ইসলামী সংগঠন ও তরুণ-যুবক-ছাত্র
-ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
(শেষ কিস্তি)
তাফসীরকারকগণ উপর্যুক্ত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা ও প্রাসঙ্গিক কাহিনী বিশুদ্ধ হাদীছের বরাতে উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহ বিন ছামের নামক[১] একটি ছেলে সেই যুগে রাজ-দরবারের যোগ্য যাদুকর হবার উদ্দেশ্যে এ বিদ্যা শিক্ষার জন্য গুরুর কাছে যাতায়াতের পথে এক নিষ্ঠাবান (খৃষ্টান) ধর্মযাজকের সাক্ষাৎ পায়। তার কাছ থেকে সে (তাওহীদভিত্তিক) সত্য দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে ও তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকে। ছেলেটির কাছ থেকে রোগমুক্তি সহ বিভিন্ন ধরণের কারামত প্রকাশ হতে থাকে। কিছু-কিছু লোক তার হাতে তাওহীদের দ্বীন গ্রহণ করে। শিরকে নিমজ্জিত তৎকালীন রাজা প্রথমতঃ ধর্মযাজককে করাত দিয়ে চিরে হত্যা করে। অতঃপর ছেলেটিকে প্রথমে তাওহীদের দ্বীন পরিবর্তন করতে বলে। সে অস্বীকার করলে তাকে হত্যা করার বহু প্রচেষ্টা (সাগরে নিক্ষেপ করা, পর্বত থেকে নিচে ফেলে দেয়া ইত্যাদি) চালায়; কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় তার সবই ব্যর্থ হয়। অতঃপর ছেলেটি শাসককে নিজেই বলে দেয় তাকে হত্যা করার পদ্ধতি। ‘বিসমিল্লাহি রাব্বিল গোলাম’ (আল্লাহর নামে যিনি এই বালকের রব) এই বলে যদি তাকে তীর মারা হয় তাহলে সে নিহত হবে। রাজা হাজার-হাজার জনতার সামনে তাকে শূলে চড়িয়ে তাওহীদের বাণীর মৌখিক স্বীকৃতি দিয়ে উপর্যুক্ত বাক্য ‘বিসমিল্লাহি রাব্বিল গোলাম’ পাঠ করে তীর ছুড়লে তা তার কপালে বিদ্ধ হয় এবং সে শহিদী মৃত্যু লাভ করে। এই দৃশ্য দেখে হাজার-হাজার মানুষ শহীদ ছেলেটির ধর্ম- ‘তাওহীদের দ্বীন’ গ্রহণ করে এবং রাজাকে ‘রব’ হিসাবে মানতে অস্বীকার করে বসে। রাজা তাদের উপর প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে বিশাল গর্ত খুঁড়ে তাদেরকে সেখানে নিক্ষেপ করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে মারে।[২]
উপরিউক্ত আয়াতসমূহ এবং সেগুলোর তাফসীরে বালকের সত্য দ্বীন গ্রহণ, তাওহীদের উপর দৃঢ়তা, শিরক প্রত্যাখ্যান ও তার বিরোধিতা, সত্য-দ্বীন প্রচার ও দাওয়াত এবং তার জন্য কৌশল অবলম্বন, সকল প্রকার চ্যালেঞ্জ এমনকি জীবনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ, মৃত্যুর বিনিময়ে শাসকের মুখ দিয়ে তাওহীদের বাণী উচ্চারণ করানো, তার মৃত্যুর হৃদয়বিদারক অবস্থা দেখে হাজার-হাজার মানুষের তাওহীদের সঠিক দ্বীন গ্রহণ ইত্যাদি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। সুতরাং সকল যুগের তরুণ-যুবকদের জন্যই উপর্যুক্ত ছেলেটি দ্বীনী ও দাওয়াতী আদর্শ। উল্লেখ্য, ছেলেটি তৎকালীন শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেনি আবার ক্ষমতার দ্বন্দ্বেও অবতীর্ণ হয়নি। তারপরেও তার প্রতি এবং অন্যান্য তাওহীদপন্থীদের উপর এই লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক শাস্তি প্রয়োগ করা হয়। যার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলার কাছে তাদের সর্বোচ্চ মর্যাদা ও মহাকৃতকার্যতা[৩] শাহাদত লাভ ও জান্নাতের গ্যারান্টি মেলে।[৪]
তরুণ-যুবকদের মনে রাখতে হবে যে, তারা ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের পরামর্শ ছাড়া কোন সাংগঠনিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না ও সীমালঙ্ঘন করবে না। কেননা কার উপর কোন্ দায়িত্ব কখন দিতে হবে, কী ধরণের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে তা বয়স্ক, অভিজ্ঞ ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলগণ ভাল বুঝবেন। যথাযথ কর্ম-নির্ণয়, কর্মবণ্টন ও তার পদ্ধতি নির্ধারণ মূলত তাঁদেরই কাজ। তা নাহলে সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে এবং অকারণ ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। সংগঠনের কর্মজাল (Network), নির্দেশ পরম্পরা (Chain of Command) এবং সম্মিলিত কর্মশক্তির গতি (Team Spirit) নষ্ট হবে, যা সর্বস্তরে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করবে। যেমনটা হয়েছিল উহুদের যুদ্ধে। গিরিপথে আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কমান্ডে নিয়োজিত পঞ্চাশ জন তীরন্দাজ প্রধান সেনাপতি (স্বয়ং নবী (ﷺ)-এর নির্দেশনা (সর্বাবস্থায় যথাস্থানে টিকে থাকতে হবে) ভুলে গিয়ে ও স্থানীয় কমান্ডারের আদেশ উপেক্ষা করে বিজয় নিশ্চিত মনে করে স্থান ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধের মূল ময়দানে ফিরে আসে। তখন পরাজিত মুশরিকরা সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ঐ গিরিপথ দিয়েই খালিদ বিন ওয়ালিদের (ইসলাম গ্রহণের পূর্বে) নেতৃত্বে পুনরায় সুনিপুণ রণকৌশলে আক্রমণ রচনা করে ময়দানে ঢুকে পড়ে এবং মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয় ঘটায়।[৫]
যুবকেরা বহু সাহসী কাজ করেছে কিন্তু তা নবী (ﷺ)-এর নির্দেশ কিংবা অনুমোদন সাপেক্ষে। আর স্থায়ী পরামর্শ দাতা ছিলেন আবূ বাকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মত সিনিয়র ছাহাবীগণ যাঁরা কেউ কেউ পরবর্তীতে খলীফাহ হন কিংবা খলীফাগণের পরামর্শদাতা হন।
তাদেরকে আরো মনে রাখতে হবে যে, একটি শান্তিপ্রিয় মুসলিম দেশে আবেগ কিংবা ক্রোধ-তাড়িত হয়ে কোন ধরণের অবৈধ ও অশান্তি সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। নবী (ﷺ)-এর রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে মুসলিম-অমুসলিম উভয় পক্ষের মধ্যে ঘোষিত সুশৃঙ্খল প্রকাশ্য যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া, আর গ্রুপ সৃষ্টি করে জেহাদের নামে খামাখা এখানে সেখানে ত্রাস সৃষ্টি করা কখনই এক কথা নয়। মূল কাজ হল- যথাযথ জ্ঞানার্জন, জ্ঞান বিতরণ, কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে দ্বীনী জীবন গঠন, দাওয়াত ও প্রচারে আত্মনিয়োগ, সমাজ সংস্কারে মনোনিবেশ, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পরস্পর জামা‘আতবদ্ধ হওয়া ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মতৎপরতা পরিচালনা করা তদুপরি বৈধ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে পদচারণা ও এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং জনমত পূর্ণাঙ্গ দ্বীন-ইসলামের অনুকূলে নিয়ে আসার যথাসাধ্য চেষ্টা করা- ইত্যাদি ইত্যাদি। যে কোন সামষ্টিক কর্মেই যুব কর্মীরাই মাঠের সফল কর্মী। তারা তো নব নব পীরতন্ত্র ও পুরোহতিতন্ত্রের সমর্থক হয়ে যথাকর্মবিমুখ ও স্থবির হয়ে যেতে পারে না। অযৌক্তিক অন্ধভক্তির মায়াজালেও পতিত হতে পারে না; যদিও আদব-আখলাক্ব ও শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই থাকতে হবে। তারা উদ্দেশ্যমুলক বা অপরিণামদর্শী হাস্যকর বক্তব্যেও মুগ্ধ হতে পারে। যেমন এগুলো পারেননি ‘আছহাবে কাহ্ফের’ সেই যুবকেরা, ‘আছহাবে উখদূদের’ কাহিনীতে সংশ্লিষ্ট তরুণ আব্দুল্লাহ বিন ছামের এবং নবী (ﷺ)-এর যুগের তরুণ যুবকেরা এমন কি ‘আযরের’ যুগে স্বযং ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ জমঈয়তে আহলে হাদীছের সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. আব্দুল বারী (রাহিমাহুল্লাহ) প্রসঙ্গত বলেন : “... তবু এ সাধনায় আমাদের জয়লাভ করতেই হবে। আর বিজয়কে সম্ভব করতে পারেন একদল সৎ, ধর্মভীরু, নির্লোভ, বুদ্ধিমান, সহানুভূতিশীল ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। সমাজের সকল স্তর থেকেই হোক এদের উদ্ভব। কারণ পুরোহীততন্ত্রে অনাস্থাবান মুসলমানরা তো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অমর বাণী ‘أَلَا كُلُّكُمْ رَاعٍ’ (তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল)-এ পরিপূর্ণ বিশ্বাসী।[৬]
তরুণ-যুবক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মনে-মগজে শুধু জড়বাদী ও পার্থিব স্বার্থান্বেষণের চিন্তা প্রবেশ করানো দুরারোগ্য ক্যান্সারের জীবানু ঢোকানোর মতই বা তার চাইতেও মারাত্মক। কুপরিবেশে পড়ে তরুণ-যুবক ছাত্র-ছাত্রীরা যদি একদিকে আদর্শিক ও নৈতিকভাবে দেওলিয়া হয়ে হয়ে পড়ে অন্য দিকে মাদকাসক্তি, অবাধ নারী-পুরুষ মিশ্রণ ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও প্রতিপক্ষ দমনের ছাড়পত্র পেয়ে যায়; তাহলে সেটাতো আর ইসলামী পরিবেশ নয়; বরং সুস্পষ্ট জাহিলিয়্যাতের পরিবেশ। যেমনটা জাহেলী যুগের এক ব্যক্তি অবাধ্য দুষ্ট-সন্তানদের নিয়ে তার খেদোক্তি কবিতাকারে প্রকাশ করছে :
إِنَّ بَنِيَّ كُلُّهُمْ كَالْكَلبِ ... أَبَرُّهُّمْ أَوْلَاهُمْ بِسَبِّيْ
لَمْ يُغْنِ عَنْهُمْ أَدْبِيْ وَضَربِي ... وَلَا إتِّساعِي لَهُم ورُحبِي
فَلَيتَنِي مِتُّ بِغَيْرِ عَقْبِ ... أَولَيْتَنِي كُنتُ عَقِيمَ الصُّلبِ
‘আমার সন্তানেরা সবাই কুকুরের মত; তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে ভালো সেও আমার গালি খাওয়ার অধিকতর যোগ্য। আমার শাসন (আদব শিক্ষা দান) ও পিটুনিতে তাদের কোনই লাভ হয়নি; এমনকি আমার পক্ষ থেকে ছাড় দিয়েও তাদের জন্য জীবনযাত্রার মান প্রশস্ত ও স্বচ্ছল করেও নয়। হায়! আমি যদি কোন বংশধর না রেখে মারা যেতাম কিংবা যদি দৈহিকভাবে সন্তান দানে অক্ষম (আঁটকুড়ে) হতাম! (তাহলে সেটাই ভালো ছিল)’।
এখান থেকে উদ্ধার পেতে হলে ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’ মার্কা মাঝে মধ্যে কিছু কর্মসূচি গ্রহণ বা প্রশাসনিকভাবে গৃহীত কিছু সাময়িক প্রতিরোধ ও দমন কার্যক্রম কি যথেষ্ট? এগুলোর ফলাফল খুবই ক্ষণস্থায়ী; আবার এর প্রতিক্রয়াও (Reaction) কম নয়। তাই যথাযথ পরিকল্পনায় ইসলামী কায়দায় তরুণ-যুবক ও ছাত্র-ছাত্রীদের গড়ে তুলতে হবে।
যুগের পরিবর্তনে অনেক কিছুরই বাহ্যিক উন্নতি ঘটতে পারে, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বহু কিছু আবিষ্কৃত হতে পারে, অর্থনৈতিক উন্নতি বলতে আধুনিক চিন্তাবিদদের অনেকে যা বুঝেন তাও সাধিত হতে পারেÑ কিন্ত যে মানুষ এই পৃথিবীর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়; তার কী হবে? সুসভ্য মানবিক পৃথিবী তো আর স্বার্থান্ধ অসভ্য মানুষ দিয়ে গড়ে ওঠবে না কিংবা টিকেও থাকবে না। মানুষগুলো সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত দ্বীন ইসলামের পথ অনুসরণ না করে পার্থিব সকল কিছু সাথে নিয়েই তো দিন-দিন ধ্বংসের অতল তলে নিমজ্জিত হচ্ছে।
আজকে যারা শিশু কালকে তারা তরুণ-যুবক। জীবনের সূচনা থেকেই তাদের ঈমানী, নৈতিক, চারিত্রিক, দৈহিক, মেধাগত, আত্মিক, মনস্তাত্মিক, আদর্শিক, সামাজিক সকল বিষয়ে সার্বিক ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠতে হবে। কোন সচেতন মুসলিম তরুণ-তরুণী বা ছাত্র-ছাত্রী মাঠে-ময়দানের হাওয়ার পেছনে ছুটতে পারে না। তার ইসলামী আদর্শই তাকে গ্রহণীয় ও বর্জনীয় বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে সঠিক নীতিতে অটল ও সচল রাখবে। আর এই উন্নত চরিত্র ও আদর্শিক জ্ঞান সময় মত অর্জন না করলে জীবনের গতি পথে বিশেষ করে শিক্ষা জীবনে সঠিক পথে অবিচল থাকা ও ভুল পথ পরিহার করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত একজন আরবী কবির কবিতা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে :
قَدْ يَنْفَعُ الْأَدَبُ الْأَوْلَادَ فِي الصِغر .. ولَيْسَ يَنْفَعُهم مِن بَعْدِه أَدبُ
إِنَّ الغُصُوْنَ إذا قَوَّمتَها اعتَدلَت.. ولا تَلِينُ وَلَوْ قَوَّمتَها وَهِي الْخَشَبُ
‘ছোট কালে সন্তানদের মধ্যে আদব-শিক্ষা-দীক্ষা উপকারী হয়; কিন্তু এর পর কোন আদব-শিক্ষা-দীক্ষা উপকারে আসে না (আসতে চায় না)। নিশ্চয় গাছের শাখাগুলোকে (কাঁচা অবস্থায়) যদি সোজা কর তাহলে সেগুলো সোজা হবে; কিন্তু সেগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া অবস্থায় যদি সোজা করতে যাও তাহলে তা নরম ও সোজা হয় না (হয় যা আছে তাই থাকে নয় ভেঙ্গে যায়)’। বাংলা প্রচলিত কথায় যাকে বলে :
‘কাঁচায় না বাঁকালে বাঁশ
পাকলে ভাঙ্গে টাশ-টাশ’।
বিখ্যাত আরবী কবি আহমদ বেগ শাউকী মিসরী বলেছেন :
إِنَّمَا الْأُممُ بِالأَخلاقِ فإنْ .. هم ذَهبَتْ أخلاقُهُم ذَهَبُوا
‘উম্মত গঠিত হয় ও টিকে থাকে উন্নত চরিত্রের বলে
আর যদি তাদের চরিত্র হারায় তাহলে তারা নিজেরাই হারিয়ে যায়’।
যেটাকে ইংরেজীতে বলা হয় :
“Money is lost nothing is lost, health is lost something is lost, character is lost everything is lost.”
যুবকদের তাদের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থেকে প্রেরণা নিয়ে হতাশা ঝেড়ে ফেলে সদা কর্মোদ্দমী থাকা কর্তব্য। আরবীয় যুবক কবি হাশেম আর-রিফা‘য়ী তাঁর কবিতায় বলেন,
تَرَى هَلْ يَرْجِعُ الماضي فإِنِّيْ ...أَذُوْبُ لِذَلِك المَاضي حَنِيْنا
شَبابٌ ذَلَّلُوا سُبلَ المَعالي ... وَمَا عَرفُوا سِوى الْإِسلامِ دِيْنا
إذا شهدوا الوغَى كانوا كُماةً .... يدّكُون المعاقلَ والحُصونا
وإن جَنَّ عليهم الظَلامُ فَلا تَرَاهُم .... مِن الإِشْفَاق إِلَّا سَاجِدِينا
كَذلِك أَخْرَجَ الْإِسْلَامُ قَوْمِي ... شَبَابًا طَاهِرًا حُرًّا أَمِيْنًا
أَمُدُّ يَدي فَأنتَزعُ الرَّوَاسِي .... وأَبنِي المَجْدَ مُؤْتَلِفًا مَكِينًا
‘এটাকি আশা করা যায় না যে, অতীত আবার ফিরে আসবে? আমিতো সেই অতীতের কথা স্মরণ করে তার প্রতি আবেগাপ্লুত ও বিগলিত হয়ে পড়ি।
তখন এমন যুবকেরা ছিল যারা উচ্চতা ও সম্মানের পথগুলো সহজ করে ফেলেছিল। যারা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন কিছুকে দ্বীন হিসাবে জানেনি মানেনি।
যখন তারা যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হত তখন তারা মহাবীর হয়ে যেতো। তারা প্রতিপক্ষের ঘাঁটি এবং দুর্গগুলোকে (সদর্পে) পদানত করত।
আর যখন রাতের অন্ধকার চতুর্দিকে ছেয়ে নিত, তখন তাদেরকে দেখতে পেত (আল্লাহর) ভয়ে সেজদা রত।
আর এভাবেই ইসলাম আমার কওমকে প্রস্তুত করেছিল; যুবক হিসাবে তারা পবিত্র, স্বাধীন এবং আমানতদার।
আমি আমার হাত সম্প্রসারিত করে পর্বতগুলোকে (স্থানচ্যুত করে) ছিনিয়ে নেই এবং সমুজ্জ্বল, সুদৃঢ় স্থায়ী মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করি!’
কোন কওম যদি তার স্বজাতির অতীত ইতিহাস চর্চা না করে তাহলে সেটি যেমন অপরাধ ঠিক তেমনই তারা যদি ইতিহাস চর্চা করে কর্তব্যকর্মবিমুখ হয়ে শুধু গালগপ্পে মাতোয়ারা হয়ে থাকে বা নিশ্চুপ থাকে-সেটিও নিন্দনীয় বিষয় ও অধঃপতনের সাক্ষাৎ আলামত। জমঈয়তে আহলেহাদীছের সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. আল্লামা আব্দুল বারী সাহেব বলেন, ‘কোন জনগোষ্ঠী বা কোন প্রতিষ্ঠানই (শুধু) তার অতীত নিয়ে কোন দিন বেঁচে থাকতে পারে না। সে অতীত যত মহান ও তাৎপর্যপূর্ণ হোক। অতীতের দৃঢ় ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে একটি সুন্দর, সার্থক ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে বর্তমানে সাধনা না করলে আমরা ব্যর্থ হতে বাধ্য’।[৭]
তরুণ-যুবক-ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের প্রথম থেকেই জেনে নিতে হবে- ইসলাম বনাম জাহিলিয়্যাত, ঈমান বনাম কুফর, তাওহীদ বনাম শিরক, সুন্নাত বনাম বিদ‘আত, তাক্বলীদ (অন্ধ অনুকরণ তা জাতীয় হোক বা বিজাতীয়) বনাম ইত্তেবা‘, সুসংস্কার বনাম কুসংস্কার, সুকৃষ্টি বনাম কুকৃষ্টি, সুসভ্যতা বনাম কুসভ্যতা- সেগুলো কী এবং কেমন। মুসলিম সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আধুনিক মতবাদ (Modern Thoughts), (দার্শনিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক যেটা হোক), অনৈসলামিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, মুক্তবুদ্ধি চর্চার নামে দুষ্টবুদ্ধির চর্চা এবং পাশ্চাত্বের প্রাচ্যবিদদের সেই ইসলাম বিরোধী পুঁতিগন্ধময় মিথ্যাচার ও প্রতারণার চর্বিত চর্বন, পুরাতন কাশন্দি ঘাটন ও তাদের নির্গত বমন গলধঃকরণপূর্বক নির্লজ্জভাবে পরিবেশন, কথিত যুক্তিবাদের (জধঃরড়হধষরংস) নামে অন্তসারশূন্য কুযুক্তির আবতারণ- ইত্যাদি প্রসঙ্গে খুবই সজাগ থাকা কর্তব্য। নাস্তিক্যবাদ (Infidelity), ধর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করার যে তত্ত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Securalism), কমিউনিজম (Communism) ও সমাজতন্ত্র (Socialism) সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার থাকা বাঞ্ছনীয়। বিজ্ঞানকে নাস্তিকদের একক কীর্তি ও নিজস্ব সম্পদের মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে একদল। আরেক শ্রেণির দুর্গতিসম্পন্ন লোক ধর্মকে প্রগতিবিরোধী আখ্যা দিয়ে ভুয়া বাজিমাত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এদের থেকে মুসলিম তরুণ-তরুণী ও ছাত্র-ছাত্রীদের সাবধান থাকতে হবে ও তাদের যথাযথ জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ জমঈয়তে আহলেহাদীছের সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. আব্দুল বারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন এভাবে, ‘প্রগতি কিসের? মনুষ্যত্বের না পশুত্বের? আমার মতে প্রগতির মাপকাঠি তো সেটাই হওয়া উচিত যার মাধ্যমে আমি বুঝতে পারব যে, আমি জৈব স্থুল প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়েছি না পশুশক্তিকে জয় করে উচ্চতর মনুষ্যত্বের সোপান বেয়ে চলেছি। ধর্মহীন জড়বাদী বিজ্ঞানের অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আজ সজাগ ও সচেতন’।[৮]
নোবেল পুরস্কার বিজয় বিজ্ঞানী মিলিকান (R. A Millikam) বলেন, ‘Religion and science, then, in my analysis, are the two great forces which have pulled and are still pulling mankind onward and upward.’ ‘অতএব আমার বিশ্লেষণ মতে ধর্ম ও বিজ্ঞান হল সেই দুই মহান শক্তি যা অতীতে মানব গোষ্ঠীকে সম্মুখ ও ঊর্ধ্বপানে আকর্ষণ করেছে এবং এখনও করছে’।
পৃথিবীবিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন (Einstein) বলেন, ‘Science without religion is lame, religion without science is blind.’ ‘ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু এবং বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ’।
মুসলিম দেশগুলোতে ইহুদীদের বিভিন্ন চক্রান্ত তাদের যিওনিষ্ট আন্দোলন (Zionist Movement) এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের (Christion Missionary) ইসলাম ও মুসলিম বিদ্ধেষী বিভিন্ন ধরণের কুশলি কার্যক্রম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়াও যরূরী। প্রচলিত ও সদ্য আমদানীকৃত (Newly Imported) বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির শরী‘আতি মূল্যায়ন প্রসঙ্গে তাদের সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা যরূরী। তাহলে জীবনের গতিপথে তাদেরকে আর কেউ বিভ্রান্ত করে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।
প্রফেসর ড. আব্দুল বারী (রাহিমাহুল্লাহ) অন্যত্র উল্লেখ করেছেন, ‘ফ্রয়েডকে যারা পীর মানেন তারা বলেন, কুসংস্কার ও ধর্মের যুগ পেরিয়ে মানুষ এখন বিজ্ঞানের যুগে প্রবেশ করেছে। এ যুগে ধর্ম অচল। ওদিকে কার্ল মার্কসের উম্মতদের কাছে ধর্ম আফিম ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলাম ও তার কালজয়ী বিশ্বজনীন শিক্ষা ও অবদান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ পাশ্চাত্যের পুচ্ছগ্রাহী এই নব্যতন্ত্রীরা তাদের পীরপয়গম্বরদের অনুকরণে সামাজিক অনাচার ও অবিচার নিরসনে অন্যান্য ধর্মের চরম ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে ইসলাম সম্পর্কেও তাদের লম্বা ফাতাওয়া জারি করেন : Religion is the opium of the people (ধর্ম হল মানুষের জন্য আফিম স্বরূপ)।[৯]
তিনি অন্যত্র উল্লেখ করেছেন, ‘লা-দ্বীনী সেক্যুলারিজম প্রসঙ্গে যুবকদেরকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘তানযীম, তাবলীগ, তাসনীফ ও তা‘লীম- জমঈয়ত পরিগৃহীত এই চারটি কর্মক্ষেত্রেই আমরা তাঁরই কৃপায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভে সমর্থ হয়েছি। সাংগঠনিক অধিবেশনে ইনশাআল্লাহ এ সম্পর্কিত রিপোর্ট আপনাদের সমীপে পেশ করা হবে। জমঈয়ত এখন নতুন কিছু উদ্দোগ গ্রহণে আগ্রহী। লা-দ্বীনী সেক্যুলারিজমের বিষ-বাষ্প থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের হেফাযত করতে হবে। এদের মনে আমাদের আক্বীদা ও আমল, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে গৌরব-বোধ জাগ্রত করতে হবে।[১০]
তরুণ ও যুবকদের সব সময় মনে রাখতে হবে আল্লাহ তা‘আলার এই বাণী :لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا ‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ এর মধ্যেই রয়েছে উত্তম আদর্শ; তাদের জন্য যারা আল্লাহর আশা করে এবং আখেরাতে দিবসের (আশা করে) এবং আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করে’ (সূরা আল-আহযাব : ২১)।
*অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
তথ্যসূত্র :
[১]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪৩০।
[২]. ছহীহ মুসলিম, বিভাগ : যুহদ, অধ্যায় : আছহাবুল উখদুদ, যাদুকর এবং ধর্মযাজকের কাহিনী, হা/৭৫১১; তাফসীর ইবনু কাছীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪২৭-৪৩১।
[৩]. আল-ফাউযূল কাবীর।
[৪]. সূরা আল-বুরূজ, আয়াত : ১০-১১-এর তাফসীর দ্র.।
[৫]. হাদীছ ও সীরাতুন্নবীর প্রতিটি গ্রন্থেই এর বিবরণ রয়েছে। বিশেষ করে ছহীহ বুখারী, মাগাযী, অধ্যায় : উহুদের যুদ্ধ; ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ, পৃ. ৫২৪-৫২৫, যাদুল মা‘আদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৯৬।
[৬]. প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী, ধর্ম বিজ্ঞান প্রগতি (ঢাকা, ২০০০), পৃ. ৪৩।
[৭]. ধর্ম বিজ্ঞান প্রগতি, পৃ. ৪০।
[৮]. ধর্ম বিজ্ঞান প্রগতি, পৃ. ২২।
[৯]. ধর্ম বিজ্ঞান প্রগতি, পৃ. ১৪।
[১০]. ডক্টর মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল বারী, তাবলীগে দ্বীন ও আহলেহাদীছ আন্দোলন (হাদীস প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং হাউজ, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ, ১৯৮৫), পৃ. ৩৯, ৪০।