ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি
-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
(শেষ কিস্তি)
সুন্নাতকে অবজ্ঞা করার পরিণাম
মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশ্ব মডেল। আল্লাহ প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। মানুষের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। যদি কেউ তাঁর আদর্শের অবমূল্যায়ন করে, তবে তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ হবে এটাই স্বাভাবিক।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ فَوَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমাদের কেউ (প্রকৃত) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকটে প্রিয়তর হব তার পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি হতে’।[১] অন্য হাদীছে এসেছে, আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের কেউ (প্রকৃত) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকটে প্রিয়তর হব তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষ হতে’।[২]
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ هِشَامٍ رضى الله عنه قَالَ كُنَّا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ آخِذٌ بِيَدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فَقَالَ لَهُ عُمَرُ يَا رَسُوْلَ اللهِ لَأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ إِلَّا مِنْ نَفْسِىْ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لَا وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْكَ مِنْ نَفْسِكَ فَقَالَ لَهُ عُمَرُ فَإِنَّهُ الآنَ وَاللهِ لأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ نَفْسِىْ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم الآنَ يَا عُمَرُ
‘আব্দুল্লাহ ইবনু হিশাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমরা একদা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম। তিনি ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাত ধরে ছিলেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার আত্মা ব্যতীত আপনি আমার কাছে সবকিছু থেকে উত্তম। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, না। আল্লাহ্র শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, যতক্ষণ আমি তোমার কাছে তোমার জীবনের চেয়েও অধিক প্রিয় না হব (ততক্ষণ তুমি মুমিন নও)। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহ্র শপথ! এখন আপনি আমার নিকটে আমার জীবনের চেয়েও অধিক প্রিয়। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবার বললেন, হে ওমর! এবার ঠিক হয়েছে’।[৩]
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ الزُّبَيْرِ رضى الله عنه أَنَّهُ حَدَّثَهُ أَنَّ رَجُلًا مِنَ الْأَنْصَارِ خَاصَمَ الزُّبَيْرَ عِنْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِىْ شِرَاجِ الْحَرَّةِ الَّتِىْ يَسْقُوْنَ بِهَا النَّخْلَ فَقَالَ الْأَنْصَارِىُّ سَرِّحِ الْمَاءَ يَمُرُّ فَأَبَى عَلَيْهِ فَاخْتَصَمَا عِنْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لِلزُّبَيْرِ اسْقِ يَا زُبَيْرُ ثُمَّ أَرْسِلِ الْمَاء إِلَى جَارِكَ فَغَضِبَ الْأَنْصَارِىُّ فَقَالَ أَنْ كَانَ ابْنَ عَمَّتِكَ فَتَلَوَّنَ وَجْهُ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ قَالَ اسْقِ يَا زُبَيْرُ ثُمَّ احْبِسِ الْمَاءَ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَى الْجَدْرِ فَقَالَ الزُّبَيْرُ وَاللهِ إِنِّىْ لأَحْسِبُ هَذِهِ الآيَةَ نَزَلَتْ فِىْ ذَلِكَ (فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ
আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হাদীছ বর্ণনা করেন যে, জনৈক আনছারী ব্যক্তি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে যুবাইরের সাথে হাররার নালার পানির ব্যাপারে ঝগড়া করল, যে পানি দ্বারা তারা খেজুর গাছকে সিক্ত করত। আনছারী ব্যক্তি বলল, নালার পানি ছেড়ে দিন, যেন তা প্রবাহিত হয়। কিন্তু যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তা অস্বীকার করলেন। ফলে তারা দু’জন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে বিতর্ক করলে তিনি যুবাইরকে বললেন, তুমি প্রথমে পানি নাও। অতঃপর প্রতিবেশীর দিকে পানি ছেড়ে দাও। এতে আনছারী ব্যক্তি রাগান্বিত হয়ে বললেন, সে তো আপনার ফুফাতো ভাই! তখন রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেহারা রাগে লাল হয়ে গেল। তিনি যুবাইরকে বললেন, তুমি পানি নাও এবং আটকিয়ে রাখ, যেন পানি বাঁধ পর্যন্ত উঠে যায়। যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আল্লাহ্র কসম! আমার মনে হয় এই আয়াতটি এ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। ‘আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করবে’।[৪]
আলোচনার শেষ পর্যায়ে এসে বলা যায় যে, মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ ব্যতীত আধুনিক বিশ্বের অচলাবস্থা দূর করা সম্ভব নয়। কারণ তাঁর আদর্শই নিখুঁত, অজেয়, চিরন্তন ও সুদৃঢ় ভিত্তিসম্পন্ন। তাই বর্তমান বিশ্বের অবস্থা অবলোকন করে খ্রীস্টান দার্শনিক জর্জ বার্নাড ‘শ বলেন,
If all the world was united under…, then Muhammad (sm) would have been the best fitted man to lead the people of various creeds, dogmas and ideas to peace and happiness.
‘যদি গোটা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, আদর্শ ও মতবাদসম্পন্ন মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একনায়কের শাসনাধীনে আনা হত, তবে একমাত্র মুহাম্মাদই সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতারূপে তাদেরকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন’।[৫]
মূলনীতি-১০ : জাগতিক শক্তির ভারসাম্য অর্জন
ইসলাম সর্বজনীন ও চিরন্তন জীবন বিধান। তাই ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য কল্যাণকর যেকোন সমসাময়িক বিষয়ের প্রতিযোগিতায় ইসলামের প্রাধান্য থাকা অপরিহার্য। বিজ্ঞানের উৎকর্ষে প্রযুক্তি যখন এগিয়ে যাবে, তখন শক্তি, সামর্থ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য সকল ক্ষেত্রে ইসলামেরও উৎকর্ষ সাধিত হতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় যেকোন মুসলিম দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করা আবশ্যক। তবে এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক দুরূহ কাজ, যা দীর্ঘকালব্যাপী ধারাবাহিক প্রয়াসের দাবী রাখে। তাই তড়িৎ শিল্পায়ণ, কৃষিখাত জোরদারকরণ এবং গ্রামীণ অধিবাসীসহ সকলের জন্য পর্যাপ্ত সেবা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রধান প্রধান শাখায় নেতৃত্ব প্রদান করা। বিশেষ করে প্রকৌশল, ফলিত বিজ্ঞান, মাইক্রো-ইলেকট্রনিক্স, তথ্য-প্রযুক্তি, কৃষি ও প্রজনন-প্রকৌশল, জীব-প্রকৌশল, চিকিৎসা, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে একবার বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার শিকড় প্রোথিত করতে পারলে সর্বক্ষেত্রে এর বিকাশ ঘটবে এবং পর্যাপ্ত মৌলিক অবকাঠামো গড়ে উঠবে। তাই আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে উৎসাহ প্রদান করে বলেন,
وَ اَعِدُّوۡا لَہُمۡ مَّا اسۡتَطَعۡتُمۡ مِّنۡ قُوَّۃٍ وَّ مِنۡ رِّبَاطِ الۡخَیۡلِ تُرۡہِبُوۡنَ بِہٖ عَدُوَّ اللّٰہِ وَ عَدُوَّکُمۡ وَ اٰخَرِیۡنَ مِنۡ دُوۡنِہِمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَہُمۡ اَللّٰہُ یَعۡلَمُہُمۡ وَ مَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ شَیۡءٍ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ یُوَفَّ اِلَیۡکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لَا تُظۡلَمُوۡنَ
‘তোমরা কাফেরদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ব বাহিনী প্রস্তুত রাখবে, যা আল্লাহ্র শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করবে। এছাড়া অন্যদেরকেও করবে, যাদের সম্পর্কে তোমরা জান না; কিন্তু আল্লাহ জানেন। আর তোমরা যা কিছু আল্লাহ্র পথে ব্যয় কর, তার প্রতিদান তোমাদেরকে পুরোপুরি দেয়া হবে। তোমাদের উপর অত্যাচার করা হবে না’ (সূরা আল-আনফাল : ৬০)। আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اصۡبِرُوۡا وَ صَابِرُوۡا وَ رَابِطُوۡا وَ اتَّقُوا اللّٰہَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা কর এবং যুদ্ধের জন্য সদা প্রস্তুত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (সূরা আলে ইমরান : ২০০)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী বলেন,
كل ما تقدرون عليه من القوة العقلية والبدنية وأنواع الأسلحة ونحو ذلك مما يعين على قتالهم فدخل في ذلك أنواع الصناعات التي تعمل فيها أصناف الأسلحة والآلات من المدافع والرشاشات والبنادق والطيارات الجوية، والمراكب البرية والبحرية والحصون والقلاع والخنادق وآلات الدفاع والرأْي والسياسة التي بها يتقدم المسلمون ويندفع عنهم به شر أعدائهم، وتَعَلُّم الرَّمْيِ، والشجاعة والتدبير
‘ঐ সমস্ত বিষয়, যার দ্বারা তোমরা বৃদ্ধিবৃত্তিক, দৈহিক ও যাবতীয় অস্ত্রশক্তিসহ এরূপ অন্যান্য বিষয়ে শক্তি অর্জন করতে পারবে, যার মাধ্যমে বিরোধী শক্তির সাথে সংগ্রাম করতে পারবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যাবতীয় ইন্ডাস্ট্রী, যাতে সব রকমের অস্ত্র ও প্রতিরক্ষার যন্ত্র, মেশিনগান, বন্দুক, জঙ্গী বিমান, জল ও স্থল পথের যুদ্ধ জাহাজ, দুর্গ, অপসারণযন্ত্র, পরিখা ও সংরক্ষণের যাবতীয় সরঞ্জাম তৈরি হবে। এছাড়া কূটনীতি ও রাজনীতিও এর অন্তর্ভুক্ত, যার দ্বারা মুসলিমরা অগ্রগতির শীর্ষে পৌঁছে যাবে এবং শত্রুদের আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে পারবে। তাছাড়া তীর নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ, বীরত্ব প্রদর্শন এবং প্রতিরোধ কৌশলও এর অন্তর্ভুক্ত’।[৬]
আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহকে সার্বিক প্রস্তুতি নেয়ার কথা বললেও মুসলিমরা আজ অনেক পিছিয়ে। অথচ যাবতীয় জ্ঞান-ভাণ্ডার তাদের কাছেই সংরক্ষিত। মূলত কুরআন-সুন্নাহই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মূল উৎস। মুসলিমরা পিছিয়ে থাকার কারণে পশ্চিমা বিশ্ব তাকে কাজে লাগিয়েছে। তারা নতুন নতুন জ্ঞান আবিষ্কার ও সমরাস্ত্র ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য ৩০ লক্ষাধিক বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীকে নিয়োগ দিয়েছে। তারা এ খাতে হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করছে।[৭]
উক্ত আয়াতে ইসলামের সর্বজনীনতা ফুটে উঠেছে। আল্লাহ প্রদত্ত অহির বিধান বিরোধী যেকোন শক্তির মুকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও পৃথিবীব্যাপী তার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। মুসলিমদের হাতেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি থাকবে। তাদের হাতেই সাহিত্য-সংস্কৃতির চাবী থাকবে। তারাই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পের ধারক ও বাহক হবে। বিশ্বকে শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনার জন্য তাদের হাতেই অত্যাধুনিক অস্ত্রভা-ার থাকবে, যাতে করে যেকোন নাশকতা ও বিশৃঙ্খলার মুকাবিলা করা যায়। উক্ত আয়াতের বাস্তব ইঙ্গিত নিম্নের হাদীছে ফুটে উঠেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
عَنِ الْمِقْدَادِ بْنِ الْأسْوَدِ رضى الله عنه قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ لَا يَبْقَى عَلَى ظَهْرِ الْأَرْضِ بَيْتُ مَدَرٍ وَلَا وَبَرٍ إِلَّا أَدْخَلَهُ اللهُ كَلِمَةَ الْإِسْلاَمِ بِعِزِّ عَزِيْزٍ أَوْ ذُلِّ ذَلِيْلٍ إِمَّا يَعِزُّهُمُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ فَيَجْعَلُهُمْ مِنْ أَهْلِهَا أَوْ يُذِلُّهُمْ فَيَدِيِنُوْنَ لَهَا
মিক্বদাদ বিন আসওয়াদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘পৃথিবীর এমন কোন মাটির ঘর ও তাঁবুও অবশিষ্ট থাকবে না, যেখানে ইসলামের কালেমা প্রবেশ করবে না। সম্মানের সাথে হোক বা অসম্মানের সাথে হোক। আল্লাহ তাদের সম্মান দিবেন ফলে তিনি তাদেরকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করে নিবেন। অথবা অপমান করবেন ফলে তারা তার প্রতি বাধ্য হবে’।[৮] এর ব্যাখ্যায় নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯ খৃ.) বলেন, ‘নিঃসন্দেহে ইসলামের বিজয়ের সম্প্রসারণ আবশ্যক করে দেয় এভাবে যে, মুসলিমরা তাদের আত্মবিশ্বাস, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সামরিক শক্তি পুনরায় ফিরে পাবে। এমনকি তারা কুফরী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপরও জয়লাভ করতে সক্ষম হবে’।[৯]
বর্তমান মুসলিম বিশ্বে ওআইসিভুক্ত দেশগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সহজেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মুসলিম দেশগুলোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিকাশ এবং তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যেই মুসলিম দেশগুলো ওআইসি, আরবলীগ, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, কমিটি ফর ইকোনমিক এন্ড কমার্শিয়াল কো-অপারেশন, মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ, ওয়ার্ল্ড এসেম্বলী অব মুসলিম ইয়ুথ ইত্যাদি সংস্থা গড়ে তুলেছে। কিন্তু এ সমস্ত সংস্থাকে অধিক ক্ষমতা যেমন দেয়া হয়নি, তেমনি পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দও দেয়া হয়নি। ফলে এগুলো উজ্জীবিত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হচ্ছে না।
বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তিগত বিকাশের জন্য ১৯৮৩ সালে ইসলামাবাদ ঘোষণায় ভবিষ্যৎ যে পরিকল্পনা প্রকাশ করে, তা অত্যধিক গুরুত্ব বহন করে। মুসলিম দেশগুলোর প্রতি নিম্নোক্ত আহ্বান জানায় :
(ক) মুসলিম উম্মাহকে একটি আলোকিত, বৈজ্ঞানিকভাবে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী সমাজে রূপান্তরের জন্য কাজ করতে হবে।
(খ) সুদৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারী নীতি ও পরিকল্পনা অর্জনে অবিচলিত প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। দেশীয় প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে এবং প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে।
(গ) জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবস্থাসমূহের চাহিদামাফিক ও সৌকর্যময় উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ বিনিয়োগ করতে হবে। তড়িৎ আধুনিকায়ন ও আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধির জন্য মৌলিক বিজ্ঞান ও উচ্চ প্রযুক্তি খাতে সক্ষমতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
(ঘ) বৈজ্ঞানিক কর্মকা- ও তার পরিচিতির জন্য শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে অনুকূল করতে হবে। চিন্তার স্বাধীনতা ও উদ্যোগের প্রতি উপযোগী পরিবেশ প্রদানের মাধ্যমে মেধাবী ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিবর্গকে বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে এবং তাদের কাজে লাগাতে হবে।
(ঙ) আন্তর্জাতিকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী সুসম্পর্ক লালনের মাধ্যমে বিশেষতঃ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
(চ) ওআইসি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিদ্যমান বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহকে পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন দিতে হবে এবং বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের যৌথ কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ে ঐসব প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব পালনে সক্ষম করতে হবে।
(ছ) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণমুখী প্রয়োগের কাজে তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বেও অনুশীলন ঘটাতে ভবিষ্যতে মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অব্যাহত গবেষণাকে উৎসাহিত করতে এবং বিশ্বে সমতা, ন্যায় বিচার ও শান্তির জন্য কর্মরত সুশীল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলোর প্রতি পূর্ণ সহযোগিতা বাড়াতে হবে।[১০]
উক্ত ঘোষণায় সদস্য দেশগুলোকে ২০ বছরের মধ্যে ইসলামী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবস্থায় একটা উল্লেখযোগ্য মাত্রা ও যোগ্যতাসম্পন্ন উৎকর্ষে পৌঁছানোর আহ্বান জানানো হয়।
যদি পরস্পরের মাঝে কৌশলগত যোগাযোগ অব্যাহত থাকে তবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা ও নির্ভরতা জোরদার হবে। এই সংযোগ বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এতে যে দিকগুলো থাকতে পারে সেগুলো হল, (ক) আঞ্চলিক অর্থ গ্রুপ প্রতিষ্ঠা (খ) বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও স্বার্থ সংরক্ষণ (গ) সহযোগিতার ভিত্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা। যেমন দূরপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকা ইত্যাদির মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক অর্থ গ্রুপ গড়ে তুলা। গ্রুপগুলোকে জাপান, চীন, জার্মানী, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্ববিস্তৃত ভূ-অর্থনৈতিক ক্ষমতার ব্লকের মত পরস্পরের সাথে একটি কাঠামো তৈরি করে নেয়া। ফলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার ঐক্যের বন্ধন আরো নিবিড় ও সুসংহত হবে।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা যেমন ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ ও ব্রুনাই-এর মধ্যে; পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে এবং সুদান, মিশর ও লিবিয়ার মধ্যে শক্তিশালী জোট গঠন করা যেতে পারে। এটাই কালক্রমে ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করবে। জোটভুক্ত দেশগুলোর প্রতিরক্ষা নীতি এই ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতার উপর স্থিত হবে, যা উদ্ভূত বিশ্ব পরিস্থিতির উদ্বিগ্ন দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
তেল-গ্যাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ উৎপাদনকারী দেশগুলোর স্বার্থেই এবং মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে গরীব দেশগুলোর কল্যাণে তাদের এই সম্পদগুলোর কার্যকর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সমাজ এই ত্রয় হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার প্রধান নির্মাণ কাঠামো। ইসলাম পরিবেশের প্রতি বন্ধুসুলভ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সক্ষমতা
একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে সুসঙ্গবদ্ধ পরিসীমার মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। মুসলিম দেশগুলোর আজ যা প্রয়োজন তা হল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে নেতৃত্ব অর্জন করা। মুসলিমরা যদি সমগ্র বিশ্বে ইসলামের বার্তা প্রচারের আকাক্সক্ষা রাখে এবং পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেয়া ও পথ-প্রদর্শনের অপরিহার্য দায়িত্ব পালন করতে চায়, তবে তাদেরকে বিশেষ শক্তি ও প্রশিক্ষণ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-প্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সমরাস্ত্রে পূর্ণাঙ্গ সামর্থ্যবান হতে হবে। তাদেরকে জীবনের প্রতিটি শাখায়, প্রতিটি বিভাগে ও প্রতিটি প্রয়োজনে পাশ্চাত্যের হাত থেকে মুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল হতে হবে।
নিজেদের পরিধানের বস্ত্র ও জীবন ধারণের খাদ্যে পর্যন্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। প্রয়োজনীয় অস্ত্র যেন মুসলিমরা নিজেরাই তৈরি করতে পারে, নিজেদের যমীনে লুক্কায়িত খনিজ সম্পদ যেন নিজেরাই উত্তোলন করতে পারে এমন সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। বিশাল বিশাল সমুদ্রগুলোতে নিজেরাই সামুদ্রিক জাহাজ ও নৌবহর নিয়ন্ত্রণ করবে। শত্রুর মুকাবিলায় সর্বদা নিজেদের নির্মিত যুদ্ধ জাহাজ, কামান ও ভারী অস্ত্র প্রস্তুত রাখবে। মুসলিমদের আমদানীর চেয়ে রফতানী বেশী হবে। যেন পাশ্চাত্যের কাছে কোন বিষয়ে হাত পাততে না হয়। কারণ মুসলিম বিশ্ব যতদিন জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের মুখাপেক্ষী থাকবে, ততদিন পাশ্চাত্যজগৎ তাদের রক্ত শোষণ করবে, তাদের ভূখ-ের জীবনী শক্তি খর্ব করে দিবে, নিজেদের সেনাবাহিনীকে ট্রেনিং দিতে পাশ্চাত্যের দ্বারস্থ হতে হবে। এমতবস্থায় পাশ্চাত্যের মুকাবিলা করা তো দূরের কথা, তাদের দিকে তাকিয়ে কথাও বলতে পারা যাবে না।
জামাল্দ্দুীন আফগানী (১৮৩৮-১৮৯৭ খৃ.) তাঁর অনেক বক্তৃতায় ও লেখায় বিজ্ঞান ও কারিগরী ক্ষেত্রে মুসলিমদের অগ্রগতি না হওয়ার বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা তাদের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির জন্যই করেছে। তাই মুসলমানদের বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী জ্ঞান আহরণের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। তিনি আরো জোর দিয়ে বলেন, ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মুসলমানদের বিজ্ঞান সাধনার পথেই অগ্রসর হতে হবে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার কোন বিকল্প নেই।[১১]
এছাড়া মুসলিম বিশ্বের জন্য অতীব জরুরী কর্তব্য হল, শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজানো, যাতে তার রূহ ও পয়গামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। যেমন ইতিপূর্বে মুসলিম বিশ্ব প্রাচীন পৃথিবীর জ্ঞানগত নেতৃত্ব কায়েম করেছিল এবং দুনিয়ার বৃদ্ধিবৃত্তি ও সভ্যতা-সংস্কৃতির অস্থি-মজ্জায় মিশে গিয়েছিল। মুসলিমদের প্রজ্ঞা দুনিয়ার সাহিত্য ও দর্শনের হৃৎপি-ে বাসা বেঁধেছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী সভ্য দুনিয়া তার বুদ্ধি দ্বারা চিন্তা করেছে, কলম দ্বারা লেখেছে এবং গ্রন্থ প্রণয়ন করেছে। এই আধ্যাত্মিক চেতনা, শিল্প-প্রযুক্তিগত সামরিক প্রস্তুতি ও শিক্ষার স্বাধীনতার সাথেই মুসলিম বিশ্বের উত্থান ঘটতে পারে। নিজেদের দাওয়াত সর্বত্র পৌঁছাতে পারে, পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই এর জন্য প্রয়োজন সুশৃঙ্খল চেষ্টা-সাধনা, পরিপূর্ণ প্রস্তুতি, বিরাট কুরবানী এবং প্রাণান্তকর সাধনা।
মূলনীতির প্রভাব পর্যালোচনা
যেকোন বিষয়ে প্রণীত মূলনীতিকে পূর্ণাঙ্গ রূপে বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই মূলনীতিকে কার্যকর করার জন্য তত্ত্বাবধান একান্ত জরুরী। যেমন ঈমানের মূল স্তম্ভ ৬টি। আর ইসলামের স্তম্ভ ৫টি। যদি ঈমান ও ইসলামের রুকনগুলো বাস্তবে রূপায়ন না করা হয়, তবে তার কোন মূল্য থাকে না। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রায় বক্তব্যের মধ্যে ছিল মূলনীতি সমাহার।
(ক) মদীনা সনদ : মদীনায় যাওয়ার পর সমাজ বিনির্মাণে রাসূল (ছাঃ) প্রণয়ন করেছিলেন ‘মদীনা সনদ’। এই সনদের প্রত্যেকটি ধারা যথাযথভাবে কার্যকর করার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ আদর্শের প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। জাতি ধর্মের মাঝে যে বিভেদ ও বিদ্বেষ প্রচলিত ছিল, তা দমন করতে তিনি সক্ষম হন। হাজার বছরের গোত্রীয় দ্বন্দ্ব ও বংশীয় গোঁড়ামি মদীনা সনদের মাধ্যমে তিনি উৎখাত করেন।[১২]
(খ) হুদায়বিয়ার সন্ধি : রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের পূর্বে বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে প্রণীত কাফেরদের প্রদত্ত সন্ধি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। বাহ্যিকভাবে উক্ত সন্ধি মুসলিমদের বিরুদ্ধে গেলেও তা কার্যকরের মধ্যেই বড় কল্যাণ নিহিত ছিল। আর এটাকেই আল্লাহ তা‘আলা ‘স্পষ্ট বিজয়’ বলে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন (সূরা আল-ফাত্হ : ১)। পরবর্তীতে উক্ত সন্ধির পথ ধরেই মক্কা বিজয়ের দ্বার উন্মোচিত হয়।
(গ) মূলনীতিসমৃদ্ধ ভাষণ ও তার প্রভাব : মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভাষণগুলো প্রায় সবই মূলনীতিসমৃদ্ধ। আর সেগুলোই ছাহাবীগণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। যেমন-
عَنْ أَبِىْ مَالِكٍ الْأَشْعَرِيِّ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ فِى الْجَنَّةِ غُرْفَةً يُرَى ظَاهِرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا وَبَاطِنُهَا مِنْ ظَاهِرِهَا أَعَدَّهَا اللهُ لِمَنْ أَلَانَ الْكَلَامَ وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ وَتَابَعَ الصِّيَامَ وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ.
আবু মালেক আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয় জান্নাতে একটি বিশাল প্রাসাদ রয়েছে, যার বাহিরটা ভিতর থেকে এবং ভিতরটা বাহির থেকে দেখা যায় (এতটাই মসৃণ)। আল্লাহ তা‘আলা এই জান্নাত তৈরি করেছেন ঐ ব্যক্তির জন্য, যে নরম কথা বলে, ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাদ্য দান করে, নিয়মিত নফল ছিয়াম পালন করে এবং রাত্রিতে ছালাত আদায় করে, যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে’।[১৩] অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ثَلَاثٌ مُنْجِيَاتٌ وَثَلَاثٌ مُهْلِكَاتٌ فَأَمَّا الْمُنْجِيَاتُ: فَتَقْوَى اللهِ فِى السِّرِّ وَالْعَلاَنِيَّةِ وَالْقَوْلُ بِالْحَقِّ فِى الرِّضَى وَالسُّخْطِ وَالْقَصْدُ فِى الْغِنَى وَالْفَقْرِ وَأَمَّا الْمُهْلِكَاتُ فَهَوًى مُتَّبَعٌ وَشُحٌّ مُطَاعٌ وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِهِ وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তিনটি বিষয় মানুষকে মুক্তি দেয়, আর তিনটি বিষয় মানুষকে ধ্বংস করে। মুক্তি দানকারী বিষয়গুলো হল- (ক) প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহ্কে ভয় করা (খ) সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি উভয় অবস্থায় সত্য কথা বলা (গ) স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল উভয় অবস্থায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। আর ধ্বংসকারী বিষয়গুলো হল- (ক) প্রবৃত্তির পূজা করা (খ) লোভ-লালসার পিছনে ছুটা (গ) আত্মাহংকার করা। আর এটা ঐগুলোর চেয়ে অনেক বেশী জঘন্য’।[১৪]
আধুনিক যুগে চ্যালেঞ্জিং সময়ে ইসলামী পুনর্জাগরণকে সফল করা অত্যন্ত কঠিন। তাই আলোচিত মূলনীতিগুলো যথাযথভাবে কার্যকর করলে আশা করা যায় অবশ্যই ফল পাওয়া যাবে।
[১]. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ১২, হা/১৪, ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[২]. তদেব, পৃ. ১২, হা/১৫।
[৩]. তদেব, পৃ. ৮১২-৮১৩, হা/৬৬৩২, ‘ক্বসম’ অধ্যায়।
[৪]. সূরা আন-নিসা : ৬৫; ছহীহুল বুখারী, পৃ. ২৯১, হা/২৩৬০।
[৫]. বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা), পৃ. ২৯০।
[৬]. আব্দুর রহমান বিন নাছের আস-সা‘দী, তাফসীরুস সা‘দী (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ২০১৩ খৃ.), পৃৃৃ. ৩৩৫।
[৭]. Ibrahim B. Syed, Muslim Unity Through Science and Technology in the 21 Century; website : www.irfi.org (e-mail : irif@iname.com). Ibrahim B. Syed, Islamic Science, Past, Present and Future. www.irfi.org. এ.কে.এম. আজহারুল ইসলাম, নিন্দিত বিশ্ব নন্দিত গন্তব্য (চট্টগ্রাম : আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন, জুলাই-২০০৭), পৃ. ২৪৬।
[৮]. মুসনাদুল ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪, হাদীছ সংখ্যা-২৩৮৬৫, সনদ ছহীহ।
[৯]. সিলসিলাতুল আহাদীছ আছ-ছহীহাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২, হাদীছ সংখ্যা- ৩, ‘আগামী দিনগুলো ইসলামের জন্য’ অধ্যায়।
[১০]. নিন্দিত বিশ্ব নন্দিত গন্তব্য, পৃ. ২৪৭।
[১১]. সেখ মোহাম্মদ ইসমাঈল ও কাজী জহুরুল হক, ইসলাম ও আধুনিক মুসলিম জাহান (ঢাকা : বিশ্ব সাহিত্য ভবন, আগস্ট ২০০১ খৃ.), পৃ. ১১০।
[১২]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ১৭৩।
[১৩]. শু‘আবুল ঈমান, হা/৩৬০৯; মিশকাতুল মাছাবীহ, হা/১২৩২; সনদ হাসান, ইমাম মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, ছহীহুল জামি‘ আছ-ছগীর ওয়া যিয়াদাতুহু, (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৯৮৬ খৃ./১৪০৬ হি.), হা/২১২৩।
[১৪]. শু‘আবুল ঈমান, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৩৯৬, হা/৬৮৬৫।