দ ইবনু ফাওয়ায আছ-ছুমাইল, ২য় খণ্ড (রিয়াদ : দারু ইবনি জাওযী, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৪২১ হি.), পৃ. ৩৫।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪৮৩; ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩২।
[১০]. দোভাষী হল ভিন্ন ভাষাভাষী দু’জন কথকের মধ্যে মাধ্যম। যে একজনের কথাকে (ভাষা) অপরজনের জন্য নকল করে, যে ভাষায় সে বুঝতে পারবে। -শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া লি শাইখিল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৬।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫৩৯; ‘সদয় হওয়া’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৯।
[১২]. ছহীহ বুখারী, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৪১।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫৪৯; ছহীহ মুসলিম, হা/২৮২৯; মিশকাত, হা/৫৬২৬।
[১৪]. তিরমিযী, হা/৩০১০, সনদ হাসান; মিশকাত, হা/৬২৩৭।




ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৪র্থ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
আত্মসাতের পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
রামাযানের শেষ দশকের গুরুত্ব ও করণীয় - মাইনুল ইসলাম মঈন
ফাযায়েলে কুরআন (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
সুন্নাতের রূপরেখা - মাইনুল ইসলাম মঈন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ফিলিস্তীন, হে মুসলিম! - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ১১ রাক‘আতের নির্দেশ দিয়েছিলেন (শেষ কিস্তি) - ব্রাদার রাহুল হোসেন (রুহুল আমিন)
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৫ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বিদ‘আত পরিচিতি (৩০তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ফাযায়েলে কুরআন (৭ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ