সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০১:৪৫ অপরাহ্ন

শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি

-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন


(২য় কিস্তি)

(২) জাল ও যঈফ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত সকল প্রকার আক্বীদা ও আমল নিঃসঙ্কোচে এবং নিঃশর্তভাবে বর্জন করা।

ইসলামের ক্ষতি সাধন, মুসলিম ঐক্য বিনষ্টকরণ এবং উম্মাহ্কে সঠিক পথ ও বিশ্ববিজয়ী কর্মসূচী থেকে বিচ্যুত করার জন্য যে কয়টি বিষয় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, তার মধ্যে জাল ও যঈফ হাদীছ অন্যতম। মুসলিম জাতির প্রায় সকল বিষয়ে মতানৈক্য ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে এর প্রধান ভূমিকা। ইহুদী-খ্রীষ্টান চক্র এবং তাদের দোসর কতিপয় পথভ্রষ্ট মুসলিম ফের্কা অসংখ্য জাল হাদীছ তৈরি করে এবং যঈফ হাদীছ প্রচার করে এই সর্বনাশ করেছে। মুসলিমরা এভাবেই তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছে। অথচ শরী‘আতের মানদণ্ডে জাল ও যঈফ হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ব্যাপারে উম্মতকে চূড়ান্তভাবে সতর্ক করে গেছেন। এর বিরুদ্ধে ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম এবং তাবে-তাবেঈন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী আপোসহীন মুহাদ্দিছগণও অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম করেছেন এবং ঐ চক্রের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন। তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছহীহ হাদীছগুলোকে লক্ষ লক্ষ জাল ও যঈফ হাদীছ থেকে পৃথক করে দিয়েছেন। যুগের পর যুগ তাঁরা এভাবেই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ খেদমত করে আসছেন। কিন্তু দুঃখজনক হল, সংখ্যাগরিষ্ঠ একশ্রেণীর আলেম, ইমাম, খত্বীব, বক্তা, মুফাসসির সমাজে নির্দ্বিধায় জাল ও যঈফ হাদীছ প্রচার করছেন, বই-পুস্তকে, প্রবন্ধ-নিবন্ধে লিখছেন, ছাত্রদের পড়াচ্ছেন, পেপার-পত্রিকাসহ অসংখ্য মিডিয়ায় শয়তানের বমির মত ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এটা যেন তাদের মূল সম্বল। অন্যথা তাদের পেটপূজার ধর্ম ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে এবং পকেট খালি হয়ে যাবে। জেনারেল শিক্ষিত ব্যক্তিরাও এ কাজে পিছিয়ে নেই। মূলত তাদের কারণেই সমাজে জাল ও যঈফ হাদীছ চালু আছে এবং এর কুপ্রভাবেই মুসলিম সমাজ দূষিত হয়েছে। মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চূড়ান্ত হুঁশিয়ারী হাদীছের পাতাতেই থেকে গেছে। তাদের কাছে সালাফদের পরিশ্রমের কোনও মূল্য নেই। অন্যদিকে তারা ছহীহ হাদীছের বিশাল ভাণ্ডার থেকে মুসলিম উম্মাহকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ছহীহ হাদীছ থেকে উম্মত তেমন কোন উপকার লাভ করতে পারছে না।

যঈফ হাদীছ আমলযোগ্য নয় :

শরী‘আত ত্রুটি, সন্দেহ ও দুর্বলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ইসলামে এগুলোর কোন আশ্রয় নেই। যঈফ হাদীছের সংজ্ঞায় ইবনুছ ছালাহ (৫৭৭-৬৪৩হি./১১৮১-১২৪৫ খ্রি.) বলেন,

كُلُّ حَدِيْثٍ لَمْ يَجْتَمِعْ فِيْهِ صِفَاتُ الْحَدِيْثِ الصَّحِيْحِ وَلاَ صِفَاتُ الْحَدِيْثِ الْحَسَنِ...فَهُوَ حَدِيْثٌ ضَعِيْفٌ

‘যে হাদীছে ছহীহ ও হাসান হাদীছের বৈশিষ্ট্য সংশ্লিষ্ট হয়নি তাকেই যঈফ হাদীছ বলে’।[১]

এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা দুর্বল, অভিযুক্ত, ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তির কথা গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,

یٰۤاَیُّہَا  الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا  اِنۡ جَآءَکُمۡ فَاسِقٌۢ بِنَبَاٍ فَتَبَیَّنُوۡۤا  اَنۡ  تُصِیۡبُوۡا قَوۡمًۢا بِجَہَالَۃٍ  فَتُصۡبِحُوۡا عَلٰی مَا فَعَلۡتُمۡ  نٰدِمِیۡنَ

‘হে মুমিনগণ! কোন ফাসিক ব্যক্তি যদি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তোমরা তা যাচাই করে দেখবে। যাতে তোমরা মূর্খতাবশত কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও’ (সূরা আল-হুজুরাত : ৬)।

মুহাদ্দিছগণ উক্ত আয়াতের আলোকেই আস্থাহীন, অভিযুক্ত, পাপাচারী, ফাসিক ব্যক্তির বর্ণনা গ্রহণ করেননি। কারণ শরী‘আত অতি স্বচ্ছ, অভ্রান্ত, অকাট্য, অপ্রতিরোধ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ تَمَّتۡ  کَلِمَتُ رَبِّکَ صِدۡقًا وَّ عَدۡلًا  لَا مُبَدِّلَ لِکَلِمٰتِہٖ 

‘আপনার রবের কথা সত্য ও ন্যায়ে পরিপূর্ণ। তাঁর কথার পরিবর্তনকারী কেউ নেই’ (সূরা আল-আন‘আম : ১১৫)। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً ‘আমি তোমাদের নিকট সম্পূর্ণ দীপ্তিমান ও অতি স্বচ্ছ দ্বীন নিয়ে এসেছি’।[২] ইমাম মুসলিম (২০৪-২৬১ হি.) বলেন,

وَاعْلَمْ وَفَّقَكَ اللهُ تَعَالَى أَنَّ الْوَاجِبَ عَلَى كُلِّ أَحَدٍ عَرَفَ التَّمْيِيْزَ بَيْنَ صَحِيْحِ الرِّوَايَاتِ وَسَقِيْمِهَا وَثِقَاتِ النَّاقِلِيْنَ لَهَا مِنَ الْمُتَّهَمِيْنَ أَنَّ لاَيَرْوِىَ مِنْهَا إِلاَّمَا عَرَفَ صِحَّةَ مَخَارِجِهِ وَالسِّتَارَةِ فِىْ نَاقِلِيْهِ وَأَنْ يَّتَّقِىَ مِنْهَا مَا كَانَ مِنْهَا عَنْ أَهْلِ التُّهَمِ وَالْمُعَانِدِيْنَ مِنْ أَهْلِ الْبِدَعِ

‘তুমি (ছাত্র) জেনে রাখ, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে তাওফীক্ব দান করুন! যারা ছহীহ ও ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনা সমূহ এবং ন্যায়পরায়ণ ও অভিযুক্তদের সম্পর্কে বুঝে, তাদের প্রত্যেকের উপর ওয়াজিব হল, তারা যেন সেই বর্ণনাগুলো থেকে শুধু তাই বর্ণনা করে, যার উৎসের সত্যতা ও তার বর্ণনাকারীদের শ্লীলতা সম্পর্কে জানবে। সেই সাথে ঐগুলো থেকে সাবধান থাকবে, যেগুলো ত্রুটিযুক্ত ও অস্বীকারকারী গোঁড়া বিদ‘আতীদের থেকে এসেছে’।[৩]

ইমাম ইবনুল আরাবী (৪৬৯-৫৪৩ হি./১০৭৬-১১৪৮ খ্রি.) সর্বক্ষেত্রে যঈফ হাদীছ বর্জনের পক্ষে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তার এই মত খুবই প্রসিদ্ধ। যেমন তিনি বলেন, إِنَّ الْحَدِيْثَ الضَّعِيْفَ لاَيُعْمَلُ بِهِ مُطْلَقًا ‘যঈফ হাদীছ কোন ক্ষেত্রেই আমলযোগ্য নয়’।[৪] যারা যঈফ হাদীছের প্রতি শিথিল মনোভাব প্রদর্শন করে থাকেন মুহাদ্দিছ আবু শামাহ আল-মাক্বদেসী (মৃ. ৬৬৫ হি.) তাদের সমালোচনা করে বলেন,

جَرَى فِيْ ذَلِكَ عَلَى عَادَةِ جَمَاعَةٍ مِّنْ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مُتَسَاهِلُوْنَ فِيْ أَحَادِيْثِ فَضَائِلِ الْأَعْمَالِ وَهَذَا عِنْدَ الْمُحَقِّقِيْنَ مِنْ أَهْلِ الْحَدِيْثِ وَعِنْدَ عُلَمَاءِ الْأُصُوْلِ وَالْفِقْهِ خَطَأٌ

‘এ ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণের একটি দলের অভ্যাস প্রচলিত আছে। তারা ফাযায়েলে আমল সংক্রান্ত হাদীছের প্রতি শিথিলতা প্রদর্শন করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিছগণ, উছূলবিদ ও ফক্বীহদের নিকট তা ভ্রান্তিপূর্ণ।[৫] ইমাম আহমাদ ইবনু তাইমিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন,

لاَيَجُوْزُ أَنْ يُّعْتَمَدَ فِى الشَّرِيْعَةِ عَلَى الأَحَادِيْثِ الضَّعِيْفَةِ الَّتِىْ لَيْسَتْ صَحِيْحَةً وَلاَ حَسَنَةً

‘শরী‘আতের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীছ সমূহের উপর নির্ভরশীল হওয়া বৈধ নয়, যা ছহীহ এবং হাসান বলে প্রমাণিত হয়নি’।[৬] ইমাম আহমাদ মুহাম্মাদ শাকের (১৩০৯-১৩৭৭হি./১৮৯২-১৯৫৮ খ্রি.) বলেন,

وَإِنَّهُ لاَ فَرْقَ بَيْنَ الْأَحْكَامِ وَبَيْنَ فَضَائِلِ الْأَعْمَالِ وَنَحْوِهَا فِىْ عَدَمِ الْأَخْذِ بِالرِّوايَةِ الضَّعِيْفَةِ بَلْ لاَحُجَّةَ لِأَحَدٍ إِلاَّ بِمَا صَحَّ عَنْ  رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ حَدِيْثٍ صَحِيْحٍ أوحَسَنٍ

‘যঈফ হাদীছ থেকে দলীল না নেওয়ার ব্যাপারে আহকাম এবং ফাযায়েলে আমাল বা অন্য কোন বিষয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বরং ছহীহ ও হাসান হিসাবে প্রমাণিত হাদীছ ছাড়া কেউ শরী‘আত সাব্যস্ত করতে পারে না’।[৭] ইমাম আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯ খ্রি./১৩৩৩-১৪২০ হি.) বলেন,

وَهَذَا وَالَّذِىْ أُدَيِّنُ اللهَ بِهِ وَأَدْعُوْ النَّاسَ إِلَيْهِ أَنَّ الْحَدِيْثَ الضَّعِيْفَ لاَ يُعْمَلُ بِهِ مُطْلَقًا لاَفِىْ الْفَضَائِلِ وَالْمُسْتَحَبَّاتِ وَلاَ فِىْ غَيْرِهِمَا

‘এ জন্যই আমি আল্লাহর দিকে ফিরে যাই এবং মানুষকেও আমি এদিকেই আহ্বান করি যে, যঈফ হাদীছের উপর কোন ক্ষেত্রেই আমল করা যায় না। না ফযীলতের ক্ষেত্রে, না মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে। এতদ্ব্যতীত অন্য কোন বিষয়েও না’।[৮] অন্যত্র তিনি বলেন,

إِنَّ الْحَدِيْثَ الضَّعِيْفَ إِنَّمَا يُفِيْدُ الظَّنَّ الْمَرْجُوْحَ وَلاَ يَجُوْزُ الْعَمَلُ بِهِ اِتِّفَاقًا فَمَنْ أَخْرَجَ مِنْ ذَلِكَ الْعَمَلِ بِالْحَدِيْثِ الضَّعِيْفِ فِىْ الْفَضَائِلِ لاَبُدَّ أَنْ يَأْتِىَ بِدَلِيْلٍ وَهَيْهَاتَ

‘নিশ্চয়ই যঈফ হাদীছ কেবল অতিরিক্ত ধারণার ফায়েদা দেয়, ঐকমত্যের ভিত্তিতে যার প্রতি আমল করা বৈধ নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি বলে, ফযীলত সংক্রান্ত যঈফ হাদীছের উপর আমল করা যাবে তাকে অবশ্যই দলীল পেশ করতে হবে। কিন্তু তা তো অসম্ভব’! [৯] মুহাদ্দিছ ড. ছুবহী ছালেহ বলেন,

لَانُسْلِمُ بِرِوَايَةِ الضِّعْيْفِ فِيْ فَضَائِلِ الْأَعْمَالِ وَلَوْ تَوَافَرَتْ لَهُ جَمِيْعُ الْشُّرُوْطِ الَّتِىْ لَا حَظَّهَا الْمُتَسَاهِلُوْنَ فِيْ هَذَا الْمَجَالِ

‘ফাযায়েলে আমলের ক্ষেত্রে আমরা যঈফ হাদীছের কাছে আত্মসমর্পণ করি না। এ জন্য যাবতীয় শর্তসমূহ যদি একত্রিতও হয় তবুও এই স্থানে শৈথিল্যবাদীদের কোন সুযোগ নেই’।[১০]

জাল হাদীছ প্রচার করা ও আমল করা হারাম :

রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাম দিয়ে বানানো বর্ণনাকে জাল হাদীছ বলে। ইমাম নববী নববী (৬৩১-৬৭৬ হি.) জাল হাদীছের সংজ্ঞায় বলেন, هُوَ الْمُخْتَلَقُ الْمَصْنُوْعُ وَشَرُّ الضَّعِيْفِ ‘রচিত, বানোয়াট ও নিকৃষ্ট দুর্বল বর্ণনাকে মুওযূ বা জাল বলে’।[১১] ড. মাহমূদ আত-ত্বহ্হান বলেন,  

هُوَ الْكِذْبُ الْمُخْتَلَقُ الْمَصْنُوْعُ الْمَنْسُوْبُ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

‘রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দিকে সম্পর্কিত করে বর্ণিত বানোয়াট মিথ্যা হাদীছকে জাল হাদীছ বলে’।[১২]

শরী‘আতের নামে মিথ্যাচার করার পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। আল্লাহ বলেন, 

فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا لِّیُضِلَّ النَّاسَ بِغَیۡرِ  عِلۡمٍ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ  الظّٰلِمِیۡنَ

‘সুতরাং ঐ ব্যক্তির চেয়ে বড় যালেম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে, যাতে সে বিনা ইলমে মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে পারে? নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা যালেম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দান করেন না’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৪৪)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ সম্পর্কে ঐ সমস্ত কথা বলা হারাম, যে বিষয়ে তারা জানে না (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩৩)। অনুরূপ হাদীছেও এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَلِّغُوْا عَنِّىْ وَلَوْ آيَةً وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِىْ إِسْرَائِيْلَ وَلاَحَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘একটি আয়াত (কথা) হলেও তোমরা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও। আর বাণী ইসরাঈলদের সম্পর্কেও বর্ণনা কর, তাতে সমস্যা নেই। তবে কেউ যদি আমার উপর ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করে, তাহলে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে বানিয়ে নেয়’।[১৩] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ سَلَمَةَ بْنِ الْأَكْوَعِ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ مَنْ يَّقُلْ عَلَىَّ مَا لَمْ أَقُلْ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

সালামা ইবনুল আকওয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলতেন, ‘কেউ যদি আমার সম্পর্কে এমন কথা বলে, যা আমি বলিনি, তাহলে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে তৈরি করে নেয়’।[১৪] অন্য বর্ণনায় এসেছে,

عَنِ الْمُغِيْرةِ بْنِ شُعْبَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ رَوَى عَنِّىْ حَدِيْثًا وَهُوَ يُرَى أَنَّهُ كَذِبٌ فَهُوَ أَحَدُ الْكَاذبِيْنَ

মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কেউ যদি আমার পক্ষ থেকে এমন কোন একটি হাদীছ বর্ণনা করে, যার সম্পর্কে সে সন্দিহান যে তা মিথ্যা, তাহলে সে মিথ্যুকদের একজন’।[১৫] মুহাদ্দিছ আবী হাতিম ইবনু হিব্বান (২৭০-৩৫৪ হি.) উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন,

فَكُلُّ شَاكٍّ فِيْمَا يَرْوِىْ أَنَّهُ صَحِيْحٌ أَوْ غَيْرُ صَحِيْحٍ دَاخِلٌ فِىْ ظَاهِرِ خِطَابِ هَذَا الْخَبَرِ وَلَوْ لَمْ يَتَعَلَّمِ التَّارِيْخَ وأَسْمَاءَ الثِّقَاتِ والضُّعَفَاءِ

‘হাদীছটি ছহীহ না গায়র ছহীহ এরূপ প্রত্যেক সন্দেহকারী ব্যক্তি উক্ত হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অন্তর্ভুক্ত হবেন। যদিও তিনি ইলমে তারীখ এবং দুর্বল ও শক্তিশালী রাবীদের নামগুলো না জানেন’।[১৬]

অতএব জানা-শুনা জাল ও যঈফ হাদীছ তো বর্ণনা করা যাবেই না, বরং ত্রুটিপূর্ণ বা দুর্বল হতে পারে মর্মে সন্দেহ হলেও তা প্রচার করা যাবে না। এর পরিণামও জাহান্নাম। তাই জাল হাদীছের ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকা আবশ্যক।

জাল হাদীছ বর্জনের ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিছ একমত। এর প্রচার-প্রসার এবং তার প্রতি আমল করা সবই মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যে হারাম। ড. ওমর ইবনু হাসান ওছমান ফালাতাহ বলেন, وَهُوَ إِجْمَاعٌ ضِمْنِىٌّ آخَرُ عَلَى تَحْرِيْمِ الْعَمَلِ بِالْمَوْضُوْعِ ‘জাল হাদীছের প্রতি আমল করা ইজমার আওতাধীন বিষয় সমূহের মধ্যে একটি বিশেষ হারাম’।[১৭] আহকাম, আক্বীদা, ফযীলত, ওয়ায-নছীহত কিংবা উৎসাহ ও সতর্কতা যে উদ্দেশ্যেই জাল হাদীছ বর্ণনা করা হোক, তা মুসলিম উম্মাহ্র ইজমা দ্বারা হারাম, কাবীরা গোনাহ সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোনাহ এবং সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ। ইমাম নববী (৬৩১-৬৭৬ হি.) বলেন,

أَنَّهُ لَا فَرْقَ فِىْ تَحْرِيْمِ الْكِذْبِ عَلَيْهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ مَا كَانَ مِنَ الْأَحْكَامِ وَمَا لَاحُكْمَ فِيْهِ كَالتَّرْغِيْبِ وَالتَّرْهِيْبِ وَالْمَوَاعِظِ وَغَيْرِذَلِكَ فَكُلُّهُ حَرَامٌ مِنْ أَكْبَرِ الْكَبَائِرِ وَأَقْبَحِ الْقَبَائِحِ بِإِجْمَاعِ الْمُسْلِمِيْنَ

‘শারী‘আতের আহকাম ছাড়াও উৎসাহ, ভীতি, ওয়ায-নছীহতসহ যেকোন বিষয়েই রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর মিথ্যারোপ করা হোক না কেন তা হারাম। এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যে সবই হারাম, বৃহৎ কাবীরা গোনাহ সমূহ ও জঘন্য কার্যাদির অন্তর্ভুক্ত’। পরক্ষণে তিনি বলেন,

تُحْرَمُ رِوَايَةُ الْحَدِيْثِ الْمَوْضُوْعِ عَلَى مَنْ عَرَفَ كَوْنَهُ مَوْضُوْعًا أَوْ غَلَبَ عَلَى ظَنِّهِ وَضْعَهُ فَمَنْ رَوَى حَدِيْثًا عَلِمَ أَوْ ظَنَّ وَضْعَهَ وَلَمْ يَتَبَيَّنْ قَالَ رِوَايَةُ وَضْعِهِ فَهُوَ دَاخِلٌ فِى هَذَا الْوَعِيْدِ مُنْدَرِجٌ فِىْ جُمْلَةِ الْكَاذِبِيْنَ عَلَى رَسُوْلِ اللِهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ 

‘ঐ ব্যক্তির উপর জাল হাদীছ বর্ণনা করা হারাম, যে ব্যক্তি জানে যে তা জাল অথবা সে জাল বলে ধারণা করে। যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে জাল হাদীছ বলে কিন্তু তা জাল বলে প্রকাশ করে না, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর মিথ্যারোপকারীদের যে শাস্তি, সে তার মধ্যে অন্তর্র্ভুক্ত হবে’।[১৮] যায়েদ বিন আসলাম বলেন,

مَنْ عَمِلَ بِخَبَرٍ صَحَّ أَنَّهُ كِذْبٌ فَهُوَ مِنْ خَدَمِ الشَّيْطَانِ

‘হাদীছ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও যে তার উপর আমল করে, সে শয়তানের খাদেম’।[১৯]

অতএব জাল হাদীছের ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না। কারণ জাল হাদীছ দ্বারা শারঈ কোন বিধান প্রমাণিত হয় না। এর উপর আমল করা পরিষ্কার হারাম।[২০]

হাদীছ বর্ণনার ব্যাপারে সালাফদের সতর্কতা :

আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হুঁশিয়ারীকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈগণ হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে কঠোর মূলনীতির অনুসরণ করেছেন। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব ও আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) বলেন,

 بِحسْبِ الْمَرْءِ مِنَ الْكِذْبِ أَنْ يُّحَدِّثَ بِكُلِّ مَاسَمِعَ

‘কোন ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে’।[২১]  অন্য বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ عَامِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ الزُّبَيْرِ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ قُلْتُ لِلزُّبَيْرِ إِنِّىْ لاَ أَسْمَعُكَ تُحَدِّثُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَمَا يُحَدِّثُ فُلاَنٌ وَفُلاَنٌ فَقَالَ أَمَا إِنِّىْ لَمْ أُفَارِقْ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَكِنِّىْ سَمِعْتُهُ يَقُوْلُ مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

আমের ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, আমি যুবাইরকে বললাম, আপনাকে আমি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছ বর্ণনা করতে শুনছি না, যেমন অমুক অমুক হাদীছ বর্ণনা করছেন। তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে পৃথক ছিলাম এমনটি নয়; বরং আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করবে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে তৈরী করে নেয়’।[২২] অন্য এক বর্ণনায় এসেছে,

قَالَ أَنَسٌ إِنَّهُ ليَمْنَعُنِىْ أَنْ أُحَدِّثَكُمْ حَدِيْثًا كَثِيْرًا أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ تَعَمَّدَ عَلَىَّ كَذِبًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘তোমাদের নিকট বেশী বেশী হাদীছ বর্ণনা করতে আমাকে বাধা দেওয়ার কারণ হল, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কেউ যদি ইচ্ছা করে আমার উপর মিথ্যারোপ করে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে তৈরি করে নেয়’।[২৩]

মোটকথা সমস্ত ছাহাবীই রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন এবং আপসহীন নীতি মেনে চলেছেন। তাদের ধারাবাহিকতায় তাবেঈগণও সেই পথ অবলম্বন করেছেন। প্রফেসর ড. হাসান মুহাম্মাদ মাক্ববূলী বলেন, وَقَدِ اتَّبَعَ هَذَا الْمَنَهَجَ سَائِرُ الصَّحَابَةِ .. ثُمَّ التَّابِعِيْنَ مِنْ بَعْدِهِمْ ‘সকল ছাহাবী এই মূলনীতির অনুসরণ করেছেন।.. অতঃপর তাঁদের পরবর্তী তাবেঈগণও উক্ত মূলনীতি অনুসরণ করেছেন।[২৪]

ছাহাবায়ে কেরাম এত কিছু মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও হাদীছ বর্ণনার ব্যাপারে কতই না সতর্কতা অবলম্বন করতেন। কিন্তু আমরা হর-হামেশা জাল-যঈফ হাদীছ বলছি, আমল করছি, লিখছি, বক্তব্যে প্রচার করছি। কিন্তু আমাদের বুক কাঁপে না। আরো আশ্চর্যজনক হল, যে হাদীছটি বর্ণনা করা হচ্ছে সেটা কোন্ হাদীছ গ্রন্থে আছে সেটাও জানা নেই। ছহীহ-যঈফ যাচাই করা তো দূরের কথা।

হাদীছ গ্রহণ ও বর্জনের শর্ত এবং উছূল বা মূলনীতি সমূহ উম্মতের সেরা ব্যক্তিত্ব ইসলামের চার খলীফা আবুবকর, ওমর, ওছমান, আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ছাহাবীদের পক্ষ থেকেই এসেছে। অতঃপর মুহাদ্দিছগণ তা রূপায়ন করেছেন মাত্র। ড. শায়খ মুছত্বফা আস-সুবাই বলেন,

شُرُوْطُ الْأَئِمَّةِ لِلْعَمَلِ بِالْحَدِيْثِ أَنَّ هَذَا كَانَ شَرْطُ أَبِىْ بَكْرٍ وَعُمَرَ وَعَلِىٍّ لِلْعَمَلِ بِالْحَدِيْثِ

‘হাদীছের উপর আমলের জন্য মুহাদ্দিছ ইমামগণ যে সমস্ত শর্ত আরোপ করেছেন, সেগুলো মূলত আবুবকর, ওমর ও আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এরই শর্ত, যা তাঁরা হাদীছের আমলের ক্ষেত্রে করেছিলেন’।[২৫] অতঃপর তিনি বলেন,

وَعَلَى هَذِهِ الْعِنَايَةِ سَارَ التَّابِعُوْنَ وَمَنْ بَعْدَهُمْ فِىْ التَّثَبُّتِ فِىْ الرِّوَايَةِ وَالتَّدْقِيْقِ وَالنَّقْدِ وَالتَّمْحِيْضِ وَالتَّحَرَّى فَقَدِ اسْتَطَاعُوْا بِهَذِهِ الْعِنَايَةِ أَنْ يَعْرِفُوْا حَالَ الرَّاوِىْ وَالْمَرْوِىَّ مِنْ حَيْثُ الْقَبُوْلِ وَالرَّدِّ وَمَيَّزُوْا مِنَ الصَّحِيْحِ وَالْحَسَنِ وَالضَّعِيْفِ مِنَ الْمَرْوِيَّاتِ

‘আর এই উপযুক্ত প্রচেষ্টার উপরেই তাবেঈ ও তাদের পরবর্তীগণ বর্ণনাকে সুদৃঢ়করণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষাকরণ, সমালোচনা, পরিশোধন ও অনুসন্ধানের প্রয়াস চালু রেখেছেন। এর ফলেই বর্ণনাকারী ও বর্ণিত ব্যক্তির গ্রহণ ও বর্জনযোগ্য অবস্থা জানতে সক্ষম হয়েছেন এবং বর্ণনাগুলোর ছহীহ, হাসান ও যঈফের মধ্যে পার্থক্য করতে পেরেছেন’।[২৬] যেমন-

عَنِ ابْنِ أَبِىْ الزِّنَادِ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ أَدْرَكْتُ بِالْمَدِيْنَةِ مِائَةً كُلُّهُمْ مَأْمُوْنٌ مَايُؤْخَذُ عَنْهُمُ الْحَدِيْثُ يُقَالُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِهِ

ইবনু আবী যিনাদ তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, ‘আমি মদীনায় প্রায় একশ’ ব্যক্তিকে পেয়েছি, যারা প্রত্যেকেই মিথ্যা থেকে নিরাপদ ছিলেন। তারপরও তাদের কারো নিকট থেকে হাদীছ গ্রহণ করা হত না। কারণ তাদের সম্পর্কে বলা হত তারা হাদীছ বর্ণনার যোগ্য নন।[২৭]

হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে ছাহাবীগণের অন্যতম শর্ত ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে রাবী পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সনদ বর্ণনা করা এবং সনদে উল্লিখিত পরস্পর ব্যক্তিবর্গ ন্যায়পরায়ণ কি-না তা যাচাই করা। কেউ হাদীছ বর্ণনা করলেই তা গ্রহণ করা হত না।

عَنِ ابْنِ سِيْرِيْنَ قَالَ لَمْ يَكُوْنُوْا يَسْأَلُوْنَ عَنِ الْإِسْنَادِ فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ قَالُوْا سَمُّوْا لَنَا رِجَالَكُمْ فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ وَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدَعِ فَلاَ يُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ

তাবেঈ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক সময় লোকেরা সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত না। কিন্তু যখন ফিৎনার যুগ আসল তখন তারা হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকে বলতে লাগল, আপনারা যাদের নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা করছেন আমাদের নিকট তাদের নাম বলুন। অতঃপর তারা যদি ‘আহলে সুন্নাতের’ অন্তর্ভুক্ত হতেন তাহলে তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হত। আর তারা যদি বিদ‘আতীদের অন্তর্ভুক্ত হত, তাহলে তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হত না’।[২৮] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেছেন,

إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِيْنٌ فَانْظُرُوْا عَمَّنْ تَأْخُذُوْنَ دِيْنَكُمْ.

‘নিশ্চয়ই এই ইলম (সনদ) দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তোমরা লক্ষ্য রেখো কার নিকট থেকে তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করছো’।[২৯] সুফিয়ান ছাওরী (৯৭-১৬১ হি./৭১৬-৭৭৮ খ্রি.) বলেন, اَلْإِسْنَادُ سِلاَحُ الْمُؤْمِنِ فَإِذَا لَمْ يَكُنْ مَعَهُ سِلاَحٌ فَبِأَىِّ شئٍ يُقَاتِلُ ‘সনদ হল মুমিনের হাতিয়ার। যখন তার সাথে হাতিয়ার থাকবে না, তখন সে কী দ্বারা যুদ্ধ করবে’? [৩০]

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হি.) বলেন, اَلْإِسْنَادُ مِنَ الدِّيْنِ وَلَوْ لاَ الْإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَاشَاءَ‘হাদীছের সনদ বর্ণনা করা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। যদি সনদ না থাকত তাহলে যার যা ইচ্ছা তা-ই বর্ণনা করত’।[৩১] সা‘দ ইবনু ইবরাহীম বলেন,

لاَيُحَدِّثُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلاَّ الثِّقَاتُ

‘(ছাহাবীদের যুগে) ন্যায়পরায়ণ বা স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ ছাড়া রাসূল (ছাঃ) থেকে কেউ হাদীছ বর্ণনা করতেন না’।[৩২]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


তথ্যসূত্র :
[১]. হাফেয আবু আমর ওছমান বিন আব্দুর রহমান ইবনুছ ছালাহ, মুক্বাদ্দামাহ ইবনুছ ছালাহ (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি), পৃ. ২০।
[২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫১৯৫, ৩য় খণ্ড ৪র্থ অংশ, পৃ. ৫৮৮; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, সনদ হাসান, আলবানী, ইরওয়া, হা/১৫৮৯; মিশকাত, হা/১৭৭ ও ১৯৪, পৃ. ৩০ ও ৩২, টীকা নং ২, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।  
[৩]. ছহীহ মুসলিম, মুক্বাদ্দামাহ দ্রঃ, অনুচ্ছেদ-১।              
[৪]. হাফেয সাখাভী, আল-ক্বাওলুল বালীগ ফী ফাযলিছ ছালাতি আলাল হাবীবিশ শাফি‘, পৃ. ১৯৫; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ১/৪৭-৪৮ পৃ.।
[৫]. ঐ, আল-বাইছ আলা ইনকারিল বিদাঈ ওয়াল হাওয়াদিছ, পৃ. ৬৪-৬৫; আল-হাদীছুয যঈফ ওয়া হুকমুহু ইহতিজাজি বিহী, পৃ. ২৬৮-২৬৯।       
[৬]. ইবনু তায়মিয়াহ, ক্বায়েদাতুন জালীলাহ ফিত তাওয়াসসিল ওয়াল ওয়াসীলাহ, পৃ. ৮৪; আল-হাদীছুয যঈফ ওয়া হুকমুল ইহতিজাজি বিহী, পৃ. ২৬৭।             
[৭]. আল্লামা আহমাদ মুহাম্মাদ শাকের, আল-বায়েছুল হাদীছ, পৃ. ৮৬।         
[৮]. ইমাম মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, ছহীহুল জামে‘ আছ-ছগীর ওয়া যিয়াদাতুহু (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৯৮৬/১৪০৬), ভূমিকা দ্রঃ ১ম খণ্ড, পৃ. ৫০।
[৯]. তামামুল মিন্নাহ, পৃ. ৩৪।
[১০]. ঐ, উলূমুল হাদীছ ওয়া মুছত্বালাহুহূ, পৃ. ২১১-২১২।        
[১১]. তাদরীবুর রাবী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৩। 
[১২]. ড. মাহমূদ আত-ত্বহ্হান, তাইসীরু মুছত্বালাহিল হাদীছ (দিল্লী : কুতুবখানা ইশা‘আতুল ইসলাম তাবি), পৃ. ৮৯।         
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১; ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৯১, ‘নবীদের ঘটনাবলী’ অধ্যায়; মিশকাত, হা/১৯৮, পৃ. ৩২, ‘ইলম’ অধ্যায়।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/১০৯, পৃ. ২১, ‘ইলম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৮। 
[১৫]. ছহীহ ইবনু মাজাহ, হা/৪০, পৃ. ৫, সনদ ‘ছহীহ’।    
[১৬]. ইবনু হিব্বান, আল-মাজরূহীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮; আশরাফ ইবনু সাঈদ, হুকমুল আমাল বিল হাদীছিয যঈফ ফী ফাযাইলিল আ‘মাল (কায়রো : মাকতাবাতুস সুন্নাহ, ১৯৯২/১৪১২), পৃ. ২৫।     
[১৭]. ড. ওমর ইবনু হাসান ওছমান ফালাতাহ, আল-ওয়ায‘উ ফিল হাদীছ (দিমাষ্ক : মাকতাবাতুল গাযালী, ১৯৮১/১৪০১), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩২।
[১৮]. ইমাম নববী, শরহে ছহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮, মুক্বাদ্দামাহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ ২-এর শেষাংশ; আল-ওয়ায‘উ ফিল হাদীছ ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৪; তাইসীরু মুছত্বালাহিল হাদীছ, পৃ. ৯০।
[১৯]. মুহাম্মাদ তাহের পাট্টানী, তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত, পৃ. ৭; আল-ওয়ায‘উ ফিল হাদীছ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৩।   
[২০]. সূরা আল-আন‘আম : ১৪৪; সূরা আল-আ‘রাফ : ৩৩; সূরা আল-হুজুরাত : ৬; ছহীহ বুখারী, হা/১০৬, ১০৯, ১২৯১, ৩৪৬১, ৫১৪৩; ইমাম আবুল হুসাইন মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল-কুশাইরী, ছহীহ মুসলিম (দেওবন্দ : আছাহহুল মাতাবে‘ ১৯৮৬), হা/৩, ৪, ২৫৬৩; মিশকাত হা/১৯৮, ৫০২৮।
[২১]. ছহীহ মুসলিম, মুক্বাদ্দামা দ্রঃ ১ম খণ্ড, পৃ. ৯, অনুচ্ছেদ-৩।  
[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/১০৭, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১, ‘ইলম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৮।
[২৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১০৮, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১।       
[২৪]. প্রফেসর ড. হাসান মুহাম্মাদ মাক্ববূলী আল-আহদাল, মুছত্বালাহুল হাদীছ ও রিজালুহু (ছান‘আ- সউদী আরব : মাকতাবাতুল জীল আল-জাদীদ, ১৯৯৩/১৪১৪), পৃ. ৩৮।  
[২৫]. ড. শায়খ মুছত্বফা আস-সিবাঈ,  আস-সুন্নাহ  ওয়া  মাকানাতুহা  ফিত  তাশরীঈল  ইসলামী, পৃ. ৬৭।    
[২৬]. প্রফেসর ড. হাসান মুহাম্মাদ মাক্ববূলী  আল-আহদাল,  মুছত্বালাহুল  হাদীছ  ওয়া  রিজালুহু, পৃ. ৩৮।     
[২৭]. ছহীহ মুসলিম শরহে নববী সহ, মুক্বাদ্দামাহ দ্রঃ, অনুচ্ছেদ-৫, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২, হা/৩০।     
[২৮]. ছহীহ মুসলিম মুক্বাদ্দামাহ দ্রঃ, অনুচ্ছেদ-৫, ১/১১ পৃঃ হা/২৭।      
[২৯]. ছহীহ মুসলিম হা/২৬, ১/১১ পৃঃ।      
[৩০]. আবুবকর খত্বীব আল-বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ; আস-সুন্নাহ ক্বাবলাত তাদবীন, পৃঃ ২২৩।         
[৩১]. ছহীহ মুসলিম, মুক্বাদ্দামাহ দ্রঃ, হা/৩২, ১/১২, অনুচ্ছেদ-৫।       
[৩২]. ছহীহ মুসলিম, মুক্বাদ্দামাহ দ্রঃ, হা/৩১, ১/১২ পৃঃ, অনুচ্ছেদ-৫।          




ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৯ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (৯ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ক্যারিয়ার : শিক্ষক নিবন্ধনের প্রস্তুতির ধরন ও বিষয়াবলী - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
মসজিদ : ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
এমফিল ও পিএইচডি : গবেষণার প্রকৃতি ও পদ্ধতি - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২০তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন - মাইনুল ইসলাম মঈন

ফেসবুক পেজ