বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ অপরাহ্ন

ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ

-ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন*


(৭ম কিস্তি)

আত্মপ্রশংসা এড়ানো ও অন্যের কাজের স্বীকৃতি দেয়া

নেতৃত্বকে সবসময় যথাসম্ভব মহত্ত্ব ও উদারতার প্রতীক হিসাবে বিরাজ করতে হয়। তিনি নিজেকেই একক যোগ্য হিসাবে ভাববেন না বা কোন প্রকারে এ জাতীয় কিছুর বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেন না। তিনি কখনো আত্মপ্রশংসা করবেন না। যে কোন কাজের কৃতিত্ব-ক্রেডিট নিজে নেবার চেষ্টা করবেন না বা অন্যের কৃতিত্বে ভাগ বসাবেন না; বরং যতটা পারেন নিজের কৃতিত্বের ভাগ অন্যকে দেয়ার চেষ্টা করবেন। তাঁকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এটাই তার জন্য চূড়ান্ত কৃতিত্ব ও স্বীকৃতি। যে নেতা আত্মপ্রশংসা করেন বা নিজেই সব ক্রেডিট নিতে চান কিংবা অপরের কাজের স্বীকৃতি দিতে চান না বা তাতে কার্পণ্য করেন অথবা অন্যের কৃতিত্বে কোনো না কোনোভাবে ভাগ বসাতে চান - তার প্রতি মানুষ প্রকাশ্যে বা গোপনে বিরক্ত ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। আর সাংগঠনিক ও জামা‘আতী কাজটা এমন যে, সেখানে অধিকাংশ কাজেই কারো না কারো কোনো না কোনো দিক থেকে কিছু না কিছু অবদান থাকেই। তদুপরি এ জাতীয় একক দাবীর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে অন্যকে খাটোও করা হয়। আর সঙ্কীর্ণমনা ও প্রদর্শনেচ্ছু নেতৃত্ব দিয়ে ইসলামী সমাজের বৃহত্তর কোন মহৎ কর্ম আশা করা যায় না। অপরকে সত্যিকার কৃতিত্বের উদার স্বীকৃতি প্রদান নেতৃত্বের সততা ও মহত্ত্বেরই বহিঃপ্রকাশ, সাথে সাথে তা কর্মীদের কর্মপ্রেরণার জন্যও সহযোগী। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রী খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাঁর নিজের জন্য ও ইসলামের জন্য সকল প্রকার ত্যাগ-তিতিক্ষার স্বীকৃতি গভীর আন্তরিকতার সাথে প্রকাশ্যে দিয়েছেন।[১] যে ক’জন মহিলা প্রথম হাবাশায় হিজরত করেছিলেন তাঁদের তিনজনই স্বামী বিয়োগের পর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রী হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছিলেন।[২] আবূ বাকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রতি তিনি প্রকাশ্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন, যেমনটা আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ مِنْ أَمَنِّ النَّاسِ عَلَىَّ فِىْ صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبَا بَكْرٍ وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيْلًا غَيْرَ رَبِّىْ لَاتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ وَلَكِنْ أُخُوَّةُ الْإِسْلَامِ وَمَوَدَّتُهُ لَا يَبْقَيَنَّ فِى الْمَسْجِدِ بَابٌ إِلَّا سُدَّ إِلَّا بَابَ أَبِىْ بَكْرٍ

‘মানুষের মধ্যে আমার প্রতি যার সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে সঙ্গদান ও ধন-সম্পদ খরচার দিক থেকে, তিনি হলেন আবূ বাকর। আর আমি যদি আমার রব্কে ছাড়া অন্য কাউকে খলীল (বন্ধু) হিসাবে গ্রহণ করতাম, তাহলে আবূ বাকরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম। তবে ইসলামের ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ থাকবে। মসজিদের (মসজিদে নববীর) যত দরজা আছে তার সব ক’টিই বন্ধ করে দেয়া হোক শুধু আবূ বাকর-এর দরজা ছাড়া’।[৩]

মহাবীর খালিদের বীরত্বের স্বীকৃতি দিয়ে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ‘সাইফুল্লাহ’ (আল্লাহর তরবারী) উপাধি দিয়েছেন।[৪] এছাড়া নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের স্বীকৃতি দিতে বলেছেন ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে বলেছেন।

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أُعْطِىَ عَطَاءً فَوَجَدَ فَلْيَجْزِ بِهِ فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَلْيُثْنِ بِهِ فَمَنْ أَثْنَى بِهِ فَقَدْ شَكَرَهُ وَمَنْ كَتَمَهُ فَقَدْ كَفَرَهُ

জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কাউকে যদি কেউ কিছু দেয় আর সে যদি তার প্রতিদান দিতে সক্ষম হয় তাহলে সে যেন তা করে; আর যদি সে তাতে অক্ষম হয় তাহলে যেন কমপক্ষে প্রশংসা করে। যে প্রশংসা করে সে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে আর যে তা গোপন করে সে অকৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে’।[৫]

জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে আরো বর্ণিত আছে। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنْ أَبْلَى بَلَاءً فَذَكَرَهُ فَقَدْ شَكَرَهُ وَإِنْ كَتَمَهُ فَقَدْ كَفَرَهُ ‘কেউ যদি কারো সহযোগিতা লাভ করে বা উপকৃত হয় আর তা সে উল্লেখ করে বা স্বীকৃতি দেয়, তাহলে সে তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। আর যদি গোপন করে তাহলে সে কৃতঘ্নতা করল’।[৬]

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِىِّ  صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا يَشْكُرُ اللهَ مَنْ لَا يَشْكُرُ النَّاسَ. وَرَوَى الْتِرْمِذِيْ عَنْهُ بِلَفْظٍ : "مَنْ لَا يَشْكُرِ النَّاسَ لَا يَشْكُرِ اللهَ"

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ঐ ব্যক্তি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে না, যে মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না’।[৭] হাদীছটি তিরমিযীতে এসেছে এই ভাষায়, ‘যে মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না সে আল্লাহরও শুকরিয়া আদায় করে না’।[৮]

নেতা হোন বা কর্মী, তিনি কখনো আত্মপ্রশংসার এই নীরব-ঘাতক ব্যাধিতে (আদ্দা-আদ্দাফীন) আক্রান্ত হবেন না। এই মারাত্মক রোগ কর্মীদের নিকট নেতৃত্বের ওজন ও গুরুত্ব কমিয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়;  এ রোগে আক্রান্ত একজন কর্মীকেও আরেকজন কর্মীর সামনে হাল্কা করে দেয় ও সমালোচনার বিষয়ে পরিণত করে। অতি প্রশংসা ইসলামপন্থী নেতা বা কর্মীদের মানসিক ও নৈতিক ক্ষতি করে এবং তার কর্মোদ্যম ব্যাহত করে। এ বিষয়ে বেশ কিছু হাদীছও এসেছে। একবার একজন আরেকজনের তা‘রীফে বাড়াবাড়ি ও প্রশংসায় অতিরঞ্জন করছিল; কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা পসন্দ করেননি।

عَنْ أَبِىْ بَكْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ أَثْنَى رَجُلٌ عَلَى رَجُلٍ عِنْدَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ وَيْلَكَ قَطَعْتَ عُنُقَ صَاحِبِكَ قَطَعْتَ عُنَقَ صَاحِبِكَ مِرَارًا ثُمَّ قَالَ مَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَادِحًا أَخَاهُ لَا مَحَالَةَ فَلْيَقُلْ أَحْسِبُ فُلَانًا وَاللهُ حَسِيْبُهُ وَلَا أُزَكِّىْ عَلَى اللهِ أَحَدًا أَحْسِبُهُ كَذَا وَكَذَا إِنْ كَانَ يَعْلَمُ ذَلِكَ مِنْهُ

আবূ বাকরাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, কোন এক ব্যক্তি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে আরেক ব্যক্তির প্রশংসা করছিল, তখন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘তোমার ধ্বংস হোক, তুমি (অতি প্রশংসা করে) তোমার সঙ্গীর ঘাড়টা কেটে ফেললে, তোমার সঙ্গীর ঘাড়টা কেটে ফেললে, কয়েকবার বললেন। অতঃপর বললেন, তোমাদের মধ্যে কারো যদি তার আরেক ভাইয়ের প্রশংসা একান্তই করতে হয় তাহলে যেন বলে, ‘আমি অমুককে এমনটা মনে করি আর আল্লাহই তার (আসল) অবস্থা অধিক জানেন, আর আমি আল্লাহর নির্দেশ ডিঙ্গিয়ে কাউকে ত্রুটিমুক্ত ও নিখাঁদ প্রশংসার পাত্র হিসাবে ঘোষণা করছি না, আমি তাকে মনে করি যে, তিনি এমন এমন; যদি সে জেনে থাকে যে, তার মধ্যে সেগুলো রয়েছে’।[৯]

আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনায় এসেছে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অতি প্রশংসাকারীকে বললেন, لَقَدْ أَهْلَكْتُمْ أَوْ قَطَعْتُمْ ظَهْرَ الرَّجُلِ ‘তোমরা লোকটিকে ধ্বংস করে দিলে বা তার পীঠ কেটে দিলে’।[১০] অর্থাৎ তার প্রশংসা তো করলে না, বরং তার মারাত্মক ক্ষতি করলে।

শরী‘আতে আত্মপ্রশংসা ও কৃতিত্বের দাবি সেটা সত্য হোক বা মিথ্যা, তা খুবই আপত্তিকর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করে বলেছেন, فَلَا تُزَکُّوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَنِ اتَّقٰی ‘তোমরা নিজেদের প্রশংসা নিজেরাই কর না, কে তাক্বওয়া অবলম্বন করেছে তা তিনিই (আল্লাহ) বেশি জানেন’ (সূরা আন-নাজ্ম : ৩২)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, قُلۡ کُلٌّ یَّعۡمَلُ عَلٰی شَاکِلَتِہٖ فَرَبُّکُمۡ اَعۡلَمُ بِمَنۡ ہُوَ اَہۡدٰی سَبِیۡلًا ‘বলে দিন (হে নবী!) প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ পদ্ধতিতে কাজ করে, আর পথ-চলায় কে বেশি হেদায়াতপ্রাপ্ত তা আপনার রব্ই বেশি জানেন’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৮৪)। 

অপরের কৃতিত্বের স্বীকৃতি দেয়া বা সংযত ও মার্জিতভাবে প্রশংসা করা এবং যথাযথভাবে পরিচয় তুলে ধরা বৈধ। আর যদি সেটা প্রতিদানের পর্যায়ে পড়ে, তাহলে তো সেটা করারই নির্দেশ রয়েছে এবং তা করা উচিত। যেমনটা দলীল সহকারে উল্লেখিত হয়েছে; কিন্তু কোন অবস্থাতেই অতিরঞ্জন, সীমালংঘন বা চাটুকারিতার পর্যায়ে যাওয়া যাবে না। আর এ জাতীয় ক্ষেত্রেই নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছ রয়েছে।

মিক্বদাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, أَنْ نَحْثِىَ فِىْ وُجُوْهِ الْمَدَّاحِيْنَ التُّرَابَ ‘আমরা যেন অতি প্রশংসাকারীদের মুখগুলোতে মাটি নিক্ষেপ করি’।[১১]

আর সে কৃতিত্বের দাবি যদি নিজের জন্য অথবা উদ্দেশ্যমূলক কিংবা ডাহা মিথ্যা হয়, তাহলে তো সেটা আরো বড় ধরণের জালিয়াতী ও অপরাধ। যে প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

لَا تَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ یَفۡرَحُوۡنَ بِمَاۤ اَتَوۡا وَّ یُحِبُّوۡنَ اَنۡ یُّحۡمَدُوۡا بِمَا لَمۡ یَفۡعَلُوۡا فَلَا تَحۡسَبَنَّہُمۡ بِمَفَازَۃٍ مِّنَ الۡعَذَابِ ۚ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ.

‘তুমি কখনো মনে কর না যে, স্বীয় কার্যে যারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং যারা কাজ না করেই তার জন্য (ভুয়া) প্রশংসা পেতে ভালোবাসে, তারা আযাব থেকে বেঁচে যাবে। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক কঠিন শাস্তি’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৮৮)।

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামের চূড়ান্ত বিজয় ‘মক্কাহ্ বিজয়ের’ সময় উটনীর পিঠে তাঁর পিছনে বসিয়েছিলেন এক আযাদকৃত দাসপুত্র উসামাহ্ বিন যাইদকে।[১২] তিনি মক্কায় প্রবেশের সময় সূরা আল-ফাত্হ তেলাওয়াত করছিলেন।[১৩] আর আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করতঃ বিনয়ে মাথা এতটা অবনত করেছিলেন যে, তার থুতনী সওয়ারীর সাথে লেগে যাচ্ছিল।[১৪] নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কা’বার ভিতরেও প্রবেশ করেছিলেন দুই আযাদকৃত দাস- একজন বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অপরজন ঐ উসামাহ্ বিন যাইদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ।[১৫] অতঃপর তিনি কাবার দরজায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর নামে তাকবীর দিয়ে মহান-বিজয়ের সকল কৃতিত্ব আল্লাহ তা‘আলাকে দিয়েছিলেন, যেমনটা বিভিন্নসূত্রে বিবরণে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَطَبَ يَوْمَ الْفَتْحِ بِمَكَّةَ فَكَبَّرَ ثَلَاثًا ثُمَّ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا االلهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ صَدَقَ وَعْدَهُ وَنَصَرَعَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ.

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাত্হ মাক্কাহ্-এর দিন খুত্ববাহ দিলেন এবং তিনবার তাকবীর দিলেন (‘আল্লাহু আকবার’ বললেন), অতঃপর বললেন, ‘এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই, তিনি তাঁর ওয়াদা বাস্তবায়ন করেছেন এবং তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং বিরোধী বাহিনীগুলোকে একাই পরাস্ত করেছেন’।[১৬]

অতঃপর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাক্কী জীবনে মুশরিক মুনিবের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত কৃষ্ণকায় হাবাসী বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) -কেই কাবার উপরে উঠে ফরয ছালাত আদায়ের জন্য আযান দেয়ার নির্দেশ দিলেন।[১৭] তার আযানের আওয়াজ শুনে কোনো কোনো কুরাইশী ব্যক্তি বলে ফেলল : দেখ, এই দাসের অবস্থা - সে কোথায় উঠে গেছে![১৮] এ সময় নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলছিলেন,

يا معشر قريش إن الله قد أذهب عنكم نخوة الجاهلية وتعظمها بالآباء، الناس من آدم وآدم من تراب ثم تلا هذه الآية (یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ  اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ  مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا ؕ اِنَّ  اَکۡرَمَکُمۡ  عِنۡدَ اللّٰہِ  اَتۡقٰکُمۡ)

‘হে কুরাইশরা! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের মধ্য থেকে জাহেলিয়াতের অহংকার ও বংশগৌরব বিদূরিত করে  দিয়েছেন; সকল মানুষ আদম থেকে (সৃষ্টি হয়েছে) আর আদম (সৃষ্টি হয়েছেন) মাটি থেকে’। অতঃপর তিনি আল্লাহর এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘হে লোকেরা! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একটি মাত্র পুরুষ ও একটি মাত্র নারী থেকে এবং তোমাদেরকে অনেক বংশে ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে পরস্পর পরিচিত হতে পার। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে বেশি তাক্বওয়াসম্পন্ন (পরহেযগার)’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩)।[১৯]

বলা বাহুল্য, অন্য যে কোন নেতা হলে হয়তো ঐ সময় স্বীয় ক্রেডিট-কৃতিত্বের দাবি করে বহুবার ‘আমি’ ও ‘আমার’ শব্দ ব্যবহার করতেন অর্থাৎ বলতেন : ‘আমি আন্দোলন করেছি, আমি সংগ্রাম করেছি, আমি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি, আমি ত্যাগ করেছি, আমি সাহস করেছি, আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম অথবা আমার বিচক্ষণতা, আমার বুদ্ধিমত্তা, আমার বক্তব্য, আমার লিখনী, আমার কৌশল, আমার শ্রম, আমার বীরত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এগুলো সম্পূর্ণরূপে পরিহার করেছেন এবং বিনয় ও নির্লিপ্ততার এক অপরূপ অবিস্মরণীয় অবয়বে আবির্ভূত হয়েছেন।

সুতরাং সত্যিকার ইসলামী সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে যে কোন ধরনের আত্মম্ভরিতার ভাব, আত্মপ্রশংসার মানসিকতা, ক্রেডিট লাভের ফিকির, কৃতিত্ব প্রকাশের কৌশল ও চাটুপ্রীতি থেকে দূরে থাকার জন্য সদাসচেষ্ট থাকতে হবে। তবে মানুষ ভুল-ত্রুটি ও আবেগের ঊর্ধ্বে নয়; তাই এ জাতীয় কিছু ঘটে গেলে দ্রুত শুধরে নিতে হবে। স্মর্তব্য যে, ঘটনার সত্যিকার বিবরণ দেয়া, কল্যাণকর রিপোর্ট পেশ করা, বাস্তবতাকে তুলে ধরা, দরকারে আত্মপক্ষ সমর্থন করা, মিথ্যার অপনোদন করা, ভুল সংশোধন বা ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটানো ইত্যাদি কারণ ও প্রয়োজনে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় স্বাভাবিকভাবে ও মার্জিত ভাষায় যথাযথ ফোরামে তা উত্থাপন করতে বাধা নেই। কেননা সত্য তত্ত্ব ও বাস্তব তথ্যের অনুপস্থিতিতে সংগঠনের সদস্যগণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ অন্ধকারে থেকে যান। আবার সেই সুযোগে অকর্মা, সুযোগ-সন্ধানী ও চাটুকারদের অবাধ পদচারণা ও বাচালতায় প্রতিষ্ঠান নোংরা, পুঁতিগন্ধময় এবং অস্বচ্ছ হয়ে উঠে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

* সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

তথ্যসূত্র : 
[১]. বিস্তারিত : ‘সংগঠন ও নারী’ অধ্যায়ে দেখুন।
[২]. প্রাগুক্ত।
[৩]. ছহীহ বুখারী, ‘ফাযায়েলে আছহাবিন্নাবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ’ অধ্যায়, ‘সব দরজা বন্ধ করে দাও আবূ বাকরের দরজা ছাড়া’ অনুচ্ছেদ; হা/৩৬৫৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৮২; মিশকাত, হা/৬০১০।
[৪]. বিস্তারিত বিবরণ : ‘স্থানীয় আমীর প্রসঙ্গে’ আলোচনায় দেখুন।
[৫]. আবূ দাউদ, ‘আদব’ অধ্যায়, ‘অবদানের কৃতজ্ঞতা’ অনুচ্ছেদ; হা/৪৮১৩, সনদ হাসান।
[৬]. আবূ দাউদ, ‘আদব’ অধ্যায়, ‘অবদানের কৃতজ্ঞতা’ অনুচ্ছেদ; হা/৪৮১৪, সনদ ছহীহ।
[৭]. আবূ দাউদ, ‘আদব’ অধ্যায়, ‘অবদানের কৃতজ্ঞতা’ অনুচ্ছেদ; হা/৪৮১১, সনদ ছহীহ।
[৮]. তিরমিযী, ‘বির ওয়া ছিলাহ’ অধ্যায়, ‘যে তোমার প্রতি অবদান রাখে তার শুকরিয়া জ্ঞাপন প্রসঙ্গে’ অনুচ্ছেদ; হা/১৯৫৪, সনদ ছহীহ।
[৯]. ছহীহ বুখারী, ‘শাহাদাত’ অধ্যায়, ‘এক ব্যক্তি কারো নির্দোষিতার সাক্ষ্য দিলে তাই যথেষ্ট’ অনুচ্ছেদ, হা/২৬৬২; ছহীহ মুসলিম, ‘যুহ্দ’ অধ্যায়, ‘প্রশংসা নিষিদ্ধ যদি তা অতিরঞ্জন হয় এবং প্রশংসিতের ফিতনার কারণ হয়’ অনুচ্ছেদ, হা/৩০০০। 
[১০]. ছহীহ বুখারী, ‘শাহাদাত’ অধ্যায়, ‘প্রশংসায় আতিশয্য অপসন্দনীয় যা জানা তাই বলতে হবে’ অনুচ্ছেদ, হা/২৬৬৩; ছহীহ মুসলিম, ‘যুহ্দ’ অধ্যায়, ‘প্রশংসা নিষিদ্ধ যদি তা অতিরঞ্জন হয় এবং প্রশংসিতের ফিতনার কারণ হয়’ অনুচ্ছেদ, হা/৩০০১। 
[১১]. ছহীহ মুসলিম, ‘যুহ্দ’ অধ্যায়, ‘অযাচিত প্রশংসার মধ্যে এবং প্রশংসার ফলে যদি প্রশংসিত ব্যক্তির বিভ্রান্তে পতিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে তা নিষিদ্ধ’ অনুচ্ছেদ, হা/৩০০২।
[১২]. ছহীহ বুখারী, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপরের দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ’ অনুচ্ছেদ, হা/৪২৮৯।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, হা/৪২৮১।
[১৪]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৮৮।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, হা/৪২৮৯।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/১৭৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; মুসনাদে আহমদ, হা/৪২৪৭; আবূ দাউদ, হা/১৯০৫; ইবনু হিশাম, পৃ. ৭৪৪; যাদুল মা‘আদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০৭; আল-বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৯৬;  আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃ. ৫৩৬।
[১৭]. আল-বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৯৯; যাদুল মা‘আদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০৯।
[১৮]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৯৯।
[১৯]. ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ, পৃ. ৭৪৪, বিদায়াহ নিহায়াহ্, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৯৬, যাদুল মা‘আদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০৭।




তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
যাদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব (শেষ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আল-উরওয়াতুল উছক্বা - অনুবাদ : ইউনুস বিন আহসান
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মেসবাহুল ইসলাম
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
আত্মহত্যাকারীর শারঈ বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
কুরআনী প্রবাদ সংকলন : তাৎপর্য ও শিক্ষা (শেষ কিস্তি) - প্রফেসর ড. লোকমান হোসেন
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৮ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২২তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বিদ‘আত পরিচিতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ