মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১১:৪১ পূর্বাহ্ন

ইসলামী সংগঠন ও তরুণ-যুবক-ছাত্র

-ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন*


তরুণ-যুবকের মন-মানসিকতা হবে পরিছন্ন; তারা থাকবে সদাপ্রফুল্ল ও সহাস্য। তারা হবে কর্মঠ-কর্মচঞ্চল, কঠোর পরিশ্রমী তৎসঙ্গে সিনিয়র, দায়িত্বশীল ও সহকর্মীদের সার্বিক সহযোগী। কাজের মধ্যেই খুঁজে পাবে তারা তাদের তারুণ্য ও যৌবনের স্বার্থকতা। যে সংগঠন ও জামা’আতে তরুণ ও যুবক যত বেশি, সে সংগঠন তত সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময়। কেননা সাধারণ নিয়মেই অগ্রবর্তীরা বুড়ো হয়ে যাবে এবং বিদায় নিবেন আর পরবর্তীরা তাদের শূন্যস্থান পূরণ করবে। স্থলাভিষিক্ত হওয়ার লোক যদি তৈরি না হয়, তাহলে যে কোন প্রতিষ্ঠান তা উপস্থিত ক্ষেত্রে যতই জাঁকজমকপূর্ণ দেখা যাক না কেন, সেটি শুধুমাত্র মৃত্যুর প্রহর গণনা করছে বলে ধরে নিতে হবে। 

এ বিষয়টি সার্বিকভাবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের সমাজের বয়স বাড়ছে। প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি দেশকে নাকি তখনই প্রবীণ বলা যায়, যখন এর ৭ শতাংশ মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি হয়। এর পরের সাত বছরে যদি সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়, তাহলে সেটি বৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইউনিসেফ’ জানাচ্ছে যে, বালাদেশে এমন ঘটনা ঘটতে চলেছে ২০২৯ সালের মধ্যে এবং ২০৪৭ সাল অবধি এ দেশ এক প্রবীণ সমাজে পরিণত হবে।[১]

যথাযোগ্য কর্মক্ষম তারুণ্যের অনুপস্থিতিতে প্রৌঢ় ও বৃদ্ধের চিন্তা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়া শুধুমাত্র কঠিনই নয় বরং অসম্ভব। অপরাপর কাজে প্রস্তুতি ও কৃতকার্যতার জন্য যেমন তারুণ্য সহায়ক তেমনই দ্বীনের কাজের জন্যও তা বড় নিয়ামক। তারুণ্যের মূল্যবান সময়, দৈহিক শক্তি ও কর্মোদ্দম যথাসম্ভব দ্বীনের কাজে ব্যয় হওয়া উচিত। ক্বিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পা সরাতে দেয়া হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার আয়ুস্কাল ও যৌবন কোন কাজে ব্যয় করেছে তার কৈফিয়ত না দিতে পারবে।[২] আবার ক্বিয়ামতের দিন যখন কোন ছায়া থাকবে না তখন যে সাতজনকে আল্লাহ  তা’আলা ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন তাদের একজন হল ঐ যুবক, যে তার রব্-এর ইবাদতের মধ্যে বেড়ে উঠেছে (শাব্বুন নাশাআ ফী ‘ইবাদতিল্লাহ)।[৩]  যুগে-যুগে যুবকদের সত্য কবূল করা ও দ্বীনের পথে তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীমে একাধিক জায়গায় দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন আছহাবে কাহফের কাহিনী, আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

اَمۡ حَسِبۡتَ اَنَّ  اَصۡحٰبَ الۡکَہۡفِ وَ الرَّقِیۡمِ ۙ کَانُوۡا  مِنۡ  اٰیٰتِنَا  عَجَبًا . اِذۡ اَوَی الۡفِتۡیَۃُ  اِلَی الۡکَہۡفِ فَقَالُوۡا رَبَّنَاۤ اٰتِنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ رَحۡمَۃً  وَّ ہَیِّیٔۡ لَنَا مِنۡ  اَمۡرِنَا  رَشَدًا

“তুমি কি মনে করেছ (হে নবী!) গুহা ও ফলকের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল? যখন যুবকেরা গুহায় আশ্রয় নিল তখল বলল : হে আমাদের রব্! আপনি নিজের পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম সঠিক হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন (সূরা আল-কাহফ : ৯-১০)।” আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন : 

نَحۡنُ نَقُصُّ عَلَیۡکَ نَبَاَہُمۡ  بِالۡحَقِّ ؕ اِنَّہُمۡ فِتۡیَۃٌ  اٰمَنُوۡا بِرَبِّہِمۡ وَ زِدۡنٰہُمۡ ہُدًی  . وَّ رَبَطۡنَا عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ اِذۡ قَامُوۡا فَقَالُوۡا رَبُّنَا رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ لَنۡ نَّدۡعُوَا۠ مِنۡ دُوۡنِہٖۤ  اِلٰـہًا لَّقَدۡ قُلۡنَاۤ  اِذًا  شَطَطًا . ہٰۤؤُلَآءِ قَوۡمُنَا اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اٰلِہَۃً ؕ  لَوۡ لَا یَاۡتُوۡنَ عَلَیۡہِمۡ بِسُلۡطٰنٍۭ بَیِّنٍ ؕ فَمَنۡ اَظۡلَمُ  مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا

“আমরা তোমার কাছে তাদের কাহিনী সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল এমন কিছু যুবক যারা তাদের রব্-এর উপর ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদের হেদায়াত বৃদ্ধি করে দিয়েছিলাম। তাদের পরস্পরের আত্মাগুলোর মধ্যে আমি (ঈমানের) বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছিলাম; যখন তারা উঠে গেল (র্শিকি কর্মকা-ের জাতীয় অনুষ্ঠান থেকে) তখন বলল যে, আমাদের রব তো তিনিই যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের রব্ (স্রষ্টা, পালনকর্তা, নিয়ন্ত্রকারী), তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ইলাহ (মা‘বূদ) হিসাবে কক্ষনো ডাকব না, (আর যদি ডাকি) তাহলে আমরা অতিশয় গর্হিত কথা বলে ফেলব। আমাদের এই স্বজাতিরা আল্লাহ ছাড়া বহু ইলাহ (মা‘বূদ) গ্রহণ করেছে, (কিন্তু) তাদের এই ইলাহ (মা‘বূদ) গ্রহণের উপর তারা কেন সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করে না? আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে তার চাইতে বেশি অত্যাচারী আর কে হতে পারে? (সূরা আল-কাহফ : ১৩-১৫)।”

ইমাম ইবনু কাছীর “ وَّ رَبَطۡنَا عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ اِذۡ قَامُوۡا” (আমি সেই যুবকদের মনগুলোর মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছিলাম যখন তারা উঠে গেল)-এর তাফসীর করতে গিয়ে বলেন :

“রোমের শাসক দুকইয়ানুসের আমলে বার্ষিক মূর্তিপূজা ও বলিদান অনুষ্ঠানে অভিজাত বংশের এই যুবকেরা তাদের মুরুব্বীদের সাথে গিয়ে উপস্থিত হয়। এ সকল কাজের অসারতা বুঝতে পেরে তারা এক-এক করে উঠে যায় এবং একটি গাছের নিচে স্বাভাবিকভাবেই জড়ো হয়। একজন আরেক জনের মনোভাব বুঝতে পেরে তারা মত-বিনিময় করে এবং একমত পোষণ করে বলে উঠেÑ আসমান ও যমীনের স্রষ্টা ছাড়া অন্য কারো জন্য পূজা ও যবাই করা অযৌক্তিক ও অবৈধ। অতঃপর তারা পরস্পর ‘ইখওয়ানু ছিদক’ (সত্যের ভ্রাতা) হয়ে যায়। তারপর তারা এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটি ঘর বানায় এবং সেখানে ইবাদত করতে থাকে। রাজার কাছে এই খবর পৌঁছালে সে তাদেরকে ডেকে পাঠায় এবং ভর্ৎসনা ও শাসানোর পর তাদেরকে মত পরিবর্তনের নির্দেশ করে সময়সীমা নির্ধারণ দেয় এবং এর অন্যথা হলে কঠিন শাস্তির পরোয়ানা জারী করে। এ সুযোগে ঐ যুবকেরা তাদের দ্বীন নিয়ে হিজরত করে গুহায় প্রবেশ করে।”[৪] এখানে যুবকদের দ্বীনের কাজে সুসংগঠিত হওয়া এবং পরিকল্পনা গ্রহণের কথা খুবই পরিষ্কার। তারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়নি বা যার-যার মত এদিক ওদিক চলে যায়নি। 

উপর্যুক্ত আয়াতগুলো এবং তার তাফসীর নিয়ে একটু চিন্তা করলেÑ র্শিকে জর্জরিত, মিথ্যা কবলিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন কথিত ধর্মের বিরুদ্ধে পূর্বযুগের একদল যুবকের অনাস্থা জ্ঞাপন, সত্য তাওহীদী দ্বীনের স্বচ্ছ জ্ঞানলাভ ও তা দৃঢ়ভাবে গ্রহণ, যথাযথ যুক্তির মাধ্যমে পরস্পর পর্যালোচনা, করণীয় বিষয়ে মযবুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সত্যিকার রব্-এর সাথে কাউকে শরীক না করার ঘোষণা, নির্ভেজাল ইবাদতের জন্য গৃহ নির্মাণ এবং চ্যালেঞ্জ করে র্শিক ও কুসংস্কার মুক্ত ইবাদত করা, অতঃপর সমাজে টিকতে না পেরে অপারগ হয়ে ঈমান ও জীবন নিয়ে হিজরত করা ও গুহায় প্রবেশ করা এবং সঠিক পথপ্রাপ্তি ও তার উপর কায়েম থাকার জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে। আর যুবকদের এ সকল কাজ আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুবই পসন্দনীয় এবং গ্রহণযোগ্য হয়েছে তাই তিনি কুরআনে কারীমে ‘ فِتۡیَۃٌ  اٰمَنُوۡا بِرَبِّہِمۡ’ (তাদের রব্-এর ঈমান আনা যুবকদল) হিসাবে উল্লেখ করে কাহিনীর বর্ণনা দিয়েছেন। সকল যুগের যুবকদের জন্যই যা দৃষ্টান্ত ও আদর্শ স্বরূপ। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) উপর্যুক্ত আয়াতগুলোর তাফসীর করতে গিয়ে যুবকদের প্রসঙ্গে বলেন : 

فَذَكَرَ تَعَالَى أَنَّهُمْ فِتْيَةٌ -وَهُمُ الشَّبَابُ-وَهُمْ أَقْبَلُ لِلْحَقِّ، وَأَهْدَى لِلسَّبِيْلِ مِنَ الشُّيُوْخِ، الَّذِيْنَ قَدْ عَتَوْا وعَسَوا فِيْ دِيْنِ الْبَاطِلِ؛ وَلِهَذَا كَانَ أَكْثَرُ الْمُسْتَجِيْبِيْنَ لِلهِ وَلِرَسُوْلِهِ ﷺ شَبَابًا. وَأَمَّا الْمَشَايِخُ مِنْ قُرَيْشٍ، فَعَامَّتُهُمْ بَقُوْا عَلَى دِيْنِهِمْ، وَلَمْ يُسْلِمْ مِنْهُمْ إِلَّا الْقَلِيْلُ. وَهَكَذَا أَخْبَرَ تَعَالَى عَنْ أَصْحَابِ الْكَهْفِ أَنَّهُمْ كَانُوا فِتْيَةً شَبَابًا

“আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন যে, তাঁরা ছিল ‘ফিতইয়াহ’ অর্থাৎ তরুণ-যুবকদল। আর নবীনরাই হক্ব (সত্য) গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশি অগ্রণী ও সঠিক পথ লাভের ক্ষেত্রে বৃদ্ধদের চাইতে অধিক হেদায়াতপ্রাপ্ত। প্রবীণরা (অধিকাংশই দ্বীনের) বিরুদ্ধাচরণ করেছে ও বাতিল দ্বীনের মধ্যে কালক্ষেপণ করেছে। আর এ জন্যই দেখা গেছে যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আহ্বানে সাড়া দানকারীদের অধিকাংশই ছিল যুবক।[৫] আর কুরাইশদের মধ্যে যারা বয়স্ক তাদের অধিকাংশই তাদের নিজেদের ধর্মের উপরই কায়েম ছিল এবং (প্রথম দিকে) ইসলাম গ্রহণ করেছিল খুব কমসংখ্যকই। আর অনুরূপ আছহাবে কাহ্ফ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা জানাচ্ছেন যে, তারা ছিল তরুণ যুবক।”[৬]

যে লোকটিকে সর্বপ্রথম শিক্ষক, দা‘য়ী ও ইমাম হিসাবে মাক্কাহ থেকে মদীনাহয় পাঠানো হয় তিনি ছিলেন একজন অল্প বয়স্ক তরুণ। তাঁর নাম মুছ‘আব বিন উমাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। এই যুবকের ঈমানী তেজ, সৎসাহস, নিরলস দা‘ওয়াতী কার্যক্রম, ক্ষুরধার বিচক্ষণতা ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের অপূর্ব দক্ষতার কারণে খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে মদীনাহর বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করে এবং মদীনাহর ঘরে-ঘরে ইসলাম এবং নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নাম ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করে।[৭] তাঁর সততা, দক্ষতা ও ব্যক্তিত্ব¡ মুহাজির-আনছার সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হবার কারণে নবী (ﷺ) তাঁকে বদরের যুদ্ধে (২য় হি.) মূল পতাকা বহনকারী নিয়োগ করেন।[৮] উহুদের যুদ্ধেও (৩য় হি.) তিনি মুহাজিরদের পতাকা-বাহক ছিলেন।[৯] এই যুদ্ধে তিনি শাহাদত বরণ করেন। 

মৃত্যুর পূর্বে নবী করীম (ﷺ) তরুণ উসামাহ্ বিন যায়েদকে ‘শাম, অভিযানে (১১ হি.) সেনাপতি নিয়োগ করেন। এই বাহিনীতে মুহাজির ও আনছার থেকে অনেক সিনিয়র ছাহাবী অংশগ্রহণ করেছিলেন। বয়সের স্বল্পতার জন্য অনেকেই আপত্তি করলে নবী করীম (ﷺ) স্বয়ং খুত্ববায় দাঁড়িয়ে যান এবং বলেন : “তোমরা যেমন উসামাহর ইমারতে (সেনাপতিত্বে) আপত্তি করছ ঠিক তেমনই তার পিতা যায়েদের (বিন হারিছাহ) সেনাপতিত্বে (মু’তার যুদ্ধে; ৮ হি./৬২৯ খ্রি.) আপত্তি করেছিলে। আল্লাহর কসম! সে সেনাপতিত্বের যোগ্য ছিল। সে ছিল আমার অতি প্রিয়, তারপর এ নিজেও (তার পুত্র উসামাও) আমার প্রিয়।”[১০] 

বলা বাহুল্য, নবী করীম (ﷺ)-এর যুগে তরুণরা ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন এবং যুদ্ধে যোগদানের জন্য তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যেত এবং কেউ বয়সের স্বল্পতার জন্য অংশগ্রহণ করতে না পারলে তার আফসোসের সীমা থাকত না। দৃশ্যত ছোট (১৭ বছরের) যুবক উমাইর বিন আবি ওয়াক্কাছ নবী করীম (ﷺ)-কে খুবই অনুরোধ করে বদরের যুদ্ধে (২য় হি.) অংশগ্রহণের অনুমতি নেন এবং শহীদ হন।[১১] তরুণ হারিছাহ (বিন সুরাকাহ) এই যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁর মাতা ‘রুবাইয়্যি’ নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে এসে বললেন, আমার ছেলে যদি জান্নাতে গিয়ে থাকে তাহলে আমার আর কোন দুঃখ নেই। নবী করীম (ﷺ) বললেন : “শুধুমাত্র একটি জান্নাত? সে তো অনেক জান্নাত! আর ও তো জান্নাতুল ফিরদাউসে অবস্থান করছে।”[১২] এই যুদ্ধে মুশরিক সর্দার আবূ জাহলকে টার্গেট করে হত্যা করেছিলেন দুই তরুণ ‘আফ্রার দুই পুত্র- (মু‘য়ায বিন ‘আমর ও মু‘য়াউয়িয বিন ‘আফরা)।[১৩] 

১৫ বছর বয়সের সামুরাহ বিন জুনদুব ও রাফি’ বিন খাদীজ উহুদের যুদ্ধে (৩য় হি.) অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষিত হলে প্রথম জন পিতার সুপারিশে (সে ভাল তিরন্দাজ) আর দ্বিতীয় জন দৈহিক শক্তির পরীক্ষা দিয়ে কৌশল করে অংশগ্রহণের অনুমতি লাভ করেন।[১৪] উহুদের যুদ্ধের সময় ১৪ বছরের বালক আব্দুল্লাহ বিন ‘উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে বয়সের স্বল্পতার জন্য নবী করীম (ﷺ) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেননি। অতঃপর ৪র্থ হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধের সময় যখন তাঁর বয়স যখন ১৫ বছর হয় তখন তিনি তাতে অংশগ্রহণ করার অনুমতি লাভ করেন।[১৫] আর আমাদের তরুণ ও যুবকেরা শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে দ্বীন প্রচারের জন্য একটু কুরআন-সুন্নাহর লেখাপড়া, সামান্য মেহনত, একটু সমাজ সংস্কারের কর্ম, কিছুটা সাংগঠনিক কাজ করতেই যেন হিমশিম খেয়ে যায়, অপারগ হয়ে পড়ে। এ আর কিছু নয়Ñ শুধুমাত্র মানসিক প্রস্তুতি ও হিম্মতের অভাব, সচেতনতার কমতি, দায়িত্ববোধের স্বল্পতা, কর্মতৎপরতার ঘাটতি।

সূরা বুরূজের কাহিনীও আবর্তিত হয়েছে মূলত এক বালকের ঈমানী দৃঢ়তা ও আত্মত্যাগকে কেন্দ্র করে। পূর্বযুগের (ইয়াহুদী শাসক যু-নাওয়াছের আমলে (৫২৩-৫২৫ খ্রি.)[১৬] ইয়ামানের (বর্তমান সঊদী আরবের) নাজরান অঞ্চলের ঐ ছোট্ট তরুণটির দ্বীনের ক্ষেত্রে পালিত ভূমিকাও আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুবই পছন্দ হয়েছে, তাই তাকে কেন্দ্র করে যে কাহিনী তা তিনি কুরআনে কারীমে উল্লেখ করেছেন : 

قُتِلَ اَصۡحٰبُ الۡاُخۡدُوۡدِ . النَّارِ ذَاتِ الۡوَقُوۡدِ ۙ. اِذۡ ہُمۡ عَلَیۡہَا قُعُوۡدٌ ۙ. وَّ ہُمۡ عَلٰی مَا یَفۡعَلُوۡنَ بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ شُہُوۡدٌ . وَ مَا نَقَمُوۡا مِنۡہُمۡ  اِلَّاۤ  اَنۡ یُّؤۡمِنُوۡا بِاللّٰہِ الۡعَزِیۡزِ  الۡحَمِیۡدِ

“ধ্বংস হয়েছে গর্তের নায়করা। যে গর্ত ছিল জ্বালানীবিশিষ্ট আগুনময়। যখন তারা এর পাশে বসে ছিল এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করেছিল (পোড়ানোর দৃশ্য) তা তারা দেখছিল। আর তারা তাদের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছিল এ জন্যই যে, তারা পরাক্রমশালী স্বপ্রশংসিত আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল (সূরা আল-বুরূজ : ৪-৮)।”

(ইনশাআল্লাহ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

* অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। 

তথ্যসূত্র :
[১]. প্রবীণনিবাস,  দৈনিক প্রথম আলো, সোমবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২২। 
[২]. তিরমিযী, হা/২৪১৬; বিভাগ : আয-যুহদ (হাদীছটি বিস্তারিতভাবে পরবর্তীতে উল্লেখ করা হয়েছে)।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩১ (পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচিত হবে)।
[৪]. ইবনু কাছীর, তাফছীরুল কুরআন আল-‘আযীম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৯৯-২০০। 
[৫]. ইবনু কাছীর, তাফছীরুল কুরআন আল-‘আযীম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৯৯-২০০।
[৬]. ইবনু কাছীর, তাফছীরুল কুরআন আল-‘আযীম, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৪০।
[৭]. ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ, পৃ. ৩১০-৩১৩, আল্লামাহ মুবারকপুরী, আর-রাহীক আল-মাখতুম, পৃ.২০৯-২১২, শায়খ আবুল হাসান নাদভী, আস-সীরাহ, পৃ. ১৩০-১৩৪।
[৮]. ইমাম ইবনু কাইয়্যেম আল-জাউযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭২; ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ, পৃ. ৪১৯; আর-রাহীক আল-মাখতুম, পৃ. ২৮৬; শায়খ নাদভী, আস-সীরাহ, ১৮১।
[৯]. যাদুল মা‘আদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭২, ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ, ৪১৯; আর-রাহীক আল-মাখতুম, পৃ. ২৮৬; শায়খ নাদভী, আস-সীরাহ, ১৮১।
[১০]. ছহীহ বুখারী, আল-মাগাযী, অধ্যায় : মরণ-ব্যাধির সময় নবী (ﷺ)-এর উসামা বিন যায়েদকে সেনাপতি নিয়োগ করে প্রেরণ, হা/ ৪৪৬৯।
[১১]. শায়খ নাদভী, আস-সীরাহ, পৃ. ১৮০।
[১২]. ছহীহ বুখারী, বিভাগ : জিহাদ, হা/২৮০৯, আল-মাগাযী, অধ্যায় : বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীর সম্মান, হা/৩৯৮২, ফাতহুল বারী শারহ ছহীহ বুখারী, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৫।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, আল-মাগাযী, অধ্যায় : আবু জাহলের হত্যা, হা/৩৯৬২, ৩৯৬৩; আর-রাহীক আল-মাখতুম, পৃ.৩০৫-৩০৬।
[১৪]. ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ, পৃ. ৫২৪, শায়খ নাদভী, আস-সীরাহ, ১৯২, আর-রাহীক আল-মাখতুম, ৩৪৫, বিস্তারিত দেখুন : যাদুল মা‘আদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৯৫।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, আল-মাগাযী, অধ্যায় : খন্দকের যুদ্ধ আর ওটাই আহযাব, হা/৪০৯৭, ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ, পৃ. ৫২৪।
[১৬]. আর-রাহীক আল-মাখতুম, পৃ. ৩৫-৩৬; তাফসীর ইবনু কাছীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪৩১। 




প্রসঙ্গসমূহ »: যুবসমাজ সংগঠন
ইসলামী শিষ্টাচার - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৭ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ধারা (২য় কিস্তি) - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
গাযওয়াতুল হিন্দ : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ - হাসিবুর রহমান বুখারী
ফাযায়েলে কুরআন (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৭ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ফাযায়েলে কুরআন (৫ম কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
সমকামিতার ভয়াবহতা ও তার অপকার (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৩য় কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের ধারণা: গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (১৭তম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ