ইসলামী শিষ্টাচার
-মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
প্রিন্সিপ্যাল, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।
[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
অহংকারমুক্ত হওয়া :
অহংকার একটি ধ্বংসাত্মক স্বভাব। এটি শিষ্টাচার পরিপন্থী সমাজ বিধ্বংসী এক মারণাস্ত্র। ব্যক্তি থেকে পরিবার এবং পরিবার থেকে সমাজ এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত এ কারণে ধ্বংস হতে পারে। ‘অহংকার পতনের মূল’ নীতি কথা হলেও আমরা অনেকে বাস্তবতার আশায় থাকি যে, দেখি কখন পতন হয়। কিন্তু মানুষ সবসময় পতন চোখে দেখে না। অনেক সময় পতন ভিন্নভাবে হয় অথবা তার পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত প্রলম্ভিত হয়, যা কবরে শুয়ে শুয়ে দেখা যায় না। তবে এর প্রভাবে আযাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই আত্মোহংকার শুধু ক্ষতিই বয়ে আনে, সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। পরকালে জাহান্নাম তো সুনিশ্চিত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘যারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে তারা মূলত শক্তিশালী, কঠোর কর্কশভাষী ও অহংকারী’।[১] কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা অহংকারীদের পরিণতি হিসাবে তাদের থাকার জায়গা হবে জাহান্নাম সেটাও বলা হয়েছে। আল্লাহ অহংকারীদের সম্পর্কে বলেন, فَادۡخُلُوۡۤا اَبۡوَابَ جَہَنَّمَ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا فَلَبِئۡسَ مَثۡوَی الۡمُتَکَبِّرِیۡنَ ‘অতএব জাহান্নামের দরজাসমূহে প্রবেশ কর, এতেই অনন্তকাল বাস কর। আর অহংকারীদের আবাসস্থল কতই না নিকৃষ্ট’ (সূরা আন-নাহল : ২৯)। এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কথাটা শুনতে কতই না খারাপ, জায়গাটাও খারাপ। বিশেষ করে যে আল্লাহর কালাম ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছ থেকে অহংকারী তার জন্য ধ্বংস। তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে মৃত্যুর দিন থেকেই অর্থাৎ তাদের রূহ প্রবেশ করবে’।[২]
দেশ বা জাতির উন্নতি করবে সেটা অনেক দূরের কথা, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুগে যুগে অহংকারীরা ধ্বংস হয়েছে, তাদের পতন হয়েছে। ফেরাঊন, নমরুদ, হামান, ক্বারূন সহ কুখ্যাত এই ব্যক্তিরা অহংকারী ছিল। আর অহংকার মানেই সত্যকে অস্বীকার করা বা অবজ্ঞা
করা। যেমন হাদীছে এসেছে- রাসূল ফ বলেন, اَلْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ ‘অহংকার হল, সত্যকে দম্ভভারে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা’।[৩] আল্লাহ কুরআনে অহংকারবশত চলাফেরা করতে নিষেধ করেছেন। অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেন, ‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পসন্দ করেন না’ (সূরা লুক্বমান : ১৮; বানী ইসরাঈল : ৩৭)। সুতরাং এটা কখনই ইসলামী শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না যে, কোন মানুষ অহংকারী বা আত্মোহংকারী হবে। এটা কোনদিনই মুমিনদের গুণাবলী ছিল না আর হতেও পারে না।
পানাহারের শিষ্টাচার
মুমিনের পুরো জীবনটাই শিষ্টাচারভুক্ত তথা ইসলামী শিষ্টাচারের সাথেই সম্পৃক্ত। খানাপিনার বৈশিষ্ট্য বা শিষ্টাচার তার মধ্যে অন্যতম। মানব জীবনের সাথে সবচেয়ে যে বিষয়টি সম্পৃক্ত তা হচ্ছে পানাহার। মানুষের জীবন পরিচালিত হয় এই খাদ্য গ্রহণের উপর। খাদ্য শুধু মানুষের ক্ষুধার চাহিদা নিবারণ করে না, বরং এটি একটি ইবাদতও বটে। তাই এই খাদ্য গ্রহণ, শুরু ও শেষের কতিপয় নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। নিম্নে আমরা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ।
ক. হালাল হওয়া
ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত হল হালাল খাদ্য গ্রহণ করা। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘জনৈক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে মলিন চেহারায় আকাশের দিকে দু’হাত উঠিয়ে আল্লাহকে বলে- হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এমনকি সে যা কিছু দ্বারা বেড়ে উঠেছে সেগুলোও হারাম।[৪] তাহলে তার এই ইবাদত কিভাবে কবুল হবে’। অর্থাৎ ইবাদত করবে ঠিকই তবে তা আল্লাহর দরবার পর্যন্ত পৌঁছবে না। কারণ উক্ত হাদীছের প্রথমে বলা হয়েছে, আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া কিছুই কবুল করেন না। অথচ বর্তমানে মানুষ খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম পরোয়া করছে না। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
.يَأْتِى عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِى الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنَ الْحَرَامِ
‘এমন যুগ আসবে যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা থেকে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল না হারাম হতে’।[৫] অন্যদিকে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন তার মালের হিসাব প্রথমে নেয়া হবে- ব্যক্তি তার সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করেছে এবং তা কোথায় ব্যয় করেছে’।[৬] খাদ্য যদি হারাম হয়, তাহলে তার ইবাদত যেমন কবুল হবে না তেমনি সে জান্নাতেও প্রবেশ করবে না। কারণ রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘হারাম দ্বারা বেড়ে উঠা শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[৭] সুতরাং প্রতিটি মুসলিমকে অবশ্যই খাদ্য গ্রহণের পূর্বে তা হালাল না-কি তা বিবেচনা করতে হবে।
খ. বসে পানাহার করা
বসে খাদ্য গ্রহণ করা সুন্নাত। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাঁড়িয়ে পানাহার করতে নিষেধ করেছেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, أنَّهُ نَهَى أَنْ يَّشْرِبَ الرَّجُلُ قَائِمًا ‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন’।[৮] হাদীছের শেষাংশে উল্লেখ আছে যে, ক্বাতাদা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমরা আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করলাম, পান করার ক্ষেত্রে যদি এমন হয়, তাহলে খাদ্যের ব্যাপারে কী হবে? অর্থাৎ খাদ্যের বেলাতেও কি একই? তিনি বললেন, হ্যাঁ একই হুকুম; বরং বসে খাওয়ার ব্যাপারে তার চেয়েও বেশী কঠোর। অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,لَايَشْرِبَنَّ أَحَدٌ مِّنْكُمْ قَائِمًا فَمَنْ نَسِىَ مِنْكُم فَلْيَسْتَقِى ‘তোমাদের কেউ যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। কেউ যদি ভুলবশতঃ করে তাহলে যেন বমি করে ফেলে’।[৯] অবশ্য এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সঠিক কথা এটাই যে, এখানে নিষেধাজ্ঞা বলতে নিতান্তই অপসন্দীয় উদ্দেশ্য; হারাম উদ্দেশ্য নয়। আর বমি করা বলতে যদি কেউ দাঁড়িয়ে খায়, তাহলে তার জন্য সুন্দর হচ্ছে- হাদীছের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সে যেন বমি করে ফেলে দেয়। আলেমদের নিকট বমি করা ওয়াজিব না হলেও মুস্তাহাবকে নাকচ করে না’।[১০]
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দাঁড়িয়ে খাদ্য গ্রহণ করা ঠিক নয়। ডাঃ বান কিউবের দৃষ্টিতে, এতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেমন হৃদ ও পিত্ত রোগ, মানসিক রোগ সহ এমন কিছু রোগে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে, যার দ্বারা মানুষের পরিচিতি নিঃশেষ হয়ে যায়।[১১] সুতরাং যেকোন খাদ্য বা পানীয় দাঁড়িয়ে নয়; বরং বসেই পানাহার করা উচিত। যদিও কিছু ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে খাওয়া বা পান করা যায়, যা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।[১২] উল্লেখ্য যে, ঠেস দিয়ে বসে খাওয়া যাবে না, যা স্বাস্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ছাহাবীরাও বলেছেন, আমরা রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কোন সময় ঠেস দিয়ে বসে খেতে দেখিনি।[১৩]
গ. বিসমিল্লাহ বলা
মুসলিমদের যত গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার আছে, তার মাঝে প্রত্যেক কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা অন্যতম। মুসলিম ব্যক্তিমাত্রই যেকোন ভাল কাজ করার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। ‘বিসমিল্লাহ’ বলার মাধ্যমে মূলত আল্লাহ্কে স্মরণ ও তাঁর উপর ভরসা করা হয়। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে খাওয়া শুরু করলে খাদ্যে বরকত হয়। ওয়াহশী ইবনু হারব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমরা খাদ্য খাই কিন্তু তৃপ্ত হই না। তিনি বললেন, ‘বিসমিল্লাহ বলে খাও, তোমাদের খাদ্যে বরকত হবে’।[১৪] এর দ্বারা বুঝা যায় যে, বিসমিল্লাহতে বরকতপূর্ণ এমন প্রভাব আছে, যা কোন কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বললে সে কাজে বা কথায় সফলতা পাওয়া যায়।[১৫] সুতরাং খানা আসার সাথে সাথে খাওয়া শুরু না করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إنَّ الشَّيْطَانَ لَيَسْتَحِلُّ الطَّعَامَ أَنْ لَّايُذْكَرَ اسْمُ اللهِ ‘শয়তান সেই খাদ্যকে নিজের জন্য হালাল করে নেয়, যাতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা হয় না’।[১৬] তাই মুসলিম হিসাবে আমাদের এ অভ্যাস গড়ে তোলা আবশ্যক।
সুধী পাঠক! ‘বিসমিল্লাহ’ না বললে শয়তান যেহেতু খাদ্য গ্রহণকারীর সাথে মিলিত হয়, তাই অন্তত শয়তান থেকে বাঁচার জন্য হলেও ‘বিসমিল্লাহ’ বলা উচিত। এমন অনেক মুসলিম ভাই আছেন, যারা দিনের পর দিন পানাহার করে যাচ্ছেন অথচ কখনো খাওয়ার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার প্রয়োজনই মনে করেন না। অথচ এটা মহা অন্যায় এবং ইসলামী শিষ্টাচার পরিপন্থী। উল্লেখ্য যে, খাওয়ার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে বলবে بِسْمِ اللهِ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ ‘বিসমিল্লাহি আউওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু’।[১৭]
ঘ. আল-হামদুলিল্লাহ বলা
কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিক দিয়ে মানুষ দু’ধরনের হয়ে থাকে। যারা মুমিন তাদের অন্যতম গুণাবলী হল তারা আল্লাহর সকল ফায়ছালাতেই সন্তুষ্ট থাকে এবং শুকরিয়া আদায় করে। বিপরীত দল যারা শুকরিয়া আদায় করে না। অর্থাৎ ভালটা অর্জন করলে নিজের কৃতিত্ব বলে স্বীকার করে আবার কোন বিপদে পড়লে তখন তা ভিন্নভাবে প্রকাশ করে। যেমন আল্লাহ বলেন,
فَاَمَّا الۡاِنۡسَانُ اِذَا مَا ابۡتَلٰىہُ رَبُّہٗ فَاَکۡرَمَہٗ وَ نَعَّمَہٗ فَیَقُوۡلُ رَبِّیۡۤ اَکۡرَمَنِ – وَ اَمَّاۤ اِذَا مَا ابۡتَلٰىہُ فَقَدَرَ عَلَیۡہِ رِزۡقَہٗ فَیَقُوۡلُ رَبِّیۡۤ اَہَانَنِ.
‘মানুষ এমন যে, যখন তার পালনকর্তা তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর সম্মান ও অনুগ্রহ দান করেন, তখন বলে, আমার পালনকর্তা আমাকে সম্মান দান করেছেন। আবার যখন তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর রিযিক সংকুচিত করে দেন, তখন বলে, আমার পালনকর্তা আমাকে হেয় করেছেন’ (সূরা আল-ফজর : ১৫-১৬)। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এমন আচরণ অবশ্যই প্রশংসনীয় নয়; বরং নিন্দনীয়। তাই যেকোন খাদ্য গ্রহণ করা হোক না কেন, মুমিন হিসাবে সর্বদা আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে। এটা ইসলামী শিষ্টাচারের অন্যতম অংশ। আর প্রশংসার সর্বোত্তম দু‘আ হল ‘আলহামদুলিল্লাহ’। তাই পানাহারের মাঝে মাঝে ও শেষে সেটা বলতে হবে। তবে এটা ছাড়া কিছু ছহীহ দু‘আ রয়েছে, যা খাবার শেষে বলতে হয়। যেমন,
اَلْحَمْدُ لِلهِ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُّبَارَكًا فِيْهِ غَيْرَ مَكْفِىٍ وَلَا مُوَدَّعٍ وَلَامُسْتَغْنًى عَنْهُ رَبَّنَا.
উচ্চারণ : আল-হামদুলিল্লাহি হামদাং কাছীরাং ত্বইয়িবাম মুবা-রাকাং ফীহি। গাইরা মাকফিইন ওয়ালা মুওয়াদ্দা‘ইন ওয়ালা মুস্তাগনান ‘আনহু রব্বানা।
অর্থঃ ‘পাক-পবিত্র, বরকতময় অগণিত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। হে আল্লাহ! আপনার নে‘মত হতে মুখ ফিরানো যায় না, আপনার অন্বেষণ ত্যাগ করা যায় না এবং এর প্রয়োজন হতেও মুক্ত থাকা যায় না’।[১৮] আর শুকরিয়া আদায় করলে আল্লাহ তা আরো বৃদ্ধি করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَ اِذۡ تَاَذَّنَ رَبُّکُمۡ لَئِنۡ شَکَرۡتُمۡ لَاَزِیۡدَنَّکُمۡ وَ لَئِنۡ کَفَرۡتُمۡ اِنَّ عَذَابِیۡ لَشَدِیۡدٌ ‘যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয় আমার শাস্তি হবে কঠোর’ (সূরা ইবরাহীম : ৭)।
ঙ. ডান হাতে খাওয়া
ইসলামী শিষ্টাচারের অন্যতম অধ্যায় হল ডান হাতে খাওয়া বা পান করা। কোনভাবেই বাম হাতে পানাহার করা যাবে না। বর্তমানে এ শিষ্টাচারের বেশ অভাব। চা স্টলে বাম হাতে চা পান করা বর্তমানে ফ্যশানে পরিণত হয়েছে। ডান হাতে যেন তৃপ্তিই পায় না। অধিকাংশ মুসিলম ভাইদের এমন বদ অভ্যাস দেখা যায়। তাই মুসলিম মাত্রই বাম হাতে নয়; বরং ডান হাতে পানাহার করতে হবে। এক্ষেত্রে সব পিতা-মাতাকে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদেরকেও সুন্নাতে রাসূলের ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নশীল হতে হবে।
পানাহারের ক্ষেত্রে আরো এমন অনেক নীতিমালা আছে, যা খেয়াল করা আবশ্যক এবং মুসলিম হিসাবে পালন করাও যরূরী কতর্ব্য। যেমন- অপচয় রোধ করা, দস্তরখানা ব্যবহার করা, ধীর গতিতে খাওয়া, খাদ্যের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য না করা, পড়ে যাওয়া খাদ্যদানা উঠিয়ে নেয়া, পরিমাণমত খাওয়া, মেহমান সাথে রাখা ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন!!
অন্যের সাথে ভাল ব্যবহার
অন্যের সাথে সুন্দর ব্যবহার করার ব্যাপারে নিম্নের হাদীছটি অত্যন্ত চমৎকার। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, صِلْ مَنْ قَطَعَكَ وَاعْفُ عَمَّنْ ظَلَمَكَ ‘যে তোমার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো, আর যে তোমার সাথে খারাপ আচরণ করে, তুমি তার সাথেও ভাল ব্যবহার কর’।[১৯] কথাটা এভাবেও বলা যায় যে, ‘সকলের সাথে এমন ব্যবহার করুন যেমনটা আপনি তাদের থেকে আশা করেন-এমনকি তারা নতুন হলেও’। বিষয়নিষ্ঠ বিতর্ক করুন, ব্যক্তিগত আক্রমণ কখনো নয়। তবে একই হাদীছের শেষে বর্ণিত অংশ দ্বারা বুঝা যায় যে, নরম হতে হবে তা ঠিক; তবে হক্বের বেলায় যা প্রয়োজ্য তাই করতে হবে। وقل الحق ولو على نفسك অর্থাৎ ‘যদি নিজেদের বিরুদ্ধেও হয় তথাপি হক্বটাই বল’। এক মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের আবশ্যক হল সর্বদা কল্যাণ কামনা করা। এটি হাদীছে বর্ণিত মুসলিমদের ৬টি হক্বেরও একটি। এটিই পূর্ণাঙ্গ মুমিনের গুণাবলী।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে ইসলামী শিষ্টাচার প্রায় উঠেই গেছে। মুসলিম হয়ে অপর মুসলিম ভাইকে চিনা আজ বড়ই কঠিন। অথচ মহান আল্লাহ বলেন, وَ مَا یُلَقّٰہَاۤ اِلَّا الَّذِیۡنَ صَبَرُوۡا وَ مَا یُلَقّٰہَاۤ اِلَّا ذُوۡحَظٍّ عَظِیۡمٍ ‘এই গুণের অধিকারী করা হয় শুধু তাদেরকেই যারা ধৈর্যশীল, এই গুণের অধিকারী করা হয় শুধু তাদেরকে যারা মহা ভাগ্যবান’ (সূরা হা-মীম সিজদা ৩৪)। শত্রুকে বন্ধুরূপে আনয়নের জন্য ভাল ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইসলাম উত্তম আচরণ ও দাওয়াত ও যুদ্ব-বিগ্রহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিদৃষ্ট হয় যে, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ছাহাবীদের আচরণেই মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে, তরবারী দ্বারা নয়। তাই যেকোন মূল্যে আচরণ অবশ্যই সুন্দর করতে হবে। আরবী কবি ইয়া‘কূব আল-হামাদুনী বলেন,
جراحات السنان لها التئام * ولا يلتام ما جرح اللسان ‘তরবারীর কোন আঘাত মিটে যেতে পারে, কিন্তু জিহ্বা দ্বারা তথা কথার আঘাত কখনো মিটে যায় না’। এক মুসলিম অপর মুসলিমের জন্য সর্বদা দু‘আ করবে বা কল্যাণ কামনা করবে এটাই স্বাভাবিক। আবুদ্দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন, مَا مِنْ عَبْدٍ مُسْلِمٍ يَدْعُوْ لِأَخِيْهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ إِلَّا قَالَ الْمَلَكُ وَلَكَ بِمِثْلٍ ‘যে লোক তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দু‘আ করে, তার জন্য একজন নিয়োজিত ফেরেশতা ‘আমীন’ বলতে থাকে আর বলে, তোমার জন্যও অনুরূপ’।[২০] আল্লাহু আকবার! আমি দু‘আ করব একজন ব্যক্তির জন্য আর তার ফলে আমি পাব একজন ফেরেশতার দু‘আ।
উপসংহার
আচরণে যদি মানুষ শিষ্ট না হয়, ব্যবহারে উগ্রতা যদি পরিহার না করে তবে কখনো মানুষ হিসাবে শিষ্টাচারী হওয়া সম্ভব নয়। সৎভাবে কৃত্রিমতা পরিহার করতে না পারলে কখনো পবিত্র মনের অধিকারী হওয়া যায় না। মানবিক সত্তার প্রকাশ ঘটে তার শিষ্ট স্বভাবে। ঔদ্ধত্য আর উচ্ছৃঙ্খলতা এখানে পরাজিত হয়। অহংকার অন্যকে ছোট ভাবতে শেখায়। পক্ষান্তরে শিষ্টাচার মানুষকে সম্মান করতে শেখায়। কদর্যতা আর অশ্লীলতা শিষ্টাচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কাজেই ব্যক্তিকে হতে হয় আচরণে মার্জিত, বক্তব্যে সৎ, সরল আর স্পষ্ট। বিনয় মানুষকে ছোট করে না; বরং পরায় সম্মানের মুকুট।
প্রিন্সিপ্যাল, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।
১. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯১৮।
২. তাফসীরে ইবনু কাছীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ৫৭৬।
৩. ছহীহ মুসলিম, হা/৯১।
৪. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৯৩।
৫ . ছহীহ বুখারী, হা/২০৫৯; মিশকাত, হা/২৭৬১।
৬. তিরমিযী, হা/২৪১৬, সনদ হাসান।
৭ . বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, মিশকাত, হা/২৭৮৭।
৮. ছহীহ মুসলিম, হা/২০২৪।
৯ . ছহীহ মুসলিম, হা/২০২৬।
১০. শারহু নববী, ১৩ তম খ-, পৃ. ১৯৫।
১১. ডাঃ মুহাম্মাদ তারিক মাহমূদ, সুন্নাতে রাসূল (ছাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান (ঢাকা : আল-কাওছার প্রকাশনী, ১৯৯৭), ১ম খ-, পৃ. ৯৯।
১২. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬১৬।
১৩ . ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৯৮; আবুদাঊদ, হা/৩৭৭২।
১৪. আবুদাঊদ, হা/৩১৯৯, সনদ ছহীহ।
১৫ . মুহাম্মাদ আবু তালেব, বিজ্ঞানময় কোরআন (চট্টগ্রাম : ইডেন প্রকাশনী, দ্বিতীয় প্রকাশ, ২০০১), পৃ. ৩৪,৩৫৪।
১৬. ছহীহ মুসিলম, হা/৫৩৭৮।
১৭. আবুদাঊদ, হা/৪২০২।
১৮ . ছহীহ বুখারী, হা/৫৪৫৮।
১৯ . বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৭৫৮৫; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৯১১, সনদ ছহীহ।
২০. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৩২।