মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১২:৪৫ অপরাহ্ন
সুন্নাতের রূপরেখা
-মাইনুল ইসলাম মঈন*

(শেষ কিস্তি)

হাদীছের আলোকে সুন্নাহ্র গুরুত্ব

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টই বোঝা যায় যে, পবিত্র কুরআনে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ্র অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। অতএব আমরা যদি কুরআনের নির্দেশ পূর্ণরূপে মেনে নিই, তবে অব্যশই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যে কোন আদেশ-নিষেধ মেনে নিতে আমরা বাধ্য। আর তখনই অতিরিক্ত প্রমাণ হিসাবে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিজের বক্তব্যের ব্যবহার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। সুন্নাহ্র গুরুত্ব ও প্রয়াজেনীয়তা সম্বন্ধে উপরিউক্ত আয়াতগুলো ছাড়াও নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথাতেও ব্যক্ত হয়েছে এবং তাঁর সুন্নাহ পরিত্যাগের ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন। নি¤েœ এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কয়েকটি হাদীছ পেশ করা হল।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ অবজ্ঞা করার ব্যাপারে ভবিষ্যতবাণী

عَنْ أَبِىْ رَافِعٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا أُلْفِىنَّ أَحَدَكُمْ مُتَّكِئًا عَلَىْ أَرِيْكَتِهِ يَأْتِيْهِ الْأَمْرُ مِنْ أَمْرِىْ مِمَّا أَمَرْتُ بِهِ أَوْ نَهَيْتُ عَنْهُ فَيَقُوْلُ لَا نَدْرِى مَا وَجَدْنَا فِىْ كِتَابِ اللهِ اتَّبَعْنَاهُ.

আবূ রাফে‘ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমি যেন তোমাদের কাউকে এরূপ না দেখি যে, সে তার গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে, আর তার কাছে আমার কোন আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা পৌঁছলে সে বলবে যে, আমরা এসব কিছু জানি না। যা আল্লাহর কিতাবে পাব, আমরা তারই অনুসরণ করব’।[১]

‘গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকা’ দ্বারা আলেমরা বুঝেছেন যে,

أصحاب الترفة والبدعة الذين لزموا البيوت وصدوا عن طلب العلم والحديث.

‘এখানে এমন ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে, যে বিলাসিতা ও বিদ‘আতের ব্যাপারে আগ্রহী। যে ঘরে বসে থাকে এবং জ্ঞান ও হাদীছের ব্যাপারে অনুসন্ধান করা থেকে বিরত থাকে’।[২]

অতএব এখানে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ত্যাগ স্বীকার করা, শিক্ষালাভ ও পরিশ্রম করার ব্যাপারে তাদের অনীহার জন্যই তারা সুন্নাহ থেকে পালিয়ে বেড়ায়।

কুরআনের মতো আরেকটি অহি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দেয়া হয়েছে

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, أَلَا إِنِّيْ أُوْتِيْتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ ‘নিশ্চয়ই আমাকে কিতাব দেয়া হয়েছে এবং তার সাথে তার সদৃশ কিছু দেয়া হয়েছে’।[৩] ইমাম বায়হাক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন

هَذَا الْحَدِيْثُ يَحْتَمِلُ وَجْهَيْنِ أَحَدُهُمَا أَنَّهُ أُوْتِيَ مِنَ الْوَحْيِ الْبَاطِنِ غَيْرِ الْمَتْلُوِّ مِثْلَ مَا أُوْتِيَ مِنَ الظَّاهِرِ الْمَتْلُوِّ وَالثَّانِيْ أَنَّ مَعْنَاهُ أَنَّهُ أُوْتِيَ الْكِتَابَ وَحْيًا يُتْلَى وَأُوْتِيَ مِثْلَهُ مِنَ الْبَيَانِ أَيْ أُذِنَ لَهُ أَنْ يُبَيِّنَ مَا فِي الْكِتَابِ فَيَعُمَّ وَيَخُصَّ وَأَنْ يَزِيْدَ عَلَيْهِ فَيُشَرِّعَ مَا لَيْسَ فِي الْكِتَابِ لَهُ ذِكْرٌ فَيَكُوْنُ ذَلِكَ فِيْ وُجُوْبِ الْحُكْمِ وَلُزُوْمِ الْعَمَلِ بِهِ كَالظَّاهِرِ الْمَتْلُوِّ مِنَ الْقُرْآنِ.

‘এই হাদীছের দুই ধরনের অর্থ হতে পারে। ১. আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এক বাতেন (লুক্কায়িত, গুপ্ত, অপ্রকাশিত) অহি দান করা হয়েছে, যা তেলাওয়াত করা হয় না, যেমন তাকে প্রকাশ্য অহি দান করা হয়েছে যা তেলাওয়াত করা হয়। ২. এর আরেকটা অর্থ হতে পারে যে, তাঁকে কিতাব দেয়া হয়েছে, যা এমন অহি যা তেলাওয়াত করা হয় এবং তাঁকে এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাকে কিতাবটি ব্যাখ্যা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। যার সাধারণ ও সুনির্দিষ্ট প্রয়োগে রয়েছে এবং কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি এমন বিষয়ে তিনি বিধিনিষেধ যুক্ত করতে পারেন। এদিক থেকে আদেশ করার ব্যাপারে তাঁর দায়িত্ব এবং সে আদেশ মানার ব্যাপারে অন্যদের কর্তব্য কুরআনের ¯পষ্ট তেলাওয়াত থেকে প্রাপ্ত বিধিনিষেধ মেনে চলার মতই অবশ্যকরণীয়’।[৪] হাসান বিন আতিয়া বলেন, كَانَ جِبْرِيْلُ يَنْزِلُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالسُّنَّةِ كَمَا يَنْزِلُ عَلَيْهِ بِالْقُرْآنِ ‘জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এমনভাবে সুন্নাহ নাযিল করেন, যেভাবে তিনি তাঁর কাছে কুরআন নাযিল করতেন’।[৫] ইবনু হাযম ইমাম মালিক থেকে বর্ণনা করেন,

كان رسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إمام المسلمين وسيد العالمين يسأل عن الشيء فلا يجيب حتى يأتيه الوحي من السماء.

‘মুসলিম ও সারা পৃথিবীর ইমাম রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যদি কিছু জিজ্ঞেস করা হত, তবে তিনি আকাশ থেকে অহি লাভ না করা পর্যন্ত তার উত্তর দিতেন না’।[৬]  

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রেখে যাওয়া দু’টি অহির পরিপূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত ধ্বংস অনিবার্য

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের জন্য দু’টি বস্তু রেখে গেছেন, যার পরিপূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে বিদায় হজ্জের সময় বলেছেন,تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ رَسُوْلِهِ ‘আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা সে দু’টি জিনিস আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হবে না; (আর তাহল) আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ’।[৭] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,

لِكُلِّ عَمَلٍ شِرَّةٌ وَلِكُلِّ شِرَّةٍ فَتْرَةٌ فَمَنْ كَانَتْ فَتْرَتُهُ إِلَى سُنَّتِيْ فَقَدْ أَفْلَحَ وَمَنْ كَانَتْ إِلَى غَيْرِ ذَلِكَ فَقَدْ هَلَكَ.

‘যে কোন কর্মকান্ডরই এমন একটা সময় থাকে যখন সেটা অতি উৎসাহে স¤পন্ন করা হয়, আবার প্রতিটি কর্মকান্ডরই স্থবিরতার একটা কাল থাকে। কেউ যখন তার স্থবিরতাকে আমার সুন্নাহর সীমার ভিতরে রাখে, তখন সে কল্যাণ লাভ করে। আর যে সে সীমার বাইরে চলে যায়, সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে’।[৮] 

এই হাদীছে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে চেয়েছেন যে, ভাল আমল বা নফল ইবাদত ইত্যাদি করার সময় যে কেউ নি¤œতম যেটুকু করবে তা যেন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ সীমারেখার বাইরে না চলে যায়। তাহলে সত্যিকার হেদায়াত লাভ করা এবং আখিরাতে নাজাত প্রাপ্ত পাওয়া সম্ভব। আর যারা সুন্নাহকে স¤পূর্ণ পরিত্যাগ করেন অথবা দ্বীনের ব্যাপারে নতুন নতুন ধারণা সংযোজিত করেন- উভয় শ্রেণীর জন্যই এ হাদীছে একটা ¯পষ্ট সতর্কবাণী উল্লেখ করা হয়েছে।

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সিদ্ধান্তকেও আল্লাহ্র কিতাব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত বলা হয়েছে

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ وَزَيْدِ بْنِ خَالِدٍ  رَضِىَ اللهُ عَنْهُأَنَّ رَجُلَيْنِ اِخْتَصَمَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ أَحَدُهُمَا اقْضِ بَيْنَنَا بِكِتَابِ اللهِ وَقَالَ الْآخَرُ أَجَلْ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فاقْضِ بَيْنَنَا بِكِتَابِ اللهِ وَائْذَنْ لِيْ أَنْ أَتَكَلَّمَ قَالَ تَكَلَّمْ قَالَ إِنَّ ابْنِيْ كَانَ عَسِيْفًا عَلَى هَذَا فَزَنَى بِامْرَأَتِهِ فَأَخْبَرُوْنِيْ أنَّ عَلَى ابْنِيْ الرَّجْمُ فَاقْتَدَيْتُ مِنْهُ بِمِائَةِ شَاةٍ وَبِجَارِيَةٍ لِيْ ثُمَّ إِنِّيْ سَأَلْتُ أَهْلَ الْعِلْمِ فَأَخْبَرُوْنِيْ أَنَّ عَلَىْ ابْنِيْ جَلْدَ مِائَةٍ وَتَغْرِيْبَ عَامٍ وَإِنَّمَا الرَّجْمُ عَلَى امْرَأَتِهِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَا وَالَّذِي نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَأَقْضِيَنَّ بَيْنَكُمَا بِكِتَابِ اللهِ أَمَّا غَنَمُكَ وَجَارِيَتُكَ فَرَدٌّ عَلَيْكَ وَأَمَّا ابْنُكَ فَعَلَيْهِ جَلْدُ مِائَةٍ وَتَغْرِيْبُ عَامٍ وَأَمَّا أَنْتَ يَا أُنَيْسُ فَاغْدُ إِلَى امْرَأَةِ هَذَا فَإِن اِعْتَرَفَتْ فَارْجُمْهَا فَاعْتَرَفَتْ فَارْجُمْهَا.

আবূ হুরায়রা ও যায়েদ ইবনু খালেদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, একদা দু’ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে তাদের ঝগড়া পেশ করল এবং তাদের একজন বলল, আমাদের মধ্যে আল্লাহ্র কিতাব দ্বারা বিচার করুন। অপর লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! হ্যাঁ; অবশ্যই আমাদের মাঝে আল্লাহ্র কিতাব দ্বারা ফায়সালা করে দিন এবং আমাকে ঘটনার বিবরণ বলার অনুমতি প্রদান করুন। তিনি বললেন, বল। লোকটি বলল, আমার পুত্র এই ব্যক্তির চাকর ছিল এবং তার স্ত্রীর সাথে যেনা করেছে। লোকেরা আমাকে বলেছে যে, আমার পুত্রের শাস্তি হল রজম। কিন্তু আমি রজমের বিনিময়ে একশ’ ছাগল ও একটি দাসী ফিদিয়াস্বরূপ আদায় করেছি। অতঃপর আমি আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করলাম। তাঁরা আমাকে ফাতাওয়া দিয়েছেন যে, আমার পুত্রের শাস্তি হল একশ চাবুক এবং এক বৎসরের জন্য নির্বাসন। আর এই ব্যক্তির স্ত্রীর উপর অবশ্যই পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। অতঃপর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, সেই মহান সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ। অবশ্যই আমি তোমাদের উভয়ের মধ্যে আল্লাহর কিতাব দ্বারা বিচার করব। একশত ছাগল আর দাসীটি তোমার কাছে ফেরৎ আসবে, তবে তোমার পুত্রের জন্য শাস্তি স্বরূপ একশ’ চাবুক ও এক বৎসরের জন্য নির্বাসন। আর হে উনায়স! আগামীকাল সকালে তুমি এই ব্যক্তির স্ত্রীর নিকট যাও। যদি সে স্বীকার করে, তাহলে তাকে পাথর নিক্ষেপ করবে। পরদিন ভোরে সে ঐ মহিলাটির নিকট গেল এবং সে তা স্বীকার করল। অবশেষে তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হল।[৯]

এক বৎসর নির্বাসনের সাথে এই একশ’ চাবুক মারার বিচার কুরআনে কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না, তবুও নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটাকে আল্লাহ্র কিতাব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। মূলত কুরআনে আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বিধান দেয়ার যে কর্তৃত্বের কথা বলা হয়েছে, এটা তারই ফলশ্রুতি।

মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্য-মিথ্যা পার্থক্যের মাপকাঠি

عَنْ جَابِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ جَاءَتْ مَلاَئِكَةٌ إِلَىْ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهْوَ نَائِمٌ فَقَالُوْا إِنَّ لِصَاحِبِكُمْ هَذَا مَثَلًا فَاضْرِبُوْا لَهُ مَثَلًا فَقَالَ بَعْضُهُمْ إِنَّهُ نَائِمٌ وَقَالَ بَعْضُهُمْ إِنَّ الْعَيْنَ نَائِمَةٌ وَالْقَلْبَ يَقْظَانُ فَقَالُوْا مَثَلُهُ كَمَثَلِ رَجُلٍ بَنَى دَارًا جَعَلَ فِيْهَا مَأْدُبَةً وَبَعَثَ دَاعِيًا فَمَنْ أَجَابَ الدَّاعِىَ دَخَلَ الدَّارَ وَأَكَلَ مَعَهُ مِنَ الْمَأْدُبَةِ وَمَنْ لَمْ يُجِبِ الدَّاعِىَ لَمْ يَدْخُلِ الدَّارَ وَلَمْ يَأْكُلْ مِنَ الْمَأْدُبَةِ فَقَالُوْا أَوِّلُوْهَا لَهُ يَفْقَهْهَا فَقَالَ بَعْضُهُمْ إِنَّهُ نَائِمٌ وَقَالَ بَعْضُهُمْ إِنَّ الْعَيْنَ نَائِمَةٌ وَالْقَلْبَ يَقْظَانُ فَقَالُوْا فَالدَّارُ الْجَنَّةُ وَالدَّاعِى مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ.

জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা ঘুমন্ত অবস্থায় একদল ফেরেশতা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে আসলেন। ফেরেশতাগণ বললেন, তোমাদের সাথীর জন্য একটি উদাহরণ রয়েছে। তাঁর জন্য উদাহরণটি পেশ কর। অতঃপর একজন বললেন, তিনি তো নিদ্রিত। অন্যজন বললেন, তাঁর চক্ষু নিদ্রিত কিন্তু অন্তর জাগ্রত। তখন একজন বললেন, তাঁর উদাহরণটি ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে ব্যক্তি একটি গৃহ নির্মাণ করে, অতঃপর সেখানে একটি ভোজের আয়োজন করে এবং লোকদের আহ্বান করার জন্য একজন আহ্বায়ক প্রেরণ করে। যে ব্যক্তি তাঁর আহ্বানে সাড়া দিল, সে উক্ত গৃহে প্রবেশ করতে পারল এবং খাদ্য গ্রহণ করল। আর যে ব্যক্তি তাঁর আহ্বানে সাড়া দিল না, সে উক্ত গৃহে প্রবেশ করতে পারল না এবং খাদ্য গ্রহণও করতে পারল না। অতঃপর তারা বললেন, তাঁকে এই উদাহরণের তাৎপর্য বলে দিন, যাতে তিনি বুঝতে পারেন। তাদের কেউ বললেন, তিনি তো নিদ্রিত। অন্যরা বললেন, তাঁর চক্ষু নিদ্রিত কিন্তু অন্তর জাগ্রত। তারা বললেন, গৃহটি হল ‘জান্নাত’। আহ্বায়ক হলেন মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। অতএব যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবাধ্য হল, সে আল্লাহর অবাধ্য হল। মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন মানুষের মধ্যে পার্থক্যকারী।[১০]

এই হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, যারা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয় এবং যারা তাঁর সুন্নাহ ও আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের মাঝে তিনি হলেন পার্থক্যকারী। সুতরাং নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহর অনুসরণে যারা নিজের জীবনকে বিন্যস্ত করার ব্যাপারে তোয়াক্কা করে না, তাদের চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে, তারা জান্নাতের প্রতিফল উপভাগে করতে পারবে না।

সুন্নাতের অবাধ্যকারী জাহান্নামী

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّ أُمَّتِىْ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى  قِيْلَ وَمَنْ أبَى؟ قَالَ مَنْ أَطَاعَنِىْ دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِىْ فَقَدْ أَبَى.

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আমার উম্মতের সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে কেবল অস্বীকারকারী ব্যতীত। জিজ্ঞেস করা হল, কে অস্বীকারকারী? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে আমার অবাধ্যতা করল, সে অস্বীকারকারী।[১১]

অর্থাৎ একজন মুসলিম যদি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনুসরণ করে, তবে সে জান্নাতের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করল না। আর যদি তাঁকে অনুসরণ না করে, তাহলে সে আসলে জান্নাতে প্রবেশ করাকেই প্রত্যাখ্যান করল। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এখানে তাদের কথাই বলেন, যারা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। অর্থাৎ যারা তাঁর সুন্নাত অস্বীকার করবে তাঁরা তাঁরই উম্মত।

পরিশেষে বলা যায়, আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা সুন্নাহ্র স্বরূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ‘সুন্নাহ’ শব্দটি পরিভাষায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হলেও সত্যিকার মুমিন হতে হলে আমাদের রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সকল সুন্নাত অনুসরণ করা অপিহার্য। প্রকৃতপক্ষে কুরআন অনুসরণ করলে আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ মানতে বাধ্য। কেননা আল-কুরআন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সকল আদেশ-নিষেধ মানাকে আবশ্যক করে দিয়েছে। তাই আসুন! ইহকালিন কল্যাণ ও পরকালিন মুক্তির জন্য পবিত্র কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সকল ছহীহ সুন্নাহকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!


* এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; শিক্ষক, মহব্বতপুর দারুল উলূম আলিম মাদরাসা, মোহনপুর, রাজশাহী।

[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৯১২; আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৫; তিরমিযী, হা/২৬৬৩; ইবনু মাজাহ, হা/১৩; বায়হাক্বী-দালাইলনু নবুঅত হা/২৯৩৬; মিশকাত, হা/১৬২।
[২]. শারফুদ্দীন হোসাইন বিন আব্দুল্লাহ আত্ তীবী, শারহুত-তিব্বী আলাল মিশকাতিল মাছাবীহ, (রিয়াদ : মাকতাবা নায্যার মোস্তফা আলবায, প্রথম সংস্করণ ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খ্রি.) ২য় খ-, পৃ. ৬২৯।
[৩]. আবূ দাউদ, হা/৪৬০৪।
[৪]. আওনুল মা‘বুদ ওয়া হাশিয়াতু ইবনুল কায়্যিম, ১৬তম খ-, পৃ. ২৩১।
[৫]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী, ১৩তম খ-, পৃ. ২৯১।
[৬]. ইবনু হাযম, আল-ইহকাম ফি উছূলিল আহকাম, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৫৭।
[৭]. মুওয়াত্ত্বা মালিক, হা/১৫৯৪; মিশকাত, হা/১৮৬। এ হাদীছটি মুরসাল বরং মুযাল (অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে দু’জন রাবীর নাম উল্লেখ করা হয়নি) এজন্য যঈফ বটে। তবে ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে হাসান সনদে ইমাম হাকিম (হা/৩১৮) এর শাহিদ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি ‘আত্তাজুল জামিউ লিল উসূলিল খামসাহ’ নামক গ্রন্থে এর উভয় সনদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
[৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৯৫৮।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬৩৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৯৭; মিশকাত, হা/৩৫৫৫।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৮১, ‘ই‘তিছাম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২; মিশকাত, হা/১৪৪।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৮০, ‘ই‘তিছাম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২; মিশকাত, হা/১৪৩।




বিদ‘আত পরিচিতি (১৫তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৯ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (১২তম কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
সন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ এবং তার প্রতিদান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আশূরায়ে মুহাররম - আল-ইখলাছ ডেস্ক
রামাযানের শেষ দশকের গুরুত্ব ও করণীয় - মাইনুল ইসলাম মঈন
ফাযায়েলে কুরআন (৭ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
শারঈ মানদন্ডে শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
বিদ‘আত পরিচিতি (১৪তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
তওবার গুরুত্ব ও ফযীলত - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ফেসবুক পেজ